দেবেশ রায়
‘কেডা রে অক্রূর? ধাঁধা খেলার মইধ্যে ভোটাভুটি তুলে? আপনি ধাঁধা কন উকিলবাবু’-–ভিড়ের কেউ বলে।
যোগেন খাঁকারি দিয়ে গলা সাফ করে, ‘রও, খাড়াও, মনজুর আলমের মতন ব্যাপারী, অমাবস্যার রাতে দুই নম্বর সুচে সুতা পরাবার পারে। তারে এড়া একমণি বাটখারার নাগাল শক্ত আর ভারী ধাঁধা ধইরব্যার লাগব।’
‘আরে আমারে নিয়্যা পইড়লেন ক্যান মণ্ডলমশায়? আমার মুখখামির কি কুনো তল আছে?’
‘তা হাইলে খেলবা না ধাঁধা? তয় ছাড়ান দ্যাও।’
‘আরে, খেলা ছাড়ে কেডা, আপনি কন জোরে, মহাজন ঠিক জব দিবে,’ ভিড়ের ভিতর থেকে কথা ওঠে। আলমের দিকে তাকিয়ে যোগেন একটু হেসে ও একটা ভুরু নাচিয়ে বলে, ‘তয়?’
আলম বলে, ‘ক-অ-ন তয়! দশের ইচ্ছা তো ফ্যালবার পারি না। তয় আমার কথাডা এডডু ভাইববেন, কঠিন কিছু জিগাইয়া দশের কাছে ঘাড় হেঁট করায়েন না।’
যোগেন দেখে, ভিড় আরো বেড়ে গেছে, তার মানে হাটে রটে গেছে যে এখানে ধাঁধা খেলা হচ্ছে। সেই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে যোগেন বলে, ‘তাইলে কই?’
‘কন, কন, হেই যারা লগে আছে, বইস্যা পড়। মণ্ডলমশাক দেখা যায় না।’
যারা সামনে ছিল, তাদের কেউ-কেউ বসে পড়ল আর কেউ-কেউ পিছিয়ে গেল। যারা বসছিল, তাদের কারো ছাতার পেছনকাঠিতে পেছনের কারো খোঁচা লাগে আর সে চিল্লিয়ে ওঠে, ‘আরে, কেডা রে, মাঘমাসে ছাতার পাছা মোতনে ঢুকায়?’ এই কথায় হাসির হুল্লোড়টা থামতেই যোগেন উঁচু গলায় বলে ওঠে, ‘তা হাইলে জিগাই?’ আর ভিড়টা একেবারে চুপ হয়ে গেল।
যোগেন বলে, ‘ধাঁধাঁ তো আর গাবের নাগাল টুপটুপ কইর্যা পড়ে না, জোরে না ঝাঁকি দিলে ধাঁধাঁ পড়ে না। আমি আইস্যা এইখানে খাড়াইছি আর আলমভাই ফাল দিয়া আইস্যা ঝাঁকাইব্যার ধইরছে, দুকানে চলেন, গদিত বসেন, জিরান ন্যান। সেই ঝাঁকির চোটে ধাঁধাখান মাথায় পইড়ল নাইরকেলের নাগাল।
একখান্ মাও, তার দুইখান মাথা
দশখান মানুষ বুকের গাঁতায় (গর্তে)
একবেলা চইললেও নাই এড্ডুও ব্যথা।’
ভিড়টা চুপই থাকল, একেবারে চুপ। আলম বাঁহাত কপালে দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু-আধটু করে শোনা যায়, ‘মাও একখান?’ ‘আর মাথা দুইখান?’ ‘বুকে গাঁতা’ আছে কার-কার?’ ‘ব্যথার কথা আসে ক্যান?’ ‘চলা আর বেলা নয় বুঝা গেল—একবেলা চইললে তো পাও ব্যথা করব্যার পারে কিন্তু সেই ব্যথাড়া হয় না।’ যে যার মত করে ইশারা ধরে অর্থের ভিতরে ঢুকতে চায়। কিন্তু অনেক রকম ভাংচি ইশারা থাকে। কোন্ কোন্ ইশারা ভাংচি সেটা আগে বাছতে হয়।
এখন সেই হিশেবটা চলছে ভিড়টা একেবারে চুপ করে গেছে, কান পাতলে যেন এত মানুষের শ্বাসটানার আওয়াজ আলাদা-আলাদা শোনা যাবে। একটা-আধটু ফিশফিশ হয়ত ওঠে—শলা পরামর্শের। সে ফিশফিশ ঐ শ্বাসের আওয়াজে চাপা পড়ে যায়। ঐ ফিশফিশটাকেই কেউ একজন চড়িয়ে দেয় একটুখানি, যেন লুকিয়ে, ‘ছাতা’।
শুনে একটি নীরবতায় সবাই মিলিয়ে নিতে চায়। হ্যাঁ, ছাতাটাকে উলটো গর্ত বলা চলে। এক ছাতায় দশজন যেতেও পারে বটে। কিন্তু ‘ছাতা’র সঙ্গে একবেলা যাওয়ার একটা সম্বন্ধ যদি ভাবাও যায়, ‘ব্যথা’ আসবে কী করে। ছাতা ছাড়াও হাঁটায় যে ব্যথা, ছাতাধরা হাঁটাতেও সেই একই ব্যথা। তাহলে? এক উলটানো গর্তের মিল দিয়ে কি এতগুলো অমিল ঢাকা যায়? ‘ওঃ, আইলেন আমাগ চাণক্য পণ্ডিতের সম্বন্ধী! ছাতার মাথাখান কি দুইডা?’
ধাঁধাঁ খেলায় জবাবে পৌঁছানোর এই প্রক্রিয়াটাই উদ্বেগ-উত্তেজ ছড়ায় আর এমন সব ভুল উত্তর থেকেই ঠিক উত্তরটা তৈরি হয়ে যায়। ‘ছাতা’ বলে যে ঢোক গিলেছে, সে উত্তরের আকারটার আভাস দিয়েছে—গোল কিছু। সেই আভাস ধরেই একজন বলে ওঠে, ‘ধামা
এবার সে সরাসরি ধমক খায়, ‘ধামা? আরে, ধামার গর্তডা কি মাথা না হোগা?’ ‘থাহে, থাহে, মাথা ছাড়া ধামা না।’ এই কথাটুকুতে একটু নতুন মোচড় আছে—হ্যাঁ, দুজন মানুষ এমাথা-ওমাথা করে ধামা নিয়ে যাচ্ছে। বা, স্বামী-স্ত্রী। হাট থেকে ফিরছে—একখান ধামার দুইখান মালিক বা মাথা। বুকের গর্তটাও না-হয় হল। সেই গাঁতায় ‘দশজন মানুষও না-হয় হল—ধামা তো আর খালি নেই, দশরকম জিনিশে ভরা। ‘মাও’-ও না হয় হল—ধামা না-হয় মায়ের মতই খাওয়া জোটায়। কিন্তু ‘ব্যথা’টা কোথায় যাবে? মানে, বেচাবিক্রি খুব ভাল হয়েছে, তাই একবেলা ধামা মাথায় গেলেও পায়ে ব্যথা লাগছে না! হতে পারে! হতেও পারে! তবে ঐ একবেলা যাওয়ার কথাটা ঠিক মিল খাচ্ছে না যেন! এটাও ধাঁধাখেলার বড় মজা—ভিড় জানিয়ে দেয় কোন্ উত্তরটা খাপমত লাগছে না, লাগানোর জন্য একটু গোঁজ লাগাতে হচ্ছে। তুমি যদি ঠিক হয়ে থাক তো ঠিক, কিন্তু একবারে ঠিক না।
কাঁচালঙ্কার স্তূপের পাশে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় আচমকা হাঁচি শুরু হয়ে যায়। হাঁচি চলছে তো চলছেই। গামছায় নাকঝাড়ার আওয়াজ। যোগেন পর পর দুটো হাঁচি দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে। আলম তার লুঙ্গি তুলে নাক ডলে নেয়।
ভিড়ের পেছনের আলগা দাঁড়ানো কেউ হেঁকে ওঠে, ‘আরে, এত হাঁচাহাঁচির হইলডা কী?’ লোকটার নাকে লঙ্কার ঝাঁজ হয় ঢোকেনি, বা এখানে যে একটা লঙ্কার স্তূপ আছে তাও সে দেখেনি।
আলম হঠাৎ হেসে ফেলে বলে ওঠে, ‘পাইছি, পাইছি জব। পাইছি।’
‘পাইছ তো, কও।’
‘নাকী কয়্যা ফেললে জব কর্পূরের নাগাল উইড়া যাইবেনে? ছাইড়বেন না মহাজন, চাইপ্যা ধইর্যা রাহেন। নিজের বিচি নিজের মুইঠ্যায়। ছাইড়া দিলে আর পাবেন না।’
আলম মাথার ওপর একটা হাত ঘুরিয়ে বলে, ‘নাও, নাও। নৌকা। ‘যোগেন তাকে জড়িয়ে ধরে ‘আলমভাই আমারে হারাইয়্যা দিছে রে–এ’।
‘তয় চলেন, দুকানে বসেন।’
‘বত্সব ক্যা, শুইব। এতগুলা মানুষেরে কিছু কাজের কথা কয়্যা নেই আলমভাই। তুমিও শুনো। কামের কথা।’
বলে যোগেন ভিড়ের দিকে ঘাড় ফেরায় কিছু বলতে আর হাঁচির একটা দমক এসে পড়ে—একটা, দুটো, তিনটে। চতুর্থটা আসবে কী আসবে না, যোগেনের নাক কুঁচকে যায়, চোখ বন্ধ হয়ে যায়, হাঁ খুলে যায়, ঘাড় হেলে যায়—নাঃ কেটে গেল। কাপড়ের খুঁট তুলে যোগেন নাক মোছে ও নাক টেনে নেয়। সেই লঙ্কার পাহাড়ের দোকানি দু-হাত জড়ো করে ক্ষমা চাইবার মুদ্রায়, তার মুখে হাসি, পরিস্থিতির এমন বদলে। যোগেন তার দিকে তাকিয়ে আবার নাক টেনে গলা পরিষ্কার করে বলে, ‘হাত দুইখান তো জড়ো কইরছেন মাপ চাওনের লাইগ্যা; আর মুখে হাসিখান ধইর্যা রাইখছেন তো যোগেন মণ্ডলের হাঁচির বহর দেইখ্যা। আরে মিয়া—আমার নাকে তোমার মরিচের ঝাঁঝে সুড়সুড়ি লাইগলে অপরাধটা কার হইল। তোমারনি? আরে ব্যাটা বাঁদির বাচ্ছা, তোর মরিচের এত ঝাল আইসে কোথ্ থিক্যা রে যে আমার নাক শুলায়—একখান না, দুইখান না, তিনখান, আর চার নম্বরখান মুখ ভেঙায়, নাক বেঁকায়, চোখ ধাক্কায় কিন্তু পড়ে না। আরে বেটা ন্যাড়া যবন, তোর মরিচের ঝাঁঝে যে ব্রাহ্মণের হাঁচি পইড়ল, তাতে ত্রিদোষ প্রাচিত্তির কইরব্যার লাগব। হালার যবন, তর হাতের মরিচ এমন সুমিষ্ট কেমনে হয় রে হালারে। প্রাচিত্তির কর্, প্রাচিত্তির কর্—তিন দিন তিন মুইঠ্যা কাঁচা মরিচ এক্কেরে গাছ থিক্যা মাথা মুইড়্যা আমার সিঁড়ির গোড়ায় থুয়্যা যাবি। আমি মন্ত্র পইড়া গঙ্গাজল ছিটাইয়া শুদ্ধি কইর্যা নিব। তোর মরিচে হট্টলমুলার স্বাদ যা হইব-না!’ মুলো দিয়ে শোলমাছ রান্নাকেই হট্টলমুলা বলে।
ভিড় আরো বেড়ে গেল। ঐ কাঁচালঙ্কার ঝাঁঝ থেকে হাঁচতে-হাঁচতেই যোগেন যে ভাষণ দেওয়া ধরেছে, সেটা ভিড় ধরতে পারে কী পারে না, তবে, তারা গল্পের মজাটায় মেতে উঠেছে। লঙ্কার ঝাঁঝে হাঁচার কারণে প্রথমে এক মুসলমান জমিদার, আর পরে এক ব্রাহ্মণ—বামুনের খ্যামতা জমিদার নির্ভর না-লঙ্কাদারকে গালাগাল দিচ্ছে। কোথায় যে মুসলমান জমিদারের কথা শেষ আর বামুনের কথা শুরু হয়, তা ধরা যায় না।
‘আরে, মরিচের কামই তো ঝাঁঝানো আর হাঁচানো। না হইলে তো মিয়াশাহেব ও বামুনঠাকুর দুইজনেই কইবেন, ‘তুই বরং কুসুরার চাষ দে রে, তোর মরিচেই যদি এত মিষ্ট, কুসুর তাহলি কতখান মিষ্ট হইব, ক-অ।’
ততক্ষণে ভিড় জমে উঠেছে—হাসির ফোয়ারা কোনো রকমে চাপা দেওয়া হচ্ছে, কথাগুলো আরো ভাল করে শোনার জন্য ও মনে রাখার জন্য। যোগেন ছাড়া কেউ এমন বলতে পারে না, যা পরে মনে পড়লে হাসি একেবারে বুড়বুড়িয়ে উঠবে, আ-হা। যদি মরিচের ঝালে জিভ আর নাক জ্বলে তাহলেও মরণ, আর খাওয়ার সময় তার মরিচের ঝাঁঝে যদি হট্টলমুলোর স্বাদ না বাড়ে তাহলেও মরণ। পরদিন তাকে ডেকে বলা, তুই বরং আখের চাষ ধর রে, তোর হাতে কাঁচা মরিচ যদি এত মিষ্টি হয় তাইলে আখ দিয়ে তো রসগোল্লা গড়াবে রে।
‘আমাগ বাঁচনের আর কুনো পথ নাই। আমাগ আর বাঁচনের কুনো পথ নাই গ। আমি ভোটে খাড়াইছি, তো আমারে কইব্যার ধইরছিল, যুগেন—তোমাগো আর মুসলমানরেগ আলাদা আসন আছে, সংরক্ষিত আসন, তুমি সেইখান থিক্যা খাড়াও। কংগ্রেসের সিট নিয়্যা কামড়াকামড়ি করো ক্যান। জবাবে আমি কইছি—সংরক্ষিত হইতে ডর লাগে স্যার, সাধারণ হইতে আর ডর লাগে না। এ তো আমাগ সবাইয়ের আসন। জিতলে আপনারাই কইবেন—যোগেনের কুনো আপনপর নাই, ক্যামন নিজের আসনখান ছাইড়্যা আমাগ সবাইয়ের আসনে জিতবার পারল। আমি কত্তা যোগেন মণ্ডল নমশুদুর থাইকতে চাই, কিন্তু হইব্যার চাই আপনার মানুষ। মানে, আপনার পাইক আর লাইঠ্যাল হবার চাই না, আপনাগ নাগাল দ্যাশের দশজন মানুষের একজন এই দ্যাহেন, বরিশালের দশজন ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-মানুষগ তিরিশখান মাথা এই ছাপার হরফে কইছেন, আমরা চাই যোগেন আমাগ দশজনের একজন হোক। সেই আশীর্বাদখান ছাপাইয়্যা বিলি-বণ্টন কইরব্যার ধইরছেন আপনারা। ক্যান যে এত ছাপাছাপি বিলি-বণ্টন, সেডা আমার বুদ্ধিতে ঢুকে নাই। তবু না ঢুইকল্যে আমি কাউরেও ছাপাছাপি বন্ধ কইরতে কই নাই। না, সবাইয়েরই তো মনের হাউশ থাকে একখান-দুইখান। তো একখান গোটা ভোট হইব্যার ধইরছে, একখানা ছাপাকাগজ বিলি-বণ্টন কইরলে মনে এডডু আনন্দ হয়। আনন্দ হয় তো হউগ। কিন্তু আমি তো জানি, আমার এই বরিশালে যত ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ নমশূদ্র-মুসলমান আছে তাগো সব্বাইই আমাগ চন্দ্রদ্বীপের পণ্ডিত, এক্কেরে সূর্যচন্দ্রের গ্রহনক্ষত্রের চলাফেরা পাকখাওয়ার হিশাবপত্তর কইষ্যা প্রতি বচ্ছরই পাঁচখান পঞ্জিকা লেখেন, এত পণ্ডিত। আরে-এ, চাইর ঝাঁকিতে এক কুড়ি গুইন্যা, মাটিতে দাগ দিয়্যা, আবার চাইর ঝাঁকিতে আর-এক কুড়ি গুইন্যা ফেলাবার পারি আর দুইখান কুড়ির দাগ মিল্যায়্যা যে একমন কলাইয়ের ডাইল হইল, তাও বুইঝব্যার পারি, আর সূর্যচন্দ্র গ্রহনক্ষত্র জোয়ারভাটার হিশাব কইরতে পারব না? কী যে কন। আমাগ ষোল-আনির আধ-পাই মানষিও কুনো ছাপা কাগজের সোজা-উলটা দেইখ্যা বুইঝবার পারে না। টাকার নোটেরও না। তাগ হাতে একখান ছাপা-কাগজ—!’
সকলে মিলে এত জোরে-জোরে হাসতে শুরু করে দিল যে যোগেনকেও থেমে, সারা শরীর দুলিয়ে সবার সঙ্গে হাসতে হয়। যোগেন নিজেই এতক্ষণ কোনোরকমে হাসি সামলে কথাগুলি বলছিল, সেই তিরিশজন বর্ণহিন্দু নেতার তাকে সমর্থন জানিয়ে ইস্তাহারের কথা। এখন বলতে যাবে—তার নামে অপপ্রচার নিয়ে যে সে হিন্দু হয়ে গেছে, কংগ্রেস হয়ে গেছে ও পাওয়া-ভোট বেচে দেবে। কথাটা তোলার আগেই সবাই টের পেয়ে গেছে যোগেন কী বলবে।
‘আস্ত একডা সম্রাটের ছবি ছাড়া তার মাথা কোনডা আর হোগা কোনটা বুঝে না। আরে, যোগেন মণ্ডল হিন্দু হইয়া গিছে না মুসলমান হইয়া গিছে সেই কথাডার বিচার তো হইবেনেই। যোগেন মণ্ডল তো অ্যাহনও বাঁইচ্যাই আছে, এই-যে, অ্যাহন বিসারদির হাটে কাঁচা মরিচের ঝাঁঝে হাঁইচতেছে। যোগেন মণ্ডল তো অ্যাহনও মরে নাই। তার ভূত ব্রহ্মদৈত্য হইছে না নমশূদ্ৰই আছে, সেইডা বিচারের টাইম তো অ্যাহনও আইসে নাই। কিন্তু আমার কথাডা তো এই অ্যাহুনিই বিচার কইরব্যার লাগব। কথাডা হইল—ইস্তাহারডা পইড়ল কেডায়, কোন্ পণ্ডিত।’
‘একডা কথা আমি সিধাসিধি কই। আপনাগ কথা আপনাগই জাইনতে হবে। না অইলে এই এই বিদ্যালঙ্কার পণ্ডিতগ হাত থিক্যা বাঁচন নাই। আমি যে খাড়া হইছি এই ভোটে, নমশূদ্র হইয়্যাও যে নমশূদ্রদের সিটে খাড়া না হইয়্যা বাবুগ সিটে খাড়া হইছি—এইডা মহাত্মা গান্ধীর দান। পাঁচ বছর আগে জেবারদা জেলে সে মইরতে চাইছিল। যাতে তার মরণ হয় সেই লগে খাওয়া বন্ধ করছিল। মরণের সাধ ক্যান তার আইছিল? শাহেবরা ঠিক কইরা দিছিল—ভোট হইত তিনপ্রকারে। বাবুরা আর শুদ্দুররা দুইডা আসন। একটা বাবুগ। আর-একটা শুদ্দুরগ। আসন এক-এক কইর্যা। ভোট দিব বাবুগ আসনে বাবুরা। আর শুদ্দুরগ আসনে শুদ্দুরবা। মুসলমানরা মুসলমান্গ সিটে খাড়াইব আর মুসলমানরাই ভোট দিবে। মহাত্মা গান্ধী, তাইতে ভাইবলেন, দ্যাশডা যদি এমন টুকরা-টুকরা হয়, আমি তাইলে আর বাঁইচ্যা থাইক্যা করবডা কী? আমি তাইলে মরি—কিছু খাইব না, না খাইয়্যা মরব। তহন মহাত্মা গান্ধী জেলে আটক। দিন কাইট্যা গেল। এই মরে কী সেই মরে। আটদশ দিন পর একডা পুনাচুক্তি সই হইল। সবাই মাইন্যা নিল—হ্যাঁ, বাবুগ, শুদ্দুরগ আর মুসলমানগ সিট আলাদা হইব কিন্তু ভোট দিবে সবাই। আর বাবুগ সিটটা খোলা সিট—সেইডাতে বাবুরা, শুদ্দুররা আর মুসলমানরা যার বাবু হওয়ার ইচ্ছা স্যায় খাড়াইবার পারব। কিন্তু শুদ্দুর আর মুসলমানগ সিটে শুদ্দুর আর মুসলমান না হইলে খাড়াইবার পারব না—বাবুরা তো আর শুদ্দুর বা মুসলমান হবার চায় না। কিন্তু সব সিটেই সবাই ভোট দিবে। দেহেন-না, এই দক্ষিণের পটুয়াখালিতে মুসলমানদের সিট নিয়্যা বাঘ-সিংহের লড়াই? ফজলুল হক শাহেব আর নাজিমুদ্দিন শাহেব। তেমনি আমারও এডডু সাধ হইছিল – বাবু হইবার। নমশুদ্দুর বাবু। তাই আমি শুদ্দুরদের সিটে খাড়াই নাই। বাবুদের সিটে খাড়াইছি। বাবুদের সিটটারে ক্যাও কয় হিন্দু সিট, ক্যাও কয় কংগ্রেসের সিট, আমি কইছি, বাবুগ সিট। এই তিনডা কথাই ভুল। এটার নাম খুলা সিট। সেই খুলা-সিটে আমি খাড়াইব্যার পারছি মহাত্মা গান্ধীর হেই পাঁচ সাল আগে উপাস দিয়া গঙ্গাযাত্রা কইরব্যার চেষ্টার ফলে। কেউ যদি বিদ্যালঙ্কার সাইজ্যা আপনাগ আইস্যা বুঝায়, যোগেন হিন্দু হইছে, যোগেন কংগ্রেস হইছে, তাগ কইবেন—যোগেন শুদ্দুরবাবু হইছে, বাবুশুদ্দুর হয় নাই।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন