দেবেশ রায়
এই রাস্তাটা অনেক পুরনো, হয়ত আদিকালের পায়েহাঁটা পথকে নানা সময় নানারকম করে একটা পাকাপথ বানাবার চেষ্টা হয়েছে। কখনো মাটি পিটিয়ে, কখনো তার সঙ্গে বালি মিশিয়ে পেটাই করে, কখনো ছোট-ছোট ঝামা দিয়ে, কখনো কয়লার গুঁড়ো দিয়ে। ফলে, রাস্তাটা হয়ত মাস-দুই-তিন চলার মত থেকেছে, তারপরই ভাঙতে-ভাঙতে আগের চাইতে খারাপ হয়ে গেছে। তখন লোকের মুখে শোনা যায়, দোহাই দে বাবা, রাস্তাটারে রাস্তার মতন থাইকব্যার দে। লোকজনের মুখের এমন কথার সাধারণত মাথামুন্ডু থাকে না। তবে এই রাস্তাটার ব্যাপারে এই কথাটার মাথাও আছে, মুন্ডুও আছে। মেরামতির চেষ্টার দু-মাস যেতে-না-যেতেই যখন রাস্তাটা ভাঙতে শুরু করে তখন মেরামতির মাটি কিংবা বালি কিংবা শুরকি কিংবা ঝামা কিংবা কয়লাগুঁড়ো উগরে দেয় রাস্তাটা, উগরে দেয়ার মত করেই উগরে দেয়। ফলে যা ভাঙন ছিলই, তার সঙ্গে এই সব দ্রব্য মিশে ভাঙনটাকে অচেনা করে দেয়। শেষে একবার বুঝি ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড গোটা-গোটা ইট কোণাকুনি বসিয়ে পাকা রাস্তা বানিয়ে দিল। সেটা ভাল কাজই হয়েছিল। সময়ে তো সব রাস্তাই ভাঙবে—কেয়ারি-মেরামতির পর উগরনোটা বন্ধ হয়েছিল। সেই মেরামতিই এই রাস্তার শেষ মেরামতি। তারপর তো ফরিদপুর-মাদারিপুর থেকে খাড়া টানা শ-খানেক মাইলের রাস্তাই তৈরি হয়ে গেল। বরিশাল থেকে কাশীপুর পর্যন্ত রাস্তাটুকু একবার পিচঢালা হয়েছিল—কবে, সেটা যোগেনের খেয়াল নেই ও কেন, সেটা যোগেন কখনো ভাবেনি, এখন একা-একা সাইকেল চালাতে-চালাতে ভাবতে চায়।
মাঘ মাস, রাস্তাটা তাই শুকনো। হেঁটে যেতে একজনের যতটা জায়গা দরকার, সাইকেলে তার একফালি হলেই চলে। রাস্তার একটা ধার দিয়ে সরু ফালির মত পথ পেলে অসুবিধে নেই। সেই ফালি কোনো গর্তে গিয়ে পড়লেই ঝামেলা। গর্ত এড়াতে সাইকেল ডাইনে-বাঁয়ে ঘোরাতে হয়, রাস্তার ওপর নজর রাখতে হয়, গতি যায় কমে, কোনো-কোনো সময় একটা পড়ো-পড়োও হতে হয়। এই রাস্তা নিয়েই যোগেনের ভাবনাটা একটু পাক খেল। আচ্ছা, জায়গা থেকে আর-একটা জায়গা পর্যন্ত পুরনো, চালু, চেনা, হাঁটাপথ যদি থাকে, তবে ঐ দূরত্বটা যুক্ত করতে যদি রাস্তা নতুন করে ও ভাল করে বানাতে হয়—তাহলে পুরনো রাস্তাটাকেই তো নতুন ও ভাল করা স্বাভাবিক। এখনো তা হল না কেন? একটুমাত্র পশ্চিমে সরে গিয়ে, নতুন রাস্তা বানাতে হল কেন? কথাটা এতদিন ওঠেনি কেন? যোগেনের মনে হওয়া না-হওয়ার কথা বাদ দেওয়া যায়—সে না-হয় বি এম কলেজ থেকে ২৯-এ বি এ পাশ করে সেই-যে বরিশাল ছেড়েছিল, সাত-আট বছর পর ফিরে এল উকিল হয়ে। কিন্তু বরিশালের ভদ্রলোকরা তো কাউকে ছেড়ে কথা বলে না, কংগ্রেস আর হকশাহেব দুয়েরই ভিত শক্ত—কথাটা তাহলে উঠলই না কেন? নিজের মনে প্রশ্নটা এভাবে এল কেন? সে তো একটা আন্দাজ করতে চায়—পুরনো এই রাস্তাটাই নতুন না করে নতুন একটা রাস্তা বানানো হল কেন? ঠিকঠাক কারণ খুঁজে বের করা তার কলেজজীবনের অভ্যাস—অশ্বিনীকুমারের ‘লিট্ল ব্রাদার অব দি পুওর’-এর কর্মী হিশেবে। এখন সেই অভ্যেসই কোর্টের নথি তৈরির কাজে লাগে। একদিন সিভিল কোর্টের জজশাহেব তার নথি খুলে বলে উঠেছিলেন—’মিস্টার মণ্ডল তো তাঁর হাতের লেখার গুণে ও নথির পরিচ্ছন্নতায় মামলার অর্ধেকটা আগেই জিতে নেন।’ সেই কথার পর তো বার লাইব্রেরিতে সিনিয়ররা তার পেছনে লাগলেন, ‘এই যোগেন, তোমার শ্রুতিলিখিন ক্লাশ কখন?’
বার্থী তারা ইনস্টিটিউশন থেকে অঙ্ক আর সংস্কৃতে লেটার নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে যোগেন বরিশাল শহরে ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হল। বছরের হিশেবে সেটা ১৯২৪-এর ২০ আগস্ট। আর অশ্বিনীকুমার মারা যান ৭ নভেম্বর, ১৯২৩–যোগেন কলেজে ঢোকার মাস নয়েক আগেই। তবু, যোগেন তো একটু বেশি বয়সেই পড়াশুনো শুরু করে, অশ্বিনীকুমারের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ক্লাস ফাইভেই, তখন তার বয়স পনের-ষোল। উলটো করে বলা যায়—অশ্বিনীকুমারই পৌঁছে গিয়েছিলেন যোগেনের কাছে। ১৯১৯ বরিশালে মারণঝড় আর সাইক্লোনের বছর। অশ্বিনীকুমার তখন বুড়ো—কিন্তু সেই উদ্ধার-ত্রাণ-পুনর্বাসনের অভিযানের সেনাপতি। স্কুলে-স্কুলে ঘুরে ভলান্টিয়ার বাহিনী তৈরি করে দু-জন করে নেতার অধীনে উপদ্রুত উপকূলের নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সেই কাজেই অশ্বিনীকুমার এসেছিলেন যোগেনদের স্কুলে।
অশ্বিনীকুমার-মুগ্ধ হতে বরিশালবাসী কারো তাকে চোখে দেখার দরকার ছিল না। সত্যি বলতে—বহু দূরের গ্রামের গরিব চাষীরা অনেকে জানতই না, অশ্বিনীকুমার নামে একজন হাত-পা ওয়ালা মানুষ আছেন, তাঁর বাড়িঘর অফিসকাছারি আছে, তিনি হেঁটে চলে বেড়ান ও কথাবার্তা বলেন। তারা, এই চাষীরা, রোয়াগাড়ার সময় ‘জয় গৌর’-এর সঙ্গে ‘জয় অশ্বিনী ও বলত। তেমন অশ্বিনীকুমারকে তাদেরই স্কুলের হেডমাস্টারমশাইয়ের পাশে ধুতির খুঁটো জড়িয়ে বসে থাকতে দেখে যোগেনের বাকরোধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কথা বলতে যখন তিনি দাঁড়ালেন, তখন যোগেন বুঝতে পারে—না, ধুতির খুঁট নয়, ওটা একটা কাপড়ের উতোরি। শাদা একটা পণ্ডিতি পাঞ্জাবি আর কাপড়ের জুতো তার পরনে।
অশ্বিনীকুমার খুব আস্তে-আস্তে কথা বলেন ও শুধুই কাজের কথা। কোথাও কোনো হুঙ্কার নেই, কোথাও কোনো হাহুতাশ নেই, কোথাও কাউকে দোষারোপ নেই।
তিনি বলেছিলেন—বরিশাল সমুদ্র-উপকূলবর্তী একটি বদ্বীপ। সেই কারণে বরিশাল জিলা আমরা প্রকৃতির অনেক সাহায্য পাই—আমাদের ফলনের পরিমাণ বঙ্গদেশে অদ্বিতীয়। প্রকৃতির এই সাহায্যের মতই কখনো-কখনো আমাদের খুব বিপদও ঘটে। সামুদ্রিক ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসে বরিশাল খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বরিশালের স্থলভাগের ভিতরে অজস্র ছোটবড় খাল পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। ফলে দোনা দিয়ে দুই মুখে বন্যার স্রোত ঢুকে মধ্যপথে একটা জলবিস্ফোরণ ঘটায়। এটাও বরিশালের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য যে সমুদ্রোপকূলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঐ দোনাপথে সারা জিলায় ছড়িয়ে পড়ে। এ-বছর খুব বড় দুর্যোগ হয়েছে। আমার বয়স যখন ৩১, তখন একবার এমন ভয়ংকর দুর্যোগ হয়েছিল—মনে আছে। এখন, আমার বয়স ৬৩–এখন আবার সেইরকম আর-একটি দুর্যোগ ঘটল। এই বিপদ থেকে এখন নিজেদের বাঁচতে হলে কয়েকটি কাজ পরপর করতে হবে। প্রথম কাজ—দুর্যোগ-আক্রান্ত প্রধান জায়গাগুলির সর্বত্র প্রতিটি শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে, টাইফয়েড ও কলেরার ইঞ্জেকশন দিতে হবে। কারো কোনো আপত্তি বা বাধা শোনা হবে না। আমরা এই অঞ্চলে ঘুরে-ঘুরে দেখেছি ও ঠিক করেছি—প্রথম দফায় যুদ্ধসৈন্যদের ন্যায় দ্রুততায় পটুয়াখালির দক্ষিণে, পুবে দশমিনা আর পশ্চিমে গলাচিপা গ্রাম পর্যন্ত এই ইঞ্জেকশন-অভিযান শেষ করতে হবে। প্রথম দফায় গলাচিপা নদী পার হওয়ার দরকার নেই। এই ইঞ্জেকশন বাহিনীকে—একটি ম্যাপের ওপর তাঁদের যাত্রাপথ আঁকতে হবে, ইঞ্জেকশন-দেওয়া প্রতিটি ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা লিখতে হবে। পরিচ্ছন্ন হাতের লেখায় তারা কোথা থেকে এসেছে বা কোথাও থেকে এসেছিল কী না—সেটা পরিষ্কার করে লিখতে হবে। ইঞ্জেকশন বাহিনীর পেছনে পানীয়জল ও খাদ্যবাহিনী।
অশ্বিনীকুমারের দেখাদেখি পনের বছরের কিশোর যোগেন শিখেছিল—যে-কাজের হিশেব নেই, সে-কাজের দরও নেই। যোগেন শিখেছিল—নিজের সারাদিনের কাজের হিশেব কষতে। যোগেন শিখেছিল—আয়োজনে সময় খরচ না করে কাজটাতে ঢুকে পড়তে। ১৯১৯-এর দুর্যোগত্রাণের কাজ আর ১৯২১-এর প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মিলনের জন্য অভ্যর্থনা সমিতির ভলান্টিয়ারের কাজ—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো ফাঁক ছিল না। গরমের আর পুজোর ছুটির শুরু ও শেষে এক সপ্তাহ করে বাড়িতে থাকা আর বাকি সময়টা ভলান্টিয়ারি। ভলান্টিয়ারির মানে—গ্রামের মানুষকে গিয়ে হিশেব দেখিয়ে জানাতে হবে—গত দু-এক বছরে কোন্ বা কোন্-কোন্ প্রতিদিনের দরকারি জিনিশ বরিশালে তৈরি করে, বরিশালের বাইরে পাঠানো হয়েছে। জোলা ও তাঁতিরা কী বুনেছে বেশি—গামছা নাকী জালি শাড়ি? কতটা সময় ধরে কতটা জায়গার কটা পুকুর কী কী কারণে ভেঙে গেছে ও মজে যাচ্ছে? কোন্ গ্রাম থেকে কোন গ্রাম পর্যন্ত মাইল দুয়েক মত বাঁধরাস্তা বানালে বা খাল কাটলে যাতায়াত সহজ হয়? পুরনো চৌকিদারি এলাকার জনবসতির হার কী রেটে কমেছে বা বেড়েছে? সাব-সাব-পোস্টঅফিসের লোকসংখ্যা কী হারে কমেছে বা বেড়েছে? যদি বেড়েই থাকে তাহলেও চিঠিবিলির কাজে সরকারি রেটেই আরো কত লোক দরকার?
শেষ চারটি প্রশ্নে এটাও সঙ্গে-সঙ্গে জানতে চাওয়া হয়েছে—শিক্ষিত ভদ্র যুবকেরা কে কে এই কাজ বিনা বেতনে ও সরকারি অনুদানের অপেক্ষায় না থেকে এখনই করে ফেলতে রাজি আছে?
তার পনের বছর বয়স থেকে, বলা যায় তার পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত, যোগেনের কেটেছে অশ্বিনীকুমারের ছায়ায়-ছায়ায়। তার বয়েসি অন্য সব কিশোর-যুবকদের মতই। না। যোগেনের বয়েসি বর্ণহিন্দু বাড়ির কোনো কোনো কিশোর-যুবকের মত। যোগেন যখন অশ্বিনীকুমারের সংগঠন, ‘লিট্ল ব্রাদার্স অব দি পুওর’-এর ভলান্টিয়ার হয়েছে, তখন তাতে নমশূদ্রও নেই, মুসলিমও নেই। অশ্বিনীকুমারের মৃত্যু যোগেনের উনিশ বছর বয়সে। তিনি দেশের কাজ বলতে যা বুঝতেন ও হাতেকলমে করেছেন তার প্রভাব ছিল, তাঁর হাতে তৈরি নেতারা ছিলেন, তাঁর স্কুল ও কলেজে তাঁর ভাবনায় ভাবিত কর্মী-শিক্ষকরা ছিলেন। যোগেনের মত ভাল, বুদ্ধিমান ও সক্রিয় ছাত্র সব কাজেই ডাক পেত ও ভার পেত। বিএ পাশ করার পর আরো পড়ার সংস্থান জোটাতে যোগেনকে বরিশাল ছাড়তে হল। অশ্বিনীকুমারের কাছ থেকেও তাকে সরতে হল।
এর উলটোটাও সত্যি।
অশ্বিনীকুমার নিজেই ততদিনে সরে যাচ্ছেন অশ্বিনীকুমারের কাছ থেকে
অশ্বিনীকুমার তো প্রাচীন নেতা—কংগ্রেসের চাইতে প্রাচীন, গান্ধীজির চাইতে প্রাচীন, আর যদিও কলকাতায় তাঁর সম্মান ও প্রতিপত্তি কলেজজীবন থেকেই অব্যাহত, তবুও তাঁর সমস্ত চিন্তা ও কাজ তো রচিত হয়েছে বাখরগঞ্জ-বরিশালকে ভিত্তি করেই। তাঁর প্রধান কর্মকাল তো যোগেনের জন্মের অনেক আগে থেকে যোগেনের নয়-দশ বছর বয়স পর্যন্ত। সারা বাংলায় গুপ্ত সমিতির বিরুদ্ধে যখন ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেই ১৯০৮-এই, অশ্বিনীকুমারকে গ্রেপ্তার করে লক্ষ্ণৌ জেলে নিয়ে যাওয়া হল। অশ্বিনীকুমারের নেতৃত্বে আত্মনির্ভরতার ও শিক্ষাপ্রসারের যে-অভিযান চলছিল বরিশালে, তাকে নিরীহ সমাজ-সংস্কারের আন্দোলন বলে মেনে নেয়নি ইংরেজ-সরকার। সংস্কার-কাজে ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সমাবেশে অশ্বিনীকুমার বর্ণহিন্দু সংস্কৃতি দিয়ে নির্ধারিত সীমা ভেঙে, বরিশালের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ও নমশূদ্রদের কাছে পর্যন্ত যেতে চাইছিলেন ও সেই স্তর পর্যন্ত স্বদেশবোধ ছড়াতে মুকুন্দ দাসের মত এক সাংস্কৃতিক যোক্তা সম্ভব করে তুলেছিলেন। ১৯১০-এ মুক্তি পাওয়ার পর অশ্বিনীকুমার নতুন করে ভাবার ভিত পাচ্ছিলেন না, বরিশালে বা তার নিজের মধ্যে। তাঁর বি এম কলেজকে বাঁচাতে তিনি সরকারের শর্ত মেনে সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেন ও সরকার-অনুমোদিত ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব দিতে বাধ্য হন। আবার ১৯২১-এ অসহযোগ আন্দোলনে বি এম কলেজ জাতীয় বিদ্যালয় হয়ে গেল। শিল্পোন্নয়নে তিনি ইংরেজের সমর্থনেও বিশ্বাস জানাচ্ছেন। ক্রমেই অশ্বিনীকুমার হয়ে যাচ্ছিলেন অশ্বিনীকুমারের গল্প।
সে-গল্পের সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী জাগরণ মিশে আছে। ‘বন্দেমাতরম্’ বলা নিষেধ করে কার্লাইল সার্কুলার জারি হল। তার প্রতিবাদে বরিশালে প্রাদেশিক সম্মিলন। সম্পাদক অশ্বিনীকুমার। পুলিশের সুপার কেম্পশাহেব, সভা ভেঙে দেওয়ার সরকারি হুকুম জারি করতে সভার মঞ্চে এলে সভায় উপস্থিত মানুষজনের দাবিতে ভয় পেয়ে নিজেই ‘বন্দেমাতরম্’ বলতে বাধ্য হয়েছিল আর সরকারি এই হুকুমে নেতারা সভা ভেঙে দিতে বাধ্য হয়েছিল। সমিতির পরামর্শসভায় বিপিন পাল বলেন, ‘আমি গবর্মেন্ট মানি না কিন্তু লাঠি মানি।’ তার জবাবে কাব্যবিশারদ বলেন, ‘আমি গবর্মেন্ট মানি, কিন্তু লাঠি মানি না।’ পুলিশের লাঠিতে মৃতপ্রায় ছেলে চিত্তরঞ্জনকে সম্মেলনে এনে মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ থেকে বলছেন, ‘জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?’ সিলেট থেকে সুন্দরবনের লাটমহল পর্যন্ত পুরো বঙ্গদেশের নেতা ও জমিদাররা এসেছিল, কলকাতার বুদ্ধিজীবীরাও সেই সখিলনে, বরিশালে। একসঙ্গে এতগুলো একনম্বরি জমিদার, নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের এমন লাঠিপেটা আর গ্রেপ্তার সম্ভবত আর কখনো পুলিশ করতে পারেনি। সুরেন ব্যানার্জি, ফণিভূষণ ব্যানার্জি, গীষ্পতি রায়চৌধুরি, কৃষ্ণকুমার মিত্র, শচীন্দ্র প্রসাদ, বেচারাম লাহিড়ী, শশিভূষণ দে, ললিত ঘোষাল, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, ব্রজেন গাঙ্গুলি, কেদার দাশগুপ্ত, জি চৌধুরি, বিপিন পাল—এঁরা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি যে গণতন্ত্র, প্রগতি ও আইনশৃঙ্খলার প্রতীক ব্রিটিশরাজের সেপাই তাঁদের এমন পেটাই পেটাতে পারে। এঁরা সকলেই ‘বাবু’, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান নির্ভর। এঁরা প্রধানত বর্ণহিন্দু। কাব্যবিশারদকে যখন পুলিশ মারছিল, তখন এক সুবেদার এসে সেই সেপাইকে নিরস্ত করে, ‘মাৎ মারো, ব্রাহ্মণ হ্যায়।’ ব্রাহ্মণদের নীতি অনুযায়ী কাব্যবিশারদ কোনো সেলাই-করা জামা পরেননি—ফলে তাঁর পৈতে তাঁকে বাঁচিয়েছে। সম্মিলনে অবিশ্যি রাজেন সাহা বলে এক অজলচল হিন্দুকেও দেখানো হয় বালকবীর হিশেবে। সে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিলেতি কলমে সই করতে, আর জেলখানায় বিলেতি কম্বল গায়ে দিতে, অস্বীকার করে।
হ্যাঁ, অশ্বিনীকুমারই বুঝেছিলেন—মুসলিম ও অবর্ণহিন্দুদের বিপুল জনস্তরকে মিলিয়ে দিতে না পারলে দেশবোধ তৈরি হবে না। এটা তিনি বুঝেছিলেন স্বদেশী যুগের কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনা থেকে। সেই বোঝাবুঝি পরে তিনি আর নিজের মধ্যেও ফিরিয়ে আনতে পারেননি। ১৯০৬-০৭-এই-বা কতটা পেরেছিলেন? তাঁর ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’র প্রায় অর্ধেক নেতারাই তো ছিল ছোট বা মেজ জমিদার। যেখানে ছোট বা মেজ জমিদার হিন্দু আর তার চাষীরা বেশির ভাগই মুসলিম, সেখানে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন হয়ে উঠছিল হিন্দু জমিদারের সঙ্গে মুসলিম-চাষীর স্বার্থের সংঘাত। এটাই বদলে যেত ছোট ও মেজ জমিদার যখন মুসলিম আর চাষীরা অবর্ণহিন্দু। বরিশালে তো এটা আকছার—এক আদি জমিদারি যে কত উপ-উপ স্বত্বে ভাগ আর সেই ভাগাভাগির কোন্ স্তরে যে হিন্দু জমিদারিতে মুসলিম ছোট বা মেজ ছিল, বা উলটোটা, সেটা তখনো বা এখনো জানা যায়নি। ফলে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে ধরে হিন্দু-মুসলমান জমিদারদের ও হিন্দু-মুসলমান চাষীদের দুটো আলাদা সমাবেশই ঘটে যাচ্ছিল— জমিদারদের আর চাষীদের। বা, বড়জোর বাবুদের বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতার সমাবেশ এক-এক জায়গায় এক-এক রকম করে ভাগ হয়ে যাচ্ছিল। ১৯০৭-এর অক্টোবরে উত্তর কলকাতায় স্বদেশী মিছিলের ওপর পুলিশ চালাল লাঠি আর পুলিশের পেছন থেকে নতুন শহুরে ‘ছোটলোকরা’, ‘ধাঙড়, মেথর, ডোম’—ইত্যাদি শূদ্র হিন্দুরা মারল ঢিল-পাটকেল। দাঙ্গা বেধেছে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে, কুমিল্লায়, জামালপুরে, দেওয়ানগঞ্জে। একদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জমিদারবাবু নিজের জমিদারির স্বার্থে নমশূদ্র ও অন্যান্য শূদ্রদের সঙ্গে একজোট হওয়ার কথা বলছেন, অন্যদিকে ঠিক ঐ সময়ই, ঐ সুযোগেই ময়মনসিংহে এক-এক জমিদারের ডজন-ডজন কুলদেবতার খোরপোশের জন্য চাষীদের ওপর ‘ঈশ্বরবৃত্তি’-র নামে খাজনা বসাচ্ছেন। আর-একদিকে, পুব বাংলা ও আসামে পরপর তিন-চার বছর পাটের ফলনের বান ডেকেছিল—১৯০৬ থেকে ১৯০৯ পাটের ব্যবসায়ী মুসলিম মহাজনরা লাভে-মুনাফায় ফেটে পড়ছিল। তারা কোথা। না-কোথা থেকে নতুন-নতুন পির আর মৌলবি আমদানি করে রটাতে লাগল—ইংরেজরা ঢাকার নবাব সলিমুল্লা-র হাতে নতুন প্রদেশ ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’-এর ভার দিয়ে চলে যাচ্ছে। সেই সব পির-মোল্লারাই হয়ে দাঁড়াল নেতা। হিন্দু জমিদার বা বাবুদের তো পুরুত দরকার নেই—তারা নিজেরাই তো কুলীন বামুন-কায়েত।
স্বদেশী বা স্বাধীনতা বা কংগ্রেস বা আন্দোলন সম্পর্কে যোগেন খুব রাজনীতি করে, চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে, পড়াশুনোয় মীমাংসা দেখে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছয়নি। যোগেনদের মত হদ্দ গরিব নমশূদ্রদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও আর—কতটুকুই উচ্চ হতে পারে? আকাঙ্ক্ষার সেই উচ্চতা তো একটা অপরিবর্ত প্রক্রিয়া নয়। বরং অহোরহ পরিবর্তমান ফলে, তার জীবনযাপন থেকে ছিটকে গেছে বহু দরকারি, বহু অনিবার্য, বহু স্বাভাবিক ভারসাম্য। একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী অথচ হদ্দ গরিব নমশূদ্রের যদি ব্যক্তিত্বের ভিতরই ঢুকে পড়ে থাকে নেতৃত্ব, তাহলে তাকে চলাফেরা, মেলামেশা ও মতামতে সব সময় সজারুর মত কাঁটা উঁচিয়ে থাকতে হয়—আত্মরক্ষার দরকারে। সে সব সময়ই আক্রান্ত। সে-আক্রমণ সব সময়ই আসে তার জাতি-পরিচয় থেকে, তার নমশূদ্র পরিচয় থেকে। সে নিজেই এক পলকের জন্যও নিজের সেই পরিচয় ভুলতে পারে না। কোনো বর্ণহিন্দু বাড়িতে গেলে সে এক গ্লাস জল চাইতে পারে না। তাকে বেশ খেয়াল করে বর্ণহিন্দু বাড়ির নিমন্ত্রণ সামলাতে হয়। স্কুলে না-হয় তা নিয়ে মারামারি করেছে। কলেজে না-হয় তা নিয়ে দল পাকিয়েছে। কিন্তু এখন? তার ভিতর অস্বীকারের মনোভাব শিকড় গাড়ছে। সে-শিকড় জালের মত নয়। সে-শিকড় বহুতোয়া নদীর মত নয়। সে-শিকড় স্তবকের মত নয়। সে-শিকড় এক-ফলক বর্শার মত শাণিত, তীব্র, বিদ্ধক্ষম, মৃত্তিকাতলের সমস্ত বাধার ভিতর দিয়ে সূচ্যগ্রগতি।
কিন্তু বর্শা তো খননের হাতিয়ার নয়। বর্শা তো আক্রমণের হাতিয়ার, শূন্যকে এফোঁড়-ওফোঁড় করার হাতিয়ার।
অশ্বিনীকুমারের বরিশালপ্রাণতা যোগেনের ভিতর বাসা বেঁধেছে। আর, যোগেনের জৈবক্রিয়া থেকে তৈরি হয়েছে এক পদ্ধতি—যাতে পরিধিকে ছোঁয়া যায়। যোগেন নিজেও কেন্দ্র-পরিধির এই দখল তার ব্যক্তিত্বে টের পায়।
তাই এক ভয় হয়ে উঠছে ক্রমেই বাস্তব। যদি কোনো একদিন মাটির অন্তর্ভেদী বর্শা ফলক তার স্বভাবে ফিরে যায় : আক্রমণে। তাহলে তো গাছটা উপড়ে যাবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন