১৯৫৪। বয়স ৫৫ বছর

হরিশংকর জলদাস

১৯৫৪। বয়স ৫৫ বছর 

২৪ জানুয়ারি অজিতকুমার ঘোষকে নিয়ে কল্যাণীতে কংগ্রেস অধিবেশন দেখতে যাওয়ার সময় ধর্মতলা থেকে বাসে উঠে প্রথমে বাসের সামনের দিকে বসলেন জীবনানন্দ। পরে তাঁরই আগ্রহে সিট বদল করে মাঝামাঝি জায়গায় বসা হয়। 

জীবনানন্দ বললেন- 

‘দুর্ঘটনা হলে বাঁচবার আশা থাকবে।’ (‘জীবনানন্দ প্রসঙ্গ : জীবন নদীর তীরে’, অজিতকুমার ঘোষ)। 

২৮ ও ২৯ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে এক কবি-সম্মেলন হয়। প্রধান উদ্যোক্তা সিগনেট প্রেস। উদ্যোক্তাদের পক্ষে আহ্বায়ক ছিলেন নীহাররঞ্জন রায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও দিলীপকুমার গুপ্ত; যুগ্ম-সম্পাদক : আলোক সরকার ও পূর্ণেন্দুবিকাশ ভট্টাচার্য। প্রথম দিনে অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি জীবনানন্দ সবার শেষে কবিতা আবৃত্তি করেন। ‘বনলতা সেন’, ‘সুচেতনাসহ আরো ৩/৪টি। আবৃত্তি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। জীবনানন্দ যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কবি নিঃসন্দেহে সেদিন তা প্রমাণিত হয়েছিল। 

সে মাসে প্রকাশিত হল ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। 

প্রথম মুদ্রণ : বৈশাখ ১৩৬১, মে ১৯৫৪। 

প্রকাশক : শ্রীসৌরেন্দ্রনাথ বসু, নাভানা, ৪৭ গণেশচন্দ্র এভিনিউ, কলকাতা-১৩। 

মুদ্রাকর : শ্রীগোপালচন্দ্র রায়, নাভানা প্রিন্টিং ওয়ার্কস লিমিটেড, ৪৭ গণেশচন্দ্র এভিনিউ, কলকাতা-১৩। 

প্রচ্ছদশিল্পী : ইন্দ্র দুগার (১৯১৮–১৯৮৯)। 

রয়াল পৃ. ১৩৬। বোর্ড বাঁধাই। 

মূল্য : পাঁচ টাকা। 

এই সংকলনের জন্যে কবিতাগুলো বাছাই করেছিলেন বিরাম মুখোপাধ্যায় (১৯১৫- ১৯৯৮)। 

কবিতার সংখ্যা : ৭২। 

কবিতাগুলোর শিরোনাম হল : 

১. নীলিমা, ২. পিরামিড, ৩. সেদিন এ ধরণীর, ৪. মৃত্যুর আগে, ৫. বোধ, ৬. নির্জন স্বাক্ষর, ৭. অবসরের গান, ৮. ক্যাম্পে, ৯. মাঠের গল্প, ১০. সহজ, ১১. পাখিরা, ১২. শকুন, ১৩. স্বপ্নের হাতে, ১৪. ধান কাটা হয়ে গেছে, ১৫. পথ হাঁটা, ১৬. বনলতা সেন, ১৭. আমাকে তুমি, ১৮. তুমি, ১৯. অন্ধকার, ২০. সুরঞ্জনা, ২১. সবিতা, ২২. সুচেতনা, ২৩. আবহমান, ২৪. ভিখিরী, ২৫. তোমাকে, ২৬. হাজার বছর শুধু খেলা করে, ২৭. শব, ২৮. হায় চিল, ২৯. সিন্ধু সারস, ৩০. কুড়ি বছর পরে, ৩১. ঘাস, ৩২. হাওয়ার রাত, ৩৩. বুনো হাঁস, ৩৪. শঙ্খমালা, ৩৫. বিড়াল, ৩৬. শিকার, ৩৭. নগ্ন নির্জত হাত, ৩৮. আট বছর আগের একদিন, ৩৯. মনোকণিকা, ৪০. সুবিনয় মুস্তফী, ৪১. অনুপম ত্রিবেদী, ৪২. আকাশলীনা, ৪৩. ঘোড়া, ৪৪. সমারূঢ়, ৪৫. নিরঙ্কুশ, ৪৬. গোধূলি সন্ধির নৃত্য, ৪৭. একটি কবিতা, ৪৮. নাবিক, ৪৯. খেতে প্রান্তরে, ৫০. রাত্রি, ৫১. লঘুমুহূর্ত, ৫২. নাবিকী, ৫৩. উত্তর প্রবেশ, ৫৪. সৃষ্টির তীরে, ৫৫. তিমির হননের গান, ৫৬. জুহু, ৫৭. সময়ের কাছে, ৫৮. জনান্তিকে, ৫৯. সূর্যতামসী, ৬০. বিভিন্ন কোরাস, ৬১. তবু, ৬২. পৃথিবীতে, ৬৩. এইসব দিনরাত্রি, ৬৪. লোকেন বোসের জর্নাল, ৬৫. ১৯৪৬-৪৭, ৬৬. মানুষের মৃত্যু হলে, ৬৭. অনন্দা, ৬৮. আছে, ৬৯. যাত্রী, ৭০. স্থান থেকে, ৭১. দিনরাত, ৭২. পৃথিবীতে এই। 

এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত নিম্নলিখিত শিরোনামের ১৮টি কবিতা ইতিপূর্বে কোনো গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়নি : 

১. আবহমান, ২. ভিখিরী, ৩. তোমাকে, ৪. মনোকণিকা, ৫. সুবিনয় মুস্তফী, ৬. অনুপম ত্রিবেদী, ৭. তবু, ৮. পৃথিবীতে, ৯. এইসব দিনরাত্রি, ১০. লোকেন বোসের জর্নাল, ১১. ১৯৪৬-৪৭, ১২. মানুষের মৃত্যু হলে, ১৩. অনন্দা, ১৪. আছে, ১৫. যাত্রী, ১৬. স্থান থেকে, ১৭. দিনরাত, ১৮. পৃথিবীতে এই। 

এই গ্রন্থের ভূমিকায় জীবনানন্দ লেখেন— 

‘কবিতা কী এ-জিজ্ঞাসার কোনো আবছা উত্তর দেওয়ার আগে এটুকু অন্তত স্পষ্টভাবে বলতে পারা যায় যে কবিতা অনেক রকম। হোমারও কবিতা লিখেছিলেন, মালার্মে, র্যাবো ও রিলকেও। শেক্সপীয়র, বদলেয়ার, রবীন্দ্রনাথ ও এলিয়টও কবিতা রচনা করে গেছেন। কেউ কেউ কবিকে সবের উপরে সংস্কারকের ভূমিকায় দেখেন; কারো কারো ঝোঁক একান্তই রসের দিকে। কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিস – শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়। 

বিভিন্ন অভিজ্ঞ পাঠকের বিচার ও রুচির সঙ্গে যুক্ত থাকা দরকার কবির; কবিতার সম্পর্কে পাঠক ও সমালোচকেরা কী ভাবে দায়িত্ব সম্পন্ন করছেন এবং কী ভাবে তা করা উচিত সেই সব চেতনার ওপর কবির ভবিষ্যৎ কাব্য, আমার মনে হয়, আরো স্পষ্টভাবে দাঁড়াবার সুযোগ পেতে পারে। কাব্য চেনবার, আস্বাদ করবার ও বিচার করবার নানারকম স্বভাব ও পদ্ধতির বিচিত্র সত্যমিথ্যার পথে আধুনিক কাব্যের আধুনিক সমালোচককে প্রায়ই চলতে দেখা যায়, কিন্তু সেই কাব্যের মোটামুটি সত্যও অনেক সময়েই তাঁকে এড়িয়ে যায়। 

আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন, এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার, কারো মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার; সুররিয়ালিস্ট। আরো নানারকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য—কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়। কিন্তু কবিতাসৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক ও সমালোচকদের উপলব্ধি ও মীমাংসায় এত তারতম্য। একটা সীমারেখা আছে এ তারতম্যের; সেটা ছাড়িয়ে গেলে বড়ো সমালোচককে অবহিত হতে হয়। নানা দেশে অনেক দিন থেকেই কাব্যের সংগ্রহ বেরুচ্ছে। বাংলায় কবিতার সঞ্চয়ন খুবই কম। নানা শতকের অক্সফোর্ড বুক অব ভর্সের সংকলকদের মধ্যে বড়ো কবি প্রায়ই কেউ নেই, কিন্তু সংকলনগুলো ভালো হয়েছে; ঢের পুরোনো কাব্যের বাছবিচারে বেশি সার্থকতা বেশি সহজ, নতুন কবি ও কবিতার খাঁটি বিচার বেশি কঠিন। অনেক কবির সমাবেশে একটি সংগ্রহ; একজন কবির প্রায় সমস্ত উল্লেখ্য কবিতা নিয়ে আর এক জাতীয় সংকলন; পশ্চিমে এ ধরনের অনেক বই আছে; তাদের ভেতর কয়েকটি তাৎপর্যে এমন কি মাহাত্ম্যে প্রায় অক্ষুণ্ণ। আমাদের দেশে দু-একজন পূর্বজ (উনিশ- বিশ শতকের) কবির নির্বাচিত কাব্যাংশ প্রকাশিত হয়েছিল; কতদূর সফল হয়েছে এখনও ঠিক বলতে পারছি না। ভালো কবিতা যাচাই করবার বিশেষ শক্তি সংকলকের থাকলেও আদিম নির্বাচন অনেক সময়ই কবির মৃত্যুর পরে খাঁটি সংকলনে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ পায়। কিন্তু কোনো কোনো সংকলনে প্রথম থেকেই যথেষ্ট নির্ভুল চেতনার প্রয়োগ দেখা যায়। পাঠকদের সঙ্গে বিশেষভাবে যোগ স্থাপনের দিক দিয়ে এ ধরনের প্রাথমিক সংকলনের মূল্য আমাদের দেশেও লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের কাছে ক্রমেই বেশি স্বীকৃত হচ্ছে হয়তো। যিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেননি তাঁর কবিতার এ রকম সংগ্রহ থেকে পাঠক ও সমালোচক এ কাব্যের যথেষ্ট সংগত পরিচয় পেতে পারেন; যদিও শেষ পরিচয়লাভ সমসাময়িকদের পক্ষে নানা কারণেই দুঃসাধ্য। এই সংকলনের কবিতাগুলো শ্রীযুক্ত বিরাম মুখোপাধ্যায় আমার পাঁচখানা কবিতার বই ও অন্যান্য প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনা থেকে সঞ্চয় করেছেন, তাঁর নির্বাচনে বিশেষ শুদ্ধতার পরিচয় পেয়েছি। বিন্যাস সাধনে মোটামুটিভাবে রচনার কালক্রম অনুসরণ করা হয়েছে। 

জীবনানন্দ দাশ
কলকাতা 
২০.৪.১৯৫৪

‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বিষয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্যকৃত একটি চমৎকার পর্যালোচনা ‘দেশ’ (চৈত্র ১৩১৬) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া নিম্নোক্ত পত্রিকায় ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থটি বিষয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা বের হয়। 

১. ‘পূৰ্ব্বাশা’ : জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১।

২. ‘ঊষা’ : শ্রাবণ ১৩৬১।

৩. ‘কবিতা’ : পৌষ ১৩৬১। 

৪. ‘সাহিত্যপত্র’ : আশ্বিন ১৩৬১। 

১০.১০.৫৪ তারিখে সুরজিৎ দাশগুপ্তকে জীবনানন্দ লিখলেন— 

‘শরীর মোটেই ভালো নয়; নানা ব্যাপারে বিব্রত : তোমার চিঠির উত্তর দিতে দেরী হয়ে গেল তাই। কিছু মনে করো না। তুমি ১৭ অক্টোবরের পরে কোনো একদিন বিকেলে আমার এখানে এলে চিঠি ও প্রবন্ধ সম্পর্কে কথাবার্তা হতে পারে।’ [‘জলার্ক’, ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৫৯]। 

১৩ অক্টোবর রাতে গারস্টিন প্লেসে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের পুরনো বাড়িতে একটা বড় ধরনের কবি-সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রাচীনদের সঙ্গে তিরিশের অনেক কবিও যোগ দিয়েছিলেন সেই সম্মেলনে। এতে উপস্থিত ছিলেন করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭– ১৯৫৫), কুমুদরঞ্জন মল্লিক (১৮৮৩–১৯৭০), কালিদাস রায়, বনফুল (১৮৯৯ – ১৯৭৮), সজনীকান্ত দাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও জীবনানন্দ দাশ। এই অনুষ্ঠানে জীবনানন্দ ‘মহাজিজ্ঞাসা’ নামক কবিতাটি পাঠ করলেন। ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি সে বছর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র পুজো বার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া আরও অন্তত বারোটি পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়। পত্রিকাগুলো হল—’দেশ’, ‘দৈনিক বসুমতী’, ‘পূৰ্ব্বাশা’, ‘ঊষা’, ‘বন্দে মাতরম্’, ‘বর্ধমান’, ‘জয়শ্ৰী’, ‘সেতু’, শতভিষা’, ‘ময়ূখ’ ইত্যাদি। 

বেতার কেন্দ্রে যাওয়ার পূর্বের একটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন প্রভাতকুমার দাস- 

‘কিন্তু বেতার কেন্দ্রে যাওয়ার পূর্বে খুব অনিশ্চিত ও চিন্তান্বিত, কিছুটা অস্থির মনে হল তাঁকে। প্রেমেন ও সুধীনবাবু আসবেন তাঁকেও যেতে হবে, সুতরাং কড়ে আঙ্গুলের কাছে ছেঁড়া কাপড়ের জুতোর এক পাটির শোচনীয় অবস্থা সামাল দেন কি করে? শেষ পর্যন্ত গড়িয়াহাটার বাজার থেকে সুচরিতা এক জোড়া সাত নম্বর বাটার পাম্পশু কিনে দিয়ে তাঁকে তৎক্ষণাৎ নিশ্চিন্ত ও প্রসন্ন করলেন। জীবনানন্দ মোটামুটি আত্মস্থ হয়ে কবি সম্মেলনে গেলেন।’ [জীবনানন্দ দাশ’, প্রভাতকুমার দাস, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ১০৬] 

১৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রোজকার মতন সান্ধ্য-ভ্রমণে বের হয়েছিলেন জীবনানন্দ। তাঁর রোজকার ভ্রমণের সীমা ছিল ল্যান্সডাইন দিয়ে রাসবিহারী এভিনিউ ধরে কিছুটা পশ্চিমে। তারপর রসা রোড ছুঁয়ে সাদার্ন এভিনিউ দিয়ে সোজা গড়িয়াহাটার গোলপার্ক। কোনোদিন চক্রাকারে প্রদক্ষিণ করতেন ঢাকুরিয়া লেক থেকে ছোট লেক, একেবারে টালিগঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত। 

ওই দিন দেশপ্রিয় পার্কের কাছে সান্ধ্য-ভ্রমণের সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে ছুটন্ত ট্রামের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গুরুতর আহত হন জীবনানন্দ। প্রভাতকুমার দাস তাঁর ‘জীবনানন্দ দাশ’ গ্রন্থে ১৪ অক্টোবরের এ দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে— 

‘একা বেড়িয়ে ফেরার পথে রাসবিহারী এভেনিউতে ‘জলখাবার’ ও ‘জুয়েল হাউস’-এর সামনে রাস্তা পেরুতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। কিছুটা দূরে যে একটা ট্রাম, অবিরাম ঘণ্টি বাজিয়ে এগিয়ে আসছে সেদিকে খেয়াল নেই— হয়তো ডায়াবেটিসের জন্য সামান্য সময় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। গাড়ি যখন থামলো, তখন তাঁর দেহ ক্যাচারের ভেতরে ঢুকে গেছে। রক্তাপুত অচৈতন্য দেহ উদ্ধারের কাজে ফুটপাত থেকে ছুটে এলেন ‘সেলি কাফের’ মালিক চুনীলাল দেব। তিনিই ট্রামের ক্যাচার থেকে তাঁকে টেনে হেঁচড়ে বের করে আনলেন, তখন কবির অবস্থা সংকটজনক অজ্ঞান অচেতন। অল্প সময়ের মধ্যে ট্যাক্সিতে করে নিয়ে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হল। পরে চুনীবাবুর কাছে খবর পেয়ে বাড়ির লোকজন আত্মীয় পরিজন এক এক করে হাসপাতালে উপস্থিত হলেন। দুর্ঘটনার ফলে তাঁর পাঁজরা, কণ্ঠী ও উরুদেশের হাড় ভেঙে যায়।’ [পৃ. ১০৭] 

১৫ অক্টোবর ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দকে দেখতে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে যান। সেদিনের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন— 

‘ডানদিকের ওয়ার্ডের মাঝামাঝি একটা দরজার কাছে জীবনানন্দ দক্ষিণ শিয়রে শুয়ে আছেন একটা ভাঙাচোরা রঙ-ওঠা লোহার খাটে; ভাঙা ডান পাটি তখনও ব্যান্ডেজ জড়ানো শুধু, মনে হয় যেন একটা পাতলা সরু তক্তা মতো কিছু ব্যান্ডেজের আবরণের ভিতরে রয়েছে, পায়ের পাতা তবু কাত হয়ে আছে বাইরের দিকে, রক্ত ফুটে বেরুচ্ছে জায়গায় জায়গায়, ফলে কোথাও কোথাও জট পাকানো কালো ছোপ ধরে আছে; গায়ে একটা পাতলা চাদর—বেশ ময়লা, মাথার কাছে জং-ধরা কাত হয়ে থাকা একটা চৌকো লোহার লকার, তার ওপরে দু’চারটে ওষুধ-বিষুদের শিশি ঠোঙা তুলো ডিশ তোয়ালে, জীবনানন্দ চুপচাপ কিন্তু শ্বাস পড়ছে ছোট ছোট তাড়াতাড়ি হেঁচকা-মতন; হাত দুটি পাশে পড়ে আছে নেতিয়ে, যদিও ঢাকা, দেখা যাচ্ছে; হয়তো ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়ে থাকবে বা ব্যথার ওষুধ; নাকে অক্সিজেনের নল, অক্সিজেন, জলের ভিতরে বুদ্বুদের বহর দেখেই বোঝা যায়, না যাওয়ার মতোই যাচ্ছে, হয়তো দিদিমণিরা এখুনি এসে ঠিক করে দেবেন; বাঁ হাতে স্যালাইনের নল, জল পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা।’ [‘আলেখ্য: জীবনানন্দ’, ভূমেন্দ্র গুহ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ৩২] 

১৫ অক্টোবর শুক্রবার সঞ্জয় ভট্টাচার্যের (১৯০৯—১৯৬৯) চিঠি নিয়ে মেডিকেল কলেজের দুই তরুণ ডাক্তার ভূমেন্দ্র গুহ ও দিলীপ মজুমদার সজনীকান্ত দাসের (১৯০০— ১৯৬২) কাছে যান। সজনীকান্তের প্রচেষ্টায় প্রখ্যাত ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় (১৮৮২-১৯৬২), ডা. অজিতকুমার বসু ও ডা. অমলানন্দ দাশকে (জীবনানন্দের খুড়তুতো ভাই, জীবনানন্দের কাকা প্রেমানন্দ দাশের ছেলে। ডাক নাম – বুবু। সুখলতা রাওয়ের জামাতা। পাঁচের দশকে ইনি কলকাতায় চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যাপক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন, নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান হিসেবে তিনি তাঁর কর্মজীবনের শেষের দিকে কাজ করেছেন। আহত জীবনানন্দের শেষের দিনগুলোতে চিকিৎসার সুব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। অমলানন্দের সঙ্গে যুগ্ম-দায়িত্বে কাজ করার জন্যে মনোনীত হয়েছিলেন আরেকজন বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার অজিতকুমার বসু) সঙ্গে নিয়ে ১৭ অক্টোবর জীবনানন্দকে দেখতে যান। বিধান রায় আধঘণ্টা ছিলেন। সুচিকিৎসার আশ্বাস দেন তিনি। ভূমেন্দ্র গুহ সেদিনের বর্ণনায় লেখেন— 

‘মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় জীবনানন্দকে দেখতে এলেন সন্ধেবেলা সাতটা সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ, সঙ্গে সজনীকান্ত দাস। অন্যান্য যাঁরা তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদ-প্রাধান্যের জন্য তাঁর সঙ্গী হওয়ার জন্য দায়বদ্ধ, তারা পুলিশের লোক হয়তো রাজনৈতিক সচিব ইত্যাদি; … খুব যে একটা খুঁটিয়ে দেখলেন টেখলেন জীবনানন্দকে, তা নয়, সংগৃহীত তথ্যগুলি দ্রুত জেনে নিলেন কী কী ওষুধপত্র দেওয়া হয়েছে বা কী কী করা হয়েছে তখন পর্যন্ত হিসেব নিলেন এবং চিকিৎসা পদ্ধতির যে ছকটি তৈরি হয়েছিল, তা মোটামুটি সমর্থন করলেন ও সামান্য অদল বদল করতে বললেন।’ [আলেখ্য : জীবনানন্দ’, পৃ. ৫৩] 

হাসপাতালে জীবনানন্দের জন্যে প্রথমে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পরে অবশ্য পৃথক জায়গার ব্যবস্থা হয়। তখন নড়াচড়া করানো বারণ। 

‘দেখতে আসেন অনেক আত্মীয়-স্বজন। আসেন অশোকানন্দ দাশ, তাঁর স্ত্রী নলিনী দাশ, সুপ্রিয়া দাশগুপ্ত, খুড়তুতো বোন জ্যোৎস্না দাশগুপ্ত। তাঁরা বেশ কিছুক্ষণ করে করে হাসপাতালে থেকেছেন। কিন্তু জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশকে বেশিক্ষণের জন্যে হাসপাতালে ধরে রাখা যায়নি। বস্তুত, জীবনানন্দ যেদিন মারা যান, তার কয়েকদিন আগে থেকে তিনি হাসপাতালে আসা পুরো বন্ধ করে দেন এবং মৃত্যুর সময়ে তিনি হাসপাতালে ছিলেন না।’ [প্রাগুপ্ত, পৃ. ৫০] 

লেখকদের মধ্যে দেখতে আসেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সজনীকান্ত দাস এবং চল্লিশের দশকের অনেক কবি। এ সময় ‘ময়ূখ’ পত্রিকার তরুণ লেখকরা ভূমেন্দ্র গুহ, সমর চক্রবর্তী (১৯৩২––১৯৮৪), জগদীন্দ্র মণ্ডল (জন্ম. ১৯৩৪), স্নেহাকর ভট্টাচার্য বিশেষভাবে খেটেছিলেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন সিস্টার শান্তি ব্যানার্জি। তার সাক্ষ্য মেলে ভূমেন্দ্র গুহের লেখায় — 

‘জীবনানন্দের জ্বর ছিল, ঘন ঘন ছোট ছোট শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছিল, চোখ বন্ধ, কপালে ঘাম, ঠোঁট দৃঢ়বদ্ধ, শান্তি নামের নার্সটি এই ভিজে তোয়ালে দিয়ে গা- মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন তো এই চিরুনি চালিয়ে চুল সাজিয়ে দিচ্ছেন, এই অক্সিজেনের নল নাক থেকে বার করে পরিষ্কার করে আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তো ভাঙা পা খানি দু’পাশে বালিশ পেতে এমনভাবে গুছিয়ে রাখছেন যাতে হঠাৎ নড়ে গিয়ে বেশি ব্যথা তিনি না পান, খুব তোষামোদ করে এক কাপ হরলিক্স খাওয়াতে পারলেন তো পরের মুহূর্তেই সজাগ হয়ে উঠে হিসেব করে নিলেন এখুনি কোনও ইনজেকশন দেওয়ার সময় হয়ে গেছে কিনা, বা স্যালাইনের নলের বোতলটি খালি হয়ে গেল কিনা?’ [আলেখ্য: জীবনানন্দ’, পৃ. ৩৮] 

‘ময়ূখ’ গোষ্ঠী জীবনানন্দের সেবায় নিজেদের পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করেছেন। যাঁদের কথা বলতে গিয়ে লাবণ্য দাশ ‘মানুষ জীবনানন্দ’ গ্রন্থে লিখেছেন – 

‘আহত অবস্থায় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে শয্যা নেবার পরে দেখেছি তাঁর সেবা করবার জন্য তরুণ বয়সী ছেলেদের সে কি আগ্রহ! তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আবার হোস্টেলেও থাকতেন। কিন্তু সেখানকার নিয়মকানুন, উপরওয়ালাদের রক্তচক্ষু, পাঁচিলের উচ্চতা—কোন কিছুই তাঁদের আটকাতে পারেনি। তাঁরা ঠিক 

সময়েই ছুটতে ছুটতে কবির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।’ 

ক্রমশ জীবনানন্দের ফুসফুসে নিউমোনিয়া দেখা দেয়—সেপটিক নিউমোনিয়া। ২২ অক্টোবার শুক্রবার (৫ কার্তিক ১৩৬১ বঙ্গাব্দ) রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে কবি জীবনানন্দ দাশ শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ভাষায়— 

‘মর্ত্যের বন্দর থেকে একটি জাহাজ শান্তি পারাবারে চলে গেল।’ [‘শেষ দেখার দিনগুলি’]। 

মৃত্যুকালে জীবনানন্দের বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর ৮ মাস ৪ দিন। মৃত্যুস্থান : শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল। ড. দিলীপ মজুমদার ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ সাল, রাত সাড়ে এগারটায়, জীবনানন্দের মৃত্যুমুহূর্তে ময়ূখগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে জীবনানন্দের পাশে ডিউটিরত ছিলেন (তখনো তিনি ডাক্তার হননি, ছাত্র)। তাঁর সাক্ষ্য অনুসারে মৃত্যুকালে জীবনানন্দের শেষ সংলাপ ছিল 

‘ধূসর পাণ্ডুলিপির রং সারা আকাশ জুড়ে, ধূসর পাণ্ডুলিপি সারা আকাশ জুড়ে—।’ 

[আলেখ্য : জীবনানন্দ’, ভূমেন্দ্র গুহ, পৃ. ৭৭]। 

জীবনানন্দের জীবনের অনেকাংশ জুড়ে ছিলেন সহোদরা সুচরিতা দাশ। তাঁর রাগ-ত্যাগ, স্নেহ-আবদার সুচরিতাকে ঘিরেই আবর্তিত হতো। আহত হবার একদিন আগে জুতো কিনে দেবার জন্যে যেমন আবদার করেছেন, আবার মৃত্যুর ২/১ দিন আগে হাসপাতালের মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আমের আচার এনে দেবার জন্যে তেমনি সুচরিতার ওপর রাগারাগি করেছেন। জীবনানন্দের মৃত্যুমুহূর্তে এই সুচরিতার বর্ণনা দিয়েছেন ভূমেন্দ্র গুহ— 

‘দিদি (সুচরিতা দাশ) একটি শক্ত বিমূর্ত মূর্তির মতো তাঁর লোহার খাটের মাথার দিকের রেলিং ধরে দৃঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। সাধারণত অন্তর্লোকের তরঙ্গবিক্ষুব্ধতা বহিরঙ্গে প্রকাশিত হতে দিতে তাঁর গভীর অনীহা, তবু তাঁর গালের ওপর শুকিয়ে ওঠা অশ্রুর রেখা সহজেই আবিষ্কার করা গেল।’ [প্রাগুপ্ত, পৃ. ৭৩-৭৪] 

২৩ অক্টোবর শনিবার প্রায় সব সংবাদপত্রে জীবনানন্দের মৃত্যুর সংবাদ বেরিয়েছিল। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র শিরোনাম ছিল- 

‘পরলোকে কবি জীবনানন্দ দাশ। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে জীবনাবসান।’ 

৮ কার্তিক ১৩৬১-এর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় এই সংবাদ-শিরোনাম লেখা হয়- ‘রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ/শনিবার কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন।’ 

মৃত্যুর পর জীবনানন্দের বাসভবনে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের আগমনের বিবরণ পাওয়া যায় ভূমেন্দ্র গুহের ‘আলেখ্য : জীবনানন্দ’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন— 

‘খুব সকালে সবার চাইতে আগে এসেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, শোওয়ার পোশাকেই মোটামুটি, পায়ে হালকা চটি, হাতে রজনীগন্ধার একটি গুচ্ছ, শবদেহের পাশে শুইয়ে দিয়ে এক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কাউকে একটি কথা না বলে যেমন এসেছিলেন, তেমনি ধীর পায়ে জুতোর শব্দ না তুলে চলে গেলেন। সেই গাম্ভীর্য সেই শোক আর ছোঁওয়া গেল না।’ [পৃ. ২৮] 

নাতিদীর্ঘ এক শোভাযাত্রাসহ জীবনানন্দ দাশের মৃতদেহ কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। 

উল্লেখযোগ্য যাঁরা শবযাত্রা অনুগমন করেছেন বা মৃত্যুর পর কবির বাসভবনে গেছেন অথবা শ্মশানঘাটে গেছেন, তাঁর হলেন—দেবপ্রসাদ ঘোষ, নির্মল ভট্টাচার্য, সরোজ দাস, সজনীকান্ত দাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, দিনেশ দাস, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, জগদীশ ভট্টাচার্য, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, গোপাল ভৌমিক, বাণী রায়, প্রতিভা বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ, বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন চট্টোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ গুহ, ভূমেন্দ্র গুহ, সুশীল রায়, অরুণ ভট্টাচার্য, অমল দত্ত, অজিত বসু, বিরাম মুখোপাধ্যায়, বিভাস রায়চৌধুরী প্ৰমুখ। 

মার্চ ১৯৫৪-তে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনটি প্রকাশিত হয়। পূর্ববর্তী সংস্করণে গৃহীত চারটি কবিতার সঙ্গে বুদ্ধদেব আরও ছ’টি কবিতা যুক্ত করলেন। কবিতা ছ’টি হল—’হায় চিল’, ‘বিড়াল’, হাওয়ার রাত’, ‘সমারূঢ়’, ‘আকাশলীনা’ ও ‘আট বছর আগের একদিন’। 

১৯৫৪ সালে জীবনানন্দের আকস্মিক মৃত্যুতে বুদ্ধদেব বসু ‘কবিতা’ পত্রিকার ‘জীবনানন্দ সংখ্যা’ প্রকাশ করেন (পৌষ ১৩৬১)। এতে ‘জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে’ নামের একটি দীর্ঘ লেখা লিখেন বুদ্ধদেব। অংশ বিশেষ এ রকম— 

‘তাঁর অনন্যতা বিষয়ে অনেক পাঠকই আজকের দিনে সচেতন, আর তিনি যে আমাদের ‘নির্জনতম’ কবি, অত্যধিক পুনরুক্তিবশত এই কথাটার ধার ক্ষয়ে গেলেও এর যাথার্থ্যে আমি এখনও সন্দেহ করি না। ‘আমার মতন কেউ নাই আর তাঁর এই স্বগতোক্তি প্রায় আক্ষরিক অর্থেই সত্য। যৌবনে, যখন মানুষের মন স্বভাবতই সম্প্রসারণ খোঁজে, আর কবির মন বিশ্বজীবনে যোগ দিতে চায়, সকলের সঙ্গে মিলতে চায় আর সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিতে চায় নিজেকে, সেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের ঋতুতেও তিনি বুঝেছেন যে তিনি স্বতন্ত্র, ‘সকল লোকের মধ্যে আলাদা’, বুঝেছেন যে তাঁর গান জীবনের ‘উৎসবের’ বা ‘ব্যর্থতার’ নয়, অর্থাৎ বিদ্রোহের আলোড়নের নয়—তাঁর গান সমর্পণের, আত্মসমর্পণের, স্থিরতার। ‘পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত’ রোমান্টিক হয়েও, তাই তিনি ভাবের দিক থেকে রোমান্টিকের উল্টো; আধুনিক বাংলা কাব্যের বিচিত্র বিদ্রোহের মধ্যে তাঁকে আমরা দেখতে পাই না। বস্তুত, তাঁকে যেন বাংলা কাব্যের মধ্যে আকস্মিকরূপে উদ্ভূত বলে মনে হয়; সত্যেন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের ক্ষণিক প্রভাবের কথা বাদ দিলে—তিনি যে মহাভারত থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রবাহিত তাঁর পূর্বজ স্বদেশীয় সাহিত্যের কোনো অংশের দ্বারা কখনো সংক্রমিত হয়েছিলেন, বা কোনো পূর্বসূরীর সঙ্গে তাঁর একাত্মবোধ জন্মেছিলো, এমন কোনো প্রত্যক্ষ পরিচয় তাঁর কাব্যে নেই বললেই চলে। এ থেকে এমন কথাও মনে হতে পারে যে, তিনি বাংলা কাব্যের ঐতিহ্যস্রোতের মধ্যে একটি মায়াবী দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন ও উজ্জ্বল, এবং বলা যেতে পারে যে, তাঁর কাব্যরীতি ‘হুতোম অথবা অবনীন্দ্রনাথের গদ্যের মতো একেবারেই তাঁর নিজস্ব ও ব্যক্তিগত, তাঁরই মধ্যে আবদ্ধ, অন্য লেখকের পক্ষে সেই রীতির অনুকরণ, অনুশীলন বা পরিবর্ধন সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, এ বিষয়েও সন্দেহ নেই যে, চলতিকালের কাব্যরচনার ধারাকে তিনি গভীরভাবে স্পর্শ করেছেন, সমকালীন ও পরবর্তী কবিদের উপর তাঁর প্রভাব কোথাও কোথাও এমন সূক্ষ্মভাবে সফল হয়ে উঠেছে যে, বাইরে থেকে হঠাৎ দেখে চেনা যায় না। বাংলা কাব্যের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আসনটি ঠিক কোথায় সে বিষয়ে এখনই মনস্থির করা সম্ভব নয়, তাঁর কোনো প্রয়োজনও নেই এই মুহূর্তে; এই কাজের দায়িত্ব আমরা তুলে দিতে পারি আমাদের ঈর্ষাভাজন সেই সব নাবালকদের হাতে যারা আজ প্রথম বার জীবনানন্দর স্বাদুতাময় আলো- অন্ধকারে অবগাহন করছে। আপাতত, আমাদের পক্ষে, এই কথাই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মর্তব্য যে, ‘যুগের সঞ্চিত পণ্যে’র ‘অগ্নিপরিধির মধ্যে দাঁড়িয়ে যিনি ‘দেবদারু গাছে কিন্নরকণ্ঠ’ শুনেছিলেন, তিনি এই উদ্ভ্রান্ত, বিশৃঙ্খল যুগে ধ্যানী কবির উদাহরণস্বরূপ।’ 

একই সংখ্যায় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘রবীন্দ্রোত্তর কোবিদ কবি’ নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। এতে সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেন— 

‘জীবনানন্দর অভিজ্ঞতা একটি অলৌকিক স্বতন্ত্র বস্তু। তাঁর জীবনবোধ, প্রেমবোধ, ইতিহাসবোধ, সমাজবোধ—সবই স্বাতন্ত্র্যে বলয়িত এক একটি আলোকমণ্ডল। কল্পনার আলোতে বোধগুলো উজ্জ্বলকায় হয়েছে সত্যি, কিন্তু সে কল্পনা প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক বাস্তবতার বৃত্ত ছেড়ে অলৌকিকতার পথে বিচরণশীল হয়নি। জীবনানন্দকে এ জন্যেই ইতিহাস সচেতন কবি বলা হয়।’ 

এছাড়া জীবনানন্দের জীবদ্দশায় ও তাঁর মৃত্যুবছরে সঞ্জয় ভট্টাচার্য নিম্নোল্লিখিত প্রবন্ধ-কবিতা রচনা করেন— 

প্রবন্ধ : 

১. ‘বাংলা কবিতার নতুন দিক’, পূৰ্ব্বাশা, আশ্বিন ১৩৫৫। ২. ‘লৌকিক কবি জীবনানন্দ দাশ’, পূৰ্ব্বাশা, ফাল্গুন ১৩৬১। ৩. জীবনানন্দ দাশের কবিতা’, দেশ, চৈত্র ১৩৬১। ৪. ‘কবি জীবনানন্দ’, উত্তরসূরী, পৌষ-ফাল্গুন ১৩৬১। 

কবিতা : 

১. ‘দুপুর-রাত্রিতে’, ময়ূখ, কার্তিক-অগ্রহায়ণ ১৩৬১।

২. ‘হাসপাতালে’, ক্রান্তি, কার্তিক ১৩৬১। 

৩. ‘জীবনানন্দকে’, পূৰ্ব্বাশা, পৌষ ১৩৬১।

অকবি-সমালোচক অমলেন্দু বসু জীবনানন্দ বিষয়ে সর্বাধিক উৎসাহী ছিলেন। ‘কবিতা পত্রিকায় (পৌষ ১৩৬১) ‘যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। ‘অমৃত’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎসারে অমলেন্দু বসু জীবনানন্দ দাশকে ইয়েটস-এর চেয়েও বড় কবি বলেছেন। 

জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে দীর্ঘ সাহিত্যিক-বিরোধিতার অবসান ঘটিয়ে সজনীকান্ত দাস লিখেন— 

‘রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যসাহিত্যের তিনি অন্যতম গৌরব ছিলেন, তিনি অকপটে সুদৃঢ়তম নিষ্ঠার সহিত কাব্য সরস্বতীর সেবা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহার প্রকাশভঙ্গিতে অস্পষ্টতা থাকিলেও সাধনায় কিছুমাত্র ফাঁকি ছিল না। তিনি ভঙ্গি ও ভানসর্বস্ব কবি ছিলেন না। তাঁহার অবচেতন মনে কবিতার যে প্রবাহ অহরহ বহিয়া চলিত, লেখনীমুখে সজ্ঞান সমতলে তাহার ছন্দোবদ্ধ প্রকাশ দিতে প্রয়াস করিতেন। সহৃদয় ব্যক্তিরা তাঁহার বক্তব্যের চাবিকাঠি খুঁজিয়া পাইয়া আনন্দ লাভ করিতেন; যাঁহারা তাহা পাইতেন না তাঁহারাই বিমুখ হইতেন। এই হিংসা- হানাহানি-কলহ-বিদ্বেষ-কণ্টকিত বর্তমান পৃথিবীতে এই উদার হৃদয় প্রসন্নপ্রেমিক কবিকে পদে পদে আমাদের মনে পড়িবে।’ [‘শনিবারের চিঠি’, কার্তিক ১৩৬১]

৮ কার্তিক ১৩৬১-এর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সম্পাদকীয়তে লেখা হয়– 

‘কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুতে বাংলার সাহিত্য-পাঠক প্রত্যেকেই এ কারণে বিশেষ বেদনা অনুভব করিবেন যে, আকস্মিক এই দুর্ঘটনার আঘাত রবীন্দ্রোত্তর বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিকে চিরকালের মত নীরব করিয়া দিল।’ 

জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পরে পরে নিম্নবর্ণিত ৭টি পত্রিকা ‘জীবনানন্দ সংখ্যা’ প্রকাশ করে— 

১. ‘কবিতা’। পৌষ ১৩৬১, ২৯:২। সম্পাদক : বুদ্ধদেব বসু 

২. ময়ুখ’। পৌষ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১-৬২। সম্পাদক : জগদীন্দ্র মণ্ডল ও সমর চক্রবর্তী

৩. ‘ঊষা’। কার্তিক ১৩৬১। এই বিশেষ সংখ্যার আমন্ত্রিত সম্পাদক : বুদ্ধদেব বসু।

৪. ‘উত্তরসূরী। পৌষ-ফাল্গুন ১৩৬১, ২:২। সম্পাদক : অরুণ ভট্টাচার্য 1

৫. ‘জলার্ক’। কার্তিক ১৩৬১, ২:৭। সম্পাদক : সুরজিৎ দাশগুপ্ত। 

৬. ‘গার্লস কলেজ পত্রিকা’, হাওড়া। ১৯৫৪-৫৫। সম্পাদক : অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

৭. ‘একক’। যতীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ সংখ্যা। সম্পাদক : শুদ্ধসত্ত্ব বসু। 

মৃত্যুর অব্যবহিত পরে জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে খ্যাতিমান কবিসাহিত্যিক-সমালোচক আত্মীয়-স্বজনরা নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। তা হল- 

সজনীকান্ত দাস : 

‘রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যসাহিত্যের তিনি অন্যতম গৌরব ছিলেন, তিনি অকপটে সুদৃঢ়তম নিষ্ঠার সহিত কাব্য সরস্বতীর সেবা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহার প্রকাশভঙ্গিতে অস্পষ্টতা থাকিলেও সাধনায় কিছুমাত্র ফাঁকি ছিল না।’ [শনিবারের চিঠি’, কার্তিক ১৩৬১]। 

বুদ্ধদেব বসু : 

‘জীবনানন্দ কবিতা লিখতেন ছাত্র-ব্যবহার্য পালা এক্সেরসাইজ খাতায়, শক্ত পেনসিলে। তাঁর অভ্যেস ছিল দুপুর বেলায় লেখা এবং রচনাটি মনঃপূতভাবে শেষ হলে পরে, রাত্রে অন্য খাতায় কালিতে তার প্রতিলিপি তোলা। প্রতি কবিতার রচনার তারিখ সাধারণত উল্লেখ করতেন না, কিন্তু খাতার মলাটে মাস, বছরের উল্লেখ থাকত।’ [‘কবিতা’, পৌষ ১৩৬১]। 

অজিত দত্ত : 

‘জীবনানন্দর কবিতা যে দুর্বোধ্য হিজিবিজি কিছু নয়, আস্বাদ করতে পারলে তার রস যে সত্যই অতুলনীয়, এ ধারণা শিক্ষিত ও কাব্যানুরাগী পাঠকমহলেও বিরল দেখেছি।’ [কবি জীবনানন্দ’, ‘আন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ অক্টোবর ১৯৫৪]। ফিয়ের ফালোঁ এ. জে : 

‘ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ঊর্ধ্বে কবি (জীবনানন্দ) আপাতত অর্থহীন জীবনের সত্যিকার তাৎপর্য খুঁজে বেরিয়েছেন।’ [‘ঊষা, কার্তিক ১৩৬১]। 

সুরজিৎ দাশগুপ্ত : 

‘তাঁর (জীবনানন্দ) সান্নিধ্যে পেতাম একটি গভীর নিঃসঙ্গতা, সকল পল্লবগ্রাহিতার ঊর্ধ্বে সফেন সমুদ্রের অতলে একটা ধ্যাননিমগ্ন নীরবতা। ‘ তাঁর মানসক্ষুব্ধতার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল আধুনিক কালের কেন্দ্রহীন জীবনের মত্ত প্রমথন। .. হেমন্তের কবি বলে যাঁর প্রসিদ্ধি, হেমন্তের ছায়াপথ বেয়ে তিনি নক্ষত্রের ফুল কুড়োতে চলে গেলেন! তাঁর পশ্চাতে আমাদের জন্য রেখে গেলেন যে বাণীরূপ তার দ্বারা তিনি আমাদের মধ্যে সঞ্জীবিত।’ [‘জলার্ক’, কার্তিক ১৩৬১] অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় (জীবনানন্দের ছাত্রী) : 

‘স্বপ্রতিষ্ঠিত কবির গর্বোন্নত ভঙ্গিমা তো তাঁর ছিল না। তাঁর কবি পরিচয় লাভ করেছি তাঁর সেই আত্মবিস্মৃত মুহূর্তে, যখন তিনি আমাদের পাঠ্যতালিকার সর্বশেষ কঠিন প্রবন্ধটি সহজগম্য করবার আপ্রাণ চেষ্টায় আপনাকে ডুবিয়ে দিতেন।’ [‘গার্লস কলেজ পত্রিকা’, হাওড়া, ১৯৫৪-৫৫]। 

নীহাররঞ্জন রায় : 

‘যে স্বল্প সংখ্যক কবির কবিকর্ম নিয়ে আমার এই গর্ব, সাম্প্রতিক বাংলা কাব্যের গর্ব, জীবনানন্দ তার অন্যতম এবং সম্ভবত মহত্তম। জীবনকে আলাদা জগতে নিয়ে নতুন করে সৃষ্টির সাধনায় সাম্প্রতিক বাংলা কাব্যে তিনি অগ্রচারী।’ [‘নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন, ত্রিংশৎ অধিবেশনে মূল সভাপতির ভাষণ]। 

তরুণ সান্যাল : 

‘জীবনানন্দের ছন্দে ও বিলম্বিত মাত্রাপয়ারে যে নিপুণতা, তাঁর কবিতায় যে অপরূপ চিত্রকল্পের ব্যবহার, শুধু তা দিয়ে তাঁর পরিচিতি স্বীকৃত হলে কবি জীবনানন্দের উপর অবিচার হবে। কবিকে চিনব তাঁর কাব্যে, তাঁর আনন্দ বা বেদনাবোধের গভীরতায়, বিশ্বাসের তন্ময়তায় এবং বিশেষভাবে কোনো কবিদর্শনের প্রকাশনায়।’ [জীবনানন্দ দাশ’, ‘সীমান্ত’, শ্রাবণ ১৩৬২]। 

হরপ্রসাদ মিত্র : 

‘বাংলা কবিতায় গত ত্রিশ বছরের বিচিত্র আধুনিকতার মধ্যে তিনি (জীবনানন্দ দাশ) বারবার সেই চিরকালের শান্ত মাধুর্যের ছবি এঁকেছেন। ইদানীং তাঁর কোনো কোনো লেখায় দেখা দিয়েছিল দুর্বোধ্যতা। সে তাঁর গূঢ় মননেরই ভঙ্গি। খ্যাতির শিখরে পৌঁছেও তিনি শিল্পীর পরীক্ষা পরিত্যাগ করেননি.।’ [‘একক’, যতীন্দ্রনাথ- জীবনানন্দ সংখ্যা]। 

সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় : 

‘জীবনানন্দ তাঁর সাফল্যের ভিতর দিয়ে মানুষকে শিখিয়েছেন — ভালবাসা। আর তাঁর ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে শিল্পীকে শিখিয়েছেন–থীম অথবা আঙ্গিক, এককভাবে এর কোনটাই যেন শিল্পীর কাছে চরম বা absolute না হয়।’ [সময় গ্রন্থির কবি জীবনানন্দ’, ‘এক্ষণ’]। 

রঞ্জিত সিংহ : 

‘চোখ-কানের ঝগড়া মেটাতেই জীবনানন্দের সারাজীবন কেটে গিয়েছিল।’ [শ্রুতি ও প্রতিশ্রুতি’, ১৯৬৪]। 

রথীন্দ্রনাথ রায় : 

‘নানা জিজ্ঞাসা ও বক্তব্যের বিন্যাসে জীবনানন্দের কবিচরিত্র একটি অখণ্ডবোধ যা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও নব নব চেতনার আলোকে ক্রম সম্প্রসারণশীল।’ সমর চক্রবর্তী (‘ময়ূখ’ পত্রিকাগোষ্ঠীর সদস্য, শেষ ক’দিনের সঙ্গী) : 

‘সময়ের ক্লেদাক্ত নরককুণ্ডে ফেলে আমরা তোমাকে হনন করেছি বরণ করবো তোমাকে হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে, কিংবা ভিজে মেঘের দুপুরে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।’ 

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত : 

‘আমাদের জীবনে জীবনানন্দই সেই সমুদ্রতীর, সেই অনবরুদ্ধ দীপ্ত আকাশ।’

মণীন্দ্র রায় : 

‘স্মৃতিপূজার হিড়িকে তাঁর (জীবনানন্দ) বিষয়ে চারদিক থেকে সত্যমিথ্যা এত প্রশস্তিপত্র রচিত হতে থাকে, যার ভেতর থেকে কবির আসল চেহারা আবিষ্কার করা অন্ধের হস্তীদর্শনের মতোই পণ্ডশ্রম হয়ে ওঠে। … যদি তিনি নিজের ভাবনাচিন্তাকে আরো সচেতনভাবে সংগঠিত করতে পারতেন এবং তাঁর স্বাভাবিক কবিত্বশক্তি শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকত, জীবনানন্দ দাশ হয়তো রবীন্দ্রোত্তর যুগের একজন মহৎ কবি হতেন।’ [কবি জীবনানন্দ দাশ’, ‘পরিচয়’, শ্রাবণ ১৩৬২]।

বিমলচন্দ্র ঘোষ :  

‘জীবনানন্দের জীবনদর্শন একাকিত্বের তমসাচ্ছন্ন নৈরাশ্যে অন্তর্মুখীন। যে অন্তরের দ্বার, গবাক্ষ, জানালা, বাতায়ন মনুষ্যময়ী পৃথিবীকে এড়িয়ে চলার অত্যুদ্ভুত অহংকারে অবরুদ্ধ।’ [জীবনানন্দ দাশের জীবন দর্শন’, ‘বারোমাস’]। 

লাবণ্য দাশ (কবি-পত্নী) : 

ভূমেন্দ্র গুহকে ডেকে বললেন— ‘অচিন্ত্যবাবু এসেছেন, বুদ্ধদেব এসেছেন, সজনীকান্ত এসেছেন, তাহলে তোমাদের দাদা নিশ্চয়ই বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন; বাংলাসাহিত্যের জন্য তিনি অনেক রেখে গেলেন হয়তো। আমার জন্য কী রেখে গেলেন, বলো তো!’ [আলেখ্য : জীবনানন্দ’, ভূমেন্দ্র গুহ, পূ. ২৮] 

সমসাময়িককালে জীবনানন্দ বিষয়ে নিস্পৃহ ছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী জীবনানন্দের সমকালের কবি ছিলেন। জীবনানন্দের জীবৎকালে তাঁরা জীবনানন্দের নামই নেননি প্রায়। মৃত্যুর পরে ‘কবিতা’ পত্রিকায় জীবনানন্দ সংখ্যায় (১৩৬১) অমিয় চক্রবর্তীর একটি পত্রাংশ, ১৯৬৩-তে প্রকাশিত ‘একালের কবিতা’র ভূমিকায় সম্পাদক বিষ্ণু দে’র কয়েকটি পঙ্ক্তি এই মাত্র পাওয়া যায়। জীবনানন্দের জীবৎকালে কবি অরুণ মিত্র ‘অরণি’ পত্রিকার ১৯৪৬-এর ১৫ নভেম্বর সংখ্যায় প্রসঙ্গক্রমে সমকালের বিশিষ্ট কবি হিসেবে জীবনানন্দের নাম করেছিলেন একটি বাক্যে। 

আর্থিক সংকট, অসুস্থতা ও পানাসক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার প্রাণপণ সংগ্রাম চালিয়েও বারবার ব্যর্থ হন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। পরাজয়ের বেদনায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন তিনি। মৃগী রোগ ছাড়াও আমাশয় ও যকৃতের রোগ তাঁকে দুর্বল করে ফেলে। 

পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। পাকিস্তান-গণপরিষদ কর্তৃক বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা। পূর্বপাকিস্তান-সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক-মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষিত হয়। প্রদেশে গভর্নরের শাসন জারি হয়। চৌধুরী খালিকুজ্জামানের স্থলে ইস্কান্দার মির্জা গভর্নর নিযুক্ত হন। আদমজী জুটমিলে বাঙালি অবাঙালি দাঙ্গায় নিহত হয় ৬০০। 

 নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর মৃত্যু হয়। মারা গেলেন র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট মানবেন্দ্রনাথ রায়।

১৯৫৪-তে জন্মালের জয় গোস্বামী, নির্মল হালদার, মলয় সিংহ, স্নেহলতা চট্টোপাধ্যায়, কাঞ্চনকুন্তলা মুখোপাধ্যায়, উজ্জ্বল সিংহ। 

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯–১৯৬১)। ঔপন্যাসিক। আমেরিকান। 

তাঁকে পুরস্কার দেওয়ার পক্ষে নোবেল কমিটি লেখেন— 

‘For his powerful mastery of the art of story-telling most recently displayed in the ‘Old man and the Sea’ and for his influence on contemporary style.’ 

তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ—’The Old man and the Sea ‘, ‘ A Farewell to Arms’, ‘For whom the Bell Tolls’, ‘The Sun also Rises’. 

১৯৫৩-তে ‘পূৰ্ণকুম্ভ’ গ্রন্থের জন্য শ্রীমতি রাণী চন্দ ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পান। 

প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রকাশিত হয় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘প্রতিধ্বনি’ অনুবাদ গ্রন্থ। প্রকাশ পায় শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘জোনাকিরা’, অরুণ মিত্রের উৎসের দিকে’, দিনেশ দাসের ‘অহল্যা’, মনীন্দ্র রায়ের ‘অমিল থেকে মিলে’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘নীল নির্জন’. আনন্দ বাগচীর ‘তিনটি স্বগতসন্ধ্যা’, ক্ষিতিমোহন সেনের ‘বাংলার বাউল’, বুদ্ধদেব বসুর ‘সাহিত্যচর্চা’, সমর সেনের ‘সমর সেনের কবিতা’, সমরেশ বসুর ‘শ্রীমতী কাফে’, হরপ্রসাদ মিত্রের ‘তিমিরাভিসার, জরাসন্ধের ‘লৌহ কপাট’। প্রকাশিত হয় মানিকের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের চেক অনুবাদ। অনুবাদক : দুসান ঝাভিতেল 

সকল অধ্যায়

১. ১৮৯৯ – জন্ম
২. ১৯০০। বয়স ১ বছর
৩. ১৯০১। বয়স ২ বছর
৪. ১৯০২। বয়স ৩ বছর
৫. ১৯০৩। বয়স ৪ বছর
৬. ১৯০৪। বয়স ৫ বছর
৭. ১৯০৫। বয়স ৬ বছর
৮. ১৯০৬। বয়স ৭ বছর
৯. ১৯০৭। বয়স ৮ বছর
১০. ১৯০৮। বয়স ৯ বছর
১১. ১৯০৯। বয়স ১০ বছর
১২. ১৯১০। বয়স ১১ বছর
১৩. ১৯১১। বয়স ১২ বছর
১৪. ১৯১২। বয়স ১৩ বছর
১৫. ১৯১৩। বয়স ১৪ বছর
১৬. ১৯১৪। বয়স ১৫ বছর
১৭. ১৯১৫। বয়স ১৬ বছর
১৮. ১৯১৬। বয়স ১৭ বছর
১৯. ১৯১৭। বয়স ১৮ বছর
২০. ১৯১৮। বয়স ১৯ বছর
২১. ১৯১৯। বয়স ২০ বছর
২২. ১৯২০। বয়স ২১ বছর
২৩. ১৯২১। বয়স ২২ বছর
২৪. ১৯২২। বয়স ২৩ বছর
২৫. ১৯২৩। বয়স ২৪ বছর
২৬. ১৯২৪। বয়স ২৫ বছর
২৭. ১৯২৫। বয়স ২৬ বছর
২৮. ১৯২৬। বয়স ২৭ বছর
২৯. ১৯২৭। বয়স ২৮ বছর
৩০. ১৯২৮। বয়স ২৯ বছর
৩১. ১৯২৯। বয়স ৩০ বছর
৩২. ১৯৩০। বয়স ৩১ বছর
৩৩. ১৯৩১। বয়স ৩২ বছর
৩৪. ১৯৩২। বয়স ৩৩ বছর
৩৫. ১৯৩৩। বয়স ৩৪ বছর
৩৬. ১৯৩৪। বয়স ৩৫ বছর
৩৭. ১৯৩৫। বয়স ৩৬ বছর
৩৮. ১৯৩৬। বয়স ৩৭ বছর
৩৯. ১৯৩৭। বয়স ৩৮ বছর
৪০. ১৯৩৮। বয়স ৩৯ বছর
৪১. ১৯৩৯। বয়স ৪০ বছর
৪২. ১৯৪০। বয়স ৪১ বছর
৪৩. ১৯৪১। বয়স ৪২ বছর
৪৪. ১৯৪২। বয়স ৪৩ বছর
৪৫. ১৯৪৩। বয়স ৪৪ বছর
৪৬. ১৯৪৪। বয়স ৪৫ বছর
৪৭. ১৯৪৫। বয়স ৪৬ বছর
৪৮. ১৯৪৬। বয়স ৪৭ বছর
৪৯. ১৯৪৭। বয়স ৪৮ বছর
৫০. ১৯৪৮। বয়স ৪৯ বছর
৫১. ১৯৪৯। বয়স ৫০ বছর
৫২. ১৯৫০। বয়স ৫১ বছর
৫৩. ১৯৫১। বয়স ৫২ বছর
৫৪. ১৯৫২। বয়স ৫৩ বছর
৫৫. ১৯৫৩। বয়স ৫৪ বছর
৫৬. ১৯৫৪। বয়স ৫৫ বছর
৫৭. জীবনানন্দ দাশ বিষয়ক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন