১৯০৮। বয়স ৯ বছর

হরিশংকর জলদাস

১৯০৮। বয়স ৯ বছর 

জানুয়ারি মাসে বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হল জীবনানন্দকে। বাবা এই স্কুলেরই শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক। কম বয়সে বিদ্যালয়ে ভর্তির বিরোধী ছিলেন সত্যানন্দ। তাই স্কুলে ভর্তি হতে এত দেরি হল জীবনানন্দের। কড়া অনুশাসন, প্রহার—এসবের ঘোর বিরোধী ছিলেন সত্যানন্দ। তিনি বিশ্বাস করতেন—শৈশবটা হল খেলবার, বাগানে বেড়াবার, প্রজাপতির পেছনে দৌড়াবার আর ঘুড়ি উড়াবার জন্যে। মায়ের কাছে বাল্যশিক্ষা গ্রহণ। সংসারের কাজ-কর্মের ফাঁকে ফাঁকে কুসুমকুমারী নিজ সন্তানদের শিক্ষার বুনিয়াদ গড়ে দিয়েছিলেন। জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দ দাশ ‘জীবনানন্দ স্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন— 

‘দাদা আমার চেয়ে পুরো তিন বছরেরও বড়ো নন। শৈশবে ও কৈশোরে অনেক সময়েই আমি তাঁর সাথী ছিলাম। আমাদের শৈশব অত্যন্ত আনন্দে কেটেছে। বাবা কম বয়সে ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করার বিরোধী ছিলেন। ছেলেবেলায় আমরা মায়ের কাছে লেখাপড়া শিখেছি। সে পাঠ খুব বেশিক্ষণের জন্য নয়। খেলবার, বাগানে বেড়াবার, প্রজাপতির পেছনে দৌড়াবার, ঘুড়ি ওড়াবার প্রচুর অবকাশ ছিল।’ 

মা-বাবা এবং বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জগদীশ মুখোপাধ্যায়—এই তিনজন জীবনানন্দের জীবনে শিক্ষার ভিত্তি গড়েছিলেন। পিতার উপনিষদ-পাঠ ও মাতার গানের সুরে বালক জীবনানন্দের ভোরের ঘুম ভাঙতো। অলি মামুদ, ফকির, মোতির মা, মোতিলাল, শুকলাল প্রমুখ পরিচারক-পরিচারিকার কাছে নানারকম কাহিনি ও ছড়া শুনতেন জীবনানন্দ। লাজুক স্বভাব তাঁর, কিন্তু খেলাধুলোয় নিমগ্ন, ভালো সাঁতারও কাটতে জানতেন। 

বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষক ছিলেন রাখাল চট্টোপাধ্যায়, সত্যানন্দ দাশ, হরিচরণ, কালীশ বিদ্যাবিনোদ, ভুবন ঘোষ, তারিণী সেন প্রমুখ। 

ঘরে জীবনানন্দের জীবন গড়ার কারিগর ছিলেন তাঁর মা-বাবা আর স্কুলে ছিলেন প্রধান শিক্ষক জগদীশ মুখোপাধ্যায়। এঁদের সম্পর্কে জীবনানন্দ ‘আমার মা বাবা’ নামের লেখাটিতে লিখেছেন যে, পরবর্তীকালে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে তিনি অনেক বড় বড় অধ্যাপকের কাছে পড়বার সুযোগ পেয়েছেন। 

তাঁদের পড়ানো জীবনানন্দকে ডিগ্রি পেতে সহায়তা করেছে মাত্র, ভেতরের এষণাকে জাগায়নি। জীবনানন্দ উক্ত প্রবন্ধে লিখেছেন— 

‘সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি সম্পর্কে অনেক খবর জুগিয়েছেন তাঁরা (অধ্যাপকরা), কিন্তু বোধীর অভাবে সে খবর পরীক্ষার খাতায় পর্যবসিত হয়ে ডিগ্রি দান করে অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে। জীবনের যা কিছু কাণ্ডজ্ঞান, মর্মজ্ঞান, রসাস্বাদ, যা কিছু লোকসমাজে এষণাশক্তি বা নির্জনে ভাবনা প্রতিষ্ঠা, যা কিছু মাদার-উইট, যা কিছু সংবাদকে বিদ্যায় পরিণত করতে পারে বিদ্যাকে জ্ঞানে—সমস্ত জিনিসেরই অন্তর্দীপন ও বিবিধ নিয়ম এঁদের (মা-বাবা আর জগদীশ মুখোপাধ্যায়) কাছ থেকেই লাভ করবার সুযোগ হয়েছিল আমার।’ ( পৃষ্ঠা : ১০) 

জীবনানন্দ সংস্কৃত পড়তেন শিক্ষক কালীশবাবুর বড়ভাই কামিনী বিদ্যাবিনোদের কাছে। শিক্ষক কামিনীবাবু ক্লাসে সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন। 

রবীন্দ্রনাথের বয়স ৪৭। পাবনায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মিলনে সভাপতিত্ব করেন কবি। কবিবন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের আকস্মিক মৃত্যু হয়। মধ্যম-জামাতা সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য হঠাৎ মারা যান। ক্ষিতিমোহন সেন বিশ্বভারতীতে যোগ দিলেন। রজনীকান্ত সেনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। 

মজঃফরপুরে বোমা বিস্ফোরণে দুই শ্বেতাঙ্গ মহিলা নিহত হয়। আততায়ী প্রফুল্ল চাকী আত্মঘাতী হন। তাঁর ধড় থেকে মুণ্ড বিচ্ছিন্ন করে স্পিরিটে ডুবিয়ে রাখে পুলিশ। ১৮ বছর বয়সে ক্ষুদিরাম বসু ধরা পড়লেন এবং ১১ আগস্ট তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বোমা বিস্ফোরণ ও হত্যার সমর্থনের অপরাধে তিলকের ৬ বছর কারাদণ্ড হয়। কলকাতার মানিকতলায় বোমা কারখানা আবিষ্কৃত হয়। অরবিন্দ, বারীন্দ্র ঘোষসহ ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ‘বন্দে মাতরম্’, ‘সন্ধ্যা’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়। 

হিন্দু-মুসলমান সমস্যা স্পষ্টতর হচ্ছে। গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দিচ্ছে। ইংরেজ সরকার কর্তৃক আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের। 

সংবাদপত্র আইন প্রণীত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলাসাহিত্য আবশ্যিক-পাঠ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়। 

এ বছর জন্মালেন বুদ্ধদেব বসু (কুমিল্লা। পিতা : ভুবনচন্দ্র বসু ও মাতা বিনয়কুমারী), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী কাদের নেওয়াজ, শামসুন নাহার মাহমুদ। 

১৯০৮-এ পরলোক গমন করেন কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় [মাইকেল মধুসূদন দত্ত যাঁকে ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’ (১৮৬১) উৎসর্গ করেন] ও ক্ষুদিরাম বসু। ২০ মার্চ (৭ চৈত্র ১৩১৪ বঙ্গাব্দ) কাজী নজরুল ইসলামের পিতা কাজী ফকির আহমদের মৃত্যু হয়। 

এ বছর সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান রুডলফ্ অয়কেন (১৮৪৬–১৯২৬)। জার্মান দার্শনিক। 

তাঁর সম্পর্কে নোবেল কমিটির মন্তব্য ছিল 

‘In recognition of his earnest search for truth, his penetrating power of truth, his wide range of vision, and the warmth and strenght of presentation with … in his numerous work he has vindicated and developed an idealistic philosophy of life.’ 

তাঁর বিখ্যাত রচনা হল – ‘ Main Currents of Modern Thought’, ‘The Truth of Religion’, ‘The Meaning and Value of Life’ ইত্যাদি 

প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : রবীন্দ্রনাথের ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’, ‘প্রহসন’, ‘রাজা প্রজা’, ‘সমূহ’, ‘স্বদেশ’, ‘সমাজ’, ‘শারদোৎসব’, ‘মুকুট’, ‘কথা ও কাহিনী’, নবীনচন্দ্র সেনের ‘আমার জীবন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘তীর্থ সলিল’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সীতা’ ও ‘মেবার পতন, বেগম রোকেয়ার ‘Sultana’s Dream’ প্রকাশিত হল। 

প্রকাশ পেল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মডার্ন রিভিউ’ 

সকল অধ্যায়

১. ১৮৯৯ – জন্ম
২. ১৯০০। বয়স ১ বছর
৩. ১৯০১। বয়স ২ বছর
৪. ১৯০২। বয়স ৩ বছর
৫. ১৯০৩। বয়স ৪ বছর
৬. ১৯০৪। বয়স ৫ বছর
৭. ১৯০৫। বয়স ৬ বছর
৮. ১৯০৬। বয়স ৭ বছর
৯. ১৯০৭। বয়স ৮ বছর
১০. ১৯০৮। বয়স ৯ বছর
১১. ১৯০৯। বয়স ১০ বছর
১২. ১৯১০। বয়স ১১ বছর
১৩. ১৯১১। বয়স ১২ বছর
১৪. ১৯১২। বয়স ১৩ বছর
১৫. ১৯১৩। বয়স ১৪ বছর
১৬. ১৯১৪। বয়স ১৫ বছর
১৭. ১৯১৫। বয়স ১৬ বছর
১৮. ১৯১৬। বয়স ১৭ বছর
১৯. ১৯১৭। বয়স ১৮ বছর
২০. ১৯১৮। বয়স ১৯ বছর
২১. ১৯১৯। বয়স ২০ বছর
২২. ১৯২০। বয়স ২১ বছর
২৩. ১৯২১। বয়স ২২ বছর
২৪. ১৯২২। বয়স ২৩ বছর
২৫. ১৯২৩। বয়স ২৪ বছর
২৬. ১৯২৪। বয়স ২৫ বছর
২৭. ১৯২৫। বয়স ২৬ বছর
২৮. ১৯২৬। বয়স ২৭ বছর
২৯. ১৯২৭। বয়স ২৮ বছর
৩০. ১৯২৮। বয়স ২৯ বছর
৩১. ১৯২৯। বয়স ৩০ বছর
৩২. ১৯৩০। বয়স ৩১ বছর
৩৩. ১৯৩১। বয়স ৩২ বছর
৩৪. ১৯৩২। বয়স ৩৩ বছর
৩৫. ১৯৩৩। বয়স ৩৪ বছর
৩৬. ১৯৩৪। বয়স ৩৫ বছর
৩৭. ১৯৩৫। বয়স ৩৬ বছর
৩৮. ১৯৩৬। বয়স ৩৭ বছর
৩৯. ১৯৩৭। বয়স ৩৮ বছর
৪০. ১৯৩৮। বয়স ৩৯ বছর
৪১. ১৯৩৯। বয়স ৪০ বছর
৪২. ১৯৪০। বয়স ৪১ বছর
৪৩. ১৯৪১। বয়স ৪২ বছর
৪৪. ১৯৪২। বয়স ৪৩ বছর
৪৫. ১৯৪৩। বয়স ৪৪ বছর
৪৬. ১৯৪৪। বয়স ৪৫ বছর
৪৭. ১৯৪৫। বয়স ৪৬ বছর
৪৮. ১৯৪৬। বয়স ৪৭ বছর
৪৯. ১৯৪৭। বয়স ৪৮ বছর
৫০. ১৯৪৮। বয়স ৪৯ বছর
৫১. ১৯৪৯। বয়স ৫০ বছর
৫২. ১৯৫০। বয়স ৫১ বছর
৫৩. ১৯৫১। বয়স ৫২ বছর
৫৪. ১৯৫২। বয়স ৫৩ বছর
৫৫. ১৯৫৩। বয়স ৫৪ বছর
৫৬. ১৯৫৪। বয়স ৫৫ বছর
৫৭. জীবনানন্দ দাশ বিষয়ক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন