১৯২৫। বয়স ২৬ বছর

হরিশংকর জলদাস

১৯২৫। বয়স ২৬ বছর 

১৬ জুন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) মৃত্যু হয়। এ সময় জীবনানন্দ ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ নামক কবিতাটি লেখেন। প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার ‘চিত্তঞ্জন দাশ সংখ্যায় [শ্রাবণ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ]। ‘বঙ্গবাণী’র সম্পাদক ছিলেন বিজয়চন্দ্র মজুমদার (১৮৬১-১৯৪২)। কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাস রায় (১৮৮৯-১৯৭৫) বলেছিলেন— 

‘এই কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছে প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রবীণ কবি ছদ্মনামে কবিতাটি লিখেছেন।’ 

শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীও (১৮৬৯–১৯৩২) কবিতাটি পড়ে সপ্রশংস মন্তব্য করেছিলেন তাঁর সম্পাদিত ‘দি সার্ভেন্ট’ নামক দৈনিক পত্রিকায়। এই ‘চিত্তরঞ্জন দাশ সংখ্যা’তেই পূর্বজ খ্যাতিমান কবিদের মধ্যে লিখেছিলেন কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। 

কিন্তু কবিতাটি প্রকাশের ব্যাপারে জীবনানন্দ-মাতা কুসুমকুমারী ক্ষুব্ধ হন। তিনি জীবনানন্দকে রাজা রামমোহন রায় এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে কবিতা লিখতে চিঠি দিলেন। চিঠিতে কুসুমকুমারী লিখেছিলেন, ‘চিত্তরঞ্জন সম্বন্ধে লিখেছ, ভালই করেছ, কিন্তু রামমোহনের ওপর লিখতে বলেছি তোমাকে, মহর্ষির ওপরেও।’ [আমার মা-বাবা, জীবনানন্দ দাশ, পৃ. ১৩] জীবনানন্দ তাঁর মা সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। কিন্তু মায়ের চিঠি সত্ত্বেও ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় বা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ে কোনও কবিতা জীবনানন্দ লেখেননি। কিন্তু বিবেকানন্দ বিষয়ে কবিতা লিখলেন। মায়ের চিঠির মাস তিনেক পরে ‘বঙ্গবাণী’তে ‘বিবেকানন্দ’ নামে জীবনানন্দের একটি কবিতা প্রকাশিত হল। 

‘কল্লোল’-এর তৃতীয় বর্ষ একাদশ সংখ্যায় (ফাল্গুন ১৩৩২ বঙ্গাব্দ) জীবনানন্দের ‘নীলিমা’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবির নাম প্রিন্টিং-এ ভুল হয়, লেখা ছিল ‘জীবনান্দ দাশগুপ্ত’। কবিতাটি অনেক তরুণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সে সময়ের তরুণতম কবি ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬)। তিনি জীবনানন্দের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতিচারণ 

করেছেন এভাবে – 

‘এক টুকরো নীলিমার মতো একটি কবিতা উড়ে এসে পড়ল ‘কল্লোলে’। লেখক শ্রীজীবনানন্দ দাশগুপ্ত। ঠিকানা? এক ডাকেরও পথ নয়। মাঝখানে বৈধতার চৌকাঠকে অটুট রেখে হৃদয়ের কারবার করতে হবে, ‘কল্লোলে’র সে মন্ত্র ছিল না। বিনা সই সুপারিশে সটান হাজির হলাম তাঁর মেসে। দরজায় ধাক্কা দেবার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ের কপাটও খুলে গেল। শুধু খুলে গেল বললে পুরো বলা হবে না। খোলার মধ্যে আবার বন্ধ হবার সঙ্কেত আছে।’ [‘অন্তরঙ্গ জীবনানন্দ’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত]। 

প্রকৃতপক্ষে জীবনানন্দ ও অচিন্ত্যকুমারের মধ্যে প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হয়েছিল আরও দেরিতে। ‘কল্লোল’ পত্রিকার দ্বাদশ সংখ্যায় (চৈত্র ১৩৩২) সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘কল্লোলের তৃ তীয় বৎসরে আমরা কয়েকটি লেখককে বিশেষ করে পেয়েছি। তাঁদের প্রতিভা জয়যুক্ত হউক এই কামনা করি।’ 

এই ‘কয়েকটি লেখকের মধ্যে ছিলেন জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), অজিতকুমার দত্ত (১৯০৭-১৯৭৯), জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। এই পত্রিকার সঙ্গে জসীম উদ্দীন যুক্ত হয়েছিলেন তৃতীয় সংখ্যায়, বুদ্ধদেব ও অজিতকুমার অষ্টম সংখ্যায়। 

জীবনানন্দের প্রথম গদ্যরচনা ‘স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে’ প্রকাশিত হল ‘ব্রহ্মবাদী পত্রিকায়। পরপর তিনটি সংখ্যায় (পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন-চৈত্র ১৩৩২ বঙ্গাব্দ)। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল এটি। নিবন্ধটি সাধুভাষায় লিখিত। উল্লেখ্য, কালীমোহন দাশ জীবনানন্দ দাশের মাতামহ চন্দ্রনাথ দাশের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। ১৯২৫ সালের ১ অক্টোবর লক্ষ্মীপূজার সন্ধ্যায় হঠাৎ হৃদ্যন্ত্র বিকল হয়ে কালীমোহন দাশ পরলোক গমন করেন। তাঁরই স্মরণে লিখিত ‘স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে’ নামের লেখাটি এ পর্যন্ত প্রাপ্ত জীবনানন্দের আদিতম গদ্য। 

জীবনানন্দ দাশ বোধ হয় ইংরেজি কবিতা লিখেই কবিতা—জীবন শুরু করেছিলেন। ১৯২৫-এ লেখা ইংরেজি কবিতার একটি পুরো খাতা ইদানীং পাওয়া গেছে। 

‘বঙ্গবাণী’ ও ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত জীবনানন্দের কবিতাগুলো অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এঁদের মধ্যে মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) একজন। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং-এ গিয়ে জীবনানন্দের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। পরবর্তীকালে উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। অশোকানন্দ লিখেছেন— 

‘অনেক শীতের সন্ধ্যায় মোহিতবাবু কালো কোট পরে গলায় কমফর্টার জড়িয়ে এসে আসন গ্রহণ করতেন। বহুক্ষণ ধরে কবিতা নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা চলতো।’ [‘আমার দাদা জীবনানন্দ’, গার্লস কলেজ পত্রিকা, হাওড়া, ১৯৫৫, পৃ.৪ 

রবীন্দ্রনাথের বয়স ৬৪। ২১ জানুয়ারি ইতালির উদ্দেশে আর্জেন্টিনা ত্যাগ করলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮ দিন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছালেন; ভারতে ফিরলেন ১৭ ফেব্রুয়ারি। মি. গান্ধী শান্তিনিকেতনে এলেন। 

দেশব্যাপী ‘চরকা-আন্দোলন’ জোরদার হচ্ছে। এই আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের সমর্থন নেই। ফলে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ খদ্দরনীতি বা খিলাফৎ আন্দোলন কোনোটিকেই সমর্থন করলেন না। 

জোসেফ তুচ্চি ইতালি থেকে শান্তি নিকেতনে পড়াতে এলেন। 

১৬ জুন দার্জিলিং-এ চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু হলে নজরুল হুগলিতে বসে ‘অর্ঘ্য’, ‘ইন্দ্ৰপতন’, ‘অকাল সন্ধ্যা’, ‘সান্ত্বনা’ ইত্যাদি কবিতা রচনা করেন। এ বছর ‘চিত্তনামা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। নজরুল গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে। এ সময় কাব্যগ্রন্থ ‘ছায়ানট’, ‘পুবের হাওয়া’, ‘সাম্যবাদী’ প্রকাশিত হয়। 

প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাস করেন বুদ্ধদেব বসু। 

লোকার্নো চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। চীনের রাষ্ট্রনায়ক সানইয়েৎ সেনের মৃত্যু হয়। মি. জন লোগি বেয়ার্ড নামক একজন ইংরেজ বৈজ্ঞানিক ‘টেলিভিশন’ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। 

এ বছর জন্মেছেন অরুণ ভট্টাচার্য, কেদার ভাদুড়ী, রশীদ করীম, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, শাহেদ আলী, মুনীর চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক। 

মৃত্যুবরণ করেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। 

এ বছর সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান জর্জ বার্নার্ড শ’ (১৮৫৬–১৯৫০)। নাট্যকার। ইংল্যান্ডের অধিবাসী। 

তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি লেখেন— ‘For his work which is marked by both idealism and humanity, its stimulating satire often being infused with a singular poetic beauty.’ 

জর্জ বার্নার্ড শ’র বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য—’ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’, ‘সেন্ট জোন’, ‘আরমস্ অ্যান্ড দ্য ম্যান’, ‘উইডোয়ারস্ হাউস’, ‘দ্য ডেবিলস্ ডিসাইপল’ ইত্যাদি। 

প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’, ‘গৃহ প্রবেশ’, ‘প্রবাহিনী’, ‘সংকলন’ ও ‘গীতিচর্চা’ প্রকাশিত হয়। ইংরেজিতে প্রকাশ পায় টক্স ইন চায়না’, ‘পোয়েম্স’ (অনুবাদক : টমসন), ‘রেড ও লিয়ান্ডার্স’, ‘ব্রোকেন টাইজ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’। বের হয় গোকুল নাগের ‘পথিক’, নজরুলের ‘সাম্যবাদী’, ‘পুবের হাওয়া’, ‘চিত্তনামা’, ‘রিক্তেন বেদন’, স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘মিলনরাত্রি’। প্রকাশ পায় সমারসেট মম-এর ‘পেইন্টড ভেইল’, হ্যারল্ড ল্যাস্কির ‘এ গ্রামার অব পলিটিক্স’, কাফ্ফার ‘দি ট্রায়াল’। 

‘লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। 

শচীন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ‘শেষস্মৃতি’ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত হয়। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘আবাহন’ নামের গানের বই নিষিদ্ধ হয়। 

সকল অধ্যায়

১. ১৮৯৯ – জন্ম
২. ১৯০০। বয়স ১ বছর
৩. ১৯০১। বয়স ২ বছর
৪. ১৯০২। বয়স ৩ বছর
৫. ১৯০৩। বয়স ৪ বছর
৬. ১৯০৪। বয়স ৫ বছর
৭. ১৯০৫। বয়স ৬ বছর
৮. ১৯০৬। বয়স ৭ বছর
৯. ১৯০৭। বয়স ৮ বছর
১০. ১৯০৮। বয়স ৯ বছর
১১. ১৯০৯। বয়স ১০ বছর
১২. ১৯১০। বয়স ১১ বছর
১৩. ১৯১১। বয়স ১২ বছর
১৪. ১৯১২। বয়স ১৩ বছর
১৫. ১৯১৩। বয়স ১৪ বছর
১৬. ১৯১৪। বয়স ১৫ বছর
১৭. ১৯১৫। বয়স ১৬ বছর
১৮. ১৯১৬। বয়স ১৭ বছর
১৯. ১৯১৭। বয়স ১৮ বছর
২০. ১৯১৮। বয়স ১৯ বছর
২১. ১৯১৯। বয়স ২০ বছর
২২. ১৯২০। বয়স ২১ বছর
২৩. ১৯২১। বয়স ২২ বছর
২৪. ১৯২২। বয়স ২৩ বছর
২৫. ১৯২৩। বয়স ২৪ বছর
২৬. ১৯২৪। বয়স ২৫ বছর
২৭. ১৯২৫। বয়স ২৬ বছর
২৮. ১৯২৬। বয়স ২৭ বছর
২৯. ১৯২৭। বয়স ২৮ বছর
৩০. ১৯২৮। বয়স ২৯ বছর
৩১. ১৯২৯। বয়স ৩০ বছর
৩২. ১৯৩০। বয়স ৩১ বছর
৩৩. ১৯৩১। বয়স ৩২ বছর
৩৪. ১৯৩২। বয়স ৩৩ বছর
৩৫. ১৯৩৩। বয়স ৩৪ বছর
৩৬. ১৯৩৪। বয়স ৩৫ বছর
৩৭. ১৯৩৫। বয়স ৩৬ বছর
৩৮. ১৯৩৬। বয়স ৩৭ বছর
৩৯. ১৯৩৭। বয়স ৩৮ বছর
৪০. ১৯৩৮। বয়স ৩৯ বছর
৪১. ১৯৩৯। বয়স ৪০ বছর
৪২. ১৯৪০। বয়স ৪১ বছর
৪৩. ১৯৪১। বয়স ৪২ বছর
৪৪. ১৯৪২। বয়স ৪৩ বছর
৪৫. ১৯৪৩। বয়স ৪৪ বছর
৪৬. ১৯৪৪। বয়স ৪৫ বছর
৪৭. ১৯৪৫। বয়স ৪৬ বছর
৪৮. ১৯৪৬। বয়স ৪৭ বছর
৪৯. ১৯৪৭। বয়স ৪৮ বছর
৫০. ১৯৪৮। বয়স ৪৯ বছর
৫১. ১৯৪৯। বয়স ৫০ বছর
৫২. ১৯৫০। বয়স ৫১ বছর
৫৩. ১৯৫১। বয়স ৫২ বছর
৫৪. ১৯৫২। বয়স ৫৩ বছর
৫৫. ১৯৫৩। বয়স ৫৪ বছর
৫৬. ১৯৫৪। বয়স ৫৫ বছর
৫৭. জীবনানন্দ দাশ বিষয়ক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন