ভূত যে সব সময় মানুষের ক্ষতিই করে, তা কিন্তু নয়। অনেক সময় ভূত মানুষের অনেক রকম উপকারও করে। ব্যাপারটা খুব অবাক শোনাচ্ছে। তাই না? তাহলে আসল ঘটনা খুলেই বলি, এবার।
এ গল্পটা অর্থাৎ সৎ ভূতের এই অদ্ভুত গল্পটা শুনেছিলাম পরাণ মাঝির মুখ থেকে। পরাণ মাঝি সুন্দরবন থেকে হলদিয়ার মধ্যে নৌকা চালাতো।
সেবার মাঝির সঙ্গে সাহায্যকারী ছিলো হৃদয় নামে এক অল্পবয়সী উৎসাহী তরুণ। তারা তখন যাচ্ছে সুন্দরবন থেকে। মাঝ-নদী বরাবর নৌকো এসে পড়েছিল।
এমন সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।
হৃদয় আর মাঝি নৌকোর ছাউনিতে বসে কাজ করছিলো। কয়েক দিন ধরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় তাদের গতিপথের কিছু একটা নিশ্চয়ই গণ্ডগোল হয়েছে। ঠিক কোন্ জায়গায় তারা এখন আছে তার নির্ভুল হিসেবের কিছুতেই মিল হচ্ছিলো না। হৃদয় এতই বিব্রত হয়ে পড়েছিলো যে, লক্ষ্যই করেনি কখন মাঝি তার ছাউনি থেকে বেরিয়ে গেছে।
সে হঠাৎ বলে উঠলো –ভাইজান, আমরা ঠিক পথেই চলেছি।
কোনো উত্তর না পেয়ে ফিরে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল – মাঝি তার জায়গায় বসে নেই, সেখানে অন্য কে যেন অপরিচিত একটা লোক বসে বসে কিসব যেন করছে। তার পরনে কালো পোশাক।
প্রায় আঁৎকে উঠে হৃদয় বললো —আরে, কে আপনি? এখানে কি করছেন?
লোকটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, হৃদয়ের মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো; তারপর —তারপর নৌকোর ছাউনির আরও ভেতরের দিকে নীরবে চলে গেল।
হৃদয় দৌড়োতে দৌড়োতে ছাউনির বাইরে মাঝির কাছে গিয়ে চিৎকার করে বললো –ভাইজান, ছাউনিতে বসেছিলো ও লোকটা কে?
মাঝি বিরক্ত হয়ে বললো – এমন হৈ চৈ করছো কেন? মাঝ নদীতে -নৌকো, বাইরের লোক কোত্থেকে আসবে? নিশ্চিত তুমি ভুল কিছু দেখেছো।
হৃদয় বললো –আপনি কতক্ষণ উঠে এসেছেন ভাইজান?
মাঝি বললো – তা মিনিট দশেক হবে।
—তাহলে ঐ লোকটাই এতোক্ষণ বসে বসে ছাউনির ভেতর কি করছিলো?
—কি করছিলো, সেটা দেখে এলেই তো পারতে। মাঝি ব্যস্ত হয়ে এলো, দেখলো সত্যিই ছাউনির ভেতর একটা প্লেটের ওপর পাকা হতের লেখা -নৌকো ভুল পথে চালাচ্ছেন।
কটমট করে হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে মাঝি বললো —আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে তোমার লজ্জা করে না। কই তোমার লোক?
হৃদয় আর কি করে, বোকার মতো এদিক-ওদিক দেখতে লাগলো। কিন্তু কোথাও তো কেউ নেই। মনে মনে ভাবতে লাগলো – তবে যে আমি নিজের চোখে দেখে গেলাম, কি যেন করছিলো বসে – সে কোথায় গেল? – মাঝি ভাবলো হৃদয় বোধ হয় চালাকি করার জন্যে নিজের হাতে শ্রেটের ওপর লিখে তার সঙ্গে মজা করছে। হৃদয়কে ধমক দিয়ে বললো এই প্লেটের উল্টোপিঠে এই কথাটা লেখো তো।
হৃদয় অবাক স্বরে মাঝিকে বললো ভাইজান, আমি যে একদম লেখাপড়া জানি না তা তো আপনি জানেনই, তবে শুধু শুধু আমাকে সন্দেহ করে লিখতে বলছেন কেন? আসলে ভুলটা আমারই হয়েছে এই বলে সে কেঁদে ফেললো।
মাঝি তো তার কথাকে বিশ্বাসই করলো না! সে হৃদয়কে বললো যত্তোসব ভাওতাবাজি। হৃদয়কে চুলের মুঠি ধরে মারতে শুরু করে দিলো। হৃদয়ের মুখের স্বীকারোক্তি শুনতে না পেয়ে রাগ প্রচণ্ড বেড়ে গেল তার। সে একটা ধারালো ছুরি বার করে তাকে খুন করে ফেলবার হুমকি দিলো।
কিন্তু সে হৃদয়ের মুখের স্বীকারোক্তি পেলো না। তখন মাঝি নিজের মনেই গজগজ করতে করতে নিজের কাজে চলে গেল।
এদিকে নৌকো এগিয়েই চলেছে। ঠিক পথে চলছে না ভুল পথে চলছে তা কে জানে।
এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এলো। একসময় নৌকে এসে ভিড়লো একটা ছোট পাহাড়ের কোলে। জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়টি। নানারকমের আতঙ্ক সূচক আওয়াজ কানে আসছে সেই পাহাড়ের গহ্বর থেকে।
মাঝির এবার খুবই ভয় করতে লাগলো। হৃদয়ের ওপর তার যে রাগ ছিলো, তা ভুলে তাকে জিজ্ঞেস করলো হ্যাঁরে হৃদয়, এ কোথায় এলাম রে ভাই?
হৃদয়ের মনে কোনো রাগ নেই। সে সহজ মনেই বললো, ভাইজান, আপনাকে আমি প্রথমেই বলেছিলাম, শুনলেন না তো।
ঠিক এই সময়েই সারা আকাশ কালো মেঘে ভরে গেল। এমন গাঢ় কালো হয়ে গেল যে নৌকোতেই মাঝি হৃদয়কে বা হৃদয় মাঝিবে পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলো না। দুজনেই দুজনকে ডাকছে কিন্তু কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু অন্ধকারের জন্যে কেউ এক পা এগোতে সাহস পাচ্ছে না। হঠাৎ যেন তারা বুঝতে পারলো, জলের থেকে নৌকোটা ওপর দিকে শূন্যে উঠছে। তারা ভয়ে অবাক হয়ে গেল। চোখ বুজে রইলো তারা। ভয়েতে হৃদয় আল্লাকে মনে মনে ডাকতে লাগলো।
নৌকোটা ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে আবার জলের ওপরে নেমে এলো। একজন কালো কুচকুচে লোক জল থেকে উঠে এলো। তার মুলোর মতো দাঁত। আর শনের মতো চুল। বিশাল দেহ।
ভয়ে জড়সড় হয়ে দুহাত জোড় করে বসলো হৃদয় আর মাঝি। বিরাট আকারের কালো লোকটা তাদের বললো –তোদের নিষেধ করা সত্ত্বেও তোরা এদিকে এলি কেন? আমি মানুষের ছদ্মবেশ নিয়ে প্লেটে লিখে দিলাম কোন্ দিকে নৌকো চালাতে হবে। কেন শুনলি না? এটা হলো ভূতের রাজ্য। এই পাহাড়ের নাম ভূতের পাহাড়। এখানে কোনো মানুষ আসে না।
মাঝি হাত জোড় করেই বললো – আমাদের ক্ষমা করে দিন। সব দোষই আমার। ভুল হয়ে গেছে প্রভু।
ভূতটা তখন বললো –ঠিক আছে, আমি তোদের কোনো ক্ষতি করবো না, আর কাউকে তোদের কোনো ক্ষতি করতে দেবো না। কারণ আজ থেকে আট বছর আগে তুই আমায় জল থেকে তুলে আমায় বাঁচিয়েছিলি। তাই আমি কৃতজ্ঞতাবশতঃ তোকে ছেড়ে দিচ্ছি। যা এখান থেকে পালা। নৌকোয় পাল লাগা। আমি এখান থেকে ফুঁ দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি ওপারে পৌঁছে যাবি।
মাঝি ও হৃদয় নৌকায় পাল লাগালো। আর মুহূর্তের মধ্যেই তাদের গন্তব্যস্থানে হাজির হলো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন