সহযাত্রী ভূত – সমুদ্র পাল

ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায় একাই আমি সেদিনের যাত্রী ছিলাম। এ কামরায় যে কজন যাত্রী ছিলেন তারা সকলেই দু’চারটে স্টেশন আগেই নেমে গেছে। কেউ দুর্গাপুরে, কেউ আসানসোলে। বাইরে গাঢ় অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। গাছপালা, নদী নালার ওপরে কে যেন কালির ছোপ বুলিয়ে দিয়েছে। পৌষের রাত, কনকনে ঠাণ্ডায় হাতে-পায়ে যেন খিল ধরে যাচ্ছে। জানলার কাচটা তুলে দিয়ে পুরু কম্বলে সর্বাঙ্গ ঢেকে স্টল থেকে সদ্য-কেনা একখানা ইংরাজী নভেল পড়ছিলাম মন দিয়ে।

হঠাৎ গাড়ীর গতি মন্দীভূত হয়ে এলো। গাড়ী একটা স্টেশনে এসে থামলো। বাইরে থেকে কুলিদের চিৎকার কানে ভেসে এলো – “বরাকর বরাকর।” বইখানা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো, ঘুমও জড়িয়ে আসছিলো চোখে। ভাবলাম, বেঞ্চির ওপর বিছানাটা ছড়িয়ে একটু তন্দ্রাসুখ উপভোগ করি। সরকারী চাকরি করি, ধানবাদে চলেছি অফিসের কাজে। আরও ঘণ্টা খানেকের মতো লাগবে ধানবাদে পৌঁছোতে। মিনিট পাঁচেক পরে গার্ডের হুইসল শুনতে পেলাম, গাড়ি ছেড়ে দিলো। গাড়িটা সবে চলতে শুরু করেছে এমনি সময়ে ভয়ঙ্কর একটা চিৎকারে জায়গাটা মুখরিত হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে কামরার দরোজায় প্রচণ্ড একটা ধাক্কা মেরে কে একজন হঠাৎ আমার কামরার ভেতরে ঢুকে পড়লো। লোকটা বোধকরি তাল সামলাতে পারে নি, হুমড়ি খেয়ে পড়লো আমার পায়ের কাছেই।

লোকটা আচমকা হুড়মুড় করে কামরার মধ্যে ঢুকে পড়ায় প্রথমটা ঘাবড়ে গেছিলাম আমি। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। মেঝের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে লোকটা মুমূর্ষু রোগীর মতো হাঁফাচ্ছিলো। শরীরটা তার থর থর করে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। ভয়ে শিউরে উঠলাম আমি। লোকটা কোনো সাংঘাতিক অসুখে ভুগছে না তো? হয়তো এখনই আমার চোখের সামনে এমন একটা কিছু ঘটে যেতে পারে যা প্রতিরোধ করার শক্তি আমার নেই।

না, ভয়ের কোনো কারণ নেই। লোকটা এখনও স্থির হয়ে শুয়ে রয়েছে। যন্ত্রণার কোনো লক্ষণ নেই, সহজভাবে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস পড়ছে। একটু ইতস্ততঃ করে গলাটা একটু চড়িয়ে বললাম, “কি হে বাপু,একটু সুস্থ হয়েছো তো? যাও, এবার ওধারে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ো।”

আশ্চর্য! আমার কথা শেষ হতে না হতেই লোকটা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ওধারের একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়লো। কামরার দরোজাটা যে খোলা রয়েছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করলো না। মনে মনে বিরক্ত হয়ে আমি উঠে গিয়ে দরোজাটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর ফিরে এসে বেঞ্চিতে বসে রইলাম চুপটি করে। ঘুমোতে ইচ্ছে করলো না। আকস্মিক উত্তেজনায় আমার তখন তন্দ্রার ঘোরটা কেটে গেছে। বেশ কয়েকটা মিনিট এভাবে কেটে গেল। আমার অজান্তে আমার চোখ দু’টো ওধারের বেঞ্চিতে বসা লোকটার চারপাশে ঘোরাফেরা করছিলো।

লোকাটাকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো। গোঁফ-দাড়ির জঙ্গলে ভরা ঐ প্রকাণ্ড মুখ, জ্বল-জ্বলে চোখ, চ্যাপ্টা নাক, ডান ভুরুর ওপরে একটা কাটা দাগ, গায়ে ঢিলে হাতা পাঞ্জাবি… ওকে যে এর আগে কোথাও দেখেছি একথা হলফ করে বলতে পারি আমি। হঠাৎ আতঙ্কে আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে এলো। এই তো সেই কুখ্যাত ডাকাত মঙ্গল সিং, যাকে ধরবার জন্যে পুলিশ এক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ মনে পড়ছে দিন কয়েক আগেই ওর ছবি দেখেছি একখানা খবরের কাগজে। ও নাকি নৃশংস খুনী। টাকার লোভে আজ পর্যন্ত কতো লোককে ও শেষ করে দিয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই।

হয়তো আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই লোকটা ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকালো। জ্বলজ্বলে চোখ দু’টোর পূর্ণদৃষ্টি স্থির হয়ে রইলো, আমার মুখের ওপর। আমিও, হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। ওর হিংস্র কুটিল দৃষ্টির সঙ্গে আমার দৃষ্টিও মিলিত হলো। ভয়ে আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। আবছা অন্ধকারের ভেতর থেকে ওর চোখ দু’টো জ্বলছিলো রক্তলোলুপ বন্য পশুর চোখের মতো।

ভয়ে আমি আড়ষ্ট হয়েই রইলাম। কিছুতেই মনে সাহস আনতে পারছিলাম না। ভাবলাম চেনটা টেনে গাড়িটা থামিয়ে দেবো না কি? লোকজন এসে পড়লে বিপদের আশঙ্কা থাকবে না। কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে হলো, ও চেষ্টা করতে গেলে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেওয়া হবে। ট্রেন থামবার আগেই এ জগৎ থেকে নির্ঘাত বিদায় নিতে হবে আমায়। চুপচাপ বসে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। পরের স্টেশনে গাড়ি যখন থামবে তখন রেল পুলিশকে খবর দিলেই চলবে। পুলিশ নিশ্চয়ই ওর গতিবিধির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। হয়তো ওর পিছু ধাওয়া করে পুলিশ বরাকর স্টেশনে এসেছিলো। কিন্তু পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ও সরে পড়েছে। পুলিশের দারোগা হয়তো এতোক্ষণে কাছাকাছি সব স্টেশনেই খবর পাঠিয়েছে। সামনের স্টেশনে গাড়ি থামলেই পুলিশের লোক তল্লাশি শুরু করবে প্রতিটি রেলের কামরায়। হ্যাঁ, হঠাৎ উত্তেজনার বশে কিছু না করাই ভালো। দেখাই যাক না কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।

কিন্তু মনের মধ্যে ভয় আবার উঁকি দিতে থাকে। অপেক্ষা করা ঠিক হবে কি? আমি বসে থাকবো চুপচাপ আর ও হয়তো এগিয়ে আসবে একটু একটু করে তারপর হঠাৎ একসময় অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর। আমার টুটিটা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে দেবে। নাঃ, অপেক্ষা করার কোনো মানেই হয় না। সময় থাকতে ‘চেন’টা টেনে দেওয়াই ভালো। ওটা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। পরে হয়তো এ সুযোগ পাবো না।

না, সত্যিই লোকটা এবার কিছুটা এগিয়ে এসেছে আমার দিকে। এক শীতল হিমানী প্রবাহ যেন বয়ে গেল আমার মেরুদণ্ড বেয়ে। একটু দূরে সরে গেলাম বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আমি গেছে।

ওর ঘৃণাভরা হিংস্র দৃষ্টিটা মুহূর্তের জন্যেও আমার মুখের ওপর থেকে নড়ে নি। ঐ দৃষ্টির মাঝে যেন ওর ভয়াবহ অতীতের ইতিহাস লুকানো রয়েছে। ওর সাম্প্রতিক অপরাধের ঘটনাটা উঁকি দেয় মনের মধ্যে। মাস দুই আগে ও যে ধনী গৃহস্থ ও তার স্ত্রীকে নির্মমভাবে হত্যা করে, তাদের করুণ অসহায় মূর্তি ভেসে ওঠে- আমার চোখের সামনে। একটা কুড়ুল নিয়ে ও তাদের আক্রমণ করেছিলো। খবরের কাগজে খুনের বিস্তারিত বিবরণ বেরিয়েছিল। নিহত স্বামী-স্ত্রী দেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন, মুখ এমনি বিকৃত যে চেনা যায় না। ঘরের মেঝে আর দেওয়াল রক্তে লাল। দু’টো খুন করেও ওর রক্তের তৃষ্ণা মেটে নি। গৃহস্থের চার বছরের একটা ছেলে ঘুমোচ্ছিলো ওপরতলায়। তাকেও খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলেছিলো কুডুলের আঘাতে আঘাতে।

না, এবার আর সন্দেহের কোনো কারণ নেই। লোকটা সরে এসেছে অনেকটা কাছে। আশ্চর্য, লোকটা নড়াচড়া করছে অথচ কোনো আওয়াজ পাচ্ছি না তো। আরো কিছু দূরে পিছিয়ে গেলাম আমি। হে ভগবান, গাড়িটাকে আরও দ্রুত চালিয়ে দাও যাতে এক্ষুনি পৌঁছে যেতে পারি পরের স্টেশনে। আরো ভালো হয়, যদি গাড়িটার গতি এমনি মন্থর করে দাও যাতে নির্ভয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়তে পরি।

যা অনুমান করেছি ঠিক তাই। এবার লোকটাকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লক্ষ্য করলাম। স্পষ্ট দেখলাম, আমার ঠিক পাশের বেঞ্চিটাতে ও সরে এলো। ওর চোখ দু’টো যেন আরো বড়। আরো হিংস্র হয়ে উঠেছে। চুম্বকের মতো ওর চোখ যেন টানছে আমায় আমাকে ধ্বংস করার জন্যে। আত্মরক্ষার জন্যে যদি কিছু থাকতো আমার কোনো অস্ত্র, ছড়ি, যা হোক একটা কিছু। গাড়িটাও যদি আরো দ্রুতগতিতে চলতো! যদি—

এবার ও এসে পড়েছে আমার ঠিক সামনে। মাত্র কয়েক ফুটের ব্যবধান। ভয়ে আমার স্নায়ুগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ উৎকণ্ঠা অসহ্য। কথা বলার শক্তি নেই আমার। হয়তো আর এক মুহূর্ত পরেই আমার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে চিরদিনের মতো।

লোকটা এবার উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর রক্ত পিপাসু চোখের ক্রুর দৃষ্টি যেন আমার চোখ ভেদ করে মাথায় আঘাত হানছে। আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। মস্তিষ্ক আর যেন কাজ করছে না। না, বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। ভাবছিলাম, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যই ওর ঐ লম্বা লম্বা বীভৎস আঙুলগুলো চেপে ধরবে আমার গলাটা।

এর কদাকার বীভৎস মুখখানা এখন আমার মুখের ঠিক সামনে— মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। ওর রক্তহীন লালাসিক্ত ঠোঁট দুটো ওঠা নামা করছে সাপের মতো পাক খেয়ে খেয়ে। ওর নিঃশ্বাসে যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে একটা বিষাক্ত বাষ্প। মুখে কিছু না বললেও ওর চোখ বলে দিচ্ছে ওর মনের কথা।

ওর পেশীবহুল লম্বা হাত দু’টো এগিয়ে আসছে আমার দিকে। এতক্ষণ যে চিৎকারটা চেপে রেখেছিলামা সেটা হঠাৎ বেরিয়ে এলো প্রচণ্ড বেগে। দেহের সমস্ত শক্তি সংযত করে ছুটে গেলাম দরোজার দিকে। ওর হাতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরার চাইতে রেলের চাকায় গুঁড়িয়ে যাওয়া ভালো। চট করে দরোজাটা খুলে লাফিয়ে পড়লাম বাইরে।

লাফিয়ে পড়ার পর বুঝতে পারলাম, কোথায় যেন একটা গলদ রয়েছে। গাড়ি থেমে গেছে একটু আগে, আর আমি পৌঁছে গেছি কুমার ধুবিতে। প্লাটফর্মের ওপর পড়ে গেছিলাম। তাড়াতাড়ি উঠে ধুলো ঝেড়ে ছুটলাম স্টেশন-মাস্টারের ঘরের দিকে।

“শুনছেন স্যার, পুলিশে খবর দিন চট করে” হন্তদন্ত হয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম – “এই ট্রেনে ডাকাত মঙ্গল সিং রয়েছে –একই কমরায় ওর সঙ্গে আমি অনেকক্ষণ ছিলাম।”

স্টেশন-মাস্টার গম্ভীর মুখে আমার আপাদমস্তক একবার দেখে নিলেন ভালো করে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন– “পুলিশ মঙ্গল সিংকে ধাওয়া করেছিলো বরাকরের কাছে, তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠতে গিয়ে ও চাকার নিচে পড়ে যায়। মিনিট দশেক আগে ফোনে খবরটা এসেছে।”

আমি আঁৎকে উঠলাম। ভাবলাম, তাহলে যাকে আমি ট্রেনে আমার কামরায় দেখেছিলাম সে কে?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন