প্রেতাত্মার প্রতিশোধ – সমুদ্র পাল

তা প্রায় অনেকদিন হয়ে গেলো। বারো তেরো বছর তো হবেই। মুম্বাই শহরের এক ঠাণ্ডা কনকনে রাত।

সারা পৃথিবী তখন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। চারিদিক ঘন কুয়াশায় ভরে আছে। ধোঁয়া আর কুয়াশা। সব মিলে ধোঁয়াশা। দশ হাত দূরের জিনিসকেও ভালো মতো দেখা যায় না।

রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। পালি হিল থেকে শেষ বাস ছাড়ছে। যাবে মুম্বাই শহরের দিকে।

বাসে বেশী লোকজন পালি হিল থেকে উঠলো না। বাসের দোতালাটা একদম ফাঁকা। একতলায় দু’চারজন মাত্র যাত্রী উঠেছে।

দোতলায় ধীরে ধীরে উঠে বসল একজন যাত্রী। পরনে স্যুট, হ্যাট, পায়ে বুট। অভিজাত পোশাক পরা।

কোটের কলার তোলা।

টুপীটা এমনভাবে পরা মুখখানা দেখাই যায় না।

বাসের কন্ডাকট্যার দোতলায় এসে টিকিট চাইলো তার কাছে। বাবু টিকিট—

—মুম্বাই কতো?

—পাঁচ টাকা।

—এই নাও।

লোকটা টিকিট কিনলো বটে, তবে কন্ডাকট্যার তার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।

কঙ্কালসার শরীর। মুখখানা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। কোর্টের কলার ও টুপীর মাঝে শুধু দেখা যাচ্ছে তার চোখ দু’টি ধগ্ ধগ্ করে জ্বলছে।

এ কেমন লোক?

কন্ডাকট্যার ঘাবড়ে গেল বেশ। সে কোনো কথা বলতে পারলো না। লোকটার হাত থেকে টাকা নিতে গিয়ে তার কঙ্কালসার হাতের সঙ্গে নিজের হাত ঠেকাতেই সে শিউরে উঠলো।

বরফের মতোই ঠাণ্ডা হাত তার। যেন বরফের একটা টুকরো হঠাৎ তার হাতে ঠেকলো।

কন্ডাকট্যার টিকিট দিল। কোনো কথা তার মুখ থেকে বেরোলো না। শুধু তার দিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখে নিলো আর একবার

—কি দেখছো? লোকটা জিজ্ঞাসা করলো।

—মুম্বাই-এর কোন্ জায়গায় নামবেন?

—আপনার কি দরকার? মেজর হোম কারও কথার জবাব দেয় না। কন্ডাকট্যার এবার খুবই ঘাবড়ে গেলো।

লোকটা যে সে লোক নয়— পুরো একজন মিলিটারী মেজর। বাপরে এর সঙ্গে কে কথা বলে। কিন্তু একজন মিলিটারী মেজর এতো রোগা? কোনো কিছু ভেবে কূল কিনারা করতে পারলো না।

তবে তার গা-টা ঘিনঘিন করতে লাগলো।

লোকটার গায়ে যেন কেমন মড়া পচা গন্ধ। কন্ডাকট্যার আর দেরী না করে নিচে নেমে এলো।

মিনিট পনেরো পরে।

লোকটা একজায়গায় বাস থামতেই যেন হঠাৎ হাওয়ায় ভর দিয়ে নিচে নেমে এলো। বিদ্যুতের গতিতে বাস থেকে নেমে গেল।

কন্ডাকট্যার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এরকম লোকের পাল্লায় সে জীবনে আগে কখনো পড়েনি। যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।

দুই

রাত প্রায় বারোটা।

মুম্বাই-এর থ্রি স্টার হোটেল।

খট্ খট্ খট্

-কড়া নড়ে উঠলো।

একজন বেয়ারা দরোজা খুলে দিলো।

—কে? কাকে চান?

—ঘর খালি আছে?

—ভেতরে আসুন।

ঘুম জড়ানো স্বরে সে বললো।

তারপর তাকিয়ে দেখে ম্যানেজার চেয়ারে নেই। সে বললো বসুন, দেখি ঘর খালি আছে কিনা।

বেয়ারাটা হোটেল রেজিস্টার খুললো। তারপর বললো —একটা ঘর খালি আছে।

—কোথায়?

—দোতলায়।

—ভাড়া কতো?

—খাওয়া থাকা আশি টাকা।

— এই নাও।

লোকটা একটা একশো টাকার নোট তার হাতে দিলো। বেয়ারা টাকাটা নিয়ে লোকটাকে তার ঘরে পৌঁছে দিতে গেল।

—রাতে কিছু খাবেন?

—না।

—ক’দিন থাকবেন?

—আজ রাতটুকু।

—আপনার নাম?

—মেজর হোম।

নাম লিখে মেজর হোমকে তার ঘরে পৌঁছে বেয়ারা রামশরণ চলে গেল। লোকটা অর্থাৎ মেজর হোম দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। রামশরণ এবার ভাবতে লাগলো, এমন আজব লোক সে জীবনে দেখেনি।

যেমন কঙ্কালসার শরীর, তেমনি ঢলঢলে পোশাক আর পোশাকের ফাঁকে জ্বল জ্বল করছিলো দু’টি চোখ। ভাগ্যিস এই অদ্ভুত লোকটার সঙ্গে বেশীক্ষণ কথা বলতে হয়নি তার।

তিন

গাঢ় অন্ধকার রাত। প্রায় দু’টো বাজে। থ্রি স্টার হোটেলের তিন নম্বর ঘরে ঘুমিয়েছিলো সুরজিৎ খান। প্রখ্যাত স্মাগলার, ধনী এবং চরিত্রহীন লোক এই সুরজিৎ খান।

সারা মুম্বাই শহরের লোক তাকে ভয় করে। আজ প্রায় চারদিন হলো সে এই হোটেলে এসে উঠেছে।

সুরজিৎ খান দরোজা বন্ধ করে আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলো। জানলাটা খোলা।

মাথার কাছে গরাদ দেওয়া জানালা। এই মোটা গরাদ ভেদ করে কেউ ভেতরে আসতে পারবে না, তা সুরজিৎ খান ভালো করেই জানতো। হোটেলের ঘড়িতে তখন আড়াইটে বাজলো।

এমন সময় সুরজিৎ খানের হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।

—কে?

সুরজিৎ খান উঠে বসলো।

জানলার বাইরে একটা মূৰ্তি!

—কে তুমি?

সুরজিৎ খান প্রশ্ন করলো লোকটার দিকে চেয়ে।

—আমি মেজর হোম।

—মেজর হোম্!

—হ্যাঁ।

—সে তো মৃত। আমি নিজের হাতে তাকে গুলি করে মেরেছি!

—মেরেছো? হাঃ-হাঃ-হাঃ

যেন পিশাচের হাসি হেসে উঠলো জানালার সেই অদ্ভুত লোকটা!

—হ্যাঁ।

—কিন্তু আমি মরিনি—মরবো না—

বলতে বলতে সেই গরাদ দেওয়া জানলা দিয়ে, সেই ছোট্ট ফাঁক গলিয়ে ঢুকে পড়লো লোকটা!

সুরজিৎ খান অবাক।

বিশালদেহী মেজর হোম গরাদের ওই ছোট্ট ফাঁক দিয়ে কি করে অনায়াসে ঢুকলো?

ভেতরে ঢুকে মেজর হোম বললো —কি, তুমি আমাকে পারছো না চিনতে?

—মেজর হোম!

—হ্যাঁ। আমিই..

—তুমি ভেতরে এলে কি করে?

—আমার ইচ্ছায়।

সুরজিৎ খান ভালো করে তাকালো। মেজর হোম এর মতো মুখ বটে লোকটার।

মেজর হোম এর মতো পোশাক, টুপী, কিন্তু একি কঙ্কালসার চেহারা। তার চোখ দু’টিতে অমন দৃষ্টি কেন?

—তুমিই মেজর হোম?

—হ্যাঁ, আমিই—

—কি চাও?

—কি চাই, তা তোমার ভালো করেই জানা উচিত সুরজিৎ খান। তুমি হ্যাঁ, তুমিই কি আমাকে গুলি করে খুন করোনি?

—হ্যাঁ, কিন্তু…

—শোনো, তুমিই কমলা বিবিকে আমার অনুপস্থিতিতে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলে। সে যেতে চায়নি বলে, তুমি তার ওপরে অত্যাচার করেছিলে। মনে পড়ে?

—হ্যাঁ।

—তারপর সেই সময় আমি হঠাৎ এসে পড়াতে তুমি আমাকে হত্যা করেছিলে গুলি করে। কমলা বিবি বাধা দিতে গেছিলো বলে তুমি তাকেও গলা টিপে শেষ করে দিয়েছিলে। মনে আছে?

—না, না, তুমি—

—চুপ করো!

সঙ্গে সঙ্গে মেজর হোম দু’হাতে সুরজিৎ খান-এর গলা টিপে ধরলো। ঠাণ্ডা দু’টি বলিষ্ঠ হাত।

বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা!

যেন দু’টি বরফের চাপ। সুরজিৎ খানের গলায় চেপে বসছে ধীরে ধীরে।

আঁ-আঁ-আঁ-আঁ চিৎকার করে উঠলো সুরজিৎ খান।

তারপর জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো।

চিৎকার শুনে পাশের ঘরের লোকজন গিয়ে ম্যানেজারকে ডেকে তুললো। ম্যানেজার দৌড়ে এসে দরোজা ভেঙে ঘর খুললো। কিন্তু কি আশ্চর্য! ঘরে কোনো লোকের প্রবেশের কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। কেউ তো ঘরে ঢোকেনি।

অথচ সুরজিৎ খান মরে পড়ে আছে। তার গলায় দু’টো লম্বা লম্বা দাগ। গলা টিপে তাকে কে বা কারা যেন হত্যা করেছে।

সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে ফোন গেল।

পুলিশ এসে হোটেল পাঁতি পাঁতি করে খুঁজলো। কিন্তু সবাই আছে —কেবল নেই সেই রহস্যময় আগন্তুক। সে যেন তার ঘর থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

পুলিশ দেখলো হোটেল রেজিস্টারে নাম লেখা মেজর হোম।

কিন্তু কে এই মেজর হোম?

খোঁজ নিয়ে জানা গেল কয়েকদিন আগে সে খুন হয়েছে।

তবে সে এখানে এলো কি করে? পরে পুলিশ তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করে বাস ড্রাইভার কন্ডাকট্যার ও হোটেলের বেয়ারার স্টেটমেন্ট নিলো।

পুলিশ বুঝে নিলো যে, এ সেই রহস্যময় আগন্তুকের কীর্তি ছাড়া আর কারো নয়।

কিন্তু কে হতে পারে সে?

পুলিশ রহস্য ভেদ করতে না পেরে, এটা একটা আত্মহত্যার কেস বলে রিপোর্ট লিখলো।

কিন্তু পুলিশ আজও এটা একটা নিছক অদ্ভুত ঘটনা বলে স্বীকার করে। রহস্যময় আগন্তুকটি আর কেউ নয়, নিশ্চয়ই মেজর হোমের প্রেতাত্মা। প্রেতাত্মা যে প্রতিশোধ নিতে ফিরে আসতে পারে, এটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।

আর তাই, আজও এই অদ্ভুত রহস্যময় ঘটনার কোনো কিনারা হয়নি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন