গুরুদাস খাসনবিশের মৃত্যু – তারাপদ রায়

রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

গুরুদাস খাসনবিশের মৃত্যু – তারাপদ রায়

শেষ রাত্তিরে খুন হলেন গুরুদাস খাসনবিশ। গুরুদাস খাসনবিশের খুন হওয়ার কোন কারণ বা হেতু খুঁজে পাওয়া গেল না।

গুরুদাস সরকারী চাকরি করতেন। বছর বারো আগে অবসর নিয়েছেন। একশো সাত টাকা পঞ্চাশ নয়া পয়সা করে পেনসন পেতেন। আয় বলতে শুধু এই ছিল। দু-একটা যা ছোটখাটো ইন্সিওর ছিল, সেও কোন্ কালে ম্যাচিওর করে গেছে, সেসব টাকা-পয়সা কবে হজম হয়ে গিয়েছে! সম্পত্তি বলতে কিছু জামা-কাপড়, একটা পুরোন ছাতা, একজোড়া ছেঁড়া পাম্প সু এবং বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলে রুপো দিয়ে বাঁধানো একটা সাড়ে চার রতি প্রবালের আংটি।

নিঃসন্তান এবং বিপত্নীক গুরুদাস বন্ধুবান্ধবের বিশেষ ধার ধারতেন না, প্রায় কেউই ছিল না তেমন। কারোর সঙ্গে শত্রুতা বা বিবাদ নয়, সরকারী চাকরিও করেছেন সাধারণ কেরানীর কাজ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিরামিষ চাকরি—সে সূত্রেও যে কোন শত্রুতা তৈরি হয়ে থাকতে পারে সেটা অসম্ভব, আর যত বদমায়েস কর্মচারীই হোক না কেন, রিটায়ার করার বারো বছর পরে কার আর কি আক্রোশ থাকতে পারে তাঁর ওপর।

গুরুদাস খাসনবিশ আমার বাড়ির পিছনের দিকে একতলার একটা ঘরের ভাড়াটে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার অতি অল্পই পরিচয় ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, পরিচয় হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। মাত্র বছর দেড়েক আগে তিনি আমাদের এখানে ভাড়াটে হয়ে আসেন। ঘরটা তখন আমার খালিই পড়ে ছিল। এক হোটেল থেকে দু-বেলা আমার ভাত দিয়ে যেত, অনেক সময় সেই হোটেলের কোন কোন খদ্দের থাকার জায়গা খুঁজলে হোটেলের মালিক আমার বাড়িতে ঘর আছে কিনা খোঁজ করতেন। হোটেলের মালিক নিত্যানন্দবাবু আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গুরুদাসবাবুকে।

গুরুদাসবাবুকে দেখে আমি একটু ভয়ই পেয়েছিলাম। সারা মুখে তুলো ব্যান্ডেজ, একটা হাত প্লাস্টার করা, লাঠি ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। আমাকে বললেন, ‘রিটায়ার করার পর প্রত্যেক বছর শীতের শেষে একটু তীর্থ করতে—মানে এই বেড়াতে-টেড়াতে বেরোই, এবারো বেরিয়েছিলুম।’ এইটুকু বলে, ডান হাতটা প্লাস্টার করা বলে তুলে উঠাতে পারলেন না, বাঁ-হাতটা কপালে তুলে নমস্কার করে, ‘একটু দ্বারিকানাথের কাছে যাব বলে বেরিয়েছিলুম। আমার ভাগ্যে নেই। শর্টকাট হবে শুনে একটা একটু বাঁকা পথে গিয়ে, একটা পাহাড়ী খাদ পেরোতে গিয়ে সোজা পুল থেকে পড়ে যাই প্রায় চল্লিশ ফুট নিচে। বাঁচবারই আশা ছিল না, কোন রকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছি।’ বলে, ক্ষীণ করুণ হাসি হাসলেন গুরুদাসবাবু। সারা মুখে ব্যান্ডেজ, শুধু চোখের কোণায় একটু হাসির রেখা দেখলাম।

সেই থেকে গুরুদাসবাবু আমাদের বাড়ির নিচেতলার ভাড়াটে। একটা ঠিকে ঝি এসে দু-বেলা জল তুলে, ঘর ঝাঁট দিয়ে যায়। দুপুরে আর রাতে আমার মতই হোটেল থেকে ভাত আসে। ঘর থেকে কদাচিৎ বেরোতেন তিনি। সন্ধ্যার পরে একটা লাঠি ভর দিয়ে একটু এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে ফিরে আসতেন আর মাসে একবার বেরোতেন পেনসন আনতে। তাঁর সঙ্গে আমার কদাচিৎ কথাবার্তা হত, মাসে একবার মিনিট কয়েকের জন্যে আসতেন ভাড়াটা দিতে। তাঁর কাছে কোন লোকজন বা চিঠিপত্র এসেছে বলেও মনে পড়ে না। গুরুদাস খাসনবিশের একটা দোষ ছিল, গাঁজা খেতেন। ওঁর ঘর থেকে প্রায়ই গাঁজার গন্ধ আসত। কিন্তু বাড়িওলা হিসেবে তাতে আমার আপত্তির কি থাকতে পারে!

সেই গুরুদাস খাসনবিশ খুন হলেন। কেন, কি করে নিরীহ, অবসরপ্রাপ্ত কেরানী গুরুদাস, কার কি শত্রুতা করেছিলেন যে তাঁকে এই বৃদ্ধ বয়সে জীবন দিতে হল—এই সব সমস্যার চেয়েও যে সম্যসা আমার কাছে আরো বড় হয়ে দেখা দিল, সেটা হচ্ছে পুলিশের হাঙ্গামা। আমি নিত্যানন্দবাবুকে দেখিয়ে দিলাম। বললাম, ‘হোটেলের মালিক নিত্যানন্দবাবু আমার কাছে গুরুদাস খাসনবিশকে পাঠিয়েছিলেন।’ কিন্তু বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, খুনের মামলা, পুলিশ কি অত সহজে ছাড়ে? এর আগে ক’টা খুন হয়েছে এ-বাড়িতে, জানাশোনা আর কেউ কখনো খুন হয়েছে কিনা, ইত্যাদি যত সব প্রশ্ন। এক-একটা প্রশ্ন শুনি আর আঁতকে আঁতকে উঠি; যেন আমার বাড়িটা খুনেরই আখড়া, যেন খুনী মাত্রেই আমার বিশেষ পরিচিত। শুধু একটা মাত্র প্রশ্ন পুলিশের বাকি রয়ে গেল—যেটা করলেই পারত, ‘আপনার খুন করতে কেমন লাগে?’

নিত্যানন্দবাবুর ঘাড়ে খাসনবিশের বোঝা চাপিয়ে বিশেষ যে রক্ষা পাওয়া গেল তা নয়, পুলিশের অত্যাচার চলতেই লাগল।

সুতরাং একদিন চলে গেলাম গর্জনের কাছে তার দাঁতের চেম্বারে। রোমাঞ্চের পাঠকদের নিশ্চয় গর্জন গোয়েন্দাকে মনে আছে? সেই দন্তচিকিৎসক কাম গোয়েন্দা এবং তার সাকরেদ শশক। শশক আমাকে দেখামাত্র বলল, ‘আসুন মাস্টারমশায়!’

কবে কোন্কালে শশকের এক পিসতুতো ভাইকে প্রাইভেট পড়িয়েছিলাম, সেই সুবাদে শশক এখনো আমাকে মাস্টারমশায় বলে। গর্জন তখন চেম্বারের ভেতরে একটা বাচ্চা ছেলের দুধদাঁত পড়েনি, তাই সেটা তুলে ফেলছে। বাচ্চা ছেলেটা কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে, তার মা আর ঠাকুমাই বোধ হয় দুজনে তাকে দু’দিকে ধরে রয়েছে।

এ পাট শেষ হতে প্রায় পনেরো মিনিট লাগল। আমি ওয়েটিং রুমে বসে একটা হাফডোরের ফাঁকে ফাঁকে এসব দেখছিলাম। গর্জন বেরিয়ে এল। বলল, ‘কি খবর?’

বিশেষ ভনিতা না করে সমস্ত খবর সবিস্তারে বললাম। পুরো সময়টা গর্জন টেবিলে তাল ঠুকে ঠুকে রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য গেয়ে গেল গুনগুন করে। মন দিয়ে শুনল বলে বোধ হল না।

সব শোনা হয়ে গেলে বলল, ‘তাহলে চল, একবার থানায় যাই। ওঁরা কি বলেন শোনা যাক।’

আমি বললাম, ‘আবার থানায়?’

গর্জন বলল, ‘ভয় কি, তুমি তো আর খুন করনি? প্রশ্নটা করে কি রকম একটা ফাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমার তো আরো ভয় হল, কি জানি, শেষে গর্জনও সন্দেহ করতে লাগল নাকি!’

আমি, গর্জন আর শশক—এই তিনজন মিলে থানায় গেলুম। শশক থানার বাইরে রাস্তায় দাঁড়াল, গর্জন আর আমি ভেতরে গেলাম।

গর্জন নানা কারণে পুলিশের কাছে অপ্রিয় ব্যক্তি এবং আমি বিনা কারণে সন্দেহভাজন। কিন্তু কেন জানি না, থানায় কিন্তু আমাদের অভ্যর্থনার ত্রুটি-হল না: ‘কি খবর, একেবারে মিস্টার গর্জন বোসকে সঙ্গে করে? এ যে আমাদের পরম সৌভাগ্য!’ হেঁ হেঁ করে হাসতে হাসতে বড় দারোগা শঙ্করবাবু দুটো চেয়ার এগিয়ে দিলেন। এই আপ্যায়নে কিছুটা ব্যঙ্গ ছিল কিনা কি জানি! আমরা তো বসলাম।

গর্জন খুব বিনীত ভাবে বলল, ‘আপনাদের কাছে দু-একটা কথা জানতে এলাম।’

শঙ্করবাবু বললেন, ‘বলুন। তার আগে দু-কাপ চা দিই?’

চা এল। থানার আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ। গর্জন কথা চালাতে লাগল, ‘আচ্ছা, মৃতের ঘরটা নিশ্চয় আপনারা ভালো করে দেখেছেন?’

শঙ্করবাবু বললেন, ‘তা দেখেছি, কিছুই তো পেলাম না। বিছানাপত্র, দু-একটা বই, এই কিছু জামাকাপড়, একটা লাঠি—এইসব কিছুই সন্দেহজনক নয়।’ একটু থেমে দারোগাবাবু বললেন, ‘শুধু একটা জিনিস বাদে—’

আমি অনুমান করে বললাম, ‘কি, একটা গাঁজার কল্কি?’

দারোগাবাবু যেন অবাক হলেন, ‘সেকি, গুরুদাস খাসনবিশ গাঁজা খেতেন নাকি?’

আমি বললাম, ‘সেই রকমই গন্ধ আসত ওর ঘর থেকে।’

শঙ্করবাবু যেন একটু বিব্রত হলেন: ‘না, গাঁজার কল্কি বা ওসব কিছু তো পাইনি, তবে একটা অন্য জিনিস পেয়েছি—যেটা গুরুদাস খাসনবিশের ঘরে কেন ছিল তা বুঝতে পারছি না।’

গর্জন নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, ‘জিনিসটা কি?’

শঙ্করবাবু হঠাৎ মেঝেতে বুট ঠকে বললেন, ‘কোই হ্যায়!’ একটা সেপাই এসে সেলাম জানাল। শঙ্করবাবু তাকে বললেন, ‘মালখানা—’

একটু পরে মালখানার জমাদারবাবু এল। তাকে শঙ্করবাবু একটা ছোট স্লিপ লিখে দিলেন। একটু পরে সে একটা রবারস্ট্যাম্প নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখল। সামনে একটা কালির প্যাড ছিল, তাতে একটা ছাপ দিয়ে কাগজে ছাপ দিলেন শঙ্করবাবু। বারাসতের এক সাব রেজিস্ট্রারের নামে একটা রবারস্ট্যাম্প। সরকারী অফিসারেরা নাম সই করে নিচে যে ধরণের স্ট্যাম্প দিয়ে থাকেন, এটাও ঠিক তাই।

গর্জন একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, সাব রেজিস্ট্রাররা তো গেজেটেড অফিসার?’

আমি সরকারী ব্যাপার একটু-আধটু জানি। তাই বললাম, ‘হ্যাঁ।’

গর্জন কি একটু ভাবল, রবার স্ট্যাম্পটা একটু নাড়াচাড়া করল। তারপর বলল, ‘খুব সম্ভব এ নামে এ কোন সাব রেজিস্ট্রার নেই। দেখবেন তো একটু খোঁজ নিয়ে!’

দারোগাবাবু বললেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়েছি, এ রকম কেউ বারাসতে নেই। সিভিল লিস্টে এই স্ট্যাম্পে যে নাম আছে সেই নামে কোন লোকই নেই।’

গর্জন বলল, ‘তাহলে তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আচ্ছা, পরে দেখা হবে, এখন আমরা উঠি।’

আমরা বেরিয়ে আসতে দেখি শশক রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিপরীত ফুটপাথে সালোয়ার কামিজ পরা তরলা একটি মেয়েকে অপাঙ্গে দেখছে। গর্জন আর আমাকে দেখতেই পায়নি। গর্জন আস্তে এগিয়ে গিয়ে শশকের পিঠে হাত রাখল: ‘কি ব্যাপার, ওয়াচ করছ নাকি?’

শশক, লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না, না। আপনাদের কি হল?’

‘আমাদের কিছু হয়নি; তোমার কিছু হল?’ একটু হেসে প্রায় প্রশ্রয় দেওয়ার ভঙ্গিতে গর্জন প্রশ্ন করল।

শশক আরো লজ্জা পেয়ে গেল। গর্জন এ বিষয়ে আর কথা বাড়াল না। বলল, ‘শোন, কাল দুপুরে তোমার দুটো কাজ আছে। একবার যেতে হবে গুরুদাস খাসনবিশের পুরোন অফিসে। সেখানে যারা পুরোন কর্মচারী আছে, তারা নিশ্চয় গুরুদাসকে চিনবে। তাদের কারো কাছ থেকে গুরুদাস দেখতে কেমন ছিলেন, আচার-আচরণ কেমন ছিল, তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু খবর পাও, সংগ্রহ করবে। আর একবার যাবে পেনসন অফিসে। গুরুদাস খাসনবিশের পেনসন তিনি নিজে গিয়ে নিতেন, না আর কেউ অথরিটি লেটার নিয়ে গিয়ে নিত? যদি দেখ অথরিটি লেটার দিয়ে কেউ নিত, তাহলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট, গেজেটেড অফিসারের সই—এগুলো লাগে অথরিটি দিয়ে পেনসন নিতে—ওগুলোও দেখে এস। দুপুরে এসব খোঁজ-খবর নিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে আসবে।’

শশককে নির্দেশ দেওয়া হয়ে গেলে গর্জন তাকে ছুটি দিয়ে দিল। আমি একটু বোকা বোধ করছিলুম নিজেকে। জিজ্ঞাসা করলাম গর্জনকে, ‘এসব খবরের দরকার কি?’

গর্জন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘সেসব কাল জানা যাবে। কাল দুপুরে আমার ওখানে যাবে, তখন আলোচনা করা যাবে। চল, এখন একটা সিনেমা দেখে আসি—’

বিখ্যাত বিদেশী সিনেমা চলছিল চৌরঙ্গীর একটা হলে। হাউস ফুল। যথারীতি বাইরে থেকে ব্ল্যাকে দুটো টিকিট কেটে ঢুকলাম। সেন্সরবোর্ড কেটে আর কিছু অবশিষ্ট রাখেনি, ইন্টারভ্যাল পর্যন্ত দেখে বিরক্তি ধরে গেল। দুজনেই বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। গর্জন বলল, ‘ধরে নেওয়া যাক এখানেই বই শেষ। সেন্সর ইচ্ছে করলে শেষেরটুকু সব কেটে দিতে পারত—ধর তাই করেছে।’

রাস্তায় বেরিয়ে গর্জন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে আমাকে বলল, ‘তোমাকে একটা টাস্ক দিচ্ছি, আজ সারারাত আর কাল সকালে ভেবে রাখবে, দুপুরে আমাকে বলা চাই।’

আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।

গর্জন বলল ‘ভাল করে ভেবে রাখবে। যে লোক গাঁজা খায় না, তার ঘর থেকে গাঁজার গন্ধ কেন বেরোয়?’

আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম; গর্জন হাত দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন নয়, কাল চাই উত্তর।’

পরের দিন দুপুরে গর্জনের ওখানে আমার খাওয়ার নিমন্ত্রণ—শুধু এইটুকু মনে ছিল, তার ধাঁধাটা ভুলে গিয়েছিলাম। আর মনে থাকলেও কিছু করার ছিল না। যে লোক গাঁজা খায় না, তার ঘর থেকে গাঁজার গন্ধ বেরোয় কেন—এ প্রশ্নের জবাব দেবার সাধ্য আমার নেই। আর এটাও জানি যে আমার কাছে জবাবের জন্যে গর্জন বসে নেই; উত্তর সে নিজেই খুঁজে বের করবে কিংবা ইতিমধ্যে করে ফেলেছে।

গর্জনের বাড়িতে যথাসময়ে পৌঁছে দেখি শশক ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে। তিনজনে খেতে বসলাম। খেতে খেতে কথা হল। গর্জন শশককে বলল, ‘গুরুদাস খাসনবিশের অফিসে গিয়েছিলে?’

শশক বলল, ‘গুরুদাসবাবু যদিও অনেকদিন রিটায়ার করেছিলেন, তবু অফিসে অনেকেই তাঁকে চেনে। অনেকদিন কাজ করেছিলেন কিনা, পুরোন লোকেরা সবাই তাঁকে ভালভাবে জানে। তবে গত দেড় বছর তাঁকে দেখেনি। ওই বদরিনাথ না লছমনঝোলা, কোথায় গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে ফিরে এসেছিলেন। তারপর আর অফিসে যাননি।’

আমি বললাম, ‘সেকি, আমি যতদূর জানি, গুরুদাসবাবু মাসে অন্তত একবার অফিসে যেতেন ওই পেনসন আনতে। তাছাড়া তাঁর পেনসন কে এনে দিত?’

গর্জন হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে শশককে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে পেনসনের লেটার অফ অথরিটি কার নামে দেখলে?’ বলে নিজেই প্রশ্নের সুরে উত্তর দিল, ‘হরিদাস খাসনবিশ?’

শশক এবং আমি দুজনেই অবাক হলাম। শশক গর্জনকে বলল, ‘আপনিও গিয়েছিলেন নাকি গুরুদাসের অফিসে?’

‘আরে না, এই দেখ,’ বলে একটা কাগজের টুকরো এগিয়ে দিল। তাতে লেখা রয়েছে হরিদাস খাসনবিশ।

আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা কি হল?’

গর্জন বলল, ‘দাঁড়াও, খাওয়া সেরে নিই; তারপর ব্যাপারটা কি হল দেখা যাবে।’

খাওয়া শেষ হল। আমার অতি প্রিয় বেনারসী সুপুরি আর দানা জর্দা দেওয়া মিঠে পান আনতেও গর্জন ভোলেনি।

মিঠে পান চিবোতে চিবোতে গর্জনের শোবার ঘরে গিয়ে দুজনে দুটো পাশবালিশে হেলান দিয়ে বসলাম। শশক একটা মোড়া টেনে নিয়ে একটু ওপাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল।

একটা হাই তুলে গর্জন একবার বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য বিড়বিড় করে গাইল বলে মনে হল, তারপরে আর একটা হাই তুলে চোখ বুজে এলিয়ে পড়ল।

আমি বাধ্য হয়ে ওকে একটা ছোট ধাক্কা দিলাম। গর্জন একটা চোখ, তাও অর্ধেক খুলে কামরাজ নাদারের স্টাইলে একটা হাত তুলে বলল, ‘পারকালাম।’

একটু পরে গর্জনের নাসিকাগর্জন ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। আমি আর শশক অধৈর্য হয়ে উঠলাম। এবং তারপরে ক্রমশ দুপুর কেটে গিয়ে বিকেল হল। গর্জন ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুলো। আমরা সবাই চা খেলাম।

চা খাওয়া শেষ করে গর্জন বলল, ‘যা হোক, আর সাসপেন্স বাড়িয়ে লাভ নেই।’ তারপর আমার দিকে সোজা হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার ঘরে যে লোকটা মারা গেছে, তার নাম গুরুদাস খাসনবিশ নয়।’ এইটুকু বলেই গর্জন একেবারে চুপ।

‘মানে?’

আমার বিমূঢ়তা দেখে গর্জন কিছুটা সদয় হল: ‘মানে, তোমার ঘরে যে খুন হয়েছে, সে হল হরিদাস খাসনবিশ, গুরুদাসের ভাই। ছোট ভাই কি বড় ভাই, সেটা আজ বলতে পারব না। আর গুরুদাস খাসনবিশের মত সাধারণ ভেতো মাছিমারা লোকটি কেন খুন হতে যাবে? খুন বিনা কারণে হয় না, গুরুদাস নামে এই সামান্য লোকটিই বা কেন বিনা কারণে খুন হবেন?’

আমরা আর কিছু বলার আগেই গর্জন প্রাঞ্জল করে ব্যাখ্যা করতে বসল, ‘আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল এই ফলস্ রবার স্ট্যাম্পটা দেখে। আর, তাছাড়া তোমার বর্ণনা ব্যান্ডেজ, প্লাস্টার ইত্যাদি লেপটানো গুরুদাসের কথা শুনে। আমার ধারণা, বছর দেড়েক আগেই গুরুদাস ভ্রমণ করতে গিয়ে গায়েব হয়ে যায়। হয় মরে গেছে, না হয় খুন হয়েছে; কিংবা সন্ন্যাসী হয়ে যেতেও পারে—সংসারবন্ধনহীন ব্যক্তির পক্ষে বুড়ো বয়সে সন্ন্যাসী হওয়া বিচিত্র নয়।

‘গুরুদাস হারিয়ে গেল। কিন্তু তার স্থানে গুরুদাস সেজে আরেকজন এল। কি কারণে সে আসতে পারে? এক: গুরুদাসের সম্পত্তি বা আয়ের লোভে। সম্পত্তি গুরুদাসের যতদূর মনে হয় কিছুই নেই, আয় ওই পেনসনের টাকাটা। ওটার লোভ তেমন কিছু বড় লোভ নয়। এই সামান্য ক’টা টাকার জন্যে মাসে মাসে মিথ্যে ডাক্তারের সই আর গেজেটেড অফিসারের জাল সার্টিফিকেটের ঝামেলা কিছু কম নয়।

‘তবু গুরুদাস বেঁচে আছে, এটা প্রমাণ করার জন্যেই গুরুদাসের পেনসন নেওয়া প্রয়োজন। কেননা এমন একজন কেউ আছে, যার আত্মগোপন করা প্রয়োজন—সেটা গুরুদাস খাসনবিশের ছদ্মবেশেই তার পক্ষে সবচেয়ে সহজ।

‘এরকম একটা অবস্থা দাঁড়িয়ে গেলে মনে হয় একই রকম দেখতে দুজন লোক, যেমন যমজ ভাই—এদের একজনের পক্ষে আরেকজনের ছদ্মবেশে কিছু হাসিল করা খুব অসুবিধে নয়।

‘যা হোক, ইতিমধ্যে তুমি ওই গাঁজার গন্ধের ব্যাপারটা বললে। গাঁজা খায় না, অথচ গাঁজার গন্ধ—খুব সহজ সমাধান, নিশ্চয় গাঁজার গন্ধ দিয়ে অন্য কোন গন্ধ ঢাকতে চায়। কিন্তু সেটা কিসের গন্ধ হতে পারে? আসলে এক্ষেত্রে শাক দিয়ে মাছ না ঢেকে, শাক দিয়ে শাকই ঢাকা হল। মানে, গাঁজা দিয়ে গাঁজা, খুব সম্ভব ওই ঘরে কাঁচা গাঁজার কিছু কিছু স্টক থাকত। কাঁচা গাঁজারও একটা মাদক গন্ধ আছে, সেটা ঢাকা দেবার জন্যে একটা গাঁজার ধোঁয়া দেওয়া হত।

‘আমার যেই সন্দেহ হল, আমার পেসেন্ট আছেন মল্লিকসাহেব, আবগারির সুপারিন্টেন্ডেন্ট, তাঁকে কাল রাতে টেলিফোন করে বললাম গুরুদাস খাসনবিশ বলে গাঁজার চোরাই ব্যবসায় কোন ব্যক্তি জড়িত আছে কিনা। তিনি আজ দুপুরে অফিস থেকে, তোমাদের যে চিরকুটটা দেখালাম, সেটা পাঠিয়ে জানালেন গুরুদাস নয়, হরিদাস খাসনবিশ নামে একজন দু’বছর ফেরার। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তবে মল্লিকসাহেবের বিশ্বাস, সে এখনো কলকাতাতেই অপারেট করছে।

‘সমস্যাটা সঙ্গে সঙ্গে জলের মত সহজ হয়ে গেল। তোমার ঘরের মৃত ব্যক্তিটি হরিদাস খাসনবিশ—খুব সম্ভব গুরুদাসের মায়ের পেটের ভাই। যেভাবেই হোক, ফেরারী আসামী হরিদাস ভাইকে সরিয়ে প্লাস্টার ব্যান্ডেজের ছদ্মবেশে তোমার ঘরে এসে বসেছে। ওখানে বসেই গাঁজার কারবার চালায়, খুব সম্ভব হোটেলের যে ছেলেটা ভাত নিয়ে আসে, তার মারফৎ। গাঁজা খুবই বহুমূল্য জিনিস। যে টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত এল, সেই ক্যারিয়ারেই গাঁজা এল কিংবা গেল—একবার একটা টিফিন ক্যারিয়ারে দু-চার হাজার টাকা দামের গাঁজা চালান কিছুই নয়।

‘হরিদাস এক-আধবার ঘর থেকে বেরুতে। পেনসন আনতে যেত। সেখানে কিন্তু হরিদাস খাসনবিশ নামই ব্যবহার করত গুরুদাসের অথরিটি লেটারে। পেনসন অফিসে আর আবগারি মামলার ফেরারী আসামীকে কে চিনবে? গুরুদাসের পুরোন অফিস তাই সেখানে আর নিজেকে গুরুদাস বলে দাবী করেনি, কারণ সেখানে অনেকেই গুরুদাসকে দীর্ঘকাল ধরে চেনে।’

গর্জন কথা বলা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আপাতত এ কাহিনী শেষ। আমাকে এবার চেম্বারে যেতে হবে।’

আমি অস্বস্তির সঙ্গে বললাম, ‘তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল?’

গর্জন বিরক্ত হয়েই যেন বললে, ‘বুঝতে পারলে না! গুরুদাস নয়, হরিদাস মরেছে তোমার ঘরে—’

আমি তবুও হাল ছাড়লাম না: ‘কিন্তু তাতে তো কিছু হেরফের হচ্ছে না। একজন তো নিশ্চয় খুন হয়েছে। হরিদাস কেন খুন হল, কে খুন করল?’

গর্জন তাকাল: ‘সে রহস্যের সমাধান কি আজকেই করতে হবে?’

আমি অসহায়ের মত বললাম, ‘তাহলে?’

গর্জন হাসল। একবার ঠোঁটটা বিড়বিড় করে বুদ্ধির্যস্য গাইল, তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, দেখা যাবে।’

সকল অধ্যায়

১. এই এক নূতন! – সুকুমার সেন
২. হরিদাসের গুপ্তকথা – ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
৩. চুরি না বাহাদুরি – নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত
৪. হত্যাকারী কে? – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
৫. কৃত্রিম মুদ্রা – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়
৬. হত্যারহস্য – দীনেন্দ্রকুমার রায়
৭. দিনে ডাকাতি
৮. বহুরূপী (বাঁকাউল্লার দপ্তর) – কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়
৯. চিঠিচুরি – পাঁচকড়ি দে
১০. বঙ্গের গুপ্তকথা – অম্বিকাচরণ গুপ্ত
১১. শোণিত-লেখা – অমূল্যচরণ সেন
১২. অদ্ভুত হত্যা – রজনীচন্দ্র দত্ত
১৩. গহনার বাক্স – জগদানন্দ রায়
১৪. ঘড়িচুরি – সরলাবালা দাসী (সরকার)
১৫. সখের ডিটেকটিভ – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
১৬. শঠে শাঠ্যং – চারু বন্দ্যোপাধ্যায়
১৭. অগাধ জলের রুই-কাতলা – হেমেন্দ্রকুমার রায়
১৮. চণ্ডেশ্বরপুরের রহস্য – মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য
১৯. কল্কেকাশির কাণ্ড – শিবরাম চক্রবর্তী
২০. সবুজ রঙের গাড়ি – মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়
২১. অচিন পাখি – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
২২. শেষ দৃশ্য – প্রণব রায়
২৩. জরাসন্ধ-বধ – মণি বর্মা
২৪. সার্জেন্ট মুখার্জি – হেমেন্দ্র মল্লিক
২৫. একটি চলে যাওয়া দিনের গুরুতর কাহিনী – সুকুমার দে সরকার
২৬. সঙ্কেত – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২৭. রহস্যভেদ – আশালতা সিংহ
২৮. সন্দেহ – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২৯. ভয়ঙ্কর ভাড়াটে ও পরাশর বর্মা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. স্বামীজী আর অনুকূল বর্মা – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
৩১. একটি খুন – বিধায়ক ভট্টাচার্য
৩২. ষড়যন্ত্র – গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৩. ঝাউবীথি—বেলা তিনটে – যজ্ঞেশ্বর রায়
৩৪. নীল তারা – পরশুরাম
৩৫. দুই ডিটেকটিভ, দুই রহস্য – পরিমল গোস্বামী
৩৬. নিরুদ্দিষ্ট – সুধাংশুকুমার গুপ্ত
৩৭. আর এক ছায়া – সমরেশ বসু
৩৮. আমার প্রিয়সখী – সন্তোষকুমার ঘোষ
৩৯. প্রেমলতার হাসি – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
৪০. ভোম্বলদাস অ্যান্ড কোম্পানি – মোহিতমোহন চট্টোপাধ্যায়
৪১. চিহ্ন – শ্রীধর সেনাপতি
৪২. নিহত একজন – আনন্দ বাগচী
৪৩. ছিপ – অদ্রীশ বর্ধন
৪৪. লাজ আবরণ – কৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৫. হাওয়াই চটির সন্ধানে – হিমানীশ গোস্বামী
৪৬. গোলোকধাম রহস্য – সত্যজিৎ রায়
৪৭. তদন্ত – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
৪৮. একটি লক্ষ্য, তিনটি খুন – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
৪৯. অন্তর্ধান – অমিত চট্টোপাধ্যায়
৫০. গুরুদাস খাসনবিশের মৃত্যু – তারাপদ রায়
৫১. আক্কেল দাঁত – গুরণেক সিং
৫২. গোয়েন্দা ও প্রেতাত্মা – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
৫৩. তিন খণ্ড হাড় – বীরু চট্টোপাধ্যায়
৫৪. মাণিকজোড় – শোভন সোম
৫৫. ত্রিশূলে রক্তের দাগ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৫৬. রত্নাকরের রক্ত চাই – প্রবীরগোপাল রায়
৫৭. কুয়াংকারের মৃত্যু – মিহির দাশগুপ্ত
৫৮. রিপুসংহার – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
৫৯. রহস্যভেদী সদাশিব – মঞ্জিল সেন
৬০. গুরুবিদায় – নারায়ণ সান্যাল
৬১. প্রেম – মনোজ সেন
৬২. ডেডবডি – ইন্দ্রজিৎ রায়
৬৩. জানোয়ার – অমল রায়
৬৪. বিরাট ধোঁকা – কালীকিঙ্কর কর্মকার
৬৫. জগদ্দলের জগাপিসি – প্রদীপ্ত রায়
৬৬. খণ্ডপানা – সুকুমার সেন
৬৭. সদুঠাকুমার পিস্তল – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
৬৮. ছারপোকা – হিমাংশু সরকার
৬৯. বাঘের ঘরে – শেখর বসু
৭০. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৭১. অনিন্দ্যসুন্দরের অপমৃত্যু – অনীশ দেব
৭২. পোড়া মোমবাতির রহস্য – সুভদ্রকুমার সেন
৭৩. হাবুল দারোগার গল্প – অত্রদীপ চট্টোপাধ্যায়
৭৪. দরজার ওপারে মৃত্যু – সিদ্ধার্থ ঘোষ
৭৫. রীতিমত নাটক – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন