রীতিমত নাটক – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

রীতিমত নাটক – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

টেলিফোনটা বেয়াড়াভাবে বেজে উঠল।

রাত সাড়ে দশটার বেশি হবে না। কফির পেয়ালা নিয়ে প্রতুল তখন দাবায় বসেছে। একা-একা দাবা খেলায় তার অভ্যাস। দু’ পক্ষের চাল সে একাই দেয়। নিজেকে নিজে মাৎ করার একটা আনন্দ আছে। এ-পক্ষের সামান্য একটা বোড়ের ঠেলায় ও-পক্ষের রাজার প্রাণ যায়-যায় অবস্থা—টেলিফোনটা বেজে উঠল ঠিক এমনি সময়।

প্রতুল বিরক্ত হলে বোঝা যায় না। ভুরু দুটোর মাঝখানে একটা খাঁজ পড়ে শুধু। তামাকের পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে রেখে, প্রতুল ক্রেডল্ থেকে রিসিভারটা তুলে নিলে: হ্যালো,কে?

জবাবে টেলিফোন তারের ও-প্রান্ত থেকে খক্‌খক্ করে খানিকটা কাশির আওয়াজ হল মাত্র। প্রতুলের চিনতে বাকি রইল না। কাশিটা তার অত্যন্ত পরিচিত। বললে, কে, দুর্লভ!

এবারের জবাব এল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি দুলর্ভ দত্ত। প্রতুলবাবু কি—

দুর্লভ দত্ত আবার বিষম খেলেন। কোন কারণে উত্তেজিত হলেই তিনি বিষম খেয়ে কাশতে থাকেন, প্রতুল তা জানে। দুর্লভ একদা তার স্কুলের সহপাঠী ছিল। এখন বিখ্যাত পার্ল থিয়েটারের ম্যানেজার এবং চার আনার মালিক।

দুর্লভের কাশি থামলে প্রতুল বললে, আমি কথা বলছি। কি ব্যাপার?

দুর্লভ এবারে কাশলেন না। কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, ভয়ানক ব্যাপার! খুন!

খুন! কোথা?

এইখেনে—আমার থিয়েটারের ফিমেল গ্রীনরুমে।

কে খুন হল?

সুতপা, আমার হিরোইন। তুমি এখুনি একবার এস ভাই। আমি কি যে করব—একেবারে দিশেহারা—

দুর্লভ দত্ত আবার বিষম খেলেন।

হতাশ চোখে একবার প্রতুল দাবার ছকের দিকে তাকাল। তারপর ‘আচ্ছা যাচ্ছি’ বলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

জুড়িয়ে যাওয়া কফির পেয়ালাটা এক চুমুকে শেষ করে প্রতুল পাইপটা আবার মুখে দিল। ঘড়িতে দেখল, রাত দশটা বেজে বাইশ মিনিট। থিয়েটার এই সবে ভেঙেছে নিশ্চয়। বাংলা থিয়েটারের সবটাই অনাটকীয়। একমাত্র নাটকীয় শুধু নায়িকার খুন হওয়া।

দেখা যাক পার্ল থিয়েটারের গ্রীনরুমে কি রহস্য তার জন্যে অপেক্ষা করছে। প্রতুল বেরিয়ে পড়ল।

পার্ল থিয়েটারের ফটকের সামনে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। থিয়েটারের ভেতরেও।

প্রতুলকে দেখেই দুর্লভ দত্ত পড়ি-কি-মরি ছুটে এলেন। রোগা লম্বাটে শুকনো চেহারা। মাথার সামনে চুল একেবারে পাতলা হয়ে এসেছে। পান-জর্দার কল্যাণে মুখের দাঁতগুলি তরমুজের বিচি হয়ে উঠেছে। গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবির ওপর ফরাসডাঙ্গার পাকানো উড়ুনি গলায় বাঁধা।

প্রতুল কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই দুর্লভ দত্ত বলে উঠলেন, সুতপা আমায় দয়ে মজিয়ে গেছে ভাই! দু’দিন বাদে আমার ‘রাহুর প্রেম’ নাটকের দুশো নাইটের উৎসব, আর ঠিক এই সময় কিনা—

শোকের আবেগে দুর্লভ দত্ত বিষম খেলেন।

প্রতুল বললে, সুতপার দেহ এখন কোথায়?

আবেগ সামলে দুর্লভ বললেন, সাজঘরেই পড়ে আছে। সে কী লোমহর্ষক দৃশ্য—চোখে দেখা যায় না!

পুলিশ তো এসে গেছে দেখছি।

হ্যাঁ ভাই। আনন্দবাবু এসেছেন বটে, তবু তোমায় খবর না দিয়ে পারলুম না।

তারপর গলা একটু নামিয়ে দুর্লভ সঙ্গোপনে বললেন, পুলিশকে বিশ্বেস নেই—কি জানি, খুনের দায়ে যদি আমাকেই ফাঁশিয়ে—

দুর্লভ এবার ভয়ে কেশে ফেললেন।

হেসে প্রতুল বললে, পুলিশের নিন্দে করলে আরও ফেঁশে যাবে দুর্লভ। ভেতরে চল।

এস। বলে দুর্লভ এগোলেন।

অডিয়েন্স ছাড়া তোমার-থিয়েটারের কোন লোক বেরিয়ে যায়নি তো?

বেরোবে কেমন করে? ফটকে যে পুলিশ। কিন্তু সুতপা যে আত্মহত্যা করে ডুবিয়ে যাবে—

আত্মহত্যা! খুন নয়? পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে প্রতুল একটু অবাক হয়ে বললে।

দুর্লভ দত্ত সখেদে বলে উঠলেন, ওই একই কথা রে ভাই! দুটোই অপঘাতে মৃত্যু! দেখবে চল না—

স্টেজের পেছন দিকে বাঁ-দিক ঘেঁষে ছোট একটা কাঠের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই দেড়তলার সারি-সারি ঘর। এই ঘরগুলোই সাজঘর। মেকআপের জন্য ব্যবহার হয়। ফালি বারান্দার শেষের দিকে ছোট ঘরটা সুতপার একলার।

বারান্দার মুখেই ইন্সপেক্টর আনন্দমোহনের সঙ্গে দেখা। ফালি বারান্দার পথটুকু একাই জুড়ে বিপুলবপু আনন্দমোহন এগিয়ে আসছিলেন প্রতুলকে দেখে।

এসে গেছেন দেখছি।

মৃদু হেসে প্রতুল বললে, কি করি বলুন, দুর্লভ যেরকম নার্ভাস হয়ে পড়েছে, ওকে ঠাণ্ডা করার জন্যেই আসতে হল। কি দেখলেন?

দেখবার কিসসু নেই। পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল কেস অভ সুইসাইড। এতে নার্ভাস হবার কি আছে মশাই?

ময়লা রুমাল বার করে আনন্দমোহন সশব্দে হাঁচলেন। কার্তিকের শেষ, হিম লেগে সর্দি হয়েছে বোধ হয়।

দুর্লভ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, নাভার্স হবার কি আছে? আপনি তো থিয়েটারের ম্যানেজার নন মশায়; আপনি পুলিশ, পাষাণ—

দুর্লভ উত্তেজনায় কাশতে শুরু করলেন।

প্রতুলের সামনে হাঁচি, পেছনে কাশি; অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করতে লাগল সে।

আনন্দমোহন থমথমে মুখে প্রতুলকে বললেন, এসেছেন যখন, একবার দেখেই যান। আমার দেখা হয়েছে আমি চললাম।

প্রতুল নরম গলায় বললে, দুর্লভের কথায় রাগ করবেন না। ভয়ে ও মাত্রাজ্ঞান হারিয়েছে।

আনন্দমোহন অভিমান-ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, তাই বলে পুলিশকে বলবে পাষাণ—হার্টলেস! জানেন, আমি পাঁচ ছেলেমেয়ের বাপ? জানেন, আমার স্ত্রী তিনদিন বাপের বাড়ি থাকলে, আমি ছটপট করে মরি?

অমায়িকভাবে প্রতুল বললে, তা আর জানিনে। আমরা বলাবলি করি, আনন্দবাবুর মত এমন আদর্শ স্বামী পুলিশ-বিভাগে আর দেখা যায় না। সত্যি, পাষাণ বলাটা দুর্লভের অন্যায় হয়েছে।

আনন্দমোহন খুশি হয়ে হেঁচে ফেললেন। তারপর প্রতুলকে বললেন, যান, ওই কোণের ঘরটায় লাশ আছে।

প্রতুল বললে, যাব কি করে?

কেন?

বৌদির তোয়াজের গুণে আপনার দেহখানি ডবল-ডেকার হয়ে উঠেছে যে। আপনার পাশ দিয়ে মাছি গলবারও উপায় নেই। আপনি না পেছুলে আমি এগোই কি করে—

আনন্দমোহন একটু অপ্রস্তুত হলেন। বললেন, আচ্ছা, আসুন।

সরু বারান্দায় কোনও মতে ঘুরে সুতপার ঘরের দিকে এগোলেন তিনি। তাঁর পেছনে প্রতুল আর দুর্লভ দত্ত।

এক পাল্লা দরজাটা হাট-খোলা। ছোট ঘরখানা লম্বা-চওড়া ছ’ফুট বাই আট ফুটের বেশি হবে না। সিলিং থেকে ঝোলানো একটা বাতি ছাড়াও সমুখের দেয়ালে টাঙানো বড় আর্শিটার দু’ পাশে একশ পাওয়ারের আরও দুটি বাতি জ্বলছে। দিন হয়ে আছে ঘরের ভেতরটা। সেই ঝলসানো আলোয় আর্শির বুকে ছায়া পড়েছে সুতপার। লাল সিল্কের গদিমোড়া একখানা ভারী চেয়ার—একসময় বোধ করি স্টেজে রাজা-উজিরের বসবার জন্য ব্যবহার হত—তার ওপর ডান দিকে কাৎ হয়ে বসে আছে সুতপা। ময়ূর-কণ্ঠী সিল্কের শাড়ির আঁচলটা বুক থেকে খসে লুটোচ্ছে। ডান হাতখানা চেয়ারের পাশে ঝুলে আছে। বাঁ হাতের মুঠোর মধ্যে ঝকঝকে একখানা ছোরার সুন্দর কাজ করা বাঁট। ছোরার ফলাটা প্রায় বারো আনা নরম বুকের বাঁ দিক ঘেঁষে বসানো।

ছোরাটা বিঁধে আছে বলেই বোধ হয় বেশি রক্ত বেরোতে পারেনি। কাঠগোলাপের ছড়ানো পাপড়ির মত চাপ-চাপ কালচে রক্ত কিছু কিছু ছড়িয়ে আছে কাঁচা হলুদ রঙের কাঁচুলির ওপর। আর একটি রক্তের ধারা নেমে গেছে বুক থেকে কোলের শাড়ির ওপর। সুতপা বোধ করি মারা যাওয়ার আগে আর্শির সামনে বসে মেকআপ তুলছিল। মুখের অনেকখানি রং তোলা। এক পাশের আঁকা ভুরু মুছে গেছে। রং-করা ঠোঁট দুটো অল্প খোলা, বড় বড় স্থির চোখের তারায় এখনও আতঙ্ক।

কাছে এসে প্রতুল ভাল করে দেখলে। সুতপার বয়স তিরিশের মধ্যে। বিশেষ কিছু বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ল না। শুধু পাউডারের কৌটোটা উল্টে আছে, আর রং মোছা তোয়ালেটা চেয়ারের নিচে পড়ে। মেকআপ টেবিলের একপাশে সুতপার নিজস্ব ছোট একটা অ্যাটাচি কেস পড়ে ছিল।

প্রতুল সেটা খুললে। বারান্দা থেকে আনন্দমোহন বললেন, ওটা ভাল করে দেখুন, যা কিছু কাজের জিনিস ওর মধ্যেই আছে।

অ্যাটাচির মধ্যে রুমাল, কিছু খুচরো টাকা, সেফটিপিন, চুলের কাঁটা আর লবঙ্গ-এলাচের সঙ্গে ছোট একটা শিশি আর একখানা বই পাওয়া গেল। শিশিটা দেখে প্রতুলের চিনতে দেরি হল না। বইখানার নাম ‘পরলোকের কথা’।

অ্যাটাচি বন্ধ করে বেরিয়ে আসবার আগে হঠাৎ প্রতুলের চোখ পড়ল আবছা অন্ধকারে ঘরের কোণে একটা পুরোন কাঠের বাক্সের পাশে। সেখান থেকে কি একটা নিয়ে প্রতুল পকেটে ভরে ফেলল। তারপর বেরিয়ে এসে দাঁড়াল বারান্দায়।

আনন্দমোহন জিজ্ঞাসা করলেন, দেখলেন?

দেখলাম।

কি মনে হয়?

আপনি কি বুঝছেন? প্রতুল প্রশ্ন করলে।

এর আর বোঝাবুঝি কি! পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল কেস অভ সুইসাইড। যার বাক্সে বিষের শিশি আর ‘পরলোকের কথা’ থাকে, সে মেয়ে যে মরবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

শান্ত স্বরে প্রতুল বললে, হতে পারে। কিন্তু সুতপা আত্মহত্যা করেনি।

দুটো গলা থেকে একসঙ্গে আওয়াজ বেরোল, তার মানে?

আর, বলেই আনন্দমোহন আর দুর্লভ দত্ত একসঙ্গে হেঁচে ও কেশে ফেললেন।

প্রতুল ধীরে-সুস্থে তার পাইপ ধরাল। তারপরে বললে, নিচে যাওয়া যাক, চলুন।

স্টেজের ভেতর একটা বাগানের সেট পাতা ছিল। তারই একটা বেঞ্চিতে আনন্দমোহনকে নিয়ে প্রতুল এসে বসল। দুর্লভ দত্ত বসলেন না। মানসিক উদ্বেগের জ্বালায় আলমগীরের মত দুই হাত পেছনে মুঠো করে গোটা স্টেজময় চক্কর দিতে লাগলেন।

আনন্দমোহন বললেন, আপনি তাহলে বলতে চান, সুতপা নিজে খুন হয়নি, কেউ তাকে খুন করেছে?

পাইপ টানতে টানতে প্রতুল বললে, তাই তো মনে হয়।

খুন!—বলে, দুর্লভ দত্ত অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আলমগীর যেন সহসা শাজাহানের মত পঙ্গু হয়ে গেল। মিনিটখানেক হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকে দুর্লভ কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে উঠলেন, এ কি সর্বনেশে কথা বলছ ভাই প্রতুল? আমার থিয়েটারে খুন! হায়, হায়, পোড়ারমুখী আমাকে খুন করে গেল? কাল বাদ পরশু আমার দুশো নাইটের—

দুর্লভ দত্ত যথারীতি বিষম খেলেন।

আনন্দমোহন কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। তারপর পেঁচার মত মুখ করে ভারী গলায় বললেন, দেখুন প্রতুলবাবু, দু-দশটা কেস আপনি নির্ভুল ডিটেকশন করেছেন বটে, নামও হয়েছে। কিন্তু আমিও আনন্দমোহন—খুন-জখম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আমারও চুল পাকল। স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, মেয়েটা নিজের বুকে নিজেই ছুরি বসিয়েছে। আর আপনি বলে দিলেন কেউ তাকে খুন করেছে!

নির্বিকার ভাবে প্রতুল জবাব দিলে, বেশ তো, আপনি আত্মহত্যা বলেই রিপোর্ট দিন না। আমার ভুলও তো হতে পারে। আসি ভাই দুর্লভ।

প্রতুল উঠে দাঁড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দমোহন তার হাতখানা খপ করে ধরে বললেন, বসুন, বসুন। প্রতুল লাহিড়ী ভুল করবে বললেই হল কিনা, আপনাকে কি আমি চিনি না ভাই—

আনন্দমোহনের গলার সুর পাল্টে গেল। অমায়িক অন্তরঙ্গতায় তাঁর মুখের পেঁচা-ভাবও এক মুহূর্তে উবে গেল। প্রতুলকে বসিয়ে তিনি বললেন, আপনি যখন বলছেন সুতপাকে কেউ খুন করেছে, তখন একটা প্রমাণ নিশ্চয় পেয়েছেন?

পাইপ মুখে প্রতুল বললে, তা পেয়েছি।

গলা নামিয়ে আনন্দমোহন প্রশ্ন করলেন, কি? তারপর দুর্লভের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে-পিঠে কেউ নেই তো?

আজ্ঞে না। যারা আছে তারা সব ওই একতলার সাজঘরে জটলা করছে।

আনন্দমোহন এবার প্রতুলের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন।

পাইপটা নিভে গিয়েছিল। মুখ থেকে নামিয়ে প্রতুল বললে, ছোরাটা সুতপার বুকের কোন্‌খানে বিঁধে আছে লক্ষ্য করেছেন কি?

করেছি। বাঁ-দিকের পাঁজর ঘেঁষে। হার্ট নির্ঘাৎ ফুটো হয়ে গেছে মনে হয়।

ছোরাটা সে ধরে আছে কোন হাতে?

বাঁ-হাতে।

প্রতুল হঠাৎ দুর্লভকে জিজ্ঞাসা করলে, সুতপা কি বাঁ হাতেই বেশির ভাগ কাজ-কর্ম করত?

জবাব এল, না তো।

প্রতুল বললে, স্বভাবতই মানুষের ডান হাতের চেয়ে বাঁ হাতটা কমজোরী হয়ে থাকে। সুতরাং একটা মেয়ের পক্ষে অনভ্যস্ত বাঁ হাতে ছোরা ধরে বুকে বসাতে গেলে স্বভাবতই ছোরাটা বিঁধবে ডান দিক ঘেঁষে, তাই না আনন্দবাবু?

চিন্তিত মুখে আনন্দমোহন বললেন, তাই।

তাহলে কি এটাই বোঝা যাচ্ছে না যে ছোরাটা আর কেউ সুতপার বুকে বিঁধিয়ে দিয়ে, তারই একখানা হাতের মুঠোয় বাঁটটা ধরিয়ে দিয়েছে?

আনন্দমোহনের মুখ থেকে কোন কথাই বেরোল না। আর, দুর্লভ দত্ত একটা হৃদয়-বিদারক শব্দ করে উঠলেন, ওঃ!

ছোরাটা যেন তাঁরই হৃদয় বিদীর্ণ করেছে।

প্রতুল বললে, কিন্তু অধিকাংশ খুনীই যেমন একটা-না-একটা ভুল করে বসে, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

অর্থাৎ সুতপার বাঁ হাতের মুঠোয় ছোরাটা ধরিয়ে দেওয়াই তার ভুল হয়েছে।

প্রতুল হাসি মুখে বললে, ঠিক তাই।

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর দুর্লভ দত্ত হঠাৎ থিয়েটারি ভাষায় ককিয়ে উঠলেন, কিন্তু কে—কে এই নরাধম নারীহন্তা?

হাসি চেপে প্রতুল বললে, তুমি উত্তেজিত হয়ো না দুর্লভ, এখুনি বিষম খাবে। আনন্দবাবু পাকা লোক—খুনীকে উনিই ধরে ফেলবেন ঠিক।

মুরুব্বিচালে আনন্দমোহন দুর্লভকে অভয় দিলেন: ঘাবড়াবেন না, কালই জানতে পারবেন নরহন্তাটি কে। ছোরাখানার বাঁটে খুনীর আঙুলের ছাপ নিশ্চয় লেগে আছে, তারপর ধরে ফেলতে আর কতক্ষণ!

পাইপটা নতুন করে ধরাতে ধরাতে খুব সহজেই প্রতুল বললে, ছোরার বাঁটে সুতপা ছাড়া আর কারুর আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আনন্দবাবু। খুনী এত বোকা নয় যে, আপনার জন্যে তার স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাবে।

আনন্দমোহন কেমন থতিয়ে গেলেন: কেমন করে আপনি জানলেন?

প্রতুল বললে, সহজ বুদ্ধি দিয়ে। একটা ভরা থিয়েটারের মধ্যে খুন করবার সাহস যে রাখে, সে যে অত্যন্ত চতুর সন্দেহ নেই। সে শুধু নিজের আঙুলের ছাপ সম্পর্কে সতর্ক হয়নি, খুনটাকে আত্মহত্যা বলে প্রমাণ করবার চেষ্টাও করে গেছে।

আনন্দমোহন শুধু উচ্চারণ করলেন, হুম্।

কোনও কথাই তিনি আর বললেন না। প্রতুল চুপচাপ পাইপ টানতে লাগল। আর দুর্লভ দত্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ময়াল সাপের মত ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন।

মিনিট তিনেক পরে আনন্দমোহন বললেন, তাহলে কি করা যায় বলুন তো?

তাঁর গলার আওয়াজটা এবার তেমন জোরালো শোনাল না।

দুর্লভ দত্ত এবার প্রতুলের একখানা হাত সাপটে ধরে সকাতরে বলতে লাগলেন, তুমি আমাকে বাঁচাও ভাই প্রতুল। আমার জানমান তোমারই হাতে সঁপে দিলুম—দয়া করে বল, সুতপাকে কে খুন করেছে?

প্রতুল শশব্যস্তে বলে উঠল, আরে, কি কর দুর্লভ! কে খুন করেছে আমি তার কি জানি।

গলা কাঁপিয়ে দুর্লভ বললেন, তুমি যদি না জানবে তো জানবে কে? তোমার মত গোয়েন্দা ইচ্ছে করলেই জানতে পারে—তুমি বাংলার শার্লক হোমস—দয়া করে তুমি বলে দাও খুনী কে, আমি তোমার স্বর্ণমূর্তি গড়ে পূজা করব!

প্রাণের আবেগে দুর্লভ প্রতুলের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। আশ্চর্যের কথা, কাশতে তিনি ভুলে গেলেন।

বিব্রত হয়ে প্রতুল বলে উঠল, তুমি কি পাগল হলে দুর্লভ?

এখনও হইনি, তবে হতে আর দেরি নেই। কাল বাদ পরশু আমার ‘রাহুর প্রেম’-এর দুশো নাইট—হায় হায়, থিয়েটার আমার ডুবল প্রতুল।

দুর্লভ দত্তের নাটুকেপনার মধ্য দিয়ে এমন একটা আর্ত ব্যাকুলতা ফুটে উঠল, যেটা প্রতুলের কাছে ঠিক কৌতুককর বলে মনে হল না। সহানুভূতির সঙ্গে সে বলতে লাগল, ওঠো দুর্লভ, উঠে পড়। তোমার স্টাফ দেখলে কি ভাববে? এই খুনের একটা কিনারা করার চেষ্টা আমি করব, কথা দিচ্ছি।

আনন্দমোহন বীরদর্পে বলে উঠলেন, আমিও কথা দিচ্ছি, খুনীকে প্রতুলবাবু ধরতে পারলেই তাকে নির্ঘাৎ ফাঁসিকাঠে লটকে দেব।

আশায় বুক বেঁধে দুর্লভ দত্ত উঠে দাঁড়ালেন। এবং নতুন করে বুকে চাদর বাঁধলেন। যেন ফরাসডাঙ্গার জরিপাড় চাদরটাই তাঁর আশা।

প্রতুল বললে, বস দুর্লভ। তোমার কাছ থেকে আমার কিছু জানবার আছে।

উইংসের পাশ থেকে একটা টুল এনে দুর্লভ বসলেন প্রতুলের সামনে।

প্রতুল প্রশ্ন করলে, তোমার এই পার্ল থিয়েটারে সুতপা কতদিন কাজ করছে?

দুর্লভ বললে, বছর তিনেক।

খুবই আশ্চর্য! নামকরা নটনটীরা কোনও থিয়েটারেই তো ছ’ মাসের বেশি টিকে থাকেন না। পিংপংয়ের বলের মত ক্রমাগতই এ-থিয়েটারে ও-থিয়েটারে ঘুরে বেড়ান।

দুর্লভ সখেদে বললেন, সুতপার সঙ্গে আমাদের পাঁচ বছরের কনট্র্যাক্ট ছিল। দুটো বছর সে ফাঁকি দিয়ে পালাল।

প্রতুল বললে, পাঁচ বছর! এত লম্বা চুক্তির কারণ?

দুর্লভ বললেন, তোমাদের আশীর্বাদে থিয়েটারের আর্টিস্ট চরিয়ে ঘুণ হয়ে গেছি। সুতপা থিয়েটারে জয়েন করার তিন মাসের মধ্যেই বুঝতে পারলাম মেয়েটা খাঁটি সোনা। কেবল ঘষে-মেজে নিতে পারলেই হয়। করে ফেললুম পাঁচ বছরের চুক্তি। জানো তো থিয়েটারে হিরোইনের কিরকম আকাল! ওই ছুঁচো ডায়মণ্ড সরকার—

ডায়মণ্ড সরকার! প্রতুল অবাক হয়ে বললে।

আহা, ওই দাশু সরকার—ডায়মণ্ড থিয়েটারের মালিক। ব্যাটা আমাকে পার্ল দত্ত বলে কিনা। ওই সরকার সুতপাকে ভাঙাবার কম চেষ্টা করেছে! কিন্তু সুতপা তেমন মেয়েই নয়। বললে, দত্ত মশায় আমাকে প্রথম চান্স দিয়েছেন, তাঁকে ছেড়ে যাব না, পাঁচ হাজার টাকা দিলেও না।

বটে! কত মাইনে পেতো সুতপা?

এখন ষোলশ পাচ্ছিল। আসছে বছর থেকে দু’ হাজার হত।

দুর্লভ দত্তের চোখে প্রায় জল এসে পড়ল। বললেন, কাল বাদে পরশু দুশো নাইট প্লেতে সোনার মেডেল নেবে, আর আজ কিনা সব শেষ হয়ে গেল!

প্রতুল প্রশ্ন করল, সুতপা কেমন মেয়ে ছিল দুর্লভ?

নির্জলা চরিত্র।

কুমারী না বিবাহিতা?

বিবাহিতাও বটে, আবার কুমারীও বটে।

মানে?

স্বামীর সঙ্গে সুতপার ছাড়াছাড়ি। তাই বলে তার কোনও বেচাল ছিল না। কোনও পাড়াতুতো দাদা, কাকা বা মামাকে কোনও দিন সঙ্গে দেখিনি।

সহকর্মীদের সঙ্গে তার ব্যবহার কি রকম ছিল?

ভালই। সবাই তাকে পছন্দ করত।

সবাই! কারও সঙ্গে কোন অসদ্ভাব ছিল না? মনে করে দেখ তো?

দুর্লভ বললেন, সে-ক্লাসের মেয়েই নয় সুতপা। কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয়, শিক্ষিতা মেয়ে সে, ভালই জানত।

প্রতুল কিছুক্ষণ নীরবে পাইপ টানল।

আনন্দমোহন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কিছু দেখবার নেই তো প্রতুলবাবু? লাশ পোস্টমর্টেমে পাঠাবার ব্যবস্থা করি তাহলে?

প্রতুল বললে, করুন।

আনন্দমোহন উঠে গেলেন। প্রতুল দুর্লভের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ঘটনাটা কখন জানতে পেরেছিলে?

পৌনে দশটা নাগাদ।

প্লে তখন শেষ হয়েছিল?

সবেমাত্র শেষ হয়েছে।

সুতপার কাজ কি শেষ অবধি থাকে?

না। লাস্ট সিনের আগেই ওর কাজ ফুরিয়ে যায়।

ঘটনাটা প্রথমে কে জানতে পারে?

মহীতোষ।

মহীতোষ কে?

‘রাহুর প্রেমে’ হিরোর পার্ট করে। সেও থিয়েটারে আছে প্রায় বছর দেড়েকের ওপর।

মহীতোষ কত পায়?

বারোশ।

কেমন লোক?

যেমন আর-পাঁচটা অ্যাক্টর হয়। তবে একটা দোষ আছে মহীতোষের, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ছোঁক-ছোঁক করে। সুতপার ওপর ভয়ানক ঝুঁকেছিল। কিন্তু সে-গুড়ে বালি। সুতপা আমায় বলে, মহীতোষবাবুর সঙ্গে আর সে প্লে করবে না। শুনে আমি মহীতোষকে আচ্ছা করে কর্‌কে দিয়েছিলুম। পরে শুনেছিলুম, সুতপাকে ও নাকি শাসিয়েছিল ‘দেখে নেবে’। কিন্তু ওই অব্দি; সাহসে আর কুলোয়নি।

পাইপটা মুখ থেকে নামাল প্রতুল: তবে যে বললে, সুতপার সঙ্গে কারুর অসদ্ভাব ছিল না?

দুর্লভ বললেন, সে তো ছ’ মাস আগেকার কথা। সে সব চুকেবুকে গেছে।

এই ছ’ মাসের মধ্যে দুজনের ব্যবহার কেমন ছিল?

ছ’ মাসের মধ্যে পাঁচ মাস তো সুতপা থিয়েটারেই আসেনি।

কেন?

ওর পেটে গ্যাসট্রিক আলসারের মত হয়েছিল, তাই ছুটি নিয়ে হাওয়া-বদল করতে গিয়েছিল রাঁচীতে।

ও! তাহলে ওই পাঁচ মাস কি অন্য বই প্লে হয়েছিল?

অন্য বই হবে কেন, ‘রাহুর প্রেম’ই হয়েছিল। মল্লিকাকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছিলাম।

মল্লিকা! সে কে?

আমার থিয়েটারের পুরোন অ্যাকট্রেস হরিলক্ষ্মী—তারই মেয়ে। বছরখানেক ঢুকেছে। ভদ্র ঘরের মেয়ে। বেশ পার্টস আছে মেয়েটার। রাহুর প্রেমে যে-ক’দিন হিরোইন সেজেছিল, সুতপার মত না হলেও লোকে ভালই বলেছিল। তবে সুতপার সঙ্গে তুলনা হয় না। সে ছিল বাংলা থিয়েটারের নাট্য-ভিক্টোরিয়া। পার্ল থিয়েটারের লক্ষ্মী।

ফরাসডাঙ্গার চাদর দিয়ে দুর্লভ চোখ মুছলেন।

প্রতুল বললে, তাই তো দুর্লভ, সুতপা সত্যিই তোমাকে ডুবিয়ে গেছে দেখছি। এখন কি করবে ভাবছ? রাহুর প্রেম বন্ধ করে দেবে?

দুর্লভ বললে, বন্ধ চট করে করা যাবে না ভাই। বইখানা খুব জমে গেছে, আরও একশো রাত্রি টানবে বলে মনে হয়। অথচ—কি যে করি! এখন মল্লিকাই ভরসা।

মল্লিকা এটা বোঝে নিশ্চয়?

তা কি আর বোঝে না। এই তো কিছুদিন আগেই আমাকে বলেছিল, ঠেকার সময় থিয়েটার চালাতে আমরা, আর মোটা মাইনের বেলায় সুতপা! আপনাদের বেশ বিচার ছোটবাবু!

কেমন মেয়ে এই মল্লিকা?

মেয়েটা বড় বদমেজাজী, কথাও বড় ক্যাঁটকেঁটে।

সুতপার সঙ্গে ব্যবহার কেমন ছিল?

মনে কি ছিল জানি না, তবে মুখে তো ভাব-সাবই ছিল।

প্রতুল একটু নড়ে-চড়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা দুর্লভ, দোতলায় তিনটে মেকআপ রুম, নয়?

হ্যাঁ।

একটা তো সুতপার জন্যে ছিল, আর বাকি দুটো কে কে ব্যবহার করে?

সুতপার ঠিক পাশের ঘরটাই হল মহীতোষের। আর তারই পাশে একেবারে সিঁড়ি-মুখে যে বড় সাজঘরটা, সেখানে সাজে মল্লিকা, রেবা, লতা আর হরিলক্ষ্মী।

মল্লিকা বাদে বাকি তিনজন কেমন মেয়ে?

রেবা ভারি ভালমানুষ আর লতাও খুব ঠাণ্ডা। আর হরিলক্ষ্মীর কথা ছেড়ে দাও। পঞ্চাশ পার হয়েছে, পুরোন লোক, তাই আজও জবাব দিইনি।

প্রতুল বললে, এবার দোতলার ক’জনকে একে একে ডাকো। দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই। আনন্দবাবুকে ডেকে আনো।

প্রথমে কাকে ডাকব?

মহীতোষকে।

মহীতোষ এল। লম্বা-চওড়া সুপুরুষ চেহারা। কিন্তু চোখের কোলে উজ্জ্বলতার চিহ্ন। প্রতুলের চোখ এড়ালো না। দেখতে তরুণ হলেও ভাল করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, মহীতোষের বয়স হয়েছে। চুনট করা ধুতির কোঁচা হাতে ধরে, গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে, পেটেন্ট লেদারের জুতো মসমসিয়ে প্রতুলের সামনে এসে দাঁড়াল সে। একটু উদ্ধত ভঙ্গিতে বললে, নমস্কার। ডেকে পাঠিয়েছেন কেন?

প্রতুল বললে, আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই মহীতোষবাবু।

তার আগে আমি জানতে চাই, আমাকে এতক্ষণ আটকিয়ে রেখেছেন কোন অধিকারে?

মৃদু হেসে শান্ত গলায় প্রতুল বললে, যে অধিকারে রাস্তার একজন কনস্টেবল লাটসাহেবের গাড়ি আটকিয়ে রাখতে পারে।

মহীতোষ ভুরু কোঁচকাল: অর্থাৎ!

অর্থাৎ পুলিশী অধিকারে।

মহীতোষের গলার স্বর একটু নরম হল। নিজের সোনার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, আমার একটা জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে স্যার। যা জিজ্ঞেস করার একটু চটপট করলে বাধিত হব।

সুতপাকে মৃত অবস্থায় আপনিই প্রথম দেখেন?

আমি প্রথম কিনা জানি না, তবে দেখেছিলাম।

ক’টার সময়?

ন’টা পঁয়তাল্লিশে আমাদের প্লে ভাঙে, ঠিক তার পরেই।

সুতপার সাজঘরে আপনি গিয়েছিলেন কেন?

মেকআপ তোলবার ক্রীমটা আমার ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই ওরটা চাইতে গিয়েছিলাম।

গিয়ে কি দেখলেন?

নিজের বুকে ছোরা বিঁধিয়ে সুতপা কাৎ হয়ে বসে আছে।

দেখে আপনি কি করলেন?

তাড়াতাড়ি নেমে এসে দত্তমশাইকে জানাই।

ছোরাটা আপনার?

রুক্ষ গলায় মহীতোষ বললে, কি বলতে চান আপনি?

প্রতুল বললে, চটছেন কেন। জিজ্ঞেস করছি ছোরাটা কার?

থিয়েটারের!

আপনি কখনও ব্যবহার করেননি?

করেছি বৈকি। ব্যবহার করেছি। লাস্ট-সিনের আগের সিনে এই ছোরাটা নিয়েই আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকি।

আজও ছোরাখানা ব্যবহার করেছিলেন বোধ হয়?

করেছিলাম।

তারপর কোথায় রেখেছিলেন?

আমার মেকআপ রুমে।

সুতপা তখন তার মেকআপ রুমে ছিল?

বলতে পারি না। আমি দু’ মিনিটের মধ্যেই নেমে এসেছিলাম, লাস্ট সিনের গোড়াতেই আমার অ্যাপিয়ার।

লাস্ট সিনে সুতপা অ্যাপিয়ার হত?

না, ওর কাজ আগের সিনেই শেষ। আর কিছু জানবার আছে?

মহীতোষ একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল।

প্রতুল বললে, আচ্ছা মহীতোষবাবু, শুনেছি সুতপার সঙ্গে একসময় আপনি ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছিলেন। এবং সে-সুযোগ সে দেয়নি বলে ‘দেখে নেবো’ বলে তাকে শাসিয়েছিলেন। একথা কি সত্যি?

মহীতোষের মুখের চেহারাটা দপ্ করে নিভে গেল। তবু ঝাঁঝালো গলায় সে বললে, ওসব পার্সোনাল কথার জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। আমার তাড়াতাড়ি আছে, চললাম।

প্রতুল বললে, বেশ। তাড়াতাড়ি থাকে তো আপনাকে আটকাবো না। কিন্তু নাকের পাশে এখনও রং লেগে রয়েছে যে! মুছে ফেলুন।

পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বার করে নাকটা মুছতে মুছতে মহীতোষ চলে গেল।

এর পর ডাকা হল মল্লিকাকে।

বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি হবে না। বেশভূষায় আলোকপ্রাপ্তা হলেও চেহারার মধ্যে যে ছাপ রয়েছে, সেটাকে ঠিক ভদ্রজীবনের ছাপ বলা চলে না। মেকআপ তোলার পরেও চোখের কাজল, ঠোঁটের রং, ফাঁপানো খোঁপা আর বাঁ গালের নিচে আঁকা তিলটি তার প্রমাণ। শরীরে যৌবনের প্রগলভতা আছে, কিন্তু কমনীয়তা নেই। পুলিশের সামনে এসে দাঁড়াতে খুব যে ভয় পেয়েছে, তার ভঙ্গি দেখে মনে হল না।

প্রতুল জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম মল্লিকা?

উত্তর এল: মল্লিকা ঘোষ।

প্রতুল ভুলেই গিয়েছিল যে আজকাল এদেরও একটা-না-একটা পদবী থাকে।

‘রাহুর প্রেম’ বইতে তোমার কাজ কখন শেষ হয়?

আমার কাজ দ্বিতীয় অঙ্কেই শেষ।

তারপর চলে যাও, না থাকো?

মল্লিকা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল; যাব কেমন করে? থিয়েটারের মালিকরা কি আমার জন্যে আলাদা গাড়ি দেয়? সকলের সঙ্গে এক গাড়িতেই যেতে হয়।

এতক্ষণ কি কর?

কি আর করব! চা খাই, পান খাই, গল্পগুজব করি।

দ্বিতীয় অঙ্কের পর আজ তুমি কি করছিলে?

সাজঘরে বসে তাস খেলছিলাম।

দোতলায়?

মল্লিকা ঘাড় নাড়লে।

কার সঙ্গে?

একা একা।

পাঁচজনের সঙ্গে তুমি বড়-একটা মেলামেশা কর না, না?

না।

তবে যে বললে, কাজ শেষ হয়ে গেলে তুমি গল্পগুজব কর? সে তো একা একা হয় না!

সকলের সঙ্গে গল্প করতে ভাল লাগে না।

আচ্ছা মল্লিকা, সুতপা যে খুন হয়েছে, তুমি কি করে জানতে পারলে? ঘরে গিয়ে দেখেছিলে?

মল্লিকা ঝাঁঝিয়ে জবাব দিল, ঘরে যাব কেন! খুন দেখবার অত শখ আমার নেই। মহীতোষবাবু চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে সাজঘর থেকে নিচে নেমে গেলেন, তাই তো জানলাম।

ও! তুমি কোথায় ছিলে?

নিচে।

কি করছিলে?

পান আনতে দেব বলে রামটহলকে ডাকছিলাম।

এই যে বললে, দোতলায় তাস খেলছিলে?

খেলছিলাম তো। খানিক পরে নিচে গিয়েছিলাম।

প্রতুল বললে, তুমি এখানে কত মাইনে পাও মল্লিকা?

মল্লিকা বললে, সে জেনে আপনার কি লাভ?

আনন্দমোহন ধমকে উঠলেন: যা জিজ্ঞেস করছেন, ঠিক-ঠিক জবাব দাও।

মল্লিকা মুখ গোঁজ করে বললে, তিনশো।

সহানুভূতির স্বরে প্রতুল বললে, মোটে! তুমি তো সবরকম পার্টই করতে পারো শুনেছি, তোমাকে আরও বেশি দেওয়া উচিত।

মল্লিকা চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, আমরা তো চুনোখুঁটি থিয়েটারের মালিকদের কাছে। আমাদের আর দর কি বলুন? অথচ গলায় কাঁটা আটকালে এই মল্লিকা ছাড়া গতি নেই।

মল্লিকা বাঁকা চোখে দুর্লভ দত্তের দিকে বিষ-কটাক্ষ হানল।

দুর্লভ দত্ত চটে উঠে বললেন, অত দেমাক করিস নে মল্লিকে। যা না ওই ছুঁচো ডায়মণ্ড সরকারের থিয়েটারে—দেখ না কত টাকা দেয়?

কঠিন ভঙ্গিতে মল্লিকা বললে, বেশ, তাই যাব। কাল থেকে আর গাড়ি পাঠাবেন না। আসি তাহলে।

ছোট্ট একটা নমস্কার করে মল্লিকা পেছন ফিরল।

প্রচণ্ড ক্ষোভের সঙ্গে দুর্লভ দত্ত বললেন, তোরা এমনিই বেইমান বটে। কাল বাদে পরশু দুশো নাইট—বাগে পেয়ে আমাকে টাইট দিচ্ছিস, তা কি আর আমি বুঝি না! বেশ, এখুনি তোর সঙ্গে বোঝাপড়া করব—দাঁড়া···

আনন্দমোহন আবার ধমক দিলেন: থামুন মশাই, আগে পুলিশের বোঝাপড়া হোক! এখন ঝামেলা করলে দলকে দল চালান করে দেব।

থতমত খেয়ে দুর্লভ বলে উঠলেন, নাও কথা! ঝামেলা আমি করছি, না ওই হাড়-জ্বালানি—

এতক্ষণ পরে দুর্লভ আবার কেশে ফেললেন।

মল্লিকার দিকে চেয়ে নরম গলায় প্রতুল বললে, তুমিই বা এত রাগারাগি করছ কেন মল্লিকা? সুতপা নেই, হিরোইনের পার্ট যে এখন তোমারই, তা তো তুমি জানো।

দুর্লভের প্রতি আবার একবার বিষ-কটাক্ষ হানলে মল্লিকা। বললে, ওনাদের চেনেন না আপনি, ওনাদের মর্জি হলে রাতারাতি দশটা মল্লিকা জোগাড় করে আনবে।

প্রতুল হাসি মুখে বললে, তা কখনও হয়, হিরোইনের পার্ট যে পাঁচ মাস ধরে তোমারই করা। তাছাড়া—হিরোইন সাজবার উপযুক্ত চেহারা নিয়ে তুমি জন্মেছো—কিন্তু ওটা কি হয়েছে? কুমকুমের টিপটা অমন বেঁকে আছে কেন? মুছে ফেলো—

তাই নাকি! ব্লাউজের ভেতর থেকে সুদৃশ্য একখানা রুমাল বার করে মল্লিকা টিপটা মুছে ফেলল।

তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে প্রতুল বললে, এবার তুমি যেতে পারো মল্লিকা।

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মল্লিকা চলে গেল।

আনন্দমোহন প্রশ্ন করলেন, আর কে আছে?

দুর্লভ বললে, রেবা আর লতা।

ডাকুন।

রেবা আর লতা এল চোখের জলে ভাসতে ভাসতে। ভয়ে ভাবনায় একেবারে জড়সড়, ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছে।

রেবার মোটাসোটা থলথলে চেহারা। লতাকে লতা না বলে কঞ্চি বলাই ভাল। দুজনেরই বয়স চল্লিশ ছোঁয়-ছোঁয়। সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরনে, মাথায় সিঁদুর। রেবার হাতে পানের ডিবে, লতার হাতে উল বোনার সরঞ্জাম।

আনন্দমোহন গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, যা জিজ্ঞেস করা হবে তার ঠিক-ঠিক জবাব দেবে। মিছে কথা বলার চেষ্টা করো না!

কি একটা বলতে গিয়ে রেবা তোতলা হয়ে গেল।

প্রতুল সাহস দিয়ে বললে, কোন ভয় নেই আপনাদের। দু-একটা প্রশ্ন ছাড়া আপনাদের পুলিশ আর কিছুই করবে না।

সাহস পেয়ে দুজনে চোখের জল মুছলে।

প্রতুল বললে, নিন আনন্দবাবু, যা জানতে চান জিজ্ঞেস করুন এঁদের।

আনন্দমোহন বললেন, কেন, আপনি?

এঁদের কাছে আমার কিছু জানবার নেই।

বেঞ্চির হাতলে পাইপটা ঠুকে ঠুকে প্রতুল পোড়া তামাক ফেলে দিতে লাগল।

রেবা আর লতার দিকে তাকিয়ে আনন্দমোহন একবার গলা খাঁকারি দিয়ে আওয়াজটা সাফ করে নিলেন। তারপর ভারিক্কী চালে প্রশ্ন করলেন, খুনের সময় তোমরা দুজনে কোথায় ছিলে? কি করছিলে?

লতা বললে, আমি স্টেজের পাশে পিয়ানোর টুলে বসে আমার খোকার সোয়েটার বুনছিলাম।

রেবা বললে, আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কচুরি আর আলুর দম খাচ্ছিলুম।

আনন্দমোহন ভুরু কুঁচকে বললেন, খুনটা কোন্ সময় হয়েছে বল তো?

দুজনে একসঙ্গে জবাব দিলে, প্লে ভাঙার পর।

কি করে জানলে?

বোকা-বোকা চোখে তাকিয়ে রেবা উত্তর দিলে, সবাই বলাবলি করছিল কিনা—

সুতপা কেমন মেয়ে ছিল? শুনেছি, স্বভাবটা তার ভয়ানক ঝগড়াটে ছিল?

জিব কেটে লতা বললে, ও-কথা বললে পাপ হবে। এই তো সেদিন আমার নাদুর অসুখ শুনে পাঁচটা টাকা আমার হাতে দিয়ে বললে, ফল কিনে দিও।

রেবা গদগদ স্বরে বললে, সত্যি, অমন মেয়ে আর হয় না! বাড়ি থেকে কত জিনিস এনে এনে খাওয়াত—ডিমের চপ, পটলের দোর্মা—

আনন্দমোহন ধমক দিয়ে উঠলেন, রাখ তোমার পটলের দোর্মা! সুতপার সঙ্গে কারুর ঝগড়া ছিল বলতে পার?

দুজনে একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলে। তারপর বললে, মহীতোষবাবুর সঙ্গে একবার ঝগড়া হয়েছিল।

হুম্! আচ্ছা, কি মনে হয় তোমাদের—সুতপাকে কেউ খুন করেছে?

ভয়ে-ভয়ে লতা বললে, তা হতে পারে।

না, সে আত্মহত্যা করেছে?

বোকা-বোকা চোখে চেয়ে রেবা বললে, তাই হবে।

আনন্দমোহন এবার কড়া ধমক দিয়ে উঠলেন, ঠিক করে বল?

কিছুই বলতে না পেরে রেবা হাপুস নয়নে কেঁদে ফেললে।

প্রতুল বললে, বড্ড ভয় পেয়েছেন—এবার নাহয় ওঁদের যেতে দিন।

মুখে রাজ্যের বিরক্তি মাখিয়ে আনন্দমোহন বললেন, যাও তোমরা। যত্ত সব—

আর কে বাকি রইল দুর্লভ? প্রতুল জিজ্ঞাসা করল।

হরিলক্ষ্মী।

আনন্দমোহন বলে উঠলেন, সে তো পঞ্চাশ বছরের বুড়ি। দুর্লভবাবুর চিড়িয়াখানার আর একটি জীব। কি হবে তাকে ডেকে?

তবু সবাইকে যখন দেখলেন, তাকেও একবার দেখুন না। বলে প্রতুল তার পাইপে তামাক ভরতে লাগল।

বেশ, ডাকুন তাকে।

কোনও কোনও মানুষ যেমন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলে, দুর্লভ দত্তর পিছু পিছু হরিলক্ষ্মী তেমনিভাবে এসে দাঁড়াল।

বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে বলে মনে হয়। শুকনো চেহারা হলেও হাড়গুলো মোটাসোটা। রং বোধ হয় এককালে ফর্সাই ছিল, এখন তামাটে, মুখের চামড়া কোঁচকানো। পরনে থান, দু’হাতে একগাছা করে ভারী চুড়ি, বোধ হয় কেমিকেলের। ডান হাতে হরিনামের ঝুলি। চক্ষু দুটি শিবনেত্র হয়ে আছে।

আনন্দমোহন বললেন, এর এমন তুরীয় অবস্থা কেন?

দুর্লভ বললেন, সন্ধ্যের পর রোজ একটু আফিমের অভ্যেস আছে কিনা। বলি আজ বেশি খেয়ে ফেলেছ নাকি?

হরিলক্ষ্মী যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, আমায় কিছু বলছেন বাবা?

বলছি, মাত্রাটা আজ বেশি হয়েছে নাকি?

হরিলক্ষ্মী হাসল। সামনের দুটো দাঁত নেই। বার্ধক্য তার মুখখানাকে শ্রীহীন করলেও হাসিটা শিশুর মতই নির্মল। হেসে বললে, ভুলে দু’ বার খেয়ে ফেলেছি। গোবিন্দ! গোবিন্দ!

বড় কাজই করেছ!—আনন্দমোহন তেতো মুখে বললেন, হরিনামের ঝুলি নিয়ে এ তো এখন বৈকুণ্ঠে বাস করছে, একে আর জেরা করে লাভ কি? যাও তুমি বাছা!

হরিলক্ষ্মী তেমনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এক-পা এগোতেই প্রতুল বললে, দাঁড়ান। আমি দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

হরিলক্ষ্মী বললে, বেশ তো বাবা, জিজ্ঞেস কর।

আপনি কতদিন থিয়েটারে আছেন?

ঝিমিয়ে পড়া স্বরে হরিলক্ষ্মী বললে, তা প্রায় তিরিশ বছর হবে।

এখন মাইনে পান কত?

একশ টাকা। জবাব হয়ে যেত, কেবল দত্ত মশায়ের দয়ায় টিকে আছি।

আফিম ধরেছেন কতদিন?

বছর দশ-বারো আগে একবার আমাশায় ধরেছিল, কিছুতেই আর সারে না, ধরেছি সেই তখন থেকে—

রোজই খান?

নিত্যি। না খেলে চলে না বাবা, পেটটা খারাপ করে।

কই, আপনার আফিমের কৌটো?

হরিলক্ষ্মী আঁচল থেকে ছোট একটি টিনের কৌটো বার করে দেখাল, এই যে বাবা—

হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে প্রতুল একবার খুলে দেখল। তারপর ফিরিয়ে দিয়ে বললে, আমার প্লাস্টিকের কারখানা আছে; একটা ভাল কৌটো পাঠিয়ে দেব’খন।

তেমনি শিশুর মত হেসে হরিলক্ষ্মী বললে, ভাল কৌটো নিয়ে আমার কি হবে বাবা, তা দিও, মল্লিকার কাজে লাগবে।

মল্লিকা আপনার নিজের মেয়ে, না মানুষ করেছেন?

না বাবা, আমার পেটের মেয়ে।

আর কোন ছেলেমেয়ে নেই।

ছিল আরও চারটি, গোবিন্দই তাদের নিয়েছেন। মল্লিকা আমার শিবরাত্তিরের সল্‌তে।

বেশ মেয়ে মল্লিকা, অভিনয়ও নাকি ভাল করে। এবার থেকে ওকে সুতপার জায়গায় নেওয়া হবে শুনলাম।

হরিলক্ষ্মী আধবোজা চোখ দুটো হঠাৎ একবার মিটমিট করে উঠল। বললে, সবই গোবিন্দের দয়া—

প্রতুল বললে, দুনিয়ায় এক-একটা মানুষ জন্মায়, যারা মরেও অপরের ভাল করে যায়। সুতপাও তেমন মেয়ে ছিল, তাই না?

হরিলক্ষ্মী তুড়ি দিয়ে একটা হাই তুললে। তারপর বললে, কার কথা বলছ বাবা, সুতপা? সে ছিল স্বর্গের দেবী। জোয়ান মেয়েটা চলে গেল আর আমি রইলাম পড়ে। এই কি গোবিন্দর ইচ্ছা—

হরিলক্ষ্মীর কাতর গলায় এমন একটা সকরুণ বেদনা ফুটে উঠল যে মিনিটখানেক কেউ কোন কথা বলতে পারলেন না।

প্রতুল একদৃষ্টিতে চেয়েছিল আফিমের নেশায় জবুথবু ওই বুড়ির হাতের দিকে। কি ভাবছিল সেই জানে।

আর একটা হাই তুলে হরিলক্ষ্মী বলে উঠল, গোবিন্দ! গোবিন্দ! এবার আমি যাব বাবা?

আনন্দমোহন বিরক্তমুখে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও তুমি বাছা। গোবিন্দর নাম শুনে আমাদের কোন লাভ হবে না।

প্রতুলের ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। বললে, আর দুটো মাত্র কথা আছে; আপনার ডান হাতের চুড়িগাছা অমন তেবড়ে বেঁকে গেল কি করে?

হরিলক্ষ্মী একবার নিজের হাতের দিকে তাকাল। মিটমিট করে উঠল তার শিবনেত্র। তারপর বললে, ঘরের কাজকর্ম সবই তো করতে হয় বাবা, পলকা চুড়ি, কখন ঠোকা লেগে বেঁকে গেছে, কে জানে—

ও! আচ্ছা, ‘রাহুর প্রেমে’ কোন্ পার্ট আপনি করেন?

হরিলক্ষ্মী বললে, হিরোইনের মামী।

মামী বিধবা না সধবা?

সধবা।

প্রতুল হেসে বললে, তা বুঝতে পারছি। মাথায় এখনও আপনার সিঁদুর লেগে রয়েছে, মুছতে ভুলে গেছেন বোধ হয়!

অত খেয়াল হয়নি বাবা।

থান কাপড়ের আঁচলটা দিয়ে হরিলক্ষ্মী সিঁথিটা মুছতে যাচ্ছিল, প্রতুল বললে, থান কেন, রুমাল দিয়ে মুছুন না—রুমাল নেই আপনার?

হরিলক্ষ্মীর হাতখানা এক মুহুর্তের জন্যে পাথরের মত অনড় হয়ে গেল। পরক্ষণেই দন্তহীন মুখে শিশুর মত সরল হেসে বললে, রুমাল তো আমি ব্যবহার করি না বাবা।

প্রতুলের মুখে সুকঠিন গাম্ভীর্য নেমে এল। স্থির দৃষ্টিতে হরিলক্ষ্মীর পানে তাকিয়ে বললে, ব্যবহার করেন না, না হারিয়ে ফেলেছেন? দেখুন তো, এই রুমালখানা চিনতে পারেন কিনা?

পকেট থেকে প্রতুল আধময়লা একটা রুমাল বার করলে। সস্তা লংক্লথের টুকরো, চারপাশ মুড়ে হাতে সেলাই করা। রক্তের ছিটে লাগা।

আনন্দমোহন আর দুর্লভ দত্ত স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন রুমালখানার দিকে। হরিলক্ষ্মীর শিবনেত্র থেকে হঠাৎ এক ঝলক আগুন বেরিয়েই স্তিমিত হয়ে গেল।

জড়ানো গলায় হরিলক্ষ্মী বললে, এ রুমাল তো আমার নয়!

প্রতুল বললে, মিছে কথা বলে আর লাভ নেই। ছোরা নিয়ে সুতপার ঘরে ঢোকার সময় এই রুমাল দিয়ে আপনি ছোরার বাঁট ধরেছিলেন। তারপর কাজ শেষ করে পালিয়ে আসবার সময় পাছে কারোর চোখে পড়ে, সেই ভয়ে রুমালখানা ওই ঘরেরই কোণে কাঠের বাক্সের পাশে ফেলে দিয়ে এসেছিলেন; তাই নয় কি, বলুন?

হরিলক্ষ্মীর আফিমের নেশা যেন উড়ে পালাল। মুখ হয়ে গেল ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে, সম্পূর্ণ খোলা চোখ দুটোয় ফুটে উঠল এক অদ্ভুত আতঙ্কের দৃষ্টি। কোন কথাই সে বলতে পারল না, থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল সে।

রুমালটা আনন্দমোহনের হাতে দিয়ে প্রতুল বললে, আমার কাজ শেষ হয়েছে। এবার আপনার কাজ।

দুর্লভ দত্ত এতক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলেন: হরি, তোর এই কাজ! ও! এতদিন কী কালসাপই পুষে রেখেছিলাম!

প্রবল উত্তেজনায় দুর্লভ কাশতে শুরু করলেন।

পরদিন সকালে উত্তর কলকাতার ডি-সি’র অফিসঘরে কথা হচ্ছিল।

আনন্দমোহন প্রশ্ন করলেন, হরিলক্ষ্মীকে আপনি সন্দেহ করলেন কি কারণে?

পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে প্রতুল বললে, সন্দেহটা প্রথমে হয় হরিলক্ষ্মীর আফিমের কৌটো দেখে। সরষের মত ছোট ছোট আফিমের বড়ি। দশ-বারো বছর ধরে যার আফিমের অভ্যেস, ওই বড়ি একটার বদলে দুটো খেলেও তার অতখানি নেশা হওয়ার কথা নয়। কাজেই বুঝতে পারলাম, হরিলক্ষ্মীর নেশাটা ভান। দ্বিতীয়বার সন্দেহ হল, তার ডান হাতের বেঁকে যাওয়া চুড়ি দেখে। ঘরের কাজ করতে গিয়ে যদি ঠোকাই লাগে, তাহলে বাঁ হাতের চুড়িও বেঁকে যেতে পারত; আসলে কিন্তু তা নয়। ছোরা নিয়ে সুতপাকে আক্রমণ করার মুহূর্তে সুতপা নিশ্চয় হরিলক্ষ্মীর ডান হাতখানা ধরে ফেলেছিল। এবং তারই মুঠোর চাপে ডান হাতের চুড়ি বেঁকে যায়।

কিন্তু রুমালটা যে হরিলক্ষ্মীর, এ বিষয়ে নিঃসংশয় প্রমাণ কি? প্রশ্ন করলেন ডি-সি।

প্রতুল বললে, রুমালটা আশা করি আপনারা ভাল করে লক্ষ্য করেছেন। রুমালখানার চারধার মুড়ে ফিকে সবুজ সুতো দিয়ে যে ধরণের সেলাই করা, হরিলক্ষ্মীর ব্লাউজের গলা আর হাত ঠিক সেই সুতো দিয়ে সেই ধরণের সেলাই করা।

গম্ভীর মুখে আনন্দমোহন বললেন, হুম্। কিন্তু হরিলক্ষ্মীর মোটিভটা কি?

মোটিভ মল্লিকা। সুতপাকে সরিয়ে দিতে পারলেই মল্লিকা পার্ল থিয়েটারের পারমানেন্ট হিরোইন হয়ে প্রচুর নাম আর মোটা মাইনে পাবে। তাই একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ সুখের জন্যেই হরিলক্ষ্মী তার পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছে। অন্ধ মাতৃস্নেহই তার খুনের প্রেরণা।

হুম্। আমিও ঠিক তাই ভেবেছিলুম প্রতুলবাবু। গ্রেট মেন থিঙ্ক—

আনন্দমোহন কথাটা শেষ করতে পারলেন না। কাল রাত জেগে ঠাণ্ডা লেগেছে, রুমাল বের করে সশব্দে হাঁচতে শুরু করলেন।

আর দুর্লভ দত্ত আবেগে প্রতুলের হাত দুটো চেপে ধরে, ‘তুমি বাংলার শার্লক হোমস্! তোমার স্বর্ণমূর্তি গড়ে আমি পূজা করব।’

বলেই প্রবলবেগে বিষম খেলেন।

আবার প্রতুলের সামনে কাশি, পেছনে হাঁচি।

অধ্যায় ৭৫ / ৭৫

সকল অধ্যায়

১. এই এক নূতন! – সুকুমার সেন
২. হরিদাসের গুপ্তকথা – ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
৩. চুরি না বাহাদুরি – নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত
৪. হত্যাকারী কে? – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
৫. কৃত্রিম মুদ্রা – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়
৬. হত্যারহস্য – দীনেন্দ্রকুমার রায়
৭. দিনে ডাকাতি
৮. বহুরূপী (বাঁকাউল্লার দপ্তর) – কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়
৯. চিঠিচুরি – পাঁচকড়ি দে
১০. বঙ্গের গুপ্তকথা – অম্বিকাচরণ গুপ্ত
১১. শোণিত-লেখা – অমূল্যচরণ সেন
১২. অদ্ভুত হত্যা – রজনীচন্দ্র দত্ত
১৩. গহনার বাক্স – জগদানন্দ রায়
১৪. ঘড়িচুরি – সরলাবালা দাসী (সরকার)
১৫. সখের ডিটেকটিভ – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
১৬. শঠে শাঠ্যং – চারু বন্দ্যোপাধ্যায়
১৭. অগাধ জলের রুই-কাতলা – হেমেন্দ্রকুমার রায়
১৮. চণ্ডেশ্বরপুরের রহস্য – মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য
১৯. কল্কেকাশির কাণ্ড – শিবরাম চক্রবর্তী
২০. সবুজ রঙের গাড়ি – মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়
২১. অচিন পাখি – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
২২. শেষ দৃশ্য – প্রণব রায়
২৩. জরাসন্ধ-বধ – মণি বর্মা
২৪. সার্জেন্ট মুখার্জি – হেমেন্দ্র মল্লিক
২৫. একটি চলে যাওয়া দিনের গুরুতর কাহিনী – সুকুমার দে সরকার
২৬. সঙ্কেত – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
২৭. রহস্যভেদ – আশালতা সিংহ
২৮. সন্দেহ – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
২৯. ভয়ঙ্কর ভাড়াটে ও পরাশর বর্মা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩০. স্বামীজী আর অনুকূল বর্মা – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
৩১. একটি খুন – বিধায়ক ভট্টাচার্য
৩২. ষড়যন্ত্র – গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৩. ঝাউবীথি—বেলা তিনটে – যজ্ঞেশ্বর রায়
৩৪. নীল তারা – পরশুরাম
৩৫. দুই ডিটেকটিভ, দুই রহস্য – পরিমল গোস্বামী
৩৬. নিরুদ্দিষ্ট – সুধাংশুকুমার গুপ্ত
৩৭. আর এক ছায়া – সমরেশ বসু
৩৮. আমার প্রিয়সখী – সন্তোষকুমার ঘোষ
৩৯. প্রেমলতার হাসি – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
৪০. ভোম্বলদাস অ্যান্ড কোম্পানি – মোহিতমোহন চট্টোপাধ্যায়
৪১. চিহ্ন – শ্রীধর সেনাপতি
৪২. নিহত একজন – আনন্দ বাগচী
৪৩. ছিপ – অদ্রীশ বর্ধন
৪৪. লাজ আবরণ – কৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৫. হাওয়াই চটির সন্ধানে – হিমানীশ গোস্বামী
৪৬. গোলোকধাম রহস্য – সত্যজিৎ রায়
৪৭. তদন্ত – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
৪৮. একটি লক্ষ্য, তিনটি খুন – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
৪৯. অন্তর্ধান – অমিত চট্টোপাধ্যায়
৫০. গুরুদাস খাসনবিশের মৃত্যু – তারাপদ রায়
৫১. আক্কেল দাঁত – গুরণেক সিং
৫২. গোয়েন্দা ও প্রেতাত্মা – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
৫৩. তিন খণ্ড হাড় – বীরু চট্টোপাধ্যায়
৫৪. মাণিকজোড় – শোভন সোম
৫৫. ত্রিশূলে রক্তের দাগ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
৫৬. রত্নাকরের রক্ত চাই – প্রবীরগোপাল রায়
৫৭. কুয়াংকারের মৃত্যু – মিহির দাশগুপ্ত
৫৮. রিপুসংহার – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
৫৯. রহস্যভেদী সদাশিব – মঞ্জিল সেন
৬০. গুরুবিদায় – নারায়ণ সান্যাল
৬১. প্রেম – মনোজ সেন
৬২. ডেডবডি – ইন্দ্রজিৎ রায়
৬৩. জানোয়ার – অমল রায়
৬৪. বিরাট ধোঁকা – কালীকিঙ্কর কর্মকার
৬৫. জগদ্দলের জগাপিসি – প্রদীপ্ত রায়
৬৬. খণ্ডপানা – সুকুমার সেন
৬৭. সদুঠাকুমার পিস্তল – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
৬৮. ছারপোকা – হিমাংশু সরকার
৬৯. বাঘের ঘরে – শেখর বসু
৭০. গোয়েন্দা বরদাচরণ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৭১. অনিন্দ্যসুন্দরের অপমৃত্যু – অনীশ দেব
৭২. পোড়া মোমবাতির রহস্য – সুভদ্রকুমার সেন
৭৩. হাবুল দারোগার গল্প – অত্রদীপ চট্টোপাধ্যায়
৭৪. দরজার ওপারে মৃত্যু – সিদ্ধার্থ ঘোষ
৭৫. রীতিমত নাটক – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন