বাংলাদেশের বিজয় দিবস

তসলিমা নাসরিন

বাংলাদেশের বিজয় দিবস

আজ ১৬ই ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বিজয় দিবস।

১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নমাস যুদ্ধ করে জিতেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। ভারত সাহায্য করেছিল যুদ্ধে জিততে। ওই সা হায্যটা না করলে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব হত বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের জন্ম আমাদের বুঝিয়েছিল, ভারত ভাগ যাঁরা করেছিলেন, দূরদৃষ্টির তাঁদের খুব অভাব ছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, হোক না তারা বাস করছে হাজার মাইল দূরে, হোক না তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি আলাদা, যেহেতু ধর্মটা এক, বিরোধটা হবে না। ভূল ভাবনা। ভারত ভাগ হওয়ার পর পরই বিরোধ শুরু হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শোষণ করতে শুরু করলো পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের। নিজেদের ভাষাও চাপিয়ে দিতে চাইলো। আরবের ধনী মুসলমানরা যেমন এশিয়া বা আফ্রিকার গরীব মুসলমানদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, মানুষ বলে মনে করে না, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা ঠিক তেমন করতো, বাঙা লিদের মানুষ বলে মনে করতো না। পূর্ব পাকিস্তান ফসল ফলাতো, খেতো পশ্চিম পাকিস্তান। পুবের ব্যবসাটা বাণিজ্যটা ফলটা সুফলটা পশ্চিমের পেটে। এ কদিন আর সয়! মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধ হল। শেষে, বাঙালি একটা দেশ পেলো। ভীষণ আবেগে দেশটাকে একেবারে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ইত্যাদি চমৎকার শব্দে ভূষিত করলো। কজন মানুষ ওই শব্দগুলোর মানে বুঝতো তখন? এখনই বা কতজন বোঝে? বোঝেনি বলেই তো চল্লিশ বছরের মধ্যেই দেশটা একটা ছোটখাটো পাকিস্তান হয়ে বসে আছে। ইসলামে থিকথিক করছে দেশ। টুপিতে দাড়িতে, হিজাবে বোরখায়, মসজিদে মাজারে চারদিক ছেয়ে গেছে। মানুষ সামনে এগোয়, বাংলাদেশ পিছোলো। চল্লিশ বছরে যা পার্থক্য ছিল বাংলাদেশে আর পাকিস্তানে, তার প্রায় সবই ঘুচিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমান তালে মৌলবাদের চাষ হচ্ছে দুদেশের মাটিতে। বাংলাদেশ মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রমাণ করতে, যে, মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যাপারটা ভুল ছিল না, ঠিকই ছিল। দেশের সংবিধান বদলে গেছে। পাকিস্তানি সেনাদের আদেশে উপদেশে যে বাঙালিরা বাঙালির গলা কাটতো একা ত্তরে, পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চায়নি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব বেশি বছর যায়নি, দেশের তারা মন্ত্রী হয়েছে, দেশ চালিয়েছে। আমার মতো গণতন্ত্রে সমাজতন্ত্রে সমতায় সততায় বিশ্বাসী একজন লেখককে দেশ থেকে দিব্যি তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু ধর্মীয় মৌলবাদীকে খুশি করার জন্য। যারা তাড়ালো, যারা আজও দেশে ঢুকতে দিচ্ছে নাআমাকে, সেই রাষ্ট্রনায়িকারা ওপরে যা-ই বলুক, ভেতরে ভেতরে নিজেরাও কিন্তু মৌলবাদী কম নয়।

বিজয় উৎসব করার বাংলাদেশের কোনও প্রয়োজন আছে কি? আমার কিন্তু মনে হয় না। আসলে ঠিক কিসের বিরুদ্ধে বিজয়? পাকিস্তান আর বাংলাদেশের নীতি আর আদর্শ তো এক! সত্যিকার বিরোধ বলে কি কিছু আছে আর? পাকিস্তানের ওপর নয়, বরং বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের রাগ একাত্তরের মিত্রশক্তি ভারতের ওপর। বিজয় দিবস করে খামোকাই নিজের সঙ্গে প্রতারণা না করলেই কি নয়! ১৬ ডিসেম্ব রে নয়, বাংলাদেশ বরং ১৪ই আগস্টে উৎসব করুক। পাকিস্তানের জন্মোৎসব করুক ঘটা করে। পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে মিশে রীতিমত জাঁকালো উৎসব। মুসলমানের উৎসব। বিধর্মীদের থেকে মুসলমানদের আলাদা করার ঐতিহাসিক উৎসব। বিজয় উৎসব।

সকল অধ্যায়

১. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
২. মিল এবং অমিল
৩. বাঙালি নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই
৪. সুনীল লেখক হিসেবে বড় ছিলেন, মানুষ হিসেবে বড় ছিলেন না
৫. রোগের নাম পুরুষতন্ত্র
৬. হুমায়ূন আহমেদ : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
৭. প্রাচীনতম নির্যাতন
৮. বাংলাদেশের বিজয় দিবস
৯. কেয়ামত
১০. দিল্লির গণধর্ষণ, গণরোষ!
১১. নাবালিকা ধর্ষণ
১২. পিসফুল ডেথ!
১৩. কলকাতা শাসন করছে মৌলবাদীরা!
১৪. সেই দিনগুলো
১৫. বর্বরতাকে একবার প্রশ্রয় দিয়েছো কী মরেছো
১৬. আছে দুঃখ আছে মৃত্যু
১৭. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
১৮. বাংলাদেশ ১
১৯. বাংলাদেশ ২
২০. পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক
২১. ছোটদার গল্প
২২. লিঙ্গসূত্র
২৩. প্রেম ট্রেম
২৪. দু’চারটে চাওয়া
২৫. কথোপকথন
২৬. আটপৌরে কবিতা
২৭. পঞ্চাশ!
২৮. মেয়েরা নাকি তেঁতুলের মতো!
২৯. ছোট একটা বেলি ফুলের গাছ ছিল উঠোনে
৩০. ডায়রি
৩১. রাফ খাতা
৩২. ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৩৩. বাঙালির বোরখা
৩৪. সাদামাটা সাক্ষাৎকার
৩৫. মিডিয়া আর মিডলক্লাস মিডিওকার
৩৬. আমেরিকা
৩৭. পুংপুজো
৩৮. দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়?
৩৯. বাবা
৪০. সেক্সবয়
৪১. ধর্ষণের জন্য কে দায়ী?
৪২. ফাঁসিতে বিশ্বাসী দেশগুলো কাদের মোল্লার ফাঁসির সমালোচনা করছে কেন?
৪৩. গণতন্ত্রের করুণ দশা
৪৪. নিষিদ্ধ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন