রাফ খাতা

তসলিমা নাসরিন

রাফ খাতা

ছোটবেলায় আমাদের দু ধরনের খাতা থাকতো, রাফ খাতা, আর ফেয়ার খাতা। ফেয়ার খাতায় কোনও হাবিজাবি লেখা চলবে না। রাফ খাতায় চলবে। রাফ খাতায় থাকতো আমার রাজির হাবিজাবি। যে কোনও লেখাই রাফ খাতায় আগে প্র্যাকটিস করে পরে তবেই ফেয়ার খাতায় লিখতাম। রাফ খাতা ছিল স্বাধীনতা, ফেয়ার খাতা ছিল থমথমে একটা পরাধীনতা। রাফ খাতার মার্জিনে বা মাঝখানে, অংক করতে গিয়ে, বা নানা রকম বাড়ির কাজ প্র্যাকটিস করতে গিয়ে কত যে মনের কথা লিখেছি তার কোনও হিসেব নেই। বছর শেষ হলে নতুন ক্লাসে উঠলে পুরোনো বই খাতা সের দরে বিক্রি করে দেওয়া হত, আর বিক্রি না হলেও ওসব বাঁচিয়ে রাখা যেতো না, উইপোকা খেয়ে ফেলতো। লেখার হাতেখড়ি আমার রাফ খাতায়।

 একসময় গোটা একটা রাফ খাতাকে লেখার খাতাই করে ফেললাম। ও নিয়ে ইস্কুলের লেখাপড়ার চেয়েও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। খাতাটা বাবা মার চোখের আড়ালে রাখতে হত। তবে লুকিয়ে ইস্কুলে নিতাম খাতাটা। ক্লাসের মেয়েরা কাড়াকাড়ি করে গোগ্রাসে পড়তো আমার লেখা। একসময় ওরা বাড়িতে নিয়ে যেতে শুরু করলো খাতা, পড়া শেষ হলে ফেরত আনতো, তখন আরেকজন পড়তে নিত। যার খাতা তার হাতে আসতে আসতে মাস চলে যেতো। দাদারা কবিতা-পত্রিকা। বার করতো, বাড়িতেই পত্রিকা ভাঁজ করে করে পোস্ট করা হতো গ্রাহকদের। ভাঁজে অংশ নিতাম, মুখস্ত করে ফেলতাম ছাপা হওয়া কবিতাগুলো। ওসবে দাদারা কবিতা লিখতো। তখনও কবিতা ছাপানোর মতো বয়স আমার হয়নি।

 তবে বয়স হওয়ার আগেই আমার লেখা শুধু দাদাদের পত্রিকায় নয়, শহরের, এমনকী শহরের বাইরের লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হতে শুরু করলো, এমনকী জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হলো বেশ কিছু। আর বয়স হওয়ার আগেই, যখনও বাড়ির চৌকাঠ আমার ডিঙোনো নিষেধ, কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা আর প্রকাশনা দুটোই শুরু করলাম। তখন সবে সতেরো আমি।

সেই যে লেখার শুরু। আজও চলছে সেই লেখা। মাঝখানে গেল মেডিক্যাল কলেজের কঠিন পড়াশোনা, হাসপাতালের চাকরি– লেখার গতি কমেছে, কিন্তু লেখা ছাড়িনি। কেন ছাড়িনি, ছাড়তে পারিনি বলেই ছাড়িনি। কারণ যে কথা মনে আনাগোনা করে, সে কথা অন্য আর কোনও কিছু করে প্রকাশ করতে আমি পারিনা। আমি না জানি গান গাইতে, না জানি নাচতে। আমি না পারি নাটক করতে, না পারি ভালো ছবি আঁকতে। শুধু লেখাটাই জানি। লেখাতেই বলতে পারি কী বলতে চাইছি। যা লিখে বোঝাতে পারি, তা বলে বোঝাতে পারি না। বলতে গেলে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। মনে কী এমন কথা আমার যা প্রকাশ করতেই হবে? না, মনে নতুন কোনও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নেই, গ্রহ নক্ষত্র আবিষ্কারের গোপন কোনও পরিকল্পনাও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে না। খুব সাধারণ কিছু কথা মনে, না বললে আর সব মেয়েদের মতো চিরকালই কথাগুলো বুকের ভেতর পুষে রাখতে হবে। সাধারণ কথা, আমি কী চাই, কী না চাই, আমার কী ভালো লাগে, কী ভালো লাগে না, এসব। পুরুষেরা বলে। বেশির ভাগ মেয়েরাই বলে না, কারণ মেয়েদের অত কথা বলতে নেই, অত চাওয়া থাকতে নেই, অত নিজস্বতা থাকতে নেই, অন্যের ভালোয় মেয়েদের ভালো।

কিন্তু যেহেতু আমি বিশ্বাস করি না মেয়ে বলে আমি কিছুটা কম মানুষ, যেহেতু বিশ্বাস করি না অধিকার বা স্বাধীনতা আমার কিছুটা কম হলেও চলে, তাই বলি, তাই লিখি, সময় সময় চেঁচাই। লিখি কেবল আমার জন্য নয়, লিখি তাদের জন্যই বেশি, যাদের জানতে দেওয়া হয় না কতটা অধিকার তাদের আছে নিজের জীবনটা নিজের পছন্দমতো যাপন করার। লিখে সেই মেয়েদের, সেই মানুষদের স্থবির জীবনে যদি সামান্যও তরঙ্গ তুলতে পারি, তবেই আমার লেখা সার্থক। সার্থক হই বলেই আর যা কিছুই ছাড়তে পারি, লেখাটা পারি না।

সকল অধ্যায়

১. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
২. মিল এবং অমিল
৩. বাঙালি নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই
৪. সুনীল লেখক হিসেবে বড় ছিলেন, মানুষ হিসেবে বড় ছিলেন না
৫. রোগের নাম পুরুষতন্ত্র
৬. হুমায়ূন আহমেদ : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
৭. প্রাচীনতম নির্যাতন
৮. বাংলাদেশের বিজয় দিবস
৯. কেয়ামত
১০. দিল্লির গণধর্ষণ, গণরোষ!
১১. নাবালিকা ধর্ষণ
১২. পিসফুল ডেথ!
১৩. কলকাতা শাসন করছে মৌলবাদীরা!
১৪. সেই দিনগুলো
১৫. বর্বরতাকে একবার প্রশ্রয় দিয়েছো কী মরেছো
১৬. আছে দুঃখ আছে মৃত্যু
১৭. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
১৮. বাংলাদেশ ১
১৯. বাংলাদেশ ২
২০. পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক
২১. ছোটদার গল্প
২২. লিঙ্গসূত্র
২৩. প্রেম ট্রেম
২৪. দু’চারটে চাওয়া
২৫. কথোপকথন
২৬. আটপৌরে কবিতা
২৭. পঞ্চাশ!
২৮. মেয়েরা নাকি তেঁতুলের মতো!
২৯. ছোট একটা বেলি ফুলের গাছ ছিল উঠোনে
৩০. ডায়রি
৩১. রাফ খাতা
৩২. ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৩৩. বাঙালির বোরখা
৩৪. সাদামাটা সাক্ষাৎকার
৩৫. মিডিয়া আর মিডলক্লাস মিডিওকার
৩৬. আমেরিকা
৩৭. পুংপুজো
৩৮. দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়?
৩৯. বাবা
৪০. সেক্সবয়
৪১. ধর্ষণের জন্য কে দায়ী?
৪২. ফাঁসিতে বিশ্বাসী দেশগুলো কাদের মোল্লার ফাঁসির সমালোচনা করছে কেন?
৪৩. গণতন্ত্রের করুণ দশা
৪৪. নিষিদ্ধ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন