আমেরিকা

তসলিমা নাসরিন

আমেরিকা

আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনে একবারই আমি গিয়েছিলাম, এটিই প্রথম, সম্ভবত ওটিই শেষ। প্রদীপ মুখার্জি অথবা প্রদীপ ঘোষ টোষ বলে সে বছর, দুহাজার পাঁচে, একজন কর্ণধার ছিলেন বঙ্গ সম্মেলনের, তিনি আমাকে কয়েক মাস ধরে আক্ষরিক অর্থেই হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিলেন বঙ্গ সম্মেলনে যাওয়ার জন্য। ইওরোপ আমে রিকায় বাঙালির কোনও অনুষ্ঠানে আগে যাইনি। সকলেই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি বলে একটু স্বস্তি ছিল। বাংলাদেশের বাঙালি হলে কোনও প্রশ্নই ছিল না আমার অংশ গ্রহণের।

নিউইয়র্ক শহরের মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠান হয়েছিল। দর্শকের সারিতে ছিল পনেরো হাজার বাঙালি, প্রায় সবাই পশ্চিমবঙ্গের। দেশের গান বাজনা শুনতে এসেছে, দেশি নাচ দেখতে এসেছে। সেখানে পড়লাম কিনা কবিতা, তাও আবার আমেরিকার বিদেশ নীতির সমালোচনার করে। এক দল চিৎকার করে উঠলো, তারা আমেরিকার সমালোচনা শুনতে চায় না, আমেরিকা তাদের খাওয়ায় পরায়, আমেরিকা ইরাকে আফগানিস্তানে যা করছে, ঊচিত কাজ করছে, মুসলমানদের মেরে শেষ করে দেওয়াই উচিত। ব্যস। কবিতাটি শেষ না হতেই আমাকে মঞ্চ থেকে নেমে পড়তে বাধ্য করা হল, পুরো মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেন এরিয়া থেকে যে আমাকে দূর দূর করে তাড়ালো, সে ওই প্রদীপ লোকটি। এফবিআই আসছে, আমেরিকাবিরোধী কবিতা পড়েছি বলে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারদের গ্রেফতার করবে, আমার কারণে বঙ্গ সম্মেলনটাই নষ্ট হয়ে গেল –এসব বলছিল আর আমার ওপর রেগে আগুন হচ্ছিল লোকটি। না, এই কবিতাটি আমেরিকাবিরোধী কবিতা নয়। এটি আমেরিকার সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের পক্ষে লেখা কবিতা, মানবতার পক্ষের কবিতা।

আমেরিকা

কবে তোমার লজ্জা হবে আমেরিকা?
 কবে তোমার চেতন হবে আমেরিকা?
 কবে তোমার সন্ত্রাস বন্ধ করবে তুমি আমেরিকা?
কবে তুমি পৃথিবীর মানুষকে বাঁচতে দেবে আমেরিকা?
কবে তুমি মানুষকে মানুষ বলে মনে করবে আমেরিকা?
কবে এই পৃথিবীটাকে টিকে থাকতে দেবে আমেরিকা?
শক্তিমান আমেরিকা, তোমার বোমায় আজ নিহত মানুষ,
তোমার বোমায় আজ ধ্বংস নগরী,
তোমার বোমায় আজ চূর্ণ সভ্যতা,
 তোমার বোমায় আজ নষ্ট সম্ভাবনা,
তোমার বোমায় আজ বিলুপ্ত স্বপ্ন।

কবে তোমার হত্যাযজ্ঞের দিকে, কুৎসিত মনের দিকে,
 কলঙ্কের দিকে তাকাবে আমেরিকা,
কবে তুমি অনুতপ্ত হবে আমেরিকা?
 কবে তুমি সত্য বলবে, আমেরিকা?
 কবে তুমি মানুষ হবে আমেরিকা?
কবে তুমি কাঁদবে আমেরিকা?
 কবে তুমি ক্ষমা চাইবে আমেরিকা?

আমরা তোমার দিকে ঘৃণা ছুঁড়ে দিচ্ছি আমেরিকা, আমরা ঘৃণা ছুঁড়তে থাকবো ততদিন, যতদিন না তোমার মারণাস্ত্র ধ্বংস করে তুমি হাঁটু গেড়ে বসো, ঘৃণা ছুঁড়তেই থাকবো যতদিন না তুমি প্রায়শ্চিত্ত করো, আমরা ঘৃণা ছুড়বো, আমাদের। সন্তান ছুড়বে, সন্তানের সন্তান ছুড়বে, এই ঘৃণা থেকে তুমি পরিত্রাণ পাবে না আমেরিকা।

তোমার কত সহস্র আদিবাসীকে তুমি খুন করেছো,
 কত খুন করেছো এল সালভাদরে,
 খুন করেছো নিকারাগুয়ায়,
 করেছো চিলিতে, কিউবায়,
করেছো পানামায়, ইন্দোনেশিয়ায়, কোরিয়ায়,
 খুন করেছে ফিলিপিনে, করছো ইরানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, মিশরে, প্যালেস্তাইনে,
ভিয়েতনামে, সুদানে, আফগানিস্তানে
–মৃত্যুগুলো হিসেব করো,
আমেরিকা তুমি হিসেব করো,
 নিজেকে ঘৃণা করো তুমি আমেরিকা।
নিজেকে তুমি, এখনও সময় আছে, ঘৃণা করো।
 এখনও তুমি তোমার মুখখানা লুকোও দুহাতে,
এখনও তুমি পালাও কোনও ঝাঁড়-জঙ্গলে,
তুমি গ্লানিতে কুঁকড়ে থাকো,
কুঁচকে থাকো, তুমি আত্মহত্যা করো।

থামো,
 একটু দাঁড়াও,
আমেরিকা, তুমি গণতন্ত্র, তুমি তো স্বাধীনতা।
 তুমি তো জেফারসনের আমেরিকা,
 লিংকনের আমেরিকা,
তুমি মার্টিন লুথার কিংএর আমেরিকা,
তুমি রুখে ওঠো,
 রুখে ওঠো একবার, শেষবার, মানবতার জন্য।

সকল অধ্যায়

১. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
২. মিল এবং অমিল
৩. বাঙালি নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই
৪. সুনীল লেখক হিসেবে বড় ছিলেন, মানুষ হিসেবে বড় ছিলেন না
৫. রোগের নাম পুরুষতন্ত্র
৬. হুমায়ূন আহমেদ : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
৭. প্রাচীনতম নির্যাতন
৮. বাংলাদেশের বিজয় দিবস
৯. কেয়ামত
১০. দিল্লির গণধর্ষণ, গণরোষ!
১১. নাবালিকা ধর্ষণ
১২. পিসফুল ডেথ!
১৩. কলকাতা শাসন করছে মৌলবাদীরা!
১৪. সেই দিনগুলো
১৫. বর্বরতাকে একবার প্রশ্রয় দিয়েছো কী মরেছো
১৬. আছে দুঃখ আছে মৃত্যু
১৭. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
১৮. বাংলাদেশ ১
১৯. বাংলাদেশ ২
২০. পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক
২১. ছোটদার গল্প
২২. লিঙ্গসূত্র
২৩. প্রেম ট্রেম
২৪. দু’চারটে চাওয়া
২৫. কথোপকথন
২৬. আটপৌরে কবিতা
২৭. পঞ্চাশ!
২৮. মেয়েরা নাকি তেঁতুলের মতো!
২৯. ছোট একটা বেলি ফুলের গাছ ছিল উঠোনে
৩০. ডায়রি
৩১. রাফ খাতা
৩২. ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৩৩. বাঙালির বোরখা
৩৪. সাদামাটা সাক্ষাৎকার
৩৫. মিডিয়া আর মিডলক্লাস মিডিওকার
৩৬. আমেরিকা
৩৭. পুংপুজো
৩৮. দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়?
৩৯. বাবা
৪০. সেক্সবয়
৪১. ধর্ষণের জন্য কে দায়ী?
৪২. ফাঁসিতে বিশ্বাসী দেশগুলো কাদের মোল্লার ফাঁসির সমালোচনা করছে কেন?
৪৩. গণতন্ত্রের করুণ দশা
৪৪. নিষিদ্ধ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন