পিসফুল ডেথ!

তসলিমা নাসরিন

পিসফুল ডেথ!

সিঙ্গাপুরের ডাক্তার বলেছেন মেয়েটা নাকি মারা গেছে পিসফুলি, অর্থাৎ শান্তিতে। ঘুমের ওষুধ বা ব্যথা কমার ওষুধ পেটে পড়লে ব্যথাবেদনা কমে যায়, যন্ত্রণা উবে যায়, চোখ বুজলে মনে হয় শান্তিতে চোখ বুজছে, কিন্তু গভীর করে দেখলে, এই মৃত্যুর সঙ্গে পিস বা শান্তির কোনও সম্পর্ক নেই। কী করে শান্তিতে মেয়েটি মারা যেতে পারে? মাত্র ২৩ বছর বয়স, পড়াশোনা শেষ করে ফিজিওথেরাপিস্ট হওয়া তার তখনও হয়নি, জীবনের যা কিছু স্বপ্ন ছিল তখনও তার বেশিরভাগই পূরণ হয়নি, সামনে পড়ে ছিল তার অনেকটাই ভবিষ্যৎ, কোথায় সে তার জীবনটি নিজের মতো করে যাপন করবে, তা নয়, একের পর এক পুরুষ দ্বারা তাকে ধর্ষিতা হতে হল, ভয়ংকর সব অত্যাচারের শিকার হতে হল, কোনও অপরাধ করেনি, অথচ তার ওপর চলল অবিশ্বাস্য নৃশংসতা, তাকে মরতে হল। আমি তো এতে এক বিন্দু শান্তির কিছু দেখছি না।

২৩ বছর বয়সী গণধর্ষণের শিকার মেয়েটি আজ মারা গেল। সেদিন ১৭ বছর বয়সী গণধর্ষণের শিকার আরেকটি মেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে, কারণ ধর্ষকদের বিরুদ্ধে তার কোনও অভিযোগ পুলিশ তো নেয়নি, বরং বলে দিয়েছে, কোনও একটা ধর্ষককে যেন সে বিয়ে করে নেয়। ওরা হয়তো মরে বেঁচেছে, শত শত ধর্ষিতা আর গণধর্ষিতা মেয়ে কিন্তু না বাঁচার মতো বেঁচে আছে, ধুকছে ধর্ষিতা হওয়ার চরম লজ্জা আর গ্লানিতে। যে সমাজে ধর্ষকদের লজ্জা নেই, সেই সমাজে সব লজ্জা ধর্ষিতাদের। ধর্ষণ মেয়েদের জন্য প্রাচীনকালের কণ্ঠরোগের মতো, কুষ্ঠরোগীদের সমাজ ঘৃণা করতো, ওরা কুঁকড়ে থাকতো ভয়ে, মাথা নিচু করে থাকতো, লুকিয়ে থাকতো। আজকের সমাজেও কুষ্ঠরোগীর মতো ধর্ষিতারা কুঁকড়ে থাকে। একইরকম একঘরে হয়ে যায়। এভাবেই মৃত-মতো বেঁচে থাকে, যতদিনই বেঁচে থাকে। এরকম বাঁচা কি সত্যিকার বাঁচা? ওরা বেঁচে আছে কুৎসিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, যে সমাজে পুরুষেরা মেয়েদের যত দাবিয়ে রাখে, যত তাদের দাসী বানিয়ে রাখে, যত তাদের ওপর প্রভুত্ব করে, যত তাদের জীবনকে দুঃসহ করে তোলে, তত তারা বীর পুরুষ আর পুরুষের মতো পুরুষ হিসেবে সম্মানিত হয়।

 গোটা পৃথিবী এখন জানে ভারতীয় একটি মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে। শুধু জানে না, শত সহস্র মেয়েকে শুধু মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে বীভৎস সব অত্যাচার সইতে হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিদিনই তাদের মরতে হচ্ছে দুঃখে, কষ্টে, যন্ত্রনায়; অবহেলায়, অপমানে। এই সমাজে মেয়েদের সুযোগ মেলে না এক টুখানি শান্তিতে বাঁচার বা একটুখানি শান্তিতে মরার।

সকল অধ্যায়

১. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
২. মিল এবং অমিল
৩. বাঙালি নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই
৪. সুনীল লেখক হিসেবে বড় ছিলেন, মানুষ হিসেবে বড় ছিলেন না
৫. রোগের নাম পুরুষতন্ত্র
৬. হুমায়ূন আহমেদ : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
৭. প্রাচীনতম নির্যাতন
৮. বাংলাদেশের বিজয় দিবস
৯. কেয়ামত
১০. দিল্লির গণধর্ষণ, গণরোষ!
১১. নাবালিকা ধর্ষণ
১২. পিসফুল ডেথ!
১৩. কলকাতা শাসন করছে মৌলবাদীরা!
১৪. সেই দিনগুলো
১৫. বর্বরতাকে একবার প্রশ্রয় দিয়েছো কী মরেছো
১৬. আছে দুঃখ আছে মৃত্যু
১৭. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
১৮. বাংলাদেশ ১
১৯. বাংলাদেশ ২
২০. পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক
২১. ছোটদার গল্প
২২. লিঙ্গসূত্র
২৩. প্রেম ট্রেম
২৪. দু’চারটে চাওয়া
২৫. কথোপকথন
২৬. আটপৌরে কবিতা
২৭. পঞ্চাশ!
২৮. মেয়েরা নাকি তেঁতুলের মতো!
২৯. ছোট একটা বেলি ফুলের গাছ ছিল উঠোনে
৩০. ডায়রি
৩১. রাফ খাতা
৩২. ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৩৩. বাঙালির বোরখা
৩৪. সাদামাটা সাক্ষাৎকার
৩৫. মিডিয়া আর মিডলক্লাস মিডিওকার
৩৬. আমেরিকা
৩৭. পুংপুজো
৩৮. দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়?
৩৯. বাবা
৪০. সেক্সবয়
৪১. ধর্ষণের জন্য কে দায়ী?
৪২. ফাঁসিতে বিশ্বাসী দেশগুলো কাদের মোল্লার ফাঁসির সমালোচনা করছে কেন?
৪৩. গণতন্ত্রের করুণ দশা
৪৪. নিষিদ্ধ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন