ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে

তসলিমা নাসরিন

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নামে একটি ছোট উপন্যাস লিখেছি গত বছর। বইটি পড়ে আমার চেনা জানা সবাই বললো এটি নাকি আমার জীবন কাহিনী। তাদের ভাষ্য, যমুনা আমি, আমিই। যমুনা আমি ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। কিন্তু যমুনার সঙ্গে আমার জীবনের কোনও কিছুর মিল নেই।

সুস্মিতা ভট্টাচার্যের সঙ্গে এ নিয়ে সেদিন কথা হলো।

– তোমার ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বইটা পড়লাম। খুবই ভালো লেগেছে। এখনো ঘোরের মধ্যে আছি। আমি এখন যমুনার সঙ্গে কথা বলছি, ভাবতেই ভালো লাগছে।

–যমুনার সঙ্গে মানে?

–যমুনার সঙ্গে, মানে তোমার সঙ্গে।

 –সুস্মিতাদি, কী কারণে তোমার মনে হচ্ছে, যমুনা আমি?

–মনে হচ্ছে কারণ তোমার জীবন কাহিনীই তো লিখেছো তুমি।

–কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে তো আমার আত্মজীবনী নয়, এটা একটা উপন্যাস।

— হ্যাঁ উপন্যাস, তবে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস।

–আমার নাম তো যমুনা নয়। যমুনা বাংলাদেশের মেয়ে বলে বলছো? আমার উপন্যাসে বাংলাদেশ, ময়মনসিংহ, ব্রহ্মপুত্র খুব থাকে। আমার জন্ম আর বড় হওয়া ওই দেশে আর ওই শহরে আর ওই নদের পাড়ে বলেই সম্ভবত। তার মানে কিন্তু এই নয় যে আমি উপন্যাসের ওই যমুনা।

–তোমার নাম যমুনা নয়, নামটা পাল্টে দিয়েছে।

–তাই বুঝি? যমুনাকে তার বাবা বিয়ে দিয়েছিল, আমাকে তো ওভাবে আমার বাবা বিয়ে দেয়নি।

— তা দেয়নি।

–যমুনা ডিভোর্স করার পর তার এক প্রেমিকের সঙ্গে শুয়ে একটা বাচ্চা নিয়েছিল। এরকম কোনও ঘটনা আমার জীবনে নেই। আমার কোনও বাচ্চা নেই।

— তা নেই।

–যমুনা ফিজিক্সে পিএইডি করেছিল। চাকরি করতো সোলার এনার্জিতে। আমি ফিজিক্সেও পড়িনি, ফিজিসিস্ট হিসেবে চাকরিও কোথাও করিনি।

–তা করোনি।

–যমুনা খুন করেছিল তার প্রেমিককে। আমি কাউকে খুন করিনি।

— তা করোনি।

–যমুনা দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল খুনের বিচার থেকে বাঁচতে। আমি দেশ থেকে পালাইনি।

–তুমি দেশ ছেড়েছিলে।

–দেশ ছাড়তে আমাকে বাধ্য করেছিল সরকার। রাজনৈতিক কারণে। দুটো দেশ ছাড়ার কারণ এক নয়।

— তা নয়।

–যমুনা একটা মালায়ালি ছেলেকে বিয়ে করে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছিল, যখন সোলার এনার্জির ওপর গবেষণা করছিল কেরালায়। আমি কেরালায় কোনও কিছু নিয়ে গবেষণা করিনি, ভারতের কোনও লোককে বিয়েও করিনি, ভারতের কোনও নাগরিকত্বও নিইনি।

–তা নাওনি।

–যমুনা কলকাতায় গিয়েছিল কেরালা থেকে। কলকাতায় চাকরি করতো। বাড়ি কিনেছিল, মেয়েকে ভালো ইস্কুলে পড়াতো। এসবের কিছুই আমার জীবনে ঘটেনি। আমি কলকাতায় থেকেছি বটে, তবে চাকরি করিনি। বাড়িও কিনিনি।

— তা ঠিক।

–যমুনার লেসবিয়ান রিলেনশিপ ছিল। নির্মলা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে থাকতো। কলকাতায় আমি একা ছিলাম। কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না।

– তা ঠিক। ছিল না।

–যমুনার মেয়ে হারভার্ডে পড়তো। আমার কোনও ছেলে বা মেয়ে নেই, হারভার্ডেও পড়ে না।

–তা ঠিক।

 –যমুনা মরে গেছে। আমি মরিনি।

–তা মরোনি।

–যমুনা আত্মহত্যা করেছে। আমি আত্মহত্যার বিরুদ্ধে। যমুনার বোন এসে যমুনার মৃতদেহ নিয়ে যায় দেশে। আমি মরিওনি, আমার মৃতদেহ কেউ নিয়েও যায়নি কোথাও।

— তা যায়নি।

— তাহলে কেন বলছো আমি যমুনা?

 –তুমি যা বলছে তা আমি মানছি। তারপরও বলবো তুমি যমুনা।

–কেন? যমুনা সাহসী ছিল বলে? আর আমাকেও সাহসী হিসেবে মনে করো বলে? কিন্তু সাহসী মেয়েদের গল্প তো হামেশাই লিখছে লেখকরা। আর, যমুনাকে আমার কিন্তু খুব সাহসী মেয়ে বলে মনে হয় না। সাহস থাকলে ও আত্মহত্যা করতো না।

— তা ঠিক।

–এখনও বলবে আমিই যমুনা? নিশ্চয়ই নয়।

–আসলে তুমি যতই অস্বীকার করো না কেন, তুমিই যমুনা।

 এরপর আমি আর কথা বলার উৎসাহ পাইনি। কী কারণে আমার উপন্যাসের চরিত্রকে আমার চরিত্র বলে ভাবা হয়, আমি জানি না। সে কি কয়েক বছর আমার আত্মজীবনী পড়ছে বলে গুলিয়ে ফেলে সব? উপন্যাস আর আত্মজীবনীর পার্থক্য ঠিক বুঝতে পারে না? ঠিক বুঝি না এ লেখকের দোষ, নাকি পাঠকের দোষ? যমুনা যে কাজগুলো করেছে, তার কিছুই আমি করিনি। যমুনা যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষায় আমি কথা বলি না। তবে কী কারণে আমাকে যমুনা বলে ভাবা হয়! যমুনার জন্ম ময়মনসিংহে, জীবনের কিছুটা সময় কলকাতায় বাস করেছিল, যমুনার এক বোন আছে, আমেরিকায় থাকে, যমুনার ভাই পারিবারিক সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে, এ ছাড়া যমুনার আর কোনও কিছুর সঙ্গে আমার কোনও কিছুর মিল নেই। কিন্তু এই মিলটুকুর কারণে আমাকে যমুনা বলে মনে করাটা রীতিমত অযৌক্তিক।

 আমি তো আমার পরিচিত জগতের কথাই উপন্যাসে লিখবো, যা চিনি না জানি না তা কী করে লিখবো? লিখতে গিয়ে আমার নিজের জীবন, আমার চারপাশের জীবন, আমার দেখা, শোনা এবং পড়া নানারকম জীবনের অভিজ্ঞতাই আমার গল্প। উপন্যাসের চরিত্রে চলে আসে। কিন্তু উপন্যাসের কোনও চরিত্রকে আমার চরিত্র বলে। মনে হওয়ার কারণ কী? — হতে পারে লিখতে লিখতে আমার অজান্তে কোনও না। কোনওভাবে আমি একাকার হয়ে যাই সেই চরিত্রের সঙ্গে, সেই চরিত্র আর আমার চরিত্র ভিন্ন হলেও কোথাও না কোথাও দুটো চরিত্রের গভীর মিল থেকে যায়, খালি চোখে যে মিল দেখা যায় না, আর, দেখা গেলেও আমি হয়তো দেখিনা, অন্যরা দেখে। অথবা আমার যারা চেনা জানা, যারা বলে আমার উপন্যাসের চরিত্র আমার চরিত্রই, তারা আমাকে চেনে বা জানে বলে বিশ্বাস করে, আসলে তারা আমার কিছুই চেনে না বা জানে না।

সকল অধ্যায়

১. এ লড়াই প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের নয়
২. মিল এবং অমিল
৩. বাঙালি নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই
৪. সুনীল লেখক হিসেবে বড় ছিলেন, মানুষ হিসেবে বড় ছিলেন না
৫. রোগের নাম পুরুষতন্ত্র
৬. হুমায়ূন আহমেদ : পুরুষতন্ত্রের সম্রাট
৭. প্রাচীনতম নির্যাতন
৮. বাংলাদেশের বিজয় দিবস
৯. কেয়ামত
১০. দিল্লির গণধর্ষণ, গণরোষ!
১১. নাবালিকা ধর্ষণ
১২. পিসফুল ডেথ!
১৩. কলকাতা শাসন করছে মৌলবাদীরা!
১৪. সেই দিনগুলো
১৫. বর্বরতাকে একবার প্রশ্রয় দিয়েছো কী মরেছো
১৬. আছে দুঃখ আছে মৃত্যু
১৭. বিয়ের প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি?
১৮. বাংলাদেশ ১
১৯. বাংলাদেশ ২
২০. পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক
২১. ছোটদার গল্প
২২. লিঙ্গসূত্র
২৩. প্রেম ট্রেম
২৪. দু’চারটে চাওয়া
২৫. কথোপকথন
২৬. আটপৌরে কবিতা
২৭. পঞ্চাশ!
২৮. মেয়েরা নাকি তেঁতুলের মতো!
২৯. ছোট একটা বেলি ফুলের গাছ ছিল উঠোনে
৩০. ডায়রি
৩১. রাফ খাতা
৩২. ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
৩৩. বাঙালির বোরখা
৩৪. সাদামাটা সাক্ষাৎকার
৩৫. মিডিয়া আর মিডলক্লাস মিডিওকার
৩৬. আমেরিকা
৩৭. পুংপুজো
৩৮. দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়?
৩৯. বাবা
৪০. সেক্সবয়
৪১. ধর্ষণের জন্য কে দায়ী?
৪২. ফাঁসিতে বিশ্বাসী দেশগুলো কাদের মোল্লার ফাঁসির সমালোচনা করছে কেন?
৪৩. গণতন্ত্রের করুণ দশা
৪৪. নিষিদ্ধ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন