নবশক্তি সম্পাদক-কে

কাজী নজরুল ইসলাম

নবশক্তি সম্পাদক-কে

নবশক্তি শুক্রবার ৭ ভাদ্র ১৩৩৬

২৩ আগস্ট ১৯২৯

মেঘদূত

(বিজলী)

শ্রদ্ধাস্পদ

শ্রীযুক্ত “নবশক্তি” সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু

সবিনয় নিবেদন,

আপনার সাপ্তাহিক “মেঘদূত”-এর আমি একজন নিয়মিত পাঠক। আপনার “মেঘদূত” – এর বার্তা যিনি প্রেরণ করেন তিনি বিরহী কিনা জানিনে, তবে তিনি যে একজন সত্যিকার ‘রসিক সুজন’ তাতে সন্দেহ নেই। শুধু কথা-রসিক নন, গীত-রসিক। গীত-রসিক বলছি – আমিও একজন প্রায় নিয়মিত, বেতারবাহী-সংগীত-শ্রোতা বলে। ভদ্রলোকের কান আছে, প্রাণ আছে আর সব চেয়ে বড়ো কথা, লেখনীতে ভাষা আছে। তাঁর লেখা পড়ে বেশ বোঝা যায়, তিনি পুরানো নতুন জানা-অজানা সকল গীত-রচয়িতার গানের সঙ্গে বেশ দস্তুরমতো পরিচিত। শুধু বাণীর সঙ্গেই নয়, গানের সুরের সঙ্গেও পরিচিত। তিনি যে চিত্রকূটেই থাকুন, তাঁকে আমাদের গীত-রচয়িতাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আমার নিজের দিক থেকে কিন্তু গোটাকতক কথা বলবার আছে এ নিয়ে। তার কারণ, আমার গান প্রায় প্রত্যহই কোন-না-কোনো আর্টিস্ট রেডিয়োতে গেয়ে থাকেন। এবং আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত তা শুনেও ফেলি। এক উমাপদ ভট্টাচার্য মহাশয় এবং ক্বচিৎ দু-একজন গাইয়ে ছাড়া অধিকাংশ ভদ্রলোক বা মহিলাই আমার গান ও সুরকে অসহায় ভেবে (বা একা পেয়ে) তার পিন্ডি এমনি করেই চটকান যে মনে হয়, ওর গয়ালাভ ওইখানেই হয়ে গেল। সে একটা রীতিমতো সুরাসুরের যুদ্ধ।

একদিন শুনলাম, কোন এক ভদ্রলোক আমার ঠুংরি-চালের ‘দুর্গা’ সুরের নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখিজল গানটিকে ধ্রুপদের ইমন কল্যাণ সুরে গাচ্ছেন। এবং তা শুনে গানের ‘আঁখি জল’ আমার চোখে এসে দেখা দিল। অবশ্য অনুরাগে নয়, রাগে এবং দুঃখে! ভাগ্যিস গান এবং গাইয়ে দুই-ই ছিল নাগালের বাইরে, নইলে সেদিন ভালো করেই সুরাসরের যুদ্ধ বেধে যেত।

আর একদিন একজন ‘রেডিয়ো-স্টার’ মহিলা আমার ‘আমারে চোখ ইশারায়’ গানটার ন্যাজামুড়ো হাত পা নিয়ে এমন করে তাল পাকিয়ে দিলেন যে, তা দেখে মনে হল, বুঝিবা গানটার ওপরে একটা মোটর-লরি চলে গেছে। মটর অ্যাকসিডেন্ট না হলে ওরকম কন্ধ-কাটা নুলো খোঁড়া ক্ষতবিক্ষত অবস্থা কারুর হয় না।

এরকম প্রায় প্রত্যহই হয় এবং বেতারের গাইয়ে-গুণীজন যাঁরা আমার গান দয়া করে গেয়ে থাকেন, তাঁরা আর একটু দয়া করে গানগুলোর মোটামুটি সুর ও গানের কথা জানবার কষ্ট স্বীকার করেন না।

আপনার ‘মেঘদূতের’ ‘বিজলী’ মহাশয় (বা মহাশয়া) অবশ্য তাঁদের ছেড়ে কথা কন না, মাঝে মাঝে চোখ ধাঁধিয়েও দেন তাঁদের। কিন্তু হলে হবে কি, এতেও তো তাঁদের চোখ ফুটেছে বলে মনে হয় না।

আর একটি কথা, বেতার-বার্তার বাঙালি কর্তা মহাশয় প্রায় ভুলে যান গীত-রচয়িতার নাম ঘোষণা করতে। তাতে করে অনেক নবীন অনুকারকের প্রাপ্য প্রশংসা হয়তো আমাদের ওপরে এসে পড়ে। গজল ঠুংরির নিত্যনব অনুকারক ও কারিকার গানকে শ্রোতারা আমাদের গান মনে করে প্রায় অভিযোগ করেন। গালই খেতে হয় বেশির ভাগ। গালই হোক, আর প্রশংসাই হোক, যার যেটা প্রাপ্য তা থেকে তার বঞ্চিত করা মস্ত বড়ো অন্যায়। তার চেয়েও বড়ো অন্যায় – সেই গালি বা প্রসংসা যখন কোনো নির্দোষী বেচারার কাঁধে এসে পড়ে। আমাদের গান বেতারে গীত হওয়ার বদলে কিছুই পাইনে, কাজেই বেতার-কর্তৃপক্ষের কাছে এটুকু সৌজন্য হয়তো প্রত্যাশা করতে পারি যে, তিনি অন্তত গানটা যাঁর রচনা – তাঁর নামটা উল্লেখ করেন। এতে হয়তো তাঁদের ব্যাবসার কিছু ক্ষতি হবে না। আমাদের ক্ষতি যা হবার, তা তো হচ্ছেই।

                                                      বিনীত

নজরুল ইসলাম

সকল অধ্যায়

১. মৌলবি আবদুল গফুরকে
২. সম্পাদক, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা-কে
৩. পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে
৪. আলি আকবর খান-কে
৫. মোহাম্মদ আফজলউল হক-কে
৬. মাহফুজুর রহমান-কে
৭. বলাই দেবশর্মা-কে
৮. হবীবুল্লাহ বাহার-কে
৯. মুরলীধর বসু-কে
১০. আনওয়ার হোসেন-কে
১১. ইব্রাহিম খাঁ-কে
১২. শচীন কর-কে
১৩. শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-কে
১৪. শামসুন নাহার-কে
১৫. গোপাললাল সান্যাল-কে
১৬. মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন-কে
১৭. ব্রজবিহারী বর্মণ-কে
১৮. মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন-কে
১৯. উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কে
২০. আবুল হোসেন-কে
২১. নওরোজ সম্পাদক-কে
২২. মন্মথ রায়-কে
২৩. কাজী মোতাহার হোসেন-কে
২৪. মিস ফজিলতুন্নেসা-কে
২৫. আবদুল কাদির-কে
২৬. নবশক্তি সম্পাদক-কে
২৭. আজিজুল হাকিম-কে
২৮. ড. কাজী মোহাম্মদ আবদুল হামিদ-কে
২৯. এম সিরাজুল হক-কে
৩০. নারায়নগঞ্জ সংগীত-সংসদের অভ্যর্থনা-সমিতির সভাপতি-কে
৩১. বিরজাসুন্দরী দেবী-কে
৩২. কাজী কায়েম হোসেন সাহেব-কে
৩৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে
৩৪. মাহমুদা খাতুন-কে
৩৫. জসীমউদ্দীন-কে
৩৬. অতুলচন্দ্র দত্ত-কে
৩৭. কুমুদরঞ্জন মল্লিক-কে
৩৮. বাংলা মাদ্রাসা ও মক্তবের মৌলভী সাহেবদের প্রতি
৩৯. নার্গিস আসর খানম ওরফে সৈয়দা খাতুন-কে
৪০. বরদাচরণ মজুমদার-কে
৪১. কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম-কে
৪২. ইজাবউদ্দীন আহমদ-কে
৪৩. বঙ্গীয় মুসলিম সভায় পাঠের জন্য
৪৪. মীজানুর রহমান-কে
৪৫. সুফী জুলফিকার হায়দর-কে
৪৬. ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-কে
৪৭. কার্ত্তিকচন্দ্র চক্রবর্তী-কে
৪৮. কালিদাস রায়-কে
৪৯. মতিলাল রায়-কে
৫০. ড. কাজী মোহাম্মদ আবদুল হামিদ-কে
৫১. নিখিল বঙ্গীয় তরুণ মুসলমান সমিতির উদ্দেশ্যে
৫২. সুবোধ রায়-কে
৫৩. প্রাণতোষ চটোপাধ্যায়-কে
৫৪. বাংলার তৎকালীন হক মন্ত্রীসভার প্রধান মন্ত্রী-কে
৫৫. শ্যামলাল সরকার-কে
৫৬. বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত-কে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন