গোপাললাল সান্যাল-কে

কাজী নজরুল ইসলাম

গোপাললাল সান্যাল-কে

শ্রীযুক্ত ‘আত্মশক্তি’সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,

বিনয় সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন,

আপনার (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের) ২০ আগস্টের ‘আত্মশক্তি’র ‘পুস্তক-পরিচয়’এ নতুন সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’র যে পরিচয় দিয়েছেন তৎসম্বন্ধে আমার কিছু বলবার আছে। কারণ ‘গণবাণী’র সাথে আমিও সংশ্লিষ্ট। অবশ্য ‘গণবাণী’পুস্তক নয়, ‘আত্মশক্তি’র পুস্তক-পরিচয়ের সুবিধা নিয়ে পরিচিত হলেও, যেমন আত্মশক্তি আপনার কাগজ হলেও ওই সমালোচনাটা আপনার নয়।

ওই ‘পরিচয়’নিয়ে বলবার কথাটুকু আমারই ব্যক্তিগত, আমাদের কৃষক শ্রমিক দলের নয়। আশা করি, আপনার ঢাউস কাগজের একটুখানি জায়গা ছেড়ে দেবেন আমার বক্তব্যটুকু জানাতে। এ অনুরোধ করলাম এই সাহসে যে, আপনার সম্পাদিত পত্রিকাটি ‘শুক্রবারের আত্মশক্তি’, ‘শনিবারের পত্র’নয়। হঠাৎ এ কথাটা বলার হেতু আছে। কেউ কেউ বলেছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’ নাকি একীভূত হয়ে উঠেছে ‘আত্মশক্তি’র সাথে। অবশ্য, আমার একথা বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয়নি, যদিও দুতিনবার আমার এইরূপ ভুল ধারণা করিয়ে দিয়েছেন আর কি। এ রকম ধারণার আরও কারণ আছে। হঠাৎ এক দিন কাগজে পড়লাম ইটালির মুসোলিনি আর আফ্রিকার হাব্ ‍সি রাজার ইয়ার্কি চলতে চলতে শেষে কি এক রকম সম্বন্ধ পাকতে চলছে। সেই ইয়ার্কিটা গুজব যে, হাবসি দেশটা ইটালির সাথে একীভূত (Incorporated) হয়ে যাচ্ছে। হবেও বা। অত সাদা Vs অত কালোয়, অত শীত Vs অত গ্রীষ্মের যদি আঁতাত হতে পারে, তবে শনিবারের পত্র আর শুক্রবারের পত্রিকাতেই বা বন্ধুত্ব হবে না কেন, একীভূত না হোক। আমরা আদার ব্যাপারি, অত সব জাহাজের খবর নেওয়া ধৃষ্টতা নিশ্চয়ই। তবে জানেন কি, ‘খোশ খবরকা ঝুটা ভি আচ্ছা’ বলে একটা প্রবাদ আছে, অর্থাৎ ওটাকে উলটিয়ে বললে ওর মানে হয়, ‘বুরা খবরকা সাচ্চা ভি না চা’আপনার ‘অরসিক রায়, প্রবাসীর অশোকবাবুতে যখন কথা কাটাকাটি চলছিল তখন ওটা ইয়ার্কির মতো অত হালকা বোধ হয় নাই, যা দেখে আমারা আশা করতে পারতাম যে ওটা শিগগিরই একটা সম্বন্ধে পেকে উঠবে। ‘ফরেন পলিসি’আমরা বুঝিনে, তবে আমার বন্ধু একদিন বলেছিলেন, এ লেখালেখির শিগগিরই একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে। কেননা অশোকবাবুর লেখার ক্ষমতা না থাক, তাঁর মুষ্টি লড়বার ক্ষমতা আছে।

চিন্তার বিষয়, সন্দেহ নেই। অশোকবাবুর লেখার কসরত দেখে আমার তাই মনে হয়েছিল বটে, কিন্তু বক্সিং শিখলে যে শক্তিশালী লেখক হওয়া যায়, এর সন্ধান তো আগে আমায় কেউ দেননি। তাহলে আমি আমার লেখার কায়দাটা অশোকবাবুর কাছে দেখেই শিখতাম। আর অশোকবাবু ও তাঁর চেলাচামুণ্ডারা আমায় লিখতে শেখাবার জন্য কীরূপ সমুৎসুক তা তাঁদের আমার উদ্দেশে বহু অর্থব্যয়ে ছাপা বিশেষ সংখ্যা ‘শনিবারের চিঠি’গুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন। বাগ্য়‍দেবী যে আজকাল বাগ্ে‍দিনী হয়ে বীণা ফেলে সজনে কাঠের ঠেঙ্গা বাজাচ্ছেন, তাও দেখতে পাবেন।

আপনাকে আমি চিনি, তাই আমার ভয় হচ্ছিল আপনার কাগজের ইদানিং লেখাগুলো দেখে যে, কোনোদিন বা আপনারও নামের শেষে (B. A. Cantab) দেখে ফেলি। চিঠি মাত্রই প্রাইভেট, এ কথা নীতিবিদ রামানন্দবাবুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত না হলে কেউ কি বিশ্বাস করতে পারতেন? ও-রকম লেখা ওই রকম Oxen বা Cantab B.A. ইউরোপ প্রত্যাগত অতিসভ্য ছাড়া বোধ হয় কেউ লিখতে পারেনই না, পড়তেও পারে না। অশোক বনের চেড়ির মার সীতার প্রতি কীরূপ মর্মান্তিক হযে উঠেছিল জানা নেই। কিন্তু সে মার সরস্বতীর উপর পড়লে যে কীরূপ মারাত্মক হয় তা বেশ বুঝছি। আমার ভয় হচ্ছে, কোনো দিন বা শ্রীযুক্ত বলাই চাটুজ্জে লেখা শুরু করে দেন।

শিবের গীত গাইতে ধান ভেনে নিলাম দেখে (‘ধান ভানতে শিবের গীত’নয়) আপনি হয়তো অসন্তুষ্ট হচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে এটা চিঠি, প্রবন্ধ নয়। আর, চিঠিতে যে আবোল-তাবোল বকবার অধিকার সকলেরই আছে তা ‘শনিবারের চিঠি’পড়লেই দেখতে পাবেন। তাই বলে আমার এ রবিবারের উত্তরও নয়। কেননা তাঁরা এত চিঠি লিখছেন আমায় যে, তার উত্তর দিতে হলে আবার গণেশ ঠাকুরকে ডাকতে হয়। এটাকে মনে করে নিন আসল গান গাইবার আগে একটু তারারা করে নেওয়া, যেমন আপনারা তারারা করেছেন ‘গণবাণী’র আলোচনা করতে গিয়ে।

শ্রীযুক্ত তারারা লিখেছেন ‘লাঙল উঠে গিয়ে এটা (অর্থাৎ গণবাণী) নামল’কিন্তু ‘গণবাণী’র কভারে লেখা আছে, এর সাথে ‘লাঙল’একীভূত হয়েছে। যেমন Forward-এর সাথে Indian Daily News প্রভৃতি একীভূত হয়েছে। আসলে ‘লাঙল’উঠে গেল না, সে রয়ে গেল গণবাণীর মধ্যে। এর কারণ দেখিয়েছেন ওর সম্পাদক মুজফ্ ‍ফর আহমেদ। ‘গণবাণীর’কভারের লেখাটা বোধ হয় শ্রীযুক্ত তারারার চোখে পড়ে নাই। অবশ্য আমি এ ইচ্ছা করছি না যে, তার চোখে লাঙল পড়ুক। চোখে খড়কুটো পড়লেই যেরকম অবস্থা হয়ে ওঠে।

তিনি আরও লিখেছেন এ নামের দল (বঙ্গীয় কৃষক শ্রমিক দল) এদেশে কবে তৈরি হল, কারা করল, কোন ভাতকাপড়ের সংস্থাহীন অনশন অর্ধাশনক্লিষ্ট শ্রমিকরা এর কর্ণধার তা সাধারণকে জানানো উচিত। কোন সাধারণ সভায় এর উদ্া‍বোধন, সেটাও জানানো দরকার। ‘শ্রীযুক্ত তারারা’’দরিয়া পারে’খবর লেখেন, অনেক কাগজে অনেক রকম কিছু লেখেন, সুতরাং দরিয়ার এপারের দেশি খবরটাও তিনি রাখেন এ বিশ্বাস করা অপরাধের নয় নিশ্চয়। কিন্তু না রাখাটা আপরাধের, অন্তত তাঁর পক্ষে, যিনি রাজনীতি আলোচনা করেন। তিনি আপাত আপনার কাগজে কৃষক-শ্রমিকের খবরাখবর করলেও আহা নিশ্চয় করতেন না। নইলে তিনি ওরকম প্রশ্ন করে নিজেকে লজ্জায় ফেলতেন না। ‘বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দল’সম্বন্ধে দু একটা খবর দিচ্ছি ওঁকে, ওঁর ওগুলো জানা থাকলে কাজে লাগবে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ ও ৭ তারিখে কৃষ্ণনগরে নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মিলনীর দ্বিতীয় অধিবেশন হয়। যার সভাপতি হয়েছিলেন ডাক্তার নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। ওই কনফারেন্সের বিবরণী বাংলার ইংরেজি বাংলা প্রায় সব কাগজেই বেরিয়েছিল। লাঙলে তো বেড়িয়েছিলই। অবশ্য ধনিক দলের কাগজ ‘ফরওয়ার্ড’সে বিবরণ ছাপায়নি—শুধু সভার সংবাদটুকু কোনো নারীহরণের মামলার শেষে দেওয়া ছাড়া। এরপর আ্যালবার্ট হল প্রভৃতি স্থানে বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দলের যতগুলো সভাসমিতি হয়েছে, তার কোনো সংবাদই ছাপেনি ‘ফরওয়ার্ড’। আমরা দিয়ে আসলেও না। সম্পাদকীয় এই ধর্ম ও সৌজন্যটুকু বাংলার আর কোনো কাগজ অতিক্রম করেনি। অবশ্য ‘ফরওয়ার্ড’বিলেতের ও জগতের আর দেশের শ্রমিকদের কথা লেখে, সুতরাং ও কাগজে বাংলার জঘন্য চাষি-মজুরের কথাও লিখতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তাতে আবার এ কৃষক-শ্রমিক দলটা তুলসীবাবুর, নলিনীবাবুর মতো ধনিক নেতার গঠিত নয়। গঠন করলে কারা না, যত সব বিভিন্ন জেলার সত্যিকারের মজুর, ক্ষয়কেশে হাড়-চামড়া বের করা, আধ-ন্যাংটা বেগুন সিদ্ধ মৃত মুখওয়ালা চাষা মজুর। আর তাদের নেতাগুলোকে তদ্রূপ—না আছে চাল না আছে চুলো। তাতে বলশেভিক ষড়যন্তর আসামি সব। বোঝো ঠ্যালা।

যাক, ওই প্রজা সম্মিলনের প্রস্তাবসমূহ নবম সংখ্যা লাঙলে বেরিয়েছিল। ওই সম্মিলনের প্রথম প্রস্তাবই হচ্ছে কৃষক-শ্রমিক দল গঠনের প্রস্তাব।

উহার চতুর্থ প্রস্তাব হচ্ছে : ‘লাঙল পত্রিকাকে কৃষক ও শ্রমিকদের মুখপত্ররূপে আপাতত গ্রহণ করা হউক।

প্রস্তাবগুলি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবক ও সমর্থক সকলেই বিভিন্ন জেলার কৃষক ও শ্রমিক।

তারপর তারারার সঙ্গীন প্রশ্ন–’কোন কোন ভাত-কাপড়ের সংস্থানহীন অনশন অর্ধাশনক্লিষ্ট শ্রমিকরা এর কর্ণধার’। উত্তরে তারারা মহাশয়কে সানুনয় অনুরোধ জানাচ্ছি তিনি যেন দয়া করে একবার ৩৭, হ্যারিসন রোডের ‘গণবাণী’অফিসে পদধূলি দিয়ে যান। গেলে দেখতে পাবেন বহু হতভাগ্যের পদধূলি ‘গণবাণী’অফিসে স্তূপীকৃত গণবাণীকেও ছাড়িয়ে উঠেছে। সে অফিসে মাদুরের চেয়ে মেঝেই বেশি, চেয়ার টেবিল তো নঞতৎপুরুষ সমাস। মানুষগুলো অধিকাংশই মধ্যপদলোপী কর্মধারয়। অবশ্য খাবার বেলায় বহুব্রীহি। বাজ-পড়া মাথা-ন্যাড়া তালগাছের মতো সব দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখে চোখে জল আসে, বিশেষ করে যখন দেখি ‘গণবাণী’র কর্ণধার হতভাগ্য মুজফ্ ‍ফর আহমদকে। অবস্থা তো ‘ফকির-ফোকরা, হাঁড়িতে ভাত নেই, শানকিতে ঠোকরা। আর শরীরের অবস্থা তেমনই। যেন সমগ্র মানবসমাজের প্রতিবাদ। আমি হলফ করে বলতে পারি মুজফ্র‍ফরকে দেখলে লোকের শুষ্ক চক্ষু ফেটেও জল আসবে। এমন সর্বত্যাগী আত্মভোলা মৌন কর্মী এমন সুন্দর প্রাণ, মন, ধ্যানীর দূরদৃষ্টি, এমন উজ্জ্বল প্রতিভা– সবচেয়ে এমন উদার বিরাট বিপুল মন নিয়ে সে কী করে জন্মাল গোঁড়া মৌলবির দেশি নোয়াখালীতে, এই মোল্লা-মৌলবির দেশ বাংলায় তা ভেবে পাইনে। ও যেন আগুন শিখা, ওকে মেরে নিবৃত্ত করা যায় না। ও যেন পোকায় কাটা ফুল, পোকায় কাটছে তবু সুগন্ধ দিচ্ছে। আজ তাকে যক্ষ্মা খেয়ে ফেলেছে, আর কটা দিন সে বাঁচবে জানি না। ওর পায়ের তলায় বসে শিষ্যত্ব করতে পারে না, এমন অনেক মুসলমান নেতা আজ এই সাম্প্রদায়িক হুড়োহুড়ির ও যুগের হুজুগের সুবিধে নিলে গুছিয়ে নিলে, শুধু মুজফ্ে‍ফর দিনের পর দিন অর্ধাসন অনশনে ক্লিষ্ট হয়ে শুকিয়ে মরছে। আমি জানি, এই ‘গণবাণী’বের করতে তাকে দুটো দিন কাঠে কাঠ অনশনে কাটাতে হয়েছে। বুদ্ধু মিয়াঁও আজ লিডার, আর মুজফ্’‍ফর মরছে রক্ত-বমন করে। অথচ মুজাফ্ফেরের মতো সমগ্রভাবে নেশনকে ভালোবাসতে, ভারতবর্ষকে ভালোবাসতে কোনো মুসলমান নেতা তো দূরের কথা, হিন্দু নেতাকেও দেখিনি। এই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার দিনে যদি কারুর মাথা ঠিক থাকে তা মুজফ্,‍ফরের, ‘লাঙল’ও ‘গণবাণী’র লেখা প্রবন্ধ পড়লেই বুঝতে পারবেন।

দেশের ছোটো বড়ো মাঝারি সকল দেশপ্রেমিক মিলে যখন ‘এই বেলা নে ঘর ছেয়ে’প্রবাদটার সার্থকতা হৃদয়ঙ্গম করে পনেরো দিন বিনাশ্রমে জেল বাসের বিনিময়ে অন্তত একশত টাকার ‘ভাত কাপড়ের সংস্থান’করে নিলে, তখন যারা তাদের ত্যাগের মহিমাকে মলিন করল না আত্মবিক্রয়ের অর্থদিয়ে – তাদের অন্যতম হচ্ছে মুজাফ্ত‍ফর। মুজাফ্ ‍ফর কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র কেসের দণ্ডভোগী অন্যতম আসামি এবং বাংলার সর্বপ্রথম মুসলমান স্টেট প্রিজনার। বাংলার বাইরে নানান খোট্টাই জেলে তার উপর অকথ্য অত্যাচার চলেছে। শেষে যখন যক্ষ্মায় সে মৃতপ্রায় তখন তাকে হিমালয় পর্বতস্থিত আলমোড়ায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তখন ওজন তার মাত্র ৭৪ পাউণ্ড।

সেখানে দিনের পর দিন কাটিয়েছে সে অনশনে, তবু সে চায়নি কিছু। সে বলেনি কোনোদিনই মুখ ফুটে যে, দেশের জন্য সে কিছু করেছে। বলবেও না ভবিষ্যতে। সে বলে না বলেই তো তার জন্য কান্না পায়, তার উপর আমার এত বিপুল শ্রদ্ধা। সেই নেতা যিনি আজ কর্পোরেশনের মোটর চড়ে দাড়িতে মলয় হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং ব্যাঙ্কে যার জমার অঙ্কের ডান দিকের শূন্যটা বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন, যাঁকে কলকাতা এনে তাঁর টাউন হলের অভিভাষণ লিখিয়ে দিয়ে কাগজে কাগজে তাঁর নামে কীর্তন গেয়ে বড়ো করে তুলল সেই মুজফ্অ‍ফর তার অতি বড়ো দুর্দিনে একটা পয়সা বা এক ফোঁটা সহানুভূতি পায়নি ওই লিডার সাহেবের কাছে। সে অনুযোগ করে না তার জন্য, কিন্তু আমরা করি।

যে মুসলমান সাহিত্য সমিতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল মুজফ্ব‍ফর অথচ তার নিজের নাম চিরকাল গোপন রেখে গেল, সেই মুসলমান সাহিত্য-সমিতির যখন নতুন করে প্রতিষ্ঠা হল এবং তার নতুন সভ্যগণ মুজফ্য‍ফর রাজলাঞ্চিত বলে এবং তাদের অধিকাংশই রাজভৃত্য বলে যখন তার বন্দি বা মুক্ত হওয়ার জন্য নাম পর্যন্ত নিলে না– তার ঋণের কৃতজ্ঞতা স্বীকার তো দূরের কথা, তখন একটি কথা কয়ে দুঃখ প্রকাশ করেনি মুজফ্ল‍ফর। ও যেন প্রদীপের তেল, ওকে কেউ দেখলে না দেখলে শুধু সেই শিখাকে, যা জ্বলে প্রদীপের তেলকে শোষণ করে। শুধু মুজফ্র‍ফর নয়, এ দলের প্রায় সকলেরই এই অবস্থা। হালিম, নলিনী সব সমান। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। একজনের অ্যাপেন্ডিসাইটিস, একজনের ক্যানসার, ম্যালেরিয়া, একজনের আলসার, একজনের ধরেছে বাতে। আর হাড়-হাভাতে ও হা-ভাতে তো সবাই। যাকে বলে নরক গুলজার, বলতে হলে সব শ্রীচরণ মাঝি ভরসা। কোমরের নীচে টাকা জুটল না কারুর, আর পেটের ভিতর সর্বদা যেন বোমা তৈরি হচ্ছে – খিদের চোটে এমন হুড়মুড় করে। দিনরাত চুপসে আছে–বাতাস বেরিয়ে যাওয়া ফুটবলের ব্লাডারের মতো। চায়ের কাপগুলো অধিকাংশ সময়েই দন্ত ‘ক্লাইভ স্ট্রিট’করে পড়ে আছেন। লেখককে তাঁর ইলেকট্রিক ফ্যান শীতলিত এবং লাইট উজ্জ্বলিত ড্রয়ার টেবিল ডেস্ক পরিশোভিত, দারোয়ান দণ্ডায়িত, ত্রিতল অফিস ত্যাগ করে একটু নীচে নেমে (লিফট দিয়ে) তাঁদের অফিসের মোটরে করে আমাদের ‘গণবাণী’অফিসের ও তার কর্ণধারদের দেখে যাওয়ার নিমন্ত্রণ রইল। বুভুক্ষুগুলো অন্তত তাঁর পয়সার একটু চা খেয়ে নেবে। অবশ্য ওকেও এক কাপ দেবে। আমি নিজে গিয়েই শ্রীযুক্ত তারারাকে নিয়ে যেতাম, কিন্তু এদিকেও ভাঁড়ে ভবানী। কয়েকদিন কলকাতায় যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন থাকলেও যেতে পারছিনে ট্রেন ভাড়ার অভাবে। বাড়ির হাঁড়িতে ইঁদুরেরা বক্সিং খেলছে, ডন খেলছে! ক্যাপিটালিস্টরা আমার চেয়েও সেয়ানা, তারা বলে, ‘হাত বুলোতে হয়, গায়ে বুলোও বাবা, মাথায় নয়, তোমার হাত-খরচটা মিলে যাবে, কিন্তু ও কর্মটা হবে না, দাদা। এমন কী মুজফ্ ‍ফরের মতো সুটকি হয়ে মর-মর হলেও না।’

তার পর ‘গণবাণীর’লেখা নিয়ে ‘তারারা’বলছেন–’বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকরা লেখাপড়ার সঙ্গে গোটা কয়েক মতবাদ শিখলে ওগুলো শিগগিরই বুঝতে পারবেন?’– তাঁর ইঙ্গিতটা এবং রসিকতাটা দুটাই বুঝলাম না, বুঝলাম শুধু তার জানাশোনা কতটুকু–অন্তত সেই সম্বন্ধে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি কি জানেন না, যে কোনো দেশের কোনো শ্রমিক কার্ল মার্কস-এর ‘ক্যাপিটাল’পড়ে বুঝতে পারবে না। ওই মতবাদটা যারা পড়বে তারা কৃষক শ্রমিক নয়, তারা লেনিন ল্যান্সব্যারির নমুনার লোক। কার্ল মার্কসের মতবাদ সাধারণ শ্রমিক বুঝতে না পারলেও তা দিয়ে তাদের মঙ্গল সাধিত হয়েছে হচ্ছে এবং হবে। এ মতবাদ দিয়ে এমন কতকগুলি লোকের সৃষ্টি হয়েছে যাঁরা জগৎটাকে উলটে দিয়ে নতুন করে গড়তে চাচ্ছেন বা গড়ছেন। মতবাদ কোনোকালেই জনসাধারণ বুঝবে না, মতবাদ তৈরি করে তুলবে সেইরকম লোক যাঁরা, বুঝোবেন এ মতবাদের মর্ম জনসাধারণকে। ইঞ্জিন চালাবে ড্রাইভার, কিন্তু গাড়িতে চড়বে সর্বসাধারণ। ‘গণবাণী’ ও কৃষক-শ্রমিকদের পড়ার জন্য নয়, কৃষক শ্রমিকদের গড়ে তুলবেন যাঁরা–’গণবাণী’তাঁদের জন্য। কৃষক-শ্রমিক দলের মুখপত্র, মানে তাদের বেদনাতুর হৃদয়ের মূক মুখের বাণী ‘গণবাণী’তাদের বইতে না পারা ব্যথা কথায় কথায় ফুটিয়ে তুলবে ‘গণবাণী’। ইতি –

বিনীত
– নজরুল ইসলাম
৮ ভাদ্র
১৩৩৩ বঙ্গাব্দ

 

সকল অধ্যায়

১. মৌলবি আবদুল গফুরকে
২. সম্পাদক, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা-কে
৩. পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে
৪. আলি আকবর খান-কে
৫. মোহাম্মদ আফজলউল হক-কে
৬. মাহফুজুর রহমান-কে
৭. বলাই দেবশর্মা-কে
৮. হবীবুল্লাহ বাহার-কে
৯. মুরলীধর বসু-কে
১০. আনওয়ার হোসেন-কে
১১. ইব্রাহিম খাঁ-কে
১২. শচীন কর-কে
১৩. শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-কে
১৪. শামসুন নাহার-কে
১৫. গোপাললাল সান্যাল-কে
১৬. মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন-কে
১৭. ব্রজবিহারী বর্মণ-কে
১৮. মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন-কে
১৯. উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কে
২০. আবুল হোসেন-কে
২১. নওরোজ সম্পাদক-কে
২২. মন্মথ রায়-কে
২৩. কাজী মোতাহার হোসেন-কে
২৪. মিস ফজিলতুন্নেসা-কে
২৫. আবদুল কাদির-কে
২৬. নবশক্তি সম্পাদক-কে
২৭. আজিজুল হাকিম-কে
২৮. ড. কাজী মোহাম্মদ আবদুল হামিদ-কে
২৯. এম সিরাজুল হক-কে
৩০. নারায়নগঞ্জ সংগীত-সংসদের অভ্যর্থনা-সমিতির সভাপতি-কে
৩১. বিরজাসুন্দরী দেবী-কে
৩২. কাজী কায়েম হোসেন সাহেব-কে
৩৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে
৩৪. মাহমুদা খাতুন-কে
৩৫. জসীমউদ্দীন-কে
৩৬. অতুলচন্দ্র দত্ত-কে
৩৭. কুমুদরঞ্জন মল্লিক-কে
৩৮. বাংলা মাদ্রাসা ও মক্তবের মৌলভী সাহেবদের প্রতি
৩৯. নার্গিস আসর খানম ওরফে সৈয়দা খাতুন-কে
৪০. বরদাচরণ মজুমদার-কে
৪১. কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম-কে
৪২. ইজাবউদ্দীন আহমদ-কে
৪৩. বঙ্গীয় মুসলিম সভায় পাঠের জন্য
৪৪. মীজানুর রহমান-কে
৪৫. সুফী জুলফিকার হায়দর-কে
৪৬. ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী-কে
৪৭. কার্ত্তিকচন্দ্র চক্রবর্তী-কে
৪৮. কালিদাস রায়-কে
৪৯. মতিলাল রায়-কে
৫০. ড. কাজী মোহাম্মদ আবদুল হামিদ-কে
৫১. নিখিল বঙ্গীয় তরুণ মুসলমান সমিতির উদ্দেশ্যে
৫২. সুবোধ রায়-কে
৫৩. প্রাণতোষ চটোপাধ্যায়-কে
৫৪. বাংলার তৎকালীন হক মন্ত্রীসভার প্রধান মন্ত্রী-কে
৫৫. শ্যামলাল সরকার-কে
৫৬. বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত-কে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন