৩.১০ দশম পরিচ্ছেদ – উকীল-হরিপ্রসন্ন

পাঁচকড়ি দে

কোন কোন তৃণ করতলে দলিত করিলে তাহা হইতে সুগন্ধ বাহির হয়; তেমনই মজিদ খাঁ কারারুদ্ধ হইলেই অনেকেরই মুখে তাঁহার গুণগ্রামের কথা বাহির হইতে লাগিল। এমন একজন ধর্ম্মনিষ্ঠ, দয়ালু, বুদ্ধিমান্, সদ্বিদ্বান্ সচ্চরিত্র যুবক মজিদ খাঁ যে, এইরূপ একটা কলঙ্কজনক বারবনিতার হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত আছেন, একথা সহসা কাহারও বিশ্বাস হইল না। দুঃসহ বিস্ময়ের সহিত প্রথমে সকলেই এই অপ্রত্যাশিতপূর্ব্ব সংবাদ শুনিল, কিন্তু কেহ বুঝিতে পারিল না, কোন্ কারণে মজিদ খাঁ দিলজানকে খুন করিতে পারেন। সকলেই মজিদ খাঁকে এই বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিবার জন্য সচেষ্ট হইল। সাধারণতঃ এরূপ দেখা যায়, কেহ বিপদে পড়িলে তাহার বন্ধুবর্গ ধীরে ধীরে গা-ঢাকা দেন; কিন্তু মজিদ খাঁর বন্ধুবর্গ তেমন নহেন, তাঁহার সকলে আজ মজিদ খাঁকে বিপন্মুক্ত করিবার জন্য বদ্ধপরিকর।
লদ্ধপ্রতিষ্ঠ বৃদ্ধ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু নম্র-স্বভাব মজিদ খাঁকে বড় স্নেহ করিতেন। তিনি মজিদ খাঁর এই বিপদের কথা শুনিয়া অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন; এবং যাহাতে তাঁহাকে ফাঁসীকাঠের মুখ হইতে বাঁচাইতে পারেন, তাহার আয়োজন করিতে লাগিলেন।
উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু মনিরুদ্দীনের পিতার সহাধ্যায়ী বাল্যবন্ধু। বন্ধুর জমিদারী-সেরেস্তার সমস্ত মাম্লা-মোকদ্দমা তাঁহাকেই দেখিতে হইত; তাঁহার অবর্ত্তমানে এখনও দেখিয়া থাকেন। তিনি মজিদ খাঁ ও মনিরুদ্দীনের বাল্যকাল হইতে তদুভয়কে দেখিয়া আসিতেছেন। তদুভয়ের স্বভাব পরষ্পর ভিন্ন রকমের। মনিরুদ্দীন যেমন দাম্ভিক, নির্ব্বোধ, অশিষ্ট, চঞ্চল এবং নির্দ্দয়; মজিদ তেমনি ঠিক তাহার বিপরীত-মজিদ মার্জ্জিতবুদ্ধি, বিনয়ী, শিষ্ট শান্ত ধীর এবং পরোপকারী। সেইজন্য হরিপ্রসন্ন বাবু মজিদেরই বিশেষ পক্ষপাতী। মনিরুদ্দীনের পিতার মৃত্যুর পর হইতে তাঁহার জমিদার-সংক্রান্ত কোন মাম্লা-মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে হরিপ্রসন্ন বাবু মজিদ খাঁর সহিতই তৎসম্বন্ধে পরামর্শ করিতেন। মনিরুদ্দীনকে সেজন্য তাঁহার বড়-একটা প্রয়োজন হইত না।
জোহেরার পিতার সহিতও সুবিজ্ঞ উকীল হরিপ্রসন্ন বাবুর বন্ধুত্ব ছিল। মনিরুদ্দীনের পিতার ন্যায় তাঁহারও জমিদারী-সেরেস্তার মাম্লা-মোকদ্দমা, হরিপ্রসন্ন বাবুর হাতে আসিয়া পড়িত। জোহেরার পিতার সহিত মনিরুদ্দীনের পিতার বিশেষ সদ্ভাব থাকায় তদুভয়ের জমিদারী সেরেস্তার মাম্লা-মোকদ্দমা একা নিজের হাতে লইতে হরিপ্রসন্ন বাবুর কোন গোলযোগের সম্ভাবনা ছিল না। এবং দুইজন বড় জমিদারকে হাতে পাইয়া তাঁহার আয়ের পথ বেশ সুগম হইয়াছিল। এক্ষণে মুন্সী জোহিরুদ্দীন জোহেরার বিষয়-সম্পত্তির অছি হওয়ায় হরিপ্রসন্ন বাবুর একটু ক্ষতি হইয়াছে। মুন্সী সাহেব কিছু স্বজাতিপ্রিয়। তিনি অধিকাংশ মোকদ্দমা একজন স্বজাতীয় ব্যবহারজীবীর হস্তে নির্ভর করিয়া থাকেন। তবে কোন সঙ্গীন মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে হরিপ্রসন্ন বাবুকেই তাঁহাকেই তাঁহার প্রয়োজন হইত। হরিপ্রসন্ন বাবুও তাহাতে কিছুমাত্র দুঃখিত ছিলেন না; যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিয়াছেন, এখন এই বৃদ্ধ বয়সে অতিরিক্ত পরিশ্রমে আর তাঁহার বড় একটি রুচি ছিল না। তবে তিনি জোহেরাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন বলিয়া অনেক সময়ে তাঁহাকে স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হইয়া অনেক কাজ সম্পন্ন করিতে হইত। যখন জোহেরা এতটুকুটি, তখন তিনি তাহাকে অনেকবার কোলে পিঠে করিয়াছেন। তাঁহার নিজের সন্তানাদি না থাকায় তিনি বিজাতীয় বন্ধুর কন্যা জোহেরাকে অত্যন্ত ভালবাসিয়া ফেলিয়াছেন। এবং জোহেরা অদ্যাপি তাঁহাকে পিতৃতুল্য ভক্তি করে। জোহেরা যে মজিদ খাঁর অনুরাগিণী এবং কেবল অভিভাবক মুন্সী জোহিরুদ্দীনের মত্ না থাকায় বয়স অধিক হইলেও জোহেরার বিবাহ বন্ধ আছে, তাহা হরিপ্রসন্ন বাবুর অগোচর ছিল না। মজিদ খাঁ অতি সুপাত্র। তাঁহার সহিত জোহেরার বিবাহে তিনি পক্ষপাতী ছিলেন; কিন্তু ইদানীং তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত একটা জনরব শুনিয়াছিলেন যে, জোহেরা মনিরুদ্দীনকে বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছে; কিন্তু অদ্য সহসা জোহেরা সাক্ষাৎ অভিলাষিণী হইয়া তাঁহার নিকটে একজন লোক পাঠাইতে বুঝিতে পারিলেন, তাহা জনরবমাত্র। উকীল মানুষ তিনি, জোহেরার মনোগত ভাব বুঝিতে তাঁহার কতখানি সময়ের আবশ্যক? তিনি আপন মনে কহিলেন, নিশ্চয়ই জোহেরা মজিদ খাঁ কারারুদ্ধ হওয়ায় অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছে, এখন আমার সহিত দেখা করিয়া একটা পরামর্শ করিতে চায়। মনে করিয়াছে, মজিদ খাঁর বিপদে আমি নিশ্চিন্ত আছি-কি ভ্রম! যাক্ এখন জোহেরার সহিত দেখা না করিয়া আগে মজিদ খাঁর সঙ্গে আর একবার দেখা করিতে হইবে। মজিদ, যেরূপ জটিলভাবে এই বিপদে পড়িয়াছে- যদিও সে নির্দ্দোষী, তথাপি তাহাকে উদ্ধার করা বড় শক্ত হইবে। তাহার বিরুদ্ধে তিনটি ভয়ানক প্রমাণ বলবৎ রহিয়াছে। প্রমাণগুলি লিখিয়া রাখা দরকার, ” বলিয়া পকেট হইতে নোটবুকখানি বাহির করিয়া লিখিতে লাগিলেন।
১। মজিদ খুনের রাতিতে দিলজানকে শেষজীবিত দেখিয়াছে।
২। সেই রাত্রিতেই মেহেদী-বাগানে অকুস্থানের অনতিদূরে মোবারক মজিদকে দেখিয়াছে; তখন মজিদের বড় ব্যস্ত-সমস্ত ভাব।
৩। মজিদের বাসা হইতে একখানা বিষাক্ত ছুরি পাওয়া গিয়াছে। খুব সম্ভব, সেই ছুরিতেই দিলজান খুন হইয়াছে।
অত্যন্ত কঠিন প্রমাণ। ভাবিয়া দেখিলেন, ইহাতে মজিদ যে প্রতিবাদ করিয়াছে, তাহা কোন কাজেরই নহে; তথাপি হরিপ্রসন্ন বাবু তাহাও নোটবুকের অপর পৃষ্ঠায় লিখিলেন:-
১। মজিদ এখন বলিতেছে, খুনের রাত্রিতে যে স্ত্রীলোকের সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল, সে দিলজান নহে। সে অন্য কোন স্ত্রীলোক। তাহার নাম সে কিছুতেই প্রকাশ করিতে পারিবে না।
২। মেহেদী-বাগানে অকুস্থানের কিছুদূরে তাহার সহিত মোবারকউদ্দীনের যে সাক্ষাৎ হইয়াছিল, মজিদ বলিতেছে, তাহা দৈবক্রমেই হইয়া থাকিবে।
৩। যেদিন রাত্রিকালে দিলজান খুন হয়, সেই দিন অপরাহ্ণে দিলজানের সহিত মজিদের দেখা হইয়াছিল। মজিদ বলিতেছে, সে তাহার নিকট হইতে ঐ ছুরি জোর করিয়া কাড়িয়া লইয়াছিল।
হরিপ্রসন্ন বাবু অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া দেখিলেন, মজিদ যে প্রতিবাদ করিতেছে, কিছুতেই টিকিবে না। নির্দ্দোষ হইলেও তাহাকে তাহারই দোষে এই হত্যাপরাধে দণ্ডার্হ হইতে হইবে। মজিদ কেন এরূপ কপট ব্যবহার করিতেছে? এখন আর একবার তাহার সহিত দেখা করিয়া যাহাতে তাহার মতি ফিরাইতে পারি, যাহাতে সে অকপটভাবে আমার কছে সকল কথা প্রকাশ করে, সে চেষ্টা এখন আমাকে দেখিতে হইবে। এইরূপ স্থির করিয়া হরিপ্রসন্ন বাবু মজিদ খাঁর সহিত দেখা করিতে বাহির হইয়া পড়িলেন।

সকল অধ্যায়

১. ১.০১. প্রথম পরিচ্ছেদ – আলোকে
২. ১.০২. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অন্ধকারে
৩. ১.০৩. তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নারীহত্যা
৪. ১.০৪. চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সংবাদ-পত্রের মন্তব্য
৫. ১.০৫. পঞ্চম পরিচ্ছেদ – দেবেন্দ্রবিজয়
৬. ১.০৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – মা ও মেয়ে
৭. ১.০৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – লতিমন
৮. ১.০৮. অষ্টম পরিচ্ছেদ – নুতন রহস্য
৯. ১.০৯. নবম পরিচ্ছেদ – বেনামী পত্র
১০. ১.১০. দশম পরিচ্ছেদ – অনুসন্ধান
১১. ১.১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – দারুণ সন্দেহ
১২. ১.১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – ছুরি – বিষাক্ত
১৩. ২.০১. প্রথম পরিচ্ছেদ – পরিচয়
১৪. ২.০২. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – আর এক রহস্য
১৫. ২.০৩. তৃতীয় পরিচ্ছেদ – আত্মসংযম
১৬. ২.০৪. চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ প্রবল হইল
১৭. ২.০৫. পঞ্চম পরিছেদ – বালক শ্রীশচন্দ্র
১৮. ২.০৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – দ্বিতীয় পত্র
১৯. ২.০৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – জোহেরা
২০. ২.০৮. অষ্টম পরিছেদ – উদ্যানে
২১. ২.০৯. নবম পরিচ্ছেদ – বিশ্রম্ভালাপে
২২. ২.১০. দশম পরিচ্ছেদ – ঘটনা-সূত্র
২৩. ২.১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – বিপদে
২৪. ২.১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – সংজ্ঞালাভে
২৫. ৩.০১ – প্রথম পরিচ্ছেদ – আর এক উদ্যম
২৬. ৩.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – উদ্যমের ফল
২৭. ৩.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – কে ধরা পড়িল?
২৮. ৩.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – মনে মনে নানা ভাবের প্রাবল্য
২৯. ৩.০৫ পঞ্চম পরিছেদ – সাখিয়া
৩০. ৩.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে
৩১. ৩.০৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – তিতুরাম
৩২. ৩.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – পারিবারিক
৩৩. ৩.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – পূর্ব্বকথা
৩৪. ৩.১০ দশম পরিচ্ছেদ – উকীল-হরিপ্রসন্ন
৩৫. ৩.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – মুখ বন্ধ
৩৬. ৩.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – মুখবন্ধের কারণ কি?
৩৭. ৩.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কারণ – দুর্জ্ঞেয়
৩৮. ৩.১৪ – চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে
৩৯. ৩.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ-বৈষম্য
৪০. ৪.০১ প্রথম পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে না বিপক্ষে?
৪১. ৪.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পট-পরিবর্ত্তন
৪২. ৪.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ভ্রম-নিরাস
৪৩. ৪.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – দিলজানের কথা
৪৪. ৪.০৫ পঞ্চম পরিছেদ – ঘটনা-বৈষম্য
৪৫. ৪.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – প্রত্যাগমন
৪৬. ৪.০৭ – সপ্তম পরিচ্ছেদ – দোষক্ষালনের জন্য কি?
৪৭. ৪.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – তাহার পর কি হইল?
৪৮. ৪.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – ইহা কি সম্ভব?
৪৯. ৪.১০ দশম পরিচ্ছেদ – রোগশয্যায় অরিন্দম
৫০. ৪.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – উপদেশ
৫১. ৪.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – গুরু ও শিষ্য
৫২. ৪.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কাজের কথা
৫৩. ৪.১৪ চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – ভ্রম-সংশোধন
৫৪. ৫.০১ প্রথম পরিচ্ছেদ – কারাকক্ষে
৫৫. ৫.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-দুর্ভেদ্য
৫৬. ৫.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-বৈষম্য
৫৭. ৫.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঝটিকা ভিন্নদিকে বহিল
৫৮. ৫.০৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – তদন্তে
৫৯. ৫.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কণ্ঠহার
৬০. ৫.০৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – মেঘ-ঘনীভূত
৬১. ৫.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – মহা বিপদ্
৬২. ৫.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – ধরা পড়িল
৬৩. ৫.১০ দশম পরিচ্ছেদ – নিজের বিষে
৬৪. ৫.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – নিজে মরিল
৬৫. ৫.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – শেষ
৬৬. ৫.১৩ উপসংহার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন