৪.১০ দশম পরিচ্ছেদ – রোগশয্যায় অরিন্দম

পাঁচকড়ি দে

সহসা এই একটা অপ্রত্যাশিতপূর্ব্বক ঘটনায় দেবেন্দ্রবিজয় মহাবিব্রত হইয়া উঠিলেন| দেখিলেন, তিনি এক প্রবল রহস্য-স্রোতে সটান্ ভাসিয়া চলিয়াছেন| কূলে উঠিবার জন্য তিনি যখন যে তীর-লতা সুদৃঢ়বোধে ব্যগ্রভাবে দুই বাহু প্রসারিত করিয়া টানিয়া ধরিতেছেন, তাহাই ছিঁড়িয়া যাইতেছে| বরংবার এই অকৃতকার্য্যতা তাঁহার গর্ব্বিত হৃদয়ে দারুণ আঘাত করিল| তিনি একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন কি করিবেন, কিছু স্থির করিতে না পরিয়া ক্ষুন্নমনে মনিরুদ্দীনের বাটী হইতে অবিলম্বে বাহির হইয়া পড়িলেন| নিজের বাটীতে না ফিরিয়া অরিন্দম বাবুর সহিত দেখা করিতে চলিলেন| এই একটা দারুণ গোলযোগে পড়িয়া অনেকদিন তাঁহার কোন সংবাদ লওয়া হয় নাই; সংবাদটা লওয়া হইবে| তাহা ছাড়া তাহার নিকটে সমুদয় খুলিয়া বলিলে, তিনি দুই-একটা সুপরামর্শও দেতে পারিবেন; মনে মনে এইরূপ স্তির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই স্বনামখ্যাত বৃদ্ধ ডিটেক্টিভ অরিন্দম বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করাই যুক্তি-যুক্ত বোধ করিলেন|
অরিন্দম বাবু একজন নামজাদা পাকা ডিটেক্টিভ| বিশেষতঃ ফুল সাহেবের কেস্টায় তাঁহার নাম আরও বিখ্যাত করিয়া দিয়াছে| অরিন্দম বাবুকে দেখিলে তাঁহাকে বুদ্ধিমানের পরিবর্ত্তে নির্ব্বোধই বোধ হয়; তাঁহার সরল মুখাকৃতি দেখিয়া কিছুতেই বুঝিতে পারা যায় না, ইনি ডিটেক্টিভ পুলিসের একজন তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালী, প্রধান কর্ম্মচারী| তিনি প্রথমে যখন কর্ম্মে প্রবিষ্ট হন, পুলিসের প্রবীণ কর্ম্মচারীগণের মধ্যে কেহই তখন মনে করেন নাই, কালে ইনি এমন একজন হইয়া উঠিবেন| এমন কি শেষে, যাঁহারা পূর্ব্বে এই কথা মনে করিয়াছিলেন, তাঁহারাই অনেকে অনেক সময়ে সেই নির্ব্বোধের মত চেহারার অরিন্দম বাবুর পরামর্শ গ্রহণে কুণ্ঠিত হইতেন না| যখন তাঁহারা কোন একটা জটিল রহস্যপূর্ণ মামলা হাতে লইয়া রহস্যভেদের পন্থা-অন্বেষণে একেবারে হতাশ হইয়া পড়িতেন, তখন অরিন্দম বাবু সেখানে উপস্থিত হইয়া সহসা এক আঘাতেই রহস্য-যব্নিকা ভেদ করিয়া নিজের অমানুষিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতেন|
আজ প্রায় ছয়মাসকাল অরিন্দম বাবু বাতরোগে শয্যাশায়ী| শয্যাশায়ী হইবার অনেক পূর্ব্বে তিনি কর্ম্মত্যাগ করিয়াছিলেন| বয়স বেশি হইয়াছিল বলিয়া তিনি যে আর বড় পরিশ্রম করিতে পারিতেন না; তাহা নহে; সে জন্য তিনি কর্ম্মত্যাগ করেন নাই| বৃদ্ধ বয়সেও তাঁহার দেহে যৌবনের সামর্থ্য ছিল| সারাজীবনটা চোর ডাকাত খুনীর পিছনে পিছনে ঘুরিয়া সহসা একদিন তাঁহার নিজের জীবনের উপরে স্বতঃ কেমন একটা ঘৃণা জন্মিয়া গেল| এবং সেই ঘৃণা তাঁহার হৃদয়স্থিত অদম্য উদ্যম একেবারে নষ্ট করিয়া ফেলিল| তিনি আর ইহাতে সুখবোধ করিতে পারিলেন না| আর যেন তাহা ভাল লাগিল না| শেষে তিনি এমন নিরুদ্যম হইয়া পড়িলেন যে, দুই-একটা মামলা হাতে লইয়া তাঁহাকে অকৃতকার্য্যই হইতে হইল| এমন কি যথাযোগ্য মনোযোগের অভাবে তিনি একবার একবার একজন নির্দ্দোষীকে দণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন| সেইবার শেষবার-একজন নির্দ্দোষীকে দণ্ডিত করিয়া তাঁহার মনে এমন একটা দুর্নিবার আত্মগ্লানি উপস্থিত হইল যে, তিনি সেইদিনই কর্ম্মে ইস্তফা দিলেন| ইহাতেও তাঁহার নিস্তার ছিল না| যেমন বড় বড় ব্যাবহারজীবীগণ নিত্য আদালত-গৃহে যাতায়াত করিয়া, প্রভৃত ধন এবং তৎসহ তেমনই প্রভূত খ্যাতি, প্রতিপত্তি লাভ করিয়া শেষ দশায় যখন ব্যবসায়ে একেবারে বীতরাগ হইয়া পড়েন, তখন তাঁহাদের আর কিছু ভাল না লাগিলেও গৃহে বসিয়া, অপরকে নিজের তীক্ষ্ণধার অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত যেমন খুব আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন, অরিন্দম বাবুরও শেষ দশায় ঠিক তাহাই ঘটিয়াছিল| কিন্তু অরিন্দম বাবুর উদ্দেশ্যটা একটু স্বতন্ত্র রকমের ছিল; যাহাতে কোন অর্ব্বাচীনের হাতে পড়িয়া কোন নির্দ্দোষী দণ্ডিত না হয়, সেজন্য তিনি পরামর্শগ্রাহীদের ভ্রমের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতেন| সর্ব্বাগ্রে তাহাদিগকে তাহাদের ভ্রমগুলি দেখাইয়া দিয়া পরে হত্যাকারীকে ধরিবার সূত্র নির্দ্দেশ করিয়া দিতেন| এবং ইহাতে তাঁহার খুব উৎসাহ দেখা যাইত| তাঁহার সেই উৎসাহ দেখিয়া সহজেই সকলে বুঝিতে পারিত, তাঁহার সেই নষ্ট উদ্যম আবার নবীবভাবে তাঁহার হৃদয়ে ফিরিয়া আসিয়াছে|
অরিন্দম বাবু চিকিৎসার জন্য কালীঘাটে গঙ্গার ধারে একখানি বাটী ভাড়া লইয়া এখন বাস করিতেছেন| শুশ্রূষার জন্য বাড়ীর মেয়েছেলেরাও সঙ্গে আসিয়াছেন| এদিকে চিকিৎসাও খুব চলিতেছে; কিন্তু কিছুতেই রোগের উপশম হইতেছে না| শরীরের অবস্থাও ভাল নহে-তিনি একেবারে শয্যাগত হইয়া পড়িয়াছেন| এমন কি এখন উঠিয়া বসিবার সামর্থ্যও নাই|
দেবেন্দ্রবিজয় যখন অরিন্দম বাবুর বাটীতে উপস্থিত হইলেন, তখন বেলা অনেক বাড়িয়া গিয়াছে| অরিন্দম বাবুর গৃহে তাঁহার অবারিত দ্বার-তিনি সরাসরি ভিতর বাটীতে প্রবেশ করিয়া দ্বিতলে উঠিলেন| এবং দ্বিতলস্থ যে কক্ষে রুগ্নশয্যায় অরিন্দম বাবু পড়িয়াছিলেন, সেই কক্ষ মধ্যে তিনি প্রবেশ করিলেন| অরিন্দম বাবু বিছানায় যন্ত্রণাসূচক দীর্ঘানিঃশ্বাস ফেলিতেছেন, এক-একবার চীৎকার করিয়াও উঠিতেছিলেন| এমন সময়ে অনেক দিনের পর আজ সহসা দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয় নিজের রোগের কথা তিনি একেবারে ভুলিয়া গেলেন| অত্যন্ত আগ্রহের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “আরে কেও-দাদা? এস-অনেকদিন তোমাকে দেখি নাই|”
দেবেন্দ্রবিজয় শয্যাপার্শ্বে উপবেশন করিয়া বলিলেন, “আপনি এখন কেমন আছেন? একটা গোলযোগে পড়িয়া অনেক দিন আপনার সঙ্গে দেখা করিতে পারি নাই|”
অরিন্দম বাবু কহিলেন, “কই কিছুতেই কিছু হইতেছে না-আর যন্ত্রণাও সহ্য হয় না| সে কথা যাক্, তোমার যে এতদিন দেখা নাই, কেন বল দেখি-কি এমন গোলযোগে পড়িয়াছিলে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন,-“একটা খুনের কেস হাতে লইয়া বড়ই বিব্রত হইয়া পড়িয়াছি; এখন আপনার পরামর্শ বিশেষ দরকার; আর কোন উপায় দেখিতেছি না|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “বটে, এমন কি ব্যাপার?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বড় শক্তলোকের পাল্লায় পড়িয়াছি-আমাকে একদম্ বোকা বানাইয়া দিয়াছে|”
বুকের মর্ম্মকোষ হইতে টানিয়া খুব একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তাই ত-লোকটা এমনই ভয়ানক না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যতদূর হইতে হয়| এমন কি, ব্যাপার দেখিয়া আমার বোধ হইতেছে, এবার আমি আপনার সেই পরমশত্রু ফুল সাহেবেরই প্রেতাত্মার হাতে পড়িয়াছি| সে আমাকে এমন বিপদে ফেলিয়াছিল যে, মনে করিলে অনায়াসে আমার প্রাণনাশও করিতে পারিত| অনুগ্রহপূর্ব্বক তাহা করে নাই-এই আমার পরম সৌভাগ্য|”

সকল অধ্যায়

১. ১.০১. প্রথম পরিচ্ছেদ – আলোকে
২. ১.০২. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অন্ধকারে
৩. ১.০৩. তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নারীহত্যা
৪. ১.০৪. চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সংবাদ-পত্রের মন্তব্য
৫. ১.০৫. পঞ্চম পরিচ্ছেদ – দেবেন্দ্রবিজয়
৬. ১.০৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – মা ও মেয়ে
৭. ১.০৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – লতিমন
৮. ১.০৮. অষ্টম পরিচ্ছেদ – নুতন রহস্য
৯. ১.০৯. নবম পরিচ্ছেদ – বেনামী পত্র
১০. ১.১০. দশম পরিচ্ছেদ – অনুসন্ধান
১১. ১.১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – দারুণ সন্দেহ
১২. ১.১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – ছুরি – বিষাক্ত
১৩. ২.০১. প্রথম পরিচ্ছেদ – পরিচয়
১৪. ২.০২. দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – আর এক রহস্য
১৫. ২.০৩. তৃতীয় পরিচ্ছেদ – আত্মসংযম
১৬. ২.০৪. চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ প্রবল হইল
১৭. ২.০৫. পঞ্চম পরিছেদ – বালক শ্রীশচন্দ্র
১৮. ২.০৬. ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – দ্বিতীয় পত্র
১৯. ২.০৭. সপ্তম পরিচ্ছেদ – জোহেরা
২০. ২.০৮. অষ্টম পরিছেদ – উদ্যানে
২১. ২.০৯. নবম পরিচ্ছেদ – বিশ্রম্ভালাপে
২২. ২.১০. দশম পরিচ্ছেদ – ঘটনা-সূত্র
২৩. ২.১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – বিপদে
২৪. ২.১২. দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – সংজ্ঞালাভে
২৫. ৩.০১ – প্রথম পরিচ্ছেদ – আর এক উদ্যম
২৬. ৩.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – উদ্যমের ফল
২৭. ৩.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – কে ধরা পড়িল?
২৮. ৩.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – মনে মনে নানা ভাবের প্রাবল্য
২৯. ৩.০৫ পঞ্চম পরিছেদ – সাখিয়া
৩০. ৩.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে
৩১. ৩.০৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – তিতুরাম
৩২. ৩.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – পারিবারিক
৩৩. ৩.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – পূর্ব্বকথা
৩৪. ৩.১০ দশম পরিচ্ছেদ – উকীল-হরিপ্রসন্ন
৩৫. ৩.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – মুখ বন্ধ
৩৬. ৩.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – মুখবন্ধের কারণ কি?
৩৭. ৩.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কারণ – দুর্জ্ঞেয়
৩৮. ৩.১৪ – চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে
৩৯. ৩.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ-বৈষম্য
৪০. ৪.০১ প্রথম পরিচ্ছেদ – স্বপক্ষে না বিপক্ষে?
৪১. ৪.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পট-পরিবর্ত্তন
৪২. ৪.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ভ্রম-নিরাস
৪৩. ৪.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – দিলজানের কথা
৪৪. ৪.০৫ পঞ্চম পরিছেদ – ঘটনা-বৈষম্য
৪৫. ৪.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – প্রত্যাগমন
৪৬. ৪.০৭ – সপ্তম পরিচ্ছেদ – দোষক্ষালনের জন্য কি?
৪৭. ৪.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – তাহার পর কি হইল?
৪৮. ৪.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – ইহা কি সম্ভব?
৪৯. ৪.১০ দশম পরিচ্ছেদ – রোগশয্যায় অরিন্দম
৫০. ৪.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – উপদেশ
৫১. ৪.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – গুরু ও শিষ্য
৫২. ৪.১৩ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কাজের কথা
৫৩. ৪.১৪ চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ – ভ্রম-সংশোধন
৫৪. ৫.০১ প্রথম পরিচ্ছেদ – কারাকক্ষে
৫৫. ৫.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-দুর্ভেদ্য
৫৬. ৫.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-বৈষম্য
৫৭. ৫.০৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঝটিকা ভিন্নদিকে বহিল
৫৮. ৫.০৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – তদন্তে
৫৯. ৫.০৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কণ্ঠহার
৬০. ৫.০৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – মেঘ-ঘনীভূত
৬১. ৫.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – মহা বিপদ্
৬২. ৫.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – ধরা পড়িল
৬৩. ৫.১০ দশম পরিচ্ছেদ – নিজের বিষে
৬৪. ৫.১১ একাদশ পরিচ্ছেদ – নিজে মরিল
৬৫. ৫.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – শেষ
৬৬. ৫.১৩ উপসংহার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন