শুনলাম এবং মানলাম
আসলে উরাইযের জন্য এতো ফতোয়ার প্রয়োজন ছিল না। কোরআন ও হাদিসেই যখন চেহারার পর্দার আবশ্যিকতার বর্ণনা রয়েছে, তখন এতসব ফতোয়ার দরকার কি?
উরাইয বলল, আমি পূর্বে জেনেছিলাম ‘মুখমণ্ডলের পর্দার প্রথা কেবল আরব তথা সৌদি অধিবাসীদের নিজস্ব রীতি’। কিন্তু গোটা পৃথিবীর নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য শোনার পর আমার সে সন্দেহ দূর হয়ে গেছে।
সাহসী সিদ্ধান্ত
উরাইয ও মিহার মাঝে আলোচনার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে সারা বলল, প্রকৃত শক্তিশালী সেই, যে সঠিক সময়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং নিজেকে পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। আজ আমাদের কতো বোন চেহারার পর্দার গুরুত্ব বোঝে অথবা অন্তত এতটুকু মানে যে, চেহারা ঢেকে রাখাটাই উত্তম। তাদের সেটা করার ইচ্ছাও জাগে। কতেক সময় কোনো পূর্ণ পর্দাবৃতা নারীকে দেখে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হায়! আমিও যদি তার মতো পরিপূর্ণ পর্দা করতে পারতাম। এভাবেই বছরের পর বছর চলে যায়; কিন্তু তারা আল্লাহর আনুগত্যের পথে ফিরে আসার সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় না। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন–
وَ مَا کَانَ لِمُؤۡمِنٍ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ اِذَا قَضَی اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗۤ اَمۡرًا اَنۡ یَّکُوۡنَ لَہُمُ الۡخِیَرَۃُ مِنۡ اَمۡرِہِمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیۡنًا
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তার রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।’ (সূরা আহযাব, আয়াত : ৩৬)
অর্থাৎ, আল্লাহ ও তার রাসূলের আদেশ পালনে ঐচ্ছিকতার কোনো সুযোগ নেই। ইচ্ছা হোক বা না হোক আল্লাহর বিধান মানতেই হবে। আর আল্লাহ তাআলাও কোনো মানুষের ওপর তার সাধ্যাতীত কাজ চাপিয়ে দেন না। পর্দা আল্লাহ প্রদত্ত এক অলঙ্ঘনীয় বিধান। এটি চাশতের নামায ও দান-সদকার ন্যায় ইচ্ছা নির্ভর কোনো ইবাদত নয়। বরং এটি ইসলামের এক মহান ফরয বিধান। পরকালে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। এটি ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর মাঝেই মুসলিম নারী-পুরুষ উভয়ের অন্তরের পবিত্রতা নিহিত। আল্লাহ তাআলা যেমনটি বলেছেন–
“ذٰلِکُمۡ اَطۡہَرُ لِقُلُوۡبِکُمۡ وَ قُلُوۡبِہِنَّ “
‘এটা তোমাদের অন্তরের জন্যে এবং তাদের অন্তরের জন্যে অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’ (সূরা আহযাব, আয়াত : ৫৩)
পর্দা নারীর লজ্জার ভূষণ। এটি নারী লাজুকতা ও কোমলতায় পূর্ণতা আনে।
উরাইয ও মিহা! দেখো, পৃথিবীর সবকিছুই পর্দা করে।
সমীরণের চাদরে ঢাকা ভূপৃষ্ঠের ঘূর্ণন। তাজা ফল-ফলাদিতে আছে বাকলের আবরণ। খাপের আচ্ছাদনে থাকে তরবারী। কলমের বডিতে ঢাকা থাকে কালি। অমূল্য চোখের সুরক্ষায় আছে পাপড়ির ছাউনি।
নারী হলো সুবাসিত ফুল। সবাই চায় তার ঘ্রাণ নিতে। তাই তাদের পর্দাবৃত হয়ে থাকতে হবে। ফলের বাকল ফেলে দিলে তা নষ্ট হয়ে যায়। আবরণ মুক্ত কলা কালো হয়ে যায়।
তোমরা এসব কিছুর চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান। তাই নিজেদেরকে পর্দাবৃত রাখো।
সারার কথাগুলো মিহার মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলল। ইন্টারনেটে পড়া এক আমেরিকান তরুণীর ঘটনা তার মনে পড়ে গেল। সে সারাকে বলল, হ্যাঁ, সত্যিই, পর্দায় থাকার মাঝেই রয়েছে নারীর প্রকৃত মর্যাদা। এই পর্দার বদৌলতে অনেক অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছে।
সারা আশ্চর্য হয়ে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। মিহা বলতে লাগল– ঘটনাটি আমি ইন্টারনেটে পড়েছিলাম। এক পূর্ণ পর্দাশীলা নারীর হাতে সাতজন অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছে। সে ছিল এক আমেরিকান মুসলিম নারী। নিজ ধর্ম ইসলাম নিয়ে তার গর্বের শেষ ছিল না। তার কারণে তিনজন প্রফেসর এবং চারজন শিক্ষার্থী ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
মেয়েটির কারণে ইসলাম গ্রহণকারী এক প্রফেসর সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া সাক্ষাতকারে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের ভার্সিটিতে এক আমেরিকান মুসলিম নারী পড়ত। সে আপাদমস্তক পর্দায় ঢেকে ভার্সিটিতে আসত। ভার্সিটির এক প্রফেসর ছিল ইসলাম ধর্মের ঘোর বিদ্বেষী। সে সবসময় অবলা সরলা মেয়েটিকে নানাভাবে বিব্রত করার চেষ্টা করত। কিন্তু মেয়েটি ঈমানের বলে বলিয়ান ছিল। অবশেষে সে অধৈর্য হয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে অভিযোগ জানাল।
ভাইস চ্যান্সেলর বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য একটি বিতর্ক সভা আয়োজন করলেন এবং দুজনকেই তাদের আপত্তিসমূহ গ্রহণযোগ্য প্রমাণসহ পেশ করতে বললেন। ভার্সিটির প্রায় সব প্রফেসরই এই অভিনব বিতর্ক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল।
মেয়েটি প্রফেসরের ব্যাপারে বলল, ইনি ইসলাম ধর্মকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখেন। আর সেজন্যেই তিনি আমার সাথে অসঙ্গত আচরণ করেন। উপস্থিত অপর এক অমুসলিম ছাত্রী তার কথার সত্যায়ন করে প্রফেসরকে দোষী সাব্যস্ত করল।
প্রফেসর দেবার মতো উত্তর খুঁজে না পেয়ে ইসলামকে কটাক্ষ করে আবোল তাবোল বকতে শুরু করল। ছাত্রীটিও তখন প্রফেসরের কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিল এবং ইসলামের প্রকৃত বাণী সবার সামনে তুলে ধরল। ছাত্রীটির প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য উপস্থিত সবার মনে দাগ কেটে গেল। তারা তার কাছে ইসলাম সম্পর্কে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল। মেয়েটিও অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তাদের সব প্রশ্নের সন্তোষমূলক জবাব দিতে থাকল। প্রফেসর যখন দেখল বিতর্ক অনুষ্ঠানটি ইসলামী লেকচারের রূপ পরিগ্রহ করেছে, তখন সে সেখান থেকে কেটে পড়ল।
প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে মেয়েটি উপস্থিত প্রফেসরবৃন্দ ও শিক্ষার্থীদের মাঝে ইসলামী জ্ঞান সম্বলিত কিছু বই বিতরণ করল। এই ঘটনাটি কিছু দিন পর্যন্ত টক অব দ্যা ভার্সিটি ছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই ভার্সিটির চার শিক্ষার্থী এবং তিন প্রফেসর ইসলাম গ্রহণ করে নিল।
সারা এবং উরাইয আগ্রহের সাথে সেই আকর্ষণীয় ঘটনাটি শুনছিল। উরাইযের মনে একটি প্রশ্ন বারবার উকি দিচ্ছিল।
নারীদের মাহরাম কারা
আচ্ছা সারা! তো আমি কার কার সামনে চেহারা খোলা রাখতে পারব? প্রশ্ন উরাইযের।
জবাবে সারা বলল, নারীরা তাদের মাহরামের সামনে চেহারা খোলা রাখতে পারে। এরা হলেন সেসকল লোক যাদের সাথে কোনভাবেই বিবাহ বৈধ নয়। আল্লাহ তাআলা সূরা নূর-এর মধ্যে তাদের কথা আলোচনা করেছেন–
وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِہِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَہُنَّ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَہُنَّ اِلَّا مَا ظَہَرَ مِنۡہَا وَ لۡیَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِہِنَّ عَلٰی جُیُوۡبِہِنَّ ۪ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَہُنَّ اِلَّا لِبُعُوۡلَتِہِنَّ اَوۡ اٰبَآئِہِنَّ اَوۡ اٰبَآءِ بُعُوۡلَتِہِنَّ اَوۡ اَبۡنَآئِہِنَّ اَوۡ اَبۡنَآءِ بُعُوۡلَتِہِنَّ اَوۡ اِخۡوَانِہِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ اِخۡوَانِہِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ اَخَوٰتِہِنَّ اَوۡ نِسَآئِہِنَّ اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُہُنَّ اَوِ التّٰبِعِیۡنَ غَیۡرِ اُولِی الۡاِرۡبَۃِ مِنَ الرِّجَالِ اَوِ الطِّفۡلِ الَّذِیۡنَ لَمۡ یَظۡہَرُوۡا عَلٰی عَوۡرٰتِ النِّسَآءِ ۪ وَ لَا یَضۡرِبۡنَ بِاَرۡجُلِہِنَّ لِیُعۡلَمَ مَا یُخۡفِیۡنَ مِنۡ زِیۡنَتِہِنَّ ؕ وَ تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ جَمِیۡعًا اَیُّہَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
‘ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এব তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌন কামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা নূর, আয়াত : ৩১)
মাহরামরা হলেন–
* স্বামী * পিতা * শশুড়
* পুত্র (আপন ও দুধ সম্পর্কিত)
* স্বামীর সন্তান তথা বৈমাত্রেয় পুত্র
* ভাই (বংশীয় ও দুধ সম্পর্কিত)
* ভ্রাতুষ্পত্র * ভগ্নিপুত্র * স্ত্রীলোক * অধিকারভূক্ত দাস
* যৌন কামনামুক্ত পুরুষ * নাবালেগ বালক
মিহা এবং উরাইয নিশ্চিদ্র মনোযোগের সাথে সারার কথা শুনছিল। আল্লাহর বিধানের সামনে তাদের মাথা নত হয়ে এলো। উরাইয তো নিজের উড়নার এক প্রান্ত দিয়ে চেহারা ঢেকে নিয়ে বলল, আজকের পর এই চেহারা মাহরাম ব্যতিত আর কেউ দেখবে না। সত্যিই! আল্লাহর আনুগত্যের মাঝে কতো প্রশান্তি।
এরই মধ্যে মাগরিবের আযান শোনা গেল। চোখের পলকে কেটে গেল তিন তিনটি ঘণ্টা। প্রদর্শনীর সময়ও প্রায় শেষ। কিন্তু কিতাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তখনও পড়া হয়নি।
সারা বলল, উরাইয ও মিহা! তোমাদের তাড়া নেই তো? কিতাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এখনও বাকী।
যার মধ্যে যেসকল ওলামায়ে কেরাম পরপুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখাকে বৈধ বলেছেন, তাদের প্রদত্ত প্রমাণাদি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আমি চাই তোমরা দুজন এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনাটুকুও শুনে যাও। যেন বিরোধী পক্ষের প্রমাণাদি সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে পারো। কি বলো? তোমরা শুনবে?
হ্যাঁ, নিশ্চয় শুনব। কিন্তু তার আগে মাগরিবের নামাযটা পড়ে নেয়া দরকার। বলল উরাইয।
তারা তিনজন ধীরেসুস্থে মাগরিবের নামায আদায় করে আবার এসে বসল। সারা যথারীতি পড়া শুরু করল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন