আন্দোলন; বারবার ফিরে আসে বাংলাদেশে যুদ্ধের বেশে

দাউদ হায়দার

বাংলাদেশ কি আসলেই শোকের দুঃখের না যুদ্ধের?

তাহলে আমার মা কোথায়
কোথায় বর্ষিয়ান পিতা
আমার মেয়ে
গর্ভিণী স্ত্রী
ভিটে ঘর-বাড়ি
বলতে পারেন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ?

হাঁ আমি জানি, আপনার পারবেন
পারবেন ভেজা-ভেজা কন্ঠে
চোখে জড়িয়ে রুমাল একজন যথার্থ প্রেমিকের মতো
মাটিতে পা ঠেকিয়ে
ঠায় রোদ্দুরে কিংবা প্রবল বর্ষণে

হাঁ, আপনারা পারবেন : পারবেন…

আমার মা; সেই মা
যে আমাকে না খেয়ে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন
চোখের আড়াল হলেই তন্নতন্ন কোরে খুঁজেছেন
রোদ বৃষ্টিতে আঁচলে ঢেকেছেন
গেয়েছেন ঘুম পাড়ানিয়া
পরম আদরে চুমু দিয়েছেন সকাল বিকাল
পাঠিয়েছেন হাত পা ধুইয়ে
আঁচড়িয়ে চুল
আয়নায় দেখিয়ে মুখ
খেলার সাথীদের কাছে

সেই মা; যে আমার আবদারে বিরক্ত হয়নি কখনো
বরং কপালে মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে বুঝিয়েছেন ময়নার মতোন

সেই মা এখন কোথায়
যিনি রাত্রিকালে ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখে যেতেন পুনরায়?

পিতা, সেই বর্ষিয়ান পিতা?

যে আমাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন এমেলা ওমেলায়
কিনে দিতেন টিনের বাঁশি কাঠের ঘোড়া লাটাই সুতো
রঙীন ঘুড়ি
আমার ইচ্ছেমতো পোষাক-আশাক!

বোঝাতেন খেলাচ্ছলে সংসারের ঝামেলা
বিশাল জমিজমার টুকরো টুকরো নথিপত্র
চাইতেন একটা লাল টুকটুকে বৌ-মা
যে তাকে যখন তখন
জায়নামাজ তসবী আর পানের বাসন এগিয়ে দেবে
সহজেই ডাকবে ছেলের চেয়েও গভীর ভালবাসায়

সেই পিতা, যিনি আমাকে নিয়ে স্বপ্নে দেখতেন বিভিন্ন প্রহরে!

তিনি এখন কোথায়?

কোথাইবা আমার সেই পাঁচ বছরের মেয়ে?

যে গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকত
হঠাৎ কোরে ধরতে গেলে দৌড়ে যেত
ভেঁঙচি কাটত হেসে খেলে
দোলায় চেপে হারিয়ে যেত সাতসমুদ্দুর তেরনদী
অফিস গেলে বায়না ধরতো পতুল আনতে
বিয়ে দিতো যখন তখন ছেলে মেয়ের
বাইরে থেকে ফিরে এলেই হাত রাখত পকেট মাঝে
লজেঞ্চুষের থলি পেলেই চুমু দিতো ঠোঁটের উপর
মাদুর পেতে খেতে গেলেই ঠাঁই নিতে সে মধ্যিখানে

সেই মেয়েটি কোথায় গেল?

কোথায় গেল গর্ভিণী সেই স্ত্রী বা?

এক পা হাঁটতে গেলেই পেটের ব্যাথায় পড়ে যেত
খাটের উপর শুয়ে থাকত অতিকষ্টে
ঘর গোছাতে মন বসেনা
বাটনা বাটে পাড়ার লোকে

চেয়ে থাকত একটি সময়
কেমন করে জন্ম নেবে একটি ছেলে—
বাংলাদেশে!

সবতো আমার চলেই গেলো
কোথায় থাকি এখন আমি

ঘর-বাড়ি তো পুড়েই গেছে
পোড়া ভিটেয় গাছ হয়েছে হাজার রকম

হাঁটতে গেলেও ভয় লাগে যে
পায়ে বাধে মেয়ের শরীর পিতার হাত মায়ের চুল
ছিদ্র করা গর্ভিণী এক স্ত্রীর বুক

এদিকে আবার হঠাৎ কোরে কানের মধ্যে ঢুকেও পড়ে
“দাঁড়াও তুমি—
বাংলাদেশে যুদ্ধ আসে এমনি কোরেই
পরক্ষণেই জিতে যাবে অনায়াসে
আমরা জানি; তুমিও জানো!”

৮/১০/৭১

সকল অধ্যায়

১. জন্মই আমার আজন্ম পাপ
২. জর্ণাল : স্মৃতিচিত্র
৩. আন্দোলন; বারবার ফিরে আসে বাংলাদেশে যুদ্ধের বেশে
৪. চলে এলুম
৫. আলোর গভীরে
৬. আমি তো প্রেমিক নই
৭. নিজস্ব মানুষ
৮. একটি বালক
৯. কার জন্যে ভালবাসা
১০. বাংলাদেশ
১১. তুমিই আমার প্রেমিকা
১২. স্বদেশ, তোমার মুখ
১৩. প্রতিদিন দুঃখ আসে আমার নিবাসে
১৪. মিছিলে তোমার মুখ
১৫. মায়ের চোখে
১৬. প্রেম
১৭. তোমার ছায়া
১৮. অলৌকিক বিকেল
১৯. একটি নিষিদ্ধ কবিতা
২০. তুমি আমার কবিতা পড়োনা
২১. না পারলেও পুনর্বার ভেবে দ্যাখো তুমি
২২. আমরা যেন খাঁচায় পোষা পাখী
২৩. আমার ভালবাসা
২৪. একটি ভালবাসার মুখ
২৫. একদিন কেউ কাউকে চিনবে না
২৬. নিরপরাধ বৃক্ষমূল
২৭. অতন্দ্রিলা; তুই আমার কাছে থাক
২৮. একলা হাতে
২৯. হেলেনের মতো চুম্বন
৩০. ভালোবাসার বাগান থেকে
৩১. আমার পিতাকে
৩২. আমিও শহীদ হয়ে যাবো
৩৩. স্বগত কবিতাগুচ্ছ/১
৩৪. অন্তর্গত উজ্জ্বল বিষাদ
৩৫. আমার স্ত্রীর প্রতি
৩৬. একটি যথার্থ ভালবাসা
৩৭. জেব্রা ক্রসিং-এ
৩৮. চাঁদের ভেতরে একজন
৩৯. নগ্নতাই আমার সৌন্দৰ্য
৪০. মধ্যরাতে রূপোলী চাঁদ
৪১. খেলা
৪২. আমি ভাল আছি, তোমরা?
৪৩. ছন্দে, ভুল ছন্দে গদ্যপদ্য খেলা
৪৪. একদিন আমারো প্রেমিকা ছিলো
৪৫. আমাদের সফলতা, মৃত্যু
৪৬. কবিতার এলোমেলো ভেলা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন