কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো বিল্ডিং-এর ধূসর করিডোর যেন নিঃশব্দ এক ইতিহাস বয়ে বেড়ায়। বেলা তখন এগারোটা পেরিয়েছে। দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঝাঁপ দিচ্ছে ক্লাসরুমের মেঝেতে। গরম আর অস্থিরতা মিলেমিশে তৈরি করেছে একধরনের উদ্বেগ। আজ সাইকোলজি বিভাগের প্রথম ক্লাস।
ঘরে টুকটাক গুঞ্জন—নতুন বন্ধুত্বের শুরু, পরিচয়ের খোঁজ, হালকা হাসি, কিছু চুপচাপ মুখ। এমন সময় দরজার ফ্রেমে দেখা গেল এক উচ্চতাপূর্ণ ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব।
তিনি প্রবেশ করলেন ধীরপায়ে—একটা জীর্ণ, কোটের ওপরে চাপানো কটন শার্ট, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, হাতে একটা পুরোনো নোটবুক।
“Good morning,” গলার স্বর শান্ত, অথচ গম্ভীর।
“আমি অধ্যাপক সোমেন্দ্র দাশ। আজ থেকে আমরা একসাথে মানবমনের রহস্যভেদ শুরু করব।” তিনি তাকালেন ছাত্রদের দিকে।
ঘরে একটা নিরবতা নামল, চোখে চোখে কৌতূহল।
“আচ্ছা, এই নতুন পরিবেশে সবার কেমন লাগছে?”
একজন মেয়ে বলল, “Excited, sir!”
আরেকজন ছেলেও যোগ দিল, “A bit nervous, sir.”
“ভয় হচ্ছে?” হালকা হেসে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
তারপর হঠাৎই…
তিনি হাত তুললেন বোর্ডের দিকে কিছু লেখার জন্য। আর সেই মুহূর্তেই সবার চোখে ধরা পড়ল—তার জামার বাঁ হাতার সঙ্গে একটা সরু, সবুজ সাপ যেন প্যাঁচিয়ে আছে।
“সা…সাপ!”—কেউ চিৎকার করে উঠল।
অধ্যাপক চমকে উঠে হাতটা ঝাঁকিয়ে ফেললেন। মুহূর্তেই সাপটা গিয়ে পড়ল সামনের বেঞ্চে বসে থাকা একটি মেয়ের কাঁধে। মেয়েটি মুহূর্তেই জমে গেল। তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁট কাপছে। তারপর হঠাৎ সে একটা চাপা চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
“মা গো…!!” তার কণ্ঠস্বর যেন নিজেরই কানে বিশ্বাস করতে পারছে না।
বাকি ক্লাস তখন পেছন দিকে সরে গেছে, কেউ দাঁড়িয়ে গেছে বেঞ্চে, কেউ দরজার দিকে তাকিয়ে।
আর তখনই—
অধ্যাপক হেসে বললেন, “Relax everyone! সেটা একটা খেলনা সাপ।”
ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা। যেন এক টুকরো সময় থেমে আছে।
তিনি এগিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে সাপটা তুললেন—প্লাস্টিকে তৈরি, রাবারের মত নমনীয়, চোখ দুটো আঁকা, এবং লেজে স্প্রিং লাগানো।
তিনি সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ক্লাসের শিরোনাম—‘ভয়’।”
ঘরের আবহ একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে লাগল। কেউ হাসল, কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটি চুপচাপ নিজের সিটে বসে পড়ল, তবু শ্বাস-প্রশ্বাস এখনো ভারী।
“এখন বলো,”—অধ্যাপক চোখ সরিয়ে ক্লাসের দিকে তাকালেন, “যখন তোমরা ভেবেছিলে যে এটা সত্যিকারের সাপ, তখন শরীরে কী অনুভব করেছিলে?”
“হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, স্যার।”
“বুকে ধকধক করছিল,” কেউ বলল।
“গলা শুকিয়ে গিয়েছিল,”—পিছন থেকে আওয়াজ এল।
“ঠিক,”—তিনি টুকে নিলেন বোর্ডে—
Heartbeat↑, Breathing↑, Muscles tense, Sudden reflex.
“এগুলোই ভয়-এর শারীরিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু যখন জানলে এটা খেলনা? তখন কেমন লাগল?”
“লজ্জা লাগল, স্যার।”
“রিলিফ ফিল করছিলাম।”
“কিন্তু আমি এখনো একটু কাঁপছি…”—মেয়েটির কণ্ঠ ধরা।
অধ্যাপক এবার বললেন,
“ভয় হচ্ছে মানবিক অস্তিত্বের সবচেয়ে প্রাচীন অনুভবগুলোর একটি। এই অনুভূতি আমাদের রক্ষা করে, আমাদের প্রস্তুত করে, আবার অনেক সময় বিভ্রান্তও করে। বাস্তবতাকে আমরা যেভাবে দেখি, ভয় ঠিক তারই ফ্রেম পরিবর্তন করে দেয়।”
সারা ক্লাসে তখন এক অদ্ভুত আলোড়ন। কেউ হাসছে, কেউ ভাবছে।
কিন্তু সবাই যখন হাসাহাসিতে ব্যস্ত, তখন পেছনের বেঞ্চে বসে থাকা একটি ছেলে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধভাবে পুরো দৃশ্য দেখছিল। তার মুখে হাসি নেই, চোখ দুটো বিস্ময়ে পূর্ণ। সে যেন অধ্যাপক বা খেলনা সাপের চেয়েও বেশি লক্ষ্য রাখছিল সেই মেয়েটির উপর—যার চোখ এখনো ভীত, শ্বাসে অস্থিরতা, এবং দৃষ্টিতে কিছুটা অবিশ্বাস।
ছেলেটি নড়ল না। তার চোখ সেই মেয়েটির কাঁপতে থাকা আঙুলে থেমে রইল।
তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একটা ক্ষীণ রহস্যময় হাসি ।
***
স্টেশন থেকে বেরিয়ে মেঠোপথ ধরে হাঁটছেন অবিনাশ আর পরিমল ঘোষ। চারদিকে নিরিবিলি, মাঝে মাঝে কাকের ডাক আর দূরের কোনও লাউডস্পিকারে মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ।
“এই যে রাস্তার শেষে বাঁদিকে দেখছেন, ওটাই আমাদের স্কুল,” — পরিমল বাবু বললেন।
অবিনাশ একটা হালকা হাসি দিল, “খুব শান্ত জায়গা, স্যার। শহরের তুলনায় যেন অন্য একটা পৃথিবী।”
“হ্যাঁ, এখানে সময় একটু আলসেমে কাটে,” — পরিমলবাবু চোখ নরম করে বললেন, “তবে ধীরে ধীরে ভালো লেগে যাবে।”
অবিনাশ সদ্য শহর থেকে বদলি হয়ে একটি দূরবর্তী গ্রামের স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে এসেছে। গ্রামের নাম ভাঙাপুকুর। শহুরে ব্যস্ততা পেছনে ফেলে সে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাকে রিসিভ করতে এসেছেন পরিমল বাবু—স্কুলের জীবনবিজ্ঞান শিক্ষক, বছর পঞ্চাশের এক শান্তস্বভাব মানুষ, যিনি এই গ্রামেই দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করছেন।
স্কুল গেটের সামনে এসেই মাথার ওপর লাগানো বড় বোর্ডটি চোখে পড়ল – “ভাঙাপুকুর আপার প্রাইমারি স্কুল”। জীর্ণ, রঙ চটে যাওয়া, দূর থেকে অদৃশ্যমান। যেন সময়ের সাথে সাথে বোর্ড টি বুড়ো হয়ে গেছে। স্কুল চত্বর পার হয়ে তারা উঠল অফিস ঘরে। ঘরটা জীর্ণ হলেও গোছানো। কাঠের আলমারি, পুরোনো ফ্যান, একটা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার। জানালা খুলে ভেতরে আলো এসে পড়ছে।
একজন বয়স্ক, ধবধবে সাদা চুলের মানুষ উঠে দাঁড়ালেন। পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
“এই যে, এটাই আমাদের নতুন ইতিহাসের শিক্ষক! স্বাগতম!”
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে হাত মেলালেন।
“আমি হরিহর মুখার্জি। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আপনি অবিনাশ তো?”
“হ্যাঁ স্যার, খুব আনন্দ হচ্ছে এখানে আসতে পেরে।”
“আনন্দ আপনাকেই জানাই। আমরা এখানে সবাই মিলেমিশে থাকি। ছেলেমেয়েরাও বেশ ভালো। আগামীকাল থেকে ক্লাস ধরবেন, সাত আর আট—দুটো সেকশন।”
“ঠিক আছে, স্যার। চেষ্টা করব ভালোভাবে শুরু করতে।”
হরিহরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “পরিমল, তুমি ওকে কোয়ার্টারটা দেখিয়ে দাও। নতুন জায়গা, একটু গাইড করলেই ও মানিয়ে নেবে।”
কোয়ার্টারটা স্কুল চত্বরের পাশেই — একতলা, টালির ছাদ, সামনে একটা ছোট্ট উঠোন আর কিছু নাম না-জানা গাছ। দরজাটা খুলে পরিমলবাবু বললেন, “এই আপনার ঘর। ভেতরে বাথরুম-টাথরুম সব আছে। রান্নাঘর আছে, চাইলে নিজেও রান্না করতে পারেন।”
অবিনাশ ঘরে ঢুকে চারপাশ দেখে বলল, “একদম খারাপ না। শহরে এত স্পেসও পাওয়া যায় না।”
“ঠিকই বলছেন। জল সরবরাহ সকাল-সন্ধে হয়। গ্যাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।”
“আপনি তো সব কিছু বেশ গুছিয়ে দিয়েছেন, স্যার।”
“আরে, নতুন মানুষ এলেই তো নিজের দায়িত্ব মনে হয়,”— বললেন পরিমলবাবু হাসতে হাসতে।
তখনই অবিনাশের চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা খবরের কাগজে। পাতা উলটে তার চোখ আটকে গেল এক জায়গায়।
“তিন দিন নিখোঁজ, এখনো উদ্ধার হয়নি। গ্রামের কিশোরী উধাও—পুলিশের নির্লিপ্ত ভূমিকা ঘিরে প্রশ্নচিহ্ন।”
অবিনাশ পত্রিকাটা তুলে বলল, “স্যার, এই মেয়েটি কি এখানকারই কেউ?”
পরিমলবাবু মুখ শক্ত করে বললেন, “হ্যাঁ… আমাদের স্কুলেরই ছাত্রী ছিল। ক্লাস এইট-এ পড়ত। খুব মেধাবী মেয়ে।”
এইসময় দরজায় টোকা।
হরিহরবাবু দাঁড়িয়ে, হাতে একটা থার্মোস।
“এই যে, তোমার জন্য চা নিয়ে এলাম। রেস্ট করে নিয়েছ তো?”
“হ্যাঁ স্যার। আপনাদের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ।”
হেসে হেডস্যার ঘরে ঢুকলেন।
হরিহরবাবু ঘরে ঢুকে জানালার পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়লেন। গায়ের পাঞ্জাবিটা একটু গুটিয়ে নিয়ে বললেন,
“ঘরপত্র দেখে কেমন লাগল, অবিনাশবাবু? মানিয়ে নিতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না তো?”
অবিনাশ একটু হাসল, “না স্যার। বরং বেশ গুছানো। পরিমল স্যার সব কিছু বেশ সুন্দর করে দেখিয়ে দিয়েছেন।”
হরিহরবাবু সন্তোষের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, “ভালো কথা। নতুন জায়গা, একটু সময় নেবে। তবে এখানকার ছেলেমেয়েরা আন্তরিক, ক্লাসে মজা পাবেন।”
অবিনাশ জানালার বাইরে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, “আশা করছি স্যার, এখানকার অভিজ্ঞতাটা দারুণ হবে।”
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, হঠাৎ যেন কী মনে পড়ে গেল তার।
তার গলা একটু নিচু হলো।
“স্যার… আজকের কাগজে একটা মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর পড়ছিলাম। ও কি আমাদের স্কুলেরই ছাত্রী ছিল?”
হরিহরবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন, “হ্যাঁ… ওর নাম ছিল রিমা। খুব ভালো নাচ করত। হঠাৎ করে একদিন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল।”
“এটা কি প্রথম?”
“না… আরও কয়েকজন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে গত বছরের মধ্যে। কিন্তু কোনোরকম ক্লু নেই। পুলিশও কিছু বলতে পারে না। আমরা শিক্ষকরা খুব দুশ্চিন্তায় আছি।”
“কিন্তু স্যার, পুলিশ কি সত্যিই চেষ্টা করছে? কোনো অগ্রগতি কিছু?”
হরিহরবাবু এবার চোখ নামিয়ে ফেললেন। “আমি… আমি কিছু বলতে পারব না।”
হঠাৎ করেই এক অস্বস্তিকর নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। সেই মুহূর্তে বাইরে একটা গাড়ির হর্ন বাজল।
হরিহরবাবু বললেন, “আমি এবার উঠি। তোমারও বিশ্রাম দরকার।”
অবিনাশ সৌজন্যবশত হেডস্যারকে বাইরে এগিয়ে দিতে গেল। উঠোন পেরিয়ে তারা রাস্তায় এল।
ঠিক তখনই এক সাদা জিপ এসে থামল সামনে। গাড়ি থেকে নামলেন একজন মাঝবয়সী লোক — গায়ের ওপর হালকা খাকি শার্ট, চোখে সানগ্লাস।
“এই যে, অনুপমবাবু! দেখা হয়ে গেল,”— হরিহরবাবু বললেন।
“এই অবিনাশবাবু আমাদের নতুন শিক্ষক। শহর থেকে এসেছেন। ওকে একটু গ্রামটা চেনাচ্ছি।”
“নমস্কার,”— অবিনাশ এগিয়ে এসে বলল।
“নমস্কার,”— জবাব দিলেন দারোগাবাবু।
“কেমন লাগছে জায়গাটা?”— গলা একেবারে নিরাসক্ত হলেও দারগাবাবুর কথার ভঙ্গিতে যেন একটা অভ্যস্ত সৌজন্য ছিল।
“শান্ত, নিরিবিলি। তবে নতুন জায়গা বলে সবকিছু একটু নতুন লাগছে। মানিয়ে নিতে হয়ত সময় লাগবে।”
“হবে। এখানে সময় একটু ধীরে চলে।” — অনুপমবাবু বললেন হালকা সুরে।
একটা মুহূর্ত নীরবতা। তারপর অবিনাশ একটু এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বলল,
“আচ্ছা স্যার… এই যে কাগজে পড়লাম, স্কুলের একটা মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে—আপনি কি এই কেসটার তদন্ত করছেন?”
অনুপমবাবুর মুখটা এক মুহূর্তের জন্য কড়া হয়ে উঠল। “দেখুন মশাই, আমরা যা করার করছি। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। ওপর থেকে নির্দেশ আসলে তারপরই তদন্ত জোরালোভাবে শুরু করা যাবে।”
“মানে?”
“একজন নতুন ডি.এস.পি বদলি হয়ে আসছেন এখানে। তাঁর হাতে কেসটা যাবে। তার আগে আমার কিছু করণীয় নেই।”
সরাসরি কিছু না বললেও অবিনাশ স্পষ্ট বুঝতে পারল — পুলিশের মধ্যে একধরনের ঢিলেমি বা অবহেলা আছে। হরিহরবাবু কেবল নিঃশব্দে মাথা নেড়ে অবিনাশকে ঘরে ফিরতে বললেন।
অবিনাশ তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল রোদে ঝলমল রাস্তায়, মনে এক অজানা অস্বস্তি, আর চোখে প্রথম অভিজ্ঞতার ক্লান্তি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন