আমাদের স্বপ্ন

আমাদের স্বপ্ন

আল-হামদু লিল্লাহ। মাঝে মাঝে পাঠকরা আমাদেরকে ফোন করছেন। ধন্যবাদ দিচ্ছেন। তাদের অভিব্যক্তি তুলে ধরছেন। সে দিন একজন জানালেন, হুদহুদের বই অন্যকে গিফ্ট করার মত। আরেক জন জানিয়েছেন, হুদহুদের বই পড়ে তিনি নিজের মধ্যে পরিবর্তন অনুভব করছেন। কেউ কেউ হুদহুদের সমস্ত বই কেনার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন।…

আমরা মনে করি, আপনি হুদহুদ পরিবারের অন্তরঙ্গ বন্ধু। আপনি হুদহুদের বই পড়েছেন। হোক দু-চার হরফ। এ কথার মানে হচ্ছে জীবনের মূল্যবান সময় থেকে আপনি আমাদেরকে খানিকটা অংশ দিয়েছেন। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। জীবন পরিশীলনে আমরা আপনার আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাই। আপনি কি অনুগ্রহ করবেন?

বাংলা ইসলামী সাহিত্যের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ– সাহিত্যের মান দুর্বল; তথ্য-উপাত্তের শতভাগ বিশুদ্ধতা অনিশ্চিত; কাগজ-মুদ্রণ বাজে; বাঁধাই নড়বড়ে। আরও বড় কথা, অনুবাদ আর অনুকরণের ছড়াছড়ি। এক্ষেত্রে আমরা কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছি। যেমন–

•             সাহিত্যমান ও বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য একটি সেন্সর বোর্ড গঠন করেছি।

•             সূচনা থেকেই উন্নত কাগজ-কালি ব্যবহার করে উন্নত প্রেসে বই-পুস্তক ছাপছি।

•             সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ভালো বাইন্ডার দিয়ে বই-পুস্তক বাঁধাই করছি।

•             শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসলিম সমাজের প্রয়োজন বিবেচনা করে মৌলিক রচনাবলি প্রকাশ করতে চেষ্টা অব্যাহত রাখছি।

•             অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে স্বীকৃত বিদেশী গ্রন্থাবলি অনুবাদের তালিকাভুক্ত করছি।

•             দৃষ্টিনন্দন করার জন্য একাধিক রঙে বই-পুস্তক প্রকাশ করছি।

•             পাঠকবন্ধুদের তালিকা দীর্ঘ করার জন্য সর্বোচ্চ কম দামে গ্রন্থাবলি বাজারজাত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।

আমাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ, মুসলমানদের আন্তরিক দোআ প্রাপ্তি এবং দুনিয়াতে হালাল মুনাফা অর্জন। মুসলিম সমাজে আমরা বিতরণ করতে চাই উপকারী ইলম। যেই ইলম জীবনে উপকারে আসে না, তা থেকে আমাদের মহানবী আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। আমরাও সেই ইল্‌ম বিতরণ করতে চাই না।

হুদহুদ পাখি সুলাইমান আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে অমুসলিমের দুয়ারে তাওহীদের বার্তা পৌঁছে দিত। মুসাফির কাফেলাকে দিত মিষ্টি পানির সন্ধান। হুদহুদ প্রকাশনও আল্লাহভোলা লোকদের কাছে তাওহীদের বাণী পৌঁছে দিতে চায়। জ্ঞানপিপাসায় কাতর সমাজকে দিতে চায় অমীয় সুধার সন্ধান।

এগুলো ছাড়াও আরও অনেক স্বপ্ন আছে হুদহুদ প্রকাশনের; কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য পাঠকবন্ধুদের বলিষ্ঠ সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা প্রস্তুত; আপনি প্রস্তুত আছেন?

যদি আপনার প্রাইভেট কারে, সন্তানের পড়ার টেবিলে, আপনার বালিশের পাশে, অফিসের বুকসেলফে, আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবকে প্রদেয় গিফটের তালিকায়, আপনার ভ্রমণের ব্রিফকেসে হুদহুদ প্রকাশনের বই-পুস্তক জায়গা পায় আর সুযোগ পেলেই যদি তাতে চোখ বোলানো হয়, তা হলে আমরা মনে করব আপনি বন্ধুত্বের তালিকায় হুদহুদকে জায়গা দিয়েছেন। হুদহুদ আপনার আপনজন।

যদি আমাদের কোন বই পড়ে আপনি পুলকিত হন; যদি আপনার হৃদয়ের মণিকোঠায় একটু সাড়া জাগে, তা হলে আপনার মোবাইলের মেসেজ অপশনে যান, অথবা খুলে ফেলুন আপনার ই-মেইল আইডি। লিখে ফেলুন ছোট্ট একটি মেসেজ। বাংলা, আরবী, ইংরেজি অথবা উর্দুতে। তারপর সেন্ড করুন আমাদের ঠিকানায়। পক্ষান্তরে যদি আমাদের কোন বই পড়ে আপনি রুষ্ট হন, আপনার চোখে ধরা পড়ে আমাদের কোন ক্রটি, তা হলেও আপনার পরামর্শ লিখে আমাদের কাছে প্রেরণ করুন। আমরা খুশি হব; আপনার জন্য দোআ করব এবং শুধরে যাব।

আমরা আপনার সাথে এমন বন্ধুত্ব কায়েম করতে চাই, যার উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি। যার প্রতিদান বিচারের দিনে আরশের নীচে ছায়া প্রাপ্তি। হাদীস শরীফে আছে– যদি দু’জন লোক একে অপরকে ভালোবাসে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য; এই লক্ষেই তারা (মাঝে মাঝে) মিলিত হয় এবং এই লক্ষেই বিচ্ছিন্ন হয়, তা হলে তারা সেই দিন আরশের ছায়ায় জায়গা পাবে, যে দিন উক্ত ছায়া বাদে আর কোন ছায়া থাকবে না।

আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন। আমীন।

মুহাম্মাদ আবদুল আলীম

মহাপরিচালক

হুদহুদ প্রকাশন

কানয দ্বীপে

بِسۡمِ اللّٰهِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ

মেয়েটির নাম সারা। এলাকার আর দশটা মেয়ের চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয় সে। সুন্দর মুখশ্রী। মধ্যম গড়ন। বুদ্ধিদীপ্ত চলন। শৈশব থেকেই ওর চিন্তা-চেতনা ছিল একটু ভিন্ন প্রকৃতির। সারার মাও চাইতেন তার মেয়ে হবে সবার থেকে ব্যতিক্রম। মেয়েকে অনেক ভালোবাসতেন তিনি। তাই তাকে নিয়ে চিন্তার অন্ত ছিলো না তার।

কানয দ্বীপ ও পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশের সামাজিক জীবন ব্যবস্থার মাঝে খুব একটা তফাত ছিল না। পথে বেরুলেই চারিদিকে উঁচু মিনারের সুদৃশ্য মসজিদ আর নুরানী চেহারার মুসলমান চোখে পড়ত; যা পথের শোভা বহুগুনে বাড়িয়ে দিতো। পুরুষদের মন আত্মমর্যাদা ও পৌরুষত্বের মহিমায় ভরপুর ছিল। রাস্তায় কিংবা বাসে কোনো নারীর সাথে অশালীন আচরণ করার মতো দুঃসাহস ছিল না কারোই। নারীরাও নিজেদেরকে লজ্জার আবরণে সদা আবৃত রাখত।

অধিকাংশ নারী শরঈ পর্দা পালনে ব্রতী ছিল। আর এভাবেই তারা নিজেদেরকে পুরুষের কামুক দৃষ্টি ও উপহাসমূলক বাক্যবান থেকে নিরাপদ রাখত।

দ্বীপটিতে একজন প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। ছোট বড় সবাই তাকে সশ্রদ্ধ মুহাব্বত করত। বাদশাহ, আমির-উমারা, মন্ত্রী-আমলা, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ সবার পছন্দনীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। জনসাধারণের কাছে তার বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ছিল ঈর্ষণীয়। তিনি যা বলতেন নির্দ্বিধায় সবাই তা মেনে নিতো। বাস্তবিকই তিনি ছিলেন একজন অতি মর্যাদাবান আল্লাহভীরু আলেম। মহান প্রভুর সান্নিধ্য অর্জনের নিমগ্নতায় কেটে যেত তার রাত-দিন।

কানয দ্বীপের টেলিভিশনগুলোতেও উন্মত্ত নৃত্ত-গীতির পসরা ছিল না। ছিল না কোনো নারীর উপস্থিতি। কানয দ্বীপে জীবন ছিল বড় সুন্দর ও শান্তিময়। মানুষেরা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে ঝগড়া বিবাদে জড়াত না। আলেম সাহেব কোনো বিষয়ে ফতোয়া দিলে লোকেরা তা অকপটে মেনে নিতো। জুমার দিন খতিব সাহেব প্রদত্ত খুতবা ও আল্লাহর পথে আহবানকারীর সুমিষ্ট বাণী তারা মনোযোগ সহকারে শুনত এবং আমলে পরিণত করত। দ্বীপের লোকদের ওপর বিজাতীয় সংস্কৃতি তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

তবে মাঝে মাঝে বিজাতীয় কৃষ্টির পক্ষে কিছু ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যেত। যাদের মুখ থেকে এ আওয়াজ বেরুতো, তারা বিজাতীয়দের জীবনধারায় আসক্ত ও শত্রু পক্ষের চক্রান্তের শিকার ছিল। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের কতিপয় কর্মচারীও নির্লজ্জতার প্রসার ও অশ্লীল চ্যানেল সমূহের মাধ্যমে পাপের বীজ বপনে তৎপর ছিল। তথাপি তাদের প্রচেষ্টা সমাজে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

এরপর বহুবছর কেটে গেছে। প্রচার মাধ্যমও পৌঁছেছে উন্নতির শিখরে। কানয দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছে গেছে ডিশ তথা স্যাটেলাইট কানেকশন। আর স্যাটেলাইট কানেকশনের হাত ধরে এখানে বেদ্বীন-কাফেরদের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটতে লাগল। দ্বীপের অধিবাসীরা এখন টিভির পর্দায় এমন মানুষদের দেখতে লাগল যাদের জীবনধারা ছিল পশুসুলভ। বরং তাদের যাপিত জীবন ছিল আরো নিম্নতর। খানা-পিনা, ভোগ-বিলাস ও আনন্দ-ফুর্তি ছাড়া যাদের কাছে জীবনের অন্য কোনো অর্থ ছিল না। ছিল না নামাজ-রোজা কিংবা আত্মিক পবিত্রতা বা দৈহিক পরিচ্ছন্নতার কোন বালাই।

কানয দ্বীপের মুসলিম নারীগণ টেলিভিশনের পর্দায় উলঙ্গ-বেহায়া নারীদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখতে লাগল। দ্বীপের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম মহোদয় চিৎকার করে বলতে লাগলেন- ‘আল্লাহকে ভয় করো। বিজাতিদের অনুসরণ থেকে বাঁচো। নিজ দীনের ওপর অবিচল থাকো।

তিনি নারীদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান জানালেন– তোমরা হিজাব খুলো না। পর্দা ছেড়ো না। তোমরা হলে মূল্যবান রত্ন। যে কেউ তোমাদেরকে দেখার বৈধতা নেই। তোমরা সতী-সাধ্বী। তোমরা আমাদের মা, আমদের বোন, আমাদের কন্যা। আমাদের ইজ্জত তোমরা’।

তিনি তাদের হাতে পায়ে ধরে ধ্বংসের গহব্বর থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে চাইলেন। দ্বীপের অন্যান্য আলেমগণও রেডিও, টিভিসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সহয়তায়, জুমআর খুতবার আলোচনায়, লেখালেখির সক্রিয়তায় নানাভাবে এর কুফল তুলে ধরছিলেন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে, নদীর উত্তাল তরঙ্গে ভাসমান নৌকাতে ফুটো হয়ে গেলে তা নিমজ্জন সুনিশ্চিত। লোকেরা আলেমদেরকে ভালোবাসতো বলে তাদের কথা মানতে লাগল।

কয়েক বছর পরের কথা। সর্বজন শ্রদ্ধেয় সেই আলেম ব্যক্তিটি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার সমকালিন বাকী আলেমগণও একে একে সবাই প্রভুর সান্নিধ্য গ্রহণ করেছেন। জীবিতরা পূর্বসূরীদের মহান দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। তারা সেই নৌকাটিকে নিমজ্জনের হাত থেকে বাঁচাতে সচেষ্ট রইলেন।

এদিকে শত্রুপক্ষও বসে নেই। তারা লোকদেরকে ডেকে ডেকে বলছে- হে দ্বীপবাসী! আমাদের দিকে তাকাও। দেখো কতো আনন্দময় আমাদের জীবন। যুবকের বাহুতে যুবতী নারী। যখন যেখানে খুশি দু’জন দুজনার সান্নিধ্য গ্রহণে কোনো বাঁধা নেই। দেখো, মেয়েরা সমুদ্র তটের মুক্ত বাতাসে বিকিনি পরে জীবনের স্বাদ নিচ্ছে।

নারী-স্বাধীনতার স্বাদ নিতে আকাশের বিশালতায় ছুটে চলা উড়োজাহাজে যাত্রীদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকছে। হোটেল-রিসিপশনে নিজেদের চপলা-চঞ্চলা অঙ্গভঙ্গিতে গ্রাহকদেরকে বিমুগ্ধতায় ডুবিয়ে রাখছে।

কিন্তু কানয দ্বীপের নারীকুল মনোলোভা এ আহবানে সাড়া দিলো না। কারণ, ‘কাঁধের গোস্ত কোথা থেকে কেটে খেতে হয় (অর্থাৎ এ কাজ কিভাবে আঞ্জাম দিতে হয়) নির্বুদ্ধিতা বশত শত্রুপক্ষের তা জানা ছিল না।

সেসব পুণ্যাত্ম নারীগণ যারা আশৈশব শরঈ পর্দার পূর্ণ পাবন্দি করে আসছে, তারা হঠাৎ অনাবৃত মুখে পর পুরুষের সামনে যাওয়া কিংবা এক ঝটকায় নিজেদের হিজাব খুলে ফেলাকে কিভাবে মেনে নেবে? ফলে শত্রুপক্ষের কুবাসনা পূরণে এসব পূণ্যাত্মা নারীগণ কিছুতেই প্রস্তুত ছিল না।

তীব্র স্রোতকে দিখণ্ডিত করণ

শত্রুপক্ষ নারীদেরকে হিজাব-মুক্ত করার লক্ষ্যে তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিকে ব্যর্থ হতে দেখে বুঝতে পারল যে, তারা তীব্র স্রোতের বিপরিত মুখে চলছে। তাই তারা স্রোতের তীব্রতাকে দিখণ্ডিত করে তাকে দূর্বল করার পন্থা অবলম্বন করল। নারীদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে ভেঙে ফেলা মুশকিল। কিন্তু কোনোভাবে তাদের ঐক্যের বাঁধন যদি খুলে দেওয়া যায়, তাহলে ভেঙে ফেলা সহজ হবে।

শত্রুপক্ষ ধূর্ত দৃষ্টিতে দেখল যে, নারীগণ নিজেদেরকে আবৃত রাখতে যেসব হিজাব বা বোরকা পরে থাকে সেগুলো যথেষ্ট ঢিলেঢালা ও গোটা শরীরের আদ্যোপান্ত আবৃতকারী। নারীরা বোরকা পরে পথে বেরুলে তাদের শরীরের কোন অঙ্গই আর দৃষ্টিগোচর হয় না।

তাই এবার তারা নতুন ফন্দি আঁটল। তারা বলতে লাগল– আমরা এ কথা বলছি না যে, তোমরা বোরকা পুরোপুরি খুলে ফেলো। কারণ তা হারাম। কিন্তু দেখো, যে বোরকাগুলো তোমরা গায়ে জড়াচ্ছ। সেগুলোর স্টাইল খুবই সেকেলে। আধুনিকতার নামগন্ধও নেই তাতে। বর্তমান যুগের সাথে সেগুলো একেবারেই বেমানান। তোমাদেরকে আধুনিক বোরকা পরতে হবে।

অতঃপর আধুনিক পোষাক ডিজাইনাররা কোমর বেঁধে নেমে পড়ল। তারা নানা রকম নতুন নতুন ডিজাইনের বোরকা তৈরী করল; যেগুলোর ব্যাপ্তি সাধারণ বোরকার চেয়ে অনেক কম ছিল। তাতে কি? নামসর্বস্ব হলেও সেগুলোতো বোরকাই ছিল। তাই নারীদের অনেকেই সেসব বোরকা পরতে শুরু করল। দেখতে দেখতে বোরকা ‘গাউন’-এর রূপ পরিগ্রহ করল। সৌন্দর্যকে আড়াল করার জন্যে যে বোরকা পরিধান করা হতো এখন তা নিজেই সৌন্দর্য প্রকাশক হয়ে গেল। শত্রুপক্ষ এখন খুশির জোয়ারে ভাসছে। তারা অনুভব করল স্রোতের তীব্রতা ক্রমেই দূর্বল হয়ে আসছে। তারপর নিত্যনতুন ফ্যাশনের হাত ধরে এমন বোরকার প্রচলন শুরু হলো যা বেল্ট দ্বারা কোমরে বেঁধে রাখতে হতো। ক্রমশ এমন বোরকার উদ্ভব ঘটল যা আঁটসাট হয়ে শরীরে লেগে থাকত। যাতে দেহের প্রলুব্ধকর অঙ্গের ভাঁজ প্রস্ফুটিত হয়ে পড়ত। এখন মানুষের ললুপ দৃষ্টি বোরকা পরা নারীদের পিছু ছুটল। আর এভাবেই একটি শান্ত সমাজ ব্যবস্থায় অস্থিরতা শিকড় গেড়ে বসল।

নৌকাটির নিমজ্জন তরান্বিত হতে লাগল। এ দেখে সমাজ সংস্কারক আলেমগণ চুপ করে বসে রইলেন না। তারা সেসব বোরকার ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে লাগলেন। বক্তাদের অগ্নিঝরা জ্বালাময়ী বক্তৃতায় কেঁপে উঠল মিম্বর। ইসলামের দাঈরা ওয়ায-নছীহতের মাধ্যমে এর জঘন্যতা বর্ণনা করতে লাগলেন। তারা সৌন্দর্য প্রকাশক এসব ফ্যাশনেবল বোরকা পরিধানকারী নারীদেরকে এর মন্দ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করলেন এবং বললেন, তোমাদের এসব বোরকা দ্বারা সেসব অঙ্গ দৃশ্যমান হয় যেগুলোকে আল্লাহ তাআলা ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

সংকুচিত ও চিকন বোরকা হারাম হওয়ার ব্যাপারে প্রতিটি সচেতন মানুষেরই জ্ঞান ছিল। তাই এর প্রচলন কমে আসল। নারীগণ পুনরায় সেসব বোরকা গায়ে জড়াতে লাগল যা গোটা শরীরকে ঢেকে রাখে।

শত্রুপক্ষ তাদের সব পরিশ্রম পণ্ড হতে দেখে প্রচণ্ড হতাশ হলো। পর্দা অপসারণ করে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণকে আরো সহজতর করার লক্ষ্যে তাদের শত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। তারা দেখল, দিন-রাত এক করে, প্রতারণার হাজারো ফাঁদ পেতে তারা যখন নারীদেরকে তাদের জালে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে, ঠিক তখনই কোনো আলেম এসে তাদের সামনে পবিত্র কোরআনের আয়াত ও হাদিসের বাণী পাঠ করে শোনালে মুহুর্তেই তারা তওবা করে নিজেদের শুধরে নিচ্ছে।

বস্তুতঃ ফেতনাবাজদের একথা জানা ছিল না যে, প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে ইসলামের শিকড় গ্রোথিত রয়েছে অত্যন্ত দৃঢ় ও সুগভীরভাবে। মুসলিম নারীরা মাঝেমাঝে ভুল যেমন করে, তেমনি দ্রুত তওবাও করে নেয় এবং ফিরে আসে ইসলামের দিকে।

মুসলিম নারীদের চরিত্র খাঁটি সোনার মতো। পরিচ্ছন্নতার হালকা প্রলেপ পেলেই ধূলাবালি দূর হয়ে পূর্বের ন্যায় চমকাতে থাকে।

পরিশেষে অনেক চিন্তা-ফিকিরের পর শত্রুপক্ষ প্রতারণার নতুন পন্থা উদ্ভাবন করল।

বিষয়টি মতবিরোধপূর্ণ

ফেতনাবাজরা গভীর মনোযোগে ইতিহাসের পাতা উল্টাতে লাগল এটি দেখার জন্য যে, অতীতে মুসলিম দেশগুলো থেকে পর্দা প্রথা কিভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল। তারা দেখল, পর্দা প্রথা বিলুপ্তির শুরু লগ্নে নারীদেরকে প্রথমে চেহারা খোলা রাখতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। অতঃপর চেহারা খোলা রাখাটা যখন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হলো, তখন চেহারাকে সৌন্দর্য বর্ধনের বিভিন্ন উপকরণ দ্বারা সুসজ্জিত করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হলো। তারপর এলো বোরকার রঙে ভিন্নতা। সাদামাটা কাপড়ের পরিবর্তে উজ্জ্বল-মসৃন, কারুকার্য খচিত কাপড় ব্যবহার হতে লাগল। নারীদের রূপ-মাধুরীও যেন বেড়ে গেল। তারা মুখাবয়বের কমনীয়তা প্রদর্শনে আরো একধাপ এগিয়ে গেল। এতোদিন কপালকে হিজাবের আওতাভুক্ত রেখেছিল কিন্তু এখন সেটাও উন্মুক্ত করে দিল। ধীরে ধীরে মাথার চুলও দৃশ্যমান হতে লাগল। আর এভাবেই অতীতের নারীরা পর্দা থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

শত্রুপক্ষ কানয দ্বীপের নারীদের মাঝে এই ফর্মুলাটি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিলো। কারণ, কানয দ্বীপের নারীরা বোরকা পরিধানকালে পূর্ণ চেহারা ঢেকে রাখত। স্যাটেলাইট চ্যানেল ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রথমে তাদের সামনে তুলে ধরা হলো যে, পর্দার ক্ষেত্রে চেহারা ঢেকে রাখার কোনো আবশ্যিকতা শরিয়তে নেই। নারীদের জন্যে চেহারা খোলা রাখা জায়েয আছে। অনেক ওলামায়ে কেরাম চেহারা উন্মুক্ত রাখার পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, চেহারার পর্দার বিষয়টিকে মতবিরোধপূর্ণ হিসেবে প্রমাণিত করা। অতঃপর স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে কিছু মুফতিয়ানে কেরাম সরাসরি ফতোয়া দিতে লাগল যে, ঘরের বাইরে বেরুবার সময় নারীরা চাইলে তাদের মুখাবয়ব খোলা রাখতে পারে। এটা তাদের জন্যে জায়েয আছে। আল্লাহ তাআলা নারীদের যেসব সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন, চেহারা সেসবের আওতাভূক্ত নয়।

আমাদের কর্তব্য

সারা বরাবরই শরঈ পর্দা পালনে সচেষ্ট ছিল। একজন খাঁটি মুসলিম নারীর মূর্ত প্রতীক হয়েই সে লোকসমাজে চলাফেরা করত। তার সুউচ্চ ব্যক্তিত্ববোধ ও পাহাড়সম অবিচলতায় যে কেউ প্রভাবিত হতো। রোজ সকালে এলাকার সড়কগুলো যখন মানুষের পদভারে মুখরিত হতো, তখন সারা এমন কিছু নারীদের দেখতে পেত যাদের চেহারা অনাবৃত থাকত। এসব বিষয় সারাকে মোটেই প্রভাবিত করতে পারত না। সে আপন মনে পথ চলত। যেসব ছাত্রীরা হিজাব পরিধানকালে পূর্ণ অবয়ব ও চেহারা ঢেকে রাখত, তাদেরই একজন ছিল সারা। অন্যান্য ছাত্রীদের অবস্থা এরূপ ছিল– কেউ গায়ে বোরকা জড়ালেও চেহারা খোলা রাখত আর কেউ এমন বোরকা পরত যা দেখতে গাউন-এর মতো। ছুটির পর কলেজের সামনে যুবকদের লাইন লেগে যেত। যারা মেয়েদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত এবং সুযোগ পেলে ইভটিজিং করত। কিন্তু পূর্ণ হিজাব পরিহিত সারা যুবক দলের সামনে দিয়েই হেঁটে চলে আসত অথচ তার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাত না।

কোনো অশ্রাব্য বাক্য তাকে শুনতে হতো না। যেন ফেরেশতাদের অদৃশ্য পহরা তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে রাখত।

হাসপাতালে একদিন

সারার আম্মা আমেনা বেগম নয় মাসের অন্তসত্ত্বা। ঘরের প্রতিটি সদস্য নতুন অতিথীর আগমনের দিন গুনছে। অবশেষে নির্দিষ্ট দিনে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো এবং ঘর আলো করা একটি ফুটফুটে শিশু ভূমিষ্ট হলো। সারা তার বাবার সাথে সন্ধ্যায় হাসপাতালে আসল। আমেনাকে দেখার জন্য সেখানে আরো অনেক মহিলার সমাগম হলো। তাদের মধ্যে এক সুদর্শন তরুণীও ছিল। সে অত্যন্ত ভদ্রভাবে বসা ছিল। তার চেহারা থেকে বুদ্ধিমত্তার দীপ্তি টপকাচ্ছিল। মেয়েটি এসেছিল সাদামাটা একটা বোরকা পরে। তবে চেহারা ছিল অনাবৃত। তার রূপের আলোকচ্ছটা যেন ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। আসা-যাওয়ার পথে লোকজন বিমুগ্ধ নয়নে তাকে বারবার দেখছিল।

সারা খুবই অবাক হলো। ভাবল, এ কেমন মেয়েরে বাবা! রূপের দোকান খুলে বসে আছে। অথচ আল্লাহ তাআলা নারীদেরকে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশক অঙ্গগুলো ঢেকে রাখার আদেশ দিয়েছেন। সারা সাহসী বটে তবে অভদ্র নয়। সে ধীরপদে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। বিনম্র কণ্ঠে সালাম দিল। দু’চার কথা বলার পর জানা গেলো, মেয়েটির নাম উরাইয। তার বড় বোনও সন্তান সম্ভবা। সেজন্যেই হাসপাতালে আসা। প্রাথমিক সৌজন্যতা শেষে সারা বলল, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল, চলুন না পাশের ওয়েটিং রুমে বসে নীরবে কথা বলি।

কথায় কথায় জানা গেলো নারী-স্বাধীনতা আন্দোলনের বিষয়ে উরাইযের ব্যাপক পড়াশোনা রয়েছে। সারার জ্ঞান-অভিজ্ঞতাও অসমৃদ্ধ নয়। তাই দু’জনার আলাপচারিতা বেশ জমে উঠল।

সারা ও উরাইযের কথোপকথন

সারা বলল, উরাইয তুমি নিশ্চয় জানো যে, আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন– নারী ও পুরুষ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وَ اَنَّہٗ خَلَقَ الزَّوۡجَیۡنِ الذَّکَرَ وَ الۡاُنۡثٰی ﴿ۙ۴۵﴾

‘এবং তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল-পুরুষ ও নারী।’ (সূরা নজম : আয়াত ৪৫)

তুমি এটাও নিশ্চয় জানো যে, এ দুয়ের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক কত গভীর। এরা একে অপরের পরিপূরক। জীবনের চাকা সচল রাখতে নারী-পুরুষের যুগল অবদান সুবিদিত। জগত সংসারে মানব-বংশ বৃদ্ধিতে এরা দুজনেই সমান অংশিদার। দীনের সাধারণ বিষয়াবলির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে কোনো বিভেদ নেই। দায়িত্ব পালনের বিবেচনায় দুজনেই সমান।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষদের ন্যায় নারীদেরকেও ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। পুরুষদের ন্যায় নারীদের থেকেও বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। পুরুষদের পাশাপাশি তিনি নারীদেরও ইমাম ছিলেন। পুরুষদের মতো নারীদেরকেও দীনের কথা শোনাতেন। নারীরাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে পুরুষদের ন্যায় নিজেদের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারত এবং পুরুষদের মতো তাদের পরামর্শও গৃহিত হতো। উরাইয তাকে থামিয়ে দিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল– সত্যিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন? আবু বকর, ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপস্থিতিতেও তিনি নারীদের রায় মেনে নিতেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। জবাবে সারা বলল– তুমি উম্মে সালমা রাযিয়াল্লাহু আনহা এর ঘটনা শোনোনি? যিনি মুসলমানদের সামনে উদ্ভূত জটিল একটি বিষয়ের সহজ সমাধান বের করে দিয়েছিলেন। পৃথিবী আজ নারী অধিকারের বুলি আওড়াচ্ছে। অথচ এ ঘটনাটি হাজার বছর পুরনো।

কি সেই ঘটনা? উরাইযের কন্ঠে ব্যাকুলতা।

সারা বলতে লাগল– তখনও মক্কা বিজয় হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চৌদ্দশত সাহাবীর এক বিশাল জামাত নিয়ে মক্কা অভিমূখে রওয়ানা হলেন। তখন মক্কায় ছিল কুরাইশদের একচ্ছত্র আধিপত্য। তাদের অনুমতি ব্যতিরেকে মক্কায় প্রবেশ ছিল দুঃসাধ্য। তারা যাকে খুশি প্রবেশের অনুমতি দিত আর যাকে খুশি দিত না। মুসলমানরা তো আর লড়াই করতে আসেনি। অন্যান্যদের মতো তারাও ওমরা পালন করতেই এসেছিল। কিন্তু কুরাইশরা তাদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে দিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে জোরপূর্বক প্রবেশ করার কথা ভাবলেও পরক্ষণে সন্ধি করার চিন্তা করলেন। কুরাইশরা সন্ধিনামার শর্ত স্থির কল্পে কয়েকজনকেই পাঠিয়েছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। পরিশেষে সুহাইল ইবনে আমর সন্ধি সম্পর্কে আলোচনা করতে আসল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাতেব (লেখক) কে ডাকলেন এবং বললেন, লিখো– بِسۡمِ اللّٰهِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ

সুহাইল ইবনে আমর আপত্তি তুলে বলল, আল্লাহর শপথ! ‘রহমান’ কে, তা আমি জানি না। তুমি লিখো– باسمك اللهم

মুসলমানেরা ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, আল্লাহর শপথ! আমরা بِسۡمِ اللّٰهِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ –ই লিখবো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বেশ باسمك اللهم -ই লিখো। তারপর বললেন, এখন লিখো–

‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ সন্ধিনামায় এই শর্তগুলো স্থির করেছেন।

সুহাইল ইবনে আমর এবারও আপত্তি তুলল এবং বলল, আমরা যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস করতাম তাহলে না আপনাকে বাইতুল্লায় প্রবেশে বাধা দিতাম, না আপনার সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হতাম। অতঃপর সে কাতেবকে বলল– তুমি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ লিখো।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা যতই আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার চেষ্টা করো না কেন, আল্লাহর শপথ! নিঃসন্দেহে আমি তারই রাসূল।

কাতেবকে বললেন, আচ্ছা, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ-ই লিখো।

باسمك اللهم

তারপর বললেন, এখন লিখো শর্ত হলো এই– আপনারা আমাদের ও বাইতুল্লার মাঝ থেকে সরে যাবেন। যেন আমরা বিনা বাধায় বাইতুল্লার তাওয়াফ করতে পারি।

সুহাইল ইবনে আমর বললেন, আল্লাহর শপথ! এটা কিছুতেই হবে না। কারণ, তাহলে আরবরা বলবে যে, আমি ভীত হয়ে এরূপ করেছি। এ কাজ আপনারা আগামী বছর এসে করবেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুহাইল ইবনে আমরের কথা মেনে নিয়ে কাতেবকে অনুরূপ লিখতে বললেন। সুহাইল মুসলমানদেরকে চাপে ফেলার জন্য আরেকটি শর্ত দিলো যে, মক্কা থেকে কেউ মুসলমান হয়ে মদিনায় চলে গেলে তাকে মক্কায় ফেরত পাঠাতে হবে। তবে কেউ যদি মুরতাদ হয়ে মদিনা থেকে মক্কায় চলে আসে, তাকে ফেরত পাঠানো হবে না।

মুসলমানদের পেরেশানি এবার চরমে পৌঁছল। তারা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, যে ব্যক্তি মুসলমান হয়ে আমাদের কাছে আসবে তাকে কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে– এটা কেমন শর্ত?

কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শর্তটিও মেনে নিয়ে বললেন, যে ব্যক্তি আমাদেরকে ছেড়ে তাদের কাছে চলে যাবে, তাকে আল্লাহ ধ্বংস করুন।

সন্ধির শর্তাবলি স্থির হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের সাথে এই সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হলেন যে, মুসলমানেরা এ বছর মদিনা ফিরে যাবে এবং আগামী বছর এসে ওমরা পালন করবে।

মুসলমানেরা এক বুক আশা নিয়ে ওমরার এহরাম বেঁধে এসেছিল। কিন্তু কুরাইশদের বাধার মুখে তাদের সব আশা নিরাশায় রূপ নিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্ধিনামার যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন শেষে সাহাবায়ে কেরামকে আদেশ দিলেন যে, তোমরা আপন আপন কোরবানীর জন্তু জবাই করে নাও এবং মাথা মুণ্ডিয়ে ফেলো।

দুশ্চিন্তার অতলে ডুবন্ত মুসলমানেরা চুপ করে বসে রইল। কেউ এক চুলও নড়ল না। তাদের আশা ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি নিয়ে আরেকবার ভাববেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল রইলেন। তিনি পুনরায় সবাইকে একই আদেশ দিলেন। কিন্তু এবারও কেউ সাড়া দিলো না। অতঃপর তিনি রাগান্বিত হয়ে হযরত উম্মে সালমা রাযিয়াল্লাহু আনহা এর তাবুতে চলে গেলেন। এবং তাকে বললেন, মুসলমানদেরকে আদেশ দিচ্ছি অথচ তারা তা মানছে না।

উম্মে সালমা রাযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি চান যে, মুসলমানেরা আপনার কথা মানুক, তাহলে কোনো কথা না বলে আপনি গিয়ে আপনার কোরবানির জন্তু জবাই করুন এবং একজন নরসুন্দর ডেকে মাথা মুণ্ডন করে নিন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা-ই করলেন। নিজের কোরবানীর জন্তু জবাই করলেন এবং নরসুন্দর ডেকে মাথা মুণ্ডন করিয়ে নিলেন। মুসলমানেরা এ দৃশ্য দেখে তৎক্ষণাৎ সবাই উঠে দাঁড়াল এবং একে একে সকলেই নিজ নিজ কোরবানীর জন্তু জবাই করে মাথা মুণ্ডন করে নিল। (বুখারী : হাদিস নং ২৭৩১-২৭৩২)

দেখেছো, একজন নারীর স্বীয় মতামতের উপর আত্মবিশ্বাসের নমুনা! তিনি নিজেকে তুচ্ছ ভাবেননি; বরং পূর্ণ নির্ভরতার সাথে নিজ মতামত ব্যক্ত করেছেন। আর সবাই তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে কিভাবে তা বাস্তবায়ন করেছেন।

সত্যিই চমৎকার! বলল উরাইয।

দায়িত্বে সমতা

সারা তার পূর্বের কথায় ফিরে আসল। তো আমি বলছিলাম আল্লাহ তাআলা প্রায় সব বিষয়েই নারী-পুরুষের সমতা বিধান করেছেন। কেবল যেসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সহজাত প্রকৃতি ভিন্নতার দাবিদার সেসব ক্ষেত্রে পার্থক্য স্থির করেছেন। বাইয়াতের ব্যাপারে অভিন্নতার উল্লেখ রয়েছে। গৃহ কার্যের দায়িত্বশীলতার ব্যাপারে সমতার বিধান রাখা হয়েছে। নারী-পুরুষ উভয়েই গৃহের জিম্মাদার এবং প্রত্যেকেই স্বীয় জিম্মাদারি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।

হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে–

مسئول عن أجل راع على أهل بيته.. والزراعية على بيت زوجها وليم.. فكلكم راع و رعيته. (متفق عليه)

‘পুরুষ পরিবারস্থ লোকজনদের জিম্মাদার। আর নারী তার স্বামীর ঘর এবং তার সন্তানাদির জিম্মাদার। আর প্রত্যেকেই স্বীয় জিম্মাদারি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারী ও মুসলিম)

ইবাদত বন্দেগিতে সমতা

ইবাদত এবং শরিয়তের বিধি-বিধান পালনেও নারী-পুরুষের মাঝে সমতা রয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রমযানের রোযা, যাকাত ও হজ নারী-পুরুষ উভয়ের দায়িত্বেই ফরজ। কিন্তু ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে নারীদের সহজাত প্রকৃতি কিঞ্চিৎ শীথিলতা চায়, তাই আল্লাহ তাআলা এই সময়গুলোতে নামায-রোযা পালনে তাদেরকে শীথিলতা দিয়েছেন। পৃথিবীতে মানব-বংশ বৃদ্ধির গুরু দায়িত্ব রয়েছে নারী-পুরুষের কাঁধে। আর উভয়কেই জীবিকা অন্বেষণে চেষ্টা-তদবির করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন–

فَامۡشُوۡا فِیۡ مَنَاکِبِہَا وَ کُلُوۡا مِنۡ رِّزۡقِہ

‘অতএব তোমরা তাঁর পথেঘাটে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিযিক আহার কর।’ (সূরা মুলক, আয়াত : ১৫)

আর নারী-পুরুষ উভয়েই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ব্যাপারে আদিষ্ট।

لَاۤ اُضِیۡعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِّنۡکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی

‘আমি তোমাদের কোন পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করিনা, তা সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক।’ (সূরা আল ইমরান : ১৯৫)

আল্লাহ তাআলা যেমনটি বলেছেন–

اِنَّ الۡمُسۡلِمِیۡنَ وَ الۡمُسۡلِمٰتِ وَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ وَ الۡقٰنِتِیۡنَ وَ الۡقٰنِتٰتِ وَ الصّٰدِقِیۡنَ وَ الصّٰدِقٰتِ وَ الصّٰبِرِیۡنَ وَ الصّٰبِرٰتِ وَ الۡخٰشِعِیۡنَ وَ الۡخٰشِعٰتِ وَ الۡمُتَصَدِّقِیۡنَ وَ الۡمُتَصَدِّقٰتِ وَ الصَّآئِمِیۡنَ وَ الصّٰٓئِمٰتِ وَ الۡحٰفِظِیۡنَ فُرُوۡجَہُمۡ وَ الۡحٰفِظٰتِ وَ الذّٰکِرِیۡنَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا وَّ الذّٰکِرٰتِ ۙ اَعَدَّ اللّٰہُ لَہُمۡ مَّغۡفِرَۃً وَّ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿۳۵﴾

(তরজমা) নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ, ধৈর্যশীলা নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী-তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। (সূরা আহযাব, আয়াত : ৩৫)

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে–

وَ مَا کَانَ لِمُؤۡمِنٍ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ اِذَا قَضَی اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗۤ اَمۡرًا اَنۡ یَّکُوۡنَ لَہُمُ الۡخِیَرَۃُ مِنۡ اَمۡرِہِم

(তরজমা) ‘আল্লাহ ও তার রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তার রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।’ (সূরা আহযাব, আয়াত : ৩৬)

অনেক মহিয়সী নারী তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে গেছেন।

কিছু ঘটনা

সারা বলতে লাগল। আমার পরিচিত এক বোন এক মহিলা হিফজুল কোরআন মাদরাসার পরিচালক ছিল। ঘটনাটি তার মুখ থেকেই শোনা। সূচনা কালে মাদরাসাটি সড়ক থেকে খানিকটা উঁচুতে ছিল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হতো। ভর্তির কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর একদিন এক বৃদ্ধা মহিলা ভর্তি হতে এলো। সে হুইল চেয়ারে বসা ছিল। তার মেয়ে তাকে নিয়ে এসেছিল।

হুইল চেয়ারটি সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছার পর বৃদ্ধা মহিলাটি একবার মেয়ের দিকে ও একবার সিঁড়ির দিকে তাকালো। তারপর হুইল চেয়ার থেকে নেমে গেল এবং হাঁটুর উপর ভর করে বহু কষ্টে হেঁচড়ে হেঁচড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। ভর্তি হয়ে আবার সেভাবেই চলে গেল।

আমি আরেক সাহসী নারীর সংগ্রামী জীবন গাঁথা শুনেছি। এক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিল সে। পনের বছর ধরে শয্যাই তার সঙ্গী। দেহময় বড় বড় যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়ার বসতি। শরীর অচল হলেও বিবেক ছিল তার সচল। হৃদয় ছিল ঈমানের আলোয় আলোকিত। ইসলামের সেবায় নিজেকে উজাড় করার জন্যে ছিল উদগ্রীব। তাই সাধ্যের ভেতর কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিল সে। তার গৃহিত উদ্যোগগুলো এমন ছিল–

১. সে তার ঘরের দরজা নারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিল। যেন তারা তার অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

২. নিজের ঘরটি অভাবীদের সাহায্যে ওয়াকফ করে দিল। যার ইচ্ছা তার দানের সামগ্রী এখানে রেখে যাবার ব্যবস্থা ছিল। আর ছিল তা গরীব-দুঃখীদের মাঝে সুষ্ঠু বণ্টনের পূর্ণ নিশ্চয়তা। সুতরাং তার ঘরের আঙিনা দান-সদকার বস্তুতে সদা ভরপুর থাকত। যা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্রকৃত অভাবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। আর এভাবেই কতো চুলায় আবার আগুন জ্বলল। কতো ক্ষুধার্তের ক্ষুধা নিবারণ হলো। কতো বস্ত্রহীনের বস্ত্র মিলল। কতো রোগী সুস্থ হলো তার গোনা-গুনতি নেই।

৩. প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণকালে সে কিছু উপকারী বই-পুস্তক ও ক্যাসেট দিয়ে দিত। সেই বই ও ক্যাসেট সবাই পড়ে ও শোনে কি না সে নিয়েও তার চিন্তার অন্ত ছিল না। তাই এ বিষয়েও যথাসাধ্য খোঁজ-খবর নিতো এবং বইগুলো পড়তে ও ক্যাসেটগুলো শুনতে সবাইকে উৎসাহ দিত।

৪. আগন্তুক নারীদের মাঝে ইসলামের বাণী প্রচার করে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’-এর দায়িত্ব পালন করত।

৫. বিবাহপযুক্তা যেসব নারীদের বিবাহ হচ্ছিল না, যারা বিবাহের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে বাপ-ভাইয়ের গলার কাঁটা হয়ে ঝুলছিল– পরিচিতজনদের সহায়তায় সে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করাতো।

৬. দাম্পত্য জীবনের জটিল সমস্যাগুলোর সমাধানে সে নারীদের সাহায্য করত। আল্লাহর শপথ! বিস্ময়ের আঁধার ছিল সে নারী।

কথাগুলো উরাইযের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। মনে দাগ কেটে গেল। তার মাথায় শতবার শোনা সেই কথাটি বারবার গুঞ্জরিত হচ্ছিল যে, নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারীরা আজ সর্বত্র অত্যাচারের শিকার। পুরুষ শাসিত এই সমাজ ব্যবস্থায় তাদের অধিকার আজ চরমভাবে বিনষ্ট। তারা মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়তে চায়, কিন্তু তাদেরকে উড়তে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের ডানা কেটে দেওয়া হচ্ছে। তাই সারার কথা শুনে অজান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো– বাহ! কি চমৎকার!

সারা আবার বলতে লাগল– তোমাকে আরেকটি তথ্য দিচ্ছি, কোরআন-হাদিসে ব্যবহৃত “يايهاالناس” শব্দ দ্বারা নারী-পুরুষ উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বিশ বা ততোধিক স্থানে নারীপুরুষ উভয়কে সম্বোধন করে “يايهاالناس” শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন :

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُم

‘হে মানব সমাজ, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার এবাদত কর।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২১)

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ کُلُوۡا مِمَّا فِی الۡاَرۡضِ حَلٰلًا طَیِّبًا

‘হে মানবমণ্ডলী, পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী ভক্ষণ কর’। (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৬৮)

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا

‘হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক মুত্তাকি (খোদাভীরু)।’ (সূরা হুজরাত, আয়াত : ১৩)

আর এই শব্দটি দ্বারা যে নারী-পুরুষ যুগলই উদ্দেশ্য তার প্রমাণে তোমাকে আরেকটি ঘটনা শোনাচ্ছি–

একদা আম্মাজান উম্মে সালমা রাযিয়াল্লাহু আনহা খাদেমা দ্বারা মাথার কেশ পরিপাটি করাচ্ছিলেন। তার ঘরটি ছিল মসজিদ সংলগ্ন। এ সময় হঠাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে তাশরিফ আনলেন এবং মানুষদেরকে “يايهاالناس” বলে ডাক দিলেন। উম্মে সালমা রাযিয়াল্লাহু আনহা খাদেমাকে থামো বলে মসজিদে যাবার জন্যে দাঁড়ালেন। খাদেমা বলল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো পুরুষদেরকে ডেকেছেন। জবাবে উম্মে সালমা রাযিয়াল্লাহু আনহা বললেন, الناس (লোক সকল)-এর মধ্যে আমিও অন্তর্ভূক্ত। (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং ১৭৮৪)

উরাইয বলল, সারা, আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?

একটু থামো। নারী-পুরুষের সমতা বিষয়ক আলোচনা প্রায় শেষ। বলল সারা।

ঠিক আছে বলো।

শরিয়তের আবশ্যকীয় বিধানাবলী পালনে নারী-পুরুষ সবাই সমান। তদ্রুপ আমলের প্রতিদান প্রাপ্যের ক্ষেত্রেও তাদের মাঝে নেই কোনো বিভেদ। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে–

مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ ہُوَ مُؤۡمِنٌ فَلَنُحۡیِیَنَّہٗ حَیٰوۃً طَیِّبَۃً ۚ وَ لَنَجۡزِیَنَّہُمۡ اَجۡرَہُمۡ بِاَحۡسَنِ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ

‘যে সকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরস্কার দেব, যা তারা করত।’ (সূরা নাহল, আয়াত : ৯৭)

আরো ইরশাদ হয়েছে–

فَاسۡتَجَابَ لَہُمۡ رَبُّہُمۡ اَنِّیۡ لَاۤ اُضِیۡعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِّنۡکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی

‘অতঃপর তাদের পালনকর্তা তাদের দোয়া (এই বলে) কবুল করে নিলেন, আমি তোমাদের কোনো পরিশ্রমকারীর পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষ হোক কিংবা স্ত্রীলোক।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯৫)

অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন–

وَ مَنۡ یَّعۡمَلۡ مِنَ الصّٰلِحٰتِ مِنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ ہُوَ مُؤۡمِنٌ فَاُولٰٓئِکَ یَدۡخُلُوۡنَ الۡجَنَّۃَ وَ لَا یُظۡلَمُوۡنَ نَقِیۡرًا

‘যে পুরুষ কিংবা নারী কোনো সৎকর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয়, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রাপ্য তিল পরিমাণও নষ্ট হবে না।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ১২৪)

আমলের ফযিলত সম্পর্কে যত হাদিস বর্ণিত হয়েছে তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন এই হাদিসটি–

من قال سبحان اللويحمل ج ر ت له نخلة في الجنة.

‘যে ব্যক্তি একবার সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী’ বলবে, তার জন্য জান্নাতে একটি খেজুর গাছ রোপন করা হবে।’ (তিরমিযি শরিফ, হাদিস নং- ৩৪৬৪)

নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই এই সাওয়াবের ঘোষণা। কোন নারী যদি আল্লাহর হামদ-ছানা পড়ে তবে সেও পুরুষের মতোই সাওয়াব লাভ করে। অন্য এক হাদিসে এসেছে–

مامن عبير منير يلي يه كل يوم ثنتي عشرة ركعة تطعا غير فريضة اتقي الله له بيتا في الجنة

‘যে মুসলিম বান্দা প্রতিদিন ফরয নামায ছাড়া আল্লাহর জন্যে বারো রাকাত নফল নামায পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-৭২৮)

নেক আমলের উত্তম প্রতিদান ও বদ আমলের কঠিন শাস্তির ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ বরাবর। আল্লাহর অবাধ্যতার সাজা উভয়ের জন্যেই অভিন্ন। উদাহরণত: আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন–

اَلزَّانِیَۃُ وَ الزَّانِیۡ فَاجۡلِدُوۡا کُلَّ وَاحِدٍ مِّنۡہُمَا مِائَۃَ جَلۡدَۃٍ

‘ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ করে বেত্রাঘাত কর।’ (সুরা নূর, আয়াত : ২)

চুরি সম্পর্কে বলেছেন–

وَ السَّارِقُ وَ السَّارِقَۃُ فَاقۡطَعُوۡۤا اَیۡدِیَہُمَا

‘যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে, তাদের হাত কেটে দাও।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত : ৩৮)

শিরক ও নিফাক সম্পর্কে বলেছেন–

لِّیُعَذِّبَ اللّٰہُ الۡمُنٰفِقِیۡنَ وَ الۡمُنٰفِقٰتِ وَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ وَ الۡمُشۡرِکٰتِ وَ یَتُوۡبَ اللّٰہُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا

‘যাতে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারী, মুশরিক পুরুষ, মুশরিক নারীদেরকে শাস্তি দেন এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে ক্ষমা করেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আহযাব, আয়াত : ৭৩)

মানবজাতির মর্যাদা সম্পর্কিত বর্ণনায় নারী-পুরুষকে এক কাতারে রেখেছেন। ইরশাদ করেছেন–

وَ لَقَدۡ کَرَّمۡنَا بَنِیۡۤ اٰدَمَ وَ حَمَلۡنٰہُمۡ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ وَ رَزَقۡنٰہُمۡ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ وَ فَضَّلۡنٰہُمۡ عَلٰی کَثِیۡرٍ مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِیۡلًا

‘নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদের স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি, তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭০)

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা কোনো মুসলমানকে অসম্মান বা অবজ্ঞা করাকে হারাম বর্ণনা করে নারী-পুরুষের সাম্যতা অক্ষুন্ন রেখে বলেছেন–

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا یَسۡخَرۡ قَوۡمٌ مِّنۡ قَوۡمٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنُوۡا خَیۡرًا مِّنۡہُمۡ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنۡ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُنَّ خَیۡرًا مِّنۡہُن

‘হে মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে।’ (সূরা হুজরাত, আয়াত : ১১)

মর্যাদার মানদণ্ড খোদাভীরুতা

উরাইয পূর্ণ মনোযোগ সহকারে সারার তথ্যনির্ভর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা তন্ময় হয়ে শুনছিল। খানিকটা উত্তাপ মাখা কণ্ঠে সারা বলে চলছিল– এই লোকেরা ন্যায়পরায়ণ প্রভুকে জালেম মনে করে। তাঁর প্রদত্ত বিধানে দোষারোপ করে বলে ইসলাম নারীদের ন্যায্য অধিকার হরণ করেছে।

অতঃপর সারা বিজ্ঞ আলেমের মতো পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, নারী-পুরুষের একে অন্যের ওপর প্রাধান্যের একটাই মানদণ্ড, আর তা হলো– তাকওয়া। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন :

أيها الناس انا خلقنكم من ذكر و انثی وجعلنكم شعوبا وقبائل لتعارفوا ان آرمكم عند الله اتقه

‘হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক মুত্তাকি (খোদাভীরু)।’

অর্থাৎ, দৈহিক সামর্থ্য, সম্পদের প্রাচুর্য, পুরুষালি শক্তিমত্তা কোনোকিছুই মর্যাদা ও মহত্ত্বের মাপকাঠি নয়। মর্যাদা হ্রাস-বৃদ্ধির একমাত্র মাপকাঠি হলো– তাকওয়া।

সারার কথায় উরাইযকে খানিকটা প্রভাবান্বিত মনে হলো। মুগ্ধতার রেশ কাটিয়ে দরদ ভরা কণ্ঠে সে বলল, আহা! অবলা, সরলা যেসব বোনেরা আজ নারী-স্বাধীনতার ফাঁকা বুলি শুনে প্রতারণার শিকার হচ্ছে– তারা যদি এ কথাগুলো বুঝতে পারতো। হায়! তারা যদি এ কথা অনুধাবন করতে পারতো যে, তাদের সাথে আল্লাহর কোনো শত্রুতা নেই। পুরুষের মতো তারাও আল্লাহর সৃষ্টি। তারা চাইলে তাকওয়া-পরহেযগারীতার ময়দানে পুরুষ থেকেও অগ্রগামী হতে পারে। একদম ঠিক বলেছ। উরাইযের কথায় একাত্মতা প্রকাশ করে সারা বলল, আমি তোমাকে আরেকটি বিষয় অবগত করছি।

দেখো, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রেও আল্লাহ তাআলা উভয়ের অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন। ইরশাদ করেছেন–

وَ لَہُنَّ مِثۡلُ الَّذِیۡ عَلَیۡہِنَّ بِالۡمَعۡرُوۡف

‘আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর নিয়ম অনুযায়ী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২৮)

হাকিম ইবনে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! স্বামীর উপর স্ত্রীর হক কি? জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে যখন খাবে তখন স্ত্রীকে খাওয়াবে এবং যখন নিজে পরিধান করবে তখন স্ত্রীকেও পরিধান করাবে’ (আবু দাউদ শরিফ, হাদিস নং-২১৪২)

অপর বর্ণনায় এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মনে রেখো, স্ত্রীদের উপর যেরূপ তোমাদের অধিকার রয়েছে, তদ্রুপ তাদেরও তোমাদের ওপর রয়েছে অধিকার। (তিরমিযি, হাদিস নং- ১১৬৩)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বাবা-মা দু’জনকেই শ্রদ্ধা-সমীহ করার আদেশ দিয়েছেন।

আর এক্ষেত্রেও তিনি মায়ের হকের ব্যাপারে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। বলেছেন–

وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡہِ اِحۡسٰنًا

‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি।’ (সূরা আহকাফ, আয়াত : ১৫)

তারপর ‘তার জননী তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে’-বলে মায়ের মর্যাদা বৃদ্ধিকল্পে গর্ভকালীন সময়ে তার কষ্টের কথা বর্ণনা করেছেন।

বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, একদা এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জানতে চাইল, হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমার পক্ষ থেকে উত্তম আচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার কে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম তিনবার বললেন, তোমার মা, তোমার মা, তোমার মা। চতুর্থবার বললেন, তোমার বাবা। (বুখারী শরিফ, হাদিস নং- ৫৯৭১ এবং মুসলিম শরিফ, হাদিস নং- ২৫৪৮)

লাল পাজামায় মিহা

সারা-উরাইযের আলোচনার গাড়ি বিরামহীন চলছিল। ইতোমধ্যে উরাইযের বোন মিহা তাকে খুঁজতে বেরুলো। মিহার পরিধেয় বোরকাটি ছিল খুবই সঙ্কুচিত ও অন্তর্শোভা পরিদৃশ্যকারী। যা শরীরের আকার ও দেহের প্রলুব্ধকর অঙ্গগুলোকে প্রস্ফুটিত করে রেখেছিল। হাঁটার সময় বোরকার নিচে পরিহিত লাল পাজামাটিও দৃশ্যমান হচ্ছিল। পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টি তার পিছু পিছু ছুটছিল।

মিহা ওয়েটিং রুমে ঢুকে উরাইযকে এখানে বসে থাকতে দেখে খুবই অবাক হলো। তারপর সালাম দিয়ে সারার সাথে হাত মিলালো। পরিচয় পর্ব শেষে আলোচনা শুনতে ওদের পাশেই বসে পড়ল।

ইসলামে নারীর অধিকার সম্পর্কে তখন ওদের মাঝে আলোচনা হচ্ছিল। মিহার কানে কয়েকটি শব্দ পৌঁছুতেই ওর বিরক্তি চরমে ওঠল ক্ষোভ ঝরানো স্বরে বলল, সারা! দেখো ভাই, একটা বিষয়তো পানির মতো পরিষ্কার। তা হলো– অনেক নারীই আজ জ্ঞানে-গুণে পুরুষের চেয়ে শীর্ষে এবং যাপিত জীবনে পুরুষের চেয়ে সফল।

আচ্ছা, তুমি এবং তোমার মতো মেয়েরা নারী-পুরুষের মাঝে এতো বৈষম্য খুঁজে বেড়াও কেন? সর্বক্ষেত্রে পুরুষের অগ্রাধিকার কামনা করো কেন? কেন চাও তাদের জন্য পৃথক পৃথক কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ করতে? কেন সারাক্ষণ তোমরা পুরুষ, পুরুষ জপতে থাকো?

মুখের মানচিত্রে হাসির রেখা ফুটিয়ে সারা বলল, আমরা তো নারী নারী বলেও জপি। দেখো মিহা! সৃষ্টিগতভাবেই আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য রেখেছেন। তাদের শারীরিক অবকাঠামো, আকার-আকৃতি ও স্বভাব-প্রকৃতির মাঝেও রয়েছে পার্থক্যের প্রকাশ। দৈহিক শক্তিমত্তায় পুরুষ এগিয়ে, তবে আবেগ-অনুভূতিতে কম।

বিপরীতে নারীরা আবেগ-অনুভূতিতে অগ্রগামী হলেও শারীরিক শক্তিতে ক্ষীণ। আর জীবন চলার পথে নারী-পুরুষ দুজনেই আপন সামর্থ্য অনুসারে কাজ করবে– এটাই কাম্য।

সেটা কিভাবে? প্রশ্ন মিহার।

বিষয়টি সবিস্তারে বুঝাতে সারা বলল, নারীদের কিছু বিশেষ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে। প্রত্যেক মাসের বিশেষ কিছু দিন তাকে অসুস্থ থাকতে হয়। গর্ভধারণের কষ্ট সইতে হয়। দুগ্ধপোষ্য শিশুকে স্তন্যদান করতে হয়। সন্তানকে লালন-পালন করতে হয়। এ জন্যেই তাকে হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর বাম পাজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্তরের খুব কাছেই যার অবস্থান। অন্যদিকে পুরুষকে পরিবার ও স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব বহন করতে হয়। তাই তাকে মাটি থেকে সুদৃঢ়রূপে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর সৃষ্টিগত এই পার্থক্যের কারণে নারী-পুরুষের দৈহিক ও মানসিক সামর্থ্যের মাঝে তারতম্য হয়ে গেছে।

এই তারতম্যের দৃষ্টিকোণ থেকেই তাদের ওপর ইসলামী শরিয়তের কিছু বিধি-বিধান প্রয়োগে ভিন্নতা এসেছে। পুরুষ যেহেতু সৃষ্টিগতভাবেই শারীরিক শক্তিতে বলিয়ান তাই তাকে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ঘরের বাইরে বেরুতে হয় এবং উদ্ভূত সমস্যাবলি সামাল দিতে হয়।

পক্ষান্তরে আবেগ-অনুভূতির প্রাবল্যের কারণে বাচ্চা-কাচ্চা লালন-পালন ও গৃহাভ্যন্তরের ক্রিয়া-কর্ম সম্পাদনের সামর্থ্য পুরুষের তুলনায় নারীর অধিক বিধায় ঘরের ভেতরকার দায়-দায়িত্ব তাকে অর্পণ করা হয়েছে। হযরত মারইয়াম আলাইহিস সালাম এর মা একজন নারী হয়েও তা সহজে বুঝতে পেরেছিলেন এবং বলেছিলেন–

وليس ال کو کانٹی

‘সে কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই।’

মিহাকে দেখে মনে হলো সে তার কথায় খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই সারা মিহার দিকে তাকিয়ে বলল, মিহা! মনে করো তুমি একজন স্কুল-শিক্ষিকা। তুমি চাইলে স্কুলে একটা পার্টি দিতে।

এখন পার্টি রুমটির পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে চার্ট তৈরী করা, নোটিশ বোর্ডে নোটিশ লাগানো, প্রশংসানামা প্রস্তুত করণ ও পাঠসহ যাবতীয় কাজের দায়-দায়িত্ব তোমার কাঁধে। তোমার ক্লাশে বিশজন ছাত্রী আছে। যারা একেকজন একেক রকমের কাজ সম্পাদনের সামর্থ্য রাখে। তাদের মধ্যে বেটে স্থূলকায়, ছিপছিপে লম্বা, বিশুদ্ধ ভাষী, সাহসী, লাজুক সব ধরণের ছাত্রী আছে। এখন চেয়ার অথবা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নোটিশ ঝুলানোর কাজটি তুমি কার দ্বারা করাবে? বেটে স্থূলকায় ছাত্রীটি দ্বারা?

একদম না। মুচকি হেসে মিহা বলল, বরং ছিপছিপে গড়নের লম্বা ছাত্রীটির দ্বারাই করাবো।

আর পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটির জন্য তুমি কাকে বেছে নেবে? বিশুদ্ধ ভাষী, সাহসী ছাত্রীটিকে?

কখনওই না। মিহার তাৎক্ষণিক জবাব। বিশুদ্ধভাষী ছাত্রীটিকে দিয়ে আমি প্রশংসানামা পাঠ করাবো।

এবার বলো, ছাত্রীদের মাঝে এ পদ্ধতিতে কাজ বণ্টন করে দেওয়াটা ভুল হবে না তো? প্রশ্ন সারার।

না, কোনক্রমেই না। বরং ইনসাফ ভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টনের ফলে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজটি চমৎকারভাবে সম্পন্ন হবে। বলল মিহা।

সারা বলল, বেশ, এবার বলতো স্থূলকায় ছাত্রীটি যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অসম্মতি জানায়, লাজুক ছাত্রীটিও আপত্তি তোলে, লম্বা ছাত্রীটিও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে, বিশুদ্ধভাষী ছাত্রীটিও প্রশংসানামা পাঠে অস্বীকৃতি জানায়, তখন তুমি কি করবে?

তখন আমি কিছুতেই তাদের আপত্তি গ্রহণ করব না। মিহার কষ্টে দৃঢ়তা। কারণ, প্রতিটি ছাত্রীকেই তাদের সামর্থ্যভূক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই দায়িত্ব-বৈষম্যের প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই।

সারা এটাই শুনতে চাচ্ছিল। তাই বলল, ঠিক এভাবেই নারী-পুরুষ উভয়ের সহজাত স্বভাব ও সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করেই দুজনের দায়িত্বে ভিন্নতা রাখা হয়েছে। তোমার এতে আপত্তি কেন?

উরাইযও তখন মিহার মতোই ভাবছিল। তাই সে জিজ্ঞেস করল, সারা! তাহলে কি নারীদের জন্যে ঘর থেকে বের হওয়া হারাম?

সারা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, না! আমি একথা কখন বললাম যে, নারীরা ঘরের বাইরেই পা ফেলতে পারবে না?

উরাইয বলল, কিন্তু আজকাল তো পুরুষালী বহু কাজই নারীরা আঞ্জাম দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তা পুরুষদের চেয়েও সুন্দর-সুচারু হচ্ছে।

সারা বলল, এ কথা ঠিক। আমিও তোমার সাথে একমত। কিন্তু তুমি বলতো, যদি কোনো গ্যারেজে কোনো নারীকে তুমি গাড়ি বা ট্রাকের টায়ার খুলতে বা বদলাতে দেখো তখন তোমার কেমন লাগবে? কিংবা কোনো নারীকে প্রতিদিন আট ঘণ্টা ক্রেন চালাতে অথবা দূর্ঘটনা কবলিত গাড়িকে টেনে তুলতে, ব্রিজ নির্মাণের কাজ করতে কিংবা সিমেন্টের থলি ধুতে দেখো, তাহলে কি তুমি অবাক হবে না?

সারার চমকপ্রদ উদাহরণ শুনে উরাইয এবং মিহা দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

এটা তো স্পষ্ট বিষয়। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে বিবেকবান প্রতিটি মানুষই বোঝে যে, এগুলো নারীদের উপযোগী কাজ নয়। নারীদের স্বভাব, শক্তি, সামর্থ্যের আওতাভূক্ত নয় এগুলো। আল্লাহ না করুন, যদি কোনো নারী এসব কাজে যোগ দেয়, তাহলে ধীরে ধীরে তার দেহের কোমলতা, ত্বকের লাবন্যতা ও নারী সুলভ কমণীয়তা হারিয়ে যাবে।

সারা তার পূর্বের কথার সূত্র ধরে বলতে লাগল, বিপরীতে তুমি এমন পুরুষের কথা কল্পনা করে দেখো তো, যে ঘরের কোণে বসে বসে বাচ্চার জন্য দুধ বানাচ্ছে, তাকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে বাচ্চা কেঁদে উঠলে তাকে খেলনা দেখিয়ে, গান শুনিয়ে মন ভোলাচ্ছে, রাতে ঘরে চোর আসার পর চোরকে ধরার জন্য সে তার স্ত্রীকে ডাকছে আর নিজে বাচ্চাদের সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার-চেচামেচি করছে।

উরাইয আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলল, চিৎকার-চেচামেচি তো মহিলাটি করার কথা। আর পুরুষের কাজ চোরটিকে ধরা।

সারা বলল, কেন? সমান অধিকারের প্রশ্ন ভাই। নারী-পুরুষ দুজনেই তো চোরকে ধরতে পারে এবং চোরের সাথে লড়তে পারে। তাহলে এ দায়িত্ব একা পুরুষের কেন?

ভাই, বড়ই আশ্চর্যের কথা! এবার মিহা মুখ খুলল, আমি বলতে চাচ্ছি–

পুরুষ যদি বাচ্চার জন্য দুধ বানায়, তাকে কোলে নিয়ে তা খাওয়ায়, তার দেখভাল করে ও নারী সুলভ সব কাজ আঞ্জাম দেয়, তাহলে এখন আর বাকী থাকল বাচ্চা গর্ভে নেয়ার কাজটা…..

এবার সারার হাসিতে ফেটে পড়ার পালা।

কেন এই বিভেদ

সারা বলল– এখন আমি নারী-পুরুষের কিছু স্বভাবগত ও সৃষ্টিগত পার্থক্য তুলে ধরছি। ইসলাম নারীকে গৃহিণী বানিয়েছে। তাই পুরুষের জন্য তার স্ত্রী, কন্যা, মা ও পরিবারের অন্যান্যদের জন্য ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা জরুরী। নারীর খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানের ব্যবস্থাপনায় কোনোরূপ শীথিলতা প্রদর্শন করা পুরুষের জন্য বৈধ নয়। নারীর সম্মান ও সতীত্ব রক্ষা এবং তাতে বিন্দু পরিমাণ আঁচ লাগতে না দেয়ার দায়িত্বও পুরুষের। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো একথাও বলেছেন যে,

من قتل دون عرضه فهو شهيل .

যে স্বীয় সম্মান রক্ষায় নিহত হলো সে শহীদ। (মুসনাদে আহমদ, ৩/১৯০)

আল্লাহ তাআলাও নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে অর্পণ করেছেন। পবিত্র কোরআনের এই বাণী থেকে সেকথাই বোঝা যায়–

اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوۡنَ عَلَی النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰہُ بَعۡضَہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ وَّ بِمَاۤ اَنۡفَقُوۡا مِنۡ اَمۡوَالِہِمۡ

‘পুরুষেরা নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের ওপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ৩৪)

কারণ গৃহের প্রতিরক্ষা ও তত্ত্বাবধানের বিষয়টি পুরুষ-সত্ত্বার সাথে মানানসই। পুরুষ বর্হিরণাঙ্গনের যোদ্ধা আর নারী গৃহ নামক রণক্ষেত্রের। এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা পুরুষের ওপর আরোপিত অনেক আবশ্যিক কর্ম থেকে নারী সমাজকে মুক্ত রেখেছেন।

উদাহরণতঃ পুরুষের ওপর জিহাদ ফরয, জুমার নামায ফরয, তীব্র গরম কিংবা কনকনে শীতেও মসজিদে গিয়ে জামাতে নামায পড়া ওয়াজিব।

কিন্তু সারা! উরাইয সারাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বৈষম্যের আরো দিক আছে। উত্তরাধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারীর অংশ পুরুষের অর্ধেক। এ বণ্টন পদ্ধতি কি নারী-পুরুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে না?

না। সারার সরাসরি জবাব। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা ন্যায়পরায়ণ বিচারক। তিনি কারো প্রতি বিন্দু পরিমাণ অবিচার করেন না। তার কোনো ফয়সালাই হেকমত শূন্য নয়। তিনি স্বীয় বান্দাদের লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে সম্যক অবগত। ধরো, কোনো ব্যক্তি এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে মারা গেলো। আর উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে গেলো এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা। এখন এ টাকা থেকে ছেলে মেয়ে দুজনের মধ্যে কে কত পাবে?

সম্ভবতঃ মেয়েটি পাবে পঞ্চাশ হাজার আর ছেলেটি এক লাখ। খানিকটা ভেবে নিয়ে জবাব দিল উরাইয।

একদম ঠিক বলেছ। এক বছর পর মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেলো। মহর হিসেবে পেলো পঞ্চাশ হাজার টাকা। এখন তার কাছে কত টাকা হলো। এক লাখ। উরাইযের তাৎক্ষণিক জবাব।

বিবাহ-শাদির মামলা। উপহার তো মিলেই। মেয়েটি উপহার হিসেবে পেলো বিশ হাজার টাকা। এখন তার ঝুলিতে জমা হলো কত?

এক লাখ বিশ হাজার। একটুও না ভেবে জবাব দিল উরাইয।

এদিকে তার স্বামী তার জন্য নতুন ঘর বানালো। ফার্নিচার কিনলো। ওলিমা ইত্যাদির সব ব্যয় ভার বহন করল। মেয়েটির সঞ্চিত এক লাখ বিশ থেকে এক টাকাও খরচ হলো না।

অপরদিকে উত্তরাধিকার সূত্রে এক লাখ পাওয়া ছেলেটিও বিবাহ করল। মহর হিসেবে বউকে দিলো পঞ্চাশ হাজার টাকা। ঘরের জন্য ফার্নিচার ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ টাকা খরচ হলো ষাট হাজার। বাকী থাকল কত? প্রশ্ন সারার।

থাকবে কি? বেচারা তো আরো দশ হাজার টাকা ঋনী হয়ে গেলো। স্মিতহাস্যে উরাইযের জবাব।

তারপর ঘর চালানো, বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ, স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ-পোষণ সবই ছেলেটির দায়িত্বে। এই সমস্ত খরচাদির কিঞ্চিতও স্ত্রীর উপর বর্তায় না।

পক্ষান্তরে মেয়েটি তার লাখ টাকা কোনো ব্যবসায় লাগালো। তার ও তার সন্তানদের ভরণ-পোষণের দায়িত্বের যথারীতি জিম্মাদার তো স্বামীই। অর্থাৎ, নারীর তুলনায় পুরুষের অর্থনৈতিক জিম্মাদারী বহুগুণে বেশি। পুরুষ তার উপার্জনের বৃহদাংশ তো নারীর পেছনেই ব্যয় করে। সুতরাং কথা সেটাই যা আল্লাহ তাআলা বলেছেন–

اِنَّ رَبَّکَ حَکِیۡمٌ عَلِیۡمٌ

‘নিশ্চয় আপনার পালনকর্তা প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী।’ (সূরা আনআম, আয়াত : ৮৩)

বাস্তবিকই আল্লাহর প্রতিটি ফয়সালাই প্রজ্ঞাপূর্ণ এবং তিনি তাঁর বান্দার প্রয়োজন সম্পর্কে উত্তমরূপেই অবগত আছেন।

সারার যুক্তিপূর্ণ প্রামাণিক আলোচনা উরাইয ও মিহার মনে প্রশান্তির হিমেল হাওয়া বইয়ে দিলো। মহান প্রভুর প্রজ্ঞাপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। বণ্টন-পদ্ধতির প্রকৃত রূপ জানতে পেরে তারা অভিভূত হলো।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা অবহেলিত বলে প্রকৃত সত্যকে গোপন করে যারা এতোদিন তাদেরকে ধোঁকা দিয়ে আসছিল, মনের কোণে তাদের প্রতি একরাশ ঘৃণা জন্ম নিলো।

সারা বলল, নারী-পুরুষের মধ্যকার এই প্রাকৃতিক ভিন্নতা ও বণ্টন-ব্যবস্থা সম্পূর্ণ আল্লাহ প্রদত্ত। তাই আমাদের উচিত এর ওপর সন্তুষ্ট থাকা। কিছু বিষয় পুরুষের সাথে বিশেষিত আর কিছু একান্তই নারীর সাথে। তাই তার মর্জির উপর রাজি থাকাটাই কাম্য। তার পক্ষ থেকে বণ্টিত নির্ধারিত বিষয়ে অনাস্থা প্রকাশ করলে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। সেজন্যেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন–

وَ لَا تَتَمَنَّوۡا مَا فَضَّلَ اللّٰہُ بِہٖ بَعۡضَکُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ ؕ لِلرِّجَالِ نَصِیۡبٌ مِّمَّا اکۡتَسَبُوۡا ؕ وَ لِلنِّسَآءِ نَصِیۡبٌ مِّمَّا اکۡتَسَبۡنَ ؕ وَ سۡئَلُوا اللّٰہَ مِنۡ فَضۡلِہٖ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمًا

‘আর তোমরা আকাঙ্ক্ষা করো না এমনসব বিষয়ের যাতে আল্লাহ তাআলা তোমাদের একের ওপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। আর আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা সর্ববিষয়ে জ্ঞাত।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ৩২)

অত্র আয়াতে আল্লাহ তাআলা কামনা করতেও নিষেধ করেছেন। আর যারা এর তোয়াক্কা না করে নারী-পুরুষের মাঝে বিদ্যমান শরঈ পৃথকতাকে অস্বীকার করে এবং নারী-পুরুষের মাঝে সমতা-অসম্ভব বিষয়গুলোতে সমতা স্থির করতে চায় তাদের জন্য করণীয় কি? নারী-পুরুষের মাঝে সৃজনিক ও প্রাকৃতিক ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও যদি শরিয়তের সমস্ত বিধি-বিধান তাদেরকে সমানভাবে পালনের আদেশ দেওয়া হয়, তবে সেটা তাদের উভয়ের জন্যেই জুলুম হয়ে যাবে।

তাকওয়ার পোষাক

সম্ভবত এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা নারীদেরকে পর্দা করা ও হিজাব পরার আদেশ দিয়েছেন আর পুরুষেরা যা খুশি পরতে পারে। বলল মিহা।

না, তোমার এ কথা ঠিক নয়। সারা বাঁধা দিলো। পুরুষ চাইলেই যে কোন পোষাক পরতে পারে না।

কিভাবে? মিহার কৌতুহলী প্রশ্ন।

সারা বিষয়টি সবিস্তারে বুঝিয়ে বলতে লাগল, পর্দা করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপরই ফরয। এমনকি পুরুষ পুরুষের সাথে ও নারী নারীর সাথেও পর্দা করা জরুরী। পুরুষের জন্য নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত স্ত্রী ব্যতিত সবার সামনে ঢেকে রাখা আবশ্যক। সন্তানের বয়স দশ বছর হয়ে যাওয়ার পর তাকে মা-বাবার সাথে এক বিছানায় শোয়ানোর ব্যাপারেও শরঈ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

ইসলাম-পূর্ব অজ্ঞতার যুগে আরবের লোকেরা উলঙ্গ হয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফ করত। তারা বলত, আমরা সেসব কাপড় পরে কিভাবে তাওয়াফ করব যেগুলো পরে আল্লাহর নাফরমানি করে থাকি। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দিলেন যে, ‘আজ থেকে কারো জন্যে উলঙ্গ হয়ে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করা জায়েয নেই’। (বুখারী শরিফ, হাদিস নং-৪৩৬৩)

একাকী কিংবা রাতের আঁধারেও বিবস্ত্র হয়ে নামায আদায় করা বৈধ নয়। এমনকি তিনি নির্জন স্থানেও উলঙ্গ হতে নিষেধ করেছেন, বলেছেন–

فالله أحق أن يستحيا من الناس

মানুষের জন্য আল্লাহকে লজ্জা করা অধিক জরুরী। (আবু দাউদ শরিফ, হাদিস নং-৪০১৭)

হজের মধ্যে ইহরাম পরিধানের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য রাখা হয়েছে। ইসলাম পুরুষদেরকে চাল-চলন, কথা-বার্তা, পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারীদের সাদৃশ্যতা অবলম্বনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পুরুষদেরকে টাখনু গিরার নীচে পোষাক পরিধান করতে নিষেধ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে নারীদেরকে পায়ের পাতাও ঢেকে রাখতে বলা হয়েছে। চাই তা লম্বা পোষাক পরে হোক কিংবা মোজা পরিধান করে।

অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো পর্দাভূক্ত অঙ্গের কোনো অংশ প্রকাশ পেয়ে গেলে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদেরকে সেদিকে তাকাতে নিষেধ করেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে বেগানা নারীদের দিকে তাকাতেও নিষেধ করেছেন।

এমনিভাবে যৌন উদ্দীপক কোনো কিছুর দিকে দৃষ্টি দেওয়াকেও করেছেন হারাম।

মুসলিম নর-নারীকে হারাম থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে পর্দার ভূমিকা অপরিসীম। এটি শরিয়তের অবশ্য পালনীয় বিধানাবলীর একটি। পর্দা যেমন পুরুষদের রক্ষা করে নারীর ফেতনা থেকে, তেমনি নারীকেও রক্ষা করে এ থেকে সৃষ্ট নানা কষ্টদায়ক ব্যাপার থেকে। তবে পুরুষের তুলনায় নারীর জন্য পর্দা করা অধিক জরুরী। কারণ দুষ্ট লোকের কুদৃষ্টি নারীদের ওপরেই বেশি পড়ে।

তাই আল্লাহ তাআলা নারীর নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষার্থে এবং অসৎ লোকের অশিষ্ট আচরণ থেকে নিরাপদ রাখতে নারীকে তার রূপ-সৌন্দর্য ঢেকে রাখতে বলেছেন। আর নারীর মুগ্ধ করা সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষেত্রে চেহারারই অগ্রগণ্য।

আলোচনায় উত্তাপ

উরাইয আপত্তি তুলে বলল, কিন্তু পর্দার মাসআলা নিয়ে তো ওলামায়ে কেরামের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। নারী তার পুরো শরীর ঢেকে নিয়ে মুখ ও হাতের তালুদ্বয় খোলা রাখলে সমস্যা কোথায়?

সারা উরাইযের কথার জবাব দেয়ার আগে ঠাট্টা করে বলল, মনে হচ্ছে আমাদের আলোচনা এবার উত্তাপ ছড়াবে। কারণ, এটাই সেই বিষয় যা নিয়ে কথা বলার জন্য আমি তোমার কাছে এসে বসেছিলাম।

বেশ, বেশ। ভেবে নাও, রণাঙ্গণ প্রস্তুত। উরাইযের কণ্ঠে উৎফুল্লতা। আর তুমি নিশ্চিত থাকো, আমি সত্যান্বেষী। উপযুক্ত প্রমাণ পেলে সহজেই মেনে নেবো।

সারা আলোচনার শুরুতেই বলল, নারীদের জন্য চেহারার পর্দা করা জরুরী। চলো, হাদিস কোরআনের আলোকে এর সত্যতা খুঁজে দেখি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের মুসলিম নারীরা এ বিধান মেনে চলতো। খেলাফতে রাশেদার যুগের মুসলিম নারীদেরও এ ব্যাপারে মত ও পথ ছিল অভিন্ন। বরং হিজরী চৌদ্দ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়– যখন খেলাফতের সূর্য অস্তমিত হয়ে মুসলিম সম্রাজ্য ছোট ছোট খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল-তখনকার মুসলিম নারীরাও তাদের মুখাবয়ব পর্দায় আবৃত রাখত। বিগত কয়েক বছর ধরে চেহারা উন্মুক্ত রাখার প্রচলন প্রসিদ্ধি পেয়েছে।

সত্যিই তাই! উরাইযের কণ্ঠে বিস্ময়। আশ্চর্য কথা। তুমি পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথেই এ কথা বলছ?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কেন নয়? সারার কণ্ঠে দৃঢ়তা। আমি এ কথা প্রমাণ করতে প্রস্তুত।

নারীদের চেহারা খোলা রাখার প্রবণতা আবহমানকাল থেকে নয়। প্রাচীন কালের মুসলিম নারীরা সবসময় তাদের চেহারা পর্দাবৃত রেখেছে। অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম তাদের কিতাবাদিতে একথা লিখে গেছেন। আমার ঠিক মনে নেই; তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা একটা ছোট কিতাবে লেখা আছে। কিতাবটিতে নারীদের জন্য শিক্ষণীয়, উপদেশমূলক বহু দিক নির্দেশনা সন্নিবেশিত আছে। নার্সদেরকে দেয়ার জন্য আমি আমার আম্মিকে কয়েকটি বই এনে দিয়েছিলাম। দেখি, কিতাবটির এক আধ কপি পাওয়া যায় কি না।

সারা উঠে চলে গেল। যখন ফিরে আসল তখন তার হাতে একটা ছোট কিতাব। সে বসতে বসতে পড়া শুরু করল–

তৃতীয় হিদায়াত : কতিপয় নারীরা চেহারার পর্দার ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শন করে থাকে অথচ মুসলিম নারীরা বছরের পর বছর ধরে চেহারার পর্দা করে আসছে। পূর্ববর্তী যুগের ও বর্তমান কালের বহু ওলামায়ে কেরাম এ কথা উল্লেখ করেছেন।

শাইখুল ইসলাম হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু : ৮৫২ হি.) লিখেছেন :

لم تزل عادة البناء قرينا كييئایشون وجوههن عن الأجانب

অর্থাৎ, প্রাচীন ও বর্তমান কালের নারীরা সর্বদাই পরপুরুষদের সামনে চেহারা ঢেকে রেখে আসছে। (ফাতহুল বারী, ৩৩৭/৯)

ইমাম গাজালী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

الله يلي التيجان على مير الرمان مشو في الوجود، والبناء يخرجن منتقبات.

অর্থাৎ, যুগ যুগ ধরেই পুরুষেরা তাদের চেহারা খোলা রাখত আর নারীরা মুখে নেকাব পরে বাইরে বের হতো। (ফাতহুল বারী, ৩৩৭/৯)

মুফাসসির ও মুহাদ্দিস ইমাম সুয়ূতী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু : ৯১১ হি.) পবিত্র কোরআনের–

یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡہِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِہِنَّ

(‘তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়’) আয়াতের তাফসিরে লিখেছেন– এটা পর্দার আয়াত, যা সকল নারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। (সুরা আহযাব, আয়াত : ৫৯)

এ থেকে বোঝা যায় যে, নারীদের জন্য মাথা ও চেহারা ঢেকে রাখা জরুরী।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, পূর্বের ওলামায়ে কেরাম ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে কিতাব লিখেছেন। পর্দা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তারা মুসলিম নারীদের চেহারা খোলা রাখার মাসআলাকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে লেখেননি এবং এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনায় সময় ব্যয় করেননি। এর কারণ সুস্পষ্ট। সেকালের নারীদের মাঝে চেহারা খোলা রাখার প্রচলন ব্যাপক ছিল না। তাই এ বিষয়ে কলম ধরার প্রয়োজন পড়েনি।

তুর্কিস্থান, মিসর ও সিরিয়ার প্রাচীন চিত্রসম্ভার থেকেও জানা যায় যে, তদানিন্তন মুসলিম নারীরা তাদের চেহারা পর্দাবৃত রাখত। এই চিত্রসম্ভার কাসেমির লেখা– مکتب عبنر, আহমদ খালেদের লেখা– کتاب الطاهرالحدادومسئلةالحداثت এবং মিসর আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা প্রতিটি কিতাবেই দ্রষ্টব্য।

সারার কথা শেষ না হতেই উরাইয বলল, ব্যস সারা! আমি তোমার কথা বুঝে গেছি। কিন্তু এমনও তো হতে পারে, পর্দার অন্তর্নিহীত অর্থ অনুধাবনে তাদের ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য ছিল।

না, না, বিষয়টি মোটেই এমন নয়। উরাইযের কথা সরাসরি নাকচ করে দিয়ে সারা বলল, শরঈ পর্দা কেমন হবে, কি তার শর্ত– এটি সবারই জানা। শরঈ পর্দা বলতে বোঝায়, নারীর সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা এবং পরপুরুষের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ না করা। আল্লাহ তাআলার আদেশও তাই–

لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَہُنَّ

‘তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে’। (সূরা নূর, আয়াত : ৩১)

কিন্তু আল্লাহ তাআলা সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করার পর এটাও বলেছেন–

الا ما ظهر منها

‘কিন্তু যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া। (প্রাগুক্ত)

এর দ্বারা তো চেহারা ও হাতই উদ্দেশ্য। আপত্তি তুলল উরাইয।

না, এর দ্বারা চেহারা ও হাত উদ্দেশ্য নয়। সারা বিষয়টি সবিস্তারে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল– “الا ما ظهر منها” বলে আল্লাহ তাআলা সৌন্দর্য প্রকাশক সেসব বস্তুকে বাদ দিয়েছেন যা এমনি এমনিই প্রকাশিত হয়ে যায়।

যেমন, নারীর দৈর্ঘ্য ও খর্বতা, কৃশতা ও স্থূলতা প্রভৃতি। এর দ্বারা উদ্দেশ্য সেসব সৌন্দর্য যা অনিচ্ছাবশত প্রকাশ পেয়ে যায়। যেমন, বাতাসের দোলে বোরকার নিচের পোষাক বা দেহের কোনো অংশ দেখা যাওয়া। অর্থাৎ, নারীর সৌন্দর্যের কোনো কিছু অনিচ্ছয়ায় প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি পর্দার হুকুম থেকে বিয়োজ্য। সেজন্যেই আয়াতে আল্লাহ তাআলা “الا ما ظهر منها” বলেছেন “الا ما ظهر ت” নারী নিজে যা প্রকাশ করে’-বলেননি। সুতরাং, “الا ما ظهر منها” দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যে সৌন্দর্য নারীর স্বেচ্ছা সম্পাদন ব্যতিত এমনিতেই প্রকাশিত হয়ে যায়।

বাহ! কী চমৎকার বলেছ। সারার আলোচনায় বিমোহিত উরাইযের বিমুগ্ধ উচ্চারণ।

আচ্ছা, চলো এবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করি।

কিভাবে পর্দা করব

হিজাবের ক্ষেত্রে সাধারণত জালবাব (বড় চাদর) বা খিমার (উড়না) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আভিধানিক অর্থে ‘খিমার’ বলা হয়– এমন বস্তুকে যা কোনো কিছুকে ঢেকে ফেলে।

প্রসিদ্ধ একটি হাদিসের বাক্যাংশ এরূপ–

خروا ان يتم

‘তোমাদের পাত্রগুলো ঢেকে রাখো”। (আল-মু’যামুছ ছগীর লিত তাবরানী, ২২৭০)

তাই নেশাজাতীয় দ্রব্যকে ‘খিমার’ এজন্যে বলা হয় যে, তা বিবেকের উপর পর্দা ফেলে দেয়। খিমার এরূপ কাপড়কে বলে যা দ্বারা চেহারা, গর্দান, বুক ঢেকে রাখা যায়। (বাংলায় এটিকে উড়না বলে)

খিমার বা উড়না পরিধানের পদ্ধতি হলো– নারীরা এর সাহায্যে শরীরের সেসব অঙ্গ ঢেকে ফেলবে ঘরের ভেতর যা সাধারণত খোলা থাকে। অর্থাৎ, প্রথমে উড়না মাথায় পরে তার এক প্রান্ত দ্বারা নেকাবের মতো করে চেহারা ঢাকবে এবং অপর প্রান্ত দ্বারা ঢাকবে বক্ষদেশ। আর এভাবেই শরীরের সেসব অঙ্গগুলো ঢাকতে হবে যা গৃহাভ্যন্তরে সাধারণত উন্মুক্ত থাকে। এভাবে উড়না জড়িয়ে নারীদের ঘর থেকে বেরুনো উচিত। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, উড়নাটি যেন এতটাই পাতলা না হয় যে, তাতে নারীদের মুগ্ধ করা সৌন্দর্যগুলো দৃষ্টিতে পড়ে।

ইমাম আলকামাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হাফসা বিনতে আব্দুর রহমান ইবনে আবি বকর তদীয় ফুফি উম্মুল মুমেনিন হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা এর নিকট আসলেন। তিনি এমন উড়না পরেছিলেন যে, তার ললাট দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। উম্মুল মুমেনিন সেই উড়নাটি তার থেকে নিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেললেন।

তারপর ধমকের স্বরে বললেন, আল্লাহ তাআলা সূরা নূরে কি বলেছেন তুমি জানো না?

একথা বলে তিনি আরেকটি উড়না এনে হযরত হাফসাকে পরিয়ে দিলেন। (আত্ তাবাকাতুল কুবরা লি ইবনে সা’দ, ৮/৭২)

এটা হলো হিজাবের প্রথম অংশ যা চুল ও মুখাবয়বকে ঢেকে দেয়। হিজাবের দ্বিতীয় অংশ হলো যা দ্বারা গোটা শরীর ঢাকা হয়। সেটাকে জালবাব বা বড় চাদর বলে। নারীরা এটি মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরে থাকে। এটা নারীর পুরো শরীর, পরিধেয় বস্ত্র ও সৌন্দর্যকে আড়াল করে ফেলে। (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে যাকে বোরকা বলা হয়।)

কিন্তু সারা, আজকাল বহু নারীকে বোরকা পরেও সৌন্দর্য প্রকাশ করতে দেখা যায়। বলল উরাইয।

মানে? সারা ব্যখ্যা চাইল।

মানে অনেক নারীরাই এমন সঙ্কুচিত বোরকা পরে যার ফলে তাদের দেহের বিমুগ্ধ ভাঁজগুলো বিকশিত হয়ে পড়ে।

সারা বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। বর্তমানে এ ধরনের বোরকার ব্যাপকতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আমি অনেক ফতোয়ার কিতাবে পড়েছি, এসব বোরকা পরিধান, প্রচলন ও ক্রয়-বিক্রয় সবই নিষেধ। কারণ এগুলোর ক্রয়-বিক্রয়ও অন্যায় কাজে সহযোগিতার নামান্তর। আর আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন–

وَ تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَ التَّقۡوٰی ۪ وَ لَا تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ

‘সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না’। (সূরা মায়িদা, আয়াত : ২)

কিন্তু সারা, উরাইয আবার প্রশ্ন তুলল। আমি যদি ঢিলেঢালা বোরকা পরে মেকাপ ছাড়া চেহারা ও হাত খোলা রাখি তাতে সমস্যা কোথায়?

হ্যাঁ, সত্যিই তো, তাতে সমস্যা কোথায়? মিহাও উরাইযকে সমর্থন জানালো।

ঈষৎ হেসে সারা বলল, সমস্যা তো আছেই।

কি সমস্যা? উরাইযের প্রশ্নে বিস্ময়ের ছোঁয়াচ।

একজন মুসলিম নারী হিসেবে তুমি নিশ্চয় শরঈ দলীলের উপর আস্থাশীল?

হান্ড্রেড পার্সেন্ট। উরাইযের কণ্ঠে দৃঢ়তা।

তাহলে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। সারা বলতে লাগল। একটু আগেই আমি বলেছি, সাহাবা ও তাবেয়িদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম নারীদের আমল এমনই ছিল যে, তারা নেকাব দিয়ে চেহারা ঢেকে বাইরে বেরুতো। আর উম্মতে মুহাম্মাদির সর্বজনগ্রাহ্য আমলও এটি। এ বিষয়ে বিভিন্ন মাযহাবের ওলামায়ের কেরামের বক্তব্যও অভিন্ন। যাদের মধ্যে ইমাম ইবনে আব্দুল বার মালেকী, ইমাম নববী শাফেয়ী এবং শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ হাম্বলী রাহিমাহুল্লাহ এর মতো মহান ব্যক্তিবর্গও রয়েছেন।

হিজরী চৌদ্দ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে যখন ইসলামী খেলাফতের সূর্য অস্তমিত হয়ে গেলো– তখনকার মুসলিম নারীদের আমলও এমনই ছিল।

ক্রমশ এই আপদ তুর্কিস্থান, সিরিয়া, ইরাক হয়ে অন্যান্য ইসলামী দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমদিকে এটি কেবল চেহারা খোলার উপর সীমাবদ্ধ ছিল।

কিন্তু ধীরে ধীরে গোটা শরীর থেকেই কাপড় হ্রাস পেতে লাগল। পর্দাহীনতার সূচনা একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হয়েছিল।

তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে? মিহার কণ্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক তুচ্ছ ঘটনা থেকেই পর্দাহীনতার সূত্রপাত হয়। বলল সারা।

তুমি কি আমাদেরকে সেই ঘটনাটি শোনাবে? প্রশ্ন মিহার।

হ্যাঁ, আমি সেই ঘটনাটি তোমাদের শোনাবো। তোমাদের জানা দরকার বলেই শোনাবো। কারণ, আজ ইসলামী অনেক রাষ্ট্রই সে পথে হাটছে। কিন্তু তার আগে মুসলিম নারীদের জন্য চেহারার পর্দা আবশ্যক কি না সে বিষয়টি সুস্পষ্ট প্রমাণের আলোকে তুলে ধরতে চাচ্ছি।

এ ব্যাপারে সমস্ত প্রমাণাদি কি তোমার স্মরণ আছে? জানতে চাইল উরাইয।

দ্বিতীয় সাক্ষাত

সারা বলল, এই মুহুর্তে তো সবগুলো মনে নেই। তবে গতকাল ভার্সিটিতে কিতাব প্রদর্শনী চলছিল। প্রদর্শনীতে আমি একটি কিতাব দেখেছি। যাতে পর্দা, পর্দা সম্পর্কিত ইতিহাস, পর্দা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে যাবতীয় প্রমাণাদি ও পর্দাহীনতার সূচনা সংক্রান্ত সেই ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে। ইনশাআল্লাহ আজ আসরের পর আমি সেই কিতাবটি কিনতে যাব।

উরাইযেরও আগ্রহ জাগল। সে মিহাকে বলল, মিহা, চলো না আমরাও সেই প্রদর্শনীতে যাই।

কিতাবাদি পড়া বা অধ্যয়নের ব্যাপারে মিহার তেমন ঝোঁক নেই। তথাপি সে এই ভেবে রাজি হয়ে গেল যে, এই বাহানায় সারার সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সুযোগ মিলবে। আসরের পর প্রদর্শনীতে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করে তিনজনই বাড়ির পথ ধরল। ফেরার সময় উরাইয এবং মিহা দুজনেই সারার কথাগুলো নিয়ে নিজ নিজ বিচারবোধ থেকে বিশ্লেষণ করতে লাগল।

মিহা বলল, আমি ইন্টারনেটে নারীদের ওপর বাড়াবাড়ি ও অত্যাচার বিষয়ক কয়েকটি আর্টিক্যাল পড়েছি। যেখানে নারীদের প্রতি মায়াকান্না দেখিয়ে লেখা হয়েছে যে, অবলা নারী জাতি আজ চরম অত্যাচারের শিকার। যে কোনো মুল্যেই তাদেরকে এ অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে হবে। অনেক ম্যাগাজিনেও এরকম লেখা পড়েছি। কিন্তু আজ আমি বুঝেছি, যা পড়েছি তার সবই ছিল ভুল। একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, আমি যদি আমার সৌন্দর্য প্রকাশ করে চলি তাহলে লম্পটদের কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে কিছুতেই রক্ষা করতে পারব না। আসতাগফিরুল্লাহ।

মিহার কথা শুনে উরাইয অবাক না হয়ে পারল না। সেইতো মিহাকে সবসময় উপদেশ দিয়ে বলতো– পর্দায় থাকো, সাদাসিধে চলো, সৌন্দর্য প্রকাশক চমকদার পোষাক পরে বাইরে বেরিও না।

উরাইয মিহার চেয়ে বয়সে যেমন বড়, তেমনি জ্ঞান-বুদ্ধিতেও এগিয়ে।

নামায রোজার ব্যাপারে আন্তরিক থাকলেও পর্দার ব্যাপারে সে বরাবরই ছিল শিথিল। শিক্ষিত এই মেয়েটি অধ্যয়নে খুব আগ্রহী। পর্দা বিষয়ক অনেক লেখায় সে পড়েছে যে, নারীদের জন্য সাদামাটা পোষাক পরে চেহারা খোলা রাখার বৈধতা রয়েছে। আরো পড়েছে, অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মতে নারীদের জন্য চেহারা অনাবৃত রাখা জায়েয আছে। কেবল সৌদি আরবের আলেমগণ চেহারা খোলা রাখাকে হারাম বলেছেন। পক্ষান্তরে মিসর, সিরিয়া, ইয়ামান, তুরস্ক ও অন্যান্য ইসলামী দেশের আলেমগণ এটাকে জায়েয ফতোয়া দিয়েছেন। সে কোথায় যেন এটাও পড়েছে যে, চেহারা ঢেকে রাখাটা দীনের আওতাভূক্ত কোনো বিষয় নয়। বরং এটি আবহমান কাল ধরে চলে আসা একটি রীতি মাত্র।

সারার সপ্রমাণ সরল কথাগুলো উরাইযকে সবকিছু নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। তার সঞ্চিত জ্ঞান-ভাণ্ডারকে দ্বিতীয়বার পরখ করে দেখতে এবং আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে যত কিছু পড়েছে সঠিকতার মানদণ্ডে তা যাচাই করে নিতে তাগিদ দিচ্ছে। সে বুঝতে পারছে, এ বিষয়ে তার মেনে আসা মত ও পথ কোনটিই নির্ভূল নয়।

ঘড়িতে সময় বিকাল চারটা। সারা ভার্সিটির উদ্দেশে বেরুলো। উরাইয ও মিহাও ভার্সিটির দিকে রওয়ানা হলো। সারাদের ভার্সিটিতে প্রতি বছরই এই অনাড়ম্বর কিতাব প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছাড়াও বহিরাগত অনেক নারী এই প্রদর্শনী দেখতে আসে।

সারা একটু জলদি পৌঁছে গেলো। এসেই প্রথমে সেই কিতাবটি কিনে ফেলল। উরাইয ও মিহার আগমনে বিলম্ব দেখে সে কিতাবটিতে চোখ বুলাতে লাগল। ইত্যবসরে উরাইয ও মিহা এসে গেলো। সারা আলোচনার দৈর্ঘের কথা ভেবে তাদের দুজনকে নিয়ে ভার্সিটির ক্যান্টিনের দিকে চলল।

ভার্সিটির ক্যান্টিনে

ভার্সিটির ক্যান্টিনটি যথেষ্ট প্রসস্ত। চারিদিকে গোল টেবিল বিছানো। প্রতিটি টেবিলে চারজন অনায়াসে বসতে পারে। প্রদর্শনীর কারণে ক্যান্টিনে আজ লোক সমাগম অনেক। তাদের তিন জোড়া চোখ শোরগোল মুক্ত নির্জন স্থানের সন্ধান করছিল। মিহা ক্যান্টিনের বাম কোণে খানিকটা কোলাহলমুক্ত একটি শূণ্য টেবিল দেখতে পেলো। যা খানিকটা নিরিবিলি ও কোলাহল মুক্ত ছিল। তারা তিনজন গিয়ে সেখানে বসল। সারা তার পার্স থেকে কিতাবটি বের করল এবং পনেরো নম্বর অধ্যায় খুলে উঁচু আওয়াজে পড়তে লাগল। চেহারার পর্দার ব্যাপারে কোরআন-হাদিসের দলিলসমূহ–

অধ্যায় ১ / ৭

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন