পুরাণ কাহিনিতে মহিষাসুর

মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর ৮২ তম অংশের শুরুতে বলা হয়েছে দেবতা ও অসুরের শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ চলেছিল অসুরপতি মহিষাসুরের নেতৃত্বে।

দেবাসুরমভুদযুদ্ধং পূর্ণমব্দশতমপুরা।
মহিষেঽসুরাণামধিপে দেবানাঞ্চ পুরন্দরে।
তত্রাসুরৈমহাবীর্য্যে পরাজিতম্।
জিত্বা চ সকলানদেবানিদ্রোহত্।।

চণ্ডীতে দেবীর উদর তৈরি হচ্ছে ইন্দ্রের শক্তিতে, সুরাপ্রেমী ইন্দ্র, আসবাসক্তি যাঁর সর্বজনবিদিত, ফলত দেবী মদিরা পান করেন যুদ্ধের আগে দেবীর ঠোঁট দিয়ে ছিলেন শিবঠাকুর, দেবী সেই ঠোঁটে প্রকাণ্ড রব তুলে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। অসুর উপজাতির লোকেরা নাকি মহিষাসুরকে বলে হুদুড় দুর্গা বা বজ্রের মতো আওয়াজকারী, এই আওয়াজ উলুধ্বনিও হতে পারে অথবা ‘হর-হর’, যা হুদুড় শব্দে বোঝাবার চেষ্টা হতে পারে। শব্দ নিয়ে আলোচনা করতেই হবে কারণ যে-কোনো ভাষ্য উৎপাদিত হয় ভাষার মাঝে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের ফলে। যেমন মহিষাসুরের জন্ম কাহিনি—মহিষাসুরের পিতা রম্ভ নামে এক অসুর, মাতা ‘এক মহিষী’, মহিষী অর্থাৎ ভৈসা (!!) বা মোষ আর তাই মহিষাসুরের অর্ধেক শরীর মোষের আর অর্ধেক অসুরের! খাসা যুক্তি কিন্তু ইন্দ্রের মহিষী শচী বা দশরথের তিন মহিষীর গর্ভের চার সন্তান সকলেরই অর্ধেক শরীর মোষের হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে মহা ঈশ পত্নী মহিষী, ‘রাজপত্নী’ অর্থে দিব্য চলবে, অথচ মহিষাসুরের বেলায় হয়ে যাবে স্রেফ ভৈসা বা মোষ! দন্ত্য-স তালব্য-শ মূর্ধণ্য-ষ নিয়ে নিশ্চয়ই কিছু ভাট- ভাষ্য আছে যা আমি জানি না, তবে জানি সেগুলো এই একই অবস্থান থেকে তৈরি। ভারতীয় পুরাণের বিশেষত্ব এই যে সবসময় আগেরও আগে আছে, ব্রহ্মার বছর থেকে কল্প পার হয়ে সবকিছু সেই বিগ ব্যাং এর সময় নিয়ে যাওয়া হবে, তারও আগে জানতে চাইলে মডার্ন ফিজিক্স-এর মতোই মহাকালে চলে যাবে, সময় সৃষ্টির আগে এবং ব্রাহ্মদিন ব্রাহ্মরাত্রি পেরিয়ে (এক ব্রাহ্ম অহোরাত্রি ২×১০০০ চতুর্যুগ 2580000000 মানবর্ষ, দ্র পুরাণপ্রবেশ, পৌরাণিক কালগণনা, পৃ ২২) সৃষ্টি- স্থিতি-লয়ের গোল-গল্পে চলে যাবে, যেখানে আবার বিগ ব্যাং- এর পরে বিগ ক্রাঞ্চ এবং পুনরায় বিগ ব্যাং হয়! কারো বাবার ক্ষমতা নেই এই যুক্তিকে অংক কষে খণ্ডায়! আর এই বৃত্তকল্পই ভারতীয় ‘দর্শন-বিজ্ঞান’-এর সর্বোচ্চ আবিষ্কার যেখানে বাকি পৃথিবী অনেক পেছনে, সে ‘শূন্য’ ধারণা হোক কিংবা ‘পুনর্জন্ম’, এই আবিষ্কার লা-জবাব। মহাকাশ বিজ্ঞান হোক, প্রত্নতত্ত্ব হোক অথবা ইতিহাস, মূলত কিছু গল্পকথা যা অতি সংক্ষিপ্ত ধারণা আকারে মস্তিষ্কে সঞ্চিত হয়। সব উত্তর মিলিয়ে দেওয়া একান্ত ভারতীয় এই বৃত্তকল্প গোলগল্প পৃথিবীতে আর কেউ কখনও বানাতে পারেনি।

তো সেই আগেরও আগের গল্প হল মহিষাসুরের বাবা রম্ভের এক ভাই ছিল সে হল করম্ভ (জানি না কোথায় আছে, কিন্তু অবশ্যই রম্ভ ও করম্ভের বাবার নাম আরম্ভ হবে) দুজনে মিলে কঠোর তপস্যায় বসেছিলেন তাঁরা। একটুও নড়াচড়া না- করে সাধনা করবেন রঙ এই সংকল্প করেছিলেন। করম্ভ সাধনা করছিলেন জলের মাঝে বসে। দুই ভাই তপস্যার সিদ্ধিলাভ করলে তাঁর আসন টলে যাবে দেখে ইন্দ্র কুম্ভীররূপে নিরস্ত্র করম্ভকে হত্যা করেন। রম্ভ টের পেলেও তপস্যাভঙ্গ করেননি, তপস্যা শেষে রম্ভ শোকে আত্মহত্যা করতে গেলে অগ্নিদেব তাঁকে বর দেন তাঁর পুত্র ইন্দ্রকে পরাস্ত করতে সক্ষম হবে।

ওই আগেরও আগের গল্প রম্ভ-করম্ভ শব্দের মাঝেই আছে, রম্ভ শব্দের অর্থ শব্দ’, ‘বেণু’, ‘বানর বিশেষ’ করম্ভ শব্দের অর্থ ‘দধি জল’ বা ‘দধি জলের সহিত যা শব্দ করে’, ‘উদমন্থ’, ‘কর্দম’ (মেধাতিথি) তপ্ত (কুল্লুক) “করম্ভবালুকা তাপান” মনু ১২.৭৬। করম্ভক আবার বিবিধ ভাষায় গদ্য পদ্যময় কাব্য! কী জ্বালা!

রম্ভ-করম্ভ উভয়েই তপস্যা করছিল কারণ তাদের অতুলৈশ্বর্য সত্ত্বেও কোনো সন্তান ছিল না। তাঁরা সন্তানার্থে তপস্যা করছিলেন, চোখের পলক না ফেলে, নড়াচড়া না করে, কিছু না- খেয়ে, হাজার বর্ষ ধরে! (কে জানে কোন বর্ষ! দেববর্ষ তো বটেই দেবতার একদিন মানে মানুষের একবছর) উপরন্তু করম্ভ তপস্যা করছিলেন জলের তলায় বসে তাঁকে ইন্দ্র হত্যা করেন। (এইসব মহাগল্প যদি বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্বের মহাগল্পের সঙ্গে গুলিয়ে যায় তা-তে কাউকে দোষ দেওয়ার নেই। একমাত্র মহাগাম্বাট নাহলে ঘেঁটে যাওয়াই স্বাভাবিক।) সেই মহালয়ার শুরুতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যেমন বলে ওঠেন: নারায়ণ তখন যোগনিদ্রায়, তাঁর কর্ণমল থেকে উদ্ভূত হল মধু ও কৈটভ। তাঁরা নাভিপদ্মাসীন ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে, তাঁর কাতর আহ্বানে মহামায়া যোগনিদ্ৰা দেবী নারায়ণের শরীর হতে বহির্গত হলেন, বিষ্ণু জাগ্রত হয়ে সুদর্শন চক্র দ্বারা মধুকৈটভের মস্তক ছেদন করলেন, তাঁদের মেদ দ্বারা মেদিনী তৈরি। অতীব মজা এইখানে, কৈটভের স্ত্রী লিঙ্গান্তরে কৈটভী অর্থ দুর্গা, মধুবংশীয়রা হলেন মাধব যা কৃষ্ণের অপর নাম! মজা পেয়ে একটাই অক্ষর থাকবে ‘ঘ’, অবশ্যই ঘেঁটে গিয়ে। দেবী অপর এক রূপে হত্যা করেন দুই সহোদর দৈত্য শুম্ভ এবং নিশুম্ভকে। √শুম্ভূ অর্থাৎ হিংসা। ধরে নেয়া যাক সেটা শান্তি প্রতিষ্ঠায় তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপ। মহিষাসুরের ক্ষেত্রে ঘটনাটা হল, মহিষাসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করলে ইন্দ্র অন্য দেবতাদের নিয়ে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলেন এবং তাঁদের তেজ একত্রিত হয়ে চণ্ডী আবির্ভূতা হলেন। মহিষাসুর নাকি তার আগে অমরত্বের প্রার্থনা করে ব্রহ্মার কাছে সুকঠোর তপস্যা করেন, ব্রহ্মা বলেন অমরত্ব তো দেওয়া যাবে না, মৃত্যুর উপর শর্ত আরোপ করতে পারো। তখন নাকি মহিষাসুর কোনো পুরুষ তাঁকে হত্যা করতে পারবে না, এই বর প্রাপ্ত হন। যাবতীয় কাহিনিতে অসুরদের স্ট্রিক্ট মরালিটি’ দেখা যায়, যেখানে বল ছাড়া ছল বা কৌশলের স্থান নেই। ছল ও কৌশল ‘স্পেসিফিক্যালি’ দেবতাদের অস্ত্র। বিষ্ণুর প্রায় সব অবতার কাহিনি বিভিন্ন ছলনার গল্প। সেগুলি ছাড়াও সমুদ্রমন্থনের পর মেয়ে সেজে ‘সিডিউস’ করে অসুরদের বঞ্চিত করে অমৃত হরণের কাহিনি সর্বজনবিদিত। এমনকি ওই মধুকৈটভের গল্পটা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যেমন উচ্চারণ করেন পুরাণে আদৌ সেরকম নয় বহুদিন যুদ্ধ চলার পরেও বিষ্ণু তাঁদের কিছুই করতে পারেননি। বহুবর্ষ যুদ্ধের পর মধু-কৈটভ সমর্থ প্রতিদ্বন্দ্বী বিষ্ণুর সঙ্গে লড়াই করে খুশি হয়েছেন বলে তাঁকে বর দিতে চান। বিষ্ণু তখন বর চান যেন ওঁরা তাঁর হস্তেই মৃত্যুবরণ করেন, এবং সেই বর পাওয়া মাত্র বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দ্বারা মধুকৈটভের মস্তক ছেদন করেন! এটা অসুরদের বোকামির গল্প নাকি সত্যনিষ্ঠার মহানতার গল্প, সেকথা পাঠক তাঁর ব্যক্তি-মানসিকতার গঠন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত করবেন। রাক্ষসদের আসুরী মায়ার কথা শোনা যায়, যার বর্ণনা পড়লে বোঝা যায় সেটা ছলনা নয় স্রেফ ‘টেকনোলজিক্যাল এডভান্সমেন্ট’। অসুর নৈতিকতায় কোনো স্ত্রীলোকের গায়ে হাত তোলার প্রশ্নই ওঠে না। যেমনটা অনেক পরে মহাভারত-এ দেখি অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রাখলে ভীষ্ম অস্ত্র ত্যাগ করেন। দেবী দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী, কখনো অষ্টভুজা চতুর্ভুজা ষড়ভুজা কোথাও বা অষ্টাদশভুজা, এই সমস্তকে মেলানোর জন্য একটা গল্প ভাবাই যায়—দুর্গার স্বাভাবিক মহিলাদের মতোই দুটি হাত, তা নিরস্ত্র অর্থাৎ বরাভয় ও কমণ্ডলুধারী। পেছনে দেবতারা তাঁদের অস্ত্রগুলি নিয়ে—বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, বরুণের তিরধনুক, ইন্দ্রের বজ্র ইত্যাদি। খুব স্বাভাবিকভাবেই ত্রিভুবন অধীশ্বর মহিষাসুর কোনো নিরস্ত্র মহিলার প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করেননি। কোনো-কোনো পুরাণে আছে রূপে মুগ্ধ হয়ে মহিষাসুর দেবীকে বিবাহপ্রস্তাব করেছিলেন, দেবী বলেন যে-পুরুষ তাঁকে যুদ্ধে হারাতে পারবেন তাঁকেই বরমাল্য পরাবেন। নানারূপে যুদ্ধ করে শেষে মহিষরূপে যুদ্ধ করছিলেন মহিষাসুর, দেবীর সব অস্ত্র বিফল হলে তিনি মহিষাসুরের কাঁধে পা তুলে দেন। কণ্ঠে পরমাসুন্দরী দেবীর সুকোমল পদস্পর্শে মহিষাসুর বিবশ হয়ে গেছিলেন! তখন দেবী বর্শা দ্বারা তাঁকে বিদ্ধ করেন! আজব যুদ্ধ বর্ণনা! অসুর উপজাতির হুদুড় দুর্গার মৃত্যু বিবরণের সঙ্গে কোথাও একটা মিলে যায় যেন! চণ্ডী বর্ণিত যুদ্ধ বিবরণে যাওয়ার আগে উল্লেখ্য বাঙালি দুর্গার হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু কিন্তু সেই শৈবাস্ত্ৰ ত্রিশূলে। বিষ্ণুপন্থীদের শিবের অস্ত্র ত্রিশূল ব্যবহারের পলিটিক্স এখনো দেখা যায়, নইলে রামমন্দির নির্মাণের ধুয়ো তুলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ত্রিশূল বিলি করবে কেন! তিরধনুক দিতে পারত। ‘জয় শ্রীরাম’-এর সঙ্গে ‘হর হর মহাদেব’ স্লোগান উঠবে কেন শৈব ব্রাহ্মণ রাবণকে অন্যায় যুদ্ধে হত্যাকারী রামের মন্দির বানাবার প্রজেক্টে! (রাবণের মৃত্যুবাণ চুরি করা হয়েছিল মন্দোদরীকে ঠকিয়ে—কৃত্তিবাস)। যাইহোক ইন্দ্ৰদেবকে পরাজিত করতে পারবে এমন পুত্রের বর প্রদান করার পর অগ্নিদেব রম্ভের চারিধারে এক অগ্নিবলয় রচনা করেন, যে স্ত্রী এই অগ্নিবলয়ে প্রবেশ করবে সে তৎক্ষণাৎ গর্ভবতী হবে এবং রম্ভের অভীপ্সা পূর্ণ হবে। রম্ভের হুঙ্কারে আশেপাশের সব প্রাণী ভয় পেয়ে পালাতে থাকে কিন্তু এক মহিষী সেই অগ্নিবলয়ে প্রবিষ্ট হয় এবং গর্ভবতী হয়। তখন এক মহিষ এসে সেই মহিষীকে আক্রমণ করে, রম্ভ সেই আক্রমণ সহ্য করতে না-পেরে নিহত হন, সেই মহিষীও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তখন সেই মহিষীর পেট ফেঁড়ে এক সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, যার অর্ধ শরীর মহিষের। গল্পের শেষাংশ থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব, ওই মহিষী রম্ভের মহিষী ছিলেন না ছিলেন ওই আক্রমণকারী মহিষের মহিষী এবং তিনি কাণ্ড দেখে পুরোপুরি মানুষিক আচরণ করেন একজন সাধারণ পুরুষ মানুষের মতো। মহিষ ও মহিষী-র শব্দ ব্যাখ্যা পরে জানতে চেষ্টা করব, আপাতত মহিষাসুরের অর্ধেক মহিষ হওয়ার গল্পটার সিধে ব্যাখ্যা এরকম দেওয়া যায়—একটি জঙ্গল- সম্পৃক্ত জনজাতি যারা মহিষের পিঠে চেপে ঘোরাঘুরি, এমনকি যুদ্ধও করত, (আমি ধরে নিচ্ছি কিন্নরদের অর্ধেক শরীর ঘোড়ার মতো, এটার অর্থ তারা প্রায় সর্বক্ষণ ঘোড়ায় চড়ে থাকত) এবং পরবর্তীকালে হয়তো এরাই তথাকথিত ‘রাক্ষস’ হয়ে উঠছিল কারণ মহিষ নামক প্রাণীটির ওপর নির্ভরশীলতা থাকলে প্রচুর জলাভূমির প্রয়োজন হয়, সেজন্য তারা জল বা অসু রক্ষা করতে চেয়েছিল, তাই তাদের নাম হলো রাক্ষস। এই ‘রক্ষা করিব’ থেকে রাক্ষস হয়ে ওঠার গল্পের আরেকটা ভারসন আছে—সৃষ্টি কালে ব্রহ্মা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় যেসব সৃষ্টি করেন, তারা অন্ধকারে বিকৃত ক্ষুধার্ত রূপেই সৃষ্ট হয়। তারা ক্ষুধার্ত হয়ে ব্রহ্মাকে ভক্ষণ করতে উদ্যত হয়। একদল তাঁকে রক্ষা করতে চায়, যারা ভক্ষণ করতে চেয়েছিল তারা হল যক্ষ আর যারা রক্ষা করতে চেয়েছিল তারা হল রাক্ষস। যক্ষরা ছিল কুবেরের অনুচর। সে অর্থে যাঁরা এখন জল-জঙ্গল-জলাভূমি রক্ষার বা সংরক্ষণের কথা বলেন, আজকের পৃথিবীর কুবেরের অনুচরদের কাছে (মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেটস) তাঁরা সবাই রাক্ষস। যেমন মনিরত্নমের ছবিতে রাবণ অভিষেক বচ্চন ছিলেন মাওবাদী রাক্ষস। প্রায় ওই একই কারণে রাবণও রাক্ষস, তিনি তাঁর দাদা কুবেরকে তার সকল অনুচর সমেত লঙ্কা থেকে বিতাড়িত করেন এবং প্রসিদ্ধ পুষ্পক রথটি কেড়ে নেন। কুবের তখন তাঁর ধনরত্ন নিয়ে দেবতাদের আশ্রয়ে গিয়ে তাদের খাজাঞ্চি হন এবং দেবতা স্তরে উন্নীত হন। ঠিক আমাদের কলকাতায় ইংরেজ রাজত্বের দেওয়ান ও দালালদের রাজা উপাধিপ্রাপ্ত হয়ে হেব্বি বনেদি রাজবাড়ি হাঁকাবার মতো। যাইহোক বিভিন্ন পুরাণে পূর্বে স্বকৃত নজরটানে হাবুডুবু খেয়ে অবশেষে অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌরাণিকী অভিধানের সহায়তায় মহিষাসুরের গল্পটাকে মিলিয়ে মিশিয়ে বললে মোটামুটি যা দাঁড়ায়, সেটা এইরকম—দনুর ছেলে, রম্ভ ও করম্ভ। অপুত্রক দুই ভাই। সন্তান কামনায় রম্ভ পঞ্চাগ্নি জ্বেলে এবং করম্ভ জলে নেমে কঠোর তপস্যা করছিলেন। ইন্দ্র ভয়ে কুমির হয়ে এসে করম্ভকে খেয়ে ফেলেন। তপস্যায় কোনো ফল হচ্ছে না দেখে রম্ভ শেষ পর্যন্ত আগুনে নিজের মাথা কেটে আত্মাহুতি দিতে যান। অপর মতে ভাইয়ের শোকে প্রাণ বিসর্জন দিতে যান। অগ্নি/মহাদেব রম্ভকে বারণ করেন রক্ত ত্রৈলোক্য বিজয়ী এবং অগ্নির চেয়ে ভাস্বর একটি ছেলে চান এবং অগ্নি বর দেন। রক্ত বর পেয়ে বাড়ি ফেরার পথে অন্য মতে যক্ষদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যক্ষদের দেশে অল্প বয়সি/ তিন বছর বয়সি একটি ঋতুমতী মহিষ দেখতে পান ও ভোগ করেন। অন্য মতে বিয়ে করেন। গর্ভবতী হলে স্ত্রীকে নিয়ে রম্ভ পাতালে চলে যান যাতে অন্য মহিষ আক্রমণ করতে না-পারে। কিন্তু পাতালে অন্যান্য দানবরা মহিষীর সঙ্গে বাস করতে দেখে রম্ভকে তাড়িয়ে দেন। রম্ভ তখন আবার যক্ষমণ্ডলে ফিরে আসেন। যথা সময়ে একটি ছেলে হয় এই ছেলে বিখ্যাত মহিষাসুর। ইতিমধ্যে একটি মহিষ এই মহিষীটির প্রণয়াসক্ত হয়ে রম্ভকে একদিন আক্রমণ করে হত্যা করে। রম্ভের স্ত্রী তখন যক্ষদের আশ্রয় নেন। মহিষটি হতাশ হয়ে জলে প্রাণ বিসর্জন করে বিখ্যাত নমর হয়ে জন্মান। রম্ভের দেহ সৎকার করা হয় এবং রম্ভের স্ত্রী সহমৃতা হন এবং রম্ভর জ্বলন্ত চিতা থেকে মহিষাসুর বার হয়ে আসেন। রম্ভও তখন পুত্রস্নেহে রূপান্তরিত হয়ে উঠে আসেন এবং নাম হয় রক্তবীজ। তিনি শিবের কাছে বর পান যুদ্ধে তাঁর প্রতিটি ভূপতিত রক্তবিন্দু থেকে সমান শক্তিশালী আর একটি রক্তবীজ জন্মে যুদ্ধ করবে। রক্তবীজ সমস্ত যক্ষদের তাড়িয়ে দেন এবং সমস্ত মহিষদের হত্যা করেন। রম্ভের ছেলে মহিষাসুর রাজা হন। রক্তবীজ পরে শুম্ভ নিশুম্ভের সেনাপতি হয়েছিলেন।

মহিষাসুর নিজের রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত করে স্বর্গ জয় করার জন্য দূত পাঠিয়ে ইন্দ্রকে পরাজয় স্বীকার করতে বলেন। ইন্দ্র অবজ্ঞায় দূতকে ফিরিয়ে দিয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর তিন জনের সঙ্গে পরামর্শ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। তীব্র যুদ্ধ হয়। বিষ্ণু ও মহাদেবও যুদ্ধ করেন। তবু দেবতারা হেরে যান। মহিষাসুর তখন কয়েক শতাব্দী ধরে স্বর্গে রাজত্ব করতে থাকেন। রক্তবীজ, চণ্ডমুণ্ড ইত্যাদি এসে মিলিত হন। মহিষাসুরের প্রধানমন্ত্রী হন অসিলোমা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী চিক্ষুর, বিদেশ মন্ত্রী বিড়াল, অর্থমন্ত্রী তাম্র, সেনাপতি উদক, শিক্ষামন্ত্রী শুক্রাচার্য। দুর্দান্ত মহিষাসুরকে বামুনরাও যজ্ঞভাগ দিতে থাকেন। দেবতাদের ক্রমান্বয়ে নিপীড়ন করতে থাকলে দেবতারা আবার ব্রহ্মা ও শিবকে নিয়ে বিষ্ণুর কাছে আসেন। বিষ্ণু বলেন ব্রহ্মারই বরে এই অসুর অবধ্য।

মহিষমর্দিনী তখন বিন্ধ্যপর্বতে অবস্থান করছিলেন। মহিষাসুর এঁকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করার জন্য দুন্দুভিকে দূত পাঠান। দূত দেবীর কাছে তিরস্কৃত হয়ে ফিরে এসে জানায় দেবী বীর্যশুল্কা। মহিষাসুর তখন সসৈন্যে এগিয়ে আসেন। দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর সবশেষে মহিষাসুর সরাসরি যুদ্ধে আসেন। মহিষাসুর নানা মূর্তি ধরে দেবীকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেন এবং শেষকালে মহিষরূপ ধরে আক্রমণ করলে দুর্গা তাঁর সমস্ত অস্ত্ৰ প্ৰয়োগ করেও কিছু করতে পারেন না। দুর্গা তখন মহিষাসুরের কাঁধে এক পা দিয়ে চেপে ধরেন। পদস্পর্শে অসুর মুক্তির স্বাদ পেয়ে অবসন্ন হয়ে পড়েন দুর্গা এই সময় বর্শা বিদ্ধ করে এঁকে নিহত করেন। চিক্ষুর, অসিলোমা, তাম্র, দুর্মুখ, বাঞ্চল, বিড়াল ইত্যাদিও নিহত হন। মহিষাসুর তিনবার জন্মেছিলেন। প্রথমবার উগ্রচণ্ডা, দ্বিতীয়বারে ভদ্রকালী ও তৃতীয়বারে দুর্গা তাঁকে নিহত করেন।

অপরমতে বিপন্ন দেবতারা বিষ্ণুর শরণ নিলে বিষ্ণু বলেন ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য। দেবতাদের তেজ মিলিত হয়ে যে দেবীকে সৃষ্টি করবে তিনিই এই অসুরকে মারতে পারবেন। অসুরদের অত্যাচারে ক্রুদ্ধ দেবতাদের মুখ থেকে তখন একটি করে জ্যোতি বার হতে থাকে এই সব জ্যোতি মিলিত হয়ে মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে আসে, মহর্ষির তেজও মিলিত হয়। এই মিলিত তেজ কালীর পরিত্যক্ত চর্মের খোলসের মধ্যে প্রবেশ করে দেবী কাত্যায়নী রূপে প্রকাশিত হন। ইনি অষ্টাদশভুজা। বিভিন্ন দেবতার তেজে এঁর বিভিন্ন অঙ্গ গঠন। মহাদেব এঁকে ত্রিশূল, বরুণ শঙ্খ, অগ্নি শতঘ্নী, পবন তৃণ ও ধনু, ইন্দ্র বজ্র, যম দণ্ড, ব্রহ্মা কমণ্ডলু ও অন্য দেবতারা নানা অস্ত্র ও আভরণ দেন। এই ভাবে সজ্জিত দেবী হুঙ্কার দিয়ে উঠলে অগস্ত্য এঁর নাম দেন দুর্গা। দুর্গা তখন সিংহের পিঠে চড়ে বিন্ধ্যপর্বতে চলে যান।

এই দেবী মহিষাসুরকে তিনবার বধ করে ছিলেন প্রথমবার অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে দ্বিতীয়বার ষোড়শভুজা ভদ্রকালী ও তৃতীয়বার দশভুজা দুর্গা রূপে। স্বপ্নে ভদ্রকালীর মূর্তি দেখে মহিষাসুর এই মূর্তির আরাধনা করেছিলেন। দেবী দেখা দিলে মহিষাসুর জানান মৃত্যুতে তিনি ভীত নন, তিনি চান দেবীর সঙ্গে তিনিও যেন পূজিত হন। দেবী বর দিয়েছিলেন উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী বা দুর্গা, তিন মূর্তিতেই অসুর তাঁর পদলগ্ন থাকবেন এবং দেবতা, রাক্ষস ও মানুষের পূজ্য হবেন।

স্কন্দপুরাণে দুর্গ দৈত্যকে নিহত করে দেবী দুর্গা নামে খ্যাত হন। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী বলেছেন দুর্গ অসুরকে বধ করে তিনি দুর্গা নামে পরিচিত হবেন। দেবী ভাগবতে হিরণ্যাক্ষ বংশে জন্ম দুর্গাসুর বধ কাহিনি বিস্তারিতভাবে আছে। স্কন্দপুরাণে কাশীখণ্ডে রুরু দৈত্যের পুত্র দুর্গাসুরের কাহিনি রয়েছে।

স্কন্দপুরাণে ইনি দেবী বৈষ্ণবী। পৌরাণিক বহু কাহিনিতে বিষ্ণু ও কৃষ্ণের সঙ্গেও দুর্গা যুক্ত রয়েছেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী=চণ্ডী=অম্বিকা, দুর্গা ইত্যাদি নাম আছে। কিন্তু তিনি পর্বতবাসিনী, পর্বতকন্যা নন। হরিবংশে অনিরুদ্ধ বন্দি হলে দুর্গা শব্দ (২১২০।৩৫) ব্যবহৃত হয়েছে। হরিবংশে আর্যা স্তোত্রেও বলা হয়েছে ‘যশোদাগর্ভসম্ভূতানন্দগোপকুলে জাত’। মার্কণ্ডেয় পুরাণে ইনি বৈষ্ণবী শক্তি। বৃহৎসংহিতাতে ইনি একানংশা কৃষ্ণ বলরামের মাঝখানে অবস্থিত। দেবীপুরাণ-এ মত্তদিগজের পিঠে বসে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। দেবীপুরাণ-এ দুর্গে বিরাজমানা এবং দেবী ভাগবতে নগরপালিকা বলা হয়েছে। স্কন্দপুরাণে কাশী রক্ষার নিমিত্ত মহাদেব নন্দীকে প্রতি দুর্গে দুর্গাপ্রতিমা স্থাপন করতে বলেন। চাণক্য বলেছেন প্রতি দুর্গে দেবতাদের সঙ্গে অপরাজিতাকেও স্থাপন করতে হবে এবং এই অপরাজিতা পণ্ডিতদের মতে দেবী দুর্গা।

দুর্গাপূজা স্বায়ম্ভব মন্বন্তরে (কালিকা ৬০।৩৯) রাতেই ব্রহ্মণা বোধিতা দেবী, দেবতারা তারপর পূজা করেন। আশ্বিনে শুক্লা অষ্টমী দুর্গা অষ্টমী নবমীতে রাবণ নিহত ( ৬০।৩০)। দেবী অদৃশ্যভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। স্বারোচিষ মন্বন্তরে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য মূর্তি গড়ে তিনবছর দেবীর পূজা করেছিলেন। ত্রেতা যুগে রাবণ চৈত্রমাসে এঁর পূজা (বাসন্তী পূজা) করতেন। রাবণবধের জন্য রামচন্দ্র অকালে এঁর শারদীয়া পূজা করেন বাল্মীকি রামায়ণ-এ কিন্তু এ ঘটনাটি নেই। অবশ্য কৃত্তিবাসের রামায়ণ রচনার সময় মনে হয় বাসন্তীপূজা অধিক প্রচলিত ছিল। শারদীয়া পূজা তখনও চালু হয়নি। বাল্মীকি রামায়ণ-এ রাবণবধ ঠিক শরৎকালে হয়নি। দেবীভাগবতে ও বৃহদ্ধর্মপুরাণে রাম শরৎকালে পূজা করে রাবণবধ করেন। ফলে কৃত্তিবাসও শরৎকালে রামকে দিয়ে পূজা করান। বিষ্ণুযামলে আছে শরতে ঘরে ঘরে দুর্গাপূজা। মার্কণ্ডেয় পুরাণে (৯২।১১) দেবী বলেছেন শরৎকালে পূজা করতে হবে।

দুর্গা বা চণ্ডীকে বহু স্থানে গোধাসনা দেখা যায়। গোধিকা বা গোধা মানে গোসাপ। প্রাচীন বিদিশার অদূরে উদয়গিরি গুহাতে আঠেরো হাত দুর্গার মূর্তি আছে এটি খ্রিস্টীয় ৫-শতকে খোদিত দেবী ওপরের দু-হাত দিয়ে একটি গোধা ধারণ করে আছেন। দুর্গার এটি প্রাচীনতম মূর্তি। কলিকাতা জাদুঘরে খ্রিস্টীয় ১২ শতকে নির্মিত গোধাসনা চণ্ডীমূর্তি আছে। গোধাবাহনা চণ্ডীর বহুমূর্তি পাওয়া গেছে। জৈন মূর্তি শিল্পে গোধাবাহন গৌরীর উল্লেখ আছে। কালিকাপুরাণে চণ্ডিকার কাছে গোধিকা বলি দেওয়া হবে বলা হয়েছে। বৌদ্ধশাস্ত্র মহাবস্তুতে গোধাজাতক রয়েছে। তন্ত্রসার-এ বর্ণিত দুর্গা ও মহিষমর্দিনী আধুনিক দুর্গা প্রতিমা থেকে আলাদা। মহিষমর্দিনী প্রতিমা তামিলনাড়ুতে বর্তমানে প্রচলিত। বঙ্গদেশে বর্তমানে পূজিত প্রতিমা কাত্যায়নী মূর্তি।

ব্রহ্মযামলে আছে ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’। খ্রিস্টীয় ১৪ শতক থেকে দুর্গাপূজার বিধান বাংলাতে কিছু-কিছু গ্রন্থে পাওয়া যায় তবে মনে করা হয় খ্রিস্টীয় ১২-১৩ শতক থেকে বাংলাতে পূজা চালু হয়েছিল। বিহারের কিছু কিছু অংশে এবং বাংলা ও অসমে দুর্গাপূজা হয়। ভারতে অন্যত্র নবরাত্রি ইত্যাদি ব্রত। এই পূজা মূলত উৎসব ভিত্তিক। রাজারা ও জমিদাররা নিজেদের আভিজাত্যের ও ঐশ্বর্যের প্রমাণ হিসাবে দুর্গাপূজা করতেন। এটি শক্তি পূজা। তবে বামাচারী পূজা নয়। কিন্তু তবু তন্ত্রের ছাপ বহুস্থানে রয়ে গেছে। যেমন প্রতিমা বিসর্জনের সময় বলা হয়েছে, ‘ভগলিঙ্গাভিধানৈশ্চ ভগলিঙ্গপ্রগীতকৈঃ ভগলিঙ্গাদিশব্দৈশ্চ ক্রীড়য়েয়ুঃ অলং জনাঃ’ (কালিকা ৬১।২১)। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ আছে। তন্ত্র ও পুরাণে বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি রয়েছে। দুর্গা, মহিষমর্দিনী, শূলিনী, জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা ইত্যাদি বহু নামে এঁর পূজা হয়। তন্ত্রে ইনি চতুর্ভুজা, সিংহস্থা, মরকতবর্ণা। পুরাণ অনুসারে বাংলায় অতসী পুষ্প বর্ণা ইত্যাদি। আশ্বিনে শুক্লপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্রে শুক্লপক্ষে বাসন্তী পূজা এই দুর্গার পূজা।

ভদ্রকালী ভগবতীর একটি রূপ। মহিষাসুর একবার স্বপ্ন দেখেন দেবী তাঁর মাথা কেটে রক্ত পান করছেন। ফলে দেবীকে সন্তুষ্ট করবার জন্য দেবীর পূজা করেন এবং দেবী সন্তুষ্ট হয়ে দেখা দিলে মহিষাসুর জানান ক্যাতায়ন মুনির শিষ্য রৌদ্রাশ্ব যখন হিমালয়ে তপস্যা করছিলেন সেই সময় মহিষাসুর মেয়ের রূপ ধরে তাঁর তপস্যাভঙ্গ করেছিলেন। কাত্যায়ন ফলে রেগে যান এবং শাপ দেন মেয়েমানুষের হাতেই মহিষাসুর মারা যাবেন। মহিষাসুর আরও বলেন, তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর সময় হয়ে এসেছে। তাই যজ্ঞভাগের অধিকারী হওয়ার জন্য এবং দেবীর পদসেবক হয়ে থাকতে পারার বর চান। ভদ্রকালী বোঝান যজ্ঞভাগ দেবতারা ভাগ করে নিয়েছেন। তবে মহিষাসুর মারা গেলেও দুর্গা, উগ্রচণ্ডা ও ভদ্রকালীর পায়ে সে বিলগ্ন থাকবে এবং দেবীদের সঙ্গে সে-ও পূজা পাবে।

কাত্যায়নী ভগবতী মূর্তি। কাত্যায়নের শাপের কারণে ব্রহ্মাদি দেবতাদের নিজ-নিজ দেহ থেকে তেজ বার হয়ে এই তেজ মিলিত হয়ে এই দেবীর সৃষ্টি হয়। কাত্যায়ন এঁর প্রথম পূজা করেন বলে নাম কাত্যায়নী। দশভুজা সিংহবাহিনী। আশ্বিনে কৃষ্ণা চতুর্দশীতে বোধিত হন সপ্তমীতে দেবতেজে আকার গ্রহণ অষ্টমীতে অলংকৃত, নবমীতে মহিষাসুরকে বধ। বৃহদ্ধর্মপুরাণে ব্রহ্মা আশ্বিনে কৃষ্ণা নবমীতে বোধন করে ছিলেন। দেবীর বরে কৃষ্ণা নবমীতে কুম্ভকর্ণ, এয়োদশীতে লক্ষ্মণের হাতে অতিকায়, অমাবস্যা রাত্রিতে মেঘনাদ, প্রতিপদে যমরাক্ষ, দ্বিতীয়াতে দেবাত্মক নিহত হন। সপ্তমীতে দেবী রামের অস্ত্রে প্রবেশ করেন, অষ্টমীতে রামরাবণের যুদ্ধ। অষ্টমী নবমী সন্ধিতে রাবণের মাথা সাময়িকভাবে ছিন্ন হয়, নবমীতে নিহত হয়। কাত্যায়নী দশভুজা হরিবংশে অষ্টাদশভুজা। কাদম্বরী ও ভাগবত ইত্যাদিতে উল্লেখ আছে। একটি মতে কাত্যায়নের শাপের কারণে দেবীর উদ্ভব দেবতাদের মিলিত তেজমূর্তি! কাত্যায়ন প্রথম পূজা করেছিলেন বলে নাম হয় কাত্যায়নী। হরিবংশে দেবীকে কিরাতী চীনবসনা চৌরসেনানমকতাম্ বলা হয়েছে বনে ও উপবনে থাকেন শবরপুলিন্দববরে অভিপূজিতা। সারদা তিলকে পুলিন্দ কন্যা। নারদ পঞ্চরাত্রে কিরাতিনী বেশ। কথাসরিৎসাগর-এর গল্পে এর নমুনা পাওয়া যায়।

কুষাণ সম্রাট হুবিষ্কের মুদ্রায় ঈশ ও ননা মূর্তি রয়েছে। গুপ্তযুগে (খ্রিস্টীয় ৪-৫ শতকে) মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি প্রচলিত হয়েছিল। ভিলসার নিকট উদয়গিরিতে বরাহ-গুহাতে খ্রিস্টীয় ৫-শতকে নির্মিত দ্বাদশভুজা মূর্তি রয়েছে দেবী শূলের দ্বারা মহিষাকৃতি একটি অসুরকে বধ করছেন। দেবীর দু-হাতে গোধা। মার্কণ্ডেয় পুরাণ খ্রিস্টীয় ৫-শতকে রচিত। খ্রিস্টীয় ১১ শতকে ভবদেব ভট্ট দুর্গাপূজা পদ্ধতি রচনা করেছিলেন। দুর্গাপূজাটি কাত্যায়নী পূজা।

উগ্রচণ্ডা আশ্বিন মাসে কৃষ্ণা নবমীতে কোটি যোগিনীর সঙ্গে প্রথমে আবির্ভূত হয়ে অষ্টাদশভুজা দেবী মহিষাসুরের প্রথম মূর্তি বিনাশ করেন। দক্ষ যজ্ঞে সতী দেহ ত্যাগ করে উগ্রচণ্ডা রূপ নিয়ে কোটি যোগিনীসহ শিবের সঙ্গে যোগ দিয়ে যজ্ঞ নষ্ট করেন। কালিকাপুরাণে কাত্যায়নীই উগ্রচণ্ডার রূপ ধারণ করেন। আবার দুর্গার অষ্টনায়িকার মধ্যেও একজন। কালিকাপুরাণে প্রথম সৃষ্টিতে উগ্রচণ্ডা, দ্বিতীয় সৃষ্টিতে ভদ্রকালী এবং তৃতীয় সৃষ্টিতে দুর্গারূপে মহিষাসুরকে বধ করেন। ভিন্নাঞ্জন সদৃশা, সিংহবাহিনী (কালিকা ৬০।১২৪)। এঁর অষ্টযোগিনী— কৌশিকী, শিবদূতী, উমা, হৈমবতী, ঈশ্বরী, শাকম্ভরী, দুর্গা ও মহোদরী (কালিকা ৬১।৪১ )।

চণ্ডী শিবের শক্তি। অন্য নাম চণ্ডিকা অর্থাৎ প্রচণ্ডা। মার্কণ্ডেয় পুরাণে মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবতারা ক্রুদ্ধ হলে এদের মুখ থেকে তেজ বার হতে থাকে এবং এই সব তেজ মিলিত হয়ে শিবের তেজে মুখ, বিষ্ণুর তেজে বাহু, ব্রহ্মার তেজে পায়ের পাতা, চন্দ্রর তেজে স্তন ইত্যাদি পূর্ণাবয়ব মূর্তি দেখা দেয়। দেবতারা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র থেকে অস্ত্র এবং হিমালয় সিংহ দেন। শুম্ভ, নিশুম্ভ বধের পূর্বে দেবতাদের স্তবে প্রীত হলে দেবীর দেহ থেকে যিনি বার হয়ে আসেন তিনি কৌশিকী এবং অবশিষ্ট অংশ যা পড়ে রইল তিনি কালিকা, হিমালয়ে আশ্রয় নেন। চণ্ডিকা পার্বতীর উগ্রমূর্তি। অনেক সময় ২০, ১০ বা ১২টি হাতও দেখা যায়।

দেবী ভাগবতে মহিষাসুর বধের জন্য ব্রহ্মা এসেছিলেন মহাদেবের কাছে। ব্রহ্মার বর ছিল নারীর হাতে মৃত্যু। শিব চিন্তায় পড়েন। বিষ্ণু প্রস্তাব দেন সকলের তেজ থেকে এক জন দেবী তৈরি হোক। দেবী ভাগবতে এই আবির্ভূতা দেবীর নাম মহালক্ষ্মী বামন পুরাণে ইনি কাত্যায়নী। দেবতাদের তেজ কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে এসে রূপ নিয়েছিল বলে এই নাম। এই কাত্যায়নী শিবের কেউ নন। তবে মহিষাসুর বধের পর দেবতারা ও সিদ্ধরা স্তব করেন এবং দেবী তখন হরপাদমূলে প্রবেশ করেন। বামন পুরাণেও কাত্যায়নী এই ভাবে রূপ পান। কালিকাপুরাণে এই কাহিনি একটু বদলায় দেবতাদের তেজে ধৃত বপুঃ এবং কাত্যায়নেন সন্ধুক্ষিতা (কালি ৬০।৭৭)। অর্থাৎ কাত্যায়ন যেন তিলোত্তমার মতো কাউকে সৃষ্টি করলেন। অর্থাৎ চণ্ডী কাত্যায়নী।

মার্কণ্ডেয়পুরাণে চণ্ডীর দেহ থেকে ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী ইত্যাদি শক্তি বার হয়ে শুম্ভ-দৈত্য বধে সাহায্য করেন। এই সব দেবীর সাহায্য নেওয়ার জন্য শুন্তু বিদ্রূপ করলে দেবীরা সকলে আবার চণ্ডীর স্তনে লীন হয়ে যান। মার্কণ্ডেয়পুরাণে ও বামনপুরাণে রক্তবীজ বধের সময় দেবীর মুখ থেকে ব্ৰহ্মাণী, কৌমারী ইত্যাদি দেখা দেন। দেবীর বর্ণনায় চার হাত, অক্ষমালা, কমণ্ডলু, রত্নকলস, ও পুস্তক হাতে মূর্তিও দেখা যায়। মহিষাসুর বধের সময় চণ্ডী পপৌ পুনঃ পুনশ্চৈব।

শুম্ভ নিশুম্ভকে যিনি বধ করেন তাঁকে কেবল হিমালয়বাসিনী বলা হয়েছে। তিন জনেরই শিবের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম দেবী বিষ্ণুর যোগনিদ্রা, মহামায়া দ্বিতীয় দেবী দেবগণের তথা শিবের তেজ থেকে উৎপন্ন। তৃতীয় দেবীর সম্বন্ধে বলা আছে দেবতারা হিমালয়ে এসে ‘বিষ্ণুমায়াং প্রতুষ্টঃ”। সকলেই এঁরা শিবের সঙ্গে সম্পর্কহীন। এ ছাড়াও আছে শিব এই দেবীর দূত হয়ে শুম্ভ নিশুম্ভের কাছে গিয়েছিলেন ফলে দেবীর নাম শিবদূতী (চণ্ডী ৮।২৭)। চণ্ডীতে দেবী স্বতন্ত্রা-মূলদেবী তবে কিছুটা বিষ্ণু আশ্রিতা। দেবীভাগবতে ইনি পরমেশ্বরী, জননী সর্বদেবানাং ব্রহ্মাদীনাং তথেশ্বরী ১।১৫।৩৪)। চণ্ডী-তে ইনি কোথাও শিবমায়া বা শিবশক্তি নন। সবসময় সিংহবাহিনী, আট বা দশভুজা।

শিখগুরু গোবিন্দ সিং-এর চণ্ডীগীতি বলে একটি রচনা আছে। ইনি উজ্জয়িনীর রাজকন্যা। পরে সেই রাজ্যের শাসক। ইন্দ্র এসে এঁর কাছে সাহায্য চান। ইনি বাঘের পিঠে চড়ে অসুর বিনাশ করেছিলেন।

চামুণ্ডা মার্কণ্ডেয়পুরাণে চণ্ডমুণ্ডকে নিহত করে এদের মুণ্ড নিয়ে কালী অট্টহাস করলে চণ্ডী কালীকে এই নাম দিয়েছিলেন। চণ্ডমুণ্ড তাদের সৈন্যদল নিয়ে দেবীকে আক্রমণ করলে দেবী বার হয়ে আসেন দুর্গার কপাল থেকে। রক্তবীজ অসুরের প্রতি রক্ত বিন্দু মাটিতে পড়লে সেই বিন্দু সমান শক্তিমান আর একটি অসুরে পরিণত হত। যুদ্ধে আহত রক্তবীজের রক্ত যাতে মাটিতে পড়তে না পারে সেই জন্য এই দেবী রক্তবীজের দেহ নির্গত রক্ত পান করতে থাকেন। রক্তবীজ এইভাবে অন্য অসুরের জন্ম দিতে না-পেরে মারা যান।

চামুণ্ডা কালো, করালবদনা, গায়ের চামড়া দড়িপাকান, ভীষণ দেখতে বিরাট মুখ, লকলকে জিব, এবং লাল, কোটরাগত চোখ, পরণে বাঘছাল, গলায় মুণ্ডমালা। অস্ত্র হচ্ছে অসি, পাশ ও খটাঙ্গ। তন্ত্রসারে বাঁ-হাতে পাশ ও নরমুণ্ড, ডানহাতে বজ্র ও খট্টাঙ্গ। মুখমণ্ডল সুন্দর ও কোটি দাঁত। মাথায় চুল পিঙ্গল, বাহন শব। শুষ্কমাংসাতি ভৈরবা বা নির্মাংসা এবং দ্বীপিচর্মধরা। কালী কিন্তু সাধারণ সুস্থ চেহারা। চামুণ্ডার বিভিন্ন মূর্তি রুদ্রচর্চিকা, রুদ্রচামুণ্ডা, সিদ্ধচামুণ্ডা, সিদ্ধ যোগেশ্বরী, রূপবিদ্যা-ভৈরবী, ক্ষমা ইত্যাদি। বামন পুরাণে রুরু দানবের চর্ম (বর্ম) ও মুণ্ড কালী ছেদন করে চামুণ্ডা নাম পান। বিভিন্ন পুরাণ মতে মাতৃকারা সাত, আট বা নয়। মাতৃকাদের নাম ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, ইন্দ্রাণী, চামুণ্ডা, শিবদূতী ও নারসিংহী। অর্থাৎ চামুণ্ডা একজন মাতৃকা। অগ্নিপুরাণে মাতৃকাদের নাম চামুণ্ডা ব্রহ্মাণী, চামুণ্ডা মাহেশ্বরী ইত্যাদি, এখানে চামুণ্ডা একক নাম নেই। চামুণ্ডাকে অনেক জায়গায় যমের শক্তি যামী বলা হয়। আবার শিবের ঘোর রূপ ভৈরবের শক্তিকেও চামুণ্ডা বলা হয়। ব্রহ্মাণী ইত্যাদি যেমন ব্রহ্মা ইত্যাদির শক্তি। বাজসনেয়সংহিতায় মনোজবা মনে হয় মুণ্ডকোপনিষদের যমের পত্নী যামী এবং ইনিই চামুণ্ডা। মনোজবাকে চামুণ্ডা ধরলে খ্রিস্টপূর্ব সময়ের দেবী। মনে হয় চামুণ্ডা ও দেবীর বিভিন্ন রূপের অনেকগুলি রূপ প্রাগ-আর্যদের কাছ থেকে এসে তথাকথিত আর্য ধর্মের সঙ্গে মিশেছে। চামুণ্ডা, ব্রহ্মাণী, কালিকা ইত্যাদি দেবীকে ফল শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীও মনে করা হয় এবং চামুণ্ডা মানকচুর দেবী। এই দৃষ্টিভঙ্গিও প্রাক্-আর্য জাতির কাছ থেকে পাওয়া। চামুণ্ডার পূজা একদিন সারা ভারতে ছড়িয়েছিল। ওড়িশার যাজপুরে প্রাচীন বিরজা ক্ষেত্রে আবিষ্কৃত মূর্তি ও ভুবনেশ্বরের বৈতাল দেউলে চামুণ্ডার ভয়ংকর মূর্তিটির চার হাত, অস্থিসার, মুণ্ডমালা, শবাসন। শবের হাত অঞ্জলিবদ্ধ। বড়ো বড়ো দাঁত। গভীর কোটর থেকে চোখ ঠেলে বার হয়ে আসছে। টাক মাথা থেকে অগ্নিশিখা বার হচ্ছে। হাতে কত্রি, শূল, কপাল ও নরমুণ্ড। যাজপুরে পাওয়া মূর্তিটি দ্বিভুজা, কঙ্কালসার, বসে আছেন, লম্বকর্ণ, সরু, গলিত স্তন। মুখে একটি ভয়াল ভাব। বৌদ্ধ নিষ্পন্নযোগাবলিতে চামুণ্ডার উল্লেখ আছে বজ্রযানীদের চর্চিকা-চামুণ্ডা রূপী চামুণ্ডাকে স্পষ্ট চেনা যায়। পিকিঙেও একটি মূর্তি পাওয়া গেছে। এই মূৰ্তি সম্ভবত তান্ত্রিক সাধকদের মধ্যেই অধিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বশীকরণ ইত্যাদি আভিচারিক কাজেও চামুণ্ডার পূজা হয়।

স্কন্দপুরাণে দেবী বিন্ধ্যবাসিনী, রুরু দৈত্যের পুত্র দুর্গ বা দুর্গম অসুরকে বধ করেছিলেন। তিনি হিরণ্যাক্ষ বংশজাত রুরু র পুত্র। জন্ম থেকেই দেবতাদের শত্রু! ভেবে ঠিক করেন বেদ নষ্ট করতে পারলে কোনো যজ্ঞ হবে না দেবতারা তখন দুর্বল হয়ে পড়বেন। দুর্গম তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছে বর চান এবং বেদ হস্তগত করেন। ফলে বামুনরা মন্ত্র ভুলে যান, যজ্ঞ বন্ধ হয়ে যায়, দেবতারা শীর্ণকায় হয়ে পর্বত গুহাতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অসুর অমরাবতী অধিকার করেন। যজ্ঞের অভাবে অনাবৃষ্টিতে পৃথিবী ধ্বংস হতে যায়। দেবতাদের স্তুতিতে তখন দেবীর শত নয়নে অশ্রুপাত হতে থাকে (দে-ভাগ ৭।২৮।৩৮) নবরাত্র- ব্যাপী একটানা বৃষ্টিতে পৃথিবী জলপূর্ণ হয়ে ওঠে। দেবতারা তখন দেবীকে শতাক্ষী নাম (দে-ভাগ ৭।২৮) দেন। অন্য মতে বামুনরা তখন হিমালয়ে গিয়ে দুর্গার শরণ নেন। এদের দুঃখের কথা শুনে দুর্গার চোখে জল আসে ফলে পৃথিবী আবার সজল হয়ে ওঠে। দুর্গা তখন ক্ষুধার্ত দেবতাদের সকলকে শাক ভোজন করতে দিয়ে রক্ষা করেন ফলে দুর্গা শাকম্ভরী নামে পরিচিত হন। দুর্গম এদিকে খবর পেয়ে এসে আক্রমণ করেন দেবী প্রথমে কালরাত্রিকে দূত হিসাবে পাঠান, তারপর দুর্গার দেহ থেকে বগলা, মাতঙ্গী, গুহ্যকালী ইত্যাদি অসংখ্য দেবী বার হন। দুর্গাসুর প্রথমে হাতি তারপর মহিষ হয়ে যুদ্ধ করতে থাকে এবং ১১ দিনের যুদ্ধের পর বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর হাতে নিহত হয়। দুর্গমের তেজ দেবীর দেহে মিলিয়ে যায়। দেবী বেদ ফিরিয়ে দেন। নাম হয় দুর্গা। মনে রাখতে হবে রাবণ কর্তৃক বেদবতীর সম্মান হরণ যিনি পরজন্মে সীতা।

কালিকাপুরাণ অনুসারে দীর্ঘকাল রম্ভ মহাদেবের সাধনা করেছিল, সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব বর দিতে চাইলে রম্ভ তাঁকে তিন জন্ম পুত্ররূপে পেতে চেয়ে বলেন, আপনি চিরায়ু সত্যপ্রতিজ্ঞ হয়ে আমার পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করুন। মহাদেব বলেন তথাস্তু ফেরার সময় এক তরুণী কন্যার সঙ্গে মিলনের ফলে মহিষাসুরের জন্ম হয়।

দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী নামক বইতে সুধীরকুমার মিত্র বলেছেন, “স্বয়ং দেবী দুর্গা হইয়া মহিষাসুর বধ করিয়াছিলেন, কারণ শিব জম্ভাসুরের পুত্র মহিষাসুর রূপে জন্ম পরিগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহার অসুর দেহ ঘুচানো অবতারের কার্য নহে বলিয়া দেবী স্বয়ং উহা করিয়াছিলেন”। (পৃ ১৬১)

বরাহপুরাণ মতে দৈত্য বিপ্রচিত্তি-র মাহিষ্মতী নাম্নী কন্যা সিন্ধুদ্বীপ নামক তপস্যারত ঋষিকে মহিষ বেশে ভয় দেখিয়েছিল, তখন ঋষি তাকে “মহিষ-ই হও” এই অভিশাপ প্রদান করেন। সেই মাহিষ্মতীর গর্ভে মহিষাসুরের জন্ম হয়। (চণ্ডী ১১।। ৪৩-৪৪ মন্বন্তরের বিপ্রচিত্তি-র উল্লেখ আছে।— উদ্বোধন কার্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত শ্রীশ্রী চণ্ডী, দ্বিতীয় অধ্যায়, টীকা।) মাহিষ্মতী ও সিন্ধুদ্বীপ দুটি স্থান-নাম, মাহিষ্মতী হৈহয় বংশের রাজধানী ছিল। আমাদের আধুনিক চলচ্চিত্র-পুরাণ ‘বাহুবলী’-র কাল্পনিক ঘটনাস্থল। বিধান রায়ের ‘মানসকন্যা’ কল্যাণী শহরের মতো, বিপ্রচিত্তি-র কন্যা ‘মাহিষ্মতী’, পৌরাণিক বর্ণন-ভঙ্গিমায় তাঁর পত্তন করা প্রাচীন নগরের নাম হতেই পারে। বিপ্রচিত্তি সম্পর্কে যেটুকু তথ্য আমি উদ্ধার করতে পেরেছি তা এইরকম হিরণ্যকশিপুর ভগিনীর নাম সিংহিকা, তার সঙ্গে দনুর পুত্র অর্থাৎ দানব বিপ্রচিত্তি-র বিবাহ হয়। হিরণ্যকশিপু দিতির পুত্র অর্থাৎ দৈত্য, প্রহ্লাদের পিতামহ, বিষ্ণু যাঁকে নৃসিংহ অবতারে বধ করেন। সমুদ্রমন্থনের পর যে যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধে বিপ্রচিত্তি হিরণ্যকশিপুর সেনাপতি ছিলেন, আটবার যুদ্ধের পর নবম যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। বিপ্রচিত্তি প্ৰথম দানব রাজা, তাঁর কন্যা মাহিষ্মতী, পুত্ৰ নমুচি যিনি ইন্দ্রকে পরাজিত করেন, (পুরাণে আমরা তিনজন নমুচির দেখা পাই, ইনি তৃতীয়, কশ্যপের পৌত্র) প্রথমে দুজনের মাঝে বন্ধুত্ব ছিল। দেবাসুর যুদ্ধের সময় নমুচি ইন্দ্রের বল হরণ করেন, তারপর এই শর্তে মুক্তি দেন যে দিবসে বা রাত্রে শুষ্ক বা আর্দ্র বস্তু দিয়ে ইন্দ্ৰ নমুচিকে বধ করবেন না। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে সমুদ্রফেনবৎ বজ্র দ্বারা ইন্দ্র গোধূলি বেলা নমুচিকে বধ করেন। নমুচির ছিন্ন মস্তক বন্ধুত্ব ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী ইন্দ্রকে ধিক্কার দিয়েছিল। রাহু এবং কেতু-ও বিপ্রচিত্তির পুত্র। ইল্বল ও বাতাপি-ও বিপ্রচিত্তির পুত্র, যাদের মাতা সিংহিকা। হিরণ্যকশিপুর পুত্র হিরণ্যাক্ষ। হিরণ্যাক্ষ পৃথিবীকে বেঁধে রসাতলে নিয়ে যান। রসাতলে নিবাতকবচ ও কালকেয়-রা বাস করে।

রসাতল বলতে যে ধারণাটা আমাদের মাথায় আসে, পৌরাণিক অর্থের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই, সম্পূর্ণ উলটোও বলা যেতে পারে। পৌরাণিক অধিকাংশ বিষয়ে আমাদের কিছু ভ্রান্ত আধুনিক ধারণা আছে যা অশিক্ষা প্রসূত। কারণ এগুলি আমরা রূপকথা শোনার মতো এমনি এমনি জেনে যাই। আর বুড়ো হবার পর সকলেরই একটু ধৰ্ম্মে মতি হয় তখন দু-একটা পুরাণ কেনা হয়। বাদবাকিরা ধর্মগুরুদের মুখে শোনেন, তাঁরা তাঁদের সম্প্রদায় অনুসারী বা সাম্প্রদায়িকতার বশবর্তী হয়ে উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা দেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কিন্তু পুরাণকে ‘হিস্ট্রি’ বা ইতবৃত্ত হিসাবে বোঝবার চেষ্টা করতে গেলে, এইসব ধারণাগুলোকে যথোপযুক্ত পাঠের মাধ্যমে পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার।

প্রসঙ্গে ফিরে আসি, নৃসিংহ অবতারের হিরণ্যকশিপুর হত্যার পর কনিষ্ঠ পুত্র প্রহ্লাদ রাজা হন, বিষ্ণুভক্ত হিসাবে। তারপর রাজা হন হিরণ্যাক্ষ পুত্র অন্ধক। সেই বংশে রুরুর পুত্র পরাক্রান্ত দুর্গাসুর বা দুর্গমাসুর-এর জন্ম।

অধ্যায় ১ / ৯

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন