মৃতদেহ – শঙ্কর চ্যাটার্জী

শঙ্কর চ্যাটার্জী

খোকন ড্রাইভিং লাইসেন্সটা আজ হাতে পেল। মুখে একটু খুশির আলো ফুটে উঠল। এবার যদি কিছু পয়সা রোজগার করা যায়। তবু তো তাদের মত গরিবের ঘরে দু’মুঠো ভাত জুটবে!

সংসারে সে-ই বড়। এরপর এক ভাই আর বোন। বিধবা মা লোকের বাড়িতে রান্নার কাজ করে। খোকনের বয়স তেইশ বছর। তার ওপরেই বেশি চাপ। ওর মুখে এই খবর শুনে মায়ের মুখে হাসি ফোটে। যাক, যদি দু’পয়সা বেশি আসে, সংসারের স্বচ্ছলতা বাড়ে। কিন্তু খোকন যা ভেবেছিল, তা হল না — কেউ বলে, কাঁচা লাইসেন্স। কেউ বা বলে — হাত আগে পাকাও! গাড়ি না চালালে হাত পাকবে কী করে? এইসব কথা শুনতে শুনতে হতাশা ঘিরে ধরে ওকে। একজন ড্রাইভার বন্ধু পরামর্শ দেয় — ‘এখানে তোকে কেউ কাজ দেবে না। বরং চেনাজানা গন্ডি ছাড়িয়ে চলে যা। হয়তো কাজ জুটে যেতে পারে।’ কথাটা খোকনের মনে ধরল। ব্যান্ডেলে ওর বাড়ি ছাড়িয়ে ত্রিবেণীর দিকে একদিন সে গেল। ‘গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়’ লেখা কয়েকটা দোকানে ঢুঁ মারল। ওর লাইসেন্সের ডেট দেখে একই কথা শুনতে হল। ও বলার চেষ্টা করেছিল।

— ‘গাড়ি অনেকদিন চালায়। লাইসেন্স হালে বার করেছে।’ ওর শুকনো মুখ দেখে একজন বলল, ‘তুমি গোলক মন্ডলের ওখানে গেলে কাজ পেলেও পেতে পার। কয়েকদিন আগেই ও বলছিল ওর ড্রাইভার অসুস্থ। লোক খুঁজছিল।’ নতুন একটা আশার আলো দেখতে পেল খোকন। ঠিকানাটা জেনে নিয়ে দুপুর রৌদ্রে ওখানে চলল।

গোলক মন্ডল তার বাড়িতেই ছিল। মোটা, ঘাড়ে-গর্দানে চেহারা। তার ওপর যেন লোমের জামা পরে আছে। হঠাৎ দেখলে শিম্পাঞ্জির কথা মনে হয়। খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে বেরিয়ে আসে। খোকনের মুখে সব শুনে বলে, ‘আমার গাড়ি বেশি স্পিডে ছোটানোর প্রয়োজন হয় না। লাইসেন্স থাকলেই হল।’

খোকন বুঝতে পারল না লোকটা কী বলতে চাইছে।

— ‘বুঝতে পারলে না ? আমার একটা মড়া বইবার গাড়ি আছে।’ হেঁড়ে গলায় বলে লোকটা, ‘ড্রাইভারের অভাবে রাতের দিকে ভাড়া খাটতে পারে না। এদিকে লোকের মরার কামাই নেই।’

মোদ্দা কথা কাঁচে ঢাকা শব বহনকারী গাড়ি। একটা অস্বস্তি দেহে খেলে গেল খোকনের। কিন্তু নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো। অগত্যা রাজি হয়ে যায়। খোকন তখনও জানতে পারেনি এই গাড়ি তার জীবনে বয়ে নিয়ে আসতে চলেছে এক মহা নিশার অন্ধকার!

খোকনের ডিউটি ঠিক হল রাত আটটা থেকে ভোর পাঁচটা। খোকন অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হল। কারণ এই চাকরিটাও হাতছাড়া করতে চায় না। বরং এই ফাঁকে অন্য কোথাও চেষ্টা করবে। গোলক মন্ডল বলল, ‘প্রথমে আমি তোমাকে মাসে পাঁচ হাজার দেব। কাজ দেখে মাইনে বাড়াব। এই তিনদিন এখানকার রাস্তাঘাট একটু চিনে নাও।’

কথাবার্তা পাকা করে বাড়ি ফিরল খোকন। বাড়িতে মড়ার গাড়ি চালানোর খবরটা চেপে গেল। নাহলে মা আগেই মানা করবে।

কাজ শুরু করল খোকন। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি হত মৃত মানুষগুলোকে স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তুলতে। অবশ্য মৃতের বাড়ির লোকরাও হাত লাগাত। তবে রাত বারোটার পর সাধারণত কোনো ডাক পড়ত না। ও গোলক মন্ডলের গ্যারাজে রাতটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিত। পাশেই শববাহী গাড়িটা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।

সতর্ক হয়েই ঘুমোত ও, কখন ফোন বেজে ওঠে! এই ভাবে মাস দুয়েক কাটিয়ে দিল খোকন। ওর কাজের প্রতি মনোযোগ দেখে মালিক আরও হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। সকালের ড্রাইভার রতন। বয়স্ক লোক। এখানেই বাড়ি। ও ভোর পাঁচটায় চলে আসত। খোকন এখন রাস্তাঘাট মোটামুটি চিনে গেছে। বাড়িতে জানে খোকন এক ডাক্তারের গাড়ি চালায় ডাক্তারের নাইট ডিউটি থাকে। এখন সংসার খানিকটা সচ্ছল হয়েছে।

এদিকে গরমের রোদ ঝলসানো তাপ ক্রমশ কমে আসছে। জুন মাসের মাঝামাঝি হতে চলল। আর বোধহয় এক সপ্তাহের মধ্যেই বর্ষা দেখা দেবে।

সেদিন খোকন গ্যারাজের সামনে পায়চারি করছে। গ্যারাজটা মন্ডলের বাগানের শেষ প্রান্তে। বাগানে ফুলের থেকে বড় বড় গাছের ভিড়। আম, কাঁঠাল, জামরুল ইত্যাদি। গুমোট গরম আর এক বিন্দুও হাওয়া নেই। থম মেরে আছে প্রকৃতি! গ্যারাজের ভেতর গরমে বসা কখনোই সম্ভব নয়। এই সময়ে দূরের অন্ধকার আকাশে বিদ্যুতের ঝিলিক খোকনের চোখে পড়ল। যা গরম পড়েছে বৃষ্টি না হয়ে যায় না ! মোবাইলে সময় দেখল। এগারোটা। রাত্রির বয়স বেশি হয়নি।

হঠাৎ গ্যারাজের ভেতর থেকে কাঁচ ঢাকা মৃতদেহ রাখার বাক্সটার ছিটকিনির চাপা শব্দ ওর কানে এল। যেন কেউ ছিটকিনি খুলে বেরোবার চেষ্টা করছে ! বুকে একটা শিরশিরানি উপলব্ধি করল খোকন। তারপরেই মনকে বোঝাল এ অসম্ভব ব্যাপার। ও নিশ্চয়ই ভুল শুনেছে। মনকে শক্ত রাখার চেষ্টা করল। গ্যারেজের ভেতর দিকে তাকাল। চল্লিশ পাওয়ারের বাল্বের আলো অন্ধকারকে পুরোপুরি দূর করতে পারেনি। তবু নিঃসন্দেহ হবার জন্যে ও পায়ে পায়ে গ্যারাজের দিকে এগিয়ে এল। চোখে পড়ল ছিটকিনি আটকানো খালি কাঁচের বাক্স। তখনই ওর কানে ভেসে এল মেঘ ডাকার গুড়গুড় শব্দ। একটা ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শ ওর শরীরে লাগল। তার মানে বৃষ্টি আসছে। গোলক মন্ডলের বাগানটা অন্ধকারে ঢেকে আছে। গাছে বাতাসের ছোঁয়া। গরম ভাবটা কমতে শুরু করেছে। এই প্রথম একটা কথা খোকনের মনে আঘাত করল। বৃষ্টি নামলে এই গ্যারাজেই ওকে আশ্রয় নিতে হবে। কথাটা মনে হতেই একটা গা ছমছম অনুভূতি শরীরকে ঘিরে ধরল। কিন্তু কেন এই অনুভূতি? ও কি ভয় পাচ্ছে? ভয়ের কারণ কী? আসলে ছিটকিনি খোলার শব্দটা এখনও কানের ভেতর ওর রয়ে গেছে।

বাতাসে গাছের পাতাগুলো কেঁপে উঠল। বর্ষার প্রথম বৃষ্টির জল খোকনের মাথায় পড়ল। আকাশে বিদ্যুতের চমকে এক সেকেন্ডের জন্যে বাগানটা আলোকিত হয়ে গেল। পরক্ষণেই কোথাও বাজ পড়ল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ও গ্যারাজের দিকে এগোল। গাড়িটা ওর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মৃতদেহ রাখার জায়গা পিছন দিকে। আলো মাঝামাঝি থাকার জন্যে পিছন দিকটায় আলো-আঁধারির পরিবেশ। বৃষ্টি বেশ জোরেই নামল। গাছের পাতায় রিমঝিম ধ্বনি। সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। খোকন গ্যারাজের সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। এদিকে বৃষ্টির তেজ ক্রমশ বাড়ছে। ভয়কে সংযত রেখে আরও একটু ভেতরে ঢুকল। গাড়িতে ড্রাইভারের সিটে ঢুকতেও গা শিরশির করছে।

এই সময় ওর নাকে অগুরুর গন্ধ ভেসে এল। এই ক’দিনে মড়া বয়ে বয়ে গন্ধটা নাকে পরিচিত হয়ে গেছে। বিকেলে রতনদা নিশ্চয়ই কোনো খেপ খেটেছে। তারই গন্ধ এখনও ছাড়ছে। তবু সে গাড়ির কাঁচের বাক্সের দিকে তাকাতে পারল না। মন থেকে বিস্তর ব্যাখ্যা দিয়েও আতঙ্কটাকে চাপা দিতে পারছে না। বরং পরিবেশের সাথে সাথে সেটা বেড়েই চলেছে। বাইরে রীতিমতো দুর্যোগ শুরু হয়ে গেছে ! বৃষ্টির সঙ্গে ঘনঘন বাজ পড়ার শব্দ ওর কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে। খোকনের চোখে মুখে বিপদের আশঙ্কা। কিন্তু বিপদটা কীসের সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।

এবার ওর নাকে অগুরুর সঙ্গে ধূপের গন্ধ নতুন করে এসে লাগল। এবার যেন স্নায়ুগুলো বিদ্রোহ করে উঠল। বৃষ্টিটা না হলে এই মুহূর্তেই হয়ত ও গ্যারাজ ছেড়ে বাইরে চলে যেত। অনেক চেষ্টা করল নিজের মনকে বোঝাতে। অহেতুক সে ভয় পাচ্ছে। ভয় জিনিসটাই এমন। একবার যদি মাথায় ঢুকে যায় হাজার চেষ্টাতেও বার করা যায় না! ও নিজের অজান্তে নাকটা দু’বার টানল। ধূপের গন্ধ আরও বেশি করে ওর শরীরে ঢুকল। আর সংযত থাকতে পারল না সে। উৎকণ্ঠা কমাবার জন্যে গন্ধের উৎস খুঁজতে লাগল। মৃতদেহ রাখার কাঁচের ঘরটা ওকে অনেকক্ষণ থেকেই আকর্ষণ করছিল। এখন ভয়ে ভয়ে ঐ আবছা অন্ধকার বাক্সের দিকে তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গেই এক লহমায় দেহের সমস্ত রক্ত যেন মুখে উঠে এল ! স্নায়ুগুলো অবশ হয়ে এল। ভয়ার্ত চোখে সে দেখল কাঁচের বাক্সে একটা মৃতদেহ শোয়ানো আছে! বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল। তার উত্তেজিত মস্তিষ্কে নানা কথার খেলা চলছে। এই জন্যে ছিটকিনি খোলার শব্দ সে পেয়েছিল! আর এই অগরু আর ধূপের গন্ধ তার মানে ঐ মৃতের শরীর থেকেই আসছে!

কিন্তু রতনদা মড়াশুদ্ধু গাড়ি এখানে কেন রেখে যাবে? তাহলে যাবার আগে কিছু বলবে না? মাথা যেন এই বিষয়টা মেনেই নিতে পারছে না। সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! হঠাৎ তার চোখ দুটো আরো সতর্ক হয়ে উঠল। সে দেখতে পাচ্ছে… মৃতদেহটা ধীরে ধীরে নড়ছে! খোকনের মুখের রেখাগুলো ভেঙেচুরে যাচ্ছে ! ছুটে পালাবার জন্যে মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে কিন্তু পা দুটো সম্পূর্ণ অবশ। কাঁচের পাল্লাটা খুলে গেল। নিষ্প্রাণ দেহটা হামাগুড়ি দিয়ে নিচে নামছে…

ওর মস্তিস্ক এবার বিপদ ঘন্টি বাজাল। আর এখানে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়। কিন্তু বিদ্রোহ ঘোষণা করছে ওর পা দুটো। শরীরের বাকি অংশ কেমন যেন অবশ হয়ে আছে… এ কি তবে অত্যাধিক ভয় পাওয়ার কারণে?

সেই মৃতদেহ একটু কাছাকাছি আসতে খোকন মরদেহের মুখ দেখে অজ্ঞান হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। এ কে? কাকে দেখছে ও? এ কি সম্ভব ? না চোখের ভুল? সেই ঘাড়ে-গর্দানে লোকটা! যার গায়ের কালো লোমগুলো অনেকটা বনমানুষদের মতো… আচমকা খোকনের কানে ঝড় বৃষ্টি ভেদ করে কান্নার শব্দ ভেসে এল। মালিকের বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে! কিন্তু মালিক তো এখানে! চোখের সামনে থেকে গোলক মন্ডলের মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল।

খোকন ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখল মালিক হাঁ করে বিছানায় মরে পড়ে আছে।  

অধ্যায় ১ / ৮

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন