রাত ভ’রে বৃষ্টি – ২

বুদ্ধদেব বসু

দুই

কিছু এসে যায় না। যাতে সত্যি এসে যায় তা হ’লো ইচ্ছে—ইচ্ছেটা মেটানো গেলো কি গেলো না সেটা একটা দৈব ঘটনা মাত্র। সুযোগ পেলে মিটবে, না পেলে মিটবে না; কোনো তফাত নেই। শিকলে বাঁধা কুকুরের মতো আমাদের শরীর, মন তাকে টেনে নিয়ে যায়—মন যখন যে দিকে ছোটে কেউ ঠেকাতে পারে না, কিন্তু শরীরটা জবড়জং জড় পদার্থ ব’লে পিছনে প’ড়ে থাকে। নতুন কিছু হয়নি, শুধু মনের হুকুম তালিম করেছে তোমার শরীর। মালতী, তুমি ব্যস্ত হ’য়ো না, আমার দিক থেকে একই কথা, একই রকম আছে সব—কিছু এসে যায় না।

আলো জ্বেলে দেখলুম সুন্দর একটি ছবি। মালতী ঘুমিয়ে আছে, শাড়িটা উঠে গিয়ে নিটোল একটি পা দেখা যাচ্ছে হাঁটু থেকে পাতা পর্যন্ত, আঁচল সরে গিয়ে একটি স্তন সম্পূর্ণ বেরিয়ে পড়েছে—সম্পূর্ণ গোল, নধর, উর্ধ্বমুখ। একটি শ্যামবরনী ভেনাস-বতিচেলির সদ্যতরুণী নয়, বরং টিৎসিয়ানোর কোনো ছাত্রের আঁকা পক্কযুবতী, সারা ঘুমন্ত শরীরের মধ্যে ঐ একটি অনাবৃত স্তন যেন চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, রূপের চেতনা ও স্পর্ধা নিয়ে, লোকেদের অভিনন্দন নেবার জন্য। চুপচুপে ভেজা ঠাণ্ডা শিটোনো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে আমার বেশ লাগছিলো যেন চোখ দিয়েই কিছুটা তাপ কুড়িয়ে নিচ্ছিলাম ঐ ঘুমিয়ে থাকা শরীর থেকে—কিন্তু মনে হ’লো হঠাৎ জেগে উঠলে হয়তো লজ্জা পাবে, তাই কাছে গিয়ে ওর গা না-ছুঁয়ে, আস্তে নামিয়ে দিলাম গোড়ালি পর্যন্ত শাড়িটা, স্তনটিকে ঢেকে দিলাম আঁচল দিয়ে। দেখলাম ওর চাদরটা নানা জায়গায় কুঁচকানো, ও ঘুমিয়ে আছে একটা বালিশে মাথা রেখে, অন্যটা মধ্যিখানে গর্ত নিয়ে পাশে প’ড়ে আছে। তারপর চোখে পড়লো আমার খাটের উপর ওর ব্লাউজ আর ব্রা—যেন তাড়াতাড়ি আন্দাজের ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিলো।

ভেজা কাপড় ছাড়তে বাথরুমে এসে আমার হঠাৎ মনে হলো আমি অনেকদিন পর উজ্জ্বল আলোয় মালতীর শরীর দেখলাম, মনে হ’লো আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে তার শরীর–না কি লোভনীয়? না কি সুন্দর? নাকি দু-ই? টান চামড়া, ভরপুর মাংস, চিক্কণ মেদ, যৌবনের মধ্যাহ্ন বলা যায়, এর পরেই হেলবে, হয় রোগা হ’য়ে যাবে নয় তো মোটা, হয় চামড়া ঢিলে হবে নয় তো চর্বি জ’মে-জ’মে আকার-আকৃতি কিছু থাকবে না, আর তারপরেই আমার মনে হ’লো যে ও-রকম যে হতেই হবে তা নয়, মোটামুটি একই চেহারা নিয়ে (খাওয়াদাওয়া ও প্রসাধন বিষয়ে এখনকার মতোই যত্ন নেয় যদি) মালতী আরো দশ বছর—কুড়ি বছরও কাটাতে পারে; আমি এমন পঞ্চাশ বছরের মহিলাও দেখেছি যিনি বেশ—বেশ রমণীয়া (অবশ্য জানি না সাজগোজের জারিজুরি কতটা)—কিন্তু বুঝতে পারলুম আমি চাচ্ছি ওর রূপ নষ্ট হ’য়ে যাক, হয়ে যাক বেঢপ মোটা, বা বিতিকিচ্ছিরি রোগা, চাচ্ছি কোনো পুরুষ যেন ওর দিকে আর ফিরে না তাকায়; কিন্তু আপাতত ওর শরীরের আকর্ষণ আমাকে মানতেই হ’লো, যে শরীর, শাড়ি-জামার খাপছাড়ানো অবস্থায় পরিষ্কার আলোয়, অনেকদিন পর, এক্ষুণি আমি দৈবাৎ দেখতে পেলুম। সেই একটি স্তন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আবার, কোথাও একটু ভাঁজ পড়েনি, বোটা ঘিরে কালো মণ্ডলটির রং একটু গাঢ় হয়েছে বোধহয় (ওর বুকে দুধ ছিলো প্রচুর, বুন্নিকে ও ছ-মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাইয়েছিলো), তালের মতো কালোর তলায় ঈষৎ গোলাপি তাকিয়ে আছে, যেন শিশুর মতো, কোনো চিরসুখী নিস্পাপ চোখের মতো, যেন বলছে, ‘এই আমি, আর-কিছু জানি না।’—কেন আমি আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকিনি, কেন আমি আঁচল দিয়ে ঢেকে দেবার সময়ও ওকে ছুঁলুম

না? কেন আবার?—আমার ভব্যতাবোধ, শালীনতাজ্ঞান, বেক্ষপনা! আমার বই-প’ড়ে শেখা আগডুম-বাগডুম! আমি—হাজার হোক ওর স্বামী—আমি ঐ মাংসপিণ্ড মুচড়ে দিয়ে জাগিয়ে দিতে পারতাম ওকে, ওর নরম গলাটাকে দু-আঙুলে চেপে ধ’রে খুলে দিতে পারতাম ঘুমোনো চোখ, ওকে জাপটে ধ’রে গড়াতে পারতাম আমাদের ছ ফুট চওড়া মেঝেতে। কিন্তু না-আমার মতো ফুলবাবুর পক্ষে ও-সব কিছুই সম্ভব নয়। তা-ব’লে এমন নয় যে ও-সবে আমার ইচ্ছে নেই, লোভ নেই,—পুরোমাত্রায় আছে, আর জানি ও-সব শ্ৰীমতীরও অপছন্দ নয়, আর তাই জয়ন্তকে দোষ দিতে আমি পারি না, শুধু যদি জয়ন্ত না-হ’য়ে অন্য কেউ হতো, আমার কোনো বন্ধু, যার সঙ্গে কাণ্ডিন্ -স্কির ছবি নিয়ে কথা বলা যায়!

বাথরুমে আমি ইচ্ছে ক’রে দেরি করলাম, যাতে ও জামা-টামা প’রে নিয়ে, বিছানাটাকে টান করে নেবার সময় পায়। রাতের অন্ধকারে ছাড়া বিছানায় শাদা চাদর-বালিশ আমি সহ্য করতে পারি না, কিন্তু বেরিয়ে এসে দেখলুম মালতী তার বিছানাটা টেনে-টুনে দিয়েছে, কিন্তু সুজনিতে ঢেকে দেয়নি। ওর মুখোমুখি খেতে ব’সে জোরে-জোরে নিশ্বাস পড়ছিলো আমার, মাঝে-মাঝে দম আটকে আসছিলো, কিন্তু আমি চেষ্টা ক’রে কথা বলতে লাগলুম আর ভালো লাগলো যে মালতীও জবাব দিলে সঙ্গে-সঙ্গে (দু-জনেই জানি কোন খেলা খেলছি)—চেষ্টা ক’রে খেতে লাগলুম আস্তে আস্তে আর সত্যি বেশ খিদেও পেয়েছিলো বৃষ্টিতে জলে অতটা পথ হেঁটে এসে—অন্তত পাওয়া উচিত।এও ভাবলুম যে পেট ভ’রে খেলে তক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়া যাবে-কিন্তু , আমি ক্লান্ত কিন্তু ঘুম নেই, আজকের বৃষ্টিতে আমি যেন বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছি, আমার গায়ে জোড়ে জোড়ে ব্যথা, যেন বাড়ি ফেরার পথে শেয়ালদার কোনো গুণ্ডার হাতে মার খেয়েছিলাম।

একবার সত্যি আমি মার খেয়েছিলাম ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন, আমার কলেজের বন্ধু সুব্রতর সঙ্গে বাড়ি ফিরছি সন্ধ্যেবেলা, এইমাত্র দেখা ‘বু এঞ্জেল’ ছবিটা নিয়ে কথা বলতে বলতে। বেলেঘাটা তখনও পাড়াগাঁর মতো ছিলো, সব রাস্তায় ইলেকট্রিক আলো হয়নি, অনেক মাঠ ডোবা ঝোপঝাড় অন্ধকার ছিলো, হঠাৎ কোথেকে দুটো ষণ্ডামতো ছেলে ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়লো আমাদের উপর ‘স্কাউন্ড্রেল! আর যাবি ওখানে? আর ইতরামো করবি?” এই ব’লে আমাদের পিঠে মাথায় দমাদম কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়ে মাঠের মধ্যে শাদা ছায়ার মতো মিলিয়ে গেলো। তাদের মুখে ছিলো রুমাল বাঁধা, যাবার সময় রুমাল খুলে নিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছতে লাগলো—শুধু এইটুকু আমি দেখেছিলাম তাদের।

আমাদের হাতে বই-খাতা ছিলো, সন্ধের মিটমিটে আবছায়ায় খুঁজে-খুঁজে কুড়িয়ে নিলুম সেগুলো—একটা বই পাওয়া গেলো না, কিন্তু সেজন্যে সময় নষ্ট না-করে নিঃশব্দে যে যার বাড়ি চ’লে গেলুম। আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি এ-রকম একটা ঘটনা ঘটবে বা ঘটতে পারে, এর আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়েছিলুম একেবারে-কী যে হ’লো তা বুঝে নেবারও সময় পাইনি। এই অবাক হবার, বোকা বনে যাবার অনুভূতিটা আমাকে আচ্ছন্ন ক’রে রাখলো অনেকক্ষণ—গায়ের ব্যথা ভালো করে টের পেলুম না। আরো বেশি অবাক লাগলো যেহেতু ব্যাপারটা আমার দিক থেকে একেবারে অর্থহীন, এর কোনো সুদূরতম কারণও আমি ভাবতে পারছি না, সুব্রতকে বা আমাকে কেউ যে কেন মার দিতে চাইবে আমার পক্ষে তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভেবেছিলুম সেই রাত্রে—কে ওরা? ওদের রাগটা কিসের? আর সেই সূত্রে ঘটনাটা মনে-মনে আবার সাজাতে গিয়ে আমার হঠাৎ এ-কথা ভেবে চমক লাগলো যে আমরা চেঁচিয়ে উঠিনি,ফিরে মারা দূরে থাক আত্মরক্ষার কোন চেষ্টা করিনি পর্যন্ত। ওরাও দু’জন ছিলো, আমরাও তা-ই—ধরা যাক ওদের গায়ে জোর ছিলো বেশি, কিন্তু অন্তত বাধা তো দিতে পারতাম, হয়তো বা দেখেও নিতে পারতাম লোক দুটো কারা। অথচ আমি মনে মনেও যেন মারতে পারলুম না ওদের, আমি কাউকে হাত তুলে মারছি তা ভাবতেই কেমন ঘেন্না করলো আমার, মারতে হ’লে অন্য একটা ঘেমো শরীরকে ছুঁতে হয়, এক বস্তা সম্পূর্ণ অচেনা মাংসপেশীর সঙ্গে পাতাতে হয় এক ধরনের আত্মীয়তা—না, আমি তা পারবো না। এসব কথা তখনই আমি ভাবিনি হয়তো—পরে, ধীরে ধীরে এগুলো আমার মনে হয়েছিলো; কিন্তু একটা কথা অস্পষ্টভাবে সেই রাত্রেই আমি অনুভব করেছিলাম,দুটো শরীরের যে কোনোরকম ঘনিষ্ট ছোঁয়াছুঁয়ি হওয়াটাই কুশ্রী।

অবশ্য এর একটা খুব বড়ো ব্যতিক্রম আছে, আর তাও আমার বুঝতে দেরি হয়নি, যদিও মেনে নিতে বেশ সময় লেগেছিলো। দু-বছর পরে আমরা তখন থার্ড ইয়ারে—সুব্রত আমাকে একদিন চুপি-চুপি বললে, ‘ঐ কাণ্ডটা কে করেছিলো, জানো?’ ‘কোন কাণ্ড? ঐ যে–তোমাকে আমাকে মেরেছিলো? বিমল-ইকনমিক্স অনার্সের বিমল গুপ্ত। সে আর-একটা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে—’ ‘কী করে জানলে? বিমল বলেছে আমাকে। ওর রাগটা ছিলো তোমার ওপর, যেহেতু ও ভেবেছিলো তুমি বেনামীতে ওর বোনকে প্রেমপত্র লেখো আর ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো তাকে দেখার জন্য। আমাকে ফালতু মেরেছিলো।’ ‘ওর যে বোন আছে আমি তো তা-ই জানতুম না।’ ‘আছে আছে,’ বলে সুব্রত জিভ দিয়ে একটা শব্দ করলো।

আমি তখনই জানলুম যে সম্প্রতি বিমলের সঙ্গে সুব্রতর বেশ ভাব জ’মে উঠেছে, সুব্রত মাঝে-মাঝে ওর বাড়িতেও যায়। এর পরে মাঝে-মাঝে এমনও হ’লো যে সুব্রত আর বিমলের সঙ্গে আমিও লিলি কেবিনে গিয়ে চা খেয়েছি, আড্ডা দিয়েছি। বিমলের উপর রাগ হয়নি আমার, বিমলের সঙ্গে ভাব করার জন্য সুব্রতর উপরেও রাগ হয়নি—আমার শরীরে রাগ এত কম কেন জানি না। কিংবা হয়তো রাগটা আমার মনের মধ্যে জমা হ’য়ে থাকে, আমি শরীর দিয়ে সেটা অনুভব করি না; মনে-মনে বলি, ‘তোমাকে চিনে রাখলুম, তোমাকে আর ভালবাসবো না—’, আমার রাগের প্রকাশটা বোধহয় এই রকম। তাতে অন্য লোকটার কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু আমি নিশ্চিন্তে নিজের মনে থাকতে পারি ; আমার মনে হয় আমি যে ওকে মনে-মনে ক্ষমা করছি না এতেই ওকে যথেষ্ট শাস্তি দেয়া হচ্ছে।

বিমলের বাড়িতে সুব্রতর আকর্ষণ বিমল নয়, তার তিনটি বোন-চৌদ্দ, পনেরো, সতেরো তাদের বয়স। আমাকে একা পেলে মাঝে মাঝে ওদের গল্প করে সুব্রত। বড়োটির নাম মণিকা, সুব্রতের মতে ‘খাশা চেহারা।’ তিন বোনকে নিয়ে সে আর বিমল সিনেমায় যায় মাঝে-মাঝে, অন্ধকারে মণিকার পাশে বসে হাতে হাত রাখে সুৱত, জুতো খুলে পায়ের উপরে পা দিয়ে চাপ দেয়, বসার ভঙ্গি বদল করার সময় দৈবাৎ গালে গাল ঠেকে যায় তাদের, ইত্যাদি। ‘আমি ওর বোনকে প্রেমপত্র লিখি সন্দেহ করে আমাকে মেরেছিলো বিমল, আর সে-ই এখন বোনদের সঙ্গে মেলামেশায় সুব্রতকে সাহায্য করছে—’ এই কথাটা আমার তখন মনে হওয়া উচিত ছিলো কিন্তু তা হয়নি, আসলে বিমল বা তার বোনেদের এক ফোঁটা কৌতুহলও আমার ছিলো না, নেহাত ভদ্রতা করে সুব্রতর কথা শুনে যেতুম। একদিন সুব্রত আমাকে বললে কাল রাত্রে ছাতে হঠাৎ একা পেয়ে সে কেমন ক’রে চুমু খেয়েছে মণিকাকে—অনেক, অনেকক্ষণ ধ’রে-মণিকাও সোৎসাহে তা ফিরিয়ে দিয়েছে; তায় সেই বিস্তারিত বর্ণনা শুনে আমি অবাক হলাম, কেননা তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না যে কবিরা যাকে চুম্বন বলেন তার মধ্যে মানুষের লালাসিক্ত জিহ্বারও কোনো অংশ আছে। একটু লজ্জাও করলো আমার, কেননা ঐ বর্ণনা শুনতে-শুনতে কুসুমকে আমার মনে পড়লো।

জানি না সব ছেলেরই ও-রকম হয় কিনা, কিন্তু বয়ঃসন্ধির সময়টাতে আমি বড় কষ্ট পেয়েছিলুম। কী যন্ত্রণা আমার যখন চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম টের পেলুম যে আমার শরীরের মধ্যে আর-একটা শরীর লুকিয়ে আছে—চোখ নেই কান নেই কিন্তু ভীষণভাবে জ্যান্ত, কাপড়ের তলায় ওত পেতে-থাকা জন্তু একটা, আমারই অংশ কিন্তু হাত-পায়ের মতো আমার বাধ্য নয়, স্বাধীন, নিজের একটা আলাদা ইচ্ছে আছে, হঠাৎ যখন মাথা চাড়া দেয় আমি যেন চোখে অন্ধকার দেখি। আরম্ভ হয়েছিলো খুব মৃদুভাবে, এমন কি মধুরভাবে—আমাকে হানা দেয় সব নারী মূর্তি, হাওয়ার মতো সুরের মতো সুগন্ধের মতো, ভূগোলের খাতায় মেয়েদের মুখ আঁকি ব’সে ব’সে, ক্যালেন্ডারের ছবির তরুণীর সঙ্গে মনে মনে কথা বলি। কিন্তু এই মধুর খেলা ভেঙে দিয়ে আমার দ্বিতীয় শরীর আরো জোরালো হ’য়ে উঠলো, তার হিংস্রতায় আমি ভয় পেয়ে গেলুম, কিন্তু পারলুম না মাঝে-মাঝে নিজের হাতে তার দাবি না-মিটিয়ে, আর তার ফলে মনে হ’লো অপরাধ করেছি, মা-বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারি না, আড়ষ্ট হ’য়ে থাকি—এদিকে স্কুলে এক মাস্টারমশাই, আর বাড়িতে এক পূর্ণযুবক আত্মীয়, আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অথচ স্পষ্টভাবে এমন সব ভুল উপদেশ দিতে লাগলেন যাতে আমার অপরাধবোেধ আর অপরাধবোধের কারণ দুটোই আরো বেড়ে গেলো। শরীর-মনের এই রকম অবস্থা নিয়ে আমি স্কুল থেকে কলেজে উঠলাম।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে কেষ্টনগরে পিসিমার কাছে বেড়াতে এসে আমি প্রথম সচেতনভাবে কোনো মেয়েকে ছুতে পারলুম—জাঁক করে বলার মতো কিছু নয়, দুই বোন, তেরো-চৌদ্দ বয়স, গয়না আর ছুটকি তাদের নাম, কবিতায় লেখার মতো কিছু নয়, গয়না ট্যারা, গোলগাল, আর ছুটকি হ্যালহ্যালে লম্বা, তার মুখের মধ্যে সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে তার বড়ো বড়ো দাঁত যা না-হাসলেও খানিকটা বেরিয়ে থাকে,—জজকোর্টের কোনো এক টাইপিস্টবাবুর মেয়ে তারা, পিসিমাদের পাড়ায় থাকে, বিয়ের সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে ব’লে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে। দিনের মধ্যে তারা অনেকখানি সময় কাটায় পাড়া বেড়িয়ে; যখন-তখন পিসিমার বাড়িতে চ’লে আসে, দারিদ্রের জন্যই হোক বা বহুসন্তানবতী মায়ের অমনোযোগের জন্যই হোক, তাদের জামাকাপড় সর্বদাই ময়লা আর শহুরে চোখে শোভনও নয়, তাছাড়া তরিবতও তেমন শেখেনি, হুট ক’রে ঢুকে পড়ে আমি যেখানে বসে-বসে পুরোনো বাঁধানো ‘ভারতী’ পড়ছি আমার ঘড়ি বই ফাউন্টেনপেন নিয়ে নাড়াচারা করে; ‘ঘড়িটা কোথায় পেলে?’ ‘কলমটা তোমাকে কে দিয়েছে?’ ‘অত বড়ো চুল রাখো কেন?’—এই রকম তাদের কথাবার্তার নমুনা; ‘ওটা কী বই পড়ছো?’ ব’লে মাঝে-মাঝে যখন নিচু হয় তখন ঢিলে শেমিজের মধ্য থেকে ঠেলে ওঠে তাদের যৌবনের প্রমাণ, কখনো-কখনো এমন গা ঘেঁষে দাঁড়ায় যে তাদের নোংরা ঘেমো গায়ের বা আঁচলের গন্ধে আমার নাক চুলবুল করে ওঠে। পিসিমা মাঝে-মাঝে দেখতে পেয়ে বলেন, ‘এখান থেকে ভাগ, অংশুকে বিরক্ত করিস না—।’ ওরা তাড়া খেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে পালিয়ে যায়, কিন্তু সময়ে-অসময়ে ফিরে আসে, একা গয়না, একা ছুটকি, মাঝে-মাঝে দু-বোন একসঙ্গে; এমনি হ’তে-হ’তে আমি একদিন গয়নার শেমিজের উপর হাত রাখলুম, সে হাতটা তুলে নিয়ে শেমিজের মধ্যে সেঁধিয়ে দিলে। তারপর এই খেলা ছুটকির সঙ্গেও খেলতে হ’লো আমাকে, মাঝে-মাঝে দুবোনের সঙ্গে একই সময়ে। কিন্তু এ থেকে কোনো সত্যিকার সুখ পেলুম না আমি—আসলে আমার অনেক ভাল লাগে মণীন্দ্রলাল বসুর ‘রমলা’ বা সত্যেন্দ্র দত্তর কবিতা পড়তে-মেয়ে দুটোর প্রতি এমন অবজ্ঞা আমার যে তাদের ঠিক ‘মেয়ে’ বলেই ভাবতে পারি না–’মেয়ে’ কথাটার মধ্যে যত স্বপ্ন আর কবিতা আমি ধীরে-ধীরে ভ’ রে দিচ্ছিলাম তার কিছুরই সঙ্গে মিল নেই এদের, আমি চুমু খাই না পর্যন্ত, লুব্ধও হই না (কেননা চুম্বন হ’লো প্রেমের ঘোষণা, স্বাক্ষর, চুক্তিপত্র, আর এদের সঙ্গে আমার ‘প্রেম’ হওয়া অসম্ভব), এদের গায়ের দুর্গন্ধ কষ্ট দেয় আমাকে, এদের বোকা, অমার্জিত কথাবার্তায় আমি বিরক্ত হই, আমি এদের গায়ের মাংসে খাবল দিচ্ছি নেহাত একটা জন্তুর তাড়নায়। কিন্তু জন্তুরও তৃপ্তি নেই এতে; সে ঠিক কী চায় সে-বিষয়ে আমার ধারণাও তখন পর্যন্ত অস্পষ্ট; এদিকে মনে-মনে একটু ভয়ও আছে পাছে পিসিমা বা অন্য কারো কাছে ধরা পড়ে যাই অথচ মেয়ে দুটো ঠিক এমন সময় আসে যখন আমি একা আছি, কাছাকাছি অন্য কেউ নেই, যেন সুযোগের জন্য ঘুরঘুর করে আশেপাশে, আর ভাবটা যেন আমি ওদেরই অপেক্ষায় ব’সে আছি। শেষটায় এই ব্যাপারটা কেমন ভোঁতা আর বিস্বাদ হয়ে উঠলো আমার কাছে, কলকাতায় ফিরে আসার সময় ভাবতে ভালো লাগলো যে গয়না আর ছুটকিকে আর দেখবো না।

কলেজে এসে একটা পরিবর্তন হ’লো আমার। আমি ছেলেবেলা থেকেই পড়তে ভালোবাসি; ‘চয়নিকা’র অর্ধেক কবিতা আমার মুখস্ত, শরৎচন্দ্রের কোনো কোনো বই পনেরো-কুড়িবার করে পড়েছি, একবার সারারাত জেগে গোকুল নাগের ‘পথিক’ পড়েছিলুম—আর ঐ ঝড়ঝাপটার সময় আমি যে কোনো ভবেই বেসামাল হ’য়ে পড়িনি তার কারণই তা-ই। কলেজের লাইব্রেরিতে আরো বড়ো একটা আশ্রয়ের আমি সন্ধান পেলুম, আমার চোখ আর মন খুদে-খুদে ছাপার অক্ষরগুলোকে চেটেপুটে খেয়ে নিতে লাগলো, আর সেই খোরাক থেকে জোর পেয়ে-পেয়ে আমার মনে হলো আমি বয়ঃসন্ধির জ্বালাযন্ত্রণা কাটিয়ে, স্বাবলম্বী যুবক হ’য়ে উঠছি। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো দু জন রুশ লেখককে—টুর্গেনিভ আর চেখভ, এঁদের বই থেকে যেন উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো আমার কৈশোরের স্বপ্ন—হাওয়ার মতো সুরের মতো সুগন্ধের মতো—মধুর, মধুর এক মেয়ে; পুরোনো বাড়ির বড়ো-বড়ো অন্ধকার ঘরে সে ব’সে থাকে শাদা পোশাক পরে আমার জন্য, চাঁদের আলোয় ছায়াভরা বাগানে পাইচারি করে, ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে তার বড়ো-বড়ো করুণ চোখে সারা আকাশ দেখতে পাই আমি—এই মেয়ে, কিছুটা আমার মনগড়া আর কিছুটা সাহিত্য থেকে তুলে নেয়া, সে আমাকে হানা দিতে লাগলো দিনে-রাত্রে, আমি বুঝে নিলুম যে এই বুকের দুরুদুরু, দীর্ঘশ্বাস, চোখের চাউনি, এই যে কথা বলতে গিয়ে থেমে যাওয়া আর চিঠি লিখতে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলা, আর রাত ভ’রে মাথার মধ্যে এক গুনগুন গান—এরই নাম প্রেম, আর এই প্রেম আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে পবিত্র সম্পদ। এই ‘প্রেম’কে একটা বাইরের চেহারা দেবার জন্য আমি কুসুমকে বেছে নিলুম।

‘কুসুম, আমি তোমাকে ভালবাসি।’ এই না-বলা কথাটা তাকে ঘিরে-ঘিরে ঘুরতে লাগলো কোনো বিগ্রহের সামনে ধূপের ধোঁয়ার মতো, সে বুঝে নিলে আমার কথাটা, চোখ দিয়ে সায় দিলো তাতে, বুঝিয়ে দিলো সেও আমাকে ‘ভালবাসে’। আমাদের দুজনের মধ্যে একটা গোপন ব্যবস্থা এটা, একটা অলিখিত চুক্তিপত্র, প্রেমে পড়বো স্থির করেছি ব’লেই প্রেমে পড়েছি আমরা। কুসুম বয়সে আমার ছোটো হ’লেও সম্পর্কে এক ধরনের মাসি, সম্পর্ক নিকট নয় কিন্তু দু-বাড়িতে যাতায়াত মেলামেশা আছে, তার সঙ্গে আমার দেখাশোনার কোনো বাধা নেই।কিন্তু সুব্রত যে ভাবে তার মণিকার সঙ্গে এগিয়েছে, সে রকম কিছু কুসুমের সঙ্গে আমার হয় না কখনো—সাহস বা সুযোগের অভাবে নয়, ইচ্ছে করি না বলেই হয় না। মধুর, সুন্দর, পবিত্র এই প্রেম—আমরা কি পারি শরীর দিয়ে তাকে কলঙ্কিত করতে? দেখা হয় কথা হয়, দুরুদুরু করে বুক, চোখে-চোখে জ্বলে আলো, সে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে ঝাপসা একটা গন্ধ পাই, বৃষ্টিপড়া বিকেলে ব’সে ভাবি তার কথা —এ-ই যথেষ্ট, এর বেশি হলে সব নষ্ট হবে।

তবু—তবু—আমার শরীরটাকে বাগাতে পারি না আমি। জন্তুটাকে পোষ মানাতে পারি না। আমার নির্জনতম, মধুরতম মুহুর্তে সে আক্রমণ করে আমাকে—অন্ধ, বধির, লালাঝরা হাঁ-করা একটা মুখ, ঝোপের আড়াল থেকে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ে আমার অতি কোমল ভাবনাগুলির উপর। এক এক সময় এত কষ্ট পাই যে জন্তুটার খিদে মেটাবার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি, কিন্তু বড়ো রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢুকতে সাহস হয় না।

একবার আষাঢ় মাসে বৃষ্টি শুরু হ’য়ে আর থামে না, টানা সাতদিন বাড়িতে আটকে আছি—কলেজে তখন গ্রীষ্মের ছুটি চলছে—কোনো কাজ নেই, ধোপার দেখা নেই, ধুতি- জামা ময়লা, কোনো বই ভালো লাগছে না, সেই বিশ্রী বিরক্তিকর দিনগুলি ভ’ রে আমার মনের মধ্যে শরীরের মধ্যে যে দাপাদাপি করতে লাগলো সে কোনো মানসপ্রতিমা নয়, কোনো কুসুমও নয়, একটা স্থূল জ্যান্ত মাংসল মূর্তি যার নিঃশ্বাস ঘন আর গরম, ঠোঁট ফেনায় ভেজা, হাত দুটো সাপের মতো প্যাঁচালো, যার মুখের মধ্যে চোখ নেই আর নাকের ফুটো দুটো অত্যন্ত বড়ো—এমন কোনো-কোনো সময় এলো যখন ও ছাড়া আমি আর-কিছুই ভাবতে পারি না। অবশেষে অসহ্য হ’য়ে উঠলো আমার, প্রথম যেদিন বৃষ্টি থামলো সেদিনই বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে, কোনো বন্ধুর খোঁজ করলাম না, কোথাও থামলাম না, একেবারে সোজা চ’লে এলাম সন্ধের পরে হাড়কাটা লেনে। আগে আর কখনো ঢুকিনি ঐ গলির মধ্যে, এক অদ্ভুত দৃশ্য আমার চোখের সামনে খুলে গেলো। আঁকাবাঁকা সরু গলির দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে শরীর নিয়ে স্ত্রীলোকেরা—ছড়িয়ে, সার বেঁধে, ঘেঁষাঘেঁষি, আবছায়ায়, ল্যাম্পোস্টের তলায়, আরো সরু কোণে গলির ফাঁক ভর্তি ক’রে—আর পুরুষেরা তাকাতে তাকাতে এগিয়ে যাচ্ছে ফিরে আসছে, ছোটো-ছোটো দলে, কেউ বা গোমড়ামুখে একা, কেউ ছাতার তলায় মুখ লুকিয়ে, কেউ ছায়ার মধ্যে ছায়ার মতো মিশে গিয়ে, কেউ বা রিকশাতে—কেউ ঈষৎ টলছে, কেউ গুনগুন গাইছে, কারো হাতে বেলফুলের মালা জড়ানো—কেউ বা কখনো রসিকতা ছুঁড়ে দিচ্ছে আর তক্ষুণি তার জবাব আসছে টিনের মতো ক্যানকেনে গলায়—আর ভিতর থেকে উড়ে এসে পড়ছে গান, ঘুঙুর, হার্মোনিয়াম, হল্লা। বৃষ্টি টিপটিপ, কাদা, গলিটা এত সরু আর লোক এত বেশি আর ঘেষাঘেষি যে আমার মনে হচ্ছে যেন মাথার উপরে আকাশ নেই আমার, যেন প্রকাণ্ড একটা পোড়ো বাড়িতে ঢুকে পড়েছি আর আমার সাড়া পেয়ে ন’ড়ে উঠছে ছাতাপড়া দেয়াল থেকে উইয়ের স্রোত, ফাটা মেঝের গর্ত থেকে সারি সারি পিঁপড়ে, ঝাপট দিচ্ছে দুর্গন্ধি চামচিকে, ঠাণ্ডা ব্যাং লাফিয়ে উঠছে পায়ে—যেন পৃথিবীর যাবতীয় জীবন্ত নোংরার মধ্যে হঠাৎ পথ হারিয়ে ফেলেছি। বমি পাচ্ছে আমার, হৃৎপিণ্ড উঠে আসছে গলায়, চোখ ঝাপসা, কোমরের তলাটা প্রচণ্ড চাপে ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু আমি মনস্থির ক’রে এসেছি আজ ফিরে যাবো না—যে-কোনো একটা মেয়ের সামনে থেমে পড়লুম। সে আমার গালে হাত বুলিয়ে বললো, ‘একেবারে কচি ছেলে দেখছি। তা এসো ভাই এসো!’ খানিকটা দুর্গন্ধ আর আবর্জনা পেরিয়ে তার ঘরে এলুম—একতলার ঘর, একটি মাত্র জানলা, খাটে বিছানা মেঝেতে ফরাশ দেয়ালে ছবিতে তিনটি মোটাসোটা যুবতীর শাড়ি উড়ে যাচ্ছে—আমি বেশ বয়স্কভাব ধারণ ক’রে মেয়েটাকে পাশে নিয়ে তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসলুম, কিন্তু ভেবে পেলুম না এখন আমার কী বলা উচিত বা করা উচিত, কানের মধ্যে পিঁপিঁ আওয়াজ হতে লাগলো। বোধহয় আমাকে উৎসাহ দেবার জন্যই মেয়েটি ডিবে থেকে পান বের ক’রে বললে, ‘খাবে? ‘আমি বিজ্ঞের মতো বললুম—কথা বলতে গিয়ে বড় মোটা শোনালো আমার গলা—’কী মসলা দিয়েছে তোমার পানে?’ ‘ কী মসলা দিয়েছি পানে?’ মেয়েটা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, তার শাড়িটাকে দু-হাতে ধ’রে বুক পর্যন্ত তুলে ফেললে, কোমর দুলিয়ে বললে, ‘এই মসলা?’ আর মুহূর্তে আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেলো, বরফের মতো ঠাণ্ডা। তারপর দেখলুম মেয়েটা শুয়ে পড়েছে হাঁটু উঁচু করে, শুনলুম একটা ভাঙা গলার আওয়াজ—’কী হ’লো? ব’ সে আছো কেন?’ -কিন্তু আমি কিছুতেই আর জন্তুটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। সে কুঁকড়ে গা ঢাকা দিয়েছে গর্তের মধ্যে, আমি তাকে যতই বলছি, ‘বেরিয়ে আয়! বেরিয়ে আয়, জোচ্চোর!’ ততই সে গুটিয়ে যাচ্ছে পোকার মতো। আমাকে দরজার কাছে দেখে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা, আমি কয়েকটা টাকা ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

ঘেন্না—কিন্তু ভোলা যায় না যে ব্যাপারটা, ও সব মেয়েরই শাড়ি-জামার ভলায় শরীর আছে। কুসুম—এমনকি কুসমেরও। হয়তো ক্লাশে বসে আছি, মাস্টারমশাই ফরাশি বিপ্লব পড়াচ্ছেন, হঠাৎ আমার মনে সামনে ভেসে উঠলো একটা ছবি: বাথরুমে কুসুম খুব নির্দোষ ও প্রয়োজনীয় ও স্বাস্থ্যকর কাজ করছে, ও-সব তাকেও করতে হয়, আর অমনি ক’রেই শাড়ি তুলে ধরতে হয় তখন। আমি মনে-মনে চীৎকার করি—’না, না, এ আমি মানবো না, এ মিথ্য, এ অসহ্য!’—দুই হাতে আঁকড়ে ধরি বাতাসের মতো অন্য এক কুসুমকে-শাদা লম্বা পোশাক তার পরনে, এক পুরানো বাড়ির বড়ো-বড়ো অন্ধকার ঘরে স্বপ্নের মতো তার ঝিলিমিলি। কুসুম, তুমি আমার প্রেম, তুমি আমার স্বপ্ন।

অন্য একটা কারণে আমি কষ্ট পেতুম মাঝে-মাঝে, যখন আমার সন্দেহ হতো, যে অন্য ছেলেদের তুলনায়—ধরা যাক সুব্রতর তুলনায়, আমি যথেষ্ট তুখোড় নই। আমি পরীক্ষায় উঁচু নম্বর পাই, অনেক দেশের অনেক বই পড়েছি, কিন্তু ওরা যে-সব খিস্তি বুলি আওড়ায়, যে-সব কথা বলাবলি ক’রে চায়ের টেবিল ফাটিয়ে দেয় এক-এক সময়, আমি সেগুলো বুঝতেই পারি না, আর ওরা যখন অনেক চেষ্টা ক’রে আমার মগজের মধ্যে সেঁধিয়ে দেয় অর্থটা, তখন আমি লাল হ’য়ে হাতের পাতায় মুখ লুকোই। আমি যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ছি তখনও আমি জানি না স্ত্রী-পুরুষের মিলনের পদ্ধতিটা ঠিক কীরকম, আর মাতৃগর্ভ থেকে সন্তানই বা ঠিক কোন রাস্তায় বেরিয়ে আসে, আর এ-সব ব্যাপার আড্ডায় শোনা, বাড়িতে বয়স্কদের মুখে শোনা নানা কথা মনে-মনে জোড়াতালি দিয়ে, আমি যেদিন সত্যি বুঝতে পারলুম সেদিন আমার লজ্জায় মরে যাবার দশা হ’ লো। ছি! কী কুৎসিত! কী জঘন্য! এই কি করতে হয়েছে সকলকে, করতে হবে সকলকে শুধু বেশ্যাদের সঙ্গে নয়, নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও—আমার মা-বাবা, তাঁরাও ? ছি! অন্য রকম কেন হ’লো না, ঠোঁটে ঠোঁটে চুমু খেলে যদি সন্তান হতো, নিশ্বাসের সঙ্গে নিশ্বাস মেশালে, বা কোন মেয়ে বা পুরুষ যদি একা-একা জন্ম দিতে পারতো, যেমন লেখা আছে মহাভারতে বাইবেলে-যেকোনো, অন্য যে-কোনো উপায় কি সম্ভব ছিলো না? এই একটা ব্যাপার একেবারে মেরে রেখেছে আমাদের, কেমন করে আমাদের প্রেম হবে সুন্দর—আর পবিত্র—আর মধুর যখন তার তলায় এই পাঁক, এই নোংরা, এই ঘেন্না? ধরা যাক কুসুমের সঙ্গে যদি কোনদিন আমার বিয়ে হয় তাহ’লেও কি-না, কিছুতেই না, অসম্ভব!

কুসুমের যখন বিয়ে হলো আমি তখন এম. এ. পড়ছি। আমি কিছুটা কষ্ট পেলুম যেহেতু ইচ্ছে হ’লেই তাকে আর দেখতে পাবো না (তার স্বামী ডেপুটি-ম্যাজিস্ট্রেট, মফস্বলে থাকেন), কিন্তু মনের তলায় সুখীও হলুম এই ভেবে যে চেখভের গল্পের মতো আমার এটাও ব্যর্থ প্রেম হ’লো। মনে মনে বললুম, ‘যে প্রেম বিয়োগান্ত সেটাই বেশি গভীর, কুসুম আমারই রইল–সুর, স্বপ্ন, সুগন্ধ হ’য়ে।’ শরীরটাকে বাদ দিলেই প্রেম সত্য হয়, আর যাতে শরীরের অংশ আছে সেটা প্রেম হ’তেই পারে না, এই ধারণা তখনও আমাকে ছেড়ে যায়নি। কিন্তু একবার একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতা হ’লো আমার-কুসুমের সঙ্গেই।

বিয়ের কয়েক মাস পরে কুসুম কলকাতায় এলো, ওর স্বামী ইস্টারের ছুটি কাটিয়ে দিনাজপুরে ফিরে গেলেন। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসে কুসুম—বিয়ের পর স্বাধীনতা অনেক বেড়ে গেছে তার, আমার সঙ্গে ব্যবহার অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ, আমি তাকে মনে-মনে ‘প্রেমিকা’ বলে ভাবি আর ঐ ভূমিকা মেনে নিতে তারও আপত্তি নেই—চোখে চোখে এই বার্তা বিনিময় করি আমরা। একদিন—সে-রাতটা আমাদের বাড়িতেই ছিলো সে-রাত্রে খাওয়ার পর কুসুম আমার ঘরে এলো-তেতলার কোণের ঘর সেটা—আমার বিছানায় বসে আজেবাজে গল্প করলো অনেক্ষণ, আস্তে আস্তে নিঝুম হয়ে এলো বাড়ি, কুসুম বললে, ‘আমার ক্লান্ত লাগছে, একটু শুয়ে নিই।’ বালিশে মাথা রেখে বললে, ‘সুন্দর জ্যোছনা, আজ আলোটার কি দরকার আছে’—চৈত্রমাস, জলের মতো জ্যোছনা, পাগলের মতো হাওয়া, চাঁদের আলো তার ঠোঁটে আর গালে, চোখ আরো কালো আর গভীর—শুধু চুমো খেয়ে খেয়ে সেই রাতটা কাটিয়ে দিলুম আমরা, সুব্রত যে রকম বর্ণনা দিয়েছিলো তেমনি। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলুম না, আমার হাত দুটো একেবারে বেকার রইলো, শুধু ঠোঁট খুলে শুষে নিলাম তার মুখের নিশ্বাস—সুগন্ধি ভেজা ফেনা যেন অফুরন্ত, শিয়রে ব’সে নিচু হয়ে ডুবিয়ে দিলাম আমার মুখ ঐ সুস্বাদু উৎসের মধ্যে—শুধু এ-ই, আর কিছু নয়-কামনা ও সংযম, সাধ্বিতা ও সম্ভোগ, ব্রহ্মচর্য ও ইন্দ্রিয়-বিলাসের এক অদ্ভুত মিশ্রণে কেটে গেলো সেই হাওয়ায় আর জ্যোছনায় উতল রাত্রিটা। আশ্চর্য এই যে অন্য কোনো ইচ্ছে জাগলো না আমার, কুসুমও এমন কোনো ভঙ্গি করলে না যে আরো কিছু চায়, হয়তো ভাবছিলো ওইটুকুই নিরাপদ কিংবা হয়তো নিরাশ হয়েছিলো আমার ব্যবহারে—তারপর সে আর রাত কাটায়নি আমাদের বাড়িতে, পাছে আরো এগোতে হয় সে-কথা ভেবে ইচ্ছে ক’রেই এড়িয়ে গেছে হয়তো—কিন্তু আরো এগোবার কথা, আশ্চর্য, আমার মাথাতেই খেলেনি আমার কোনো অতৃপ্তি ছিলো না, আমি তখনও ছেলেমানুষ তখনও রোমান্টিক—তারপর কয়েকটা দিন যেন সারাক্ষণ ঘোরের মধ্যে কাটলো আমার, স্নায়ুতন্ত্রে এক নতুন শিহরণ, মুখের মধ্যে এক নতুন সুগন্ধ, যেন আমার স্বপ্নকে আরো কাছে পেয়েছি, প্রমাণ পেয়েছি, স্বপ্নটা নেহাত বইয়ে পড়া ব্যাপার নয়।

আমার বিয়ের রাত, আজকের মতোই রাত ভ’রে বৃষ্টি, আজকের মতোই পাশাপাশি শুয়ে নির্ঘুম ছিলো সেই রাত্রি, কিন্তু ঠিক আজকের মতো নয়। এক বছরের মেলামেশা উৎকণ্ঠিত আশার পরে কাছে পেয়েছি মালতীকে, তার পাশে শুয়ে আছি মেঝের উপর নতুন জাজিমের বিছানায়, জাজিমের উপর চিকনপাটি পাতা, ঘরের কোণে তেলের দ্বীপ জ্বলছে। হিন্দুমতে বিয়ে হয়েছিলো আমাদের (আমার তাতে মন ছিলো না), ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জি রোডে ভাড়া বাড়িতে লগ্ন রাত দেড়টায়, পালা ফুরোতে আরো কত বাজলো কে জানে-মালতীকে আবার উপোস করিয়েও রেখেছিলেন তার মা—আগে ভাবতুম ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর,সময়ের এ-রকম অপব্যয় আর কিছু নেই, কিন্তু ঘন্টাগুলি কেমন করে কেটে গেল টের পেলুম না, আমি শুয়ে আছি মেঝের উপর নতুন জাজিমের বিছানায়, ঘরের কোণে পিলসুজে পিতলের প্রদীপ, সারা ঘরে ছায়া, সারা ঘরে জুঁইফুলের গন্ধ, টাটকা নতুন বেনারসির ফিশফিশে আওয়াজ, আমি তাকে ভালো দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু অনুভব করছি প্রতিটি রক্তকণিকায়, একটা প্রকান্ড পাকা আতার মতো ফেটে যাচ্ছি আমি, যেন সব বীজ ছিটকে বেরিয়ে আসছে-স্তব্ধতা, রাত্রি নিবিড়, বৃষ্টির শব্দ, আমি একবার চুমু খেলাম তাকে, ঠিক চুমুও নয় শুধু ঠোঁটের উপর ঠোঁট ছোঁয়ালাম একবার, পালকের মতো হালকা, একবার হাত রাখলাম তার স্তনের উপর-পাখির মতো নরম, আর উষ্ণ, আর জীবন্ত—মনে হ’লো আমার হাতের তলাতেই তার হৃৎপিণ্ড ঢিপঢিপ করছে, মনে হ’লো তার এলিয়ে-থাকা হাতের মুঠোয় আমার হৃৎপিণ্ড—শুধু এ-ই, আর কিছু নয়, রাত ভ’রে বৃষ্টির শব্দ, আমরা একজনও ঘুমোইনি শুধু পাশাপাশি শুয়ে অনুভব করেছি পরস্পরকে—আমরা এখন বিবাহিত, স্বামী-স্ত্রী, প্রাণ যা চায় রক্ত যা বলে তা-ই আমরা করতে পারি এখন, কিন্তু কিছু না করাটাই আমার মনে হলো ভালো—সুন্দর—আনন্দময়—আমি এখন তাকে পেয়েছি তাই অপেক্ষা করাটাই চরিত্রবান-বলো, মালতী, তুমিকি নিরাশ হয়েছিলে?

বিয়ে করে আমি সুখী হয়েছিলাম—সচেতনভাবে, পরিপূর্ণভাবে সুখী। মালতীর সঙ্গে আমার চেনা হবার কিছুদিন পরেই টের পেলুম যে আমি ওর শরীরটাকে আকাঙক্ষা করছি। আমার কাছে অন্তহীনরূপে কাম্য হয়ে উঠেছে ওর চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সমস্ত শরীর—অথচ আমার প্রেমের স্বপ্নকে তা মলিন ক’রে দিচ্ছে না বরং গাঢ় করে তুলছে। যে-সব অবস্থায় কুসুমকে কল্পনা করে আমি আঁতকে উঠেছি সবই যেন মালতীর পক্ষে শোভন; ওর শরীরের কোনো প্রকাশ নেই যা অসুন্দর, আমার মনে হয় ওর গালের ঘাম আমি চেটে নিতে পারি, ওর চিবানো খাবার খেয়ে নিতে আমার বাধবে না, যেদিন গিয়ে দেখি ও মাসিকের ব্যথায় কাতর হ’য়ে শুয়ে আছে সেদিন ওর প্রতি আমার আকর্ষণ আরো বেড়ে যায়। এই সেই মেয়ে, যাকে আমি একই সঙ্গে ভালোবাসতে আর ভোগ করতে পারবো—তাই আমার মনে হ’লো তখন—ওরই কাছে এসে এতদিনে আমার শরীরমনের ঝগড়া মিটে গেলো। এতদিন যেন দু-টুকরো হ’য়ে অস্থিরভাবে বেঁচে ছিলাম, এবারে আমার দুই অর্ধেকে জোড়া লেগে গেলো, আমি আস্ত একটা মানুষ হ’তে পারলাম। আমার বিয়েতে, আর মালতীর মধ্যে এইটেই আমার মনে হ’লো সবচেয়ে আশ্চর্য আর সবচেয়ে সুন্দর—এই যে আমার মন এখন জন্তুটার সঙ্গে দোস্তালি পাতিয়েছে, জন্তুটাও রোগা হ’য়ে যাচ্ছে না অথচ আমার মনের মধ্যে গুনগুন সুর আর সুগন্ধ আমাকে বাতাসের মতো ঘিরে আছে—জীবনে এই প্রথম আমার নিজেকে মনে হ’লো পুরোপুরি মানুষ, পুরোপুরি পুরুষ, স্বাধীন, আত্মস্থ, স্বাবলম্বী।

কিন্তু তাও, তাও তোমার ছেলেমানুষি, নয়নাংশু, প্রথম থেকেই তোমার বিয়ে ছিলো ফাঁকি—আর তা মালতীর নয়, তোমরাই দোষে। অসীম তোমার অবজ্ঞা সেই সব বাঙালি যুবকদের উপর যারা লাভের জন্য হিশেব ক’রে বিয়ে করে—রূপ, শ্বশুরের টাকা, সামাজিক মর্যাদা, সব এক বড়শিতে গাঁথার আশায় এম, এ. পাশ ফ্যাশনেবল চাকুরে হ’য়েও বিজ্ঞাপন দেয় খরবকাগজে, কিংবা যারা ‘প্রেম বিবাহ’ করে বন্ধুদের কাছে তাদের রাত্রিবেলার নতুন-নতুন অভিজ্ঞতার গল্প করে রসিয়ে। কিন্তু তুমি, পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক, তুমিই বা কি-রকম প্রেমিক আর স্বামী ছিলে জিগেস করি? মনে আছে—বিয়ের আগে মালতী যখন কালিম্পঙে বেড়াতে গেলো তার মা-র সঙ্গে, তুমি যে সব লম্বাচওড়া চিঠি লিখতে সেগুলিকে মালতী কেমন ঠাট্টা ক’রে বলতো আবহাওয়া-সংবাদ’! যে উপন্যাস তুমি কখনো লিখতে পারবে না তারই কয়েকটা ছেঁড়া পাতা ছিলো সেই চিঠিগুলো—মেঘলা দিন, সেদিনকার কাগজের কোনো খবর, চৈত্রের দুপুরে চৌরঙ্গির ট্রাম—এমনি সব বিষয়ের ছুতোয় তুমি নিজের মনটাকে খুলে দেখাতে যেন মালতী তোমার কোনো পুরুষ-বন্ধু—মেয়ে নয়, প্রণয়িনী নয়, যেন তোমার চিঠিতে সে এই কথাটা শুনতে চাচ্ছে না যে তার অভাবে তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছো! কিন্তু ঐ কথাটা তুমি কখনো লিখবে না—যদিও সেটাই সত্য—তা লিখতে তোমার আত্মসম্মানে বাধে, সেটা সাধারণত, সেটা ‘অন্যদের মতো’ ! ভেবে দ্যাখো বিয়ের পরে প্রথম ক’ মাস, তুমি তাকে কবিতা পড়ে শোনাও, বেছে-বেছে বলো পুরাণ ইতিহাস সাহিত্য থেকে বাছা-বাছা প্রেমের কাহিনী, বুঝেও বোঝো না সে বিরক্ত হচ্ছে, শুনছে না, হাই চাপছে—যখন তোমার প্রেম করার কথা তখন প্রেম বিষয়ে কথা ব’লে ব’লে অমূল্য সময় হেলায় নষ্ট করো, লক্ষ্যও করো না যে তোমার স্ত্রীকে যথেষ্ট ভালোবাসতে পারছো না তুমি, তাকেও যথেষ্ট সুযোগ অথবা অবকাশ দিচ্ছো না তোমাকে ভালোবাসার। আর আজ—আজ তো দেখছো যে-প্রেম নিয়ে চৌদ্দ বছর বয়স থেকে এত কথা তুমি ভেবেছো আর বলছো তার সত্যিকার চেহারাটা কী—ঐ জয়ন্ত, স্হূল, অশিক্ষিত, বেপরোয়া, তারই জন্য আজ খুলে গেল টিৎসিয়ানোর কোনো ছাত্রের আঁকা পক্কযুবতী শ্যামাঙ্গী এক ভেনাসের শরীর। আর, তুমি, শুয়ে শুয়ে ভাবছো, শুধু ভাবছো—যেমন ভেবেছো জীবন ভরে, বড় বেশি ভেবে-ভেবে তুমি অক্ষম হ’য়ে গিয়েছে, নয়নাংশু। তা না-হ’লে এতদিনে কি অপর্ণার দিকে আর একটু বেশি মনোযোগ দিতে না?

কী করতে বলো আমাকে? মালতীকে ছেড়ে দিয়ে অপর্ণাকে বিয়ে করবো? বোকা—বিয়ে কেন করতে হবে? আর কত স্পষ্ট করে একজন ভদ্রমহিলা জানাতে পারে যে সে এমনিতেই রাজী? স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হবার পর থেকে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে অপর্ণা, নিজে চাকরি ক’রে চালায়, ছেলে-পুলে নেই ঝামেলা নেই, চমৎকার–তোমাকে তার পছন্দ, আর তোমারও যে তাকে খারাপ লাগে তা তো নয়। তা’হলে কেন ক্ষণিকের মধু লুটে নেবে না ফুল যদি এগিয়ে আসে? কিন্তু আখেরে যদি প্রেমে প’ড়ে যাই, যদি সত্যি ভালোবেসে ফেলি? তবে তো আরো ভালো; বেশ খানিকটা দুঃখ নিয়ে বিলাস করতে পারবে। না, আমি আর ঝড়-ঝাপটা চাই না, আমি নিরিবিলি নিজের মনে থাকতে চাই, ঐ নৈশ অনুষ্ঠান বাদ দিয়েও কাটাতে পারবো জীবনটা, বাদ দেওয়াটাই অভ্যেস হয়ে গেছে মালতীরই সৌজন্যে।—ভীতু, অক্ষম। শরীরকে তোমার ভয়, ভালোবাসাকে তোমার ভয়। ভালোবাসাকে নয় হয়তো। একই—ও-দুটো জিনিস একই, নয়নাংশু । ভালোবাসায় শরীরই আসল—আরম্ভ, শেষ, সব ঐ শরীর । আধা-বয়সী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অত ঝগড়াঝাঁটি খিটিমিটি কেন? যেহেতু তাদের শরীর প’ড়ে আসছে। বুড়ো স্বামী-স্ত্রীরা নানাভাবে উৎপীড়ন করে কেন পরস্পরকে? যেহেতু তাদের শরীর ম’রে গেছে। প্রতিহিংসা-প্রকৃতির উপর প্রতিহিংসা। ভালোবাসা জৈব, ভালোবাসা যৌন, শরীর না-থাকলে কিছুই থাকে না ভালোবাসার। বিদ্যুতের মতো, বৈদ্যুতিক সংস্পর্শের মতো—শরীরের সঙ্গে শরীরের প্রেম। ঘরে সব সময় আলো জ্বালাতে হয় না কিন্তু সুইচ টিপলেই জ্ব’লে ওঠে, যেহেতু তারের মধ্যে বিদ্যুৎ চলছে সব সময়। এও তেমনি। আছে শরীরে শরীরে বৈদ্যুতিক যোগ, তাই যখন প্রেম করো না তখনও থাকে প্রেম, শিরায়-শিরায় বয়ে চলে সারক্ষণ—তাই কথা মধুর, হাসি মধুর, কাছে থাকা মধুর, দূরে যাওয়া মধুর কলহ মধুর কলহের পরে মিলন আরো বেশি মধুর। সবই শরীর। সেই যোগ আজ নষ্ট হ’য়ে গেছে তোমার সঙ্গে মালতীর, শরীরে-শরীরে বিদ্যুৎ আর ব’য়ে যায় না, তাই-যতই তুমি সুইচ টেপো মিস্ত্রি ডাকো আলো আর জ্বলবে না, পাওয়ার-হাউস ফতুর হয়ে গেছে। কিন্তু অন্য কোথাও তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ, তোমার আর অপর্ণার মধ্যে, খোরাক না-পেয়ে মরে যাচ্ছে, তোমার শরীর ,তাকে আবার জাগাতে পারবে অপর্ণা, সে পারবে তোমাকে যৌবন ফিরিয়ে দিতে—ওঠো, জেগে ওঠো, নয়নাংশু, মনস্থির করো, কাল তুমি অপর্ণাকে ডিনারে বলবে পার্ক স্ট্রীটের কোনো রেস্তোরাঁয়, প্রচুর মদ খাবে এবং খাওয়াবে—তারপর যাবে তার ফ্ল্যাটে, তাকে ট্যাক্সিতে পেীছিয়ে দেবে আর সে বলবে একটু আসুন এক পেয়ালা কফি খেয়ে যান—তোমর ভীরুতা ছাড়া কোনো বাধা নেই, নয়নাংশু, তোমার চল্লিশ হ’তে আর দেরি কী, এখনো কী শক্তপোক্ত পুরুষ হবে না?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন