রাত ভ’রে বৃষ্টি – ৪

বুদ্ধদেব বসু

চার

কোনো—কোনো কথা বাংলা ভাষায় বলা যায় না। বিদেশী গল্প অনুবাদ করার সময় বার-বার আমি থমকে গিয়েছি যখনই কেউ কাউকে বলেছে—’I love you’ বা ‘Do you love me? বাধ্য হয়ে লিখেছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি’, ‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? কিন্তু নিজের কানেই খাপছাড়া শুনিয়েছে, বানানো, কৃত্রিম—এটা আমাদের কাছে বইয়ের ভাষা, ভাবনার ভাষা—মুখের নয়। আমরা অনেক কিছুই ভঙ্গি দিয়ে বোঝাই, ‘গুড মর্নিং’ না ব’লে একটু হাসি শুধু, আমাদের প্রেমের প্রকাশ চোখে চোখে, হাতের ছোঁওয়ায়, সাধারণ কথার মধ্যে লুকিয়ে রাখা গভীরতর কথায়। আর যে-দেশে এখনো অসংখ্য লোক পাতানো বিয়ে করছে, আর সেই বিয়েটাকে মেনে নিচ্ছে অবশিষ্ট জীবনের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব’লে, সে-দেশে ‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসা’র মতো উকট প্রশ্ন মুখে আনার উপলক্ষ ঘটে শুধু একমুঠো দুর্ভাগ্য মানুষের জীবনে।

আমি সেই দুর্ভাগাদের একজন, ঠিক ঐ প্রশ্নটি সম্প্রতি আমাকে কয়েকবার মুখে আনতে হয়েছে। কিন্তু বলবার ভাষা ঠিক খুঁজে পাইনি—এত শক্ত ওসব কথা বাংলায় বলা। ‘মালতী, তুমি কি আমাকে আর ভালোবাসো না?’ বাজে, বিশ্রী, নাটুকে, কিন্তু ঢোঁক গিলে ঐ কথাগুলোই আমি মুখে এনেছিলাম বা ওরই কাছাকাছি কিছু-একবার নয়, অনেকবার। মালতী প্রথমে বলেছে, ‘এ আবার কী-রকম বোকার মতো প্রশ্ন!’ কিন্তু আমি যখন অনেকদূর পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে গিয়েছি প্রশ্নটাকে তখন মালতী ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠেছে ‘হ্যাঁ, বাসি, বাসি! হলো? যাও এবার নিজের কাজ করো, আর গোয়েন্দার মতো জেরা করো না।’

হায়, ভালোবাসো! যেন তা মুখের কথার উপর নির্ভর করে—যেন তা চোখে ভেসে ওঠে না, ধরা পড়ে না গালের রঙে, হাতের নড়াচড়ায়, এমন কি পর্দা ঠেলে ঘরে ঢোকার ধরনে, নিচু হ’য়ে চা ঢেলে দেবার ভঙ্গিটুকুতে পর্যন্ত ! তা আলোর মতো সহজ, রোদের মতো নির্ভুল—সেখানে কোনো তর্ক নেই, তা চিনে নিতে এক মুহূর্ত দেরি হয় না। এই কথাটাই আমি বলার চেষ্টা কবেছিলাম মালতীকে অনেক কষ্টে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে-তুমি যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসো আমি কেন তা অনুভব করি না? কেন করো না তা আমি কী ক’রে বলবো! ব্যস, এর উপর আর কথা নেই। একটা দেয়াল, বোবা দেয়াল, মাথা ঠুকলে শুধু মাথা ঠোকার প্রতিধ্বনি বেরোবে।

জয়ন্ত তখন মাসখানেক ধ’রে আসছে এ-বাড়িতে—ওরই মধ্যে কায়েমি হ’য়ে বসেছে—এক রাত্রে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। জয়ন্ত, মালতী, আমি—আমরা তিনজনে বাস্-এর জন্য দাঁড়িয়ে আছি—ভিড়ের জন্য দুটো বাস ছেড়ে দিতে হলো, আর-একটা এসে দাঁড়াতেই মালতী উঠে পড়লে তাড়াতাড়ি, তারপর জয়ন্ত, কিন্তু আমি হাতল ধরা মাত্র ছেড়ে দিলো বাটা, জয়ন্ত হাত নেড়ে কেমন একটু হাসলো আমার দিকে—আমি তক্ষুণি বুঝলাম ওটাই ওরা চেয়েছিলো, মালতী আমাকে ছেড়ে চ’লে গেলো জয়ন্তর সঙ্গে—মালতী আমাকে ছেড়ে চ’লে গেলো। আমি ছুটলাম সেই বাস্-এর পিছনে, কিন্তু প্রকাণ্ড দোতলা বাসটা মুহূর্তে হারিয়ে গেলো আমার চোখ থেকে। আমি স্বপ্নের মধ্যে বুক-ভাঙা একটা কষ্ট অনুভব করলাম যেন আমার সর্বস্ব হারিয়ে গেলো,—যেন আমার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড আর নেই, ওরকম একটা বিরাট ক্ষতির অনুভূতি আর কখানো হয়নি আমার—সেই কষ্ট নিয়েই জেগে উঠলাম অন্ধকারে। অন্ধের তো হাত বাড়িয়ে দিলাম মালতীর দিকে (তখনও আমরা জোড়া খাটে শুচ্ছি) আমার হাত তাকে স্পর্শ করলো। তবু আমি আশ্বস্ত হ’তে পারলাম না, ঠেলা দিয়ে ডেকে বললাম, ‘মালতী, শোনো।’ ঘুমের গলায় জবাব এলো, ‘কী হয়েছে?’ আমি বিছানায় উঠে ব’সে বললাম, ‘আমি এইমাত্র স্বপ্ন দেখলাম জয়ন্তবাবু তোমাকে নিয়ে পালিয়ে গেছেন।’ ‘সে আবার কী?’ আর কিছু বললো না মালতী, আমি অন্ধকারে চোখ সরু করে তার চোখ দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে উল্টো দিকে পাশ ফিরে বললে, ‘ঘুমোও’ তারপর আর তার সাড়াশব্দ পেলাম না, খানিকক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লাম। জানি না মালতীর মনে আছে কিনা, কিন্তু আমি এই স্বপ্নটা এখনো ভুলিনি, তুলবো না কোনোদিন। এই স্বপ্নের কথা ভাবলে এখনো ভীষণ কষ্ট হয় আমার, এখনো মনে হয় আমার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড আর নেই, সে তুলনায় আজ কোনো কষ্টই পাচ্ছি না, আজ আর কিছু এসে যায় না কিছুতেই।

মালতী ভালোবাসে জয়ন্তকে, এই কথাটা ও নিজে বোঝার আগেই আমি বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম ওর চোখের দিকে তাকিয়ে, ও যখন জয়ন্তর দিকে তাকায় সেই তাকানোর দিকে তাকিয়ে। ভেজা-ভেজা চোখ, যেন দূরের কিছু দেখার চেষ্টায় ঈষৎ সংকুচিত, মাঝে-মাঝে আধো বুজে আসে যেন ঘুম পেয়েছে। ওর ঐ দৃষ্টি আমার চেনা; বিয়ের আগে, বিয়ের পরেও কয়েক মাস, ঠিক অমনি করেই আমার দিকে ও তাকাতো-বা আমার দিকে তাকালে ওর দৃষ্টি হ’য়ে যেতো ওরকম—ঐ রকমই সজল দেখাতে ওর দাঁত হাসতে গেলে বা কথা বলতে গেলে। স্পষ্ট—সব স্পষ্ট আমার কাছে, যেন প্রকাণ্ড ব্যানার দিয়েছে কাগজে, যেন আমার ঘরের দেয়ালে বিরাটা হরফের প্ল্যাকার্ড আঁকা। কিন্তু মালতী নিজেকে দেখতে পায় না, তার নিজের চোখ অচেনা তার কাছে, তাই আমি প্রথম কিছুদিন ওকে লক্ষ্য করার সুযোগ পেয়েছিলাম—যেন নিশ্চিন্তে, যেন ব্যাপারটায় আমার কোনো অংশ নেই। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখলাম ওর চোখের সরলতা মুছে যাচ্ছে, দেখলাম সূক্ষ্ম রেখা মাঝে মাঝে ওর কপালে, জয়ন্তর সঙ্গে কথা বলার সময় ঠোঁটের কোণ কেমন বেঁকে যায় একটু, আমার খাওয়া-দাওয়া জামাকাপড়ের দিকে হঠাৎ বড় বেশি মনোেযোগী হয়ে উঠলো। এতদিন ও ভেবেছিলো ও শুধু জয়ন্তর পুজো নিচ্ছে, বিনিময়ে কিছুই দিচ্ছে না বা দিতে হবে না, কিন্তু এবারে ওর নিজের মনের চেহারা আর লুকানো রইলো না ওর কাছে, আর তখন থেকেই শুরু হ’লো , চলতে লাগলো—এই ঝাউতলা রোডের দেয়ালের মধ্যে, এই সুন্দর করে সাজানো ফ্ল্যাটে, দিনের পর দিন—একটা যুদ্ধ!

‘ঠাণ্ডা’ যুদ্ধ, ঘোষিত হয়নি, চোখে-চোখে যুদ্ধ, পা ফেলার যুদ্ধ, কথার তলে লুকিয়ে-থাকা কথার তীরন্দাজি। অনেক কথা আছে যা বলা যায় না বাংলায় না, অন্য কোনো ভাষাতেও না—যা বলার জন্য অন্য কিছু বলতে হয় আমাদের, কিংবা যা বলা না-হলেও সবাই বুঝে নেয়। একবার এক ধোপা ভারি মুশকিল বাধিয়েছিলো; মালতীর দু-খানা সিল্কের শাড়ি নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছে না সে—একমাস, দেড়মাস, প্রায় দু-মাস কেটে গেলো। মালতী দু-বার কেষ্টকে পাঠালো—একবার শোনা গেল জগাই ধোপা জ্বরে ভুগছে, আর একবার তার দেখা পাওয়া গেলো না। ‘চাকর দিয়ে কি আর সব কাজ হয়! বাড়ির কর্তা একেবারে ন’ড়ে বসবে না—আর শাড়ি দুটো খোয়া গেলেই বা। তার কী!’ মালতীর এ-সব স্বগতোক্তি কয়েকবার কানে আসার পর বললুম, ‘কেষ্টকেই আর একবার পাঠিয়ে দ্যাখো না।’ এবারে কেষ্ট ফিরে এসে বললো—কালই আসবে জগাই ধোপা, কিন্তু তার পরেও যখন দশ-বারোদিন কেটে গেলো তখন একদিন সন্ধেবেলা মালতী একটি বক্তৃতা দিলো ধোপাদের অসভ্যতা বিষয়ে—জয়ন্ত ছিলো, আরো অনেকে—কেমন নির্বিবাদে তারা কাপড় হারায়, ছেড়ে, আটকে রাখে, নিজেরা ব্যবহার করে, জমিয়ে রেখে পচিয়ে দেয়, ভালো জিনিসগুলো ভাড়া খাটায়, ইস্ত্রি করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফ্যালে, অথচ পাওনা আদায়ের সময় এক ফুটো পয়সা কম নেবে না—এ-সব কথা সাত কাহন হ’লো সেদিন, অন্যেরাও যোগ দিলো মাঝেমাঝে, দেখা গেলো অনেকেই ধোপার অত্যাচারের ভুক্তভোগী। জয়ন্ত জিজ্ঞেস করলে, ‘ব্যাটাচ্ছেলের নাম কী? যে আপনার শাড়ি নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না?’ ‘জগাই।’ ‘জগাই ধোপা-কোথায় থাকে?’ ‘ঢাকুরেতে’। আর কিছু বললো না জয়ন্ত, অতক্ষণ ধ’রে ধোপচর্চা শুনে বিরক্ত লাগছিলো আমার, এই সুযোগে কথা ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করলুম, ‘আচ্ছা চণ্ডীদাসের রামী কি সত্যি ধোপানি ছিলো?’

পরের দিন ছিলো রোববার, বেলা প্রায় দুটো, আমরা একটু আগে খেয়ে উঠেছি, হঠাৎ শীত চ’লে গিয়ে গরম পড়েছে কলকাতায়, পাখা চলছে, জানালা বন্ধ, মালতী পাটি পেতে কয়েকটা পত্রিকা নিয়ে শুয়ে পড়েছে, আমি হেমিংওয়ের একটা গল্প তর্জমা করতে বসেছি, এমন সময় বসার ঘরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো। প্রথমে মালতী, তারপর আমি উঠে এলুম। জয়ন্ত এসেছে, সঙ্গে একটি কালোকেলো লোক যাকে আমি ঠিক চিনতে পারলুম না, কিন্তু অনুমানে বুঝলুম সেই জগাই ধোপা। জয়ন্ত বলল, ‘মিসে মুখার্জি, এই নিন আপনার শাড়ি। ঠিক আছে তো?’ তারপর জাগাইয়ের কাঁধে একটা গুঁতো দিয়ে বললে, ‘দ্যাখ তোর সামনে কে!’ মালতীর দিকে তাকিয়ে জগাই বিড়বিড় করে কী বললো বোঝা গেলো না—বোঝার কোন দরকার ছিলো না অবশ্য—আমি দেখলুম মালতী কেমন একদৃষ্টিতে জয়ন্তর দিকে তাকিয়ে আছে, জয়ন্তর চোখ লাল, ঘামছে দরদর করে—এক পলকে বুঝে নেওয়া যায় কত হাঙ্গামা ক’রে এই শাড়ি সে উদ্ধার করেছে, শুধু শাড়ি নয়, অপরাধী ধোপাকেও সশরীরে এনে উপস্থিত করেছে মালতীর কাছে। ‘তাকিয়ে দ্যাখ কে এসেছে!’ যেন রানীর সামনে চোর ধরে আনা হয়েছে বিচারের জন্য, মালতী যেন জগাই ধোপার দণ্ডমুণ্ডের কর্তী, যেন আশা করা হচ্ছে জগাই মালতীর পায়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠবে—আর মালতী, সেও দিব্য রানীর পার্টের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে, যেন ধ’রে নিচ্ছে অধীন জয়ন্ত তার জন্য না-করতে পারে এমন কাজ নেই, যেন ইচ্ছে করলে এই ধোপার অস্তিত্বসুদ্ধ সে মুছে দিতে পারে এখন—এই সবই আমি এক মুহূর্তে দেখে নিলাম, বুঝে নিলাম। মালতীর সেদিনকার চেহারাটা গাঁথা হ’য়ে আছে আমার মনে—তার পিঠের চুল ছিলো খোলা, পরনে টুকটুকে লাল পাড়ের শাড়ি, পানের রঙে টুকটুকে ঠোঁট, দাঁড়িয়েছে একটি দয়া আর গর্ব মেশানো সুন্দর ভঙ্গিতে, আর তার চোখ—তার চোখ জয়ন্তর মুখ থেকে নড়ছে না, আর তার গালে ছড়িয়ে পড়েছে এক গভীরতর আভা, তার রক্ত চঞ্চল হ’য়ে সারা মুখে আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে—লাল, উজ্জ্বল, বিজয়ী ।

আর-একদিন আপিশ থেকে ফিরে দেখি বুন্নির জ্বর, জয়ন্ত তার মাথা টিপে দিচ্ছে শিয়রে ব’ সে। আমি ঘরে ঢোকামাত্র মালতী বললো, ‘স্কুল থেকেই জ্বর নিয়ে ফিরেছে, গলাব্যাথাও আছে—একবার কুমুদ ডাক্তারকে ডেকে আনবে নাকি?’ আমি বললুম, ‘পাশের ফ্ল্যাট থেকে ফোন ক’রে দাও না।’ ‘করেছিলুম-ডাক্তার ছিলেন, না তখন আর অন্যের বাড়ি থেকে বারবার ফোন করা যায় না তো।’ ‘কুমুদ ডাক্তার সাতটার আগে চেম্বারে আসেন না, আমি চট ক’রে স্নানটা সেরে নিই।’ বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি জয়ন্ত নেই। ‘জয়ন্তবাবু কোথায় গেলেন?’ এর উত্তরে মালতী বললো, ‘তাঁর শুয়ে-বসে দিন কাটে না তিনি কাজের লোেক, ডাক্তার ডাকাতে গেলেন।’ ঠাণ্ডা গলায় বললো এই কথাটা—রাগের ভাবে নয়, খুব সাধারণ সুরে। সে-মুহূর্তে কিছু-একটা ঘটে গেলো আমার মধ্যে—অন্ধ, রাগে দুঃখে আক্রোশে অন্ধ, আমার মগজে একটা বিষাক্ত পোকা বনবন ক’ রে ঘুরতে লাগলো ‘তুমি শুয়ে-বসে দিন কাটাও, তুমি শুয়ে-বসে দিন কাটাও!’ আমি নিঃশব্দে সিড়ি দিয়ে নেমে গেলাম, বড়োরাস্তায় এসে হঠাৎ ট্রামে উঠে পড়লাম; নামলাম গড়িয়াহাটের মোড়ে, একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চা খেলাম এক পেয়ালা, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিড় দেখলাম, হাঁটতে লাগলাম লেকের দিকে ফিরে এলাম, সিগারেট আর দেশলাই কিনলাম, লেকে এসে একটা বেঞ্চিতে ব’সে রইলাম খানিকক্ষণ, আবার আস্তে-আস্তে গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে বাড়িমুখো ট্রাম ধরলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে ক্লান্ত লাগছিলো আমার, অসম্ভব ক্লান্ত, বসার ঘরের দরজার কাছে দম নেবার জন্য দাঁড়ালাম একটু। ভিতর থেকে চাপা গলার আওয়াজ আসছে, কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না, শুধু গলার আওয়াজ—কোনো বিষাক্ত পোকার উড়ে-চলা খসখসানির মতো, সূক্ষ, খুব মৃদু, অস্পষ্ট, মাঝে মাঝে।

আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা দুজনেই হঠাৎ চুপ ক’রে গেলো।

জয়ন্ত ফুর্তির সুরে বললো ‘এই যে মশাই—হঠাৎ কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? কিছু ভাববেন —আমি একেবারে বাড়ি থেকে ধ’রে এনেছিলাম ডাক্তারকে, বুন্নি ভালো আছে, ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো এইমাত্র।’

ভিতর থেকে অস্ফুট আওয়াজ এলো, ‘মা!’

‘এই যে আমি!’ মালতী উঠে বুন্নির কাছে চ’লে গেলো, একটু পরে জয়ন্তও উঠলো, শশাবার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো, ‘মিসেস মুখার্জি, আমি চলি আজ। এগারোটার সময় ওষুধটা আর-একবার দেবেন কিন্তু।’ আমার প্রায় ইচ্ছে হ’লো জয়ন্তকে আরো খানিকক্ষণ ধরে রাখি, প্রায় ভয় করলো ভাবতে যে এই ফ্ল্যাটটার মধ্যে মালতী আর আমি একা থাকবো সমস্ত রাত । ভাগ্যিশ বুন্নির আজ অসুখ—কোনো কথাবার্তা না-বলার একটা অছিলা আছে অন্তত। এর কয়েকদিন পরে মালতী আমাদে খাট দুটোকে আলাদা করে দিয়ে শোবার ঘরটা একটু অন্যভাবে সাজালো, আমি কোনো উচ্চবাচ্য করলুম না।

এটা সেই সময়, যখন পর্যন্ত আমি চেষ্টা করছি মালতীর সঙ্গে ‘বোঝাপড়া’ করতে। খুব কষ্টের কাজ, দু-পক্ষেই কষ্টের, কেউ কারো কথা বোঝে না, বলতে গিয়ে কথাগুলো ভেঙে যায়, বা ফেরত আসে অচল সিকি-আধুলির মতো। বোবা দেয়াল, ঠাণ্ডা দেয়াল, মাথা ঠুকলো শুধু মাথা ঠোকার প্রতিধ্বনি বেরোয়। বাঁধা বুলি মালতীর মুখে এই যদি তোমার মনের কথা তা’হলে জয়ন্তবাবুকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেই পারো! দাও না কেন?’ ‘দিই না এইজন্য যে তাতে আমার কোন লাভ নেই, তাতে আমি ফিরে পাবো না তোমাকে, কেননা মানুষের মনই সব, ইচ্ছেটাই আসল, সেটাকে কাজে খাটানো গেলো কি গেলো না তা অবান্তর। ধর জয়ন্তকে আমি তাড়িয়ে দিলুম, তারপর তুমি জয়ন্তর অভাবে আধমরা হ’য়ে থাকলে তাতে আমার লাভ কী, বলো।’ এ-সব কথা মুখে আনা যায় না, মনে মনে গুছিয়ে চমৎকার ভাবা যায়, চিঠিতে লেখা যায় হয়তো, কিন্তু মুখে বলা যায় না—অন্তত নিজের স্ত্রীকে বলা যায় না, ব’লে কোনো লাভও নেই। কেননা কথাটা এতই সত্য যে মালতীও পারবে না প্রতিবাদ করতে, আর পারবে না ব’লেই ওর আক্রোশ আরো বেড়ে যাবে আমার উপর। হয়তো শেষ পর্যন্ত না-শুনেই ব’লে উঠবে—যেমন মাঝে-মাঝেই বলে : ‘আসল কথা কী জানো? তুমি ভীষণ হিংসুক, ভীষণ স্বার্থপর, তুমি চাও সকলে সব সময় তোমার মন যুগিয়ে চলবে—আমি তো আমি, বুন্নির দিকেও কেউ একটু বেশি মনোযোগ দিলে তোমার তা ভালো লাগে না।’

ঐ আর-এক কথা তোমার মুখে, মালতী হিংসে—যেন সেটা আমারই একচেটে সম্পত্তি বা স্বামীদের বা পুরুষজাতির কোনো বৈশিষ্ট্য—দাড়ি-গোঁফের মতো কিছু-একটা, যা তোমার বা মেয়েদের মধ্যে কখনোই বর্তাবে না। মনে আছে, বিয়ের পরের বছর দার্জিলিঙে বেড়াতে গিয়ে দরিয়ার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমাদের? পাঞ্জাবী মেয়ে, চৌদ্দ বছরে আঠারোর মতো, দেখায় চমৎকার চেহারা, চমৎকার ইংরিজি বলে—আমাদের ফেরার দিন সে আমাদের সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত এলো, আমি তারই সঙ্গে কথা বললুম হাঁটতে-হাঁটতে, আমার ভালো লাগছিলো ওর সঙ্গটা, অনভিজ্ঞতাবশত বুঝতে পারিনি যে তুমি তাতে রেগে যাচ্ছো। আর সেইজন্যে ট্রেনে তুমি সারা রাত কথা বললে না আমার সঙ্গে, তোমার মুখ আঁচ-প’ড়ে-যাওয়া উনুনের মতো কালো আর বোবা হয়ে রইলো, আমি সেই নির্জন কূপেতে অনেক সাধ্য-সাধনা ক’রেও তোমার রাগ ভাঙাতে পারলাম না—মনে আছে? অথচ কে এই দরিয়া যার জন্যে সেই ট্রেনের সুন্দর রাত্রিটাকে, আর দার্জিলিঙের সুন্দর স্মৃতিকে, তুমি বিষ ক’রে দিয়েছিলে? কী বলে একে? স্বামী হ’লে হিংসে, আর স্ত্রী হ’লে সুবুদ্ধি, তাই না? আমার কিছু এসে যায় না, কিন্তু পাছে তোমাকে কেউ কিছু খারাপ ভাবে’ —তা-ই না?

একবার, তোমার বাবার এলাহাবাদে গিয়ে স্ট্রোক হ’লো, তুমি টেলিগ্রাম পেয়ে চ’লে গিয়েছে—আমি একা বাড়িতে, হঠাৎ সন্ধেবেলায় ফ্ল্যাটের দরজার টোকা পড়লো। একটি মেয়ে ঘরে ঢুকে বললে, ‘আমাকে বোধহয় চিনতে পারছেন না—আমি নীলিমা।’ আমার মনে পড়লো মেয়েটি তোমার কী-রকমের আত্মীয়, তোমার বাপের বাড়িতে কয়েকবার দেখেছিলাম তাকে, তুমি বলেছিলে বিয়ের পর থেকেই তার স্বামীর সঙ্গে গোলমাল চলছে, আরো যেন কী কী বলেছিলে ঠিক মনে পড়লো না। আমি আমতা-আমতা ক’রে বললুম, ‘মালতী এখানে নেই। -এলাহাবাদে গেছে-তা আপনার কি কোন ‘হ্যা, আমার একটু দরকার ছিলো—বিশেষ দরকার —আমি একটা কাজে কলকাতায় এসেছিলাম। কালই বাবার কাছে গৌহাটিতে যাবো-আমার কলকাতায় কোন থাকার জায়গা নেই এখন, আজ রাতটা যদি-যদি এখানে থাকতে দেন আমাকে।’ কথাটা শোনামাত্র আমার মনে পড়ে গেলো তুমি বলেছিলে নীলিমা খারাপ মেয়ে, বিয়ের আগে অনেক ছেলের মুণ্ডু চিবিয়েছে, কলেজের হস্টেল থেকে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো একবার, বিয়ের পরেও ও-রোগ সারেনি বলেই গোলমাল। তাছাড়া আমি ততদিনে কিছুটা অভিজ্ঞ স্বামী হয়েছি আমার মনে হলো এই একা বাড়িতে একজন যুবতী মেয়েকে রাত কাটাতে দিলে তোমার সেটা ভালো লাগবে না। সবিনয়ে কিন্তু অল্প কথায় নীলিমাকে বিদায় দিয়েছিলুম সে-রাত্রে। তোমাকে লিখেওছিলুম খবরটা—উত্তরে তুমি পর-পর তিনখানা চিঠি লিখিছিলে আমাকে, নীলিমা যদি আবার আসে ওর সঙ্গে বেশি মেশামেশি যেন না করি, আর কিছুতেই যেন ওকে থাকতে না দিই বাড়িতে (আণ্ডারলাইন ক’রে দিয়েছিলে), ‘আমার নিজের জন্য বলছি না, কিন্তু পাড়ার লোকেরা ভুল বুঝতে পারে, আমার বাপের বাড়িতে একটা কথা উঠলে বিশ্রী হবে, তোমাকে কেউ এতটুকু খারাপ ভাবলে আমার তা সহ্য হবে না বোঝো তো।’ আমার হিতৈষী তুমি, মালতী, হিংসুক নও, সন্দিহান নও—এও আমাকে মেনে নিতে হবে যেহেতু আমি পুরুষ আর তুমি স্ত্রীলোক। কিন্তু আমি জানি ঘটনাটা যদি উল্টো হ’তো, যদি আমি থাকতুম এলাহাবাদে আর আমার কোনো আত্মীয় বা বন্ধু নিরুপায় হ’য়ে একটা রাত কাটাতে চাইতো আমাদের ফ্ল্যাটে, তা’হলে আমি এটাই আশা করতুম যে তুমি তাকে সিঁড়ি দিখিয়ে দেবে না, আর তাতে তোমার ‘নিন্দে’ হতে পারে এই ভাবনাটা খেলতোই না আমার মাথায়। পরে আমার মাঝে-মাঝে মনে হয়েছে আমি সেদিন অন্যায় করেছিলাম, সত্যি হয়তো বিপন্ন ছিলো নীলিমা, আমি বেশি কথাও বলিনি তার সঙ্গে, এক পেয়ালা চা খেয়ে যেতেও বলিনি–আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো তোমার ছায়া, মালতী, সেটাকে আমি ভয় পেয়েছিলাম। ও-রকম ব্যবহারের সঙ্গে আমার নিজের স্বভাবের মিল ছিলো না; যেহেতু আমি তোমার স্বামী, শুধু সেইজন্যেই ও-রকম করতে হয়েছিলো আমাকে।

মালতী, এটা তো মানবে তোমার উপর আমার ছিলো অন্ধ বিশ্বাস, তাতে কোনো শর্ত ছিলো না সীমা ছিলো না, কিন্তু তুমি ছিলে নিজের অজান্তেই আমার বিষয়ে সতর্ক—যদি কোনোদিন কোনো মহিলার শাড়ির বা রান্নার বেশি প্রশংসা করেছি, তাহ’লেও তুমি বলেছো—’ও-রকম বাড়াবাড়ি কোরো না তো, লোকেরা ভাববে তুমি কোনোদিন কিছু দ্যাখোনি, খাওনি।’ লোকেরা ভাববে—’ঐ এক বোকার মতো কথা তোমার মুখে, লোকেরা ভাববে! যেন লোকেরা কী ভাববে বা ভাববে না তা নিয়ে কোনো বুদ্ধিমান লোেক কানাকড়িও পরোয়া করে কখনো! তাছাড়া পাছে আমাকে কেউ কিছু খারাপ ভাবে সে বিষয়ে এতই যদি তুমি হুঁশিয়ার, তাহলে আজ কেন অপর্ণা ঘোসের বিষয়ে তুমি এত সহনশীল? শুধু সহনশীল নয়, এমনকি একটু উৎসাহী। হয়তো ভাবছো আমি কোনোমতে যদি অপর্ণার সঙ্গে জড়িয়ে যাই, তা’হলে আমার আমার হাত থেকে পুরোপুরি নিস্তার পাও তুমি, আমার বিরুদ্ধে একটা অস্ত্র তোমার হাতে আসে, নিজের একটা নৈতিক সমর্থনও খুঁজে পাও। কিন্তু না, মালতী, তোমার এই আশা আমি মেটাবো না—তুমি তা চাও বলেই আমি সে রকম কিছু ঘটতে দেবো না, আমার আমি জমিয়ে-রাখা রাগ আর কষ্টের ছায়া ফেলে-ফেলে তোমার জীবন আমি কালো ক’রে দেবো।

কিংবা হয়তো ভুল ভাবছি, হয়তো ভালোবাসা ছাড়াও ঈর্ষা সম্ভব—অন্তত মেয়েদের মধ্যে। ধরো যদি একদিন ঘরে ঢুকে দ্যাখো, আমি অপর্ণার একটি হাত নিয়ে খেলা করছি, তাহ’লে তুমি কি টুকরো ক’রে ছিড়ে ফেলবে না আমাকে? যে-টাকাটা তুমি হেলাফেলা ক’রে রাস্তায় ফেলে দিলে সেটাই অন্য কেউ কুড়িয়ে নিলে তোমার সইবে না, হয়তো এমনি ক’রেই ভগবান তোমাকে তৈরি করেছেন। কিন্তু আমি একদিন ও-রকম অবস্থায় জয়ন্তকে দেখে ফেলেছিলাম তোমার সঙ্গে, তখন তুমি ভাবোনি প্রতিবেশীরা কী বলবে বা বলবে না, তোমার বাপের বাড়িতে কী-কথা উঠবে বা উঠবে না, ও-সব ভাবনা তুমিও ভুলে গেছে সম্প্রতি। তুমি ঠাণ্ডা গলায় বলেছিরে, আমি ভুল দেখেছি। আর তোমার কথাই সত্য বলে আমাকে মেনে নিতে হ’লো যেহেতু তুমি স্ত্রীলোক, আর যেহেতু আমি বেশি কিছু বললে ‘জেলাস হাসবেন্ড’ নামক ঘৃণ্য আর হাস্যকর জীবে পরিণত হয়ে যাবো।

বিয়ে! কী জটিল, কঠিন, প্রয়োজনীয়, সাংঘাতিক মজবুত একটা ব্যাপার, আর কী ঠুনকো! দু-জন মানুষ সারা জীবন একসঙ্গে থাকবে—পাঁচ, দশ, পনেরো বছর নয়, সারা জীবন—এর চেয়ে ভয়ংকর জুলুম, এর চেয়ে অমানুষিক আদর্শ, আর কী হ’তে পারে? সন্তানের সঙ্গে সারা জীবন একত্র থাকি না আমরা, বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন বন্ধু বেছে নিই, কিন্তু আশা করা হয় দাবি করা হয় যে একবার যারা স্বামী-স্ত্রী হ’লো তারা চিরকাল তা-ই থাকবে। এই অস্বাভাবিক অবস্থাটা সহ্য করা যায় এটাকে ঈশ্বরের বিধান ব’লে মেনে নিলে, আমাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখলে। কিংবা যদি বিয়েটাকে শুধু একটা নিয়মমাফিক পোশাকি গোয়াল ব’লে ধ’রে নিয়ে, দূরে-কাছে ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা থাকে দু-জনেরই। কিন্তু যদি কেউ বিয়ে করে সুখী হতে চায়—যেমন আমি চেয়েছিলাম; যদি কেউ ভাবে একটিমাত্র স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে প্রণয়সম্বন্ধ আজীবন বজায় রাখবে—যেমন আমি ভেবেছিলাম; যদি কেউ বিয়ের মধ্যে মিশিয়ে দেয় ‘হৃদয়’ নামক ভীষণ কল্পনা, মারাত্মক বিষ—যেমন আমি দিয়েছিলাম; তা’ হলে, কোনো-না-কোনো সময়ে, হয় বাইরের কোনো ঘটনার, নয়তো নিজের কোনো পরিবর্তনের ফলে, আর নয়তো নেহাতই সময়ের শত্রুতায় তাকে হ’তেই হবে ব্যর্থ, হতাশ, উচ্ছিন্ন, যেমন আজকে আমি এই রাত্রে এই বিছানায়, নিসঙ্গতায়, অন্ধকারে।

স্ত্রী-পুরুষের সম্বন্ধ নিয়ে আগে অনেক কথা হ’তো তোমার সঙ্গে আমরা। তুমি সব সময় বলেছে—মেয়েরা উৎপীড়িত, নির্যাতিত, স্বামী বিমুখ হলে এখনো তাদের দাঁড়াবার জায়গা নেই আমাদের সমাজে, তাদের তিলতম স্খলনেরও ক্ষমা নেই, কিন্তু পুরুষ স্বেচ্ছাচারী হ’লে কেউ দোষ ধরে না। কে না জানে মেয়েদের অবস্থা আমাদের দেশে সাধারণভাবে কত শোচনীয়, এখনো কত অকথ্য অত্যাচার হচ্ছে তাদের উপর, কিন্তু তুমি কখনো ভেবে দ্যাখোনি যে এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য যাঁরা যুদ্ধ করেছেন তাঁরা সকলেই পুরুষ, আর আজকের তুমি আমি আর আমাদের মতো অসংখ্য স্বামী-স্ত্রী যে ধরনের জীবন কাটাচ্ছে, সেটা সম্ভব হয়েছে পুরুষেরই উদ্যোগে, পুরুষেরই চেষ্টায়। অন্য একটা কথা তুমি মানোনি কখনো, আমি বোঝাতে পারিনি তোমাকে যে সমাজ যেহেতু পুরুষের দ্বারা শাসিত, তাই পুরুষের কাছেই দাবি করা হয় বিশেষ এক ধরনের উদারতা ও সৌজন্য—আশা করা হয় সে স্ত্রীর সব কথা বিশ্বাস করবে, কোনো ছলনা টের পেলেও চেপে যাবে সেটা—মেয়েদের দুর্বলতার ক্ষতিপূরণস্বরূপ তারা পেয়েছে এক অসাধারণ সম্মান, সব সময়ই এই ভান আমরা চালিয়ে যাবো যে আমাদের স্ত্রীরা সমালোচনার অতীত। ভেবে দ্যাখো, নাটকে উপন্যাসে এটাই হয় যে স্বামী একনিষ্ঠ না-থাকলে স্ত্রীরা হন লেখকের ও পাঠকের করুণার পাত্রী, বা এমনকি ট্রাজিক নায়িকা–কিন্তু উল্টোটা যখন ঘটে, যখন যথেষ্ট কারণ নিয়েই স্ত্রীর প্রতি সন্দিহান হয় স্বামী, ঈর্ষাতুর হয়, তখন প্রায় সব সময়ই তাকে দেখানো হয় ঈষৎ হাস্যকরভাবে—সেই চিরাচরিত ‘জেলাস হাসবেন্ড’, যে-ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার চাইতে লজ্জার ব্যাপার পুরুষের পক্ষে আর-কিছু নেই। সেইজন্যই নীরব থাকতে হয় আমাদের—থাকতে হয়েছে আমাকে —নিজের সম্মান, স্ত্রীর সম্মান বজায় রাখার জন্য।

বলতে পারো, মালতী, কবে আমরা প্রথম বুঝেছিলাম আমাদের বিয়ে ভেঙে গেছে? মনে পড়ছে না? শশানো, আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। সেই যে জয়ন্ত একদিন মদ খেয়ে এসে তোমাকে আবোলতাবোল কী বললে, আমি তাকে হাতে ধ’রে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে এলাম, ফিরে এসে তোমাকে বললাম আমি ওঁকে বলেছি আমাদের এখানে যেন আর না আসেন—সেদিন নয়, না, সেদিনও নয়, কিন্তু তারই কয়েকদিন পরে। ও-কথা আমি বলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু যথেষ্ট জোরের গলায় বলিনি, মিনমিনে গলায় বলেছিলাম, ‘আপনি আমাদের এখানে আর না-এলেই বোধ হয় ভাল হয়—’ এই রকম ছিলো আমার ভাষাটা, নরম শোনাবার জন্য একটা বোধহয়’ জুড়ে দিয়েছিলাম মনে আছে—যদিও ব্যাপারটা আমার কুৎসিত লেগেছিলো, ফ্ল্যাটের দরজায় মাতাল জয়ন্তকে দেখে রাগে আমার গা কাঁপছিলো, তুব সেই রাগটা প্রকাশ করতে পারিনি—এমনি আমার স্বভাব, আমার দুর্বলতা। তবু আমি মনে প্রাণে চেয়েছিলাম জয়ন্ত যেন সত্যি আর না আসে, কয়েকদিন পর্যন্ত এও আশা করেছিলাম হয়তো আমাদের পুরোনো জীবন ফিরে পাবো। কিন্তু দিনের পর দিন কাটে, আমি দেখতে পাই তুমি যেন ম’রে গিয়েছে, তোমার মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না, তোমার চলাফেরা পুতুলের মতো। ক্রমে আমার সন্দেহ হয় যে—এটা হয়তো ভালো হ’লো না, একজন অর্ধমৃত স্ত্রীলোক নিয়ে সত্যি তো কোনো লাভ নেই আমার। আমি বেশি কথা বলি না তোমার সঙ্গে, কেননা কিছু বলতে গেলেই কেমন একটা ঝাঁঝালো ব্যঙ্গের সুর ফুটে বেরোয় যেটাকে আমি চাপতে পারি না, অথচ চাই না যে কোনো মুখোমুখি বচসা হোক, বরং ভাবি যে এই মন-খারাপ নিয়ে নিজের মনের সঙ্গে মুখোমুখি থাকাটাই হবে তোমার পক্ষে চিকিৎসা। (বোকার মতো, দাম্ভিকের মতো এই ‘চিকিৎসা’ কথাটাই ভেবেছিলাম তখন, যেন তোমার কোনো অসুখ করেছে, আর ওষুধের প্রেস্কৃপশন আমি খুঁজে পেয়েছি!) কিন্তু, যত দিন কেটেছে, যতবার তোমার মুখের দিকে তোমার অজান্তে আমি তাকিয়েছি, তত আমার মনে হয়েছে এটা ভোরের আগেকার অন্ধকার নয়, বরং এক ঠাণ্ডা ধূসরতা, শীতের দিনে বৃষ্টি হলে যেমন হয় তেমনি, এই আকাশ চুঁইয়ে কখনো যদি রোদুরের ফোঁটা ঝরে পড়ে তাও হবে রোগা, ফ্যাকাসে, উত্তাপহীন। তুমি জানো না কেমন তোমাকে দেখাতো সেই সময়ে—কী-রকম বিবর্ণ শীর্ণ, নিষ্প্রাণ—বিষন্ন নয়, বিষাদও সৌন্দর্য দেয়। কিন্তু তখন তোমাকে দেখে কেউ বলতো না তুমি দেখতে ভালো, তোমার মুখের গড়নও যেন বদলে গিয়েছিলো। আর তা-ই দেখে-দেখে অন্য একটা শিউরানি উঠলো আমার মনে; আমি অনুভব করলাম তুমি কত কষ্ট পাচ্ছো, আমার মনে হ’লো জয়ন্তও এই রকমই কষ্ট পাচ্ছে—তারপর ভাবলাম তিনজন মানুষ। দুঃখী হবার চাইতে শুধু একজন দুঃখী হওযা কি ভালো নয়? তোমার ঐ আর্ত মুখ ছোরা বিঁধিয়ে দিচ্ছে আমার বুকে-সমবেদনার অর্থে নয়, অন্য কারো অভাবে তোমার যে এই দশা হয়েছে সেটা আমারও পক্ষে মৃত্যুর মতো; কিন্তু এই অবস্থার কোনো প্রতিকার যদি না-ই থাকে তা’হলে অন্তত তোমার মুখে হাসি ফুটুক, প্রাণ ফিরে আসুক এই যেখানে আমি আপিশ থেকে ফিরি, রাত্রে ঘুমোই। আমি লুব্ধ হলাম জয়ন্তকে এ-বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে; মনে-মনে বললাম—এ অবস্থা অসহ্য, এর পরে ভালো-মন্দ যা-ই হোক, অন্তত এই অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।

হঠাৎ শীত ভেঙে গিয়ে বসন্তের হাওয়া দিলো, মেঘ কেটে গিয়ে মাধুরী ফুটলো আকাশে—সেই যেদিন মালতী আর আমি একসঙ্গে ‘চণ্ডালিকা’ দেখেছিলাম। পবিত্র সেই অশ্রু, যা দু-চার ফোঁটা ঝ’রে পড়েছিলো আমার গাল বেয়ে, চণ্ডালিকার বেদনার গান শুনতে শুনতে; পবিত্র সেই অমানিতার বেদনা, যা আমার মনকে ধুয়ে-মুছে নির্মল করে দিয়েছিলো, যেন নতুন উৎসাহে ও যৌবনে ভ’রে তুলেছিলো আমাকে। উৎসাহ, যৌবন: তার উৎস তো প্রেম; আমি মুহুর্তের জন্যে বুঝেছিলাম যে বৃদ্ধ হ’লেই যৌবন হারাতে হয় না, যদি হৃদয়ে থাকে প্রেম, যেমন ছিলো রবীন্দ্রনাথের, যাঁর রচিত শব্দগুলি, বিন্দুর পর বিন্দু, তরঙ্গের পর তরঙ্গ, ঝ’রে পড়ছে আমার উপর, ব’য়ে যাচ্ছে আমার উপর দিয়ে, সুরের মধ্যে গ’লে গিয়ে, নাচিয়েদের চোখে মুখে প্রতিধ্বনি তুলে—সুস্বাদ, ঘুম-ভাঙানো, মনোহরণ আমার ভালোবাসার শক্তিকে পুনর্জীবিত করে—যেমন ঐ কবিতাকে ভালোবেসেই আমি জগৎকে ভালোবাসতে পারছি। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পরে, ঘুম-ভাঙা মুহুর্তে, অন্ধকারে, যখন আমার এই সদ্য-ফিরে পাওয়া ভালোবাসা মূর্ত হ’লো মালতীর জন্য আকাঙক্ষায়, যখন আমি শরীরে মনে উদ্বেল হয়ে নিজেকে মেলাতে চাইলাম তার সঙ্গে, আর তুমি, মালতী, হঠাৎ শক্ত হ’য়ে ঠাণ্ডা হ’য়ে মিলিয়ে গেলে আমার আকাশ-ছোঁয়া হাতের বাইরে, নিজেকে নামিয়ে আনলে তোমার নারীত্বের উচ্চ চূড়া থেকে একতাল মাংসের কর্দমে—আমার.তখনকার সেই ব্যর্থতা, লজ্জা, অপমান–সে কথা কি কখনো কাউকে বলবার? আমার শরীরের এঞ্জিনে তখন ড্রাইভার ছিলো না—একটুখানি চ’লেই খানায় প’ড়ে গেলো, থেমে গেলো। আমি তখন জানলাম—যে ভাবে আমরা অভিধান খুলে কোনো নতুন শব্দের অর্থ জেনে নিই, ঠিক তেমনি নিশ্চিতভাবে জানলাম—যে তুমি জয়ন্তকে ভাবছো, ভাবছিলে, জয়ন্ত ছাড়া আর-কিছুতেই কিছু এসে যায় না তোমার। তবু আমি আরো একটুক্ষণ শুয়ে থাকলাম তোমার পাশে, উঠে আসার মতো শক্তি ফিরে পাবার জন্য, আর তখন তোমায় চুলের গন্ধে মাখা বালিশটা আমার প্রিয় মনে হ’লো, তোমার প্রতি এমন কোনো ঘৃণা অনুভব করলাম না যাতে জেদ ক’রে নিজের মনে বলতে পারি ‘জন্মের মতো এই শেষ!’ মনে হ’লো হয়তো এর পরেও আবার ফিরে আসবো তোমার কাছে—আর সবচেয়ে মর্মান্তিক লজ্জা সেইটাই।

পরের দিন আপিশ থেকে ফিরে জয়ন্তকে দেখে আমি বেশি অবাক হলাম না, প্রায় খুশি হলাম—আমি যেন প্রায় ধ’রেই নিয়েছিলাম যে তার পালা এখনো ফুরোয়নি।

সে-রাত্রেও খাওয়ার পরে আমি লিখতে বসলাম (আজজাল প্রায় নিয়ম ক’রে লিখি আমি, তর্জমা করি, নিজেও কিছু লেখার চেষ্টা করি মাঝে-মাঝে—ছাপা হোক আর না-ই হোক—কিছু -একটা করার জন্যেই, যাতে ক্লান্তির চাপে ঘুমিয়ে পড়তে পারি, সেইজন্যেই), কিন্তু লেখার প্যাড খোলামাত্র সাদা কাগজের উপর তিনটে শব্দ, সাতটি অক্ষর দেখতে পেলাম—তারা তাকিয়ে রইলো আমার দিকে একশো চোখে, এক হাজার চোখে, আমার সামনে দেয়ালে নাচতে লাগলো অক্ষরগুলো, সীলিঙে চামচিকের মতো উড়ে বেড়াতে লাগলো। ‘জয়ন্ত, ফিরে এসো।’ আমার নিশ্বাস খুব দ্রুত পড়ছিলো, আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিয়ে পাতাটি ছিড়ে ভাঁজ করে রেখে দিলাম আমার দেরাজে, খামে ভ’রে, নানা দরকারি কাগজপত্রের তলায়। অনেকগুলো চিন্তা এক ঝাঁক ভিমরুলের মতো হুল ফুটিয়ে দিলো আমার মগজে: মালতী কি চিঠি লিখেছিলো জয়ন্তকে আর তা পেয়েই সে চলে এসেছিলো আজ? না—তাহ’লে এই কাগজটাকে এমন অসাবধানে ফেলে রাখতো না সে, আর এমন একটা জায়গায় যেখানে আমার চোখেপড়া নিশ্চিত। কাতর, করুণ, আশাহীন মালতী—এটা লেখার সময় নিজের উপরে কোনা শাসন ছিলো না, তার সাংসারিক বুদ্ধি, তার মেয়েলি চতুরতা একেবারে কাজ করেনি। ঐ তিনটি শব্দ, সাতটি মোটা হয়ে-যাওয়া অক্ষর যার উপর বোঝা যায় অনেকবার কলম বুলিয়েছিলো মালতী—কত কথা তারা ব’লে দিলো আমাকে, কত স্পষ্ট ক’রে, কেমন সংশয়াতীত প্রাঞ্জলতায়। ‘জয়ন্ত, ফিরে এসো—’ এ যেন এক বিষাক্ত কবিতা আমি যার গভীর থেকে আরো গভীরে তলিয়ে যাবো ধীরে-ধীরে, কোনো গ্যালিলিওর দূরবীনে দেখা নিষ্ঠুর চাঁদ, যার অবয়ব অধ্যয়ন করে কাটিয়ে দেবো বাকি জীবন। তা যা-ই হোক, মালতীর বিরুদ্ধে একটা অস্ত্র এলো আমার হাতে, আমি তাকে শাসাতে পারবো। এবার, ভয় দেখাতে পারবো, অন্ততপক্ষে নিজেকে বসাতে পারবো বিচারকের আসনে, অন্তত আমার ফুটো-হ’য়ে-যাওয়া অহমিকাকে আবার প্রতিষ্ঠিত করতে পারবো তার সামনে। দারুণ, দারুণ লোভ হলো তখুনি মালতীকে ডেকে ঐ কাগজটা দেখাতে—শুধু তার মুখের চেহারাটা কেমন হয় তা দেখার জন্য—মনে সবটুকু অবশিষ্ট শক্তি জড়ো ক’রে পিষে দিলুম সেই প্রলোভন। আপিশে যাবার সময় কাগজটা নিয়ে বেরিয়ে যাই (বুক-পকেটে, অতি সন্তর্পণে, যেন কোনো তাবিজ, কোনো গুপ্তমন্ত্র), ফিরে এসে আবার রেখে দিই দেরাজে—আপিশে কোনো ফাঁক পেলে বা বাড়িতে বেশি রাত্রে, খুলে দেখি, তাকিয়ে থাকি মাঝে-মাঝে : এমন ক’রে অনেকগুলো দিন কেটে গেলো, যে-দিনগুলিতে জয়ন্ত আর মালতী ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে, আর আমি তা দেখেও দেখছি না, যেহেতু আমার শেখা হ’য়ে গেছে এক জাদুমন্ত্র, যা দিয়ে আমি নিমেষে ওদের ধ্বংস করতে পারি। কিন্তু ওটা নিয়ে আমি কী করবো সে-বিষয়ে মনস্থির করতে পারি না; কখনো ভাবি হঠাৎ একদিন মালতীর হাতে দিয়ে বলবো, ‘এই নাও তোমার প্রেমপত্র তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি’ (শস্তা ঔপন্যাসিকেরা যাকে ‘ক্রুর হাসি’ বলেন সেই রকম কিছু একটা মুখে ফুটিয়ে); কখনো ভাবি ওর বাবাকে পাঠিয়ে দেবো, সঙ্গে একটা বিস্তারিত চিঠি লিখে (কিন্তু চিঠি লেখাটা এত শক্ত কাজ ব’লে মনে হয় যে প্রায় তক্ষুণি সেটা সরিয়ে দিই মন থেকে); আমার মনে হয় যে সব চেয়ে ভালো কোনো সুযোগের অপেক্ষায় থাকা—একদিন যখন বচসা হবে (মাঝে-মাঝে হচ্ছে আজকাল), দু-পক্ষের মেজাজ সপ্তমে চড়বে, তখন হঠাৎ ওটা বের ক’রে ছুঁড়ে দেবো ওর মুখের উপর—রঙের টেক্কার মতো, আলোজ্বলা শহরের উপর অতর্কিত বোমার মতো হঠাৎ নিবে যাবে ওর মুখের আভা, গলার তেজ, ভেঙে পড়বে ওর কুযুক্তির দেয়াল—অবশেষে ওকে হারিয়ে দেবার তৃপ্তিটুকু অন্তত পাবো আমি। কিন্তু তারপর ভাবি : ধরো ও যদি লুটিয়ে পড়ে, যদি আমার পায়ে প’ড়ে ক্ষমা চায়, যদি বলে, ‘আমি আর-কিছু চাই না, তুমি যা ইচ্ছে হয় করো, শুধু আমাকে থাকতে দাও এই বাড়িতে, বুন্নির কাছে—’ তাতেই বা কী লাভ হবে আমার, আমি যা চাই তা কি ওতে ফিরে পাবো? তাছাড়া ওর চোখে জল দেখে, ওর মিনতি শুনে, আমিও যদি গ’লে যাই যদি মোহাচ্ছন্ন হ’য়ে কল্পনা করি যে আমরা আবার যদি ফিরে যেতে পারি অতীতে? না—প্রথমে আমি যাকে দিব্যাস্ত্র ভেবেছিলাম, আসলে তা খোলামকুচি, তা দিয়ে আমার চিন্তার স্রোতে আঁচড় কাটা যায় কিন্তু আর—কোনো কাজে তা লাগবে না। এটাকে পকেটে নিয়ে ব’য়ে বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম একদিন।

কোথায় সেই কাগজটা এখন? সেই চরম সাক্ষী, মহার্ঘ দলিল, দুর্দান্ত প্রমাণ? কোথায় শেষ রেখেছিলাম তাও ঠিক মনে পড়ছে না। হয়তো অন্য কোনো দেরাজে সরিয়েছিলাম, অগুনতি বাজে কাগজপত্রের মধ্যে—সেখানে হয়তো ধুলোয় আরশোলায় দিনে দিনে ক্ষয় পাচ্ছে সেই জড় কাগজ, কি মনের ভুলে আপিশে ফেলে এসেছি, না কি দৈবাৎ হারিয়ে গেছে? কিন্তু সেটাকে উদ্ধার করার আর কি কোনো প্রয়োজন আছে, যখন মালতী আর আমি হয়ে উঠেছি পরস্পরের চক্ষুশূল, হৃদয়ের শেল, যখন ঐ কাগজে সে যা লিখেছিলো তার হাজারগুণ বেশি বলছে তার প্রতিটি ব্যবহার, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, আর আমি—দুর্বল আমি!—প্রতিশোধের অন্য কোন উপায় না-পেয়ে কথা দিয়ে তাকে আঘাত করছি যতদূর করা যায়?

জানো, মালতী, এখন আমার কী মনে হয়? তোমার কথা শুনে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম সেজন্যে নয়, আমার কথা শুনে তুমি কষ্ট পেয়েছিলে সেজন্যেও নয়, সেগুলি হয়তো মুছে যেতে বা আমরাই পারতাম অতি সহজে মুছে দিতে—যদি-যদি অন্তত তোমার আমার শরীরের মধ্যে বন্ধুতা থাকতো! অন্তত কেন বলছি–শরীরটাই আসল, চরম, সর্ব; ওটাই স্বামী-স্ত্রীর নির্ভর, বিয়ের নির্ভর—তারই জোরে এমন একটা অসম্ভব আশা করা হয় যে দু-জন-মানুষ বরাবর একসঙ্গে থাকবে। অথচ সেটা আর নেই আমাদের মধ্যে, তাই আমরা পরস্পরের অচেনা হ’য়ে গিয়েছি, পরস্পরের ভাষাও আর বুঝি না। মুশকিল এই যে আমি তোমাকে এখনো—কী বলবো—ধরা যাক ‘ভালোবাসি’ —আর এই কথাটায় যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহ’লে বলবো ‘কামনা করি—হ্যাঁ। আমি চাই তোমাকে, ঠিক পুরোপুরি শারীরিক অর্থেই কামনা করি বলা যাক—কিন্তু তোমার শরীর আমাকে আর সাড়া দেয় না। যেখানে কারো কিছু করার নেই—না আমার, না তোমার, না ‘চণ্ডালিকা’ নাটকের, না, নিবিড় অন্ধকার কোনো রাত্রির। আমি অন্ধকারেও বুঝেছি তোমার তাচ্ছিল্য—অবজ্ঞা-অনিচ্ছা; বুঝেছি তুমি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছো শুধু—আর তা বোঝামাত্র আমিও হিম হ’য়ে গিয়েছি—হিম, দুর্বল, রিক্ত, অক্ষম। কী প্রহসন! কী অপমান! তবু আমি চেষ্টা করেছি, বারবার চেষ্টা করেছি যদি কোন দৈবক্ষণে বন্ধ দরজা খুলে যায়-কিন্তু কিছুদিন পরেই দাঁড়িয়ে গেলো একটা দেয়াল, বোবা দেয়াল, ঠাণ্ডা দেয়াল, পাশাপাশি বিছানা দুটো জেলখানার দুটো কুঠুরি হ’য়ে উঠলো, পাশাপাশি দুই কয়েদিকে শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। তখনই বুঝলাম—না, বুঝেছিলাম আগেই—তখন থেকে মেনে নিয়ে ছিলাম আমাদের বিয়ের ভিত ফেটে গেছে, এ-বাড়ি আর বেশিদিন টিকবে না।

কিন্তু কি বলছি আমি, কি ভাবছি? কেমন করে শরীরের সঙ্গে শরীরের বন্ধুতা থাকবে, মন যদি স’রে দাঁড়ায়? শরীর—যত জ্বালা এই শরীর নিয়ে, অথচ ওটাকে না হ’লেও চলে না, ভগবানের এই এক আশ্চর্য আর নিষ্ঠুর বিধান যে আমাদের মন, বা আত্মা, যাই হোক না, যে চায় আকাশ, অসীম, অমৃত ইত্যাদি অনেক-কিছু-সেই মন যখন ভালোবাসে তখন তার যন্ত্র হিসেবে ভাষা হিসেবে উপায় হিসেবে বেছে নেয় এই শরীরটাকেই, এই ছোট্ট নোংরা বুড়ো-হওয়া ঘেন্নায় ভরা শরীরটা! কোথায় তবে সেই ‘প্রেম’, কবিরা যার কথা বলেন? আমরা বন্দী হ’য়ে আছি শরীরের মধ্যে; মনে-মনে ধ্যান ক’রে, চোখে-চোখে ইশারা ক’রে, বা এমনকি ঠোঁটে ঠোঁটে চুমো খেয়ে তৃপ্ত হ’তে পারি না আমরা, আমাদের নেমে আসতে হয় এক ঘন অন্ধকারে, জন্তুর গুহায়, উৎকট ব্যায়ামে, একলা শরীরও শরীরকে পারে না সুখী করতে। অন্তত আমরা চোখে দেখতে চাই, কানে শুনতে চাই, কিন্তু চোখের জ্যোতি, গলার সুর, ঠোঁটের হাসি-তারও যোগানদার হ’লো মন, আমরা মন দিয়ে সুন্দর দেখি, মন দিয়ে কামনা করি, তারপর বার্তা ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। আমরা কোনো নারীকে যখন চাই’, যখন ‘ভোগ করি’, আসলে তখন দখল ক’রে নিতে চাই তার সমগ্র সত্তাকে, খুঁজি সেই একজনের মধ্যে আমাদের সব স্বপ্ন—পড়া বইয়ের স্মৃতি, বাস-এ দেখা চোখ, কোনো প্রিয় কোনারক-ভঙ্গি, কোনো অভিনেত্রীর কণ্ঠস্বর, কিংবা আমাদেরই অজান্তে, আমাদেরই কামনার তাপে, সেই সবগুলি লক্ষণ মিলে যায় সেই নারীর মধ্যে—মুহূর্তের জন্য—কী চপল কী ভঙ্গুর সেই মুহূর্ত!—আর তারপরেই বুঝতে পারি আমাদের মন যা চায় আমাদের শরীর তা কিছুতেই গ্রাস করতে পারে না, অথচ শরীর ছাড়া কোনো উপায় নেই আমাদের। কী সংকট! কী অদ্ভুত সমস্যা। কিন্তু তবু এইটুকুই আমার ভাগ্য যে মালতী তার শরীর দিয়ে মিথ্যে বলেনি—মন দিয়ে, কথা দিয়ে, ব্যবহার দিয়ে, এমনকি হয়তো চোখ দিয়েও মিথ্যে বলেছে, কিন্তু তার শরীর সত্যবাদী—ভালোবাসার গর্ত, আর আঁতুড়ঘর, আর সরাইখানা, আর শ্মশান, তার শরীর। মালতী, আমাকে নির্ভুল জবাব দিয়েছে তোমার শরীর, জয়ন্তকেও নির্ভুল জবাব দিয়েছে, আমি তোমাকে দোষ দিই না, তুমি সত্য আচরণ করেছো ।

আবার বৃষ্টি, পাশে গ্যারেজের টিনের ছাদে ঝম্ঝম্, কত রাত্রে শুনেছি এই বৃষ্টির শব্দ তখনও এই দুই খাট আলাদা হ’য়ে যায়নি, তখন এ-পাড়ায় বর্ষাকালে মশা হতো, বুন্নি তখনও তিন মাসের, বুন্নির জন্যই মশারি খাটাতো মালতী—মশারির ভিতরে এসে বিছানাকে আমার মনে হ’তো দুর্গ—একটা গুহা—ছোটো আঁটো ঘনিষ্ঠ সহজ, একটা গন্ধ পেতাম—শরীরের গন্ধ, চুলের গন্ধ, বুকের গন্ধ, তোমার বুকের দুধের গন্ধ পেতাম সেই বিছানায়—প্রচুর দুধ ছিলো তোমার, বুন্নির ঠোঁট বেয়ে উপচে পড়তো বিছানার চাদরে, ঘরে পাতা পুরোনো দইয়ের মতো সেই ঝাঁঝালো গন্ধটা আমার নেশার মতো লাগতো, আমি নিশ্বাসে তা শুষে নিয়েছি, আমি ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়েছি তোমার বুকের সেই উষ্ণ প্রস্রবণ—সব কেমন ছোট আর ঘনিষ্ঠ আর সহজ ছিলো—সব ছিলে তুমি, মালতী, গুহা, দুর্গ, আশ্রয় আমার—সব কি আমার বোঝার ভুল, সব কি শুধু অসার কবিতা, পড়া-বইয়ের স্মৃতি, সব কি আমি মনে মনে বানিয়ে নিয়েছিলাম?

মালতী, তুমি কি শুনতে পেয়েছে আমার কথা—উঠে বসলে কেন? বিছানা থেকে নেমে এলে কেন জানালার ধারে? আবছা আমি দেখছি তোমাকে আবছা সাদা, তোমার শরীর যেন মাংসের স্থূলত্ব হারিয়ে হালকা, স্বপ্নের মতো, বাইরের দিকে মুখ ক’রে তুমি দাঁড়িয়ে, বোজা তোমার চোখ আমার মনে হচ্ছে, ধুয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি আর বাতাসে তোমার মুখ, তোমার পিঠের ভঙ্গিতে অপেক্ষা আমি দেখতে পাচ্ছি। এতক্ষণে বাইরে বোধহয় ভোর কিন্তু মেঘের জন্য আলো ফোটেনি, এসো এই স্তব্ধ সুন্দর গভীর মুহূর্তে আমরা আবার—সব ভুলে যাও সব ভুল, এসো আবার এসো আবার—’মালতী’! আমি উঠে গিয়ে আস্তে হাত রাখলাম তার কাঁধে, আমার আঙুলের তলায় তার রক্তের তাপ, আমার নিশ্বাসে তার গন্ধ, তার পুরোনো গন্ধ। নিশ্বাসের সুরে আবার ডাকলাম,’ মালতী!’ হঠাৎ থরথর করে কেঁপে উঠলো সে, ফিরে দাঁড়িয়ে আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকালো, আমি তার মুখ তুলে ধ’রে গালে চুমা, চোখের জলে লোনা তার গাল, চোখে গলায় বুকের খাঁজে চুমো, চোখের জল বৃষ্টির ছাঁটে মিশে গেল, বৃষ্টি আর বাতাস আমাদের ধুয়ে দিচ্ছে—হালকা, নরম স্নিগ্ধতায় ভরা, আমাদের বারো বছরের জীবন যেন ভোরের বাতাস, স্মৃতি ছড়িয়ে গন্ধ ছড়িয়ে ব’য়ে গেলো, বুকের শব্দে বুকের শব্দ নিশ্বাসে নিশ্বাস, আমরা স্বামী-স্ত্রী-আশ্চর্য —সন্তান বড়ো হয়ে দূরে, বন্ধু আর বন্ধু নেই—শেষ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী শুধু, এসো আমরা একসঙ্গে বাঁচি, বেঁচে উঠি আবার, ঐ দ্যাখো জীবন আমাদের অপেক্ষায়—রাত ভ’রে অপেক্ষায়—এসো তাকে তুলে নিই আমরা, জড়িয়ে ধরি পরস্পরের মধ্যে–এসো—তোমার ঠোঁট দুটি ফুলের মতো খুলে গেলো এগিয়ে এলো, অন্ধকারে তোমার কান্না ভেজা নরম হাসি—না, কথা না, ক্ষমা চেয়ো না, মালতী, এসো—

আমি নিচু হ’য়ে তার ভোলা ঠোঁটের উপর—কিন্তু আমার ঠোঁট কোনো সজলতার স্বাদ পেলো না, মালতী যেন বাতাসের মধ্যে বাতাস আর আমি বালিশটাকে কামড়ে চাদরের একটা কোণ মুঠোর মধ্যে আঁকড়ে, আর আমার ঘুমের উপর স্বপ্নের উপর জেগে ওঠার উপর ছড়িয়ে আছে করুণাময় অন্ধকার, ঝ’রে পড়ছে করুণাময় বৃষ্টি। নামো, বৃষ্টি, আরো তুমুল হ’য়ে, আরো ঘন হও, অন্ধকার—লুকিয়ে রাখো তাদের যারা জেগে উঠতে ভয় পাচ্ছে আজ, লুকিয়ে রাখো এই লজ্জা যে তারা এখনো একই ঘরে শুয়ে আছে। ভোর, দূরে স’রে যাও—আলো আমাদের দয়া করো।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন