বুদ্ধদেব বসু
হয়ে গেছে-ওটা হয়ে গেছে—এখন আর কিছু বলার নেই। আমি, মালতী মুখোপাধ্যায়, একজনের স্ত্রী আর একজনের মা, আমি ওটা করেছি। করেছি জয়ন্তর সঙ্গে, জয়ন্ত আমাকে চেয়েছে, আমিও তাকে। নয়নাংশু হয়ত ভাবছে আগেই করেছিলুম, কিন্তু না—আজই প্রথম। আজ রাত্রে—চার ঘন্টা আগে। এই বিছানায়। যেখানে মালতী এখন শুয়ে আছে।
কেমন ক’রে হ’লো? খুব সহজ। সত্যি বলতে আগে কেন হয় নি জানি না—আমার সংযমে, জয়ন্তর ধৈর্যে, আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। রাত্তির ন-টা নাগাদ জয়ন্ত এলো, আর তক্ষুনি এমন বৃষ্টি নামলো যে আধ ঘন্টার মধ্যে জল দাঁড়িয়ে গেলো আমাদের গলিতে। দশটা, সাড়ে-দশটা—বৃষ্টি আর থামে না। অংশু গেছে তার মুমূর্ষ পিসিমাকে দেখতে বেলেঘাটায়, বুন্নি আমার মা-র কাছে। থাকছে আজ, দুর্গামণি ভাঁড়ার ঘরে মাদুর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আমি ফ্ল্যাটের দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে শোবার ঘরে এলুম-বৃষ্টির ছাঁটে কিছু ভিজেটিজে যাচ্ছে কি না দেখার জন্য। ‘আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেলো, নয়নাংশুর দেরাজে আছে নাকি দু-এক প্যাকেট?’ বলতে বলতে জয়ন্তও এলো শোবার ঘরে। আমি নিচু হ’য়ে যখন দেরাজ ঘাঁটছি তখন জয়ন্ত পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, আমি মুখ তুলে তাকিয়ে বললুম, ‘তাহলে সিগারেট চাও না?’ সে আমার কানের উপর ঠোঁট চেপে ডাকলো, ‘লোটন!’ আমি তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে আলো নিবিয়ে দিলুম। এমনি করে হয়ে গেলো ব্যাপারটা।
ভালো লাগছে, এখন বেশ ভালো লাগছে আমার। বুঝতে পারছি এতদিন এটা ঠেকিয়ে রেখে ভালো করি নি।
গা-ভরা আরাম নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, হঠাৎ চোখ খুলে দেখি আলো জ্বলছে আর চুপচুপে ভেজা জামা-কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে নয়নাংশু। আমি বললুম,’ এই এলে?’ ‘হা—আমার পাজামাগুলো কোথায় আছে জানো নাকি? ‘ঐ যে বাঁ দিকের দেরাজে’, বলে আমি আবার একটু চোখ বুজলুম, অলস লাগছিলো, উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। অংশু বললে, ‘এত রাতে ফ্ল্যাটের দরজা খোলা রেখে ভালো করো নি, তুমি আর দুর্গামণি ছাড়া কেউ বাড়ি নেই, দু-জনেই অঘোরে ঘুমুচ্ছো–যাকে বলে চোরকে ডেকে আনা, এ হলো তাই-ই।’ ‘খোলা ছিলো নাকি দরজা?’ নয়নাংশু কাপড় ছাড়তে বাথরুমে ঢুকলো, আমি হঠাৎ তাকিয়ে দেখলুম ওর খাটের উপর আমার ব্লাউজটা পড়ে আছে, আমি শুয়ে আছি কোনোমতে শুধু শাড়িটা জড়িয়ে—তড়াক ক’রে উঠে ব্লাউজ প’রে নিলুম, শাড়িটা ঠিকমতো ঘুরিয়ে দিয়ে, চুল আঁচড়ে, মুখে একটু পাউডারও বুলিয়ে নিলুম তাড়াতাড়ি-আয়নায় মনে হলো না মালতীকে অন্য দিনের চাইতে কিছু আলাদা দেখাচ্ছে। কিন্তু কী রকম ভুল হয়, আশ্চর্য—তখন আমি ভালবাসতে গিয়েও দরজা বন্ধ করতে ভুলি নি (প্রেম তাহলে বেপরোয়া উদ্দাম নয়?), কিন্তু জয়ন্ত চ’লে যাবার পর হাট হ’য়ে রইলো ফ্লাটের দরজা, ঘরের দরজা, জামাটা পর্যন্ত গায়ে দিতে মনে থাকলো না, তক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়লুম। নয়নাংশু কিছু লক্ষ্য করেছে নাকি? তা করুক গে—একজন বিবাহিতা মহিলা তাঁর শোবার ঘরে যে-ভাবেই শুয়ে থাকুন, তা নিয়ে কার কী বলবার আছে?
খেতে বসে অংশু জিগেস করলে, ‘এত রাত অবধি না-খেয়ে ছিলে কেন?’ ‘রাত অনেক বুঝি? ‘বারোটা। খেয়ে নিলেই পারতে।’বারোটা শুনে অবাক লাগলো আমার, জয়ন্ত আসার পর থেকে ঘন্টাগুলি ছিলো কি ছিলো না তখন যেন মনে করতে পারছিলুম না, যদি বুঝতুম এত রাত হয়েছে তা হলে আমার নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা হতো অংশুর জন্য, আর সে ঘরে ঢোকামাত্র বলতুম, ‘কী। কাণ্ড! এত রাত করলে! এদিকে আমি ভেবে-ভেবে সারা!’ অংশুর দিকে তাকিয়ে মনে হ’লো সে এখনো ঐ রকম কিছু শুনতে চাচ্ছে আমার মুখে; তাই বললুম, ‘তোমার এত দেরি হ’লো কেন? ‘বাঃ, কোথায় ছিলে তুমি এতক্ষণ! কী তুমুল বৃষ্টি আজ কলকাতায়-বেলেঘাটা গঙ্গা হয়ে গেছে, হেঁটে-হেঁটে শেয়ালদার মোড়ে এলুম, তারপর রিকসাতে জোড়াগির্জে অবধি এসে তবে একটা ট্যাক্সি জুটলো।’ বেশ তৃপ্তির সঙ্গে কথাগুলো বললে নয়নাংশু, যেন সুন্দরবনে বাঘ মেরে এসেছে-আমার মনে পড়লো কয়েকদিন আগে বাথরুমে একটা বিছে দেখতে পেয়ে চেচিয়ে উঠেছিলো সে, তারপর কোথেকে একটা লাঠি যোগাড় ক’রে খুব সাবধানে দূর থেকে মেরেছিলো ঐ একরত্তি প্রাণীটাকে। আমার কাছে এসে বলেওছিলো, ‘ওটাকে মেরেছি।’ আমি ওর দিকে না তাকিয়ে জবাব দিয়েছিলুম, ‘খুব বীরত্ব করেছো!’ (যেন চার বছর আগেকার বুন্নি বলছে, ‘মা, মা, শোনো—জানালায় একটা কাক বসেছিলো, আমি তাড়িয়ে দিয়েছি!’) ওকে মাঝে মাঝেই বালকের মতো লাগে আমার, বাচ্চা ছেলের মত—আর, একজন পূর্ণ যুবতীর বালক স্বামী হলে কেমন লাগে? জয়ন্ত হ’লে কী করতো ওখানে? কথাটি বলতো না-নিঃশব্দে পিষে দিতো স্যান্ডেলের তলায়।
মুর্গির ঝোল দিয়ে ভাত মেখে নিয়ে নয়নাংশু বললে, ‘তোমাকে অনেকদিন বলেছি—আমার জন্যে বসে থেকো না, সময়মতো খেয়ে নিয়ো।’ আমি জবাব দিলুম, ‘একা-একা খেতে বিশ্রী লাগে আমার। কথাটা কিন্তু খাঁটি- একটুও বানানো নয়—নয়নাংশুর ফিরতে যত দেরিই হোক ওকে ফেলে খেতে পারি না আমি, এটা আমার অভ্যাস—হয়তো একেই সংস্কার বলে— ছেলেবেলায় মা-কে দেখতুম বাবার জন্যে বসে থাকতে, হয়তো তা’ই থেকে এসেছে। অংশু মুহূর্তের জন্য খাওয়া থামিয়ে জিগেস করলে, ‘কেউ এসেছিলো?” আমি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলুম ‘জয়ন্ত-জয়ন্তবাবু এসেছিলেন ন-টা নাগাদ। তোমার জন্য অনেকক্ষণ ব’সে ছিলেন।’(এই এক ঝামেলা—অন্যদের সামনে ‘বাবু’ বলা, ‘আপনি’ বলা!) ‘আমার জন্য কেন?’ ‘কী যেন দরকার ছিলো ওঁর পত্রিকার ব্যাপারে। তা ওকে বসিয়ে রাখলে না?’ বলে নয়নাংশু আমার চোখে চোখ ফেললো। আমি চোখ নামিয়ে নিলুম না, বরং বেশ স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বললুম, ‘বেশ কথা! বারোটা অবধি বসিয়ে রাখা যায় নাকি কাউকে! আর আমি বললেই বা উনি থাকবেন কেন- নিজের বৌ ছেলেপুলে নেই! এর পর নয়নাংশু বললে, ‘কী করে গেলেন এই বৃষ্টির মধ্যে?’ এর উত্তরে আমি অনায়াসে ঝাঝিয়ে উঠে বলতে পারতুম, ‘কী করে গেলেন তার আমি কী জানি!’ কিন্তু আমি তা করলুম না, মুখে হাসি টেনে বললুম, ‘জানো তো জয়ন্তবাবু কী রকম মানুষ-ও -সব বৃষ্টিফৃষ্টিকে উনি পরোয়া করেন না।’ আমার হাসির উত্তরে আরো একটু স্পষ্ট করে হেসে বললো,’ ঠিক বলেছো। মনে আছে বুন্নির জন্মদিনে-কাল-বোশেখির ঝড়ে এমন হ’লো যে টাম -বাস সব বন্ধ, রসা রোড জলে থৈ-থৈ, জয়ন্তবাবু তারই মধ্যে হেঁটে হেঁটে চলে এলেন টালিগঞ্জ থেকে। সত্যি আশ্চর্য!’ আমি কোনো জবাব দিলুম না ও-কথার, কেননা সেই সন্ধ্যাটা আমি ভুলি নি নয়নাংশু তা ভালোই জানে—এমন দু-একটা ঘটনা ঘটে যা ভোলা যায় না; আমি সেদিন বুঝেছিলাম যে জল ভেঙে তিন মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে বুন্নির জন্য আসেনি জয়ন্ত, নয়নাংশুর জন্যও আসেনি—আমার জন্য, আমারই জন্য এসেছে। আর তা অংশুও বুঝে নিয়েছিলো—বোকা তো নয়, প্রথম থেকে বুঝে নিয়েছিলো কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে, আর ঐ একটা বিষয়ে টনটনে জ্ঞান নেই এমন কোন স্বামী আছে পৃথিবীতে?
খাওয়ার পরে নয়নাংশু যখন সিগারেট ধরিয়েছে আমি জিগেস করলুম, ‘ও হ্যা৺—তোমার পিসিমাকে কেমন দেখলে?’ হ’য়ে এসেছে—আর দু-চারদিনের ব্যাপার হয়তো।’ ‘অজ্ঞান হয়ে আছেন?’ ‘না কিন্তু -বেশ জ্ঞান আছে, দুটো-একটা কথাও বলেন মাঝে মাঝে, সলতে-ভেজানো গঙ্গাজল চুষে নেন আর টুলটুলে চোখে তাকিয়ে থাকেন লোকের দিকে।’ ‘তোমাকে চিনতে পারলেন? ‘তা কেন পারবেন না? আমি হঠাৎ বললুম, ‘আমাকে নিয়ে গেলে না কেন?’ ‘ আমি তো বললুম তোমাকে—তুমি যেতে চাইলে না।’ ‘তুমি জোর করলে না কেন? আমি তো বুঝিনি এ-রকম এখন-তখন ব্যাপার।’ নয়নাংশু আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে জবাব দিলে, ‘ইচ্ছে করলে কালও যেতে পারো- এক্ষুণি কিছু হয়ে যাচ্ছে না। কোনো অসুখ তো নয়–নেহাত বুড়ো হয়েছেন ব’লেই—যেমন একটা গাছ মরে যায়, তেমনি।’ এর পরে আর কথা বললাম না আমরা, যে যার বিছানায় শুয়ে পড়লুম।
পাশাপাশি দুটো খাট, ছোটো ঘর, হাত বাড়ালে হাত ছোঁয়া যায় এতটাই কাছাকাছি, যদি নয়নাংশু ঘুমিয়ে পড়ে আর আমি জেগে থাকি তা’হলে ওর নিশ্বাস আমি শুনতে পাবো। কাল অন্যরকম করে সাজাবো ঘরটাকে, দুটো খাট অত কাছাকাছি থাকা স্বাস্থ্যকর নয়-জেগে জেগে আর-একজনের ঘুমন্ত ভারি নিশ্বাস শুনতে কার ভালো লাগে? বা বুন্নির ঘরে আমার খাট পেতে নেবো—ওটা আরো ছোটো কিন্তু দক্ষিণ খোলা, সারাক্ষণ পাখার হাওয়া ভালো লাগে না আমার, মাথার মধ্যে যেন জাম্ ধ’রে থাকে সকালে। এ-ঘরটা গুমোট, এই তো একটু বৃষ্টি থেমেছে আর গরম, বনবন পাখার শব্দ পোকার মতো মাথার মধ্যে–আমরা দুজনেই জেগে আছি, দু-জনেই জানি অন্য জন ঘুমোয় নি; একই ঘরে, অন্ধকারে, দুই অনিদ্রা মাকড়সার মতো জাল বুনে যাচ্ছে। মস্ত মোটা দুটো মাকড়সা, মাথার উপর জ্বলজ্বলে চোখ—একটা জাল অন্যটাকে ৺ছুয়ে যাচ্ছে, জড়িয়ে যাচ্ছে অন্যটার মধ্যে—ঘর ছেয়ে গেলো। এখন আর বৃষ্টি নেই, কিন্তু আমি এখনো বৃষ্টির শব্দ শুনছি, একটা আবছা নীল-সুড়ঙ্গের উপর বৃষ্টি, ছাদ ফেটে ৺চুইয়ে-৺চুইয়ে জল পড়ছে—বড্ড গরম–আমার চোখের তলার অন্ধকার ছিড়ে হলদে লাল ফুটকি বেরিয়ে এলো, সুড়ঙ্গটা কোথায় শেষ হয়েছে কেউ জানে না, আমার দম আটকে আসছে। তোমরা ভাবছো আমি ভয় পেয়েছিলাম? তা হলে তোমরা মালতীকে চেনো না।
আজকাল- অনেকদিন ধরে-মালতী এড়িয়ে চলে তার স্বামীকে। স্বামী তাকে চায় কেনই বা চাইবে না?-কিন্তু নয়নাংশুর ঐ বেঁটে বে৺টে আঙ্গুলগুলো ওর ভালো লাগে না, তার নিশ্বাসের গন্ধ ওর ভালো লাগে না, সে ওর গা ঘেঁষে শুয়েছে ভাবতে ও শিউরে ওঠে, সে ওর গায়ে হাত রাখলে ও কাঠ হয়ে যায়। কী করতে পারে মালতী, যেমন আমরা গায়ে পিন ফুটলে ‘উঃ’ বলি এও তেমনি। ও স্বামীকে বোঝায় যে ও-সব আর ভালো লাগে না ওর, পুরো ব্যাপারটাতেই অরুচি ধরে গেছে, বয়স হলো, মেয়ে বড়ো হচ্ছে, ইত্যাদি সব টালবাহানা শুনিয়ে শুনিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করে দেয়। কিন্তু মালতীর বয়স বত্রিশ মাত্র, নয়নাংশুর সাঁইত্রিশ, আর ওদের মেয়ে সবে আটে পড়লো—কেমন কাতর হয়ে যায় নয়নাংশুর মুখ যখন গুটিগুটি পায়ে ফিরে যেতে হয় নিজের বিছানায়, আর তখন মালতীর আরো বিশ্রী লাগে তাকে, পুরষ মানুষের ঐ কাতর চেহারা ওর দু চক্ষের বিষ। আসল কথা, জোর নেই, ভারি ভদ্রলোক, সে যাকে বুর্জোয়া বলে ঠাট্টা করে তা ই, জয়ন্ত যাকে বুর্জোয়া বলে ঘেন্না করে তা-ই। যখন কাপড় চোপড় পরে থাকে, স্যুট পরে আপিশে বেরোয়, পাজামা-পাঞ্ছাবি পরে বসে থাকে বাড়িতে, তখন আমার বেশ লাগে ওকে কথাবার্তায় চৌকশ, অনেক বই পড়েছে, সুশ্রী, লোকেদের সঙ্গে ব্যবহার নিখুঁত। মেয়েরা এখনো প্রেমে পড়তে পারে ওর সঙ্গে (ওর আপিশের অপর্ণা তো মুগ্ধ), আমিও একটা বয়সে পড়েছিলুম। বিয়ের সময় ভেবেছিলুম খুব জিতেছি, কিন্তু তার পর দশ বছর..বারো বছর কাটলো, যৌবনের প্রথম ঝাপটা কেটে যাবার পরেই ও যেন বালকের মতো হয়ে যেতে লাগলো দিনে দিনে- অন্তত আমার তা-ই মনে হলো স্বামী হিসেবে, প্রেমিক হিসেবে ওকে যেন আর ভাবতে পারছি না। আমি—আমার শরীর যেন আমাকে ফেলে আলাদা হয়ে রেগে উঠলো নয়নাংশুর উপর, আমি রোগা হয়ে গেলুম, অসুখে পড়লাম একবার, সেই অসুখটাও যেন নয়নাংশুকে দুরে রাখার একটা উপায়। আগে ছিলো একটা গুমরানো ধোঁয়ানো গোছের রাগ, কেন রেগে আছে জানে না? কিন্তু জয়ন্তর সঙ্গে দেখা হবার পর আমি হঠাৎ কারণটা বুঝে ফেললাম।
.
আমার বিয়ের পর পিসিমা বলেছিলেন, ‘সোয়ামীর মতো ধন আর নেই, বুঝলি?’ নয়নাংশুর পিসিমার কথা বলছি। ওঁর মুখে ও-কথা শুনে আমার একটু হাসি পেয়েছিলো, কেননা শুনেছিলুম উনি তের বছর বয়সে বিধবা হয়েছিলেন (বিয়ে হয়েছিলো বারোতে)—স্বামী’ ব্যাপারটা গোল না চৌকো না তেকোণা তাও উনি ঠাহর করবার সময় পান নি–একটা ফাঁকা আওয়াজ, একটা ফ্যাকাসে, ময়লা, মর্চে-পড়া, রংচটা, ঝুলকালি-মাখা ধারণা-ওঁর কাছে ‘স্বামী’ কথাটা হলো, তা-ই, অথচ তারই কী সাংঘাতিক প্রতাপ ! বিয়ের প্রথম বছরটা বেলেঘাটাতেই ছিলুম আমরা-নয়নাংশুর পৈতৃক বাড়ি সেটা- শ্বশুরবাড়িতে ঐ বুড়ি পিসিমা আমাকে বিশেষ একটু ভালোবেসেছিলেন, আদর করে ‘তুই’ বলতেন, হঠাৎ-হঠাৎ নয়নাংশুর ঢাক পিটিয়ে যেতেন কখনো আমাকে একা পেলে—’জানিস, পরীক্ষায় মেডেল পেয়েছিলো!’ -’ওর সঙ্গে সাহেবদেরও আলাপ আছে, জানিস!’–আমি তখন সবেমাত্র রক্তের স্বাদ পেয়েছি, ওঁর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতুম এই চিরবিধবা চিরকুমারী চিরদুঃখী মহিলাটিকে দুঃখী কেন মনে হয় না, তিনি কি কখনো নিজের জীবনের কথা ভাবেন না, কী ব্যর্থ কী শূন্য কী নিস্ফল-কিন্তু সত্যি বলতে তাঁর মতো শান্ত হাসিখুশি মেজাজের মানুষ আমি কমই দেখেছি; একবেলা খেয়ে মাসে দুটো একাদশী করে শিবরাত্রি অম্বুবাচীর লম্বা উপপাসে টাটিয়ে থাকে—দিব্যি তো কাটিয়ে দিলেন এতগুলো বছর আর কী কাজের, কখনো দুপুরে ঘুমোন না, ডালের বড়ি দেন, আমসত্ত্ব আচার তৈরি করেন, বুড়ো চোখ নিয়েও কথা সেলাই করেন চমৎকার, নিরিমিষ রান্নার হাত তাঁর চমৎকার—তাকে কখনো দেখি নি খালি হাতে ব’ সে থাকতে-কোনো নালিশ নেই, নালিশের কোনো কারণ তাঁর থাকতে পারে তা জানেন না বলেই নালিশ নেই—অদ্ভুত! কিন্তু যদি কেউ এসে তাঁর কানে জপাতো, ‘শুনুন বামাসুন্দর, আপনি দুঃখী, আপনি বঞ্চিত, আপনার বিদ্রোহ করা উচিত’—তা’ হলেই হয়তো অন্য রকম হতো তাঁর জীবন। কিন্তু জানি না হঠাৎ পিসিমার কথা এত ভাবছি কেন ও, ৺হ্যা, তার অসুখ, আর দু-চারদিনের ব্যাপার, আমি কাল তাঁকে দেখতে যাবো, আজ যাই নি পাছে জয়ন্ত এসে ফিরে যায়, কিন্তু কাল নিশ্চয়ই।
আমি ‘বৌ’ হতে পেরে খুব খুশী হয়েছিলুম, বিয়ের পরে প্রথম প্রথম চেষ্টা করেছিলুম রীতিমতো ‘ভাল বৌ হতে, বেলেঘাটার বাড়ির সকলের সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নয়নাংশু আমার সেই চেষ্টা বানচাল ক’রে দিলে। আমাকে বলে, ‘মা যখন রান্নাঘরে যান তুমিও সঙ্গে সঙ্গে যাও কেন? ‘বাঃ যাবো না! ‘ওটা উত্তর হলো না–কেন যাও বলো, সত্যি তো ওখানে তোমার করার নেই কিছু।’ আমি মনে-মনে খুশী হলুম, এ-কথা ভেবে যে অংশু সব। সময় আমাকে কাছে পেতে চায়, একটু দুষ্টুমি করে বললুম, ‘আমার ইচ্ছে তাই যাই—হ’লো?’ ‘উহু, ঠিক বললে না, ভালো দেখাবে তাই যাও, বৌদি যান তাই যাও, ও-সব হ’লো তোয়াজ, মন যোগানো।’ ‘না-হয় তা’ই হলো—দোষ কী? ‘দোষ এই যে ওটা অনেস্ট নয়, আসলে যা ভালো লাগে না তা-ই করছো যেহেতু অন্যেরা তাতে খুশী হবে, আবার ভাবটা এমন দেখাচ্ছো যে। সেটাই ভালো লাগছে তোমার।’ আমি হেসে বলুলম, ‘অনেক ছেলে স্কুলে যেতে ভালোবাসে না, তাদের কি তবে না-যাওয়াই উচিত?’ সেটা আর এটা এক কথা নয়, স্কুলে না-গেলে ছেলেটার নিজেরই ক্ষতি, কিন্তু শাশুড়িকে তোয়াজ করে তোমার আত্মার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তাছাড়া, বাচ্চাদের শাসনে রাখতে হয়, কিন্তু তুমি ত সাবালক।’ ওর এ-সব কথা আমি প্রথম-প্রথম ঠিক বুঝতে পারতাম না; খানিকটা চমক লাগতো যখন ও নিজের খুড়তুতো ভাইকে বলতো, ‘Lout’ (যেহেতু সে কথায়-কথায় আজেবাজে রসিকতা করে আর ধড়াশ ক’ রে শুয়ে পড়ে যে-কোন সময়ে যে-কোন বিছানায়)-ভাবতুম এ আবার কী-রকমের কথা, হাজার হোক ভাই তো, আবার মনে-মনে অংশুকে তারিফ না করে পারতুম না ওর মতামত অমন স্পষ্ট আর নতুন ধরনের ব’লে। আমার মন থেকে ছাত্রীর ভাবটা একেবারে কেটে যায়নি তখনও—আমি দেখতুম ও শুয়ে-শুয়ে যেসব বই পড়ে আমি তাতে দাঁত বসাতে পারি না, আমার চেয়ে বুদ্ধিও ওর বেশি ব’লে ধরে নিয়েছিলুম–তবু মনের তলা থেকে অন্য একটা ভাবও ঠেলে ওঠে মাঝে-মাঝে, আমি দেখতে পাই কোনো-কোনো বিষয় একেবারেই বোঝে না নয়নাংশু, বোঝে না আমার মন, আমার নারীত্বকে; কেন আমি জায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে যেতে ভালবাসি, কেন ওর মা-র কাছে রান্না শিখি মাঝে-মাঝে, আর শ্বশুরবাড়ির সকলের সঙ্গে যে মিলে-মিশে বন্ধুভাবে থাকতে চাই তা অন্য কোনো সাংসারিক কারণে নয়, সত্যি আমার ভালো লাগে বলেই -এই সহজ কথাগুলো কিছুতেই বোঝে না নয়নাংশু, বোঝার চেষ্টাও করে না। এই যে বিয়ে হলো—এ থেকে সে চায় পুরোপুরি আস্ত তার স্ত্রীটিকে শুধু, আর আমি চাই—শুধু স্বামীকে নয়, স্বামীকে কেন্দ্র করে এক নতুন জীবন, চাই নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ওদের বেলাঘাটার বাড়ি সব-কিছুর মধ্যে, অংশিদার হ’তে, এমনকি অধিকারিণী হ’তে। কিন্তু অংশু আমাকে আস্তে-আস্তে কিছুটা ওর ধরনে ভাবতে শেখালে; বোঝালে, যে বেলেঘাটার জনবহুল মস্ত তেতল বাড়িতে অসুবিধে হচ্ছে আমাদের; যে যৌথ পরিবারের মতো কুৎসিত ব্যাপার আর নেই, ওতে মানুষগুলো পরস্পরের মধ্যে লেপটে পিণ্ড পাকিয়ে যায়, কেউ আলাদাভাবে, সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। কিছুদিনের মধ্যে আমিও ওর মতো স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, কবে আমরা আলাদা বাড়িতে উঠে গিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো স্বাধীনভাবে থাকতে পারবো। ‘প্রত্যেক সাবালক মানুষই আলাদা, আলাদা এক-একজন ব্যক্তি, তোমার ভিতরকার সেই ব্যক্তিত্বকে তুমি ফুটিয়ে তুলবে—অন্যদের ছাঁচে গড়া হবে না।’ এই ধরনের কথা বার-বার আমি শুনেছি নয়নাংশুর মুখে, যখনই ননদ-জায়েদের সঙ্গে দল বেঁধে বেরিয়েছি শাড়ি-জামা কিনতে বা কোনো হিন্দি ফিল্ম দেখতে, বা গান গেয়েছি শাশুড়ির বেস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজোয়, বা ক্যারাম খেলেছি আমার সেই বোকাসোকা ভালোমানুষ দেওরের সঙ্গে। আর একটা কথা প্রায়ই বলে নয়নাংশু-শাড়ি-গয়না-হিন্দি সিনেমা-ও সব মেয়েলিপনা ছাড়ো তো! আমি জবাব দিই, ‘বাঃ আমি তো মেয়েই–মেয়েলি হবো না তো কী হবো!” ‘মেয়ে হওয়া আর মেয়েলি হওয়া এক কথা নয়। সূক্ষ্ম তফাতটা কোথায় তা বুঝিয়ে দেবেন, স্যার!’ আমার ঠাট্টার উত্তরে আমাকে জাপটে ধরলো অংশু; তখনকার মতো তর্ক ফুরালো, কিন্তু আবার কোনো উপলক্ষ ঘটলে ও আমাকে একই কথা শোনায়–যার সারাংশ হ’লো এই-এই জিনিস, এই-এই কাজ ওর ‘ভালো লাগে না।’ অর্থাৎ—অন্যেরা আমাকে যে ভাবে চায় সে-রকম আমাকে হ’তে দেবে না নয়নাংশু, কিন্তু নিজের মনোমতো করে ঢেলে সেজে নেবে; আমি অন্যের ছাঁচে গড়া হবে না, অর্থাৎ শুধু নয়নাংশুর ছাঁচে গড়ে উঠবো, ও যাকে আমার ‘ব্যক্তিত্ব’ বলে সেটা হলো আসলে তা-ই। এই কথাটা তখন আমি ভাবিনি অবশ্য, অনেক পরে সেই দিনগুলির কথা ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছিলো, কিংবা হয়তো এইমাত্রই ভাবলুম। তখন আমার পক্ষে এমন কিছু ভাবা সম্ভব ছিলো না যা অংশুর পক্ষে, আর আমার পক্ষেও, গৌরবের নয়–ও যে আমাকে পুরোপুরি দখল করে নিতে চেয়েছিলো সেটাতেও ওর অসামান্য ভালোবাসারই প্রমাণ আমি পেয়েছিলুম–তখন পর্যন্ত ও আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিলো।
মুগ্ধ, তবু—যেহেতু আমার স্বাভাবিক বুদ্ধিসুদ্ধি খানিকটা আছে, তাই সেই তখনই, যখন পর্যন্ত আমার গা থেকে নতুন বিয়ের গন্ধ কাটেনি, তখনই আমার মনে হয়েছিলো অংশু যেন বড় বেশি বই-পড়া মানুষ, যা-কিছু বইয়ে পড়ে তার ভাল লেগেছে তাই যেন তার জীবনেও খাটাতে চায়। কলেজে শেষ কয়েকমাস ওর ছাত্রী ছিলুম আমি—প্রথম দেখা সেখানেই-টাটকা-পাশকরা ছোকরা মাস্টার, চেহারা ভালো, কথাবার্তায় ঝকঝকে, আমাদের ক্লাসের উনতিরিশটি মেয়ের মধ্যে এমন কেউ ছিলো না যার বুকের মধ্যে মলয়সমীরণ ঝিরঝির ক’রে ব’য়ে যায়নি। আমি একদিন অন্যদের সঙ্গে বাজি রেখে আলাপ ক’রে এলুম পড়াশুনোরই কিছু একটা ছুতো ক’ রে—তারপর দেখি হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে কয়েকটা বই হাতে নিয়ে, ওগুলো নাকি পরীক্ষার পক্ষে বিশেষ জরুরী। আমি মনে মনে বললুম, ‘ও, তাহলে তোমারও মনে এই কথা!’ দিন দশেক পরে বই ফেরত নিতে এলো, আমি তখনও পড়িনি শুনে কয়েকটা বাছা বাছা অংশ নিজে পড়ে শোনালে আমাকে, ব্যাখ্যা ক’রে বুঝিয়ে দিলো—আমি খুব মন দিয়ে শুনলুম কিন্তু কিছুই শুনলুম না, শুনলুম ওর গলার আওয়াজ আর দেখলুম ওর মুখের ভাব, ঠোঁটের নড়াচড়া, আর তারপর যখন আমরা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ায় পৌছে যাচ্ছি আর আমার বাড়ির সবাই বুঝে নিয়েছে ব্যাপারটা,- আর তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছে (কুমারী মেয়ের সঙ্গে কোনো যুবকের ঘনিষ্ঠতা দেখলে মা-বাবা এখনো উদ্বিগ্ন না-হয়ে পারেন না, অথচ একবার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল সারা জীবনের মতো কেমন নিশ্চিন্ত হয়ে যান, যেন বিয়ে একটা সর্বজ্বরহর অব্যর্থ মাদুলি!)—তখনও অংশু আমাকে যত কথা বলে তার মধ্যে বইয়ের কথা ঘুরে-ফিরে চ’লেই আসে। বিয়ের পরেও তেমনি; রাত্রে ঘরে এসে, কি রোববার দুপুরে খাওয়ার পরে, সে আমাকে ইংরাজি কবিতা পড়ে শোনায়—প্রেমের কবিতা—ডি.এইচ. লরেন্সকে নিয়ে সে খুব মেতেছে তখন কিন্তু তখন তো আর কোর্টশিপের অবস্থা নেই যে যে কোনোভাবে তাকে কাছাকাছি পেলেই খুশী হবো আমি, খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্য রকম ব্যবহার আশা করছি তার কাছে, অন্য কিছুতে মন দিতে পারছি না, আমার অবাক লাগছে যে-মানুষ হাতে-কলমে প্রেম করতে পারে সে প্রেমের কবিতা পড়বে বা শোনাবে কেন, বা কথা বলবে কেন তা নিয়ে—আর অবশেষে সে যখন আমাকে কাছে টানে সেটাও এমন নরম হাতে আর সন্তর্পণে যে আমার এক-এক সময় মনে হয় এই প্রেম করাটাকেও সে যেন মনে মনে কোনো বই থেকে তর্জমা করে নিচ্ছে-অবশ্য মুখে আমি প্রায়ই বলি, ‘উঃ কী অসভ্য! বর্বর! এই বুঝি দস্যিপনা শুরু হ’লো আবার।’ ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা যা যুগে যুগে মেয়েরা ব’লে এসেছে পুরুষটিকে আরো বেশি তাতিয়ে তোলার জন্য—কিন্তু ওর ‘দস্যিপনা’র চরম মুহূর্তেও হঠাৎ খুব আবছাভাবে আমার মনে হয় যে অংণ্ড ঠিক আমাকে ভালোবাসছে না, ও যে আমাকে ভালোবাসে সেই ধারণাটাকে ভালোবাসছে। অথচ এই ‘ভালোবাসা নিয়ে কতই না লম্বা-চওড়া বক্তৃতা ওর।
আমাদের বিয়ের পাঁচ মাস পরে একটা ঘটনা ঘটলো যা নিয়ে সে সময়ে বেশ সোরগোল হয়েছিলো কলকাতায়। একজন নামজাদা ব্যারিস্টার, বয়স পঞ্চান্ন, হঠাৎ একটি এম. এ. ক্লাশের বিবাহিতা ছাত্রীকে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে বম্বাইতে পালিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা আদালত পর্যন্ত উঠেছিলো কিন্তু মামলা টেকেনি—শোনা গেলো মেয়েটি ডিভোর্স পেয়েছে আর ব্যারিস্টারটি তাকে বিয়ে করেছেন আর আগের স্ত্রীকে লিখে দিয়েছেন কলকাতার বাড়ি আর পাঁচশো টাকা মাসোয়ারা। লোকেরা তুড়ে গাল দিতে লাগলো দু’জনকেই, কয়েকটা কাগজও স্পষ্টভাবে নাম না-করে ব্যারিস্টার সাহেবকে তুলো ধুনে ছাড়লো। আমাদের বেলেঘাটার বাড়িতে বেশ জটলা হচ্ছে এ নিয়ে, সবাই দুয়ো দিচ্ছে, ছি ছি বলছে আর সকলের বিরুদ্ধে একলা লড়াই করছে নয়নাংশু। আমি একদিন রেগে গিয়ে বললুম, ‘তা তুমি যাই বলো, ব্যারিস্টারটিকে লম্পট ছাড়া আর কিছু বলা যায় না!’ ‘কী যে বলো! লম্পটের কি জায়গার অভাব আছে কলকাতায়? আর ভদ্রলোকের ত্যাগটা তুমি কি দেখছো না? কলকাতার জমজমাট প্র্যাকটিস হারালেন, আর এই জঘন্য লোকনিন্দা!” ‘রেখে দাও তোমার ত্যাগ—একটা বুড়ো হাবড়া, এদিকে মেয়েটারও বিয়ে হয়েছিল—দুটোকে ধ’ রে চাবকে লাল করে দিলে ঠিক হয়। নয়নাংশু গম্ভীর চোখে আমার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি ছেলেমানুষ, কিছু বোঝো না।’
এর পর থেকে নয়নাংশুর সঙ্গে মাঝে-মাঝেই তর্ক হতে লাগলো আমার। স্বামী-স্ত্রী, বা স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসাই হলো আসল কথা, ভগবানের চোখে বিয়ে ব’লে কিছু নেই, দাম্পত্যের নামে লাম্পট্য চলছে ঘরে-ঘরে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা না-থাকলে তাদের একত্র বসবাস গর্হিত, যেখানে মেয়েরা স্বামী আর আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশার কোনো সুযোগই পায় না সেখানে তাদের তথাকথিত সতীত্বও একদম ঝুটা মাল এমনি সব তত্ত্বকথা আমাকে শোনায় নয়নাংশু, সবিস্তারে, অনেক উদাহরণ দিয়ে, যেন ক্লাশ পড়ানোর লেকচার দিচ্ছে। বলে, ‘ভালোবাসারও পরীক্ষা হওয়া দরকার, কিন্তু অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা না-থাকলে তা সম্ভব হয় না; যেহেতু অমুক মানুষটা কারো স্বামী, অথবা স্ত্রী, শুধু সেইজন্যে তাকে নিয়েই জীবন কাটাতে বাধ্য নয় কেউ; সম্পর্কটা যদি ব্যক্তিগত না হয়, যদি হয় মুখস্ত করা নামতার মতো, কিংবা যদি অন্য কোনো উপায়ের অভাবেই তা আঁকড়ে থাকে লোকেরা, তা হলে সেটাকে লোকেদের ওপর চাপানোর নাম জুলুম, আর তা মেনে নেয়ার নাম ভন্ডামি। আর বেশিরভাগ মানুষ—বিশেষত এই সনাতন ভারতবর্ষে – বিয়ে বলতে এখনো এই বোঝে।’ নয়নাংশুর এ সব কথার কোনো সাফ জবাব আমার মুখে তক্ষুণি যোগায় না, কিন্তু শুনতে-শুনতে রাগ হয়—কেননা আমি তখন বিয়ে হওয়া নতুন বৌ, ক্ষুধিত কুমারীত্ব থেকে আরো ক্ষুধিত নারীত্বে প্রমোশন পেয়েছি, বিয়ে ব্যাপারটা আপাতত খুবই ভালো লাগছে আমার, এমনকি প্রায় বিশ্বাস ক’রে ফেলেছি যে এটা জন্ম-জন্মান্তরের সম্বন্ধ। একদিন বললুম, ‘তা’হলে তোমার মতে মানুষেরও কুকুর-বেড়ালের মতো হওয়া উচিৎ? ইচ্ছেসুখ চরে বেড়াবে—এই তো? পশুর সঙ্গে মানুষের তুলনা হয় না—’পশুরা ভালোবাসে না, তাদের শুধু শরীর আছে, মন নেই।’ আমি হঠাৎ বললুম, ‘ঐ এক কথা তোমার মুখে ভালোবাসা ভালোবাসা! ব্যাপারটা কী বলতে পারো?’ আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে জবাব দিলো, ‘তা তুমি নিজে না-বুঝলে কেউ বোঝাতে পারবে না।’
আমি বিয়ের আগের নয়নাংশুর প্রেমে পড়েছিলুম, কিন্তু বিয়ের পর থেকে আমার মনে হ’তে লাগলো যে ‘প্রেমেপড়া’ ব্যাপারটা তেমন জরুরী নয়, বিয়েটাই আসল, বন্দেজি, একবার বিয়ে হ’য়ে গেলে সারা জীবনের মতো ভাবতে হয় না, আর সেইজন্যই- যা-ই বলুক না নয়নাংশু-পাতানো বিয়ের বিরুদ্ধে কোনো সত্যিকার যুক্তি নেই। আমি একদিন জিগেস, করেছিলুম, ‘তোমার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ এলে তুমি কি বিয়ে করতে না?’ পাগল নাকি-যাকে চিনি না তাকে কি ক’রে বিয়ে করা যায়।’ ‘কিন্তু ধরো—এক সময়ে আমাকে তোমার ভালো লাগলো, অন্য সময়ে অন্য কাউকে আরো বেশি ভালো লাগে যদি?’ নয়নাংশু একটু হেসে জবাব দিলে, ‘সে-সম্ভাবনা সর্বদাই আছে, তাকে ভয় পেলে চলবে কেন?’ আমার খারাপ লাগলো ওর কথা শুনে, জোর গলায় বললুম, ‘আমি কিন্তু কল্পনাই করতে পারি না যে তুমি ছাড়া আর কেউ আমার স্বামী হতে পারতো, বা আমি ছাড়া আর-কেউ তোমার স্ত্রী।’ আবার হাসলো নয়নাংশু, পিঠ-চাপড়ানো সুরে বলল, ‘ছেলেমানুষ!’
এই কথাবার্তার কয়েকদিন পরে আমরা একটা গানের জলসায় গেলুম—আমার মা ছিলেন সঙ্গে—মুক্তিপদ ঘোষ প্রথমে একটা মালকোশ আর তারপর একটা লক্ষ্ণৌ চালের ঠুংরি গাইলে–অপূর্ব! নয়নাংশু একদম গান ভালোবাসে না, নেহাত আমার জন্য গিয়েছিলো আর কাঠের মতো মুখ ক’রে ব’সে ছিলো সারাক্ষণ; বেরিয়ে এসে মা যখন ওকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নয়নাংশু, তোমার কেমন লাগলো? চমৎকার-না?’ তখন ও শুকনো গলায় জবাব দিলো, ‘চমৎকার।’ কিন্তু আমার মন গানের রেশে ঝিম ধরে আছে, মনে পড়ছে ওস্তাদ গাইয়ের চোখ মুখ হাত নাড়া ইত্যাদি, হঠাৎ বলে উঠলাম, ‘মুক্তিপদ ঘোষের স্ত্রী কী ভাগ্যবতী! শুনে আমার মা তক্ষুণি বললেন, ‘কী বোকার মতো কথা!’ -কথাটা কেন বোকার মতো, তা বাড়ি ফিরে এসে অনেকক্ষণ পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম—’অমুকের স্ত্রী কী ভাগ্যবতী।’ এ-কথা বলা মানেই আমি ঐ মহিলাটিকে হিংসে করছি, অর্থাৎ আমি সেই অমুকের স্ত্রী বা প্রেমিকা হ’তে চাচ্ছি—আর একথা, কখনো মনে মনে ভাবলেও, কোনো বিবাহিতা মেয়ের মুখ ফুটে বলা উচিত নয়, বিশেষত তার স্বামী কাছাকাছি থাকলে। আর তখনই আমি বুঝেছিলাম বিয়ে জিনিসটা মানুষের কী-আশ্চর্য আবিষ্কার—ধরা যাক আমার যদি এখনো বিয়ে না হ’তো, তাহলে যে-আমি আজ নয়নাংশুর প্রেমে পড়েছি সেই আমি যে কাল গান শুনে মুক্তিপদর প্রেমে প’ড়ে যেতুম না তার বিশ্বাস কী? কিন্তু আমি বিবাহিত ব’লেই ও-রকম ভাববো না, ভাবলেও চাপা দিয়ে দেবো, আমার মায়ের সঙ্গে একমত হবে যে ও-রকম ভাবা উচিত নয়। এইতো আমাদের ‘প্রেম’, নয়নাংশুর ফলাও ক’রে তোলা ‘ভালোবাসা’ —তার উপর ভরসা রাখলে প্রত্যেকটা মানুষ কি ছিন্নভিন্ন হ’য়ে যেতো না, যদি না বিয়ে তাদের মজবুতভাবে বেঁধে রাখতো?
আবার বৃষ্টি এলো-ঠাণ্ডা ভেজা বাতাসের ঝাপট—তুমি এখন কী করছে, জয়ন্ত? ঘুমিয়ে পড়েছো? না চোখ বুজে আমার কথা ভাবছো? না খোলা চোখে তাকিয়ে আছো অন্ধকারে? না, তুমি নয়নাংশু নও, তুমি জয়ন্ত স্বাস্থ্যবান জোরালো পুরুষ তুমি, ম্লান রক্তের ভাবুনে মানুষ নও, তুমি ধারণায় চলো না, যে-জিনিসটা যা সেটাই তোমার কাছে ঠিক, খিদে পেলে খেতে হয়, প্রেম পেলে প্রেম করতে হয়, ও-সব কোনো তর্কের ব্যাপার নয় তোমার কাছে—আমি জানি তুমি কী করছো এখন। এতদিন তুমি ছটফট করেছো রাত্রে, কল্পনা করেছে রাত্রে, কল্পনা করেছে অন্য এক বিছানায় অংশুর সঙ্গে আমাকে, ঈর্ষা তোমাকে এক ঝাঁক মশার মতো যন্ত্রণা দিয়েছে, কিন্তু আজ তুমি পেয়েছো তোমার লোটনকে, ডাক্তারের ছুঁচের মধ্যে রক্তের মতো আমি তোমার হাতে উঠে এসেছি, তাই আজ অঘোরে ঘুমুচ্ছো তুমি, সারাদিন যারা গতর খাটে তারা যেমন অচেতন ঘুমোয় তেমনি এক ময়লা কাপড়ের বস্তার মতো উচু হ’য়ে প’ড়ে আছে তোমার বৌ। কাল সকালে তুমি নতুন উদ্যমে কাজে বেরোবে—প্রেসে ব’সে হুড়মুড় করে পাঁচ কলম লিখে ফেলবে, ঘোরাঘুরি করবে বিজ্ঞাপনের জন্য—না, জয়ন্ত এয়ার-কণ্ডিশন আপিশে ব’সে তুমি দিন কাটাও না, তুমি রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ট্রামে-বাস-এ ঘোরাঘুরি করো সারাদিন, তুমি স্বাধীন, তুমি নির্ভীক–আমার জয়ন্ত! আমার প্রাণ! আমার আলো! তোমার জন্য আমার তেষ্টা পাচ্ছে, এই বৃষ্টির শব্দে তেষ্টা পাচ্ছে আমার-চলো সেই সুড়ঙ্গে আবার, যার ছাদ ফেটে স্রোত নেমে আসে—আমার তেষ্টা পাচ্ছে, কিন্তু জল আছে খাবার ঘরে আমি কেমন ক’রে উঠে যাই, যদি নয়নাংশু ন’ড়ে ওঠে, কিছু বলে, বা কোনোভাবে আমাকে বুঝতে দেয় যে সেও ঘুমোয়নি—যদি বাধ্য হই কিছু বলতে, যদি খোলাখুলি কিছু জিগেস করে নয়নাংশু—না, এখন তা চাই না, কেনো কথা-কাটাকাটি চাই না এখন, আমি এখন ভালোবাসছি,—আমাকে ভালোবাসাতে দাও, শুয়ে-শুয়ে তোমাকে ভালোবাসছি, জয়ন্ত-না, এই ভালো, এই ভান, এই তেষ্টা নিয়ে শুয়ে থাকা নিঃশব্দে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন