দীনবন্ধুর নোটবই

রতনতনু ঘাটী

দিনুকাকু আজও এল না৷ আজ সারাদিন বৃষ্টি৷ দিনুকাকু আসবে কেমন করে? আসা মানে তো তিন মাইল হাঁটা, তারপর বাস, তারপর ট্রেন, তারপর আবার বাস৷ দিনুকাকুর ভালো নাম দীনবন্ধু৷ থাকে মেদিনীপুরের তমলুকের কাছে একটি গ্রামে৷

এই বৃষ্টির মধ্যে আমরা সবাই এসেছি আমাদের ‘ভবানীপুর ভৌতিক ক্লাব’-এ৷ খাতা দেখলেই বোঝা যাবে, জনাবিশেক সদস্য হাজির৷ আসলে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে দিন পঁচিশেক হল৷ তাই ভৌতিক ক্লাব আজ ভরতি৷ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, আমাদের যদুবাবুর বাজারের শ্রীমন্তদা সেদিন বলছিল, ‘পরীক্ষা-টরিক্ষা সব ফুটুস৷ এবার জমবে আমাদের ভূতের গল্পের আখড়া৷’

আসলে শ্রীমন্তদা ওভাবেই কথা বলে৷ ওরকম ভাষায়৷ ছোটকা বলে, ‘শ্রীমন্ত চারবার মাধ্যমিক দিয়েছে৷ ভগবান ওর কপালে পাশ কথাটা লেখেননি৷ তাই ওর কথাবার্তাও ওরকম৷’

আমি মনে মনে বলি, ‘ভগবান কি সকলের কপালে সব কথা লেখেন? কিছু কিছু কথা চেষ্টা করে নিজেকেই লিখে নিতে হয়৷’ তা যাই হোক, শ্রীমন্তদার এই উদ্যোগে পাড়ার মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক দেনেওলা সব ছেলে-মেয়েই একত্রে৷ সব্বাই ভবানীপুর ভৌতিক ক্লাবের সদস্য৷ এই কনসেপ্টটা শ্রীমন্তদারই৷ আজকাল অনেক নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ক্লাব হচ্ছে৷ কবিতা লেখার ক্লাব, ছবি আঁকার ক্লাব, এমনকী লাফিং ক্লাবও তৈরি হয়েছে কলকাতায়৷ তা হলে ভূতের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে ক্লাব নয় কেন? প্রথমে শ্রীমন্তদা ঠিক করেছিল ভৌতিক ক্লাবের সদস্য হতে হলে কমপক্ষে ক্লাস এইট পাশ হতে হবে৷ শ্রীমন্তদার এই নিয়ম, খুব ছোটোরা ভূতের ভয় পাবে বলে কি না জানি না৷ তবে আমরা দিন পনেরোর মধ্যে ক্লাবের মেম্বারশিপ নিয়ে নিলাম৷

ক্লাবের কার্যক্রম ঠিক করেছিল শ্রীমন্তদাই৷ মাসের প্রথম এবং তৃতীয় রবিবার সন্ধ্যে বেলা সদস্যরা এসে ক্লাবে হাজির হবে৷ ক্লাবঘরের দরজা এবং জানলা বন্ধ করে দেওয়া হবে৷ ঘরে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে জিরো পাওয়ারের নীল বাল্ব৷ দুটো ফ্যানই ঘুরবে ফুল স্পিডে৷ পাঁচজন করে সদস্য ভূতের গল্প বলবে৷

আমরা সদস্যরা গল্প বলতে শুরু করেছিলাম৷ কেউ শোনাল বই থেকে পড়া ভূতের গল্প, কেউ শোনাল দাদু-ঠাকুমার মুখ থেকে শোনা ভূতের গল্প৷ কেউ কেউ টিভিতে দেখা ইংরেজি ভূতের গল্প শুনিয়েও দিল নিজের গল্প বলে৷ চার-ছটা সিটিংয়ের পর তেমন জমল না ব্যাপারটা৷

একদিন শ্রীমন্তদা বলল, ‘না রে, তেমন জমছে না গল্পগুলো৷’

শ্রীমন্তদাকে থামিয়ে দিয়ে বিভাস বলল, ‘এক কাজ করলে হয় না? যিনি ভূতের দেখা পেয়েছেন, এমন কাউকে এনে, তাঁর কাছ থেকে ভূতের গল্প শুনলে কেমন হয়?’

আমরা একবাক্যে সমর্থন করলাম বিভাসকে৷ ঋতমা বলল, ‘ঠাকুমা টাইপের কাউকে পেলে আরও ভালো হয়৷’

তামস বলল, ‘মেয়েরা যেখানেই যাবে, দল বাড়াবে৷ ঋতমা তাই ঠাকুমার কথা বলছে৷’

প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠল সুনয়না, ‘কক্ষনো না৷ ভূতের গল্প ঠাকুমারাই ভালো বলতে পারেন৷’

ঝগড়া জমতে শুরু করেছে দেখে শ্রীমন্তদা সকলকে থামিয়ে দিল৷ বলল, ‘দাদু বা ঠাকুমা যেই হোন, আমাদের খুঁজে বার করতেই হবে ভূতের গল্প-জানা একজনকে৷ দেখি চেষ্টা করে৷’

আমরা জানি, শ্রীমন্তদা চেষ্টা করলে হবে না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই, শুধু মাধ্যমিক পাশ করা ছাড়া৷ হলও তাই৷ মাসখানেকের মধ্যে একদিন সন্ধ্যে বেলা শ্রীমন্তদা হাজির করল ভৌতিক ক্লাবে দিনুকাকুকে৷

রোগা, ঝাঁটার মতো চেহারা, মাথায় বাবরি চুল৷ চোখ দুটো গর্তের মধ্যে, অনেকটা ভিতরে৷ হাঁটুর সামনে লালচে ধুতি৷ গায়ে ফুলশার্ট জামা, তিন-চার জায়গায় তালি দেওয়া৷ কাঁধে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে কাঁথাস্টিচের ঝোলা৷ ঝোলার মধ্যে গামছা আছে, যতটা ময়লা হওয়া সম্ভব, ততটাই৷ আরও কিছু আছে, যা আমরা কেউ জানি না৷ মিয়ামি বলে, ওতে নাকি ভূত তাড়ানোর মন্ত্রের খাতাও আছে৷ সার্থক বলে, ওতে নাকি তাবিজ-মাদুলি আছে৷ যাদের বেশি ভূতে ধরে, তাদের তাবিজ-মাদুলি পরিয়ে ভূতকে গণ্ডি এঁকে দেয়৷ যত বড়ো ভূত হোক, গণ্ডির মধ্যে ঢোকার সাধ্যি কারও নেই৷

ওরা যে যাই বলুক, আমরা একদিন শ্রীমন্তদাকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা শ্রীমন্তদা, দিনুকাকুর ব্যাগে গামছা ছাড়া আর কী আছে?’

শ্রীমন্তদা গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘যাই থাকুক, তাতে তোদের কী? দিনু এসেছে ভূতের গল্প বলতে৷ ও তো ভূতনামানো গুনিন৷ ও নিজে ভূতের সঙ্গে কথাও বলে৷’

শ্রীমন্তদা দিনুকাকুকে তমলুকের কাছের গ্রাম থেকে যে কীভাবে জোগাড় করেছে, সে-গল্প কাউকে বলেনি৷ প্রথম যেদিন দিনুকাকু এসেছিল, শ্রীমন্তদা আমাদের সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘দীনবন্ধু অত দূর থেকে আসবে তোদের ভূতের কাণ্ড বলতে, একদম জ্যান্ত ভূতের কেরদানির কথা৷ তাই সকলকে আরও দশ টাকা করে সদস্য-ফি বেশি দিতে হবে৷ ও তো আর মাগনা আসবে না!’

শ্রীমন্তদার কথায় দিনুকাকুও ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিল৷ মাথার বাবরি চুল ঘাড়ের এপাশে-ওপাশে দুলে উঠেছিল তখন৷

পরে শ্রীমন্তদাই আমাদের বলেছিল, দিনুকাকুকে প্রত্যেক সিটিংয়ের জন্য দিতে হয় আড়াই-শো টাকা৷ দিনুকাকু প্রথম যেদিন আমাদের ভৌতিক ক্লাবে এসেছিল, সেদিন ঝেঁপে বৃষ্টি হচ্ছে সন্ধ্যে বেলা৷ বাজও পড়ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে৷ তাই সদস্যদের সকলকে মা-বাবারা আসতে দেননি৷ যাদের সেদিন সন্ধ্যে বেলা টিউশন ছিল, তারাও আসতে পারেনি৷ আমি এসেছিলাম৷ দিনুকাকু সেদিন যে গল্পটা বলেছিল, মনে হলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়৷

দিনুকাকু মাথাটা নীচু করে চোখ বন্ধ করল৷ মাথার লম্বা চুলগুলো উলটে দিল সামনে৷ তারপর কীসব মন্ত্র বলতে বলতে মাথাটা বনবন করে ঘোরাতে লাগল৷ কাছে কোথাও বাজ পড়ল সে-সময়৷ আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম৷ তা হলে কি দিনুকাকু ভূত আনছে এই ঘরে? ভয় পেয়ে শ্রেয়া বলল, ‘না, না, দিনুকাকু, ভূত আনতে হবে না৷ শুধু ভূতের গল্পই বলো৷’ অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনাল শ্রেয়ার গলা৷

স্থির চোখে তাকিয়ে দিনুকাকু শুরু করল, ‘সেবার আমাদের গ্রামে মড়ক হয়েছিল৷ কলেরায় মারা যাচ্ছে গ্রামের লোক৷ বলতে গেলে শ্মশানে চিতা নিভছে না৷ সে-সময় কমলা সাঁতরার বরও মারা গেল দু-দিনের কলেরায়৷ সংসারে কমলা একা৷ ছোট্ট খড়ের ঘর, মাটির দেওয়াল৷ দেখতে দেখতে মড়ক সরে গেল আমাদের গ্রাম থেকে পাশের গ্রামে৷’

দিনুকাকু থেমে কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে তাকাল৷ তারপর শুরু করল, ‘কমলার বর মরল বটে, কিন্তু ওকে আর ছেড়ে গেল না৷ সন্ধ্যে হলেই শুরু হয়ে যায় কমলার বরের উপদ্রব৷ অন্ধকার রাতে কলাগাছের পাশে কলাপাতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ অনেকদিন কমলা দেখেছে, উঠোন দিয়ে সাদা কাপড় পরা একটা লোক গিয়ে সোজা তেঁতুল গাছে হেঁটে হেঁটে উঠে গেল৷ কমলা মুখ বুজে সহ্য করছিল৷ একদিন হল কী, কমলা ঘরের কেরোসিনের ল্যাম্পটা নিভিয়ে সবে শুয়েছে, অমনি ঘরের চারধারে রাখা মাটির কলসিগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে চলে এল ওর বিছানায়৷ কোনোটায় চাল, কোনোটায় ডাল রাখা কলসিগুলো আলো জ্বালতেই ফের ফিরে গেল যেখানকার জিনিস, সেখানে৷ কমলা মাটির মেঝেতে বিছানা পেতে শুত৷ খুব ভয় পেল সে৷ সারারাত ঘুমোতে পারল না৷ আলো নেভালেই সেই এক কাণ্ড৷

‘পরদিন সকাল বেলা কমলা আমার কাছে এল৷ বলল সব ঘটনা৷ আমি বললাম, আজ তো যেতে পারব না৷ পাশের গ্রামে একটা স্কুলে-পড়া মেয়েকে ভূতে ধরেছে ক-দিন হল৷ ওর সামনে পরীক্ষা৷ আজ রাতে ওর ভূতটা তাড়াই৷ কাল তোর কাছে যাব৷

‘কমলা ফিরে গেল৷ পরদিন সকালেই আবার কমলা এসে পায়ে পড়ল৷ কাল নাকি রাত্রে কেউ ওর গলা টিপে ধরেছিল৷ আলো জ্বালতেই সব ভোঁ-ভাঁ৷ আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে৷

‘আমি বললাম, শোন কমলা, ও তো তোর বর৷ ও যখন কিছুতেই ছাড়ছে না, তখন অন্য ব্যবস্থা করতে হবে৷ আজও যেতে হবে স্কুলে-পড়া মেয়েটাকে বাঁচাতে৷ কাল অনেক চেষ্টা করেছি৷ ভূতটা বলছে, ও নাকি যাওয়ার জন্য আসেনি৷ মেয়েটা বই-খাতা গুছিয়ে রাখল বিকেলে, তো সন্ধ্যে বেলা অঙ্কের খাতা উধাও৷ অঙ্ক করতে করতে হঠাৎ দেখল প্রশ্নমালার উত্তরের পাতাটা বই থেকে হাওয়া৷ সন্ধ্যে বেলা বই পড়তে পড়তে অন্ধকারের দিকে তাকালেই দেখে, কেউ ওকে চোখ পাকিয়ে ডাকছে হাত নেড়ে৷ তার চোখ দুটো একটা যোগচিহ্ন, আর-একটা গুণচিহ্ন৷ মেয়েটার পরশু অঙ্ক পরীক্ষা তো! ওই ভূতটাকে বোতলে ভরে ফেলে আসতে হবে মাকানদাড়ির পুকুরে৷ তারপর তোর বরের ব্যবস্থা৷

‘কমলা যাবে না৷ অনেক বুঝিয়েবাঝিয়ে বাড়ি পাঠালাম৷ একদিন পরে রাত্রে যখন কমলার বাড়ি গেলাম, দেখি, ল্যাম্প জ্বেলে দরজায় বসে আছে কমলা৷ আমাকে দেখে কেঁদে ফেলল৷ একলা থাকে৷ এত যদি ভূতের তাণ্ডব হয়, তাহলে থাকবে কেমন করে? কাল রাতে কমলা যখনই আলো নিভিয়ে শুয়েছে, তখনই ওর হাঁটুর উপর একটা ভারী কিছু চেপে বসেছে৷ চোখ মেলে দেখেছে, কেউ কোত্থাও নেই৷’

‘কমলা কথা বলতে বলতে হঠাৎ ওর মাথার চুল এলো করে দিল৷ চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে পাগলের মতো মাথা ঘোরাতে লাগল৷ তারপর ছুটে গিয়ে বসল ঘরের কোণে৷ বিছানার চাদরটা টেনে গা-মাথা সব ঢেকে বসে রইল৷ আমি বুঝলাম, ব্যাপার সুবিধের নয়৷ কাছে যেতেই বলল, আঁমি আঁমার গিঁন্নির কাঁছে এঁসেছি৷ বুঝলাম কমলার বর ভর করেছে তার উপর৷ অমনি একটা নারকেল ঝাঁটা নিয়ে দমাদ্দম মার দিতে লাগলাম৷ কয়েক ঘা মারার পর জিজ্ঞেস করলাম, এসেছিস, ভালো করেছিস৷ এবার চলে যা৷

‘বাইরে তখন জ্যোসনায় উবুরচুবুর করছে গাঁ-উঠোন৷ একটা প্যাঁচা ডাকল পাশের তেঁতুল গাছ থেকে৷ কুয়াশার মতো ঝুপুরঝুপুর করে রাত নামছে৷ ধরলাম কমলার চুলের মুঠি৷ চুলের মুঠি ধরলে ভূত আর বদমাইশি করতে পারে না৷ অমনি চিঁ চিঁ করে কমলার বরের ভূত বলল, আঁ্যাঁত জোঁরে ধঁরেছ কেঁন? আঁমার লাঁগে না?

‘আমি তখন মারলাম এক থাপ্পড়৷ বললাম, যাবি তো যা, না হলে কিন্তু ব্যবস্থা নিতে হবে৷

‘উত্তরে ভূত বলল, যাঁব কেঁন? আঁমরা তাঁহঁলে থাঁকব কোঁথায়?

‘বললাম, খুব তর্ক করছিস! বলে যেই গণ্ডি-মন্ত্র ঝাড়লাম, অমনি সব সুনসান৷’

দিনুকাকু চুপ করে আছে৷ আমরা ভাবলাম, ভূত এবার ছাড়ল বুঝি কমলাকে৷ দূরে খুব জোরে বিদ্যুতের ঝিলিকে জানলার কাচ ফুঁড়ে কিছুটা আলো ঢুকল৷ আমরা পলকে এ-ওর ফ্যাকাসে মুখটা দেখে ফেললাম৷

দিনুকাকু বলল, ‘তারপর ঘরে ঈশান কোণের জানলায় দেখলাম একটা ঝোড়ো বাতাস ঘুরপাক খাচ্ছে৷ গোঁ গোঁ করে গোঙাচ্ছে কমলা৷ ঝোলা থেকে বের করলাম একটা বড়ো পেরেক আর হাতুড়ি৷ বললাম, তুই যাবি, না ব্যবস্থা করব?

‘ভূত বলল, যাঁব৷

‘বললাম, যাবি, কিন্তু আর কখনো আসবি না তো?

‘ভূত বলল, আসব৷

‘আমি বললাম, আসা চলবে না আর৷ মেয়েটাকে বাঁচতে দিবি না? বলে পেরেকটা মন্ত্র করলাম৷ বললাম, চল, তোকে আটকে রাখি৷ বলেই ছিঁড়ে নিলাম কমলার মাথার একগোছা চুল৷ গাঁ গাঁ শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেল কমলা৷ আমি বেরিয়ে চললাম তেঁতুল গাছের দিকে৷ চুলটা পেরেকে জড়ালাম৷ অমনি চিৎকার করে উঠল কমলার বরের ভূত, আঁমাকে আঁটকিও নাঁ৷ আঁমি আঁর আঁসব নাঁ৷

‘শুনলাম না ভূতের কথা৷ ভূতের কথায় বিশ্বাস করতে নেই৷ তেঁতুল গাছে পেরেক পুঁতে দিলাম আটকে কমলার বরের ভূতকে৷ ও ওর ভূত-জীবনে মুক্তি পাবে না আর৷ গাছ থেকে নেমে এসে দেখি কমলা উঠে বসেছে৷ কমলাকে বললাম, ওকে বন্দি করে রাখলাম৷ তোর আর ভয় নেই৷

‘কমলা বলল, দিনুদা, বোতলে ভরে ফেলে দিলে না কেন রূপনারায়ণ নদীতে?

‘বললাম, কাল স্কুলপড়ুয়া মেয়েটার ভূতকে বোতলে ভরেছি তো! আজ আর পারব না৷ পরপর দু-দিন ভূতকে বোতলে ভরার আদেশ নেই গুরুর!’

দিনুকাকু ব্যাগ গোছাতে লাগল৷ শ্রীমন্তদা ক্লাবঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল৷ আজকের মতো ভূতের গল্প শেষ৷ আমি শুধু ভাবলাম, আপনজনের ভূতকেও মানুষ ভূতের মতোই দেখে!

যে ক-দিন দিনুকাকু ভূতের গল্প বলেছে, সে ক-দিনই আমরা একা একা কেউ বাড়ি ফিরতে পারিনি৷ ভয় করেছে খুব৷ শ্রেয়া তো সন্ধ্যের পর ঘরের বারান্দায় গেলে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যায়৷ যে আমি, আমার ভূতের ভয় কম, সেই আমিও ভূতের ভয় যে একেবারে পাচ্ছি না, তা কিন্তু নয়৷ দিনুকাকু ভূতছাড়ানো গুনিন৷ ভূতের মন্ত্র জানে৷ এসব কথা বিশ্বাস করতে মন চায় না৷ তবু আকাশ বলেছে, সে দিনুকাকুর ব্যাগের নোটবই থেকে কিছু ভূততাড়ানো মন্ত্র কপি করে নেবে৷ যদি সুযোগ পায়, জেরক্সও করে নিতে পারে৷

আমার সেরকম কোনো বাসনা নেই৷ কিন্তু এ-মাসের প্রথম রবিবার দিনুকাকু আসেনি আমাদের ভৌতিক ক্লাবে৷ সেদিন সকলে দিনুকাকুর গল্পই করেছে৷ কেউ গুনিনের অসীম ক্ষমতা নিয়ে কথা বলেছে, কেউ ‘ওসব ফালতু’ বলে উড়িয়েও দিয়েছে৷ শ্রীমন্তদা বলেছে, ‘হয়তো অসুখবিসুখ হয়েছে৷ যারা ভূত তাড়ায়, তাদের হরবখত ভূতের আক্রোশেও পড়তে হয়৷ দেখা যাক, একবার খোঁজ নিতে হবে৷ পারলে ওর ঠিকানায় কুরিয়ারে একটা চিঠি ছেড়ে দেব৷’

আজ মাসের শেষ রবিবার৷ ভৌতিক ক্লাব সদস্যে একেবারে থইথই৷ কিন্তু আজও দেখা নেই দিনুকাকুর৷ রাত আটটার ঘর ছুঁইছুঁই করছে ঘড়ির কাঁটা৷ বৃষ্টিতে ঘর-বার করতে করতে শ্রীমন্তদা বলল, ‘কী কাণ্ড! লোকটা হাওয়া হয়ে গেল নাকি? কুরিয়ারে চিঠি ছাড়লাম দিন পাঁচেক হল৷ তারও রসিদ ফেরত আসেনি৷ দিনু যদি না আসতে চায় বা টাকা যদি ওর কম হচ্ছে মনে করে, তাহলে তো কথাটা পাড়লেই পারত৷ এমন ব্যবহার তো ঠিক না৷ দেখি, অন্য লোকের তল্লাশ করতে হবে৷’

আমরা ভাবলাম, অন্য লোক নিশ্চয়ই জোগাড় করতে পারবে শ্রীমন্তদা৷ কিন্তু সে লোক কি ভূতের সঙ্গে কথা বলতে পারে? সে কি ভূত তাড়াতে পারে?

এমন সময় প্রায় বিদ্যুচ্চমকের মতো ছাতা মাথায় দিয়ে হাজির হল দিনুকাকু৷ ছেঁড়া ছাতায় ভিজে প্রায় একশা৷ শ্রীমন্তদা রাগ দেখিয়ে কীসব বলতে গেল৷ সে-কথার কিছুই শোনা গেল না৷ সদস্যদের উৎসাহ এবং উল্লাসে ঢাকা পড়ে গেল শ্রীমন্তদার রাগের কথা৷

দিনুকাকু ময়লা গামছাটা বার করে গা-হাত-পা-মাথা মুছতে মুছতে বলল, ‘এ-মাসটা বড়ো ঝঞ্ঝাটিয়া গেছে গো শ্রীমন্তদা৷ এমন হলে মানুষ বাঁচে?’

শ্রীমন্তদার আগেই আমরা বলে উঠলাম, ‘কেন? কী হয়েছে দিনুকাকু?’

গামছাটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল, ‘সে এক বেত্তান্ত৷ তোমাদের যেসব গল্প বলি, সেইরকম৷ সে বলতে অনেক সময় লাগবে৷ আজ তো হাতে বেশি সময় নেই৷’

শ্রীমন্তদা প্রায় আঁতকে উঠে বলল, ‘তুমি চলে যাবে নাকি? এরকম করলে তো হবে না দিনু! অন্য লোক দেখতে হবে৷ এখন আমাদের সদস্যদের সক্কলের ছুটি৷ আর এ-সময় তুমি কামাই করলে চলে?’

দিনুকাকু বলল, ‘শ্রীমন্তদা, রাখো আর ছাড়াই করো, আমার তো কিছু করার নেই৷ আমার সমস্যায় তুমি পড়লে এরকমই করতে৷ বেরিয়েছিলাম গো ঠিক সময়ে৷ এখন তো আর আগের মতো হুটহাট বাস-ট্রাম ধরতে পারি না৷ তার উপর এই বৃষ্টি৷’

শ্রীমন্তদা গলা চড়িয়ে বলল, ‘তাহলে আজ আর এলে কেন?’

‘এলাম, তোমাদের দেখা দিতে,’ বলে দিনুকাকু ব্যাগটা গোছাতে লাগল৷

আমরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘একটা গল্প অন্তত বলো দিনুকাকু৷’

‘একটা কেন, অনেক গল্পই শোনাতে আসব৷ আমাকে যদি রাখো, তবে তো! শ্রীমন্তদাদা, এখন আর কেউ ব্যথা দিয়ে কথা বললে ভালো লাগে না,’ বলে দিনুকাকু উঠে দাঁড়াল৷

শ্রীমন্তদা একটু নরম হয়ে বলল, ‘তুমি সত্যিই চলে যাবে দিনু? এই বৃষ্টির মধ্যে? আজকের রাতটা চলে যেও৷ গল্প নাহয় আজ না-ই বললে৷’

দিনুকাকু বাবরি চুল করতে করতে বলল, ‘না গো শ্রীমন্তদাদা, আজ যেতে হবে৷ দু-তিনটে বাড়িতে ডাক আছে৷ আমি আবার আসব৷’

শ্রীমন্তদা পকেট থেকে আড়াই-শো টাকা বার করে দিনুকাকুকে দিতে গেল৷ কিছুতেই নেবে না৷ বলল, ‘কাজই করলাম না, তার টাকা নেব কেন?’

তবু জোর করে টাকাটা দিনুকাকুর হাতে গুঁজে দিল শ্রীমন্তদা৷ ব্যাগের ভিতর থেকে একটা ছোটো নোটবই বার করল দিনুকাকু৷ তার মধ্যে টাকাটা রাখতেই লোডশেডিং হয়ে গেল৷ অন্ধকারে ডুবে গেল আমাদের ভৌতিক ক্লাব এবং আমরা সবাই৷ হনহন করে বেরিয়ে দিনুকাকু, বৃষ্টি এবং বাজ পড়ার মধ্যে৷

আমরা যে-যার জায়গায় বসে৷ বাড়ি যাব কী করে? মিনিট দশেক পরে আলো ফিরে এল৷ আর অমনি হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল একটা লোক৷ বলল, ‘আমি স্পিড কুরিয়ার থেকে আসছি৷ আপনারা একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন দিনু হাজরার নামে তমলুকে৷ উনি মারা গেছেন এ-মাসের ন-তারিখে৷’ চিঠি ফেরত দিয়ে চলে গেল লোকটা৷

আমাদের পা কাঁপছে৷ তাহলে একটু আগে যে-দিনুকাকু চলে গেল, সে কে? শ্রীমন্তদারও মুখ থেকে কথা সরছে না৷ এমন সময় আমি দেখলাম টেবিলের ওপর পড়ে আছে দিনুকাকুর নোটবইটা৷ বললাম, ‘শ্রীমন্তদা, ওই তো দিনুকাকুর নোটবই৷’

শ্রীমন্তদা নোটবইটা তুলে নিল৷ খুলে দেখল, হ্যাঁ, দিনুকাকুরই নাম লেখা নোটবই৷ তার মধ্যে আড়াই-শোটা টাকাও আছে!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন