পাতালরেলের টিকিট

রতনতনু ঘাটী

অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যে সাতটা পেরিয়ে গেল৷ সকাল থেকেই মনটা কেমন আনমনা হয়ে আছে৷ সকালেই একটা কোকিল একটানা ডেকেছিল অনেকক্ষণ৷ কেমন মন কেমন-করা সেই ডাক৷ আমাদের বাড়ির পাশের মোহনবাঁশি আমের গাছটায় কোকিলটা মাঝে মাঝে এসে বসে৷ একটানা অনেকক্ষণ ডাকে৷ আজও ডেকেছিল কোকিলটা৷ কোকিলের ডাক শুনলে মন ভালো হয়ে যায় এক-একদিন৷ আজ মনটা আনমনাই হয়ে আছে৷

আমি চাঁদনিচকে পাতালরেল ধরে বাড়ি ফিরি৷ স্টেশনে স্মার্ট গেটে কার্ডটা পাঞ্চ করতে গিয়ে দেখলাম কার্ডের টাকা ফুরিয়ে গেছে৷ অগত্যা টিকিট কাউন্টারে স্মার্ট কার্ডে টাকা ভরার জন্যে দাঁড়ালাম৷ কাউন্টারের ভিতর থেকে ভদ্রলোক বললেন, ‘মেশিন খারাপ, স্মার্ট কার্ডে টাকা ভরা যাবে না৷’ আমার কাছে মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার এগজ্যাক্ট ফেয়ারের খুচরো ছ-টাকা নেই৷ তাই পাশের কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম৷

টিকিট কাটার লাইনটা বেশ বড়ো৷ ধীরে ধীরে লাইনটা এগোচ্ছে৷ আমার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে৷ প্যান্ট-শার্ট পরা৷ মাথায় কাঁচা-পাকা চুল৷ চোখে চশমা৷ ভদ্রলোক একবার বাঁ-পকেটে, একবার ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে খুচরো টাকা বের করে গুনছেন৷ ফের পকেটে রেখে দিচ্ছেন৷ আমি ভাবলাম, ভদ্রলোকের যদি খুচরো টাকা আছে তো উনি এগজ্যাক্ট ফেয়ারের কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটতেই পারেন৷ খামোখা কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এই কাউন্টারটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে৷ একসময় ভদ্রলোক ফের খুচরো টাকা বের করে গুনতে লাগলেন৷ আমি থাকতে না পেরে বললাম, ‘দাদা, আপনি তো এগজ্যাক্ট ফেয়ারের কাউন্টারে টিকিট কাটলেই পারতেন৷ তাহলে তো এতক্ষণ কষ্ট করে লাইনে দাঁড়াতে হত না?’

ভদ্রলোক কেমন স্মিত হাসি হেসে বললেন, ‘কষ্টে কী-ই বা আসে-যায়?’

আমি মনে মনে ভাবলাম, এ কীরকম কথা! কষ্টে কী আসে-যায়? যাক গে, উনি যদি কষ্ট করতে চান তো করুন৷ ওঁর ব্যাপার৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম৷ ভদ্রলোক কাউন্টারে পৌঁছোলেন৷ ছ-টাকা দিয়ে একটা মহানায়ক উত্তমকুমার যাওয়ার টিকিট চাইলেন৷ টিকিট নিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে সরে দাঁড়ালেন৷ আমি দশ টাকা দিয়ে একটা মহানায়ক উত্তমকুমার যাওয়ার টিকিট চাইলাম৷ ওই স্টেশনে নেমে আমাকে ঠাকুরপুকুর যেতে হয় দু-বার অটো বদলে৷ হঠাৎ দেখলাম, আমার পায়ের কাছে একটা টিকিট পড়ে আছে৷ ওই ভদ্রলোকই বোধ হয় টিকিটটা পকেটে রাখতে গিয়েছিলেন৷ ভুল করে পড়ে গিয়েছে৷ আমি টিকিটটা কুড়িয়ে ভদ্রলোকের পিছন পিছন ছুটলাম, ‘এই যে দাদা, শুনছেন৷ আপনার টিকিটটা পড়ে গিয়েছিল৷ এই নিন৷’

ভদ্রলোক সকাল বেলার সেই কোকিলের ডাকের মতো বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘টিকিটে কী আসে-যায়?’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন৷ টিকিটটা ওঁর হাতে দিতে গিয়ে দেখলাম, টিকিটের উপর একটা লাল কালির ফোঁটা৷ হঠাৎ আমার মনে হল, ওটা রক্তের ফোঁটা নয় তো? তারপরে ভাবলাম, তাই-বা কেন হবে? এমন অলীক ভাবনার কোনো মানে আছে কি? পাতালরেলের টিকিট, সদ্য মেশিন থেকে বেরিয়েছে৷ তাতে রক্তের ফোঁটা আসবে কোথা থেকে? নিজের এমন অবাস্তব ভাবনার জন্যে নিজেকেই বকে দিলাম৷ তবে লাল দাগটা কিন্তু ভুল দেখিনি৷

ভদ্রলোক তখন সিঁড়ি দিয়ে নামছেন৷ আমিও এগিয়ে গেলাম৷ ট্রেন আসতে চার মিনিট দেরি এখনও৷ প্ল্যাটফর্মে নেমে সামনেই দাঁড়ালাম৷ প্রথম কম্পার্টমেন্টে উঠলে মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনের বাইরে বেরোনোর গেটটা কাছাকাছি হয়, ভিড়ও কম থাকে৷ যাঁরা নিয়মিত পাতালরেলে যাওয়া-আসা করেন, তাঁরা অনেকেই নির্দিষ্ট কম্পার্টমেন্টে ওঠেন৷ আমিও ঠিক এরকম সময় যখন এই কম্পার্টমেন্টে উঠি, তখন অনেক চেনা মুখের দেখা পাই৷ তবে আমি একটু লাজুক স্বভাবের বলে যেচে তেমন কারও সঙ্গে আলাপ করি না৷

এমন সময় দেখলাম, আমার ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে৷ আমি ট্রেন ধরার জন্যে রেডি, ট্রেনটা প্রায় এসে গিয়েছে, হঠাৎ পাশে তাকাতেই দেখলাম, সেই ভদ্রলোক আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ট্রেন ধরার জন্যে৷ ট্রেনটা কাছাকাছি আসতেই ভদ্রলোক ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিতে গেলেন৷ হতচকিত আমি খামচে ধরে ফেললাম জামাসুদ্ধ ভদ্রলোককে৷ কোনো রকমে বাঁচানো গিয়েছে৷ অনেক লোক জড়ো হয়ে গেল৷ ভদ্রলোককে বেশ বিমর্ষ এবং ক্লান্ত দেখাচ্ছে৷ একটা কম বয়সি ছেলে ভদ্রলোককে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে৷ উনি এখন বেশ ঘামছেন৷

আমিও এগিয়ে গেলাম ওঁর কাছে৷ এই ট্রেনটা আমারও ধরা হল না৷ ক-মিনিট পরে ট্রেনটা চাঁদনিচকে স্টেশন ছেড়ে গেল৷ উলটো দিকের ট্রেনও এল, ছেড়েও গেল দমদমের দিকে৷ এখন প্ল্যাটফর্মটা বেশ ফাঁকা৷

আমি ওঁর পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম৷ সমব্যথীর গলায় বললাম, ‘এমন কাজ করতে গেলেন কেন? মানুষ বেঁচে থাকার জন্যেই তো কত কষ্ট করে? আর আপনি…?’

ভদ্রলোক খুব শান্ত এবং নিরীহ গলায় বললেন, ‘বেঁচে থাকায় কী আসে-যায়?’

আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বললাম, ‘না না, আপনাকে বেঁচে থাকতেই হবে৷’

উনি খুব বিষণ্ণ চোখে তাকালেন আমার মুখের দিকে৷ কোনো কথা বললেন না৷

আমি বললাম, ‘আপনার যত রাগ জীবনের উপর কেন?’

আবারও উনি আমার মুখের দিকে তাকালেন৷ তেমনই বিষণ্ণ চোখ৷

আমি কী করব? নতুন যাঁরা প্ল্যাটফর্মে জড়ো হচ্ছেন ট্রেন ধরার জন্যে, তাঁরা জানেন না, এই ভদ্রলোক একটু আগেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিলেন৷ আমি কি সবাইকে জানিয়ে দেব, এই ভদ্রলোক একটু আগে…৷ তারপর ওঁকে জোর করে ট্রেনে তুলে দেব? অনেক তরুণ ছেলে আছে, তারা জানলে ওঁকে হয়তো ঠিক বাড়ি পৌছে দিয়ে আসবে৷ আমার এই সব ভাবনার ফাঁকে দেখলাম, ভদ্রলোক এগিয়ে যাচ্ছেন প্ল্যাটফর্মের দিকে৷

আমিও নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিলাম৷ যাক, যা করার উনিই করুন৷ আমার কী? আমার উপর তো সব আত্মহননকারীকে বাঁচানোর দায়িত্ব কেউ চাপিয়ে দেয়নি৷ তারপর আজ রাতে আমাকে একটা কবিতা লিখতে হবে৷ কাল সকালে এই লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ফোন করবেন৷

সাতপাঁচ ভাবনার ফাঁকে পরের ট্রেন এসে গেল৷ আমিও হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম৷ ফিরে দেখা হল না, ওই ভদ্রলোক কী করলেন৷ মনটা আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠল৷ টানেল দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে৷ আমার ফের সকাল বেলার কোকিলের ডাকটা কানে বেজে উঠল৷ বেআক্কেলে কোকিল! আজ কেন যে অমন করে ডাকল? কখন যে ট্রেনটা মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনে এসে গেছে, খেয়াল হল ট্রেনের ঘোষকের ঘোষণায়৷

ট্রেন থেকে নেমেই এক অসম্ভব দৌড় শুরু হয় যাত্রীদের মধ্যে৷ আমি ওই দৌড়ের মধ্যে থাকি না যেমন, আবার এই দৌড়ের সময় আমার মধ্যেও কেমন একটা দৌড়োনোর স্রোত বয়ে যায়৷ অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মতো৷ তখন আস্তে হলেও দৌড়োই৷

স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম৷ বেশ বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে৷ আজকের চাঁদটাকে অন্য দিনের চেয়ে মনমরা মনে হল৷ আজকের দিনটাই যেন এমন৷

টালিগঞ্জে অটোর লাইনে দাঁড়ালাম৷ এই অটোর লাইন অনেক সময় অ্যানাকোন্ডার মতো এঁকেবেঁকে চলে যায় পিছনের পেট্রল পাম্প পর্যন্ত৷ আজ তত লম্বা লাইন নেই৷ জনা তিরিশেক লোক দাঁড়িয়ে আছে৷ তবে আজ অটো কম৷ রাস্তায় কোথাও জ্যামে আটকে আছে মনে হয়৷ লাইন খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে৷ এখনই ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটা বাজে৷ বাড়ি পৌঁছোতে সাড়ে ন-টা পেরিয়ে যাবে৷

মন থেকে ওই ভদ্রলোকের চিন্তা কিছুতেই যাচ্ছে না৷ কী হল ভদ্রলোকের? উনি কি আমার ট্রেনটাতেই উঠেছিলেন? নাকি আমার ট্রেনে না উঠে পরের ট্রেনে…? বাড়িতে গিয়ে টিভির খবরটা দেখতে হবে৷ কিছু যদি ঘটে তবে খবরে তো দেখাবে৷ ভদ্রলোক কি সংসারে খুব দুঃখী? কেন? হয়তো খুব সামান্যই চাকরি করেন৷ পান্তা জোটালে নুন ফুরিয়ে যায়? আমার মনে হয়, এই নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেললে কেমন হয়? লিখলে গল্পটা খুবই দুঃখের গল্প হবে৷ কিন্তু কেন? পৃথিবীতে এত দুঃখ ছড়িয়ে আছে, তার উপর আবার দুঃখের গল্প কেন? এই বিষয়টা নিয়ে আনন্দের গল্প লিখলে কেমন হয়? তাই তো উচিত৷ দুঃখী মানুষকে যতটুকু আনন্দ দেওয়া যায়৷

এসব ভাবনার মধ্যে এতটাই ডুবে ছিলাম যে, কখন অটো এসেছে, আমি অটোয় উঠে বসেছি, খেয়ালই নেই৷ আমি বসেছি অটোচালকের বাঁ-দিকে৷ অটো করুণাময়ী ব্রিজ পেরোল৷ পিঁপড়ের সারির মতো অটোর লাইন, এই রাত ন-টাতেও৷ অটো হরিদেবপুর পর্যন্ত ঢিমে গতিতে চলল৷ তারপর বেশ গতি পেয়ে গেল৷ এই মার্চ মাসের সন্ধ্যে-রাতে বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব আছে বাতাসে৷ আমি বেশ একটু গুটিয়ে নিলাম নিজেকে৷ এমন সময় লুকিং গ্লাসে চোখ পড়তেই দেখলাম, ওই ভদ্রলোক আমার পিছনে অটোর ডান দিকে বসে আছেন! চমকে উঠলাম৷ টালিগঞ্জে অটোর লাইনে তো আমার সামনে ভদ্রলোককে দাঁড়াতে দেখিনি! তাহলে উনি অটোতে বসলেন কী করে? মনে মনে ভাবলাম, না না, উনি ঠিকই অটোর লাইনে ছিলেন৷ আমিই আনমনা ছিলাম বলে ওঁকে দেখতে পাইনি৷

মনে মনে ভাবলাম, তাহলে ভদ্রলোক আমাদের দিকেই থাকেন৷ যাক, তাহলে ওঁকে বাঁচিয়ে একটা ভালো কাজ করেছি৷ হয়তো দেখা যাবে উনি আমাদের পাড়াতেই থাকেন৷ দেখাই যাক, উনি কবরডাঙায় গিয়ে ঠাকুরপুকুরের অটো ধরেন কি না৷

আজ সকাল থেকেই ক্ষণে ক্ষণে ভীষণ আনমনা হয়ে যাচ্ছি৷ কোনো কিছুতেই ঠিকমতো মন বসাতে পারছি না৷ কেন এমন হল আজ? তখনই মনে পড়ল, এ সেই কোকিলটার কাজ৷ সেই যে সকালে এমন মন কেমন করা সুরে ডাকল একটানা, আর তারপর থেকেই তো…!

একদিন আমার বাড়ির পাশের ওই আম গাছটায় এসে বসেছিল একটা হলদে পাখি৷ তার ওই আগুন ছড়ানো হলদে রং দেখে সেদিন মনটা যেন অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠেছিল৷ অনেকে ওই পাখিটাকে ‘বেনেবউ’ বলে ডাকে, অনেকে বলে ‘ইষ্টিকুটুম’৷ ছেলেবেলায় মেদিনীপুরের গ্রামে আমরা ওই পাখিকে ডাকতাম ‘হলদে পাখি’ বলে৷ সেদিন সেই হলদে পাখি দেখার পর সারাদিনই মনটা টইটই করেছিল আনন্দে৷ এক-একদিন এক-একটা পাখি, ফুল কেমন মন ভালো করে রাখে সারাদিন৷ আজ যেমন ওই কোকিলটা মন খারাপ করে দিয়েছে৷

হঠাৎ খেয়াল হতে দেখি, আমি ঠাকুরপুকুরের অটোয় বসে চলে এসেছি একদম বাড়ির কাছে৷ জেমস লং সরণির কাছে বাজারে নেমে গেলাম৷ বাঁ-দিকে আমার পাড়া৷ তিন মিনিট হাঁটলেই আমার বাড়ি৷ প্রায় দশটা বাজতে চলল৷ তড়িঘড়ি বাড়ি পৌঁছে গেলাম৷

বাড়িতে থাকি আমরা দু-টি প্রাণী, আমি আর মেঘনাদদা৷ আমার স্ত্রী চাকরি করে হলদিয়ায়৷ ছেলে-বউমা আর মেয়ে থাকে বেঙ্গালুরুতে৷ মহিষাদলে গ্রামের বাড়িতে মা আর ভাইরা থাকে৷ মেঘনাদদা আমার বাবার আমলের লোক, কবে থেকে যে আমাদের বাড়িতে আছে, কেউই মনে করতে পারে না৷

সবাই বলে, এই মাইক্রো ফ্যামিলির যুগে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন৷ মেঘনাদদাই রাঁধে, বাজার করে, সব দিক সামলায়৷

আমি আর মেঘনাদদা একসঙ্গে রাতের খাওয়া খেয়ে নিলাম৷ খেতে বসে ওই ভদ্রলোকের গল্প করলাম৷ অবাক হয়ে শুনল মেঘনাদদা৷ সব গুছিয়ে মেঘনাদদার শুতে দেরি হয়৷ আমি শুতে চলে গেলাম৷

আমার ঘরের দরজা ভেজানো থাকে৷ সকাল বেলা মেঘনাদদা ঘুম থেকে ওঠার ডাক দেবে বিছানার পাশে এসে৷ আর তখনই আমি উঠব৷ কিন্তু কিছুদিন হল, একা-একাই আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে৷ কখনো কোকিলের ডাকে, কখনো মোরগের ডাকে৷ আমার বাড়ির চারপাশের গাছে যে এখন কত রকমের পাখি ডাকে৷ এসব ডাক বেশ ভালো লাগে এক-একদিন৷

গত কালকের সেই কোকিলটা ডেকে উঠল৷ সকাল এসে পড়েছে আমার ঘরের জানলায়৷ কুয়াশা কেটে রোদ ওঠার মতো চোখের পাতা থেকে ঘুমটা সরে যেতেই আমার মনে হল, মাথাটা যেন অনেক নীচে পড়ে আছে৷ হাত দিয়ে দেখলাম, একটা বালিশ মাথায় দিয়ে শুয়ে আছি আমি৷ আর-একটা বালিশ কোথায় গেল? ঘুমোবার সময় দুটো বালিশই তো উপর উপর রেখে শুয়েছিলাম৷ আমি পাশে হাতড়ে দেখতে গেলাম, বালিশটা কোথায়? অমনি আমার হাত লাগল একটা বরফ-ঠান্ডা কিছুর উপর৷ চোখ বড়ো করে তাকিয়ে দেখলাম, আমার পাশে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে সেই লোকটা! আমি আঁ আঁ করে চিৎকার করেই…৷ আর কিছু মনে নেই৷ তার পরের কথা মেঘনাদদার মুখ থেকে শুনলাম জ্ঞান ফেরার পর৷

আমার চিৎকার শুনে মেঘনাদদা ছুটে এসেছিল আমার ঘরে৷ ফ্যানটা ফুল স্পিডে চালিয়ে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়েছিল৷ আমি নাকি মিনিট পাঁচেক মড়ার মতো পড়েছিলাম৷

এইমাত্র চোখ মেলে তাকালাম৷ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘনাদদা ঠাকুর প্রণাম করল কপালে দু-হাত ঠেকিয়ে৷ তারপর বলল, ‘দাদাবাবু, তুমি চুপ করে বসে থাকো বিছানায়৷ আমি একটু দুধ গরম করে আনি৷ তুমি যেন এখনই উঠতে যেয়ো না!’

আমি বাধ্য শিশুর মতো ঘাড় নেড়ে মেঘনাদদার কথায় সায় দিলাম৷ কপালে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো ঘাম জমে আছে৷ নাকি ঘাম নয়, মেঘনাদদার দেওয়া জলের ঝাপটার গুঁড়ো?

মেঘনাদদা ব্যস্ত হয়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে৷ ফ্যানের বাতাস যতটা ঠান্ডা লাগার কথা, তার চেয়েও অনেক বেশি ঠান্ডা লাগছে৷ তাহলে কি ভোররাতে বৃষ্টি হয়েছিল?

অভ্যেস মতো বালিশের পাশে মোবাইল ফোনটা রেখে ঘুমোই৷ হাতড়ে মোবাইলটা খোঁজার চেষ্টা করলাম৷ কোত্থাও পাচ্ছি না৷ ফের ঘামতে শুরু করলাম৷ একবার মনে হল, পাশের বালিশটার নীচে ফোনটা নেই তো? যেই বালিশটা তুলে সরিয়ে দিলাম, বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, বালিশের নীচে গত কালকের লোকটার সেই পাতালরেলের টিকিটটা৷ টিকিটে সেই রক্তের দাগের মতো লাল দাগ!

তারপর? আর আমার কিচ্ছু মনে নেই!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন