ভূতবাংলোর চাবি

রতনতনু ঘাটী

পরীক্ষা শেষ হলেই অনীক ছাড়া ওরা সকলেই বেরিয়ে পড়বে যে যার মতো৷ অর্ক যাবে তার রাঙাপিসির বাড়ি মধুপুরে৷ মা অর্ককে বলে দিয়েছেন, ‘ওখানে গিয়ে শরীর সারিয়ে আসবি কিন্তু! মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলি তো সবে৷ এই তো শুরু হল৷ এর পর বড়ো বড়ো পরীক্ষা দিতে হবে৷ শরীর ঠিক না থাকলে কী করে করবি সব?’

অর্ক চিরকালই একটু পেটরোগা৷ তাই অমন টিংটিঙে চেহারা৷ কিছুতেই কিছু হজম হতে চায় না ওর৷ মধুপুরের জল খেলে নাকি লোহাও হজম হয়ে যায়৷

অয়নেন্দু বলেছে, পরীক্ষা দিয়ে সে টানা ঘুমোবে, অনেকটা কুম্ভকর্ণের মতো৷ তবে কুম্ভকর্ণ টানা ছ-মাস ঘুমোতেন৷ অয়ন কিন্তু তা করবে না৷ মাত্র সাত দিন সে ঘুমের জন্যে বরাদ্দ করে রেখেছে৷ তারপরই বেরিয়ে পড়বে মালদার গৌড়ে৷ ওখানে থাকেন ওর বাবার কলেজের বন্ধু অভিরূপকাকু৷ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার৷ সময় পেলে ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন৷ যখন অয়ন ওঁর ইতিহাসচর্চা নিয়ে কিছু জানতে চায়, তখনই অভিরূপকাকু মুখে এক ধরনের রাজকীয় গাম্ভীর্য এনে বলেন, ‘ওসব হল গবেষণার বিষয়৷ তুই সবে তো মাধ্যমিক দিবি? বড়ো হলে গবেষণা-টনা নিয়ে আমার কাছে খোঁজখবর নিস৷ এখন তোর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা মানেই সময় নষ্ট৷ আর তুই তো অঙ্কে ভীষণ কাঁচা৷ তোর দ্বারা কোনোদিন গবেষণা হবে বলে তো মনে হয় না৷’

তো এবার নাকি অয়নেন্দু গৌড়ের রাজাদের বংশলতিকা তৈরি করতে যাচ্ছে৷ এটা নাকি এ পর্যন্ত কোনো ইতিহাসবিদ তৈরি করতে পারেননি৷

দীপক যাবে বন্দিপুর৷ ওখানে ওর ইতুপিসিদের পিসেমশাই বনকর্তা, মানে ফরেস্ট অফিসার৷ দীপক ওখানকার ওয়াচ টাওয়ারে উঠে বসে থাকবে৷ ইতুপিসি টিফিন ক্যারিয়ারে করে লুচি আর মাংস ভরে দেবেন৷ দীপক ওই টঙে বসে টুকটুক করে ওসব খাবে আর বাঘের ঘোরাফেরা, খুনসুটি ক্যামেরাবন্দি করবে৷ তারপর ফিরে এসে ওইসব ফোটো একটা সিডিতে ভরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে টেলিকাস্টের জন্যে পাঠাবে৷ বেশ কিছুদিন ধরে তাই সে আহ্লাদে ছত্রিশখানা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷

অনীক কিন্তু কোথাও যাবে না পরীক্ষার পর৷ পরীক্ষা দিয়েই বসে যাবে ইলেভেনের অঙ্ক বই নিয়ে৷ অনীক ঠিক করেই রেখেছে, এর পর অঙ্ক নিয়ে পড়বে৷ তারপর ইঞ্জিনিয়ার হবে৷ অনীক বলে রেখেছে, ‘আমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যখন বড়ো বড়ো ব্রিজ আর হাউসিং কমপ্লেক্স বানাব, তোরা তখন চেয়ে চেয়ে দেখবি৷ আমার ইচ্ছে আছে একটা চলমান ব্রিজ বানাব গঙ্গাসাগর থেকে দিঘা৷ বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে ব্রিজটা ভেসে ভেসে চলে যাবে৷ মাত্র সাঁইত্রিশ মিনিট লাগবে গঙ্গাসাগর থেকে দিঘা যেতে৷’

ওর কথা শুনে অয়নেন্দু বলেছিল, ‘জলের উপর কীভাবে ভাসবে ব্রিজটা? এ কি রূপকথার গল্প নাকি? আর এটাকে তুই ব্রিজই বা বলছিস কেন? একে তো জলট্রাম বলাই ভালো৷’

অনীক বলেছিল, ‘সে যখন বানাব, তখন দেখে নিস৷ চারদিকে হইচই পড়ে যাবে৷ এমনকী, বিদেশ থেকেও আমাকে ভাড়া করে নিয়ে যেতে লোক চলে আসবে, দেখে নিস৷’

আর আমি? আমি যাব ছোড়দির বাড়ি বাঁকুড়ার সোনামুখীতে৷ জামাইবাবুর মোটর সাইকেলে চড়ে ছুটির দিন চলে যাব জঙ্গল দেখতে৷ না হলে একা গিয়ে বসে থাকব সোনামুখী রেলস্টেশনে৷ ছোট্ট স্টেশন৷ শালগাছে ঘেরা৷ ওখানে ট্রেন চলে নিজের মনে৷ কারও কোনো তাড়া নেই৷ আমার দেখতে বেশ লাগে৷

মাধ্যমিকের সব পরীক্ষার পর যেদিন অ্যাডিশনাল বিষয়ের পরীক্ষা শেষ হল, সেদিন আর বাড়ির কেউ আসেননি আমাদের সঙ্গে৷ পরীক্ষা দিয়ে বেরোতেই সব ভন্ডুল করে দিয়ে অর্ক বলল, ‘শোন, আমার মাথায় একটা দারুণ আইডিয়া এসেছে৷’

আমরা সকলে ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বললাম, ‘কী নিয়ে তোর এই দারুণ আইডিয়া, বল না৷’ অর্ক বলল, ‘আমি একটা ম্যাগাজিনে পড়েছি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় নাকি ইচ্ছেভুল ট্রেনে চেপে চলে যেতেন যে-কোথাও৷ হঠাৎ কোনো একটা অজানা অচেনা স্টেশনে নেমে পড়তেন৷ যেকোনো একটা বাংলোয় বুকিং ছাড়া থেকে যেতেন৷ সারারাত চাঁদ দেখতেন৷ রাতপাখির ডাক শুনতেন৷ আমরা যদি এমন করি, তাহলে কেমন হয়?’

দীপক চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘মানে?’

অর্ক বলল, ‘মানে, আমরা বাড়ি থেকে সোজা চলে যাব হাওড়া স্টেশনে৷ কোনো একটা দিকের শেষ স্টেশনের টিকিট কেটে উঠে বসব৷ তারপর আমাদের যে স্টেশনে নামার ইচ্ছে হবে, টুপ করে নেমে পড়ব৷’ অয়নেন্দু বলল, ‘দারুণ হবে কিন্তু৷ কিছু জানি না, চিনি না৷ বাঃ! কিন্তু সেখানে রাতে থাকব কোথায়?’ আমারও অর্কর এই আইডিয়াটা মনে ধরল খুব৷ বললাম, ‘একটা কোথাও ব্যবস্থা হয়েই যাবে৷ মানুষ তো আর সারারাত পড়ে থাকতে পারে না! কিন্তু আমরা সকলে বাড়ির পারমিশন পাব কী করে, তা ভেবে দেখেছিস?’

দীপক বলল, ‘পারমিশন পেতে হলে সবাইকেই কিন্তু সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বায়না করতে হবে৷ তবে যদি…’

অর্ক বলল, ‘রাতে কোথায় থাকব? বুক না করে বাড়ির লোক পারমিশন দেবেন নাকি, তুই কি পাগল? না, তার চেয়ে আমি ঘরে বসে বিজ্ঞানীদের জীবনী পড়ব, আবিষ্কারের মজার মজার গল্প পড়ব৷ সে ঢের ভালো৷’ দীপক দু-হাত উপরে তুলে বলল, ‘দিলি তো ব্যাপারটায় জল ঢেলে? এরকম করলে তোরা কোনোদিন অ্যাডভেঞ্চারে যেতেই পারবি না৷ তোদের দৌড় আমার দেখা আছে৷’ সেদিন কোনো সমাধানে পৌঁছোনো গেল না৷ যে-যার বাড়ি ফিরে গেলাম৷ মনে ভরসা থাকল, কাল তো ফের সকলের সঙ্গে দেখা হবে৷ কালই তো অর্কর জন্মদিন৷ তখন ওর বাড়িতে গিয়ে এই নিয়ে আলোচনা করা যাবে৷

অর্কর জন্মদিনের হুলোড়ের মধ্যেই দীপক আমাদের বলল, ‘হ্যাঁরে, আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের কী হল? বাতিল?’

আমি বললাম, ‘না৷ কাল বাবাকে বলেছি৷ বাবা বলেছেন, টাকি বেড়াতে যেতে৷ মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না৷ শেষে নিমরাজি হয়েছেন৷ বাবা বলেছেন, আগে কাল দেবেশকে ফোন করি, তারপর৷’

সব্বাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘দেবেশ কে?’

আমি বললাম, ‘দেবেশকাকু আমার বাবার বন্ধু, টুরিজম ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন৷ টাকির টুরিস্ট বাংলোয় ঘর খালি থাকলে বুক করে দেবেন৷ সেই মতো আমরা টাকি যাব৷ ধর, আজ সকালে যাওয়া৷ আজ আর কাল থাকা, পরশু ফেরা৷ তার বেশি নয়৷’

অয়নেন্দু বলল, ‘আমার বাড়িতে রাজিই করানো যাবে না৷ এই আমি আগে থেকেই বলে রাখলাম৷’

অর্ক বলল, ‘যার যার বাড়িতে রাজি করানোর দায়িত্ব তার তার৷ তা না হলে বাড়িতেই বসে থাকো৷’ অনেক টানাপোড়েন পেরিয়ে আমরা দলবেঁধে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুমতি আদায় করলাম৷ ঠিক হল, আগামী শনিবার আমরা শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে যাব টাকি৷ রবিবার সারাদিন থাকব৷ সোমবার ফিরে আসব৷ দেবেশকাকু টুরিস্ট বাংলোয় একটা ফোর রুম বুক করে দিয়েছেন৷

অর্ক বলল, ‘শুক্রবার বিকেলে আমরা একবার সকলে কোথাও দেখা করব, কী বল?’

আমরা সকলে সায় দিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, তা তো বটেই৷ তার আগে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে ফেলতে হবে৷’

ওইদিন অনীকদের বাড়ির পাশের খেলার মাঠে আমরা সব্বাই হাজির হলাম৷ অনীক যাবে না৷ তাই আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চারে তার একটুও ইন্টারেস্টই নেই৷ সে এল না৷

এবার সকলকে অবাক করে দিয়ে অয়নেন্দু বলল, ‘কাল কিন্তু আমরা ঠিক সাতটায় হাওড়া স্টেশনে বড়ো ঘড়ির তলায় হাজির হয়ে যাব৷’

আমি বললাম, ‘অ্যাই, তুই কী বলছিস? হাওড়া কেন? আমাদের তো শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরার কথা৷’

অয়নেন্দু বলল, ‘তাহলে আর অ্যাডভেঞ্চার হল কোথায়? শোন, আমরা কাল সকালে হাওড়ায় যে-কোনো দিকের একটা ট্রেনের টিকিট কেটে তারপর ধাঁ৷’

আমাদের কারও চোখে আর পলক পড়ছে না৷ অয়নেন্দু বলল, ‘কারও বাড়িতে কেউ কিচ্ছু বলবি না কিন্তু৷’ আমার মনে যে একটুও দ্বিধা ছিল না, তা বলতে পারি না৷ কিন্তু ভিতরে ভিতরে অ্যাডভেঞ্চার যেন পেয়ে বসতে লাগল৷ শেষমেষ আমিও ঘাড় নেড়ে দিলাম৷

পরের দিন সাতটায় খানিকটা আগেই আমরা এসে গেলাম হাওড়া স্টেশনে৷ শুধু অভ্যেস মতো দেরি করে এল অয়নেন্দু৷ এসেই বলল, ‘চল, চল৷ আমাদের টিকিট কাটা হয়ে গেছে৷ আর দেরি নয়৷’

আমরা দেখলাম, ওর হাতে টিকিট৷ অয়নেন্দু টিকিটটা নাচিয়ে নাচিয়ে বলল, ‘এটাই তো আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের প্রাণভোমরা৷’

তারপর আমরা চারজন গিয়ে উঠলাম একটা খড়্গপুর লোকালে৷ আমরা জানি না কোথায় যাচ্ছি৷ আমার মতো দীপকেরও চোখেমুখে যেন ভয় জড়িয়ে আছে৷ কোথায় যাচ্ছি জানি না৷ তার উপর এই প্রথম বাবা-মাকে ছেড়ে বাইরে যাচ্ছি, ভয় আমাকেও তাড়া করছে৷ যদিও আমরা মুখে কেউ কিছু বলছি না৷

এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল৷ ট্রেনটা ছুটছে গাছগাছালি আর মাঠ পেরিয়ে৷

হঠাৎ দেখলাম, ঝমঝম করে ট্রেনটা একটা বেশ বড়ো ব্রিজ পেরোচ্ছে৷ বেশ বড়ো একটা নদী৷ আমি পাশের একজন কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাকু, এটা কী নদী?’

উনি বললেন, ‘এটা রূপনারায়ণ৷’

আমি মনে মনে বললাম, বাঃ৷ নামটা তো বেশ! এমন সময় ধড়ফড় করে অয়নেন্দু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চল, নামতে হবে৷’

আমরাও তড়িঘড়ি ব্যাগ নিয়ে একেবারে ট্রেনের গেটে৷ ট্রেন থামতেই নেমে পড়লাম একটা বেশ উঁচু স্টেশনে৷ দেখলাম, স্টেশনটার নাম লেখা রয়েছে, কোলাঘাট৷

দেখলাম, কী সুন্দর রূপনারায়ণ৷ চরও জেগে আছে মাঝখানে৷ ছোটো ছোটো ডিঙিনৌকোয় মাছ ধরছে জেলেরা৷ জায়গাটা বেশ চোখ জুড়োনোই বলতে হবে৷

অয়নেন্দু এগিয়ে গিয়ে কাকে যেন কী জিজ্ঞেস করে ফিরে এসে বলল, ‘নদীর দু-পারেই টুরিস্ট বাংলো আছে৷ এপারেরটা নতুন৷ ওপারেরটা পুরোনো৷ চল, নতুনটাতেই আগে থাকার ব্যবস্থা করি৷’

ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে একটা সাইকেল ভ্যানে উঠলাম চারজন৷ নদীর পার দিয়ে রাস্তা৷ যে অর্ক বেড়াতে আসার আগে অত কথা বলছিল, সে এখন একদম চুপ৷

আমি বললাম, ‘কী রে অর্ক, মুখে যে তোর একটাও কথা নেই?’

অর্ক গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি এখন প্রকৃতি দেখছি৷’

আমরা সকলেই চুপ করে রূপনারায়ণ দেখতে দেখতে চলে এলাম নতুন টুরিস্ট বাংলোর সামনে৷ দেখলাম, গেটে তালা দেওয়া৷

পাশ দিয়ে একজন লোক যাচ্ছিল৷ আমাদের দেখে বলল, ‘এটা তো এখনও চালু হয়নি গো৷’ বলে লোকটা রূপনারায়ণের পার ধরে চলে গেল৷

গেটের তালার মরচে পড়া অবস্থা দেখে আমাদেরও মনে হল, গেটটা অনেক দিন খোলাই হয়নি৷ মজা করে অয়নেন্দু গেটের তালা নাড়াতে লাগল৷ বেশ কয়েকবার নাড়িয়েও যখন কারও সাড়া পাওয়া গেল না, তখন আমরা রূপনারায়ণের ওপারের পুরোনো বাংলোটায় যাব বলে ভাবছি, এমন সময় বাংলোটার পিছন দিক থেকে একটা ধুতি পরা বুড়ো মতন লোক এগিয়ে এসে আমাদের জিজ্ঞেস করল, ‘বুকিং আছে বাবু?’

অয়নেন্দু এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘না, মানে বুক করব ভেবেও হঠাৎ বুক না করেই চলে এলাম আমরা৷ জানি, এখন বিশেষ কেউ কোলাঘাটে আসবে না৷ তাই আর কি! আমাদের মাত্র একটা ঘর হলেই চলে যাবে৷’

লোকটা বলল, ‘একটা ঘর কেন, সব ঘরেই থাকুন না বাবু, আমার আপত্তি কীসের? তবে বুকিং না থাকলে তো এখানে থাকতে দেওয়ার নিয়ম নেই৷ আমি থাকতে দিতে পারব না বাবু৷ আপনারা অন্য হোটেল-টোটেল দেখুন৷’ বলে লোকটা যেমন বাংলোর পিছন দিক থেকে এসেছিল, তেমন করেই বাংলোর পিছনেই চলে গেল৷ অয়নেন্দু দু-তিনবার, ‘এই যে দাদু, এই যে দাদু,’ বলে ডাকল বটে, লোকটা ওর ডাকে একবারও সাড়া দিল না৷

আমি বললাম, ‘এবার বোঝ, অ্যাডভেঞ্চার কেমন হবে৷’

অনেকটা হতাশই দেখাচ্ছিল অয়নেন্দুকে৷ সেই হতাশার ছায়া এসে পড়ল আমাদেরও চোখেমুখে৷ আমি বললাম, ‘চল, এখনই ফিরতি ট্রেনে ফিরে শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে টাকি চলে যাই৷’

অয়নেন্দু বলল, ‘এসেছি ফিরে যাওয়ার জন্যে নয়৷ একটা ব্যবস্থা করতেই হবে৷’ বলে ফের ডাকতে শুরু করল, ‘ও কেয়ারটেকার দাদু, কেয়ারটেকার দাদু, একটু এদিকে এসো না! একটা জরুরি কথা ছিল৷’ কিন্তু ওদিক থেকে কোনো উত্তর এল না৷ হঠাৎ অয়নেন্দু লাফ কেটে গেটটা টপকে চলে গেল বাংলোর পিছন দিকে৷ আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম, কখন অয়নেন্দু ফিরে আসে৷

মিনিট দশেক পরে ও ফিরে এল হাসতে হাসতে৷ এসেই সুখবরটা দিতে যাচ্ছিল এমন সময় লোকটা একটা চাবির গোছা নিয়ে এগিয়ে এল গেটের দিকে৷ আমরা বুঝে গেলাম, অয়নেন্দু ম্যানেজ করেছে লোকটাকে৷ লোকটা গেটটা খুলতে খুলতে বলল, ‘আমি থাকতে দিচ্ছি বটে, কলকাতা থেকে বুকিং নিয়ে লোক এসে গেলে তখন কিন্তু ঘর ছেড়ে দিতে হবে৷’

অয়নেন্দু দু-দিকে ঘাড় দুলিয়ে বলল, ‘সে তো বটেই, সে তো বটেই৷ তখন আমরা কলকাতা ফিরে যাব, তোমাকে কথা দিয়ে রাখলাম দাদু৷’

আমরা বাংলোর লনে ঢুকে পড়তেই লোকটা ফের গেটে তালা লাগিয়ে দিল৷

আমরা চোখ চাওয়াচাওয়ি করে বললাম, ‘দাদু, আমরা ঘুরতে যাব তো! এখানে এসেছি মানে তো আর সারাদিন বাংলোর মধ্যে বসে থাকব না? গেটে তালা দিয়ে দিচ্ছ কেন?’

লোকটা বলল, ‘সে যখন যাবেন, তখন খুলে দেব বাবু৷’

আমরা এত ছোটো, তবু লোকটা আমাদের ‘আপনি’ করে কথা বলছে৷ দীপক বলল, ‘লোকটা কিন্তু মন্দ নয় রে৷ যতই হোক, বিনা বুকিংয়ে আমাদের থাকতে তো দিল৷’

বাংলোটা নতুন, সবে তৈরি হয়েছে৷ আমাদের জন্যে একটা ফোর বেডেড রুম খুলে দিল লোকটা৷ আসার সময় যে লোকটা বলেছিল, বাংলোটা এখনও চালু হয়নি, বিছানাপত্র দেখে অন্তত সেরকমই মনে হচ্ছে৷ অয়নেন্দু ঢুকেই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল৷ ওর দেখাদেখি অর্কও৷ আমি শুতে যাচ্ছি, এমন সময় অয়নেন্দু বলল, ‘তুই আর দীপক এবার দাদুকে দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা কর৷ আমি কিন্তু ওর মধ্যে নেই৷’

আমি আর দীপক রান্নাঘরে গিয়ে দেখি, কেয়ারটেকার দাদু নিজের রান্নার ব্যবস্থা করছে৷ লোকটা কিন্তু বেশ৷ বুকিং ছাড়াই আমাদের থাকতে দিয়েছে৷ এখন না বলতেই যদি খাওয়ার আয়োজন করে, তাহলে তো কোনো জবাব নেই৷

দীপক ফিসফিস করে আমাকে বলল, ‘দেখিস, বখশিশটা ভালোই দিতে হবে৷ পাস ঘর ভাড়ার টাকাটা তো নিজের পকেটেই ঢুকবে৷ এমনি কি আর অত করবে নাকি?’

আমি বললাম, ‘আজ দুপুরে কী মেনু গো দাদু?’

লোকটা আনাজ কাটতে কাটতে মাথা না তুলেই বলল, ‘এই আমার যা হোক একটা কিছু হলেই চলে যায়৷’

আমি অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বললাম, ‘আমরা কোথায় খাব দাদু? আমাদেরও খাওয়ার ব্যবস্থা করো৷’

লোকটা আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে শুধু ঘাড় নেড়ে না বলল৷ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমারটা আমি করে নিয়েছি৷ টুরিস্টদের জন্যে বাকিটা সরকার বাহাদুর করবে৷ কবে তেনাদের যদি মরজি হয়!’

আমি আর দীপক ফিরে এসে অয়নেন্দুদের বললাম, ‘খাওয়ার ব্যবস্থা হবে না৷ চল, শুয়ে থাকলে হবে? বেরোবি না? বাইরে খেতে হবে৷ এখানে নাকি খাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই হয়নি এখনও৷’

অর্ক বলল, ‘এখন চান করে চল বেরোই৷ কোনো একটা হোটেলে পেট ভরে খেয়ে এসে টানা ঘুম৷ বিকেলে বেড়ানো৷ কী বলিস অয়ন?’

এই অ্যাডভেঞ্চারের আইডিয়াটা দেওয়ার পর থেকে অয়নেন্দু আমাদের লিডার হয়ে গেছে৷ আমাদের মনে হচ্ছে, ওকে না বলে কিছু করাটা ঠিক হবে না৷

দুপুর নাগাদ প্রত্যেকের বাড়ি থেকে তিন নম্বর ফোন এল৷ এর আগে শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছোনোর খবর আর ট্রেন ধরার খবর নেওয়া হয়ে গেছে৷ আমরা ঠিকমতো টাকি পৌঁছেছি কি না, ঘর পাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, সব কোয়্যারি শেষ৷

এবার চান করে হেঁটে হেঁটে একটা হোটেলে গিয়ে খেয়ে ফিরে এসে শুরু হল আমাদের জমিয়ে আড্ডা৷ সকলেই ভীষণ খুশি অয়নেন্দুর উপর৷ ও না বললে এমন একটা অচেনা আনন্দ আমরা পেতাম না৷ লোকটাকে আর একবারও দেখতে পেলাম না৷ বিকেল গড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যের দিকে৷ কখন থেকে ইলেকট্রিক চলে গেছে৷ আর আসার নামই নেই৷ আমরা ঠিক করলাম, এই যে বেরোব, একেবারে রাতের খাওয়া খেয়ে ফিরব৷ তখন আলো নিশ্চয়ই এসে যাবে৷ কিন্তু লোকটাকে তো বলে যেতে হবে৷ আমরা চারদিক খুঁজে ফেললাম৷ কোত্থাও পাওয়া গেল না৷

অয়ন বলল, ‘হয়তো কাছে কোথাও গেছে৷ এক্ষুনি চলে আসবে৷’

না সন্ধ্যে হয়ে এল৷ তখনও লোকটার দেখা নেই৷ আমরা বাংলোর সামনে রূপনারায়ণের ধারে গিয়ে বসলাম৷ বাংলো খোলা রেখে তো আর যাওয়া যায় না৷ বাংলোর সামনের রাস্তা দিয়ে খুব একটা লোকজনের যাতায়াতও নেই৷ মাঝে অয়ন একবার এসে লোকটাকে খুঁজে গেল৷ না৷ কোত্থাও পাওয়া গেল না৷

রূপনারায়ণের জলে অন্ধকার তার চাদর বিছিয়ে দিতে ব্যস্ত৷ আমরা চারজন বসে আছি অন্ধকারে৷ একটা জবা ফুলের গাছের নীচে একঝাঁক জোনাকি উড়ছে৷ কেমন ভয় ভয়ও করছে আমাদের৷ অজানা জায়গা৷ এমন সময় আলো জ্বলে উঠল বাংলোয়৷ আমরা হইহই করে বাংলোয় ফিরে এলাম৷ এসে গোটা বাংলোটা খুঁজে দেখলাম৷ কোথাও লোকটাকে দেখতে পেলাম না৷

অয়নেন্দু বলল, ‘শোন, আমাদের মধ্যে দু-জন এখানে থাক৷ আর দু-জন যাক রাতের খাবার কিনতে৷ কে কে থাকবি আর কে কে যাবি, তোরা ঠিক কর৷’

দেখা গেল অয়ন ছাড়া কেউই বাংলোয় থাকতে রাজি নয়৷ হঠাৎ বাংলোর পিছন দিকের রান্নাঘরের দিক থেকে ঠক করে একটা শব্দ হল৷ অয়ন বলল, ‘চল তো দেখি৷ কেউ কি এল?’

চারজন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গিয়ে দেখলাম, লোকটা আপন মনে তরকারি কাটছে৷ ওর কাজ-টাজ দেখে মনে হল, লোকটা এক্ষুনি আসেনি৷

অর্ক বলল, ‘তুমি কোথায় যে গেলে বিকেল থেকে, আমরা ডেকে ডেকে তোমাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না৷ তার ফলে আমাদের বেড়ানোটাই হল না৷ কোথায় গিয়েছিলে তুমি?’

‘কোথায় আর যাব? এখানেই তো ছিলাম৷ আমার কোথাও গিয়ে কি থির হয়ে থাকার জো আছে? আর এই বাংলো ফেলে যাবই বা কোথায়?’

আমি বললাম, ‘এখানেই ছিলে, আর আমরা চারজন কেউ তোমাকে দেখতে পেলাম না? কী তাজ্জব কাণ্ড! তুমি ম্যাজিক জানো বলে মনে হয়৷ আমাদের ম্যাজিক দেখাবে?’

‘তা আপনারা যাই বলুন, আমি ওসবে ভুলবার বান্দা নই৷ আমার হাতে এখন অনেক কাজ৷ আপনাদের জল-টল সব দিয়ে দিয়েছি৷ খেয়েদেয়ে আসুন৷ দেরি করবেন না কিন্তু!’ বলে লোকটা কুটুস কুটুস করে ফের আনাজ কাটতে লাগল৷

অয়ন চোখের ইঙ্গিত করল, চল, খেতে যাই৷ আমরা আর কথা না বাড়িয়ে খেতে বেরোলাম৷ বললাম, ‘আমরা খেয়ে আসছি৷ তুমি ফের হাওয়া হয়ে যেয়ো না যেন!’

লোকটা কেমন একটা ফ্যাকাসে চোখে তাকাল আমাদের দিকে৷ সেসব উপেক্ষা করে আমরা খেতে বেরোলাম৷ ফিরে এসে দেখি, দূরে দূরে ইলেকট্রিক আছে, শুধু বাংলোটাই অন্ধকার৷ অন্ধকারে গেটের কাছে এসে দেখলাম, গেটে বাইরে থেকে তালা দেওয়া৷

এবার আমাদের মুখে আর সত্যিই কথা ফুটল না৷ এবার কী হবে? লোকটা কোথাও কেটে পড়ল না তো? অয়নেন্দু গলায় যত জোর আছে, চেঁচিয়ে ডাকল, ‘দাদু, ও কেয়ারটেকার দাদু…’

কেউ ওর ডাকে সাড়া দিল না৷ শুধু রূপনারায়ণের হিমেল বাতাস যেন আমাদের একটু কাঁপিয়ে দিয়ে গেল৷ আমি বললাম, ‘এবার কী করবি অয়ন? আমরা থাকব কোথায়?’

এবার আর অয়নেন্দুর মুখেও কথা সরল না৷ চারজন গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি৷ এমন সময় দেখলাম, লোকটা একটা হ্যারিকেন জ্বেলে নিয়ে বাংলোর রান্নাঘরের দিক থেকে গেটের দিকে এগিয়ে আসছে৷

আমি রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ‘তুমি গেটের বাইরের দিক থেকে তালা দিয়েছ কেন? আমরা কি আজ রাতটা বাইরেই থাকব নাকি?’

লোকটা খিকখিক করে হাসল খানিক৷ তারপর বলল, ‘কই, গেটে তালা তো দিইনি৷’

আমরা দেখলাম, সত্যি, গেটে তালা নেই তো৷ তাহলে কি আমরা ভুল দেখেছি?

এমন সময় একটা ঝোড়ো বাতাসে দপ করে হ্যারিকেনটা নিভে গেল, না লোকটা আমাদের ভয় দেখানোর জন্যে আলোটা নিভিয়ে দিল, বোঝা গেল না৷ আমরা তাকিয়ে দেখলাম, উধাও হয়ে গেছে৷ দীপক ভয়ে অয়নকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এখানে আর থাকা নয়৷ চল, কলকাতা ফিরে যাই৷’ হঠাৎ দেখি, লোকটা গেটের বাইরের দিক থেকে হ্যারিকেন নিয়ে বাংলোয় ঢুকছে৷ আমি মনে মনে বললাম, লোকটা সত্যি, নাকি মিথ্যে?

লোকটা বিশ্রীভাবে হাসল আমাদের দিকে তাকিয়ে৷ তারপর বলল, ‘আপনারা বড্ড ভিতু মানুষ! আমি ওই ওদিক থেকে হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে আনলাম তো৷ আজ আর আলো আসবে বলে মনে হয় না৷ চলুন, আপনারা শুয়ে পড়বেন৷ হ্যারিকেনে বেশি তেলও নেই দেখছি৷ বেশিক্ষণ জ্বলবে না৷ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন আপনারা৷’

অয়নেন্দু এবার সত্যিই রেগে গেল৷ বলল, ‘বাংলোয় তোমার কাজটা কী, তাই তো বোঝা গেল না৷ সময় মতো একটু তেলও আনিয়ে রাখার কাজটা করতে পার না?’

লোকটা ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলল, ‘করব বললে কি সব কাজ করা যায়?’

বলে লোকটা এগিয়ে গেল বাংলোর দিকে৷ আমরা ওর পিছন পিছন এগোলাম৷ ঘরে হ্যারিকেনটা রেখে লোকটা বলল, ‘নিন, শুয়ে পড়ুন৷’

দীপক জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোথায় থাকো? এই বাংলোতেই শোও তো? দরকার হলে তোমাকে ডাকব৷’

লোকটা বলল, ‘আমার থাকা না-থাকা নিয়ে ভাববেন না৷ এই দেখলেন আছি, আবার এই দেখলেন নেই৷ তখন তো মিছিমিছি ভয় পাবেন৷ কী দরকার আমাকে নিয়ে অত ভাববার?’

আমি বললাম, ‘তুমি আলোটা নিয়ে যাও৷ তোমার তো এখনও রান্না-খাওয়া হয়নি৷ তোমার কাজ হয়ে গেলে তখন আলোটা আমাদের ঘরে দিয়ে যেও৷’

‘আমি অন্ধকারে সব কাজ করতে পারি৷ আমার অন্ধকার ভালো লাগে৷ আমি ঠিক অন্ধকারে রান্না করে খেয়ে নেব৷ আপনারা ভাববেন না৷’ বলেই লোকটা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে৷

আমরাও আলোর বাতি একেবারে নিভু নিভু করে দিয়ে চোখ জ্বেলে বসে থাকলাম৷ দেখলাম, অন্ধকারের মধ্যেই লোকটার রান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে৷

একটু আগে আমাদের সকলেরই বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল৷ আমি এসব কথা বলতে যাচ্ছিলাম৷ অয়ন আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে দিল৷ সকলেই ফোনে বাড়ির লোককে জানিয়ে দিয়েছি, আমাদের কোনো অসুবিধেই হচ্ছে না৷

অ্যাডভেঞ্চারের এখানেই শেষ৷ আমরা ঠিক করলাম, ঢের হয়েছে৷ কাল সকালে উঠেই সোজা বাড়ি৷ অয়ন রান্নাঘরের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, ‘দাদু, আমাদের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে, কাল সকালেই কলকাতা ফিরে যেতে বলেছেন৷ তোমার কাজ হয়ে গেলে আমাদের বাংলোর ভাড়া-টাড়া নিয়ে নিয়ো৷ আমরা কাল সকালেই চলে যাব৷’

লোকটার গলার আওয়াজ শোনা গেল না৷ দূর থেকে একটা খিকখিকে হাসির শব্দ ভেসে এল৷ আর একটা দমকা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল আমাদের ঘরটায়৷

একটু পরে বাংলোর সামনে থেকে লোকটার গলা শোনা গেল, ‘আমাকে নিয়ে ভাববেন না আপনারা৷ আমি যখন যেখানে খুশি থাকি৷’ বলে দূরের একটা ঝাঁকড়া বটগাছের দিকে আঙুল দেখাল লোকটা৷ তারপর বলল, ‘মাত্র একটা দিন তো থাকলেন৷ আপনারা ছেলেমানুষ৷ না-ই বা দিলেন ভাড়া-টাড়া৷ আর-একটা দিন থেকে গেলে পারতেন৷ কিছুই তো দেখা হল না আপনাদের৷’

দীপক বলল, ‘না, না৷ আমরা চলে যাব৷ জায়গাটা মোটেও ভালো না৷ আর ছেলেমানুষ বলে আমরা বিনে পয়সায় থাকব কেন? তোমার যা টাকা হয়, তুমি নিয়ো৷ তবে আমাদের রসিদ দিতে হবে৷’

আবার সেই খিনখিনে হাসি ভেসে এল৷ আমরা লোকটাকে আর দেখতে পেলাম না৷

সে রাতে আমাদের চোখে একটুও ঘুম এল না৷ অর্কর বার দুয়েক অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা হল৷ ওর চোখেমুখে জল দেওয়া হল৷ সত্যিই সারারাত আর ইলেকট্রিক এল না৷ গরমে ঘামতে ঘামতে এক সময় দেখলাম, ভোর হয়ে আসছে৷

আমরা ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নিলাম৷ অয়নেন্দু গেল লোকটাকে ডাকতে৷ ফিরে এসে বলল, ‘রান্নাঘরেও তো তালা ঝুলছে রে৷ আমাদের ঘরটা ছাড়া আর সব ঘরেই তো দেখলাম তালা দেওয়া৷ লোকটা আবার কোথায় গেল?’

অর্ক গেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই দেখ, গেটেও তো ভিতর দিক থেকে তালা দেওয়া৷ বাইরে যায়নি নিশ্চয়ই৷’

দীপক বলল, ‘কাল থেকে লোকটা যা সব ভেলকি দেখাচ্ছে, ওর পক্ষে সবই সম্ভব৷’

এমন সময় আমি দেখলাম, আমাদের ঘরের টেবিলে একটা বড়ো চাবির গোছা পড়ে আছে৷ আমি বললাম, ‘ওই দেখ অয়ন, লোকটা চাবির গোছাটা রেখে গেছে৷ আমরা তো সারারাত জেগে থাকলাম৷ কখন লোকটা আমাদের ঘরে ঢুকল বল তো?’

অয়ন বলল, ‘সে যাই হোক, আমাদের আর এক মুহূর্ত এখানে থাকার দরকার নেই৷ চল, বেরিয়ে পড়ি৷’ আমরা যখন বাংলোর চাতালে এসে দাঁড়ালাম, তখন দেখি টুকটুকে লাল একটা সূর্য সবে মুখ তুলেছে আকাশে৷

নৌকো ভেসে চলেছে রূপনারায়ণের জলে৷ জেগে ওঠা চরের বালিতে একঝাঁক বক মাছ খুঁটে খাওয়ার জন্যে চুপটি করে বসে আছে৷ এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে যেন আমাদের সঙ্গে দেখা করে গেল মনে হল৷ চাবি দিয়ে গেটের তালা খুললাম আমি৷ দেখে মনে হল, এর আগে কোনোদিন তালাটা খোলাই হয়নি৷ গেটের বাইরে এসে তালা লাগিয়ে আমরা ভাবলাম, এই চাবির গোছাটা নিয়ে কী করব?

দীপক বলল, ‘রূপনারায়ণের জলে ছুড়ে দে৷’

অর্ক বলল, ‘গেটের ভিতরে ফেলে দে৷ লোকটা যদি আসে, নিয়ে নেবে৷’

আমার মাথায় কোনো বুদ্ধিই আসছে না৷ অয়নেন্দু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না৷ আমরা কলকাতায় ফিরে গিয়ে তোর দেবেশকাকুকে চাবির গোছাটা ফেরত দেব৷ উনি টুরিজমের অফিসে জমা দিয়ে দেবেন৷’

আমি বললাম, ‘তখন বাড়িতে সকলেই জেনে যাবেন যে, আমরা টাকি না গিয়ে কোলাঘাট এসেছিলাম?’

অয়নেন্দু বলল, ‘তা জানুক৷ অত চাবি ফেলে দেওয়া কি ঠিক হবে? লোকটা যদি ফিরে আসে, তখন ঢুকতে পারবে না৷ হেড অফিস থেকে চাবির গোছা আনিয়ে তবে ঢুকতে হবে৷ তখন বুঝবে, আমাদের সঙ্গে এমন করার কী ফল৷’ তারপর চাবির গোছাটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা থাক তোর কাছে৷’

আমরা যখন কোলাঘাট স্টেশনের কাছাকাছি এসেছি, তখন দেখি কী, দেবেশকাকু হনহন কর এদিকেই আসছেন৷ আমি তো অবাক৷ বললাম, ‘অ্যাই, দেবেশকাকু আসছেন৷ বাড়িতে নিশ্চয়ই সকলে জেনে গেছেন, আমরা কোলাঘাট এসেছি৷ এবার কী হবে?’

আমাদের কাছাকাছি এসে দেবেশকাকু হেসে বললেন, ‘আমি সব খবর পেয়ে গেছি, তোরা টাকি না গিয়ে কোলাঘাট এসেছিস৷ তা এখানে এই নতুন বাংলোয় আসতে গেলি কেন? ওই বুড়োটা তোদের খুব জ্বালিয়েছে তো?’

অয়ন বলল, ‘আপনি লোকটাকে চেনেন?’

দেবেশকাকু বললেন, ‘চিনি না, তবে ওর কথা আমাদের অফিসে সবাই জানে৷ ওরই জমিতে বাংলোটা তৈরি হয়েছে তো৷ তাই মরে গিয়েও ও এখনও ওর জমিটা পাহারা দেয়৷ বড়োরা এলে একঘণ্টার বেশি থাকতেই দেয় না৷ এমন সব উপদ্রব করে যে, না পালিয়ে উপায় থাকে না৷ তোরা ছোটো বলে তাই তোদের একরাত থাকতে দিয়েছে৷’

আমি চাবির গোছাটা বের করে দেবেশকাকুর দিকে বাড়িয়ে দিলাম, ‘আমরা আসার সময় কেয়ারটেকার দাদুকে তো দেখতে পেলাম না৷ তাই চাবির গোছাটা দিয়ে আসা হয়নি৷ আপনি চাবির গোছাটা নিন৷’

দেবেশকাকু একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন৷ আমাদের সকলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘না৷ ওটা তুই বাড়ি নিয়ে যা৷ আমি এদিকে একটা কাজে এসেছি৷ ফিরতে কতদিন দেরি হবে আমি নিজেই জানি না৷ ততদিনে চাবিটা অফিসের দরকার হতে পারে৷ তোর বাবাকে বলিস, তোর বাবা যেন চাবির গোছাটা আমাদের অফিসে জমা করে দেয়৷ তোরা বাড়ি ফিরে যা৷’

আমি চাবির গোছাটা ব্যাগে রাখতে রাখতে দেবেশকাকুর মুখের দিকে তাকালাম৷ দেখলাম, দেবেশকাকু মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে যেমন হনহন করে এসেছিলেন, অমন হনহন করেই বাংলোটার দিকে চলে গেলেন৷ আমরা হাওড়ার টিকিট কেটে স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছি৷ ভাবলাম, কাল তাহলে আমরা ভূতই দেখেছি? আমাদের চারজনেরই কারও মুখে কথা নেই৷ উঁচু স্টেশন থেকে দেখলাম, নীচ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ৷ এখনও শীত আসতে দেরি৷ তবু চরের বালির উপর অসময়ের অনেক কাশ ফুটে আছে৷ অয়নেন্দু বলল, ‘হ্যাঁ রে, কালকের লোকটা তাহলে…’

এমন সময় বাবা ফোন করলেন আমাকে, ‘তোরা আজই টাকি থেকে বাড়ি ফিরে আয়৷ এক্ষুনি৷’ বাবার ফোনটা রিসিভ করতে গিয়ে কখন আমার ফোনটার স্পিকার অন হয়ে গিয়েছে৷ অয়ন, দীপক আর অর্কও আমার কাছে সরে এল বাবা কী বলছেন শোনার জন্যে৷ ওদিক থেকে বাবা বললেন, ‘আজ রাতে দেবেশ অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে৷ তোদের আর ওখানে থাকতে হবে না৷ এক্ষুনি বাড়ি ফিরে আয়৷’

আমি ঘামতে ঘামতে ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে দেখলাম, চাবির গোছাটা আমার ব্যাগেই পড়ে আছে৷

অধ্যায় ৭ / ৭

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন