হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
বামন লোকটার সঙ্গে মল্লাররা উপস্থিত হল টিনের চালওয়ালা বাড়িটার সামনে৷ বাড়ির ছাদটা টিনের হলেও সামনে শনের ছাদ দেওয়া মাটির দাওয়া আছে৷ কয়েকটা মাটির ধাপ বেয়ে দাওয়াতে উঠতে হয়৷ মল্লাররা সেই দাওয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দাওয়া সংলগ্ন ঘরের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন প্রৌঢ় একজন লোক৷ তাঁর গায়ের রং বেশ ফর্সা, লম্বা শক্তপোক্ত চেহারা৷ মুখমণ্ডলে সন্ন্যাসীদের মতো দাড়ি-গোঁফ, মাথার কাঁচা-পাকা চুল কাঁধ ছুঁয়েছে৷ পরনে একটা ধুতি লুঙ্গির মতো করে জড়ানো, গায়ে সাদা পাঞ্জাবির ওপর একটা তুষের চাদর৷ মল্লারদের দিকে তাকিয়ে তিনি হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘আমিই তমসাময় শাস্ত্রী৷ আসুন, আসুন, ওপরে আসুন৷’
তমসাময়কে প্রতিনমস্কার জানিয়ে দাওয়াতে উঠে পড়ল মল্লাররা৷ তাদের নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তমসাময় বললেন, ‘এত দূর আসতে নিশ্চয়ই বেশ কষ্ট হল আপনাদের?’
সোহম জবাব দিল, ‘কষ্ট তেমন একটা হয়নি৷ তবে এ জায়গা কলকাতা শহর থেকে সত্যিই অনেকটা দূর৷ এতটা দূর ভাবিনি৷’
ঘরটা মাঝারি আকৃতির, একপাশে একটা টেবিল ঘিরে বেশ কয়েকটা মামুলি চেয়ার রাখা৷ অন্যপাশে একটা কাঠের তক্তপোশের ওপর বিছানা৷ তক্তপোশের নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবহার্য সামগ্রী৷ দেওয়ালের গায়ে টাঙানো দড়ি থেকে ঝুলছে কাপড়, গামছা এসব৷ অতি সাধারণ একটা ঘর৷
টেবিলের ওপর রাখা আছে কিছু বই, কাগজপত্র, কলম এসব জিনিস৷ টেবিলের এক পাশে জানলার ধারে একটা চেয়ারে বসলেন তমসাময়৷ আর তাঁর মুখোমুখি চেয়ারগুলোতে বসল ওরা তিনজন৷
তমসাময় বললেন, ‘এটা আমার থাকার জায়গা, আবার একই সঙ্গে অফিস ঘরও বটে৷ আমার নিজের থাকার জন্য বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই৷ এই সব সামান্য বিছানাপত্র আমার একলা থাকার জন্য যথেষ্ট৷ তবে আপনাদের মতো লোকজন এলে তাদের বসা-থাকার জন্য হয়তো একটা ভালো অফিসঘর বা আসবাবপত্রর প্রয়োজন৷ কিন্তু অর্থাভাবে তা করে উঠতে পারিনি৷ আমার যা অর্থ ছিল তা এই অতি সাধারণ আশ্রম তৈরি করতেই বেশিরভাগটাই ব্যয় হয়ে গেছে৷ বাকি যা আছে তা দিয়ে অনাথ বাচ্চাগুলোর ভরণপোষণ চালাচ্ছি৷’
মল্লার তাদের প্রত্যেকের নাম তমসাময়কে জানাবার পর প্রশ্ন করল, ‘আপনি একাই এই আশ্রম পরিচালনা করেন, নাকি আরও কেউ আছেন? কতদিন হল এই আশ্রম তৈরি হয়েছে?’
তমসাময় হেসে বললেন, ‘না, আমি একাই৷ আমার সঙ্গী বলতে কেবলমাত্র ওই বুনো৷ মানে যে লোকটা আপনাদের এখানে নিয়ে এল৷ ও স্থানীয় লোক৷ আমি এই আশ্রমটা তৈরি করেছি বছর দেড়েক হল৷’
সোহম বলল, ‘আপনি কি এ অঞ্চলেরই মানুষ?’
এ প্রশ্নর জবাবে মৃদু হেসে তমসাময় বললেন, ‘না, আমি আসলে কলকাতার মানুষ৷ সেখানেই আমার জন্ম-পড়াশোনা৷ এখানকার ভূমিপুত্র বলতে যা বোঝায় তা আমি নই৷’
তাঁর কথা শুনে চূর্ণী মৃদু বিস্মিতভাবে বলল, ‘কলকাতা ছেড়ে এত দূরে আপনি এই আশ্রম খুলতে এসেছেন? কলকাতা বা তার আশপাশে আশ্রম খোলার জন্য মনোমতো জায়গা পাননি?’
প্রশ্নের জবাবে তমসাময় প্রথমে বললেন, ‘আসলে বাপারটা ঠিক তেমন নয়৷ এখানে কেন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলাম সে ব্যাপারটা আপনাদের খুলেই বলি৷’
এ কথা বলে জানলার বাইরে পড়ন্ত বিকেলের দিকে তাকিয়ে তমসাময় বলতে শুরু করলেন—
‘হ্যাঁ, কলকাতা শহরেই আমার জন্ম, স্কুল-কলেজে আমার শিক্ষাদীক্ষা৷ বাবা ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে৷ বলা যেতে পারে সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলাম আমি৷ বাবা-মা আমাকে খুব স্নেহ করতেন আর আমিও তাঁদের খুব ভালোবাসতাম৷ পড়াশোনায় মেধাবী ছিলাম৷ আমাকে নিয়ে তাই বাবা-মা’র চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল৷ তখন আমার কুড়ি বছর বয়স৷ ভালো রেজাল্ট করে সদ্য কলেজ পাশ করেছি৷ ঠিক সেই সময় একটা ঘটনা বা দুর্ঘটনায় আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেল৷ বীরভূম জেলাতে বোলপুরের কাছে আমাদের ঠাকুর্দার আমলের একটা পুরনো বাড়ি ছিল৷ বাড়িটা তালা বন্ধ অবস্থাতে পড়ে থাকলেও বছরে এক-দু’বার আমরা বাড়িটাতে গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসতাম৷ সেবারও আমি বাবা-মা’র সঙ্গে গিয়েছিলাম সে বাড়িতে৷ তার একদিন পরেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটল৷
পুরোনো দিনের বাড়ি৷ শোওয়ার ঘরে ইলেকট্রিকের তার এক জায়গাতে খসে গিয়েছিল৷ আর তাতেই তড়িতাহত হলেন বাবা-মা৷ ভাগ্য ভালো আমি সে সময় ঘরের বাইরে ছিলাম বলে বেঁচে গিয়েছিলাম৷ যাই হোক মর্গ, থানা ইত্যাদি জায়গার কাজ মেটার পর আমার বাবা-মা’র মৃতদেহ কয়েকজন গ্রামবাসীর সহায়তায় নিয়ে যাওয়া হল কাছেই কোপাই নদীর পাড়ে কঙ্কালীতলার শ্মশানে৷ সেখানে তাঁদের দাহ করা হল৷
দাহকার্য সমাপ্ত হলে গ্রামবাসীরা ঘরের পথে পা বাড়ালেও আমি একলা সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম৷ সেই শূন্য নদীতটে তখনও ধোঁয়া ওঠা চিতা দুটোর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছিল ওই পোড়া ছাইয়ের রাশি থেকে যদি কোনওভবে উঠে দাঁড়াতেন তাঁরা? যদি তাঁরা আবার নবজীবন লাভ করতে পারতেন, তবে কত ভালো হতো! শূন্য দৃষ্টিতে চিতা দুটোর দিকে তাকিয়ে আমি ভেবে চলেছি এসব অদ্ভুত কথা, কোপাই নদীর বুকে তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামতে চলেছে৷ ঠিক সেই সময় কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে দেখি রক্তবসন পরা এক সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন৷ আমি তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, ‘কী ভাবছিস, তোর বাবা-মা যদি মরণের ওপার থেকে আবার ফিরে আসতে পারত তবে কেমন হতো?’
আমি যা ভাবছিলাম তা সেই সাধুর মুখ থেকে শোনায় বেশ অবাক হয়ে গেলাম৷ তিনি এরপর চিতা দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একমাত্র অগ্নির কাছেই পৃথিবীর সব শক্তি পরাস্ত৷ দেহ দুটো যদি অগ্নি গ্রাস না করত তবে হয়তো নবজীবন লাভের সুযোগ ছিল তাদের৷’
আমি বললাম, ‘কীভাবে নবজীবন লাভ করতেন তাঁরা?’
সন্ন্যাসী বললেন, ‘জীবন-মৃত্যুর রহস্য যদি জানতে চাস, তবে আমার সঙ্গে আয়৷’
‘সেই সন্ন্যাসীর আহ্বানের মধ্যে কেমন যেন একটা সম্মোহনী ব্যাপার ছিল৷ সে ডাক আমি অগ্রাহ্য করতে পারলাম না, তাকে অনুসরণ করে হাজির হলাম সেই তন্ত্র সিদ্ধাচার্যের ডেরায়৷ তার নাম অবধূত৷ লোকটার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল, তাই হয়তো আমি সেই কোপাই নদীর ধারে পঁচিশটা বছর তার সঙ্গে আটকে গেলাম৷
একটানা কথাগুলো বলে জানলা থেকে মল্লারদের দিকে মুখ ফিরিয়ে একটু থেমে তমসাময় এরপর বললেন, ‘এবার আসি আসল কথায়৷ বছর চারেক আগে দেহ রাখলেন অবধূত৷ তাঁর মৃত্যুর পর সে জায়গায় থাকতে আমার মন চাইল না৷ তিনি যখন চলে গিয়েছেন, তাছাড়া এখন সেখানে সে নির্জনতাও আর নেই৷ সতীপীঠ কলেবরে এখন অনেকে বেড়েছে৷ তার সঙ্গে বেড়েছে লোক সমাগম, কমেছে সেই শ্মশানের নির্জনতা৷ লোকঠকানো, ভণ্ড সন্ন্যাসীর সংখ্যাও বাড়ছে নানা জায়গাতে৷ তাই একদিন সে জায়গা ছেড়ে নির্জনতার সন্ধানে, নিশ্চিন্তে সাধনা করার জন্য আমি বেরিয়ে পড়লাম৷ হ্যাঁ, তন্ত্রসাধক অবধূতের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমিও তন্ত্রসাধনায় যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম৷ বীরভূমের নানা শ্মশান-মশানে বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়ালাম, কিন্তু কোনও জায়গাই আমার থাকার জন্য মনঃপুত হল না৷ শেষে একদিন নদী পেরিয়ে মুর্শিদাবাদ হয়ে জলঙ্গীর পাড়ে এ জায়গায় এসে উপস্থিত হলাম৷ জায়গাটা দেখে বেশ পছন্দ হয়ে গেল আমার৷ নদীর পাড়ে শ্মশান, কাছে-পিঠে কোনও জনবসতি বা লোকজনের উৎপাত নেই৷ জায়গাটা যেন অনেকটা বীরভূমের সেই কোপাই নদীর একদা নির্জন পাড়ের মতো৷ যেমন আমি চাইছি ঠিক তেমনই জায়গা৷ শ্মশানের কাছেই একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করলাম৷ পৈতৃক সূত্রে কিছু টাকার সংস্থান হয়েছিল আমার৷ বীরভূমের বাড়িটা বিক্রি করে যে টাকা আমার হাতে এসেছিল, তা দিয়েই অতি সাধারণ জীবনযাত্রা পরিচালিত হতো৷ তাছাড়া প্রতিদিন বেশ কয়েকটা মড়া শ্মশানে আসে৷ আমি হাত না পাতলেও শ্মশান যাত্রীরা অনেক সময় খাবার বা সামান্য টাকা-পয়সা দিয়ে যেত৷ তখন রক্তাম্বর পরতাম আমি৷ এরপর একদিন একটা ঘটনা ঘটল৷ যা আমার জীবন আবারও অন্য খাতে বদলে গেল৷
সে সময় রাতে কুটির ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে মাঝে-মাঝেই শ্মশানে যেতাম৷ মনে আছে সেদিন নদী থেকে একটা শোল মাছ ধরেছিলাম৷ বর্ষাকাল৷ সারা দিন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল৷ রাত দশটা নাগাদ বৃষ্টি থামতেই কুঁড়ে ছেড়ে শ্মশানে গিয়েছিলাম৷ হঠাৎ চোখে পড়ল একদল শিয়াল মাটি খুঁড়ে কী যেন বাইরে বার করে আনার চেষ্টা করছে! অনুমান করলাম সেটা কোনও লাশ হবে৷ আমি ছুটে যেতেই শিয়ালগুলো পালাল৷ দেখলাম আমার অনুমান সত্যি৷ মাটি খুঁড়ে তারা বার করে এনেছে বছর পাঁচেক বয়সি একটা বাচ্চা ছেলের লাশ৷ যেটুকু দেখলাম, মনে হল ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা৷ হয়তো আপনাদের জানা আছে যে, অনেক জায়গায় প্রচলিত রীতি আছে বাচ্চা ছেলে বা শিশুদের মৃতদেহ দাহ না করে মাটিতে পুঁতে দেওয়ার৷ আমি বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা তেমনই৷ পাছে শিয়ালের দল শিশুর মরদেহটা ছিঁড়ে খুঁড়ে না খায় তাই সেই মৃতদেহর সামনে বসলাম তাকে ভালো করে মাটি চাপা দেওয়ার জন্য৷ কিন্তু কী বলব সেই দেহটাকে স্পর্শ করে দেখলাম যে দেহ তখনও জীবিত মানুষের মতোই গরম! মনে হল সে যেন তখনও জীবিত আছে৷ হয়তো তাকে ভুল করে মৃত ভেবে মাটিতে পোঁতা হয়েছিল৷ চেষ্টা করলে সে হুঁশ ফিরে পেতে পারে৷
তন্ত্রাচার্য অবধূতের থেকে আমি বেশ কিছু কৌশল শিখেছিলাম৷ তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করলাম৷ গুরুর আশীর্বাদ আর ঈশ্বরের কৃপায় একসময় সে চেষ্টা সফল হল৷ নড়ে উঠল বাচ্চাটা৷ শরীরে ফুটে উঠল প্রাণের স্পন্দন৷ ছেলেটাকে আমি শ্মশান থেকে তুলে ঘরে নিয়ে এলাম৷ তারপর তিন-চারদিন ধরে শুশ্রুষা করে তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুললাম৷ কিন্তু সে সুস্থ হয়ে ওঠার পর দেখলাম যে নাম-পরিচয় কিছুই বলতে পারছে না৷ সে নবজীবন লাভ করেছে ঠিকই কিন্তু তার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে৷
বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর বেশ কিছুদিন তাকে নিয়ে আশপাশের গ্রামগুলো ঘুরে বেড়ালাম৷ কিন্তু কেউই বাচ্চাটাকে দাবি করল না বা তার পরিচয় দিতে পারল না অথবা তার দায়িত্ব নিতে রাজি হল না৷ বরং তাদের কেউ কেউ বলল যে, তাদের পরিচিত এমন অনাথ বাচ্চা আছে৷ আমি চাইলে বরং তারা সে সব বাচ্চার সন্ধান দিতে পারে৷ মহা মুশকিলে পড়লাম৷ বাচ্চাটাকে নিয়ে তখন কী করি? বাচ্চাটার প্রতি এতদিনে আমার মায়া পড়ে গিয়েছে৷ অসহায় ছেলেটাকে তো আর রাস্তায় ফেলে আসতে পারি না৷ কাজেই আমার কুটিরেই তাকে নিয়ে থাকতে শুরু করলাম৷ আর তাকে দেখতে দেখতে আমার মনে একসময় একটা ভাবনা আসতে শুরু করল৷ মনে হতে লাগল এই বাচ্চাটার মতো তো আরও অনেক এমন শিশু আছে, যারা অনাথ, যাদের দেখবার কেউ নেই, যদি সেই অনাথ বাচ্চাদের দেখভাল করা যেত তবে কত ভালো হতো!
ধীরে ধীরে এ ভাবনা যেন আমাকে পেয়ে বসতে লাগল৷ মনে হতে লাগল তন্ত্র-মন্ত্র সাধনা তো অনেক করলাম৷ তাতে নিজের জ্ঞান বাড়লেও সমাজের কী উপকারে লাগি আমি? মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি তখন এ জীবনটাকে কি মানুষের উপকারে লাগানো উচিত নয়? বিশেষত যদি এইসব শিশুদের কাজে লাগতে পারতাম৷ শিশুরা তো অসহায়, নিষ্পাপ হয়৷ যতদিন না তারা বড় হয়ে উঠছে ততদিন পরনির্ভরশীল থাকে৷ কিন্তু অনাথ আশ্রম খুলতে গেলে তো টাকার দরকার, সে টাকা পাব কোথায়?
কাকতালীয়ভাবেই সে সমাধানও হয়ে গেল৷ একদিন আমি কৃষ্ণনগর গিয়েছি৷ সেখানে দেখা হয়ে গেল বীরভূমে যাকে আমি বাড়ি বিক্রি করেছিলাম তার সঙ্গে৷ কী একটা কাজে লোকটা কৃষ্ণনগর এসেছিল৷ সে আমাকে জানাল যে কলকাতা থেকে কয়েকজন লোক নাকি বীরভূমে এসেছিল আমাকে খুঁজতে৷ কলকাতার বাড়িটা তারা কিনতে চায়৷ সত্যি কথা বলতে কী, আমি ভাবতাম সে বাড়ি এতদিনে কেউ দখল করে নিয়েছে অথবা ভেঙে ফেলেছে৷ আমি তো বীরভূমে আসার পর কোনওদিন আর সে বাড়িতে যাইনি৷ মাঝে কয়েক যুগ কেটে গিয়েছে৷ বাড়ির কোনও দলিলপত্রও আমার কাছে ছিল না৷ যাই হোক, খবরটা পেয়ে কলকাতা ছুটলাম, এবং শেষ পর্যন্ত কাগজপত্র জোগাড় হল৷ ভবিষ্যতে যদি কোনও প্রয়োজনে লাগে সে কথা ভেবে বাড়িটার একটা ক্ষুদ্র অংশ শুধু নিজের জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করে দিলাম৷ তারপর সে টাকা দিয়ে জলঙ্গীর পাড়ে সস্তায় এই পাঁচ বিঘা জমি কিনে আশ্রম বানালাম৷ এক এক করে এখন দশজন অনাথ বাচ্চাকে এখানে আমি আমার ক্ষুদ্র সাধ্যমতো প্রতিপালন করছি৷ তন্ত্রসাধনার বদলে ওদের প্রতিপালনই এখন আমার প্রধান কাজ৷’
একটানা কথাগুলো বলে থামলেন তমসাময়৷ তারপর একটু দম নিয়ে ঈষৎ লজ্জিতভাবে বললেন, ‘আমাকে মার্জনা করবেন৷ আশ্রম প্রতিষ্ঠার কথা বলতে গিয়ে হয়তো নিজের কথাই বেশি বলে ফেললাম৷ আসলে জীবনের পুরো কাহিনি বলার লোভ সামলাতে পারলাম না৷ কিছু মনে করবেন না৷’
তমসাময়ের কথা শুনে মল্লার বলল, ‘না, না, মনে করার কোনও ব্যাপার নই৷ বরং আপনার কথা শুনে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল আমাদের কাছে৷ বিচিত্র জীবন আপনার৷’
মল্লাররা যে এই আশ্রমে এসে খরচের বিনিময়ে এক-দু’দিন থাকতে পারে তা টেলিফোনে আগেই জানিয়েছিল তমসাময়কে৷ তাই তিনি এরপর বললেন, ‘বাড়ি বিক্রির টাকা প্রায় সবটাই তখন শেষ হয়ে গিয়েছে৷ অথচ বাচ্চাগুলোকে ভালোভাবে পড়াশোনা করাবার দরকার, আরও ভালোভাবে রাখা, খাওয়া-দাওয়ার দরকার, প্রয়োজনে ভালো চিকিৎসার দরকার, সে জন্যই আপনাদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি৷ আপনারা এখানে দু-তিন থাকুন, দেখুন, বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলুন৷ তারপর যদি মনে হয় আমি সাহায্য পাওয়ার যোগ্য তখন সাহায্য করবেন৷ আপনারা এখানে থাকবেন বলেই যে আমাকে অর্থ সাহায্য করতে হবে তেমন অন্যায় দাবি আমি করব না৷
তমসাময়ের এ কথাটা শুনে বেশ ভালো লাগল মল্লারদের৷ সোহম বলল, ‘আপনাকে জানিয়ে রাখি আমরা এই তিন বন্ধুই অনাথ হিসাবে বড় হয়েছি, পরে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি৷ তাই অনাথ শিশুদের দুঃখ, কষ্ট, চাহিদার কথা আমাদের জানা৷ আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন৷ যদি আমাদের এ আশ্রম অনাথ শিশুদের জন্য উপযুক্ত মনে হয় তবে আমাদের সাহায্য থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন না৷’
তমসাময় মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি সেই আশাই রাখি৷ তবে আপনারা শহরের লোক, এখানে থাকতে কিছুটা কষ্ট হবে৷ এখানে ইলেকট্রিসিটি নেই, রাতে লণ্ঠনই ভরসা৷ কোনও টেলিফোনও নেই৷ জানেনই তো আপনাদের সঙ্গে গঞ্জের টেলিফোন বুথ থেকে কথা বলেছি৷ আর মোবাইলের টাওয়ারও অধিকাংশ সময়ই থাকে না৷ বলা যেতে পারে এটা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জায়গা৷’
তাঁর কথা শুনে মল্লার নিজের হাতে মোবাইল ফোনটার দিকে তাকিয়ে দেখল আশ্রমে ঢোকার কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত মোবাইলের টাওয়ার থাকলেও এখন তা নেই!
চূর্ণীও নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরে তাই তো! আমার মোবাইলেও টাওয়ার নেই দেখছি!’
সোহমের মুখ দেখে মল্লারের মনে হল তার মোবাইলেরও একই অবস্থা!
শীতকালের ছোট বেলা৷ তারা আশ্রমে আসার পর বেশ খানিকটা সময় কেটে গিয়েছে, পাঁচটা বেজে গেছে৷ সূর্য এবার দ্রুত ঢলতে শুরু করেছে৷ বাইরের আলো ফুরিয়ে আসছে৷
তমসাময় বললেন, ‘আপনারা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন৷ আপনাদের বিশ্রামের প্রয়োজন৷ আপনাদের রাত্রিবাসের জন্য যতটুকু সম্ভব ব্যবস্থা করেছি দুটো ঘরে৷ একটু মানিয়ে নেবেন৷ কাল সকালে আশ্রমটা ভালো করে ঘুরিয়ে দেখাব৷ পিছনেই জলঙ্গী নদী৷ তার পাড়েও আপনাদের নিয়ে যাব৷ বুনো আপনাদের এখন থাকার ঘরে নিয়ে যাবে, রাতে খাবারের ব্যবস্থাও করবে৷’ এই বলে চেয়ার থেকে তমসাময় উঠে দাঁড়ালেন৷
তাঁর সঙ্গেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল মল্লাররা৷ দাওয়ার নীচে বুনো দাঁড়িয়ে আছে৷ তারা তিনজন এরপর দাওয়া থেকে নেমে গাড়ির কাছে গিয়ে নিজেদের ব্যাগপত্র নামাল গাড়ি থেকে৷ তারপর সে সব নিয়ে বুনোর পিছন পিছন চলল সে জায়গা থেকে কিছুটা তফাতে খড়ের ছাউনি আর দরমার তৈরি মাটির দাওয়াওলা ঘরের দিকে৷ সেদিকে হাঁটতে হাঁটতে সোহম, বুনো নামের লোকটাকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কি এ আশ্রমেই থাক?’
সে বলল, ‘হ্যাঁ, এখানেই থাকি, এখানেই এখন কাজ করি৷’
মল্লার তাকে প্রশ্ন করল, ‘এখানে কাজ করার আগে কী কাজ করতে তুমি?’ এ প্রশ্নের জবাবে একটু চুপ করে থাকার পর বুনো নামের লোকটা জবাব দিল, ‘অনেক আগে এক সময় সার্কাসের দলে কাজ করতাম৷ তারপর সে কাজ চলে যাওয়ার পর জলঙ্গীর এই শ্মশানে মড়া পোড়াতাম৷ মানে ডোমের কাজ করতাম৷ এখন এখানে কাজ করি৷’
মল্লার, বুনোকে আরও কেনও প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু ‘মড়া’, ‘ভূত’ এ সব শব্দে বেশ ভয় পায় চূর্ণী৷ পাছে সে সব আলোচনার অবতারণা হয় তাই সে মল্লারকে বলল, ‘থাক, এখন এত কথা ওর থেকে জেনে কাজ নেই৷ ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিতে হবে৷’
মল্লার আর সোহম দু’জনেই হেসে ফেলল চুর্ণীর কথার মর্ম বুঝতে পেরে৷ তবে তারা সেই বাচ্চা ছেলেগুলোকে আর দেখতে পেল না৷ অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই ঠান্ডাও পড়তে শুরু করেছে৷ মল্লাররা অনুমান করল সে জন্যই হয়তো বাচ্চাগুলো ঘরে ঢুকে গেছে৷
বুনো যেখানে মল্লারদের থাকার জন্য পৌঁছে দিয়ে গেল সেটা আসলে একটাই ঘর৷ তার মাঝে দরমার বেড়া দিয়ে পার্টিশন করে দুটো ঘর বানানো হয়েছে৷ সেই দরমার বেড়ার গায়ে অন্য ঘরে যাওয়ার জন্য দরজাও আছে৷ দুটো ঘরেই আছে চাদর বিছানো তক্তপোশ, জলের কুঁজো, লণ্ঠন৷ তাদের ঘরের ঠিক পিছনেই চট দিয়ে ঘিরে একটা শৌচাগারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আর তার সঙ্গেই বাঁশের বেড়া গিয়ে ঘেরা স্নানাগার৷ একটা টিউবওয়েল বা চাপা কল আছে সেখানে৷ ঘরের মধ্যে একটা ঘরে থাকবে চূর্ণী, আর অন্য ঘরে মল্লার আর সোমহের থাকার বন্দোবস্ত হল৷
বুনো তাদের সবকিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে চলে যাওয়ার পর পিছনের কল থেকে মুখ হাত ধুয়ে পোশাক পাল্টে ফ্রেশ হয়ে লণ্ঠন জ্বালিয়ে তারা বসতে না বসতেই বাইরে ঝুপ করে গাঢ় অন্ধকার নেমে এল৷ আর তারপরই আশ্রমের পিছনে অর্থাৎ নদীর পাড় থেকে ভেসে এল অদ্ভুত এক চিৎকার৷ সে শব্দ এত আকস্মিক যে শুনে তারা তিনজনই একসঙ্গে চমকে উঠল৷ চূর্ণী তো ভয় পেয়ে আর একটু হলেই সোহমকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু বার কয়েক সে শব্দ হওয়ার পরই সে শব্দ চিনতে পেরে মল্লার হেসে ফেলল৷ সে চূর্ণীর উদ্দেশে বলল, ‘ঘাবড়াস না, এটা শিয়ালের ডাক৷ এ ডাক আমি আমার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে শুনেছি৷’
চূর্ণী সে কথা শুনে একটু আস্বস্ত হলেও বলল, ‘তেমন বুঝলে কিন্তু আমি রাতে তোদের ঘুমাতে দেব না৷ সারা রাত গল্প করেই কাটাব৷
সোহম বলল, ‘এ জায়গাটা কিন্তু আমার বেশ লাগছে৷ সত্যিই যেন চেনা পৃথিবীর বাইরে একটা জায়গা! মোবাইলের টাওয়ার না থাকাতে কেউ আমাদের ফোন করে অন্য কাজের জন্য ডিস্টার্বও করতে পারবে না৷ যে উদ্দেশে এখানে এসেছি সে কাজ কতটা সফল হবে তা জানি না, তবে দু-দিন কমপ্লিট রেস্ট নেওয়ার জন্য কিন্তু এ জায়গা আদর্শ বলেই মনে হচ্ছে৷’
চূর্ণী প্রশ্ন করল, ‘তমসাময় ভদ্রলোককে তোদের কেমন বলে মনে হল?’
মল্লার বলল, ‘আপাতদৃষ্টিতে তো ভালো লোকই মনে হল৷ নইলে এত কথা আমাদের খুলে বলতেন না৷ তবে চট করে তো কোনও লোককে তেমনভাবে চেনা যায় না৷ দু-দিন এখানে থাকলে হয়তো লোকটাকে কিছুটা বুঝতে পারব, তার কাজকর্ম আর আশ্রম সম্পর্কেও ধারণা করতে পারব৷’
সোহম বলল, ‘তেমন হলে কাছে যে গঞ্জ আছে যেখানে গিয়েও তমসাময় ও তার এই আশ্রম সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে৷ আমরা তো দু-দিন এখানে থাকবার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি৷’
চূর্ণী বলল, ‘হ্যাঁ, সব দিক খতিয়ে দেখেই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা নেব৷’ এরপর তিন বন্ধু মিলে নিজেদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা-আলোচনা শুরু করল৷ বাইরে জলঙ্গী নদীর গায়ে আশ্রমের মাথায় ধীরে ধীরে চাঁদও উঠতে শুরু করল৷ এগিয়ে চলল সময়৷
রাত আটটা নাগাদ রাতের খাবার নিয়ে হাজির হল বুনো নামের লোকটা৷ অতি সাধারণ খাবার৷ মোটা চালের ভাত, ডাল আর পাঁচমিশালি একটা সব্জি৷ এ খাবার খেতে তাদের কোনও অসুবিধা হল না৷ বরং মল্লারদের মনে পড়ে গেল নিজেদের অতীতের দিনগুলো৷ এক সময় তারা তো এসব খেয়েই কাটিয়েছে৷ আরও একপ্রস্থ গল্প করতে করতে তাদের খাওয়া যখন শেষ হল তখন লণ্ঠনের আলো প্রায় নিভু নিভু হয়ে এসেছে৷ আরও একবার শিয়াল ডেকে উঠল সে সময়৷ তবে সে ডাক শুনে চূর্ণী এবার আর ভয় পেল না৷ খাওয়া সেরে মুখ হাত ধুয়ে চূর্ণী একটা ঘরে আর মল্লার-সোহম একটা ঘরে সঙ্গে আনা চাদর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল৷ ঘুম নেমে এল তাদের চোখে৷
কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদে মল্লারের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল৷ ঘুম ভাঙার কারণটাও সে বুঝতে পারল৷ ঘরের দরজা বন্ধ থাকলেও ঘরের বেড়ার দেওয়াল ঘেঁষে তক্তপোশে যে জায়গাতে মল্লার শুয়ে তার ঠিক কাছেই বেড়ার গায়ে জানলার মতো করা আছে৷ সেই ফোকরগুলো দিয়ে বাইরের ঠান্ডা বাতাস সোজা এসে লাগছে তার গায়ে৷ কম্বল জড়ানো থাকলেও ঠান্ডা লাগছে ওর৷ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল মল্লার৷ সোহম দিব্যি ঘুমোচ্ছে৷ মল্লার একটা চাদর দিয়ে সে জায়গাটা আটকাবার জন্য জানলার মতো জায়গাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ চাদরটা বেড়ার গায়ে গোঁজার আগে ঘরের বাইরে একবার তাকাল৷ বাইরে ঠান্ডার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশাও নামতে শুরু করেছে৷ পাতলা কুয়াশার চাদর ভেসে বেড়াচ্ছে আশ্রমের ফাঁকা জমিটার মধ্যে৷ আকাশে আধফালি চাঁদ আছে৷ আর সেই আলোতে হঠাৎই একটা দৃশ্য মল্লারের চোখে পড়ল৷ ফাঁকা জমিটার এক জায়গায় বাচ্চা ছেলেগুলো জড়ো হয়েছে৷ এত রাতে ঠান্ডার মধ্যে ঘরের বাইরে কী করছে বাচ্চাগুলো! মল্লার তাদের দেখার চেষ্টা করতে লাগল৷ তার এই জানলা দিয়ে তমসাময়ের ঘরটাও দেখা যাচ্ছে৷
এরপরই তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে ফাঁকা জমির মধ্যে ছেলেপুলেগুলোর কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি৷ তমসাময় বাচ্চাগুলোর উদ্দেশে কী বললেন তা মল্লারের পক্ষে জানা সম্ভব হল না৷ তবে মল্লারের মনে হল ছেলেগুলো যেন তমসাময়ের কথা শুনে একবার মল্লারদের ঘরের দিকে তাকাল৷ তমসাময় এরপর হাঁটতে শুরু করলেন৷ বাচ্চা ছেলেগুলো তাঁকে অনুসরণ করতে লাগল৷ মিনিট খানেকের মধ্যেই তমসাময়ের সঙ্গে বাচ্চাগুলো হারিয়ে গেল আশ্রমের যেদিকে নদী সেদিকের গাঢ় কুয়াশার মধ্যে৷ এত রাতে তারা এইভাবে কোথায় গেল তা মল্লার বুঝতে পারল না৷
আবার ঘুম নেমে এল লাগল তার চোখে৷ জানলার মতো জায়গাটা চাদর দিয়ে আটকে আবার কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানাতে শুয়ে পড়ল মল্লার৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন