জলঙ্গীর অন্ধকারে – ৮

হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

শনিবার৷ দুপুরের পর মল্লারদের ব্যাঙ্কে কাস্টমারদের ভিড় অনেকটাই হালকা হয়ে গেল৷ ব্যাঙ্কে একটা ছোট ঘর আছে৷ যেখানে বসে কখনও টিফিন সারে কর্মীরা৷ কাজের চাপ কম থাকলে সে ঘরে বসে গল্প গুজবও হয়, কেউ ধূমপানও করে৷ মল্লার যখন বুঝতে পারল তার কাছে আর এদিনের মতো লোক আসার সম্ভাবনা কম, তখন সে কিউবিকল থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট খাবার জন্য ওই ঘরে গিয়ে ঢুকল৷ লোন সেকশনের সুদীপ সেখানে বসে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিল৷ টেবিলের গায়ে তার পাশের চেয়ারে বসে মল্লার একটা সিগারেট ধরাল৷ হঠাৎ সুদীপ তাকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা মল্লারদা, তুমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস কর?’

মল্লার সিগারেটে টান দিয়ে হেসে বলল, ‘না, করি না৷ কিন্তু এই ভর দুপুরে তোমার হঠাৎ ভূত-প্রেতের কথা মনে এল কেন?’

প্রশ্নের জবাবে সুদীপ হাতের সংবাদপত্রটা মল্লারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে একটা খবর দেখিয়ে বলল, ‘এটা দ্যাখ৷’

খবরের কাগজে যে সব পাঁচমিশেলি ছোট ছোট খবর থাকে তেমনই একটা খবর৷ শিরোনাম—সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল ভূতের ছবি৷’

মল্লার পড়তে শুরু করল লেখাটা—’গত দু-দিন ধরে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে৷ তাতে দেখা যাচ্ছে মধ্যরাতে এক ব্যক্তি শ্মশানের পোড়া চিতার সামনে এসে দাঁড়ায়৷ তারপর উবু হয়ে বসে চিতার কাঠ হাতড়ে কিছু একটা মুখে তুলে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে! দু-মিনিটের এই সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজটি সোশ্যাল মিডিয়ার শোরগোল ফেলে দিয়েছে৷ অনেকর ধারণা এটি কোনও ভূত-প্রেত-অপদেবতার ছবি৷ অন্য অংশের মতে লোকটি কোনও শ্মশানকর্মী হতে পারে৷ তবে লোকটির পরিচয় জানা যায়নি৷ যতটুকু খবর পাওয়া গিয়েছে তাতে ছবিটি উত্তর কলকাতার শেষ প্রান্তে কাশীপুর শ্মশানের ছবি৷ যার নাম শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ মহাশ্মশান৷’

মল্লার খবরটা পড়ে হেসে বলল, ‘সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন অনেক অদ্ভুত ছবি, ভিডিও মাঝে মাঝেই ভাইরাল হয়৷ আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, তবে হোয়াটস অ্যাপে মাঝে-মাঝেই অনেকে এ ধরনের ছবি, ভিডিও পাঠায়৷ আমার ধারণা লোকটা শ্মশানকর্মী বা ভবঘুরে ধরনের কেউ হবে৷ শ্মশানে তো সারা রাতই নানা ধরনের লোকের আনাগোনা থাকে৷’

মল্লারের বক্তব্য শুনে সুদীপ বলল, ‘তবে লোকটার ছবি দেখে কিন্তু তাকে ঠিক ডোম বা ভবঘুরে বলে মনে হচ্ছে না৷ আমাকে আজ সকালে হোয়াটস অ্যাপে একজন ভিডিওটা পাঠিয়েছে৷ এই দ্যাখ—৷’ এ কথা বলে সুদীপ তার মোবাইল ফোন ঘেঁটে সেই ভিডিওটা বার করে মোবাইলটা মল্লারের হাতে দিল৷ মল্লার ক্লিক করতেই চালু হয়ে গেল ভিডিওটা৷

দেখেই বোঝা যাচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরাতে রাতে তোলা সাদা-কালো ছবি৷ তাতে ল্যাম্প পোস্টের আলো দেখা যাচ্ছে৷ ছবির গায়ে সময়ও ফুটে উঠছে—রাত দুটো পাঁচ৷ কাগজে যে সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে তেমনই দেখা যেতে লাগল ভিডিওতে৷ এক ব্যক্তি হেঁটে এসে দাঁড়াল শ্মশানের পোড়া চিতাকাঠের সামনে৷ তার গায়ে ফুলহাতা জ্যাকেট, পরনে সম্ভবত জিন্সের প্যান্ট৷ মাথায় একটা টুপি থাকায় লোকটার মুখ ঠিক দেখা যাচ্ছে না৷ তবে এ কথা ঠিকই লোকটাকে যেন শ্মশানকর্মী বা পাগল, ভবঘুরে গোছের মনে হচ্ছে না৷ লোকটা চিতাকাঠের সামনে এসে একবার চারপাশে তাকাল৷ এ পর্যন্ত দেখেই মল্লারের সেই লোকটার অবয়ব, পোশাক কেমন যেন চেনা মনে হতে লাগল! মল্লার মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকল ভিডিওটি৷ লোকটা চারপাশ দেখে নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসল কাঠগুলোর সামনে, তারপর দু’হাত দিয়ে কাঠগুলো হাতড়ে কী যেন খুঁজতে লাগল৷ সম্ভবত চিতাকাঠগুলোর মধ্যে কোনও কিছু খুঁজে পেয়ে সেটা তুলে নিয়ে মুখে দিল সে৷ তারপর আবারও সে কাঠগুলোর মধ্যে কোনও কিছু খুঁজতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে এরপর অন্য কোনও লোক তার কাছাকাছি চলে আসাতে লোকটা সে জায়গা ছেড়ে উঠে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল অন্যদিকে, ক্যামেরার লেন্সের বাইরে৷

ভিডিওটা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল মল্লার৷ যে লোকটাকে ছবিতে দেখা যাচ্ছে তার মুখ বোঝা না গেলেও লোকটার হাঁটা-চলা সাজ-পোশাক অনেকটা যেন সোহমেরই মতো লাগছে৷

মল্লার এরপর আবার ভিডিওটা চালিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল৷ লোকটা যখন শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে তখন তার জ্যাকেটের পিছনের বড় করে লেখা একটা ইংরেজি অক্ষরও যেন চোখে পড়ছে বলে মনে হল মল্লারের৷ আর সেটা তার মনের সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিল৷

মল্লার ভিডিওটা দু’বার দেখার পর সুদীপ তাকে প্রশ্ন করল, ‘ছবিটা দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে?’ মল্লার জবাব দিল, ‘ভালো করে দেখে আমার কী মনে হয় বলব৷ ভিডিওটা আমাকে এখন হোয়াটস অ্যাপে পাঠাওতো৷’

সুদীপ সঙ্গে সঙ্গেই ভিডিওটা পাঠিয়ে দিল মল্লারের মোবাইলে৷ মল্লারের সিগারেট টানা শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ সে এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের কিউবকলে বসল৷

মল্লার নিজের মোবাইলে সুদীপের সদ্য পাঠানো ভিডিওটা খুলে তার থেকে প্রথমে বেশ কয়েকটা স্টিল ফটো বা স্ক্রিন শট নিল৷ তারপর সে ছবিগুলো জুম করে, অর্থাৎ বড় করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল৷ সে ভাবে দেখে লোকটার মুখ বোঝা না গেলেও তার জ্যাকেটের ছবিটা বড় করে দেখতেই মল্লার যেন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গলে এই অজ্ঞাত পরিচয় লোকটা সোহমই হবে! লোকটার জ্যাকেটের পিছনে বড় করে একটা ইংরেজির ‘বি’ অক্ষর লেখা! এমনই একটা জ্যাকেট সোহম এসপ্ল্যানেড থেকে কিনেছিল৷ আসলে জ্যাকেটের পিছনে লেখা আছে ‘বস’৷ তবে তার ‘বি’ অক্ষরটা এত বড় করে পিঠ জুড়ে লেখা যে সেই অক্ষরটাই শুধু চোখে পড়ে৷

ফোনটা হাতে নিয়ে বসে মল্লার বিস্মিতভাবে ভাবতে লাগল ব্যাপারটা নিয়ে। এ কথা ঠিকই যে এমন ‘বি’ লেখা ডিজাইনের জ্যাকেট আরও হাজার জন গায়ে দিয়ে ঘুরতে পারে৷ কিন্তু তাই বলে পোশাক, অবয়ব, হাঁটা চলাতে দু’জন লোকের কি এমন অদ্ভুত মিল থাকা সম্ভব? কিন্তু যে প্রশ্নটা সবথেকে বেশি মল্লারের মনে ঘুরপাক খেতে লাগল তা হল, ছবির লোকটা যদি সত্যি সোহম হয়ে থাকে তবে অত রাতে ও শ্মশানে গিয়েছিল কেন? চিতাকাঠ থেকে কী খুঁজছিল? মল্লার অনেকক্ষণ ভাবার পরও ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না৷

অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পরও তার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকল বিষয়টা৷ বেশ কয়েকবার ভিডিওটা চালিয়ে দেখল মল্লার৷ প্রতিবারই ভিডিওটা দেখে তার মনে হতে লাগল, এ লোকটা সোহম ছাড়া অন্য কেউ নয়৷ একবার মল্লারের মনে হল চূর্ণীকে ফোন করে সে ব্যাপারটা নিয়ে কিছু জানে নাকি, অথবা ভিডিওটা দেখেছে কি না সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে৷ কিন্তু এর পরক্ষণেই মল্লারের মন বলল, এখনই তাকে ব্যাপারটা জিগ্যেস করা ঠিক হবে না। কারণ, ব্যাপারটা সম্পর্কে তার কিছু জানা না থাকলে তা শুনে সে নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে যাবে। তার চেয়ে সোহমের সঙ্গে দেখা করে তাকে সরাসরি জিগ্যেস করাই ভালো৷ পরদিন আবার সে সোহমের খোঁজে যাবে৷ এ চিন্তা মাথায় নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল মল্লার৷

রবিবার মল্লারের বাজার করার দিন৷ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মল্লার থলি হাতে চলল মানিকতলা বাজারের দিকে৷ মাছ বাজারে ঢুকে ঘুরতে ঘুরতে গত শনিবার যার থেকে সোহম আর মল্লার মাছ কিনেছিল তার সামনে আসতেই লোকটা মল্লারকে বলল, ‘আসুন, আসুন বাবু৷ রুই, চিংড়ি, পমফ্রেট, শোল সব আছে৷ কী নেবেন বলুন?’

লোকটার হাঁক শুনে মল্লার তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে মাছের দিকে তাকাল৷

মাছ বিক্রেতা এরপর মল্লারকে বলল, ‘সব ফ্রেশ মাছ বাবু৷ আপনার বন্ধুকে জিগ্যেস করে দেখবেন৷ তিনি তো আজও বাজারে বসতে না বসতেই আমার থেকে মাছ কিনে নিয়ে গেলেন৷’

মল্লার বলল, ‘কোন বন্ধু?’

বিক্রেতা বলল, ‘ওই যে যার সঙ্গে আপনি গত সপ্তাহে আমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বললেন৷ যিনি আমার থেকে শোল মাছ কেনেন৷’

মল্লারের বুঝতে অসুবিধা হল না লোকটা সোহমের কথাই বলছে৷ বিস্মিতভাবে সে মাছওয়ালাকে বলল, ‘ও আজও এসেছিল৷ কী মাছ কিনল?’

মাছওয়ালা জবাব দিল, ‘শোল মাছ বাবু৷ উনি শুধু শোল মাছই কেনেন৷ আজও তাই নিলেন৷ দু-তিন দিন পর পর এসে শোল মাছ নিয়ে যান৷ গেল বিষ্যুতবারও এসেছিলেন মাছ নিতে৷’

এই শীতের সুন্দর ভোরেও মাছ বিক্রেতার কথা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য মল্লারের মনে সেই ছবিটা ভেসে উঠল—রান্না ঘরে আস্ত একটা পোড়া শোল মাছ সোহম কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে! সোহমের শোল মাছ কেনার প্রসঙ্গে মাছ বিক্রেতাকে আর কোনও প্রশ্ন না করে তার থেকে পমফ্রেট মাছ কিনে মল্লার বাড়ি ফিরে এল৷

মল্লারের রবিবার কোনও কাজ নেই৷ সে ঠিক করে নিয়েছে দুপুরবেলা খাওয়া সেরেই সে রওনা দেবে সোহমের বাড়ির উদ্দেশে৷ যতক্ষণ না সোহমের সঙ্গে ভিডিওটার ব্যাপারে কথা বলা যাচ্ছে ততক্ষণ একটা তীব্র অস্বস্তি কাজ করছে মল্লারের মনে৷ মল্লার বাজার নিয়ে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই রান্নার মাসি চলে এল৷ তার বানানো চা আর জলখাবার খেয়ে মল্লার খবরের কাগজ খুলে বসল৷

সংবাদপত্রের দুটো পাতা ওল্টাতেই হঠাৎই একটা ছোট ছবি আর খবরের হেডলাইন দেখে উত্তেজিতভাবে মল্লার খবরটা পড়তে শুরু করল৷ প্রতিবেদনের শিরোনাম—‘শ্মশানে আবারও আবির্ভাব সেই রহস্যময় মূর্তির!’

শিরোনামের তলায় লেখা হয়েছে—‘শ্মশানে আবারও আবির্ভাব সেই রহস্যময় মূর্তির৷ এবার তাকে মাধ্যরাতে দেখা গিয়েছে উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে স্ট্র্যান্ড রোডের কাশী মিত্র শ্মশানে৷ শ্মশান সংলগ্ন একটি বাড়ির মাথায় বসানো সিসিটিভির ক্যামেরায় ধরা পড়েছে সেই ছবি৷ চুল্লির গর্ত থেকে পোড়া কাঠ উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে নদী সংলগ্ন যে স্থনে রাখা হয়, সেই স্তূপাকৃত কাঠের মধ্যে কোনও কিছু অনুসন্ধান করছিল ওই রহস্যময় ব্যক্তি৷ তিনদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল হয়েছিল উত্তর কলকাতারই রতনবাবু ঘাট সংলগ্ন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ মহশ্মশানের৷ যা কাশীপুর শ্মশান নামে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত৷ সেই ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল একজন লোক মধ্যরাতে পোড়া চিতাকাঠের ভিতর থেকে কিছু তুলে মুখে দিচ্ছে!

কাশীপুর শ্মশানে যাকে দেখা গিয়েছিল আর কাশী মিত্র শ্মশানে যাকে দেখা গিয়েছে, পোশাক দেখে অনুমান করা যাচ্ছে তারা দু’জনেই একই ব্যক্তি৷ পরপর দু’বার উত্তর কলকাতার দুটি শ্মশানে একই রহস্যময় ব্যক্তির আবির্ভাবের ফলে যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে জনমানসে৷ বিশেষত কিছু লোক ওই অপরিচিত ব্যক্তিকে অশরীরী বলে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচার করাতে কিছু মানুষের মনে আতঙ্কও সৃষ্টি হয়েছে৷ সংবাদপত্রের তরফে কাশী মিত্র শ্মশানের শ্মশানকর্মীদের ওই রহস্যময় ব্যক্তির ছবি দেখালে তাঁরা জানাল এমন চেহারার কোনও শ্মশানকর্মী তাঁদের ওখানে কাজ করেন না৷ এ ব্যাপারে স্থানীয় থানার এক আধিকারিকের সঙ্গে সংবাদ মাধ্যম কথা বললে তিনি জানান, ওই রাতে কোনও অপরাধের খবর তাদের কাছে লিপিবদ্ধ হয়নি৷ তবে রহস্যময় ভিডিও ফুটেজ দুটি তাদেরও নজরে এসেছে। পুলিশের তরফে প্রকৃত ঘটনা জানার ব্যাপারে চেষ্ট চালানো হচ্ছে৷’

এই প্রতিবেদনের সঙ্গে যে ছবিটা ছাপা হয়েছে তা দেখে মল্লার বুঝতে পারল ছবিটা সিসিটিভির ফুটেজ থেকেই নেওয়া৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে একরাশ কাঠের সামনে পিছন ফিরে উবু হয়ে বসে আছে একজন৷ বসার ধরন দেখে মনে হয় লোকটা কাঠগুলোর মধ্যে কিছু একটা খুঁজছে৷ সুদীপ মল্লারকে যে ভিডিওটা দিয়েছে সেই ভিডিওর লোকটার মতোই একই পোশাক সংবাদপত্রে যার ছবি ছাপা হয়েছে তার৷ ভালো করে ছবিটা খুঁটিয়ে দেখে মল্লার বুঝতে পারল বসে থাকা লোকটার জ্যাকেটের পিঠেও ‘বি’ লেখা আছে৷ অর্থাৎ সংবাদপত্রের অনুমান সঠিক৷ দু-তিন দিনের ব্যবধানে মধ্য রাতের শ্মশানে যে দুই ব্যক্তির ছবি ক্যামেরাতে ধরা পড়েছে তারা আসলে একই লোক!

মল্লার কাগজটা হাতে ধরে ভাবতে লাগল, সত্যিই কি সোহম রাতের বেলায় শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়াচ্ছে? সোহমের বাড়িওয়ালা তো জানিয়েছে যে সোহম রাতে বাড়ি থাকছে না৷ তবে কি সে চাকরিতে বেরোবার নাম করে শ্মশানে মশানে যাচ্ছে! কিন্তু কেন? সোহমের সেই পোড়া শোল মাছ খাওয়ার দৃশ্যও মাঝে মাঝে ভেসে উঠতে লাগল মল্লারের মনে৷ সব ঘটনা মিলিয়ে মিশিয়ে মল্লারের মাথার মধ্যে সব কিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল৷ মল্লার ভেবেই চলল, বেলা গড়াতে লাগল কিন্তু কোনও সমাধান মিলল না৷ প্রবল উত্তেজনা মাথায় নিয়ে মল্লার কোনওরকমে স্নান-খাওয়া সারল৷ পোশাক পাল্টে বাইরে বেরোবার আগে সংবাদপত্রের যে পাতায় খবরটা ছাপা হয়েছে সেই পাতাটাও ভাঁজ করে পকেটে নিল মল্লার৷ গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করে বেলা দেড়টা নাগাদ মল্লার রওনা হয়ে গেল সোহমের বাড়ির উদ্দেশে৷

মল্লার যখন সোহমের বাসস্থানে গাড়ি নিয়ে হাজির হল তখন বেলা দুটো৷ মল্লার গাড়ি পার্ক করে বাড়িটাতে ঢোকার সময় দেখল একতলার বারান্দাতে রোদে পিঠ দিয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন সোহমের বাড়িওয়ালা উমাপতিবাবু৷ তার হাতে ধরা এ দিনের সেই সংবাদপত্র, যার একটা পাতা সোহমের সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় মল্লার পকেটে এনেছে৷ কাগজটা দেখেই মল্লারের মনে হল, উমাপতিবাবু কি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরটা পড়েছেন? মল্লারের পায়ের শব্দে বাড়িওয়ালা বৃদ্ধ কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালেন মল্লারের দিকে৷ মল্লারের সঙ্গে ভদ্রলোকের চোখাচোখি হয়ে যাওয়াতে মল্লার তাকে জিগ্যেস করল, ‘সোহম বাড়িতে আছে?’

ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘তিনি তো সকালবেলা নাইট ডিউটি করে একেবারে বাজার সেরে বাড়ি ফিরলেন৷ তারপর আর বাইরে বেরিয়েছেন বলে দেখিনি৷ নিশ্চয়ই ঘরেই আছেন৷’

বাড়িওয়ালার কথা শোনার পর মল্লার টপাটপ সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠে বারান্দা দিয়ে গিয়ে এগিয়ে সোহমের ঘরের কাছে পৌঁছে গেল৷ ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ৷ অর্থাৎ সোহম ঘরেই আছে৷ বার কয়েক মল্লার বেল বাজাবার পর দরজা খুলে দাঁড়াল সোহম৷ কেমন যেন একটা উস্কোখুস্কো চেহারা তার৷ মল্লারকে দেখে একটু যেন বিস্মিতভাবে তার দিকে চেয়ে রইল সোহম৷ ব্যাপারটা খেয়াল করে মল্লার হসে বলল, ‘কী রে, ঘরে ঢুকব না? নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব?’

মল্লারের কথা শুনে যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে সোহম বলল, ‘আয়, আয় ভিতরে আয়৷’

ঘরের ভিতর আগের দিনের মতোই অন্ধকার৷ আর সেই পোড়া মাছের গন্ধও যেন মল্লার টের পেল৷ দরজা বন্ধ করে আলো জ্বালাল সোহম৷ মল্লার আগের দিনের মতোই ডাইনিং টেবিলের সামনে চেয়ারে গিয়ে বসল৷ সোহম তাকে প্রশ্ন করল, ‘দুপুরবেলা এদিকে কোথায় এসেছিলি?’

মল্লার জবাব দিল, ‘অন্য কোথাও নয়৷ আজ ছুটির দিন, তাই তোর কাছে চলে এলাম৷ পরশু এদিকে ব্যাঙ্কের একটা কাজ ছিল৷ সে কাজ মিটিয়ে রাতে তোর খোঁজে এসেছিলাম৷ তুই ছিলি না৷ বাড়িওয়ালা তোকে কিছু বলেনি?’

‘হ্যাঁ, বলেছিল৷’—সংক্ষিপ্ত জবাব দিল সোহম৷

এরপর সে মল্লারকে জিগ্যেস করল, ‘সেদিনের বোতলে এখনও কয়েক পেগ হুইস্কি আছে খাবি?’

মল্লার বলল, ‘না, দিনের বেলা ওসব খাব না৷ তুই বরং এখানে এসে বোস৷ দু’জনে মিলে গল্প করি৷’

সোহম মল্লারের কথা শুনে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে মুখোমুখি বসল৷ বালবের আলোতে সোহমের মুখের দিকে তাকিয়ে মল্লার খেয়াল করল সোহমের মুখমণ্ডলে রাত্রি জাগরণের স্পষ্ট চিহ্ন দেখা যাচ্ছে৷ চোখের কোণে কালি পড়েছে তার৷ পরপর বেশ কিছুদিন ধরে রাতে না ঘুমলে চোখে যেমন কালি পড়ে৷ তাছাড়া কেমন যেন একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা ছড়িয়ে আছে সোহমের মুখমণ্ডলে৷

সোহমকে আসল কথা জিগ্যেস করার আগে তার মনের ভাব বোঝার জন্য মল্লার হেসে বলল, ‘খুব তো আমার ওখানে মানিকতলা বাজারে গিয়ে বাজার করছিস, মাছওয়ালা বলল৷ আজ সকালেও তো তুই ওখানে মাছ কিনতে গিয়েছিলি৷ তা রান্নাবান্না শিখলি কিছু?’

সোহম আবারও সংক্ষেপে জবাব দিল, ‘ওই কোনওরকম৷’

মল্লার এরপর তাকে বলল, ‘তোর বাড়িওয়ালা পরশু বলল, তুই নাকি কিছুদিন ধরে নাইট ডিউটি করছিস! তোদের অফিসে তো নাইট ডিউটি নেই বলেই জানি৷’

মল্লারের কথা শুনে সোহম একটু চুপ করে থেকে জবাব দিল, ‘আগের অফিস ছেড়ে দিয়েছি৷ অনেকদিন হল ওই কোম্পানিতে৷ তাই আর ওখানে কাজ করতে ভালো লাগছিল না৷ নতুন কোম্পানিতে জয়েন করলাম৷ ওখানে রাত জেগে কাজ করতে হচ্ছে৷’

মল্লার প্রশ্ন করল, ‘তোর নতুন অফিস কোথায়?’

‘নর্থ ক্যালকাটাতেই৷’ আলগোছে জবাব দিল সোহম৷

‘তুই যে পুরোনো চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছিস সে খবরটা চূর্ণীকে বলেছিস?’ আবারও প্রশ্ন করল মল্লার৷

এ প্রশ্নর জবাবে সোহম মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে চূর্ণী খবরটা জানে না৷

মল্লার বলল, ‘কেন শুধু শুধু চূর্ণীকে তুই অযথা টেনশনের মধ্যে রাখছিস বল তো? এমনিতেই ও একটু নার্ভাস প্রকৃতির মেয়ে৷ তার ওপর তুই ফোনের কানেকশন নিচ্ছিস না! হঠাৎ পুরোনো অফিস যাওয়া বন্ধ করলি! পুরোনো চাকরি হঠাৎ ছেড়ে নতুন চাকরি ধরলি, কিছুই তো জানাসনি ওকে৷ বেচারা মেয়েটা তোর জন্য সারাদিন চিন্তা করে, আর তুই এদিকে নিজের ইচ্ছামতো চলছিস! তোর জলঙ্গীর আশ্রম থেকে ফেরার পর কী হয়েছে বলত? চূর্ণীর সঙ্গে কি তোর কোন সমস্যা তৈরি হয়েছে?’

‘না।’ আবারও সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল সোহম৷

মল্লার এরপর ভাবল যে এবার সোহমকে সরাসরি আসল প্রশ্নটা করাই ভালো৷ ব্লেজারের পকেট থেকে মল্লার খবরের কাগজ আর মোবাইল বার করে সোহমকে বলল, ‘দ্যাখ সোহম, গত কয়েক দিন ধরে কলকাতাতে একটা ঘটনা ঘটছে। ব্যাপারটা জেনে বা দেখে আমি খুব টেনশনে পড়ে গিয়েছি। কেন টেনশনে পড়ে গিয়েছি তা তুই একটা ভিডিও ক্লিপ আর কাগজটা দেখার পর বুঝতে পারবি৷ সত্যি কথা বলতে কী, ঘটনাটা আসলে কী তা জানার জন্যই আমি ভরদুপুরে তোর কাছে ছুটে এলাম৷’

এ কথা বলে মল্লার মোবাইল খুলে ভিডিওটা বার করে সেটা চালিয়ে দিয়ে মোবাইলটা সোহমের হাতে ধরিয়ে দিল৷

সোহম দেখতে শুরু করল ভিডিওটা। মল্লার সোহমের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য সোহমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ কিন্তু ভিডিওটা দেখার সময় সোহমের মুখের অভিব্যক্তির কোনও পরিবর্তন হল না৷ ভাবলেশহীনভাবে ভিডিওটা দেখা শেষ করে সোহম মোবাইল ফোনটা মল্লারের হাতে ফিরিয়ে দিল৷

মল্লার এরপর খবরের কাগজটা খুলে সেই খবরটা সোহমকে দেখিয়ে বলল, ‘এই খবরটা পড়৷’

কাগজটা হাতে নিয়ে সোহম যেন মনোযোগ দিয়ে খবরটা পড়তে শুরু করল৷ এবারও আগের মতোই ভাবলেশহীন সোহমের মুখ৷ শুধু কাগজটা পড়ার পর সেটা টেবিলে নামিয়ে রাখার সময় শুধু বলল, ‘ও, পুলিশও ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে৷’

মল্লার এবার আর উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে বলে ফেলল, ‘হ্যাঁ, পুলিশ, সংবাদ মাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া সবাই লোকটার খোঁজ করছে৷ যার খোঁজ তারা করছে সে তুই নয় তো? তোর সবকিছুর সঙ্গে লোকটার কী অদ্ভুত মিল!

প্রশ্নটা শুনে উত্তেজিত মল্লারের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সোহম শান্ত স্বরে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ মিল কিছুটা আছে ঠিকই, কিন্তু ভিডিও বা খবরের কাগজে যে লোকের ছবি ছাপা হয়েছে সে লোক আমি নই৷’

সোহমের কথা শুনে মল্লার উত্তেজিতভাবে বলল, ‘এ ছবি তোর নয়; হাঁটা চলা, পোশাক, সব ব্যাপারে দুটো লোকের মধ্যে এত মিল কীভাবে সম্ভব৷ তাছাড়া ভিডিওর ছবি আমি জুম করে দেখেছি৷ আর খবরের কাগজের ছবিতেও দেখা যাচ্ছে লোকটার জ্যাকেটের পিঠে একটা ‘বি’ লেখা আছে৷ হুবহু তোর জ্যাকেটের মতো! যেটা পরে তুই নবজীবন আশ্রমে গিয়েছিলি!’

এ কথার জবাবে সোহম পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তোর কি মনে হয় পৃথিবীতে অমন জ্যাকেট একটা মাত্র বানানো হয়েছে? আমি ছাড়া অমন জ্যাকেট অন্য কেউ পরতে পারে না?’

মল্লার বলল, ‘তা পারে ঠিকই? কিন্তু সব ব্যাপারে এমন মিল কি অদ্ভুত নয়? তুই আমাকে সত্যি কথা বল৷ আমার মনে হচ্ছে ছবির লোকটা আর তুই একই লোক৷ তুই রাত্রে এমনভাবে শ্মশানে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন?’

সোহম এবার তার গলায় মৃদু অসন্তোষ ফুটিয়ে বলল, ‘বার বার একই কথা বলছিস কেন? আমি শ্মশানে কী করতে যাব? আমি বলছি তো ছবির লোকটা অন্য লোক৷’

মল্লার বলল, ‘অন্য লোক! তুই তো রোজ রাতে বাইরে বেরোচ্ছিস! আর যে দুটো শ্মশানে লোকটাকে দেখা গেছে সে দুটো শ্মশানই তোর বাড়ির কাছেই, উত্তর কলকাতাতেই৷ আচ্ছা৷ তুই যেখানে নাইট ডিউটি করতে যাচ্ছিস সেই অফিসে আমাকে নিয়ে যেতে পারবি?’

মল্লার কথাটা বলেই বুঝতে পারল এ কথা বলা তার ঠিক হয়নি৷ আর মল্লারের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট বিরক্তি আর উষ্মা ফুটে উঠল সোহমের মুখে৷ সে বলে উঠল, ‘তুই কি আমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছিস নাকি? কে করতে বলেছে, চূর্ণী?’

মল্লার বুঝতে পারল ব্যাপারটা এবার অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। এমনিতেই চূর্ণী সোহমের আচরণে যথেষ্ট উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। তার ওপর যদি মল্লার সন্দেহবশত তার সঙ্গে ঝগড়া করে তাহলে মহাবিপত্তি হবে।

মল্লার তাই বলে উঠল, ‘না, তোর পিছনে গোয়েন্দাগিরি করতে যাব কেন? আর চূর্ণীর সঙ্গে তো আমার কয়েক দিন কথাই হয়নি৷ আসলে ছবিটার লোকটার সঙ্গে তোর চেহারা, পোশাকের এতটাই সামঞ্জস্য যে আমি ব্যাপারটা দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম৷ কিন্তু তুই যখন বলছিস যে তুই সে লোক নয়, তখন সমস্যা মিটে গেল৷ আসলে দিনকাল ভালো নয়, কে, কখন, কোথায়, কোন ঝামেলায় জড়িয়ে যায় বলা তো যায় না! তাই তোকে কথাটা বললাম৷’

মল্লারের এ কথা শোনার পর সোহম যেন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এল৷ মল্লার এরপর সোহমকে বলল, ‘পরশু তো পঁচিশে ডিসেম্বর৷ ব্যাঙ্ক বন্ধ৷ তোদেরও ছুটি থাকবে নিশ্চয়ই৷ তিনজন মিলে কোথাও থেকে ঘুরে আসা যায় ওইদিন৷ নবজীবন আশ্রম থেকে ফেরার পর যা কাজের চাপ গেল৷ বাইরে ঘুরে আসলে ফ্রেশ হয়ে আসা যাবে৷’

মল্লারের প্রস্তাব শুনে সোহম বলল, ‘নবজীবন আশ্রম যাবি? জায়গাটা বেশ ভালো৷’

মল্লার বলল, ‘ভালো ঠিকই, কিন্তু ভোরবেলা গিয়ে আবার রাতের মধ্যে ফিরে আসাটা খুব চাপের ব্যাপার হয়ে যাবে৷ আমি কাছাকাছি কোথাও যাওয়ার কথা বলছি৷ এই ধর দু-তিন ঘণ্টার রাস্তা৷’

কথাটা শুনে সোহম যেন আবারও একটু গুটিয়ে গেল! সে বলল, ‘কাছে-পিঠে যাওয়া মানে তো, সেই লোকজনের ভিড়৷ ওসব আমার আর ভালো লাগে না৷ গেলে তোকে বা চূর্ণীকে ফোন করে জানিয়ে দেব৷ নইলে তোরা ঘুরে আয়।’

মল্লার হেসে বলল, ‘গেলে একসঙ্গে তিনজনই যাব৷ নইলে যাব না৷’

এরপর সোহমের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে মল্লার টুকটাক নানা কথা বলল৷ কিন্তু মল্লারের মনে হল তার কোনও কথাতেই যেন কোনও আগ্রহ প্রকাশ করল না সোহম৷ যেন মল্লার কথা বলছে বলেই সে কথা বলছে৷ কথার মধ্যে মন নেই তার! একবার শুধু সোহম নিজে থেকে প্রশ্ন করল, ‘ওই ভিডিও আর নিউজ পেপারের রিপোর্টের ব্যাপারে চূর্ণী কিছু জানে?’

মল্লার জবাব দিল, ‘জানে না নিশ্চয়ই৷ জানলে আমার থেকেও বেশি ভয় পেয়ে যেত৷ ফোন করত আমাকে, তোর বাড়ি ছুটে আসত৷’

কথাটা শুনে সোহম আর কিছু বলল না৷ কিন্তু একতরফা বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না৷ কাজেই মল্লার একসময় টেবিল থেকে খবরের কাগজ আর মোবাইলটা তুলে নিয়ে বলল, ‘এবার আমি যাচ্ছি৷ নিজের প্রতি খেয়াল রাখিস আর পঁচিশে ডিসেম্বর বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আর একবার ভাবিস৷’

সোহম আলগোছে উত্তর দিল, ‘হুঁ’৷

সোহমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হল মল্লার৷ ফেরার সময় সে ভাবতে লাগল, হয়তো সোহমের কথা মতোই শ্মশানের লোকটা সোহম নয়৷ কিন্তু সোহমের মধ্যে যেন একটা পরিবর্তন এসেছে৷ সোহমের সঙ্গে কথা বলে মনে হল সে হয় কোনও কিছু ভেবে চলেছে অথবা কোনও কিছু গোপন করতে চাইছে! জলঙ্গীর সেই দুর্ঘটনার পর তার মনে কোনও সমস্যা হয়নি তো? তাহলে তো চূর্ণীর কথা মতো তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত৷ এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে মল্লার বাড়ি ফিরে এল৷

রাত ন’টা নাগাদ চূর্ণীর ফোনটা এল৷

মল্লার কলটা রিসিভ করতেই চূর্ণী ওপাশ থেকে বলল, ‘কীরে, দুই বন্ধু কেমন আড্ডা দিলি?’

চূর্ণীর গলাতে যেন আগের মতো উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা তেমন নেই৷

মল্লার বলল, ‘সোহম ফোন করেছিল বুঝি? আসলে হঠাৎই মনে হল, সোহম কেমন আছে খোঁজ নিয়ে আসি৷ তাই চলে গেলাম৷’

চূর্ণী বলল, ‘হ্যাঁ আধঘণ্টা আগে ফোন করেছিল৷ বেশ কিছুক্ষণ কথা হল৷ ও একটা নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে তা তোকে বলেছে নিশ্চয়ই৷ ওখানে নাকি নাইট শিফটে ওকে কাজ করতে হচ্ছে বিদেশি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য৷ অফিসের ল্যান্ড লাইন থেকেই ফোন করেছিল বলল৷’

একথা বলে চূর্ণী বলল, ‘যাক বাবা৷ ও যে চাকরিতে যাচ্ছে সেটাই বড় কথা৷ মনে হয় ও চাকরি ছাড়া-ধরার চাপে অমন অস্বাভাবিক আচরণ করছিল৷’

মল্লার বলল, ‘ওকে তো বললাম, চল, পঁচিশে ডিসেম্বর কোথাও ঘুরে আসি তিনজন মিলে৷ সে ব্যাপারে সোহম তোকে কিছু বলল?’

চূর্ণী জবাব দিল, ‘গেলে তো ভালোই হয়৷ কিন্তু এ ব্যাপারে সোহম কিছু বলেনি৷ তবে…৷’

কী যেন একটা কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল চূর্ণী৷ মল্লার বলল, ‘তবে কী?’

চূর্ণী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ওই তমসাময় আর বাচ্চাগুলোকে মনে হয় সোহম কিছুতেই ভুলতে পারছে না৷ আমাকে কী যেন একটা কথা প্রসঙ্গে বলল, ‘আমি যদি জীবনবাবার আশ্রমে চলে যাই, তবে তুই সেখানে গিয়ে থাকবি আমার সঙ্গে?’

মল্লার বলল, ‘আমি ওকে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলতে ও বলল, চল জীবনবাবার আশ্রমে যাব৷ এরপর আমি যখন বললাম, অতদূর নয়, কাছাকাছি কোথাও যাব, তখন সোহম আর আগ্রহী হল না৷ সোহম ফোন করলে তুই একবার প্রস্তাবটা দে৷ তোর কথায় হয়তো সোহম রাজি হতে পারে৷’

চূর্ণী বলল, ‘ওর সঙ্গে আর এ ব্যাপারে কোনও কথা না বলে একটা কাজ করা যেতে পারে৷ পঁচিশ তারিখ সকালে তোর বাড়ি আমি পৌঁছে যাব, তারপর দু’জন মিলে সোহমকে গিয়ে ধরব৷ তখন হয়তো আর ও না করতে পারবে না৷ আগাম বললে হয়তো কোনও কাজের ছুতোতে পাশ কাটাবার চেষ্টা করবে৷’

মল্লার বলল, ‘বেশ তাই হবে৷’

মল্লার এরপর চূর্ণীকে গুড নাইট জানিয়ে লাইনটা কাটতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় চূর্ণী বলল, ‘দাঁড়া, লাইন ছাড়িস না৷ আর একটা ব্যাপার তোকে বলার আছে, বলতে ভুলেই যাচ্ছিলাম৷’

মল্লার বলল, ‘কী কথা?’

চূর্ণী এবার মৃদু উত্তেজিতভাবে বলল, ‘পরশু দিন বিকালে অফিস থেকে একটু আগে বেরিয়ে পঁচিশে ডিসেম্বরের জন্য কেক কিনতে গিয়েছিলাম নিউ মার্কেটে৷ একটা স্টলে দাঁড়িয়ে কেক বাছছি৷ চারপাশে বেশ ভিড়৷ সেই ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ দেখি একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ লোকটা কোট প্যান্ট পরা থাকলেও আমি চিনতে পেরেছি লোকটাকে৷ সেই খাস্তগীর৷ যাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল জলঙ্গীর ওখানে৷ আমরা কলকাতাতে ঢোকার মুখে যে আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল৷’

চূর্ণীর কথা শুনে মল্লারের মনে পড়ল এক সপ্তাহ আগে সোহমের বাড়ির গলিতে বাইকে লোকটাকে দেখার কথা৷ মল্লার চূর্ণীকে বলল, ‘তুই ঠিক দেখেছিস?’

আশঙ্কিত গলাতে চূর্ণী বলল, ‘একশো পার্সেন্ট ঠিক৷ আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই লোকটা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল৷ লোকটা আবার আমাকে ফলো করছে না তো?’

মল্লার বলল, ‘লোকটা আবার তোকে ফলো করতে যাবে কেন?’

চূর্ণী বলল, ‘আজকাল কিছুই বলা যায় না৷ অনেক ভদ্র-শিক্ষিত মানুষ বলে পরিচিত মানুষরাও অনেক সময় মেয়েদের ফলো করে৷ তারপর সুযোগ বুঝে বাজে প্রস্তাব দেয়৷’

ব্যাপারটা শুনে মল্লারের মনে প্রশ্নের উদয় হলেও চূর্ণী যাতে ভয় না পায় সেজন্য সে বলল, ‘তোর যত আজেবাজে ভাবনা৷ এই বড়দিনের সময় তোর মতো অনেক লোকই নিউ মার্কেটে কেক-পেস্ট্রি কিনতে যায়, তেমনই হয়তো লোকটাও গিয়েছিল৷’

‘তাই হবে হয়তো৷’—একথা বলে এরপর চূর্ণী ফোন ছেড়ে দিল৷

চূর্ণীর ফোন রাখার পর মল্লারের ভাবনাটা অনেকখানি সোহমের দিক থেকে সেই খাস্তগীরের দিকে ঘুরে গেল৷ ঘুমোবার আগে বিছানায় শুয়ে মল্লার ভাবতে লাগল, খাস্তগীরকে তারা নানান জায়গাতে বারবার দেখতে পাচ্ছে কেন? ব্যাপারটা কি কাকতালীয়? নাকি অন্য কোনও রহস্য আছে এর মধ্যে? তারা যেমন লোকটাকে দেখতে পেয়েছে, তেমন লোকটা কি একবারও তাদের খেয়াল করেনি? করলে তাদের এড়িয়ে যাচ্ছে কেন? এসব কথা ভাবতে ভাবতে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ল মল্লার৷

পরের দিনটা যেন ঝড়ের মতো কেটে গেল মল্লারের৷ অফিসে একটা কাজ থাকায় সকালে উঠে একটু আগেই সে অফিস পৌঁছেছিল৷ পাঁচটা পর্যন্ত টানা অফিসের কাজ৷ মাথা থেকে অন্য সব ভাবনা মল্লারের উড়ে গিয়েছিল৷

কাজ যখন শেষ হল তখন কয়েকজন অফিস কলিগ মিলে মল্লারকে ধরল পার্ক স্ট্রিটে খানা-পিনা করার জন্য৷ চব্বিশে ডিসেম্বর রাতে পার্ক স্ট্রিট বড় মোহময় হয়ে ওঠে৷ আলো নাচ-গান-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে পার্ক স্ট্রিটের হোটেল, অলিগলি রাজপথ৷ মন্দ লাগে না দেখতে৷ এর আগে মল্লার বেশ কয়েকবার উপভোগ করেছে রাতের পার্ক স্ট্রিট৷ কাজেই মল্লার রাজি হয়ে গেল কলিগদের প্রস্তাবে৷ অফিসের কাজ শেষ হওয়ার পর ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে অফিস কলিগদের সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটে হাজির হল মল্লার৷ তারপর একটা বার কাম রেস্টুরেন্টে রাত দশটা পর্যন্ত চলল তাদের পান-ভোজন৷

পার্ক স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে একজন কলিগকে তার বাড়িতে ড্রপ করে মল্লার যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত এগারোটা বাজে৷ সারাদিন বাইরে থাকায় ক্লান্ত লাগছিল তার৷ বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানায় শুয়ে পড়েছিল সে৷

সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ মল্লারের ঘুম ভাঙল৷ ফ্রেশ হয়ে চা বানিয়ে বসতে বসতে সাতটা বাজল৷ চায়ে চুমুক দিয়ে মল্লারের মনে পড়ল, আজ পঁচিশে ডিসেম্বর—বড়দিন৷ চূর্ণীর সকালবেলা তার বাড়ি আসার কথা। তারপর সোহমকে তুলে নিয়ে কাছে-পিঠে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা৷ চূর্ণী কখন আসবে তা জানার জন্য গতকাল মল্লারের একবার ফোন করার দরকার ছিল কিন্তু করা হয়নি৷ চূর্ণী কখন আসছে তা জানার জন্য মল্লার মোবাইলটা খুলতেই দেখল পাঁচটা মিসড কল অ্যালার্ট৷ রাত সাড়ে এগারোটার পর থেকে প্রায় একটা পর্যন্ত কিছু সময় পর পর তাকে কল করেছে চূর্ণী৷ মল্লার ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা৷ চূর্ণী কি আজ বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে কথা বলার জন্য ফোন করেছিল নাকি তার কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে? দ্বিতীয় দুশ্চিন্তাটা মাথায় আসতেই মল্লার কল ব্যাক করল চূর্ণীকে৷ মল্লারের কানে চূর্ণীর ফোন বাজার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মল্লারের বাড়ির দরজার বাইরেও একটা মোবাইল বাজতে শুরু করল! চেনা শব্দ৷ চূর্ণীর মোবাইলের রিংটোন! অর্থাৎ চূর্ণী এসে গিয়েছে৷

মল্লার দরজা খুলতেই ঝড়ের মতো ঘরে প্রবেশ করল চূর্ণী৷ উদভ্রান্ত চেহারা৷ সকালে উঠে তার মাথার চুলে চিরুনি পড়েনি৷ দেখে মনে হচ্ছে সে মুখেচোখে জলও দেয়নি৷ কাঁধে শুধু তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ব্যাগটা আর হাতে ধরা একটা খবরের কাগজ৷ চূর্ণীকে দেখে কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পেরে মল্লার বলল, ‘কী হয়েছে তোর? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

প্রশ্নের জবাবে চূর্ণী মল্লারকে চমকে দিয়ে বলল, ‘মনে হয় সোহম আর বেঁচে নেই৷’

‘বেঁচে নেই মানে! কী বলছিস তুই! এ খবর তুই জানলি কীভাবে?’—বিস্মিতভাবে বলে উঠল মল্লার৷

চূর্ণী কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আমার অনুমান সোহম আর আমাদের মধ্যে নেই৷ এখন আমি বাঁচব কীভাবে৷’

মল্লার বলল, ‘ব্যাপারটা আমাকে খুলে বল? শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে, কেউ চলে গিয়েছে বলা যায় নাকি? সময় নষ্ট না করে ব্যাপারটা বল৷’

চূর্ণী বলল, ‘কিছুদিন ধরে কলকাতায় একটা ঘটনা ঘটছে তুই জানিস? একজন অদ্ভুত লোক হানা দিচ্ছে নানা শ্মশানে? অনেকে বলছে সে নাকি কোনও প্রেতাত্মা! ব্যাপারটা নিয়ে নাকি বেশ হইচইও হচ্ছে! কিন্তু এসব ব্যাপার আমি কিছুই জানতাম না৷ কাল রাত দশটা নাগাদ একটা টেলিভিশন চ্যানেলে হঠাৎই দেখলাম দুটো শ্মশানের ভিডিও ছবি৷ আমি দেখেই চিনতে পেরেছি সে লোককে৷ ও হল সোহম!’

চূর্ণী ঝড়ের মতো একটানা কথাগুলো বলার পর মল্লার বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওই ভিডিও আমি দেখেছি৷ তোকে বলিনি তুই দেখলে ভয় পেতে পারিস বলে৷ ভিডিও দুটো দেখে আমার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল ওটা সোহম ছাড়া কেউ নয়৷ তাই সেদিন আমি সোহমের কাছে গিয়েছিলাম ব্যাপারটা সম্পর্কে জানতে৷ কিন্তু সোহম দৃঢ়ভাবে বলল ছবির লোক সে নয়৷’

চূর্ণী বলে উঠল, ‘না ওই হবে৷ নিশ্চয়ই ওটা ওর ছবি৷ আমরা দু’জন ওকে চিনতে পারব না? সোহম ছাড়া লোকটা অন্য কেউ নয়!’

মল্লার বলল, ‘ভিডিও-র লোকটা সোহম হলেও সে মারা গিয়েছে বলছিস কেন? লোকে ওকে ভূত বলছে বলে? নাকি ও শ্মশানে ঘুরছে বলে?’

চূর্ণী কাঁদতে কাঁদতে হাতের খবরের কাগজের ভাঁজ খুলতে খুলতে বলল, ‘সোহম কাল আমাকে ফোন করেনি৷ টিভিতে খবরটা দেখার পরই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল৷ তোকে অনেক বার ফোন করলাম, তুই ফোন ধরলি না৷ সারা রাত জেগেই কাটিয়েছি৷ ভোরবেলা খবরের কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে গেল৷ দেখ কী লিখেছে কাগজে! আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না!’ এ কথা বলে চূর্ণী খবরটা দেখিয়ে কাগজটা মল্লারের হাতে দিল৷

মল্লার এক নিশ্বাসে পড়ল খবরটা—

‘সন্দেহভাজন ব্যক্তির গঙ্গায় ঝাঁপ

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন শ্মশানে উপস্থিত হচ্ছে এক সন্দেহভাজন ব্যক্তি৷ ইতিপূর্বে কাশী মিত্র ও শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ মহাশ্মশানে সিসিটিভি ক্যামেরায় তার ছবি ধরা পড়েছে৷ এখনও পর্যন্ত সে কোনও অপরাধ সংগঠিত করেছে এমন অভিযোগ পুলিশের কাছে না এলেও মধ্যরাতে ওই শ্মশানচারীর ব্যাপার নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে চাঞ্চল্য ছড়ানোয় পুলিশ ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজখবর শুরু করে৷ এবার অকুস্থল নিমতলা মহাশ্মশান৷ রবিবার রাত আড়াইটে নাগাদ শ্মশানে টহলরত কলকাতা পুলিশের এক কনস্টেবল গঙ্গা সংলগ্ন ফেনসিং-এর কাছে এক আধো অন্ধকার জায়গাতে এক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন৷ সেই ব্যক্তির কাছে গিয়ে পুলিশকর্মী তাকে তার সঙ্গে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে যেতে বলে৷ লোকটি পুলিশকর্মীর কথা মতো তার সঙ্গে কিছুটা এগোবার পরই ফেনসিং-এর দিকে ছুটতে শুরু করে৷ তারপর ফেনসিং টপকে গঙ্গায় ঝাঁপ দেয়৷ সেই পুলিশকর্মী এরপর ফাঁড়িতে গিয়ে অন্য পুলিশকর্মীদের ডেকে এনে নদীর পাড়ে সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির সন্ধান চালালেও আর তার কোনও খোঁজ মেলেনি৷ পুলিশকর্মী ওই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির চেহারার যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে পুলিশের অনুমান অন্য দুই শ্মশানে যে রহস্যময় ব্যক্তির ছবি দেখা গিয়েছিল, জলে ঝাঁপ দেওয়া ব্যক্তিও সে-ই৷ কলকাতা পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ওই ব্যক্তির অনুসন্ধান করা হচ্ছে এবং রাতে প্রতিটি শ্মশানে নজরদারির ব্যবস্থা বাড়ানো হচ্ছে৷’

লেখাটি পড়ে মল্লার বলল, ‘কই এখানে তো কোথাও সোহমের মৃত্যু সংবাদ লেখা নেই?’

চূর্ণী ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘জলে ঝাঁপ দেওয়ার কথা তো লেখা আছে! সোহম তো সাঁতার জানে না৷ জানলে কি জলঙ্গী নদীর ঘটনাটা ঘটত? এবার নিশ্চয়ই আর ও বাঁচবে না৷ পুলিশের ভয়ে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেসে গিয়েছে৷ এখন আমি কোথায়, কার কাছে যাব৷ থানায়? হাসপাতালে? নাকি শ্মশানে?’

এবার মল্লারের বোধগম্য হল চূর্ণী কেন সোহমের মৃত্যুর আশঙ্কা করছে৷

মল্লার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘সময় নষ্ট না করে এখনই আমাদের সোহমের বাসায় যেতে হবে৷ সেখানে তার খোঁজ না মিললে তখন অন্য জায়গাতে যাওয়ার কথা ভাবা যাবে৷ আমি সঙ্গে আছি৷ তুই নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা কর৷’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন