হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
তাদের যখন ঘুম ভাঙল তখন প্রায় পাঁচটা বাজে৷ ঘুম থেকে ওঠার পর চূর্ণী বলল, ‘আর একটু পরই তো অন্ধকার নামবে। চল তার আগে জলঙ্গীর ধার থেকে একটু ঘুরে আসি।’
পোশাক বদলে যখন তারা তাদের ঘর থেকে বাইরে বেরোল তখন সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে৷ বাইরে বেরবার জন্য হাঁটতে হাঁটতে তারা দেখতে পেল ছেলেগুলো তাদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সার বেঁধে দাওয়াতে বসে আছে৷ চূর্ণী তাদের দেখে বলল, ‘ছেলেগুলোকে দেখলেই বড় মায়া জাগে৷ আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চাদের মতো তো এদেরও বাবা-মায়ের স্নেহ ভালোবাসা, ভালো খাওয়া-পরা, ভালো শিক্ষার অধিকার ছিল৷ কিন্তু ওরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত৷ আমার মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় ঈশ্বরের প্রতি৷ কেনইবা তিনি এসব শিশুদের পৃথিবীতে পাঠান! আর কেনইবা তারপরই তাদের থেকে সব কিছু কেড়ে নেন!’
মল্লার বলল, ‘সবাই তো আর আমাদের মতো সৌভাগ্যবান হয় না, শেষ পর্যন্ত জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পারে না৷ অনাথ বাচ্চাদের একটা বড় অংশ ভবিষ্যতে অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায়৷’
সোহম বলল, ‘যারা শিশুদের দিয়ে অপকর্ম করায় তাদের মতো ঘৃণ্য জীব মনে হয় পৃথিবীতে নেই৷ আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে সে সব লোকগুলোকে ধরার সঙ্গে-সঙ্গেই ফাঁসিতে লটকে দিতাম৷’
কথা বলতে বলতে এক সময় তারা নদীর দিকে বাইরে যাবার দরজার কাছে পৌঁছে গেল৷ ঠিক সেই সময় ঝাঁপ ঠেলে আশ্রমের ভিতর প্রবেশ করল বুনো৷
তার এক হাতে একটা ছিপ, আর অন্য হাতে একটা ব্যাগ৷ সে বামন মানুষ বলে ব্যাগটা প্রায় মাটিতে ঠেকে আছে৷ আর সেই ব্যাগের ভিতর থেকে একটা মাছের শরীরের লেজের দিকের অংশটা বাইরে বেরিয়ে আছে৷ মল্লারদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যাগটা দেখিয়ে সে দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘বিরাট বড় শোল৷ এইমাত্র নদী থেকে ধরলাম৷ যা টোপ দিয়েছিলাম তাতে জানতাম বড় শোল বা বোয়াল মাছ ধরা পড়বেই৷’
সোহম জিগ্যেস করল, ‘কীসের টোপ?’
বুনো বলল, ‘সে আছে বাবুরা৷ আপনারা জোগাড় করতে পারবেন না৷ কিনতে পাওয়া যায় না৷ তা আপনারা শোল মাছ খান তো? আমি একদম মাংসের মতো রেঁধে রাতে খাওয়াব৷ বাচ্চারাও শোল মাছ খেতে বেশ পছন্দ করে৷’
মল্লার বলল, ‘হ্যাঁ, খাই৷ তার ওপর এমন টাটকা মাছ৷ নিশ্চয় খাব৷’
বুনো তার কথা শুনে হেসে তাদের পাশ কাটিয়ে ছিপ আর মাছ নিয়ে এগলো৷ আর তারা তিনজনও বাইরে বেরিয়ে পড়ল৷
মল্লাররা গিয়ে দাঁড়াল জলঙ্গীর পাড়ে৷ সূর্য প্রায় ডুবে গেছে৷ আরও গাঢ় হতে শুরু করেছে নদীর জল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারে মুছে যাবে চরাচর৷ কুয়াশায় ঢেকে যাবে চারপাশ৷ তারা তিনজন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল৷ হঠাৎ চূর্ণী বলল, ‘আরে! ওই দ্যাখ একটা পদ্ম ফুল!’
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মল্লার আর সোহম দেখল তারা যেখানে দাঁড়িয়ে তার কিছুটা তফাতে পাড় থেকে কয়েক হাত দূরে সত্যি একটা বেশ বড় পদ্ম জলের বুক থেকে মাথা তুলে আছে! তারা শহরের মানুষ৷ এর আগে কোনও দিন জলের বুকে এ ভাবে পদ্ম ফুটে থাকতে দেখেনি৷ চূর্ণী বলল, ‘ফুলটার একটা ভালো করে ছবি তুলতে পারিস কিনা দেখ? ফেসবুকে ডেস্ক পিকচার বানাব৷’
চূর্ণীর কথা শুনে সোহম পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করে পাড় ঘেঁষে এগল ফুলের ছবি তোলার জন্য৷ আলো প্রায় মরে এসেছে৷ সোহম সেখানে গিয়ে দাঁড়াল যেখান থেকে জমিটা ঢালু হয়ে হাত পাঁচেক নীচে জলে গিয়ে মিশেছে৷ বয়ে চলেছে জল৷ আর জল যেখানে মাটি ছুঁয়েছে তার কিছুটা তফাতে ফুটে আছে পদ্মটা৷
সোহম প্রথমে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার ফুলের ছবি তোলার চেষ্টা করল৷ কিন্তু আলো কমে আসায় ভালো ছবি আসছে না৷ মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটও পদ্মটা অব্দি পৌঁছেবে না৷ সোহম তাই জলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য ঢাল বেয়ে কিনারায় দাঁড়াবার জন্য পা বাড়াল৷ কিন্তু দু-পা এগতেই সে আর ব্যালেন্স রাখতে না পেরে সোজা ছিটকে পড়ল জলঙ্গীর জলে৷ চূর্ণী চিৎকার করে উঠল৷
সোহম জলে পড়ে যাওয়াতে মল্লারও তাড়াতাড়ি সেই ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নামতে লাগল সোহমকে হাত ধরে টেনে তোলার জন্য৷ মল্লারের ধারণা ছিল যে পাড়ের গভীরতা খুব বেশি হবে না৷ জল থেকে উঠে দাঁড়াতে পারবে সোহম৷ তার ভাবনা মতোই কোমর সমান জল থেকে একবার সে উঠে দাঁড়িয়ে পাড়ের দিকে এগবারও চেষ্টা করল৷ জমির সঙ্গে তার ব্যবধান মাত্র পাঁচ-সাত হাতের৷ মল্লারও এখন নীচে নেমে নদীর কিনারে পৌঁছে গেছে হাত বাড়িয়ে জল থেকে সোহমকে ওঠাবার জন্য৷ কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এগবার চেষ্টা করলেও সে যেন সামনের বদলে ক্রমশ পিছনে পিছলে যেতে লাগল৷
কোমর ছাপিয়ে তার বুকের দিকে উঠতে শুরু করল জল৷ চূর্ণী চিৎকার করে চলেছে৷ সোহমও এরপর আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, ‘আমাকে বাঁচা, আমাকে বাঁচা৷ চোরা স্রোতে পড়ে গেছি৷ জল আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ বাঁচা আমাকে!’
কিন্তু সোহমের মতোই মল্লার বা চূর্ণী কেউই সাঁতার জানে না৷ জলে নামলে তারাও তলিয়ে যেতে পারে৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জলের কিনারায় দাঁড়িয়ে মল্লার৷ জলে নামতে সাহস পাচ্ছে না সে৷ চূর্ণী চিৎকার করে চলেছে, ‘কে আছ, বাঁচাও’ বলে৷ ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে সোহম৷ একসময় তার বুক ছাপিয়ে গলা পর্যন্ত পৌঁছে গেল জল৷ স্রোত তাকে পাড় থেকে আরও দূরে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে! চূর্ণী যখন বুঝতে পারল তার বা মল্লারের পক্ষে সোহমকে বাঁচানো সম্ভব নয় তখন সে চিৎকার করতে করতে নদীর পাড় ছেড়ে ছুটল আশ্রমের দিকে তমসাময়েদের ডাকার জন্য৷ আর মল্লার নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে অসহায় ভাবে দেখত লাগল জলঙ্গীর কালো জল ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে সোহমকে৷ চারপাশে নেমে আসছে অন্ধকার! বাঁচবার জন্য শেষ একবার চিৎকার করে উঠল সোহম৷ তার হাত দুটো জলের উপর উঠে কোনও কিছুকে আঁকড়ে ধরার জন্য নিষ্ফল চেষ্টা করল৷ আর তারপরই মল্লারের চোখের সামনে জলঙ্গীর জলে হারিয়ে গেল সোহম৷
তাদের চিৎকারের শব্দ শুনে তমসাময় আর বুনোও আশ্রম থেকে নদীর দিকে আসছিলেন৷ তাই চূর্ণীর সঙ্গে দেখা হতে তাদের বেশি সময় লাগল না৷ চূর্ণীর সঙ্গে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা দু’জন ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল নদীর পাড়ে৷ মল্লার তখন আধো-অন্ধকারে একলা দাঁড়িয়ে আছে নদীর কিনারে৷ জলের দিকে তাকিয়ে সোহমের কোনও চিহ্ন না দেখতে পেয়ে চূর্ণী ব্যাপারটা অনুমান করে তীব্র চিৎকার করে উঠল, ‘সোহম কোথায় গেল!’
বাকরুদ্ধ মল্লার আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল কোথায় ডুবে গেছে সোহম!’
চূর্ণী আর্তনাদ করে উঠেই প্রচণ্ড আতঙ্কে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল৷ কিন্তু মল্লার আঙুল তুলে জায়গাটা দেখাবার সঙ্গে সঙ্গেই তমসাময় পাড় থেকে ঝাঁপ দিলেন জলঙ্গীর কালো জলে৷ তারপর ঝাঁপ দিল বুনোও৷ জল তোলপাড় করে তারা প্রায় অন্ধকারের মধ্যেই অনুসন্ধান চালাতে লাগল সোহমের৷ এবার মল্লার কিছুটা সংবিত ফিরে পেল৷ পাড়ে দাঁড়িয়ে তমসাময় আর বুনোকে সঠিক জায়গাটা বোঝাবার জন্য চিৎকার করতে লাগল, ‘আর একটু এগিয়ে! না না, ডান দিকে নয়, বাঁ-দিকে৷’
তমসাময় আর তার সঙ্গী কখনও ডুব সাঁতার দিতে দিতে, কখনও বা মাথা তুলে চারদিক দেখতে দেখতে অনুসন্ধান করতে লাগল সোহমের৷ জলে নামার মিনিট তিনেক পর হঠাৎ বুনো চিৎকার করে উঠল ‘এই যে এখানে! পেয়েছি!’
তার চিৎকার শুনে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে গেলেন তমসাময়৷ তারপর তারা দু’জন জলে ডুব দিয়ে জলের নীচ থেকে সোহমের শরীরটা টেনে তুলে তাকে নিয়ে সাঁতরে পাড়ের দিকে আসতে লাগলেন৷ জলের কিনারেই দাঁড়িয়ে ছিল মল্লার৷ তমসাময় আর বুনো সোহমের এলিয়ে পড়া শরীরটা শুকনো জমিতে টেনে ওঠালেন৷ এরপর তিনজনে মিলে সোহমকে ঢাল বেয়ে উপরে উঠিয়ে নিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিল৷ বুনো মাটিতে শুয়ে থাকা সোহমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাগ্গিস দেহটা জলের নীচে ঝাঁঝি গাছে আটকে গিয়েছিল তাই নদীর স্রোত বেশি দূর টেনে নিয়ে যেতে পারেনি৷’
সোহমকে উপরে তুলে আনতেই চূর্ণী ছুটে এল৷ মল্লার উবু হয়ে বসে ডাকতে লাগল ‘সোহম, সোহম’ বলে, কিন্তু সোহম চোখ মেলল না৷ মল্লার হাত রাখল সোহমের ভেজা বুকে৷ কিন্তু কোনও ধুকপুকানি নেই! সোহমের নাকের কাছে হাত রেখেও মল্লার কোনও নিঃশ্বাসের সাড়া পেল না৷
নিঃশব্দ সোহমের দেহ৷ মল্লার হিসাব করে দেখলে অন্তত সাত-আট মিনিট জলের নীচে ছিল সোহমের শরীর! শ্বাস না নিয়ে জলের তলায় অতক্ষণ কী কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব!’
সামান্য সময়ের মধ্যে তাদের চোখের সামনে কী ঘটে গেল তা আন্দাজ করে মল্লারের শরীরও অবশ হয়ে আসতে লাগল৷ চূর্ণী চিৎকার করে মল্লারকে বলল, ‘সোহম কি অজ্ঞান হয়ে গেছে? ও সাড়া দিচ্ছে না কেন?’
এ প্রশ্নর উত্তর দেবার ক্ষমতা তখন আর মল্লারের নেই৷ তমসাময় আর বুনোও নিশ্চুপ৷ মল্লারের মনে হল জল থেকে সোহমকে তোলার সময়ই আসল ব্যাপারটা তমসাময় আর বুনো বুঝতে পেরেছে৷ তাদের সবাইকে চুপ থাকতে দেখে চূর্ণী আবারও চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘তোরা কেউ কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে সোহমের? ওর কিছু হয়ে থাকলে আমিও আর এখান থেকে ফিরব না৷ আমিও জলে ঝাঁপ দেব৷’
চূর্ণীর মুখের ওপর সত্যি কথাটা জানাবার শক্তি মল্লার সেই মুহূর্তে অর্জন করতে না পারলেও পাছে চূর্ণী এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে কোনও অঘটন ঘটিয়ে ফেলে, সেই ভয়ে মল্লার উঠে দাঁড়িয়ে চূর্ণীর একটা হাত চেপে ধরল৷
চূর্ণী, মাটিতে পড়ে থাকা সোহমের দিকে তাকিয়ে উন্মাদের মতো বলতে লাগলে, ‘না, ওর কোনও কিছু হতে পারে না৷ নিশ্চয়ই ওর জ্ঞান ফিরবে৷ ওকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে চল৷’
চূর্ণীর কথা শুনে মল্লারের মনে হল, ‘এমনও তো হতে পারে সোহম সত্যিই অজ্ঞান অবস্থায় আছে৷ তারা তো ডাক্তার নয় যে নিশ্চিতভাবে বলতে পারে যে সোহমের মৃত্যু হয়েছে? হয়তো এখনই হাসপাতালে নিয়ে গেলে সোহম সেখানে চোখ মেলতে পারে? তার অনুমান মিথ্যা?—এ কথাটা মাথায় আসতেই সে তমসাময়কে বলল, ‘ওকে ধরাধরি করে ভিতরে নিয়ে যাই চলুন৷ এখনই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷’
তার কথার কোনও জবাব না দিয়ে তমসাময় চেয়ে রইলেন মাটিতে পড়ে থাকা সোহমের দিকে। মল্লার উত্তর না পেয়ে বলল, ‘চলুন ওঠাই ওকে৷ সময় নষ্ট করবেন না৷ হয়তো হাসপাতালে গেলে ও বেঁচে যাবে’—এই বলে সে চূর্ণীর হাত ছেড়ে দিয়ে সোহমকে নিজেই তোলার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল কিন্তু তমসাময় বললেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে গেলে কোনও লাভ হবে না৷ তবে…৷’
‘তবে কী?’ জানতে চাইল মল্লার৷
তমসাময় বললেন, ‘তবে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি ওনাকে বাঁচিয়ে তোলা যায় কি না?’
মল্লার বলে উঠল, ‘আপনি তো ডাক্তার নন, আপনি ওকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবেন?’
তমসাময় বললেন, ‘চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? এটুকু বলতে পারি, আমি যদি ওনাকে বাঁচিয়ে তুলতে না পারি তবে ডাক্তারবাবুরাও ওনার জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে না৷ তবে সময় নষ্ট করলে চলবে না৷ আমাকেও সে চেষ্টা করতে হলে এখনই করতে হবে৷’
তমসাময় বেশ দৃঢ়ভাবেই যেন কথাগুলো বললেন৷’
চূর্ণী বলে উঠল, ‘যা হয় তোরা কিছু একটা কর৷ যে ওকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবে সে আমার কাছে যা চাইবে তাকে তাই দেব আমি৷ প্লিজ কিছু একটা করুন আপনারা৷ আমি ওকে এভাবে আর পড়ে থাকতে দেখতে পারছি না৷’
তমসাময়, মল্লারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী করবেন, তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিন৷ প্রতি মূহূর্তে সময় এখন দামি৷ আমার এখানে এসে আপনাদের এসব দুর্ঘটনা ঘটবে আমি ভাবতে পারিনি৷ আমারও একটা দায়িত্ব আছে ওনাকে বাঁচিয়ে তোলার৷ আমাকে একটা চেষ্টা করতে দিন৷’
মল্লার কোথায় যেন শুনেছিল যে, রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য সাধু-সন্ন্যাসীদের অনেক টোটকা জানা থাকে৷ হয়তো তেমনই কোনও টোটকার সাহায্যে তমসাময় সোহমের জ্ঞান ফিরিয়ে দেবেন৷ তমসাময় তো বলেই ছিলেন যে ওই নবজীবন নামের ছেলেটাকে মৃত্যুর মুখ থেকে তিনি ফিরিয়ে এনেছিলেন। তমসাময়ের কথার মধ্যে এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, যাকে অগ্রাহ্য করতে না পেরে মল্লার শেষ পর্যন্ত তমসাময়কে বলল, ‘ঠিক আছে আপনি চেষ্টা করুন৷ যে ভাবেই হোক বাঁচিয়ে তুলতে হবে ওকে৷’ তমসাময় বলল, ‘তাহলে আর দেরি করা যাবে না৷ এখনই ওনাকে তুলে নিয়ে আশ্রমের ভিতর কালো কুঁড়েটাতে নিয়ে যেতে হবে৷’
এরপর কেউ আর কালবিলম্ব না করে ধরাধরি করে সোহমের হিমশীতল দেহটা মাটির থেকে তুলে নিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করে দ্রুত এগলো সেই কালো ঘরটার দিকে৷ সদ্য নেমে আসা অন্ধকারের মধ্যে চূর্ণীও তাদের সঙ্গে ছুটল সেই ঘরের দিকে৷ তমসাময় যেতে যেতে বেশ কিছু নির্দেশ দিলেন বুনোকে৷ তার কিছু কথা মল্লারের বোধগম্য হল, কিছু হল না৷ তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, যে ভাবে হোক জ্ঞান ফেরাতে হবে, বাঁচিয়ে তুলতে হবে সোহমকে৷
সে ঘরের সামনে পৌঁছে অন্ধকারের মধ্যে মাটিতে শোয়ানো হল সোহমকে৷ বুনো তারপর ছুটে গিয়ে সে ঘরের দরজার চাবি আর একটা জ্বলন্ত লণ্ঠন নিয়ে হাজির হল৷ তমসাময় তালা খুললেন দরজার৷ ঘরের ভিতর খেলা করছে জমাট বাঁধা অন্ধকার৷ বুনো লণ্ঠনটা ঝুলিয়ে দিল ফণিমনসা গাছটার গায়ে৷ মল্লার আর চূর্ণীর এখন আর কারওরই খেয়াল হল না যে ওই গাছটাতেই সাপ দেখে ও জায়গা ছেড়ে পালিয়ে ছিল তারা৷ একটা ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা তাকিয়ে আছে সোহমের দিকে৷ দরজা খোলার পর তমসাময় মল্লারদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনাদের এ ঘরে ঢোকার দরকার নেই৷ আমিই ওনাকে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছি৷ আমার বেশ কিছুটা সময় লাগবে৷ এ সময়ের মধ্যে আপনারা আমাকে ডাকবেন না৷ ডাকলে আমার কাজের ক্ষতি হতে পারে৷ আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে আমার কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন, আবার ঘরে ফিরেও অপেক্ষা করতে পারেন৷’
তমসাময়ের কথা শুনে চূর্ণী কান্না ভেজা গলায় বলে উঠল, ‘না, আমরা এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব৷ কোনও বিরক্ত করব না আপনাকে৷ আপনি যে ভাবেই হোক ওর জ্ঞান ফিরিয়ে দিন৷’
তমসাময় বললেন, ‘সে চেষ্টা আমি আপ্রাণ করব৷’
তমসাময় এবার ঝুঁকে পড়ে একলাই পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন সোহমের শরীরটা৷ তা দেখে মল্লার বুঝতে পারল এ বয়সেও যথেষ্ট শক্তি ধরেন তমসাময়! সোহমের দেহটা তুলে নিয়ে শনের ছাউনি দেওয়া সেই বেড়ার ঘরের মধ্যে তিনি ঢুকে গেলেন৷
এরপর ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি৷ বাইরে দাঁড়িয়ে রইল মল্লারেরা৷ একটু পর মল্লারের মনে হল তমসাময় সম্ভবত ঘরের ভিতর একটা বাতি জ্বালিয়েছেন৷ বেড়ার দেওয়াল আর দরজার মধ্যে যে এক চিলতে ফাঁক আছে তা দিয়ে যেন ঘরের ভিতর আবছা একটা আলো দেখা যাচ্ছে৷ বুনো মল্লারকে বলল, ‘আপনারা এখানে থাকুন৷ আমি কিছু জিনিস নিয়ে ফিরে আসছি৷’
সে জায়গাতেই মল্লার আর চূর্ণী দাঁড়িয়ে রইল ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে৷ আর বুনো চলে গেলে তার জিনিস আনতে৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য আবার বুনো ফিরে এল সেখানে৷ তার এক কাঁধে ধরা বেশ কয়েকটা কাঠের টুকরো৷ শ্মশান থেকে আনা সেই চিতা কাঠের টুকরো৷ আর অন্য হাতে সেই ব্যাগটা যার মধ্যে নদী থেকে ধরা শোল মাছটা রয়েছে৷
ঘরের সামনে একপাশে মাটিতে কাঠগুলো রেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিল বুনো৷ তারপর ব্যাগ থেকে সে শোল মাছটা বের করল৷ মাছটা তখনও জ্যান্ত৷ নড়ে উঠল মাছটা৷ বুনো বেশ কয়েবার মাছটার লেজ ধরে তার মাথাটা বাড়ি দিল মাটিতে৷ স্থির হয়ে গেল মাছটা৷ মল্লার বুঝে উঠতে পারল না, এই অবস্থাতে বুনো এখানে রান্নার আয়োজন করতে বসছে কেন?
না, ঠিক রান্না নয়, চিতা কাঠের আগুন একটু ভালো করে জ্বলে উঠতেই সে মাছটাকে আগুনের মধ্যে ফেলে দিল৷ পুড়তে শুরু করল শোল মাছটা৷ ধীরে ধীরে মাছ পোড়ার কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারপাশে৷ বিশ্রী গন্ধ!
হঠাৎ তার পাশে একটা শব্দ শুনে মল্লার দেখল নবজীবন নামের ছেলেটা আর একটা ছেলেকে নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছে৷ তার দৃষ্টি আগুনে পুড়তে থাকা মাছটার দিকে নিবদ্ধ৷ এরপর সঞ্জীবন সহ একে একে সব ছেলেগুলোই সেখানে এসে হাজির হল৷ একপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে তারা মাছ পোড়ানো দেখতে লাগল৷ মল্লারের কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না৷ মনে মনে শুধু সে একটাই প্রার্থনা করতে লাগল—সোহমের যেন জ্ঞান ফিরে আসে৷ আর চূর্ণীর যেন চারপাশে কী ঘটছে সে ব্যাপারে কোনও খেয়ালই নেই, বোবা জ্ঞান শূন্য অবস্থায় পাথরের মূর্তির মতো সে তাকিয়ে আছে কুঁড়ে ঘরের বন্ধ দরজার দিকে৷
মাছ পোড়ানো হয়ে গেল এক সময়৷ পোড়া মাছটা আগুন থেকে উঠিয়ে নিয়ে বুনো দরজার সামনে গিয়ে দরজার গায়ে মৃদু টোকা দিল৷ দরজার ঝাঁপ অল্প ফাঁক হল৷ বেরিয়ে এল তমসাময়ের হাত৷ বুনোর হাত থেকে মাছটা নিয়েই সে হাত আবার অদৃশ্য হয়ে গেল৷ বন্ধ হয়ে গেল দরজা৷
অন্ধকার কেটে গিয়ে জলঙ্গীর মাথায় এক সময় চাঁদ উঠতে শুরু করল৷ চাঁদের দিকে মুখ তুলে নদীর পাড় থেকে ডেকে উঠল শিয়ালের দল৷ যেন রাত্রিকে স্বাগত জানাল রাত্রির সন্তানরা৷ শিয়ালের ডাক থেমে যাবার পর বন্ধ কুঁড়ের ভিতর থেকে ভেসে আসতে লাগল তমসাময়ের কণ্ঠস্বর৷ মল্লার বুঝতে পারল তমসাময় মন্ত্রপাঠ শুরু করেছেন! কখনও বেশ উচ্চগ্রামে আবার চাপা গলাতে কী সব যেন বলে চলতে লাগলেন তমসাময়৷ বাচ্চা ছেলেগুলোও নিশ্চুপভাবে তাকিয়ে আছে ঘরের দিকে৷ আলো-আঁধারিতে তাদের অবয়বগুলো কেমন যেন ভৌতিক লাগছে দেখতে৷ সময় এগিয়ে চলল৷
বেশ অনেকক্ষণ ধরে তমসাময়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসার পর এক সময় তা থেমে গেল৷
চারপাশে নেমে এল এক অসীম, অসহনীয় নিস্তব্ধতা!
চূর্ণীর মধ্যে এবার চঞ্চলতা শুরু হল৷ সে যেন আর ধৈর্য রাখতে পারছে না৷ দরজার দিকে তাকিয়ে ছটফট করতে লাগল সে৷ মল্লারেরও প্রায় একই রকম অবস্থা৷ এমনকী বুনোর চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ। সবাই জানতে আগ্রহী তমসাময়, সোহমের জ্ঞান ফেরাতে সক্ষম হলেন কি না?
আর এরপর দরজা খুলে গেল। চাঁদের আলোতে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন তমসাময়। কিন্তু এভাবে তাকে আগে কখনও দেখেনি মল্লাররা। তমসাময়ের পরনে রুদ্রাক্ষের মালা। সারা কপালে সিঁদুর লেপা! প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে মল্লার আর চূর্ণী তাকাল তাঁর দিকে৷ চূর্ণী তাকে কিছু বলার আগেই তমসাময়ের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল৷ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি পেরেছি৷ আসুন, ভিতরে আসুন আপনারা৷’ কথাটা শুনেই লাফিয়ে উঠল চূর্ণী৷ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তমসাময়ের সঙ্গে মল্লার প্রায় হুড়মুড় করেই কুঁড়ের ভিতর প্রবেশ করল৷ বেশ বড় একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে ঘরে৷ ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে মাটির তৈরি পুরোনো হাঁড়ি, কলসি, সরা এসব৷ আর ঘরের ঠিক মাঝখানে সিঁদুর লেপা একটা মাটির বেদী৷ তার ওপর শুয়ে আছে সোহম৷ তমসাময়ের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে চূর্ণী প্রায় হুমড়ি খেয়ে দাঁড়াল বেদীর সামনে৷ সোহমের দেহ সম্পূর্ণ নিরাবরণ৷ শুধু একটুকরো লাল বস্ত্রখণ্ড চাপা দেওয়া আছে তার লজ্জা নিবারণের জন্য৷ সারা গায়ে তার ঘি আর তিল মাখানো৷ তার শরীরের এক পাশে ছোট ছোট মাটির সরাতে সাজানো আছে খণ্ড খণ্ড পোড়া শোল মাছ৷ ঘি আর পোড়া শোল মাছের গন্ধ মিলে মিশে একটা অদ্ভুত গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে ঘরের ভিতর৷ মল্লার খেয়াল করে দেখল সোহমের চোখ বন্ধ থাকলেও তার বুক ওঠা নামা করছে! শ্বাস নিচ্ছে সোহম!
আর এরপরই সোহমের শরীরটা একবার কেঁপে উঠল৷ সোহম চোখ মেলে বলে উঠল, ‘খুব শীত করছে আমার৷ আমি কোথায়?’
চূর্ণী আনন্দ উচ্ছাসে বলে উঠল, ‘তুই ঠিক হয়ে গেছিস সোহম৷ এই তো আমরা সবাই আছি তোর সঙ্গেই। এটা আশ্রম৷’
সোহম ধীরে ধীরে উঠে বসতেই চূর্ণী তাকে বিহ্বলভাবে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল, কিন্তু তমসাময় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দাঁড়ান৷ উনি এখন খুব দুর্বল৷ ওনাকে খাওয়াবার ব্যবস্থা করি৷’
সোহম উঠে বসে একটু ঘোলাটে চোখে নিজের শরীর আর চারপাশে তাকিয়ে বলল, ‘আমার এ অবস্থা কেন? আমার কী হয়েছিল?’
মল্লার বলে উঠল, ‘পদ্ম ফুলের ছবি তুলতে গিয়ে তুই জলে পড়ে গেছিলি৷ তমসাময়বাবু তোকে জল থেকে উদ্ধার করেন৷ অনেকক্ষণ তুই অজ্ঞান হয়েছিলি৷ উনিই জ্ঞান ফেরালেন৷ আর কোনও চিন্তা নেই৷’
কথাটা শুনে সোহম বিড় বিড় করে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার এবার মনে পড়েছে৷ জলে ডুবে গেছিলাম আমি৷’
একথা বলে সে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল রক্তাম্বর পরিহিত তমসাময়ের দিকে৷ কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল তার চোখে৷
সোহম এরপর কিছুটা শিশুর মতোই বলল, ‘খুব দুর্বল লাগছে আমার৷ খুব খিদে পাচ্ছে৷ তমসাময় মৃদু হেসে বললেন, ‘জানি খিদে পাচ্ছে৷ খাবারের ব্যবস্থা আছে৷ এ কথা বলে তিনি বেশ বড় এক খণ্ড পোড়া মাছ রাখা মাটির সরা বাড়িয়ে দিলেন সোহমের দিকে৷ সেটা দেখে কিন্তু নাক সিটকালো না সোহম৷ মল্লারদের কিছুটা অবাক করে দিয়েই পোড়া মাছটা সরা থেকে তুলে নিয়ে বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে সে খেতে লাগল৷ ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগল তার চোখ মুখ৷ খাওয়া শেষ হতে সে একটা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলল৷
আর এরপরই সম্ভবত তার লজ্জাবোধ হল৷ মল্লারকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি আমার জামা-প্যান্ট দে৷’ ঘরের এক কোণে স্তূপাকৃত অবস্থায় পড়ে ছিল সোহমের ভিজে জামা-প্যান্ট, জ্যাকেট৷ নিজেদের ঘরে ফেরার আগে আপাতত সেগুলোই পরতে হবে তাকে৷ মল্লার সেগুলো তুলে আনল, বেদী থেকে নেমে মল্লার আর চূর্ণীর সাহয্যে জামা কাপড়গুলো কোনওরকমে পরে নিল সোহম৷ তার সামনে দাঁড়িয়ে তমসাময়৷ তার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ চিত্তে সোহম বলল, ‘আমার জীবন ফিরিয়ে দিলেন আপনি৷ সত্যি আপনি জীবনবাবা৷ আমি সে নামেই ডাকব আপনাকে৷’
প্রদীপের আলোতে হাসি ফুটে উঠল জীবনবাবার মুখে৷ তিনি বললেন সবই আমার গুরুদেবের আশীর্বাদ আর আপনার ভাগ্য৷ আর বুনোও কিন্তু কৃতিত্বের দাবিদার৷ ভাগ্যিস সে শোল মাছটা ধরেছিল৷ আপনার জ্ঞান ফেরার পিছনে ওই পোড়া শোল মাছই প্রধান উপকরণ৷’
পোড়া শোল মাছ কীভাবে সোহমের জ্ঞান ফেরাল, তার কটু গন্ধ স্মেলিং সল্টের কাজ করে কি না তা জানার আগ্রহ থাকলেও মল্লার এ ব্যাপারে জানতে চাইল না তমসাময়ের কাছে৷ হয়তো ব্যাপারটা তমসাময়ের গুরুর গোপন শিক্ষা৷ প্রশ্ন করলে তমসাময় বিব্রত বোধ করতে পারেন৷ তিনি সোহমের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন সেটাই বড় কথা৷ কীভাবে ফেরালেন সেটা আর এখন সোহমদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়৷
চূর্ণী, তমসাময়কে বলল, ‘আপনার ঋণ কোনওদিন শোধ করতে পারব না৷ তবুও বলুন, যদি কিছু নেন আপনি?’
তমসাময় মৃদু হেসে বললেন, ‘গুরুদেব আমাকে তন্ত্রর যে সব শিক্ষা দিয়েছেন তা প্রয়োগ করার বিনিময় কোনও কিছু গ্রহণ করি না আমি৷ করলে আমি গুরুদেবের শিক্ষা থেকে, আমার সাধনা থেকে পথভ্রষ্ট হব৷ আমার সব শিক্ষা হারিয়ে যাবে৷ উনি নবজীবন পেয়েছেন এটাই বড় ব্যাপার৷ এটাই আমার তৃপ্তি৷ আমার আনন্দ৷ টাকা নিলে কি সে আনন্দ থাকবে?’
তাঁর কথা শুনে ঘরের বাইরে পা বাড়াতে গিয়েও হঠাৎ দরজায় মাথার ওপর চালের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মল্লার৷ ছাদের বাঁশের কাঠামোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই সাপটা৷ মাথাটা একটু নীচে ঝুলিয়ে তাদের দিকেই দেখছে সে! মল্লারের দাঁড়িয়ে পড়ার কারণ বুঝতে পেরে তমসাময় হেসে বলল, ‘ভয় নেই৷ ও কিছু করবে না৷ বললাম না ও বাস্তু সাপ৷’
তমসাময়ের কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে সোহম আর চূর্ণীকে নিয়ে সাপটার নীচ দিয়েই দরজার বাইরে বেরিয়ে পড়ল মল্লার৷ কিছুটা তফাতে বাচ্চা ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের মুখমণ্ডলে হাসি ফুটে উঠল সোহমকে দেখে৷ মল্লারের মনে হল বাচ্চাগুলো যেন অনুমান করতে পেরেছে সোহম নবজীবন লাভ করেছে৷ হয়তো বা বুনোই তাদের বলেছে দুর্ঘটনার কথা৷ বাচ্চাগুলোকে দেখে সোহম তাদের দিকে এগতেই নবজীবন আর সঞ্জীবন এগিয়ে এসে সোহমকে আনন্দে জড়িয়ে ধরল৷ কিছুক্ষণ বাচ্চাগুলোর গায়ে মাথায় সোহম প্রবল মমতায় হাত বোলানোর পর মল্লার আর চূর্ণীদের সঙ্গে ঘরে ফেরার পথ ধরল৷ বেশ স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সে বলল, ‘আমার মোবাইল ফোনটা কিন্তু জলে পড়ে গেছে৷’
চূর্ণী বলল, ‘গেছে যাক৷ তুই যে বেঁচে ফিরলি এটাই বড় কথা৷ সত্যি বলছি আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম জল থেকে যখন তোকে অজ্ঞান অবস্থায় তোলা হল তখন তোকে দেখে৷ তমসাময়ই তোর প্রাণ বাঁচালেন৷’
মল্লার বলল, ‘টাকাটা কিন্তু এই আশ্রমকেই দিয়ে যাওয়া উচিত৷’
কথাটা শুনে চূর্ণী বলে উঠল, ‘তমসাময় আজ যা করলেন তাতে আর টাকা না দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না৷ ভদ্রলোক সৎ, ছেলেগুলো অন্তপ্রাণ৷ আমাদের জমানো টাকার সঠিক ব্যবহার করবেন উনি৷’
সোহমও সম্মতি প্রকাশ করল অন্য দু’জনের কথাতে৷
ঘরে ফিরে এল তারা৷ সোহম শরীর পরিষ্কার করে পোশাক পাল্টে নিল৷ এরপর সে বলল, ‘মাছটা খাবার পর আমার আর রাতের কিছু খাবার ইচ্ছা নেই৷ খুব ক্লান্ত লাগছে৷ আমি শুয়ে পড়ছি৷’
মল্লাররা তাকে বাধা দিল না৷ চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল সোহম৷
অন্যরাতের তুলনায় কিছুটা বেশি রাতেই এদিন খাবার নিয়ে এল বুনো৷ ভাত, ডাল আর সব্জি৷ স্বাভাবিক কারণেই শোল মাছ আর মল্লারদের রেঁধে খাওয়ানো সম্ভব হল না তার পক্ষে৷ বুনো চলে যাবার পর মল্লার আর চূর্ণী খাওয়া সেরে নিল৷ এতটা উত্তেজনা সহ্য করার জন্য তাদের দু’জনের শরীরেও ক্লান্তি নেমে এসেছে৷ চূর্ণী খাওয়া সেরে তার ঘরে চলে গেল ঘুমবার জন্য৷ পরদিন সকালে তাদের কলকাতা ফেরার কথা৷ মল্লার নিজের আর সোহমের জামা কাপড় গুছিয়ে নিল৷ তারপ কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল৷
প্রায় ঘণ্টা তিনেক বাদে হঠাৎই একটা অস্পষ্ট শব্দ পেয়ে মল্লারের ঘুম ভেঙে গেল৷ সে দেখতে পেল সোহম দরজা খুলে বাইরে বেরচ্ছে৷ এত রাতে কোথায় যাচ্ছে সোহম৷ ঘরের পিছনে বাথরুম করতে নাকি? সোহমের শরীরটা দুর্বল আছে ভেবে মল্লার তার পিছনে যাবার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল৷ মল্লার যখন ঘরের বাইরে দরজায় এসে দাঁড়াল তখন দাওয়া থেকে নীচে নেমে পড়েছে সোহম৷ কিন্তু সে নীচে নেমে দ্রুত হাঁটতে লাগল৷ যেন সে নদীর দিকে যাবে বলে হাঁটতে শুরু করেছে৷ কোথায় যাচ্ছে সোহম? তাকে ওভাবে হাঁটতে দেখে মল্লারও সঙ্গে সঙ্গে দাওয়া থেকে নেমে পড়ল৷ সোহম এখন বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গেছে৷ মল্লার দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পৌঁছে গেল সোহমের কাছে৷ তারপর তাকে প্রশ্ন করল, ‘কীরে, কোথায় যাচ্ছিস?’
সোহম যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় উত্তর দিল, ‘ওদের কাছে যাচ্ছি৷ ওরা যেখানে গেছে৷’
মল্লার জিজ্ঞেস করল, ‘কারা কোথায় গেছে?’
সোহম বিড় বিড় করে বলল, ‘নদীর পাড়ে শ্মশানে৷’
মল্লার এরপর তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘কী ভুলভাল বকছিস?’
সেই ঝাঁকুনি খেয়ে যেন হুঁশ ফিরল সোহমের৷ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ তারপর মল্লারের দিকে তাকিয়ে একটু অপ্রস্তুত ভাবে হেসে সোহম বলল, ‘না, কিছু না৷ ঘুম ভেঙে গেল৷ তারপর মনে হল একটু হেঁটে আসি৷ তাই হাঁটতে নেমেছিলাম৷’
মল্লার তাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘এমনি তোর শরীরের ওপর দিয়ে আজ এত ধকল গেল! তার ওপর এই ঠান্ডায় কুয়াশার রাতে হাঁটতে বেরিয়েছিস! বলিহারি তোকে! চল ঘরে চল৷’ সোহম, মল্লারের কথার কোনও প্রতিবাদ করল না, শান্ত ছেলের মতো মল্লারের সঙ্গে ঘরে ফেরার জন্য এগলো৷ ঘরে ঢুকে দরজার ঝাঁপ বন্ধ করে আবার পাশাপাশি তারা শুয়ে পড়ল৷
রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল এক সময়৷ মুছে যেতে লাগল জলঙ্গীর বুকের ওপর নেমে আসা অন্ধকার আর কুয়াশা৷ আশ্রমের গাছগুলোর মাথার বাসা থেকে ঘুম ভেঙে ভোরের আলোকে স্বাগত জানাবার জন্য ডাকতে শুরু করল পাখির দল৷ ঘুম ভেঙে মল্লার দেখল খোলা দরজা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকছে ঘরে৷ আলোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে৷ সে মনের ক্লান্তি মুছিয়ে দেয়, মনকে সজীব করে তোলে৷ বিছানায় শুয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাইরের সদ্য আলোকিত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে মল্লারের আগের দিন বিকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে পড়ল ঠিকই, কিন্তু মল্লারের মনে হল ঘটনাটা যেন নিছক দুঃস্বপ্নই ছিল৷ এবং সে ঘটনা যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায় ততই ভালো৷
কিন্তু সোহম কই? তার পাশে তো সোহম নেই৷ চূর্ণীর ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে মল্লার দেখল, সে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ৷ অর্থাৎ চূর্ণী বাইরে বেরয়নি৷ মল্লার আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল৷ গায়ে চাদর জড়িয়ে, স্লিপারে পা গলিয়ে দাওয়াতে বেরিয়ে পড়ল সে৷ না, সোহম দাওয়াতে নেই৷ দাওয়া থেকে মল্লার নীচে নেমে পড়ল৷ সামান্য কুয়াশা এখনও থাকলেও ভোরের আলোতে জেগে উঠতে শুরু করেছে পৃথিবী৷ ওড়া উড়ি করছে পাখির দল৷ নরম, মনোরম পরিবেশ৷ কিন্তু চারপাশে ভালো করে তাকিয়েও মল্লার দেখতে পেল না সোহমকে। হঠাৎ একটা দুশ্চিন্তার উদয় হল মল্লারের মনে। রাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার পর মল্লারের ঘুমের সুযোগ নিয়ে আশ্রমের বাইরে বেরিয়ে যায়নি তো? কোনও কারণে শ্মশানের দিকে যায়নি তো?
রাতে ঘন কুয়াশাতে পাড় আর জলঙ্গীর জল মিলেমিশে যায়৷ রাতে বাইরে গেলে কী ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে সে অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে মল্লারের নিজের হয়েছে৷ হয়তো তমসাময় সঠিক সময় সে রাতে শ্মশানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন বলেই মল্লার সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে৷ ভাবনাটা মাথায় আসার সঙ্গে-সঙ্গেই আর কালবিলম্ব না করে হাঁটতে লাগল বাইরে যাবার জন্য৷ কিছুটা এগতেই সে দেখতে পেল সকালবেলা রান্না ঘরের সামনে ঝাঁটা হাতে ঝাঁট দিচ্ছে বুনো৷ মল্লার তাকে দেখে উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘সোহমকে দেখেছ তুমি? সে কোথায় গেছে দেখেছ?’
বুনো হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, দেখেছি৷ উনি একটু আগে ছেলেদের ঘরে গিয়েছেন৷ আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে৷’
বুনোর কথা শুনে যেন ধড়ে প্রাণ এল মল্লারের৷ সোহম, ছেলেদের ঘরে কী করছে তা দেখার জন্য মল্লার এরপর এগলো সেদিকে৷
ছেলেদের বাড়ির দাওয়াতে উঠতে উঠতেই মল্লার তাদের গলার স্বর শুনে বুঝতে পারল ভোরবেলাই উঠে পড়েছে ছেলের দল৷ দাওয়ায় উঠেই তার কানে এল সামনের ঘরের ভিতর সোহম ছেলেগুলোকে প্রশ্ন করল, ‘পোড়া মাছ খেতে দারুণ লাগে তাই না?’
ছেলেগুলো সমস্বরে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, খুব ভালো লাগে পোড়া শোল মাছ খেতে৷’
সোহম হয়তো ছেলেগুলোকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই সময় মল্লার ঘরে প্রবেশ করল৷ মল্লার ঘরে ঢুকতেই কথাবার্তা থেমে গেল৷ সবাই তাকাল তার দিকে৷ মুহূর্তের জন্য মল্লারের নাকে এসে লাগল গত রাতের পোড়া মাছের সেই কটু গন্ধটা৷ আর তার কারণ বুঝতেও অসুবিধা হল না৷ ঘরের এক পাশে মাটিতে পড়ে আছে ছোট ছোট মাটির সরা৷ যার মধ্যে গতকাল পোড়া মাছের টুকরো সাজিয়ে রাখা ছিল৷ এখন অবশ্য পাত্রগুলো শূন্য৷ মল্লারের অনুমান করতে অসুবিধা হল না যে, পোড়া মাছগুলো এ ঘরে এনে খেয়েছে ছেলেগুলো৷
সোহম মল্লারকে বলল, ‘একটু পরই তো আমরা আশ্রম ছেড়ে চলে যাব৷ তাই ঘুম থেকে উঠে ফিরে যাবার আগে একবার ওদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলে গেলাম৷’
মল্লার বলল, ‘ভালো করেছিস৷ আমাকেও ডেকে আনতে পারতিস৷’
এ কথা বলে সে ছেলেগুলোর উদ্দেশে বলল, ‘হ্যাঁ, একটু পর আমরা ফিরে যাব৷ সবাই ভালো থেকো আর তোমাদের জীবনবাবার কথা শুনে চলো৷ দুষ্টমি কোর না৷ মন দিয়ে পড়াশোনা করবে৷ বড় হতে হবে তোমাদের৷’
তার কথা শুনে সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়াল ছেলেগুলো৷
সোহম ছেলেগুলোকে বলল, ‘এবার তবে আমি আসি৷’
নবজীবন নামের ছেলেটা সোহমকে বলল, ‘তুমি আবার আসবে কিন্তু৷ নইলে আমাদের মন খারাপ হবে৷’
সোহম বলল, ‘হ্যাঁ, আসব৷’
ছেলেদের ঘর থেকে মল্লার আর সোহম যখন নিজেদের ঘরে ফিরে এল ততক্ষণে চূর্ণী ঘুম থেকে উঠে পড়েছে৷ বুনো চায়ের কেটলি নিয়ে হাজির হলে মল্লার তাকে জিগ্যেস করল তমসাময় কোথায় আছেন? বুনো জানাল তিনি ঘরেই আছেন। চা-পান সাঙ্গ হলে মল্লাররা তমসাময়কে দেবার জন্য চেকটা বার করে নিজেদের যেটুকু জিনিস ব্যাগে ভরা বাকি ছিল তা ভরে নিল৷ তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল৷
তারা তমসাময়ের দাওয়ার সামনে হাজির হতেই তিনি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে নীচে নেমে এলেন৷ চূর্ণীর হাতে চেকটা ছিল৷ সে তমসাময়কে বলল, ‘চেকটা কী নামে লিখব বলুন?’ তমসাময় বললে, ‘সরকারি অনুমোদন না মেলায় এখনও আশ্রমের নামে ব্যাঙ্কের বই খোলা যায়নি৷ আমার নামে লিখুন৷’
তমসাময়ের নামের বানান জেনে নিয়ে তা লিখে চূর্ণী চেকটা তাঁর হাতে দিল৷ বিজ্ঞাপনে টাকার অঙ্ক বলা ছিল না৷ সেটা দেখে তমসাময় বললেন, ‘আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা রইল না৷ ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন৷’
সোহম তাকে বলল, ‘আপনার কাছে আমারও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই৷ আপনি আমাকে নবজীবন দিলেন৷’
তমসাময়, সোহমের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘সবই আমার গুরুদেব অবধূতের শিক্ষা আর আশীর্বাদের ফল৷ আপনার জন্য এই নবজীবন আশ্রমের দরজা সব সময় খোলা রইল৷ যখন ইচ্ছা চলে আসবেন৷’
সোহমও হাসল তাঁর কথা শুনে৷
এরপর তারা তমসাময়কে নমস্কার করে তাদের গাড়ির দিকে এগলো৷ সে সময় বুনোকে আবার দেখতে পেয়ে মল্লার সোহমদের বলল, ‘ব্যাগগুলো গাড়িতে তোল৷ আমি বুনোকে কিছু টাকা দিয়ে আসি৷’—এই বলে সে এগলো বুনোর দিকে৷
বুনোর কাছে গিয়ে মল্লার দুটো পাঁচশো টাকার নোট বার করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা তুমি রাখ৷ এ ক’দিন তুমি আমাদের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছ৷ আর তমসাময়বাবুও বলেছেন যে তুমি যদি ওই শোল মাছটা না ধরতে তবে সোহমের জ্ঞান ফেরানো যেত না৷’
বুনো খুশি হয়ে টাকাটা হতে নিয়ে বলল, ‘শ্মশান থেকে টোপটা এনেছিলাম। তখনই জানতাম শোল বা বোয়াল ধরা পড়বেই। ভাগ্যিস টোপটা জোগাড় করতে পেরেছিলাম৷ তাই বাবুকে বাঁচানো গেল৷ সবই কপালের জোর৷’
মল্লার, গতকাল সোহমের মতোই স্বাভাবিক কারণেই তাকে প্রশ্ন করল, ‘টোপটা কী ছিল?’
গতকালের মতো এবার কিন্তু প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল না বুনো৷ সে বলল, ‘চলে যাবার আগে যখন আপনি জানতে চাইছেন তখন ব্যাপারটা আপনাকে বলি৷ চিতার আগুন নিভে যাবার পর অনেক সময় কাঠের গায়ে মাংসের টুকরো লেগে থাকে। অনেকে নাভি চিনতে না পেরে অন্য কিছু জলে ভাসায়৷’
গতকাল সকালে লোকগুলো মড়া পুড়িয়ে চলে যাবার পর আমি নাভিটা খুঁজে পেয়েছিলাম পোড়া চিতাকাঠ থেকে৷ মানুষের পোড়া নাভি বা মাংস শোল-বোয়ালের অব্যর্থ টোপ৷ নদীর পাড়ের শ্মশানে ডোমের কাজ করেছি বলে ব্যাপারটা আমি জানি৷ কাল ওই নাভি দিয়েই মাছটা ধরেছিলাম, আগেও ধরেছি৷’
মল্লার চমকে উঠল কথাটা জেনে৷ মনে মনে সে বলল, ‘ভাগ্যিস আমাকে মাছটা খেতে হয়নি৷’
সোহম ব্যাপারটা জানলে হয়তো বমি করে ফেলবে৷ তাই কথাটা তাকে না জানানোই ভালো৷ মল্লার এ প্রসঙ্গে আর বুনোর সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে বলল, ‘এবার গেটটা খুলে দাও৷ বেরব আমরা৷’
বুনো এগলো আশ্রমের প্রবেশ তোরণের ঝাঁপ খোলার জন্য আর মল্লার ফিরে এল গাড়ির কাছে৷ চূর্ণী-সোহম গাড়ির ভিতরে উঠে বসেছে৷ মল্লার চালকের আসনে বসে গাড়ি স্টার্ট করার সময় সোহম বলল, ‘সত্যি কথা বলছি, এখন মনে হচ্ছে ওখানে আর কটা দিন থাকতে পারলে ভালো হতো৷’
মল্লার বলল, ‘সে কীরে! কালই তো বলছিলি, আর থাকতে ভালো লাগছে না৷’
সোহম বলল, ‘তা বলেছিলাম ঠিকই৷ কিন্তু কালকের ঘটনার পর থেকে এ জায়গার ওপর হঠাৎ একটা মায়া জন্মে গেছে৷ জীবনবাবা আর বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে৷’
মল্লার গাড়ি স্টার্ট করল৷ তামসাময় তার দাওয়ার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন৷ তিনি হাত নাড়লেন চলমান গাড়ির দিকে তাকিয়ে। বুনো দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। জলঙ্গীর পাড়ের নবজীবন অনাথ আশ্রম ছেড়ে কলকাতা ফেরার জন্য রওনা দিল তাদের গাড়ি৷
গাড়িতে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই সোহম ঘুমিয়ে পড়ল৷ কলকাতা পর্যন্ত যাত্রাপথ প্রায় সবটাই ঘুমিয়ে কাটাল সোহম৷ মল্লার আর চূর্ণীর মনে হল সোহমের দুর্বলতা-ক্লান্তিভাব সম্পূর্ণ কাটেনি৷ মাঝে একবার শুধু রানাঘাটে খেতে নামল তারা৷ ফেরার সময় পুরো পথটাই মল্লার আর চূর্ণী নানা গল্প করতে করতে ফিরল৷ কলকাতায় প্রবেশ করার মুখে বিমানবন্দরের সামনে যশোর রোডে একবার সিগন্যাল না থাকাতে মল্লারদের গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল৷ সেই সময় চূর্ণী হঠাৎ মল্লারকে বলল, ‘ডান পাশের লাল গাড়িটার দিকে দ্যাখ৷ আরে সেই লোকটা না!’
মল্লার গাড়িটার দিকে তাকিয়ে তার চালকের সামনে বসা লোকটাকে চিনতে পারল৷ সেই নদী গবেষক কিঙ্কর খাস্তগীর!
তবে তিনি মল্লারদের দেখেছেন কিনা তা বুঝতে পারল না মল্লার৷ খাস্তগীরের চোখ সামনের রাস্তার দিকে৷
চূর্ণী গাড়িটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, ‘রানাঘাটে যখন খেতে নেমেছিলাম৷ তখন রাস্তার পাশে এই গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম বলে মনে হয়৷ উনি কি আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ফিরলেন?’ মল্লার বলল, ‘হতে পারে৷ উনি বলেছিলেন ওঁর বাড়ি ওই দমদমেই৷ বাড়ি ফিরছেন হয়তো৷’ এরপরই সিগন্যাল খুলে গেল৷ গাড়ির ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল খাস্তগীরের গাড়ি৷ মল্লারও এগলো নিজের রাস্তায়৷ দক্ষিণ কলকাতায় বাইপাসের ধারে অভিষিক্তা মোড়ে নিজের ফ্ল্যাটের কাছে চূর্ণী প্রথম নামল৷ তারপর সেখান থেকে সোজা উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার অঞ্চলে৷ ওখানে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে সোহম৷ চূর্ণী আর সোহমকে তাদের ঠিকানাতে নামিয়ে দেবার পর মল্লার যখন উল্টোডাঙা তার বাড়ি ফিরল তখন বিকাল চারটে বাজে৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন