হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
কুয়াশার একটা বলয় যেন শ্মশানকে আবৃত করে রেখেছে৷ প্রথমে তার কাছাকাছি পৌঁছে কোন কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না কারও৷ সেই কুয়াশার বলয় ভেদ করে কিছুটা এগবার পর আলোর আভাস মিলল৷ মশাল বা আগুনের আলো৷ সেদিকে এগতে শ্মশানের মধ্যে একটা জায়গা ধীরে ধীরে সবার দৃষ্টিগোচর হল৷ এক জায়গাতে কাঠ জড়ো করে একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে৷ তার আলো কুয়াশার আবরণ ভেদ করে কিছুটা অংশ আলোকিত করছে৷ মল্লার আর খাস্তগীররা প্রথমে দেখতে পেলেন তমসাময়কে৷ অগ্নিকুণ্ডর কিছুটা তফাতে মল্লারদের দিকে পিছন ফিরে বসে কী যেন করছেন৷ তিনি৷ এরপর সোহমকেও দেখতে পেল মল্লার৷ পোড়া চিতাকাঠের একটা ঢিবির পাশে দাঁড়িয়ে তমসাময়ের দিকে সে তাকিয়ে আছে৷ এরপর ধীরে ধীরে ছেলেগুলোর অবয়বও দৃষ্টিগোচর হতে লাগল৷ কুয়াশার গা ঘেঁষে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা৷ তাদের অবয়বগুলো কেমন যেন ভৌতিক বলে মনে হচ্ছে৷
খাস্তগীর, মল্লার কুয়াশার মধ্যে আত্মগোপন করে দেখতে লাগল তাদের৷ তমসাময় একসময় উঠে দাঁড়ালেন৷ মল্লারদের এবার চোখে পড়ল এতক্ষণ তমসাময়ের শরীরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মাটিতে পোঁতা হাড়িকাঠটা৷ সোহম এসে দাঁড়াল তমসাময়ের সামনে৷ সোহম তাকে বলল, ‘আজ আপনি রক্তাম্বর ধারণ করবেন না?’
তমসাময় বললেন, ‘না, আজ আমার রক্তাম্বর পরিধানের প্রয়োজন নেই৷ আজ যা করার তা গুরুদেব নিজের হাতেই করবেন৷ তিনি আজ রক্তাম্বর ধারণ করে তন্ত্রক্রিয়ার সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজটি সামাধা করবেন৷’
এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘গুরুদেব এখনই এসে পড়বেন৷ চলো, তার আগে দেখে আসি তোমার বন্ধু কী অবস্থায় আছে?’
এ কথা বলে তিনি সোহমকে নিয়ে পা বাড়াতে যাচ্ছিলেন মল্লারকে যে গর্তে ফেলে রাখা হয়েছিল সে দিকে, কিন্তু তার আগেই খাস্তগীরের ইঙ্গিতে তার পিছন পিছন মল্লার আর অন্যরা কুয়াশার আবরণ ভেদ করে আবির্ভূত হল তমসাময় ও সোহমের সামনে৷
তমসাময় যেন মল্লারকে দেখে মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলেন৷ খাস্তগীর, তমসাময়কে বললেন, ‘আমার সঙ্গে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আপনাদের যেতে হবে৷’
তমসাময় বললে, ‘আপনি কে? কোথায় যাব আপনার সঙ্গে?’
খাস্তগীর বললেন, ‘আপাতত প্রথমে আশ্রমের ভিতরে৷ সে জায়গার তল্লাশি করব আমরা৷ তারপর সেখান থেকে আপনাদের নিয়ে যাওয়া হবে অন্য জায়গাতে৷ আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করছি৷’ তমসাময়ের মুখমণ্ডল খাস্তগীরের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল৷ তিনি বললেন, ‘ও, আপনারা পুলিশের লোক! তা কী কারণে আমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন শুনি৷’
খাস্তগীর আঙুল তুলে হাড়িকাঠটার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘কারণটা আপনি জানেন, ওটা কীসের জন্য এখানে পোঁতা হয়েছে?’
তমসাময় যেন কিছু বুঝতে পারছেন না, এমনভাব দেখিয়ে হেসে বললেন, ‘ও ওটা তো পোঁতা হয়েছে ছাগ বলি দেবার জন্য৷ ছাগ বলি দেওয়া নিষিদ্ধ নাকি?’
খাস্তগীর এবার তার কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য ফুটিয়ে বললেন, ‘ছাগ নয়, ওটা পোঁতা হয়েছে মানুষ বলির জন্য৷ এই মল্লারবাবুকে আপনারা বলি দেবার জন্য গর্তর মধ্যে আটকে রেখেছিলেন৷ খুনের চেষ্টার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷ কী মল্লারবাবু, আমি ঠিক বলছি তো?’
মল্লার মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ৷ ঠিক৷’
তমসাময় কিন্তু তবুও দমলেন না৷ তিনি, খাস্তগীরকে বললে, ‘উনি আপনাকে এ কথা বলে ডেকে এনেছেন বুঝি? মিথ্যা কথা বলেছেন৷ ওনার সঙ্গে এই বন্ধুর একটু মনোমালিন্য হয় আশ্রমে থাকার ব্যাপার নিয়ে৷ তারপর উনি আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷’
তমসাময়ের কথা শেষ হতে না হতেই সোহম তাকে সমর্থন জানিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, উনি ঠিক বলছেন। মল্লার সকালবেলা আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।’
মল্লার সোহমের আচরণ আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে উঠল, ‘তুই কি আদৌ বেঁচে আছিস, নাকি উন্মাদ হয়ে গেছিস? তুইও আমাকে খুন করতে চাইছিলি!’
এ কথা বলে মল্লার তাকে প্রশ্ন করল, ‘চূর্ণী কোথায় বল? তার পরিবর্তে তমসাময় জবাব দিলেন, ‘তিনিও আশ্রম ছেড়ে চলে গিয়েছেন৷ তার খবর আমরা জানি না৷’ খাস্তগীর বললেন, ‘কী জানেন বা জানেন না তা পরে দেখছি৷ আর আপনার সেই বামন সঙ্গী কোথায়? আর গুরুদেবই বা কোথায়?’
তমসাময় এ কথার কোনও জবাব দিলেন না৷
খাস্তগীর এরপর তমসাময়ের উদ্দেশে বললেন, ‘ঠিক আছে, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ নেই৷ আগে আশ্রমে চলুন৷ ছেলেগুলোকে ডাকুন৷
তমসাময় বললেন, ‘আমার সম্বন্ধে যখন আপনাদের প্রধান অভিযোগ তখন না হয় আমিই যাচ্ছি আপনাদের সঙ্গে৷ সোহমবাবু আর ছেলেরা এখানেই না হয় থাকুক৷’
খাস্তগীর কড়া গলায় ধমক দিয়ে বললেন, ‘না কেউ থাকবে না৷ ডাকুন সবাইকে৷’ তমসাময় ধমক শুনে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন খাস্তগীরের দিকে৷ ঠিক এই সময় মল্লারের মনে হল, দূরে কোথা থেকে যেন মৃদু কোলাহলের শব্দ কানে আসছে! অবশ্য সেটা অন্য কিছুর শব্দ কি না তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না মল্লার৷
তমসাময় চারপাশে একবার তাকালেন৷ তারপর ছেলেগুলোর উদ্দেশে বললেন, ‘নবজীবন? সঞ্জীবন? তোমরা সবাই এখানে এসো—৷’
তাঁর কথা শুনে ছেলেগুলো যেখানে ছিল তারা সে জায়গা ছেড়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল মল্লারদের সামনে৷ তমসাময় তাকালেন তাদের দিকে৷ তারপর বললেন, ‘এরা তোমাদের ধরে নিয়ে যেতে এসেছেন৷ যাবে তোমরা?’
মল্লার খেয়াল করল ছেলেদের দলের মধ্যে সেই নতুন বাচ্চাটা নেই৷ পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই আশঙ্কায় হয়তো ছেলেটাকে আশ্রমের বাইরে আনা হয়নি৷
সেই কোলাহলের শব্দটা যেন এবার মল্লারের কানে এল৷ কুয়াশার মধ্যে দূরের কোনও কিছু দেখা না গেলেও সেটা যেন আশ্রমের দিক থেকেই আসছে! একসঙ্গে বহু মানুষের গলার শব্দ!
সে শব্দ এবার যেন খাস্তগীরের কানেও গেল৷ তিনি একবার তাকালেন আশ্রমের দিকে৷
তমসাময় বাচ্চা ছেলেগুলোকে আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘যাবে তোমরা?’
দ্বিতীয় বার প্রশ্ন শুনে ছেলেগুলো কয়েক মুহূর্তর জন্য দু-হাতে নিজেদের মাথা চেপে ধরল! এমনকী সোহমও৷ ঠিক যেমন সে নিজের মাথা চেপে ধরেছিল মল্লার আর চূর্ণীর সঙ্গে ঘরে ঢোকার পর৷ আর এরপরই একটা ঘটনা ঘটল৷ ঠিক বাঁদরেরা যেমন লাফ দেয়, ঠিক তেমনই ছেলেগুলো মাটি থেকে স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠে ঝাঁপ দিল খাস্তগীরের লোকজনদের গলা-ঘাড় লক্ষ্য করে৷ খাস্তগীর রিভলবার বার করলেন ঠিকই, কিন্তু সঞ্জীবন নামের ছেলেটা লাফিয়ে তার বুকের কাছে গলা ধরে ঝুলতে থাকল৷ বাচ্চাছেলের ওপর তো গুলি চালানো যায় না৷ তাই তিনি এক হাতে রিভলভার নিয়ে অন্য হাত দিয়ে ছেলেটাকে গলা থেকে নামাবার চেষ্টা করতে লাগলেন৷ মুহূর্তর মধ্যেই চূড়ান্ত গোলযোগ, ধস্তাধস্তি শুরু হল চারপাশে৷ খাস্তগীরের সহযোগীদের অনেকের কাছেই সরকারি অস্ত্র আছে, কিন্তু খাস্তগীরের মতোই ছোট ছেলেদের ওপর তা প্রয়োগ করতে অক্ষম৷ তারা দু-হাত দিয়ে ছেলেগুলোকে শরীর থেকে নামাবার চেষ্টা করতে লাগল৷ কিন্তু বাচ্চাদের ওই ছোট ছোট হাতগুলোতে যেন আসুরিক শক্তি! সেই হাত চেপে বসতে লাগল খাস্তগীরের সঙ্গীদের গলাতে৷ টাল সামলাতে না পেরে তাদের দু-একজন মাটিতে পড়ে গেল৷ আর এই ঘটনার মধ্যেই আশ্রমের দিক থেকে ভেসে কোলাহল তীব্র রূপ ধারণ করল৷ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে সেই শব্দ! যেন বহু মানুষ সেখানে সমবেত হয়ে চিৎকার করছে৷
মল্লারের দিকে একটা ছেলে আসতেই সে ব্যপারটা অনুমান করে নিমেষে একপাশে সরে গেল৷ বাচ্চা ছেলেটা লাফ দিল ঠিকই, কিন্তু মল্লার সরে যাওয়াতে সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বাতাসে উড়ে গিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল৷ আশ্রমের দিক থেকে আসা সম্মিলিত জনতার চিৎকার আর শ্মশানে ঘটে চলা ঘটনার শব্দে জলঙ্গীর পাড়ে রাতের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যেতে লাগল৷ শিয়ালের দল আতঙ্কিত হয়ে কোন দিকে পালাবে তা বুঝতে না পেরে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল৷ মল্লার এরপর নিজে বাঁচার জন্য ছুটল অগ্নিকুণ্ডর দিকে৷ যদি একটা জ্বলন্ত কাঠ বাগিয়ে ধরে তা দিয়ে আত্মরক্ষা করা যায় সে জন্য৷ মল্লার ছুটে গিয়ে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিল ঠিকই কিন্তু সে ফিরে দাঁড়িয়েই দেখল তার কয়েক হাত তফাতে সোহম এসে দাঁড়িয়েছে৷ তার হতে একটা খাঁড়া! বলি দেবার জন্য খাঁড়াটা এনে এখানেই কোথাও রাখা হয়েছিল যেটা মল্লাররা খেয়াল করেনি৷ আগ্নিকুণ্ডর লাল আভাতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সোহমের মুখ, চোখে জেগে আছে আদিম হিংস্রতা৷ এ মুখ যেন কোনও মানুষের হতে পারে না! মল্লারের প্রতি তীব্র ঘৃণা যেন ঝরে পড়ছে তার মুখমণ্ডলে৷ মল্লারকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোহম তার খাঁড়াটা চালাল মল্লারকে লক্ষ্য করে৷ মল্লার তার হাতে ধরা কাঠটা দিয়ে খাঁড়ার আঘাত প্রতিহত করল ঠিকই, কিন্তু সেই খাঁড়া আর কাঠের সংঘর্ষের অভিঘাতে মাটিতে ছিটকে পড়ল মল্লার৷ জ্বলন্ত কাঠটাও খসে পড়ল তার হাত থেকে৷ খাস্তগীর আর তার সঙ্গীরা তখন ছেলেগুলোর হাত থেকে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত৷ কেউ কেউ মাটিতে পড়ে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাতের দানবীয় নিষ্পেষণে গোঙাচ্ছে৷ মল্লারকে বাঁচাবার জন্য কেউ নেই৷ সোহম আবারও এগিয়ে আসতে লাগল মল্লারের দিকে৷ বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে মল্লার৷ মাথার উপরের আকাশটা কেমন যেন লাল মনে হচ্ছে! সেই লাল আকাশরে নীচে মল্লারের কাছে এসে দাঁড়াল সোহম৷ মল্লার এবার যেন সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করতে পারল তার মৃত্যুকে৷ মল্লারের দেহটাকে দু-টুকরো করে ফেলার জন্য তাকে লক্ষ্য করে খাঁড়াটা দু-হাতে মাথার উপর তুলল সোহম৷ আতঙ্কে হিম হয়ে গেছে মল্লারের শরীর, গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরোল না তার৷
এক সেকেন্ড! দুই সেকেন্ড! এই বুঝি খাঁড়াটা নেমে এল মল্লারের ওপর! কিন্তু এরপরই মল্লার খেয়াল করল সোহম যেন টলতে শুরু করেছে! খাঁড়াটা যেন সে ঠিক ধরে রাখতে পারছে না! হ্যাঁ, সে টলছে! আর এরপরই খাঁড়াটা সোহমের মাথার পিছন দিকে কাত হতে হতে তার হাত থেকে খসে পড়ল৷ সেটা পড়ে যাবার পর সোহম থরথর করে হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ল, তারপর মাটিতে গড়িয়ে পড়ল৷ মল্লারের চোখের সামনে কয়েকবার মোচড় দিয়ে স্থির হয়ে গেল সোহমের দেহটা!
আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে বসতে আরও বেশ কিছু মুহূর্ত সময় নিল মল্লার৷ তখন তার চারদিকে অনেকেই মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে৷ সোহমের হাত থেকে যেমন খাঁড়াটা খসে পড়েছিল তেমন বাচ্চাদের হাতগুলোও হঠাৎ ছেড়ে দিয়েছে লোকগুলোর গলা৷ তাদের দেহগুলো খসে পড়ে সোহমের মতো মোচড় খেয়ে স্থির হয়ে গিয়েছে৷
খাস্তগীর ছুটে এসে মল্লারের হাত ধরে টেনে মাটির ওপর দাঁড় করালেন৷ তিনি দুঁদে অফিসার, জীবনে নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন৷ কিন্তু এই অদ্ভুত বিস্ময়কর ঘটনাতে তাঁকেও যেন কেমন বিহ্বল দেখাল৷ তাঁর একজন সহকর্মী এগিয়ে এসে সোহমকে সতর্কভাবে পরীক্ষা করে বলল, ‘স্যার, এনার শরীরে তো প্রাণ নেই বলে মনে হচ্ছে! বাচ্চাগুলোরও একই অবস্থা! হঠাৎ সবাই এক সঙ্গে হার্ট ফেল করল নাকি? এ কীভাবে সম্ভব?’
খাস্তগীর তার কথার জবাব না দিয়ে চারপাশে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু তমসাময় কোথায় গেল? সে মনে হয় পালিয়েছে৷ ধরতে হবে তাকে৷ সোহম আর বাচ্চাছেলেগুলো জীবিতই হোক বা মৃত, এদের হাতগুলো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেল৷ খাস্তগীরের নির্দেশ পালন করতে শুরু করল সহকর্মীরা৷
আর এতক্ষণ পরে খাস্তগীর আরও একটা ব্যাপারেও আকৃষ্ট হলেন৷ তিনি বললেন, ‘কীসের চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ আসছে! ও কাদের শব্দ?’
নিজের প্রশ্নের জবাব তিনি পরমুহূর্তেই পেয়ে গেলেন৷ আকাশ যেন হঠাৎই আরও লাল হয়ে উঠল৷ অনেকটা দিনের মতো আলো! পাখির দল উড়তে শুরু করেছে আকাশে৷ আর সেই আলোর উৎস যেন তমসাময়ের আশ্রমে!
ব্যাপারটা অনুমান করে খাস্তগীর বললেন, ‘আগুন! আগুন! তমসাময়ের আশ্রমে মনে হয় আগুন লেগেছে! এখনই সেখানে যেতে হবে৷’
মল্লার কথাটা শুনে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আগে ওখানে চলুন, চূর্ণী হয়তো ওখানেই আছে৷’ খাস্তগীর কয়েকজন সঙ্গীকে সেখানে রেখে তাদের উদ্দেশে বললেন, ‘যদি কোনও ঘটনা ঘটে তবে এবার প্রাণ বাঁচাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করবেন না৷’—এ কথা বলে তিনি মল্লার আর বাকি লোকদের নিয়ে জলঙ্গীর পাড়ের কুয়াশা ভেদ করে আশ্রমের দিকে ছুটতে শুরু করলেন৷ তাঁরা যত এগতে লাগলেন ততই যেন কুয়াশা কেটে যেতে লাগল৷ আকাশের বুকে নাচতে দেখলেন আগুনের লেলিহান শিখা৷ কাকের দল ভয় পেয়ে আকাশের বুকে কা কা চিৎকার করতে করতে উড়ছে৷ আর আশ্রমের দিক থেকে ভেসে আসছে অজস্র মানুষের চিৎকার৷ মল্লাররা পৌঁছে গেল আশ্রমের কাছে৷ ওদের অনুমানই সত্যি! আশ্রমের একটা অংশে বেশ কয়েকটা ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ দাউদাউ করে জ্বলছে খড়ের চালগুলো৷ আশ্রমের ভিতর থেকে ভেসে আসছে উন্মত্ত জনতার কোলাহল৷
মল্লাররা যখন সেখানে উপস্থিত হল, ঠিক সেই সময় পুলিশের একটা গাড়ি এসে হাজির হল সেখানে৷ গাড়িটা দেখে খাস্তগীর বললেন, ‘এস.ডি.পি.ও সাহেবের গাড়ি৷ ঝটপট গাড়ি থেকে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে নামলেন স্থানীয় পুলিশকর্তা৷ খাস্তগীরকে দেখে তিনি বললেন, ‘আপনিও এসে গিয়েছেন৷ এখন কী করা উচিত বলুন?’
খাস্তগীর বললেন, ‘আগে গ্রামবাসীদের সামলিয়ে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করে তারপর আশ্রমে তল্লাশি চালাতে হবে৷ আশ্রম প্রধান তমসাময় শ্মশান থেকে পালিয়েছে৷ তার খোঁজ করতে হবে চারদিকে৷’ পুলিশ অফিসার তার গাড়িতে বসে থাকা একজন পুলিশকে বললেন ওয়ারলেসে থানায় খবর দিতে আরও ফোর্স পাঠাবার জন্য৷ তারপর আর কালবিলম্ব না করে সবাই ঢুকে পড়ল আশ্রমের মধ্যে৷ পঞ্চাশ-ষাট জন গ্রামবাসী আশ্রমের ভিতরে উন্মত্তভাবে চিৎকার করতে করতে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে৷ কাউকে যেন তারা খুঁজছে৷ মল্লাররা দেখতে পেল সেই কালো ঘরটা আর তার কাছাকাছি বেশ কয়েকটা ঘর জ্বলছে!
তবে পুলিশের উর্দি এমন একটা জিনিস, যা দেখে অনেকেই থমকে যায়৷ মল্লারদের সঙ্গে উর্দি পরা রাইফেলধারী পুলিশকর্মীদের দেখে গ্রামবাসীরাও একটু থমকে গেল৷ তারপর মল্লারদের এসে ঘিরে ধরে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে লাগল তারা৷ তাদের স্থির বিশ্বাস মৃত বাচ্চাটার দেহ এই আশ্রমের ভিতরেই কোথাও রাখা আছে৷ সে জন্য তারা রাত্রিবেলা হাজির হয়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আশ্রমের উপর আড়াল থেকে লক্ষ রাখছিল৷ প্রথমে তারা দেখতে পায় তমসাময় আর সোহম আশ্রম থেকে ছেলেদের নিয়ে শ্মশানের দিকে চলে গেলেন৷ আর এরপরই তারা মনস্থির করে আশ্রমের ভিতর ঢুকে তল্লাশি চালাবে৷ প্রথমে চার-পাঁচজন লোক আশ্রমে ঢোকে৷ কিছুটা এগতেই তারা বুনোর মুখোমুখি হয়ে যায়৷ গ্রামবাসীদের দেখেই বুনো পালাবার চেষ্টা করে৷ একজন লোক বুনোকে ধরতে যেতেই বুনো ছুটতে ছুটতে মাটিতে এক জায়গায় পড়ে থাকা একটা মাছ ধরার কোঁচ বা বল্লম তুলে নিয়ে লোকটাকে ছুড়ে মারে৷ কোঁচটা তার বুকে না লাগলেও হাঁটুতে লাগে৷ মাটিতে পড়ে যায় লোকটা৷ আর বুনো অন্ধকারের মধ্যে ছুটে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে আশ্রমে৷ তারপর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে কালো ঘরটাতে, তারপর কাছাকাছি বেশ কয়েকটা ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়।
গ্রামবাসীদের বক্তব্য মিথ্যা নয় বলেই মনে হল মল্লারদের৷ আহত লোকটাকেও মল্লাররা দেখতে পেল৷ ইতিমধ্যে লোকটার হাঁটুতে কাপড়ের একটা ফেট্টি বাঁধা হয়েছে৷ রক্তে ভিজে আছে জায়গাটা৷
নরম-গরমে গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠান্ডা করতে বেশ কিছুটা সময় লাগল খাস্তগীর আর এস.ডি.পি.ও সাহেবের৷ নতুন কোনও ঘরে আর অগ্নি সংযোগ করল না তারা৷ তবে কালো ঘরটা অথবা অন্য যে ঘরগুলোতে আগুন লাগানো হয়েছে সেখানে আর আগুন নেভানোর চেষ্টা করে লাভ নেই তা বুঝতে পারলেন খাস্তগীর আর এস.ডি.পি.ও৷ কারণ, ইতিমধ্যে ঘরগুলো ভস্মীভূত হতে চলেছে৷ বিশেষত সেই কালো ঘরটা সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে৷ কাঠামোটা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে আছে৷ ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে সেখানে৷ সেই পুড়ে যাওয়া কালো ঘরের দিকে তাকিয়ে খাস্তগীর পুলিশ অফিসারকে বললেন, তমসাময়ের সহকারী ওই বামন লোকটা ওখানে পুড়ে মরেছে কি না তা বোঝার জন্য আগুন না নেভা পর্যন্ত অর্থাৎ সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ এখন আমরা খুঁজে দেখি গ্রামবাসীরা যার খোঁজে এসেছে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় কি না। সবচেয়ে বড় কথা একজন ভদ্রমহিলা এখানে ছিলেন৷ কলকাতা থেকে তিনি এসেছেন৷ সম্ভবত তিনিও বিপদগ্রস্থ৷ তাকেও খুঁজে বার করা দরকার৷’
গ্রামবাসীদের এরপর কয়েকজন পুলিশ কর্মীর তত্ত্বাবধানে একজায়গায় বসিয়ে রেখে চূর্ণী আর বাচ্চা ছেলেটার খোঁজে আশ্রমে তল্লাশি শুরু হল৷ যে ঘরে মল্লাররা রাত্রিবাস করেছিল সে ঘরটা ফাঁকা পড়ে আছে৷ সেখানে কেউ নেই৷ সে ঘর থেকে বেরিয়ে মল্লাররা এগলো তমসাময়ের বাসস্থানের দিকে৷ মল্লারের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে তমসাময়ের ঘরের পাশেই৷ গাড়িটা দেখে পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন, ‘এটা কার গাড়ি?’
খাস্তগীর মল্লারকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওনাদের গাড়ি৷ এ গাড়িতে ওনারা এখানে এসেছিলেন৷ পরে এ ব্যাপারে আপনাকে জানাচ্ছি৷ আমাদের এখানে ঢুকতে আর একটু দেরি হলে হয়তো উত্তেজিত গ্রামবাসীরা গাড়িটাকেও জ্বালিয়ে দিত৷’
তমসাময়ের ঘরের দাওয়াতে উঠল সকলে৷ দরজার শিকল খোলা হল৷ পুলিশের বেশ কয়েকটা জোরালো টর্চের আলোতে সে ঘরের অন্ধকার খান খান হয়ে গেল৷ চৌকির তলা থেকে মাথার উপরের ঘরের সিলিং—সব জায়গা ভালো করে দেখার পরও ওই ঘরে কাউকে পাওয়া গেল না৷ সে ঘর থেকে নেমে মল্লাররা এরপর এগলো ব্যারাকের মতো দেখতে ছেলেদের থাকার জায়গার দিকে৷ কুয়াশার মধ্যে ডুবে আছে বাড়িটা৷
তবে এ বাড়িটাতে অনুসন্ধান চালিয়েই পাওয়া গেল সেই বাচ্চাটাকে৷ গ্রামবাসীরা যার খোঁজে এসেছে৷ টর্চের আলোতে দেখা গেল একটা ঘরের কোণে কুঁকড়ে পড়ে আছে ছেলেটা৷ পরীক্ষা করে বোঝা গেল বাচ্চাটার দেহে প্রাণ নেই, তবে শরীর তখনও তার ঠান্ডা হয়ে যায়নি৷ বাচ্চাটার দেহ উদ্ধার হবার পর খাস্তগীর পুলিশ অফিসারকে বললেন, ‘এ দেহর ব্যাপারে তো আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই৷ দেহের দাবিদার যখন আছে তখন দেহটা ওদের হাতেই তুলে দিন৷ এতে গ্রামবাসীদের ক্ষোভ প্রশমিত হবে, আমাদের প্রতি তাদের আস্থা-বিশ্বাস বাড়বে, আমাদের কাজের সুবিধা হবে৷ শ্মশানে বেশ কিছু এমন মৃতদেহ আমার লোকেরা আগলাচ্ছে, সেগুলোও তুলে আনতে হবে৷’ এস.ডি.পি.ও সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ, আগে শবটাকে এ জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলা দরকার৷ নইলে আমাদের কাজের অসুবিধা হতে পারে৷’
বাচ্চার মৃতদেহটা নিয়ে এস.ডি.পি.ও সাহেব আরও কয়েজন পুলিশকর্মী এগলেন দাবিদারদের ফেরত দিতে৷ বাকি যারা ছিল তাদের নিয়ে খাস্তগীর আবার আশ্রমের ঘরগুলোসহ নানান জায়গাতে তল্লাসি শুরু করলেন৷ সে কাজ করতে করতেই মল্লারদের কানে এল জনতার কোলাহল আশ্রমের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ দেহটা নিয়ে চলে যাচ্ছে তারা৷
এস.ডি.পি.ও সাহেব তাঁর কাজ শেষ করে কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে জানালেন, বাচ্চাটার মৃতদেহ নিয়ে গ্রামবাসীরা আশ্রম ছেড়ে রওনা দিয়েছে৷ আরও ফোর্স এসেছে৷ তিনি তাদের দু-দলে বিভক্ত করে একদলকে পাঠিয়েছেন শ্মশান থেকে লাশগুলো আপাতত আশ্রমে তুলে আনার জন্য, আর একদলকে জলঙ্গীর পাড় বরাবর অনুসন্ধান চালাতে বলেছেন যদি তমসাময় বা অন্য কারও খোঁজ মেলে, সে জন্য৷
আশ্রমের বাকি ঘরগুলোতেও এরপর তল্লাসি চালানো হল৷ ঘরগুলো সব ফাঁকা৷ চূর্ণী বা বুনোর চিহ্ন নেই কোথাও৷ গাছের মাথাগুলোতেও টর্চ মেরে দেখা হল, যদি বুনো গাছের মাথাতে উঠে লুকিয়ে থাকে সেজন্য৷ কিন্তু পুরো আশ্রম তন্নতন্ন করে খুঁজেও কারও চিহ্ন মিলল না৷ যে ঘরগুলোতে আগুন লাগানো হয়েছিল সে আগুন এখন প্রায় নিভে এসেছে, পোড়ার জন্য আর কিছু অবশিষ্ট নেই বলে৷ বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় কেটে গেছে ইতিমধ্যে৷ রাত এবার হাঁটতে শুরু করেছে ভোরের দিকে৷ খাস্তগীর বললেন, ‘আমি কিন্তু ভেবেছিলাম চূর্ণী ম্যাডামকে জীবিত অথবা মৃত এই আশ্রমের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে৷ কারণ, তিনি বাইরে বেরোলে যারা আশ্রমের চারদিকে নজরদারিতে ছিল তাদের চোখে পড়ত৷ আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি কোথায় গেলেন?’
খাস্তগীরের এক সহকর্মী একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘ওই কালো ঘরটার মধ্যে ওরা কেউ ছিলেন না তো?’ কথাটা শুনে মল্লারের বুকটা ধক করে উঠল৷ কিন্তু খাস্তগীর বললেন, ‘দিনের আলো ফুটলে ছাই সরিয়ে খুঁজে দেখব ঠিকই৷ কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে ওই ছাইয়ের নীচে কোনও দেহাবশেষ না পাবার সম্ভাবনাই বেশি৷ কারণ, মাংস পুড়লে বিশেষত, মানুষের মাংস পুড়লে বাতাসে একটা অদ্ভুত গন্ধ ছড়ায়৷ সে গন্ধ কিন্তু আমরা কেউই পাইনি৷’
তল্লাশি শেষ৷ একজন পুলিশকর্মী এসে জানালেন শ্মশান থেকে সোহম আর বাচ্চা ছেলেদের মৃতদেহগুলো গাড়িতে করে তুলে আনা হয়েছে৷ শ্মশান সংলগ্ন জলঙ্গীর পাড় বরাবর তল্লাশিও চলছে৷ খাস্তগীরকে পুলিশসাহেব জিগ্যেস করলেন, ‘এখন আর কী করা উচিত?’
খাস্তগীর বললেন, ‘ঘণ্টাখানেক পরই ভোরের আলো ফুটবে৷ আপাতত তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে৷ চলুন কোথাও বসে কথা বলি৷ আপনাকে বেশ কিছু ব্যাপার জানানোর আছে৷ একটু আলাদা বসে কথা বলতে হবে৷’
অনুসন্ধান চালাতে চালাতে মল্লাররা এসে পৌঁছে ছিল আশ্রমের প্রধান প্রবেশ মুখের কাছে৷ যেখান দিয়ে মল্লাররা গাড়ি নিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করেছিল৷ দরমার তৈরি গেটটা আগের মতোই বন্ধ আছে ভিতর থেকে৷ খাস্তগীর বললেন, ‘এ পথে কেউ বাইরে বেরোলে জানতাম৷ কারণ, এদিকেও আমার নজরদারির ব্যবস্থা আছে৷’
সে জায়গা ছেড়ে এরপর সবাই ফিরতে শুরু করল জলঙ্গীর দিকে৷ সেদিকে পৌঁছে বাইরে যাওয়ার গেটের কাছাকাছি একটা ছোট ঘরের শূন্য দাওয়া দেখে খাস্তগীর পুলিশ সাহেবকে বললেন, ‘চলুন! ওখানে বসে কথা বলি?’
এস.ডি.পি.ও সাহেব তাঁর সঙ্গী পুলিশদের সরে যেতে বললেন৷ মল্লারও সরে যাচ্ছিল, কিন্তু খাস্তগীর বললেন, ‘আপনি থাকুন, তাতে আমাদের আলোচনার সুবিধা হবে৷’
অন্য সবাই কিছুটা তফাতে চলে যাবার পর সেই ঘরের দাওয়ায় মল্লারকে সঙ্গে নিয়ে বসলেন খাস্তগীর আর পুলিশ কর্তা৷ এরপর এস.ডি.পি.ও সাহেবকে মল্লারদের কাহিনি, তার মুখ থেকে শোনা আশ্রমের ঘটনা বলতে শুরু করলেন খাস্তগীর৷ মল্লারও মাঝে মাঝে বলতে লাগল এই আশ্রমে তার আশ্চর্য অভিজ্ঞতা ও সোহমের আচরণের কথা!
সব শোনার পর পুলিশ অফিসার খাস্তগীরকে বললেন, ‘বাচ্চা ছেলেগুলোর ব্যাপারে যা শুনলাম তাতে আপনার পরিবর্তে অন্য কেউ এ কথা বললে তাকে আমি পাগল বলতাম৷ কিন্তু আপনার কথাই বা অবিশ্বাস করি কীভাবে? এমন অদ্ভুত ব্যাপার আমি জীবনে শুনিনি৷
খাস্তগীর হেসে বললেন, ‘আমার কাছে যদি সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকত, বাচ্চাগুলোর মৃত্যুর প্রমাণপত্র না থাকত, আজ যদি শ্মশানে সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সাক্ষী না হতাম তবে আমিও আপনার মতোই ভাবতাম৷ ভারতীয় তন্ত্র সাধকদের অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে অনেক কাহিনি প্রচলিত অছে৷ সম্ভবত তারই একটা প্রত্যক্ষ করছি আমরা৷ যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি৷’
পুলিসকর্তা বললেন, ‘মৃতদেহ জীবন লাভ করে কীভাবে?’
খাস্তগীর বললেন, ‘আমি একবার একটা গল্পের বইতে পড়েছিলাম এ ধরনের মানুষদের নিয়ে৷ আফ্রিকা, ইউরোপেও এমন কিছু মানুষদের দেখা যায় যাঁরা নাকি মত্যুর পরও কবর ছেড়ে উঠে এসে ঘুরে বেড়ায়, এমনকী দিনের আলোতেও তারা ঘুরে বেড়ায়৷ তবে নিজেদের পরিজনদের কিন্তু তারা আর চিনতে পারে না৷ তাদের কাছেও ফিরে যায় না৷ এর কারণ হিসাবে বলা হয় যে, আসলে তাদের মত্যুর পর নাকি তাদের শরীরে অন্য মৃত ব্যক্তির আত্মা প্রবেশ করানো হয়, তাই তাদের দেহ একই থাকলেও পূর্বের, বলা ভালো পূর্ব জন্মের কোনও কিছু মনে থাকে না৷
ব্ল্যাক ম্যাজিক জানা যে সব মানুষরা মৃত শরীরে অন্যের আত্মার প্রবেশ ঘটান, সেইসব জাদুকর, সন্নাসী গোত্রের মানুষদের নির্দেশেই কেবল পরিচালিত হয় জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি স্তরে অবস্থান করা অদ্ভুত লোকগুলো৷ ওদের জীবিত অথবা মৃত—এ দুইই বলা যায়৷ হ্যাঁ, এদের নামটা এবার মনে পড়েছে৷ এই অদ্ভুত মানুষদের ‘জম্বি’ নামে ডাকা হয়৷ আমার ধারণা সোহম বা বাচ্চা ছেলেগুলো ওই জম্বির ভারতীয় সংস্করণ৷ তমসাময় বা তাঁর গুরুদেব ওদেরকে চিন্তা তরঙ্গের মাধ্যমেও নির্দেশ দিতে সক্ষম৷ শ্মশানে তমসাময় ছেলেগুলোকে ডেকে তাদের দিকে তাকাতেই ছেলেগুলো নিজেদের মাথা চেপে ধরেছিল সেই চিন্তা তরঙ্গ গ্রহণ করার সময়৷ তারপর তারা আমাদের আক্রমণ করে৷’
পুলিশ কর্তা বললেন, ‘কিন্তু একসঙ্গে হঠাৎই সব দেহগুলো প্রাণহীন হয়ে গেল কেন?’
একটু ভেবে নিয়ে খাস্তগীর বললেন, ‘এর পিছনে দুটো কারণ থাকতে পারে৷ তমসাময় অথবা তাঁর অদৃশ্য গুরুদেব ভেবে থাকতে পারেন যে, শেষ পর্যন্ত আমরা হয়তো কোনও ছেলেকে বা সোহমকে ধরে ফেলতে পারি৷ তাদের মাধ্যমে কোনও গুপ্ত রহস্য যাতে বাইরে প্রকাশ না পায় তাই তাদের শরীরে আটকে রাখা আত্মার মুক্তি ঘটানো হয়ে থাকতে পারে৷ আমার দ্বিতীয় অনুমান হল, যে কালো ঘরটাতে আগুন লাগানো হয় সেই ঘরটাই ছিল মৃত মানুষের শরীরে অন্যের আত্মার অনুপ্রবেশ ঘটানোর ক্ষমতার উৎস৷ ওই ঘরেই তো মৃতদেহ তুলে এনে জীবিত করা হতো৷ তাই কালো ঘর আগুনে পুড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে অলৌকিক শক্তিও নষ্ট হয়ে যায়, হয়তো বা শরীরে আটকে থাকা আত্মারা মুক্তি লাভ করে৷ সোহম আর ছেলেগুলোর শরীর আবার মৃতদেহে পরিণত হয়৷ আমার কিন্তু মনে হয় ওই দ্বিতীয় অনুমানটাই ঠিক৷’
এরপর আবারও একটু ভেবে নিয়ে খাস্তগীর বললেন, ‘তবে যাই হোক না কেন, মৃতদেহগুলোকে এবার পুড়িয়ে ফেলতে হবে৷ দাবিহীন মৃতদেহ পোড়াতে সমস্য হবে না৷ সোহম ছাড়া অন্য সবাই তো সরকারি কাগজে এবং তাদের পরিবারের কাছে মৃত৷ সোহমের কোনও পরিবার নেই৷ তার দাহকার্য সম্পূর্ণ করার জন্য মল্লারবাবুকে দিয়ে সাক্ষী হিসাবে কাগজপত্রে সই করিয়ে নেওয়া যাবে৷ তবে আইন বাঁচিয়ে মৃতদেহগুলো দাহ করার আগে আর একবার ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে দেহগুলো পোস্ট মর্টেম করানো যেতে পারে৷ কিন্তু দেহগুলো পোস্ট মর্টেম করার জন্য সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া চলবে না৷ কারণ, একসঙ্গে এতগুলো মৃতদেহ দেখলেই মিডিয়া ছেঁকে ধরবে৷ আমাদের বলা কথা তারা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করবে না৷ আমরা তাদের জায়গাতে থাকলেও করতাম না৷ তখন আবার বডিগুলো নিয়ে অন্য ঝামেলা শুরু হবে৷ লোকে বলে পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা৷ আমরা বলি মিডিয়া ছুঁলে একশো ছত্রিশ ঘা!’
এস.ডি.পি.ও সাহেব বললেন, ‘গঞ্জে যে ছোট হাসপাতাল আছে, সেখানেই তবে আমি ডেড বডিগুলোর পোস্ট মর্টেমের ব্যবস্থা করছি প্রয়োজনীয় লোকদের শহর থেকে ডেকে এনে৷ আপনি ঠিকই বলেছেন, এ কাজটা গোপনেই সারা দরকার৷’
খাস্তগীর বললেন, ‘হ্যাঁ, তারপর বাইরের পৃথিবীর কাছে বেশি জানাজানি হওয়ার আগেই এই জলঙ্গীর শ্মশানেই দেহগুলো আমরা দাহ করে ফেলব৷ আপনার পুলিশকর্মীদের জানিয়ে দিন, তাঁরা যেন এ ব্যাপারে বাইরের লোকজনদের কাছে মুখ না খোলেন৷ যথাসম্ভব গোপনীয়তা রেখে কাজ করতে হবে৷ কারণ, ছেলেগুলোর দেহের ব্যাপারে বাইরের পৃথিবীকে বোঝাবার জন্য আমাদের কাছে কোনও বৈজ্ঞানিক যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা নেই৷’
আকাশে শুকতারা ফুটে উঠল এক সময়৷ ভোরের পূর্বাভাস৷ খাস্তগীরের সঙ্গে এস.ডি.পি.ও সাহেবের আলোচনা মোটামুটি শেষ৷ এবার ভোরের আলো ফুটলেই কাজে নেমে পড়বেন সবাই৷ পুলিশকর্তা দাওয়া ছেড়ে নেমে এগলেন তাঁর সহকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়ার জন্য৷ খাস্তগীরের পাশে কিছুক্ষণ নিশ্চুপভাবে বসে থাকার পর মল্লার তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘আমি কী করব?’ খাস্তগীর বললেন, ‘আপনার কোনও চিন্তা নেই৷ আপনি আমার সঙ্গেই থাকবেন৷ বুঝতে পারছি আপনার শরীর, বিশেষত মনের ওপর দিয়ে অনেক ধকল যাচ্ছে৷ মনটাকে শুধু শক্ত রাখুন৷ দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে৷ তবে এটা ঠিক, যে অভিজ্ঞতা আমাদের হল বা যে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি, তা কোনও দিন ভোলা যাবে না৷ কিন্তু কী আর করা যাবে?’
কয়েকদিন ধরে মল্লারে মনে যে উত্তেজনা প্রবাহিত হয়েছে, বিশেষত গতকাল মল্লারের ওপর দিয়ে যে ঝড় গেল তা ইতিপূর্বে কোনও দিন হয়নি৷ আর তা যেন মল্লারের মনকে অল্প সময়ের মধ্যে অনেকটা শক্ত করে তুলেছে বলে তার নিজেরই মনে হল৷ সোহমের মৃত্যুতে সে আর নতুন করে তেমন বেদনা অনুভব করছে না, কারণ সে তো আগেই মৃত ছিল৷ চূর্ণীর জন্য দুশ্চিন্তাটা মল্লারের মাথার থেকে যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তার মনে হল, এ ব্যাপারে যে কোনও ঘটনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে৷
এস.ডি.পি.ও সাহেব উঠে গিয়ে পুলিশকর্মীদের এক জায়গায় জড়ো করে তাদের কর্তব্য বোঝাতে লাগলেন৷ খাস্তগীরের যে সব সহকর্মী শ্মশানের সেই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল, যারা সোহম আর বাচ্চা ছেলেগুলোর লাশ পাহারার দায়িত্বে ছিল, পুলিশ দেহগুলোকে নিয়ে আসাবার সময় তারাও তাদের সঙ্গেই ফিরেছে৷ কিছুটা তফাতে তারাও দাঁড়িয়েছিল৷ মল্লারকে দাওয়াতে বসিয়ে রেখে খাস্তগীর তাঁর লোকদের কাছে উঠে গেলেন, তারপর তিনিও পুলিশকর্তার মতোই এক জায়গাতে বসে তাদের নিয়ে কী সব আলোচনা শুরু করলেন৷ মল্লার চুপচাপ বসে চেয়ে রইল তাদের দিকে৷
শীতকালে ভোরের দিকে আবারও একপ্রস্থ কুয়াশা নামে৷ আর তা অনেক সময় রাতের কুয়াশার চেয়েও গাঢ় হয়৷ আকাশে শুকতারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গেই যেন আবারও কুয়াশা নামতে লাগল৷ মল্লাররা যেখানে বসে রয়েছে অর্থাৎ আশ্রমের নদীর দিকের প্রান্ত থেকে আশ্রমের অন্য জায়গাগুলো যেন মুছে যেতে লাগল মল্লারের চোখ থেকে৷ কুয়াশার চাদরের আড়ালে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগল ছেলেগুলোর থাকার জায়গা। সেই ব্যারাকের মতো ঘরটা, বুনোর রান্নাঘর, তমসাময়ের ঘর ও সব কিছু৷ পুলিশকর্মী বা খাস্তগীররা যেখানে আছেন অর্থাৎ মল্লারের থেকে পঞ্চাশ হাত দূরের জায়গাও যেন ক্রমশ অস্পষ্ট বা ঝাপসা হতে লাগল৷
হঠাৎই একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল মল্লারের৷ প্রথমে তা কীসের শব্দ মল্লার বুঝে উঠতে পারল না৷ এরপর কোথা থেকে যেন কেউ চিৎকার করে উঠল, ‘পালাচ্ছে! পালাচ্ছে! ধর ধর!’ আর এরপরই গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎই একটা প্রচণ্ড শব্দ! একটা গাড়ি যেন কোনও কিছু ভেঙে বেরিয়ে গেল! কুয়াশার জন্য মল্লার প্রথমে কোনও কিছু দেখতে না পেলেও, মুহূর্তের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল চারপাশ৷ দাওয়া থেকে নেমে কুয়াশা হাতড়ে মল্লার বুঝতে পারল সাবই ছুটছে আশ্রমের মূল প্রবেশ পথের দিকে৷ মল্লার পৌঁছে গেল সেখানে৷ বেড়ার তৈরি গেটটা এক পাশে কাত হয়ে হেলে পড়ে আছে৷ উত্তেজিত জটলা তার সামনে৷ খাস্তগীর আর এস.ডি.পি.ও সাহেব ইতিমধ্যে জায়গাটাতে পৌঁছে গেছেন৷ পুলিশকর্তা, মল্লারকে দেখেই বললেন, তাড়াতাড়ি আপনার গাড়ির নাম্বার, মডেল বলুন?
মল্লার বলে দিল সেগুলি৷
খাস্তগীর মল্লারকে বলল, ‘ওঃ, কী ভুল করেছি আমরা! না, ভুল নয়৷ বোকামি৷ সব কিছু খুঁটিয়ে দেখলাম৷ কিন্তু গাড়ির ভিতরটা একবার উঁকি দিয়ে দেখলাম না! আপনার গাড়ির ভিতর কেউ বা কারা লুকিয়ে ছিল! সম্ভবত বুনোই হবে৷ কুয়াশার সুযোগ নিয়ে পালাল!’
মল্লার বলল, ‘গাড়ির ভিতর চূর্ণী ছিল না তো?’
খাস্তগীর বললেন, ‘থাকতে পারেন৷ এমনকী, হয়তো কুয়াশার সুযোগ নিয়ে তমসাময়ও আশ্রমে প্রবেশ করে গাড়িটা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন৷ ঘটনাটা এত আকস্মিক এবং কুয়াশার জন্য এদিকে যে দু’জন লোক বাইরে পাহারাতে ছিল তাঁরাও বুঝে উঠতে পারেনি, গাড়িতে কারা আছে? যদি অপরাধীরা ছাড়া গাড়ির ভিতর অন্য কেউ থেকে থাকেন সে ভয়ে তাঁরা গুলিও চালাতে পারেননি৷’
মল্লার জানতে চাইল, ‘কোন দিকে গাড়িটা পালিয়েছে?’
খাস্তগীর গঞ্জে যাবার রাস্তার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘ওদিকেই৷ তবে নিশ্চয়ই গঞ্জ পর্যন্ত গাড়িটা যাবে না৷ তার আগে রাস্তার যে বাঁকগুলি রয়েছে, ছোটখাটো যে সব রাস্তা এসে গঞ্জে যাবার রাস্তায় মিশেছে, সেগুলিরই কোনও একটি ধরে হয়তো বাংলাদেশের দিকে পালাবার চেষ্টা করবে৷’
পুলিশকর্তা খাস্তগীরকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আপনি নিশ্চিত থাকুন, গাড়িটা পালাতে পারবে না৷ আলো ফুটল বলে৷ দিনের আলোতে কিছুতেই গাড়িটার পালানো সম্ভব নয়৷’—এ কথা বলে এস.ডি.পি.ও সাহেব ওয়াকিটকির মাধ্যমে সব পুলিশ স্টেশনগুলোকে খবর পাঠাতে লাগলেন৷
শুকতারা ম্লান হয়ে এরপর ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করল৷ সূর্যোদয় হল৷ যদিও কুয়াশা ফিকে হতে আরও বেশ কিছুটা সময় লাগল৷ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল সবাই৷ কুয়াশা খানিকটা কেটে গিয়ে মোটামুটি আলো ফুটে উঠবার পর খাস্তগীর পুলিশকর্তাকে বললেন, দিনের আলোতে আর একবার ভালো করে তল্লাশি নিতে হবে৷ আপনার লোকেরা সে কাজ করুক৷ আর আমরা চলুন যাই ওই কালো ঘর আর যে ঘরগুলোতে আগুন দেওয়া হয়েছিল, সে সব জায়গাতে কিছু পাওয়া যায় কি না দেখি।’
খাস্তগীরের কথা মতোই কাজ শুরু হল৷ পুলিশকর্মীরা আশ্রমের সর্বত্র তল্লাশি শুরু করলেন৷ আর খাস্তগীর, এস.ডি.পি.ও কিছু সঙ্গী নিয়ে উপস্থিত হলেন ছাই হয়ে যাওয়া কালো ঘরের সামনে৷ মল্লারও তাঁদের সঙ্গে হাজির হল সেখানে৷ ঘরের কাছে যে বড় ফণিমনসা গাছটা ছিল সেটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে ঝলসানো অবস্থায়৷ আরও একটা জিনিস গাছটার দিকে তাকিয়ে চোখে পড়ল মল্লারের৷ সেই সাপটা পালাতে পারেনি৷ তার পুড়ে যাওয়া শরীরটা কালো ফিতের মতো ঝুলছে গাছটা থেকে৷
খাস্তগীরের নির্দেশ মতো তার সহকর্মীরা কয়েকটা বাঁশের সাহায্যে কালো ঘরের ছাই সরাতে শুরু করলেন৷ না, কোনও পোড়া দেহের সন্ধান মিলল না সেখান থেকে৷ সে ঘরে যদি কোনও অন্য কিছু গোপন জিনিস থেকেও থাকে তবে তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷ তবে যে মাটির বেদিটার ওপর সোহমকে শুইয়ে তার জীবন ফেরানো হয়েছিল, বলা ভালো তার মৃতদেহে অন্য কোনও আত্মার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল, সেই বেদিটা এখনও রয়েছে৷ আগুনের তাপে কালো হয়ে স্থানে স্থানে ফেটে গেছে বেদিটা৷ সেটা একটু পরিষ্কার করে একটু খেয়াল করতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার নজরে এল। বেদিটার ফাটলগুলোর ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে নানা আকৃতির নর করোটি! অর্থাৎ নর করোটি সাজিয়ে তার ওপর মাটি লেপে নির্মাণ করা হয়েছিল তন্ত্রাচারের বেদিটা৷ ব্যাপারটা দেখে খাস্তগীর বললেন, ‘হয়তো আমার অনুমান সত্যি, এই বেদির মধ্যে যাদের করোটি আছে হয়তো বা তাদের আত্মাদেরই প্রবেশ করানো হতো মৃতদেহের শরীরে৷ এই কালো ঘরে আগুন লাগার সঙ্গে-সঙ্গেই সেই অলৌকিক শক্তি বিনষ্ট হয়েছে৷ তাই আবারও মৃতদেহে পরিণত হয়েছে শরীরগুলি৷’
না, আর তেমন কিছু পাওয়া গেল না কালো ঘরের ছাইয়ের মধ্যে৷ তারপর খুঁজে দেখা হল অন্য পোড়া ঘরের ছাইয়ের স্তূপও৷ সে সব জায়গাতেও কিছু মিলল না৷
তল্লাশি শেষ করে পুলিশকর্মীরাও এক সময় ফিরে এসে জানাল, কোথাও কোনও জীবিত অথবা মৃত লোকের সন্ধান মেলেনি৷ খাস্তগীর বললেন, আমার অনুমান চূর্ণী ম্যাডামকে সম্ভবত ওই গাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ হয়তো অজ্ঞান করে অথবা…৷’ কথাটা শেষ করলেন না তিনি৷
রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে, কুয়াশাও কেটে গেছে৷ এস.ডি.পি.ও সাহেব বললেন, ‘এবার আমাকে বডিগুলি নিয়ে রওনা হতে হবে, অনেক কাজ করতে হবে৷’
খাস্তগীর বললেন, ‘হ্যাঁ, আজ আপনার ওপর অনেক দায়িত্ব৷ আমি আমার লোকজন নিয়ে এখানেই থাকব৷ বডিগুলো নিয়ে যাওয়ার আগে চলুন একবার সেগুলো দিনের আলোতে ভালো করে দেখে আসি।’
আশ্রম ছেড়ে জলঙ্গীর পাড়ে বেরিয়ে এল তারা৷ চারপাশে আলো ঝলমল করছে৷ বয়ে চলেছে জলঙ্গী৷ সার সার বেশ কয়েকটা ছোট বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে৷ খাস্তগীরের গাড়িটাও আছে৷
পুলিশকর্তার নির্দেশে একটা বড় গাড়ির ভিতর থেকে মৃতদেহগুলি বার করে একে একে শুইয়ে রাখা হতে লাগল সামনের জমিতে৷ নবজীবন, উজ্জীবন, সঞ্জীবন…মল্লারের চেনা মুখ সব৷ মৃতদেহগুলো বাইরে আনার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগল বাতাসে৷ সব শেষে নামানো হল সোহমের দেহটা। মল্লার ভালো করে তাকাল সোহমের মুখের দিকে৷ তার চোখ দুটো বিস্ফারিতভাবে যেন মল্লারের দিকেই তাকিয়ে৷ তার ফুলে ওঠা মুখে হাঁ-টা খোলা৷ জলে ডোবার সময় এক মুঠো বাতাসের জন্যই কি এমন বড় হাঁ করেছিল সে? মল্লার তাকিয়ে থাকতে পারল না সোহমের সেই মুখের দিকে৷ সে চোখ ফিরিয়ে নিল৷
এস.ডি.পি.ও সাহেব চাপা স্বরে খাস্তগীরকে জিগ্যেস করলেন, ‘এদের আবার জেগে ওঠার সম্ভাবনা আছে নাকি?’
খাস্তগীর জবাব দিলেন, ‘মনে হয় না৷ সবই তো পুরোনো দেহ, দেখছেন, ইতিমধ্যে দেহগুলো কেমন ফুলতে শুরু করেছে? পচন শুরু হয়েছে দেহগুলোতে৷ তবে কিছু ঘটাও বিচিত্র নয়৷ যথাসম্ভব দ্রুত কাজকর্ম মিটিয়ে দেহগুলোর সৎকার করতে হবে৷ যাতে এদের আর জীবিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই না থাকে৷’
সোহম সহ ছেলেগুলোর দেহ কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার তুলে নেওয়া হল গাড়িতে৷ দেহ সমেত কনভয় নিয়ে পুলিশকর্তা রওনা হয়ে গেলেন গঞ্জের দিকে৷
তারা চলে যাবার পর খাস্তগীর তার লোকজন আর মল্লারকে নিয়ে আশ্রমে ঢুকে কয়েকটা পাশাপাশি ঘরের দাওয়াতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসলেন৷ রান্নার সরঞ্জাম গাড়িতে কিছু ছিল৷ তারা তো পিকনিক পার্টি সেজেই তমসাময়ের আশ্রমের ওপর নজর রাখছিলেন৷ একজন চা বানিয়ে আনল, সঙ্গে বিস্কুট৷
চা শেষ করে ঘড়ি দেখলেন খাস্তগীর৷ ইতিমধ্যে সকাল সাড়ে আটটা বাজে৷ তিনি বললেন, ‘পুলিস যত দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করুক না কেন তারা পাঁচ-ছ’ঘণ্টার আগে, বেলা তিনটের আগে ফিরে আসতে পারবে বলে মনে হয় না৷ তারপর এতগুলো দেহ কাঠের চুল্লিতে দাহ করতে অন্ধকার নেমে যাবে৷’
তাই তিনি এরপর তাঁর লোকদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে বললেন৷
সকালের রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে৷ কিন্তু চারপাশের পরিবেশ থমথমে৷ গত রাতে ঘরগুলো যখন আগুনে পুড়ছিল আর লোকজন প্রচণ্ড চিৎকার করছিল তখন সেই যে পাখির দল আতঙ্কে ওড়াউড়ি করছিল তারপর আর তারা আশ্রমের গাছগুলোতে ফিরে আসেনি৷ তাই তাদের ডাক শোনা যাচ্ছে না৷ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে আশ্রম জুড়ে৷
বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর খাস্তগীর বললেন, ‘পুলিশের কাছে কী সংবাদ আসে তা জানার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমার তো কোনও কাজ নেই৷ চলুন, শ্মশানের দিক থেকে একটু ঘুরে আসা যাক৷’
মল্লার আর তাঁর দু’জন সঙ্গীকে নিয়ে খাস্তগীর এরপর আশ্রম ছেড়ে রওনা হলেন শ্মশানের দিকে৷ চারপাশে ঝলমলে আলো৷ জলঙ্গীর জলে ভেসে চলেছে কচুরিপানার ঝাঁক৷ সালতে নিয়ে মাছ ধরতে জলে নেমেছে দু’জন ধীবর৷ প্রতিদিনের মতোই চারপাশটা একইরকম উজ্জ্বল৷ অথচ রাত নামলেই কেমন অদ্ভুত বদলে যায় এ জায়গা৷ অন্ধকার আর কুয়াশার সঙ্গে নেমে আসে সীমাহীন আতঙ্কের পরিবেশ৷
নদীর পাড় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে মল্লাররা শ্মশানে পৌঁছে গেল৷ একইরকম আলোকোজ্জ্বল চারদিকটায়৷ সব কিছু স্পষ্ট দৃশ্যমান৷ ইতস্ততভাবে এখানে-ওখানে পড়ে আছে মাটির হাঁড়ি, পোড়া চিতার কাঠ, শব ঢাকা দেওয়ার সাদা কাপড়ের টুকরো৷ এমন নানা জিনিসপত্র৷ সব শ্মশানেই যেসব জিনিস পড়ে থাকতে দেখা যায়৷
খাস্তগীরের পিছন পিছন মল্লার গিয়ে দাঁড়াল ঠিক সেই জায়গাতে যেখানে তখনও হাড়িকাঠটা পোঁতা আছে৷ কয়েকটা কাগজের ঠোঙাও পড়ে ছিল তার কাছেই৷ একজন লোক ঠোঙাগুলো তুলে নিয়ে খুলল৷ তার মধ্যে কোনটাতে রয়েছে সিঁদুর, কোনটায় তিল, চাল, মধুর শিশি আর অপরিচিত কিছু তন্ত্রসাধনার উপাচার৷ খাস্তগীরের অপর সঙ্গী তাঁকে বলল, ‘স্যার খড়গটা আমরা তুলে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে রেখেছি৷’
খাস্তগীর বললেন, ‘হ্যাঁ, তমসাময়ের মামলা যদি আদালতে ওঠে তখন গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ওটা কাজে আসবে৷’
মল্লার তাকাল হাড়িকাঠটার দিকে৷ তার মন এখন অনেকটাই শক্ত হয়ে উঠেছে৷ ওই হাড়িকাঠেই তো তাকে বলি দেওয়ার কথা ছিল৷ তারপর হয়তো তার মাংস পুড়িয়ে খাবার জন্য অগ্নিকুণ্ডটা জ্বালানো হয়েছিল! আচ্ছা সোহমও কি মল্লারের মাংস খেত?—এ প্রশ্ন মুহূর্তের জন্য মল্লারের মাথায় এল৷ কিন্তু পরমুহূর্তেই মল্লারের মনে হল, গতরাতে সোহম যেভাবে খাঁড়া হাতে মল্লারকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল সে সময় যে অপার্থিব জিঘাংসা ফুটে উঠেছিল তার চোখে মুখে তাতে সুযোগ পেলে সে নিশ্চিতভাবে মল্লারের ঝলসানো মাংস খেত৷ তবে হাড়িকাঠটা দেখে বা কী হতে পারে তা চিন্তা করে এখন আর মল্লার ভয় পেল না৷ বরং সে মনে মনে হেসে বলল, ‘রাখে হরি, মারে কে!’
যে অগ্নিকুণ্ডটা গত রাতে জ্বালানো হয়েছিল সেটা এখন নিভে গেছে৷ জলঙ্গীর বুক থেকে আসা মৃদু বাতাসে মাঝে মাঝে ছাই উড়ছে সেখান থেকে৷ চারপাশটা ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন খাস্তগীর৷ কোথাও কোথাও ধুলো বা ছাইয়ের মধ্যে আঁকা হয়ে আছে গত রাতের ধস্তাধস্তির চিহ্ন৷ কোথাও পড়ে আছে জামা থেকে খসে পড়া ছেঁড়া বোতাম৷ খাস্তগীরের সঙ্গীদের মধ্যে একজন নিজের গলায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ছেলেগুলো ছোট হলে কী হবে, এত জোরে গলা টিপে ধরেছিল যে দম বেরিয়ে যাবার জোগাড়৷ এদিকে ছোট ছেলে বলে গুলি চালাতে পারছি না, আবার মারতেও পারছি না৷ তখন তো এদের আসল পরিচয় ঠিক জানতাম না৷’
খাস্তগীর বললেন, ‘হ্যাঁ, সকলেরই এক অবস্থা হয়েছিল৷ আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে তমসাময় পালাল৷ তবে পুলিশ তো চারপাশে অনুসন্ধান চালাচ্ছে৷ ধরা পড়ে যাবে মনে হয়৷’
এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘দেহগুলো আনার পর দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে৷ অন্তত তিন-চারটে চিতা একসঙ্গে জ্বালাতে হবে যাতে দেহগুলো তাড়াতাড়ি পোড়ানো যায়৷’
খাস্তগীর এরপর আর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার কোমরে গোঁজা ওয়াকিটকিটা যান্ত্রিক শব্দ করে উঠল৷ খাস্তগীর সেটা তাঁর কোমর থেকে খুলে হাতে নিয়ে ‘বলুন?’ বলতেই ওপার থেকে কোনও এক পুলিশকর্মীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল৷ তিনি বললেন, ‘গাড়িটা পাওয়া গেছে স্যার। আশ্রম থেকে সাত কিলোমিটার দূরে জলঙ্গীর একটা বাঁক আছে, সেখানে একদম নদীর ধারেই গাড়িটা পাওয়া গেছে৷ তবে গাড়িতে যে বা যারা ছিল তারা সম্ভবত নদীতে নেমে পালিয়েছে৷ নদী ওই জায়গায় বেশ সরু৷ অনেকটা বড় খালের মতো৷ সাঁতরে নদী পেরোনো যায়৷ এ ধারে পাড়ের কাছে একজোড়া লেডিস চপ্পল পাওয়া গেছে৷ সম্ভবত কোনও লেডিস ছিলেন গাড়িতে৷ এসপি সাহেবকে জানিয়েছি৷ তিনি আপনাকে খবরটা জানাতে বললেন৷ আমি স্পটেই আছি স্যার, অর্থাৎ গাড়ির সামনেই৷’
খাস্তগীর জানতে চাইলেন, ‘গাড়ির ভিতর রক্ত বা ও ধরনের কোনও চিহ্ন মিলেছে?’
ওপাশ থেকে জবাব এল, ‘না, কোথাও রক্ত নেই৷ তবে একটা ভেজা প্লাস্টিক গাড়ির সিটের ওপর পড়ে আছে৷ তাতে আশঁটে গন্ধ আছে৷ সম্ভবত মাছ বা ওই ধরনের কিছু রাখা ছিল ওতে৷’
খাস্তগীর বললেন, ‘ওখানে নদীর দু’পাড়েই তল্লাশি চালান৷ কোনও কিছু ডেভেলপমেন্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন৷’
খাস্তগীরের নির্দেশ শুনে ‘ইয়েস স্যার’ বলে লাইন ছেড়ে দিলেন সেই পুলিশকর্মী৷
খাস্তগীরের হাতে যন্ত্রটা স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘চটি জোড়া চূর্ণী ম্যাডামের হবে বলেই আমার ধারণা৷ তিনি কি সাঁতার জানেন?’
মল্লার জবাব দিল, ‘না, সে সাঁতার জানে না৷ জানলে সোহম জলে পড়ার পর সে-ই আগে ঝাঁপ দিত তাকে বাঁচানোর জন্য৷’
খাস্তগীর বললেন, ‘তবে তাকে কি জোর করে জলে টেনে নামানো হল? ডুবিয়ে দেওয়া হল? কে করল এই কাজ? বামন বুনো৷ তমসাময় নাকি তৃতীয় কেউ? যে গুরুদেবের কথা তমসাময় বলেছেন তিনি নয় তো?’
মল্লারের মন এখন অনেকটাই শক্ত হয়ে উঠেছে৷ খাস্তগীরের কথা শুনে সে বলল, ‘আশা করি চূর্ণীকে আমি জীবিত দেখতে পাব৷ তবে কোনও দুর্ঘটনা যদি ঘটে থাকে তবে তার জন্য আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত আছি৷’
তার কথা শুনে খাস্তগীর তার পিঠে হাত রেখে আশ্বাসের ভঙ্গীতে বললেন, ‘হ্যাঁ, যে-কোনও ঘটনার জন্যই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে৷ আমি আপনার পাশে আছি৷’
শ্মশানের চারদিকে ঘুরে আশ্রমে ফেরার আগে মল্লাররা এসে দাঁড়াল শ্মশান সংলগ্ন নদী ঘাটের সামনে৷ ঘাট মানে বাঁধানো কিছু নয়৷ জমিটা শুধু ঢালু নেমে গেছে জলের বুকে৷ এখানে নেমে শবযাত্রীরা অনেক সময় মৃতদেহর অস্থি বিসর্জন দেয়৷ চিতার শেষ স্ফুলিঙ্গ নেভার পর জল নেয় ইত্যাদি কাজকর্ম করে৷ জায়গাটা বেশ কিছুটা অপরিষ্কারও বটে৷ মেটে হাঁড়ির ভাঙা টুকরো, পচা ফুল, মৃতের তোষক-বালিস পড়ে আছে জলকাদার মধ্যে৷ খাদ্য অনুসন্ধানে দুটো রোগা নেড়ি কুকুর কোথা থেকে এসে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই কাদার মধ্যে৷ মল্লারদের দিকে তাকিয়ে তারা লেজ নাড়তে লাগল খাবারের আশায়৷ খাস্তগীরের এক সঙ্গীর কাছে একটা বিস্কুটের প্যাকেট ছিল। লোকটা সেই বিস্কুটের প্যাকেটটা খুলে একটা একটা করে বিস্কুট ছুঁড়ে দিতে লাগল তাদের দিকে৷ বিস্কুটগুলো মুখ দিয়ে লুফতে লাগল কুকুর দুটো৷ হঠাৎ একটা বিস্কুট গিয়ে পড়ল কাদায় পড়ে থাকা একটা তোষকের ওপর। একটা কুকুর সেটা নেওয়ার জন্য এগলো ঠিকই, কিন্তু তোষকটার কাছে এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ দ্বিতীয় কুকুরটাও একই কাণ্ড করল৷ প্রথমটার পাশে এসে সতৃষ্ণভাবে চেয়ে রইল জলকাদার মধ্যে পড়ে থাকা ছেঁড়া তোষকের ওপর থাকা বিস্কুটটার দিকে৷
বেশ কয়েক মুহূর্ত এইভাবে কেটে গেল৷ এরপর কুকুর দুটো একবার তাকাতে লাগল মল্লারদের দিকে৷ আর একবার তোষকের ওপর পড়ে থাকা বিস্কুটের দিকে৷
কুকুর দুটো তোষকের থেকে বিস্কুট তুলে নিচ্ছে না কেন? খাস্তগীরের মনে প্রশ্নের উদয় হল৷ তিনি তাঁর সহকর্মীর কাছ থেকে একটা বিস্কুট নিয়ে ইচ্ছে করেই সেটা ছুঁড়ে ফেললেন তোষকের ওপর৷ দ্বিতীয় বিস্কুটটা তোষকের ওপর পড়ার পর কুকুর দুটো তোষকের দিকে দু’পা এগিয়ে আবার পিছিয়ে এল৷ খাস্তগীর সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই তোষকের আড়ালে কিছু একটা আছে এবং সেটা জীবন্ত৷ যে কারণে ওরা এগতে ভয় পাচ্ছে৷ ওরা গন্ধের মাধ্যমে তার উপস্থিতি টের পাচ্ছে৷’
মল্লার বলল, ‘সাপ নয় তো?’
খাস্তগীর বললেন, ‘হতে পারে৷ দেখা যাক কী আছে?’
কথাটা বলেই তিনি ঢাল বেয়ে নীচে জল কাদার মধ্যে নেমে পড়লেন৷ তাঁকে অনুসরণ করল তাঁর সঙ্গী দু’জন ও মল্লার৷ সন্তর্পণে তারা কাদা ভেঙে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল তোষকটার কাছে৷ তার নীচে কোনও কিছু আছে কি না তা বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না৷ খাস্তগীর চোখের ইশারা করলেন সঙ্গীদের৷ তারা দু’জন ঝুঁকে পড়ে মুহূর্তের মধ্যে তোষকের দু’প্রান্ত ধরে তুলে নিয়ে সেটা ছুড়ে দিল জলের মধ্যে৷ আর এর পরই অবাক হয়ে গেল সকলে৷ তাদের চোখের সামনে কাদার মধ্যে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন তমসাময়!
তাঁর চোখে প্রবল বিস্ময় ফুটে উঠেছে মল্লারদের দেখে৷
খাস্তগীরের সঙ্গীরা এরপর আর দেরি করলেন না৷ তমসাময়ের হাত দুটো দু’পাশ থেকে ধরে হ্যাঁচকা টানে তাঁকে দাঁড় করালেন৷ খাস্তগীরের হাতে উঠে এসেছে তাঁর সার্ভিস রিভলভার৷ সেটা সোজা তাক করা তমসাময়ের বুকের দিকে৷ তমসাময়ের মুখ দেখে মল্লারের মনে হল যে তিনি হতচকিত হয়ে গেছেন এভাবে ধরা পড়ে যাওয়াতে৷ সরু নাইলনের ফিতে দিয়ে তমসাময়ের হাত দুটো বেঁধে দেওয়া হল৷ তারপর তাঁকে ধাক্কা মারতে মারতে জল কাদা থেকে ওপরে তোলা হল৷ পুলিশকর্মীদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য ভালো কৌশল অবলম্বন করেছিলেন৷ কিন্তু শেষরক্ষা হল না৷ কাকতালীয়ভাবে ধরা পড়ে গেলেন তিনি৷
খাস্তগীর তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘এবার নিশ্চয়ই সব কথা বলবেন আপনি?’
প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর খাস্তগীরের প্রশ্ন শুনে যেন ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে৷ তিনি বললেন, ‘না, আমি কিছুই বলব না৷’
মল্লার আর নিজের উত্তেজনা চাপতে না পেরে তমসাময়কে প্রশ্ন করল, ‘বলুন চূর্ণী কোথায়? তাকে কে ধরে নিয়ে গেছে?’
প্রশ্নটি শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তমসাময় হেসে উঠে বললেন, ‘তাহলে আপনারা এতজন মিলেও তাকে রক্ষা করতে পারলেন না?’
মল্লার এবার আর সহ্য করতে পারল না এই বিদ্রুপ৷ নিজের অজান্তেই সে ঘুসি চালিয়ে দিল তমসাময়ের মুখ লক্ষ করে! জীবনে এই প্রথমবার সে কারও গায়ে হাত তুলল৷
ঘুসি খেয়ে তমসাময় মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু খাস্তগীরের লোক দু’জন তাকে ধরে ফেলল৷ তমসাময়ের ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত চোঁয়াতে শুরু করল। মল্লার যে তমসাময়ের গায়ে হাত তুলবে এ ব্যাপারটা তিনি আশা করেননি৷ নিষ্পলক চোখে কয়েক মুহূর্ত তিনি মল্লারের দিকে তাকিয়ে থেকে জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁটের রক্ত চেটে নিয়ে বললেন, ‘আমার এই রক্তের দাম আপনাকে দিতে হবে৷ গুরুদেব সব দেখছেন, জানছেন৷’
খাস্তগীর ঝাঁঝিয়ে উঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কে আপনার গুরুদেব?’
তমসাময় ঘাবড়ালেন না৷ বরং আবারও হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে৷ বললেন, ‘ওই যিনি আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করতে হয়, যাঁর নির্দেশে আমি পরিচালিত হই, যাঁর অসীম তন্ত্র ক্ষমতা৷ তিনিই আমার গুরুদেব৷’ তমসাময়ের কথা শুনে মল্লাররা বুঝতে পারল তিনি তাঁর গুরুদেবের নাম পরিচয় এই মুহূর্তে প্রকাশ্যে আনতে চান না৷ খাস্তগীর তাঁকে বললেন, ‘আপনার গুরুদেব কোনও প্রেতাত্মা হোক বা তান্ত্রিক, দেখি আপনি ও আপনার অপকর্মের স্যাঙাত বুনোকে কীভাবে রক্ষা করেন? সেই বামনটাও ধরা পড়ল বলে৷ পুলিশের ‘থার্ড ডিগ্রি’ কাকে বলে জানেন? বড় বড় জঙ্গিরা পর্যন্ত তাতে মুখ খোলে, আপনারা তো তাদের কাছে তুচ্ছ!’
খাস্তগীরের কথার জবাবে তমসাময় শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনারা আমার কিছুই করতে পারবেন না৷ গুরুদেব আমাকে রক্ষা করবেন৷ তাঁর প্রতি আমার বিশ্বাস আছে৷’
খাস্তগীর দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘ঠিক আছে দেখা যাবে৷’
শ্মশান থেকে তমসাময়কে নিয়ে এরপর আশ্রমে ফেরার পথ ধরল মল্লাররা৷ সারাটা পথ তমসাময়ের কাঁধ দুটো শক্ত করে চেপে ধরে থাকল খাস্তগীরের লোকেরা৷
তমসাময়কে ফিরিয়ে আনা হল তাঁর আশ্রমে৷ একটা ফাঁকা ঘরের মধ্যে তাঁকে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দু’জন লোককে পাহারায় মোতায়েন করা হল সেখানে৷
বেলা দশটা বেজে গেছে৷ তমসাময়কে ঘরের ভিতর আটক করার পর খাস্তগীর ওয়াকিটকির মাধ্যমে যোগাযোগ করলেন এস.ডি.পি.ও-র সঙ্গে৷ তমসাময়কে ধরার ব্যাপারটা খাস্তগীর জানালেন তাঁকে৷ প্রত্যুত্তরে পুলিশকর্তা জানালেন, বুনোর খোঁজে জলঙ্গীর দু’পাড়েই তল্লাশি চলছে৷ সম্ভবত সেও ধরা পড়ে যাবে৷ তবে তিনি জানালেন যে পোস্টমর্টেমের জন্য ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট এদের এসে পৌঁছতে বেলা বারোটা বাজবে৷ সব কাজ মিটিয়ে ফিরে আসতে সম্ভবত সন্ধ্যা হয়ে যাবে৷’
খাস্তগীর কথাটা শুনে তাঁকে বললেন, কিছু পুলিশকর্মী পাঠিয়ে শ্মশানের দাহকাজটা দিনের আলো থাকতে থাকতে মিটে গেলেই ভালো হতো৷ রাত নামলেই ওখানের চারপাশের পরিবেশ কেমন যেন বদলে যায়৷ সব কিছু যেন অদ্ভুত হয়ে ওঠে৷ কিন্তু কী আর করা যাবে? সব তো আর নিজেদের হাতে থাকে না৷’
মল্লার জানতে চাইল, ‘তমসাময়কে নিয়ে কী করবেন?’
খাস্তগীর বললেন, ‘বডিগুলো পোড়ানো হয়ে গেলে ওকে নিয়ে আমরা জেলা সদরে ফিরব৷ কাল ওকে কোর্টে তুলে তারপর আমাদের বা পুলিশের কাস্টডিতে নেব ইন্টারোগেশন করার জন্য৷ চেষ্টা করব সত্যিটা জানার৷ এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে আপনার বান্ধবীকে খুঁজে বের করা৷’
খাস্তগীর এরপর আর বিশেষ কিছু বললেন না৷
সময় এগিয়ে চলল৷ একবার খাস্তগীর একজনকে পাঠালেন তমসাময় কী করছেন তা দেখে আসার জন্য৷ লোকটা কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভাবলেশহীনভাবে বসে আছেন তমসাময়৷
কথাটা শুনে খাস্তগীর মল্লারকে বললেন, ‘তমসাময়ের নিশ্চিত বিশ্বাস তার গুরুদেব তাঁকে রক্ষা করবেন৷ সে জন্যই লোকটা এমন ভাবেলেশহীন৷’
দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল৷ একজন লোক এসে ডাল-ভাত-সব্জি দিয়ে গেল খাস্তগীর আর মল্লারকে৷ খাওয়া সেরে নিল তারা৷ মল্লার প্রতীক্ষা করতে লাগল যদি চূর্ণীর সম্পর্কে কোনও খবর আসে সে জন্য৷ নিস্তব্ধ থমথমে দুপুর৷ শুধু নদীর পাড় থেকে মাঝে মাঝে একটা কাক ডাকছে৷ তা যেন চারপাশের নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে৷
দুপুরও শেষ হল এক সময়৷ ঠিক চারটে নাগাদ খাস্তগীরের ওয়াকিটকি শব্দ করে উঠল৷ এস.ডি.পি.ও-র কল৷ তিনি জানালেন, সব কাজ মিটতে চলেছে৷ আশ্চর্যের ব্যাপার যে বাচ্চাদের কয়েক জনের ভিসেরা ইত্যাদি কিছুই নেই! সম্ভবত আগেই একবার তাদের পোস্টমর্টেম হয়েছিল৷ শ্মশানে পৌঁছতে সাড়ে পাঁচটা হবে৷ তবে চূর্ণী বা বুনোর এখনও কোনও সন্ধান মেলেনি৷ পুলিশ তাদের খোঁজ চালাচ্ছে৷
শীতের বিকাল দ্রুত ফুরিয়ে যায়৷ আলো ধীরে ধীরে নরম হতে শুরু করল৷ মল্লারের মনে পড়ল এমনই এক শীতের বিকালে মল্লাররা তিনজন প্রথম এসে উপস্থিত হয়েছিল তমসাময়ের এই নবজীবন আশ্রমে৷ তারা দেখতে পেয়েছিল শেষ বিকালের আলোতে দাওয়াতে সার বেঁধে বসে আছে ছেলের দল৷ তখন যদি ঘুণাক্ষরে জানতে পারত বাচ্চা ছেলেগুলোর আসল পরিচয় তবে আজ আর এ অবস্থা ঘটত না। এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারের ঘটনা স্রোতের মধ্যে দিয়ে না গেলে মল্লার বা অন্য কারও পক্ষেই কোনওদিন ঘটনাটা জানা সম্ভব হতো না৷ হয়তো বা একেই বলে ভবিতব্য বা নিয়তি৷ যা ঘটার তা ঘটবেই, অবিশ্বাস্য হলেও ঘটবে৷ এ সব নানান কথা ভাবতে লাগল মল্লার৷ আর খাস্তগীর বার বার ঘড়ি দেখতে লাগলেন৷ ঘড়ির কাঁটা যখন পাঁচটা ছুঁল তখন দেহগুলো ফেরার প্রতীক্ষায় তিনি একটু অস্থিরভাবেই পায়চারি করতে লাগলেন৷
সূর্য ডুবে গেছে৷ অন্ধকার নামতে শুরু করবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই৷ আশ্রমের ঘরগুলোর দাওয়াতে ইতিমধ্যেই ছায়া ঘনাতে শুরু করেছে৷
সাড়ে পাঁচটা বাজার আগেই খাস্তগীরের ওয়াকিটকি যান্ত্রিক শব্দ করে উঠল৷ ওপাশ থেকে এস.ডি.পি.ও সাহেব জানালে, আর মিনিট দশেকের মধ্যেই শ্মশানে পৌঁছে যাচ্ছেন তিনি৷ খাস্তগীর জানতে চাইলেন, চূর্ণী বা বুনোর কোনও খোঁজ মিলেছে কি না৷ জবাবে পুলিশকর্তা জানালেন, যেখানে গাড়িটা পাওয়া গিয়েছিল, তার থেকে কিছুটা দূরে নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গাতে নাকি আগুন জ্বালানো হয়েছিল, এবং সেখানে একটা আধপোড়া শোলমাছ মিলেছে!
অন্ধকার নামতে শুরু করেছে৷ এস.ডি.পি.ও সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে খাস্তগীর তাঁর লোকেদের এক জায়গাতে জড়ো করলেন৷ তিনি তাঁদের বললেন, ‘যতক্ষণ না আমরা শবদেহগুলো পুড়িয়ে জলঙ্গীর পাড় ছেড়ে রওনা হচ্ছি ততক্ষণ প্রতি মুহূর্ত সতর্ক থাকতে হবে৷ আর যদি আমরা গতকালের মতো আকস্মিক কোনও বিপদের সম্মুখীন হই তবে গুলি চালাতে দ্বিধা করবেন না৷’
তাঁর সহকর্মীদের একজন জানতে চাইলেন, ‘তমসাময় কি এখানেই ঘরবন্দি অবস্থাতে এখন থাকবে?’
খাস্তগীর বলেন, ‘না, তাঁকে আমাদের সঙ্গে এখন শ্মশানে নিয়ে যাব৷ ওঁর হাত যেমন বাঁধা আছে তেমনই থাকবে৷ কোমরে একটা দড়িও পরাবেন ঘর থেকে বাইরে বের করার আগে৷ তাঁর সাধের মৃতদেহগুলো যখন উনি পুড়তে দেখবেন তখন মনে একটা মানসিক চাপ তৈরি করবে৷ যার ফলে পরবর্তীকালে ওঁকে ইন্টারোগেট করতে আমাদের সুবিধা হতে পারে৷ তাছাড়া…৷’ এই বলে থেমে গিয়ে তিনি এরপর সহকর্মীদের নির্দেশ দিলেন, ‘ওঁকে গিয়ে নিয়ে আসুন৷ এখনই শ্মশানের দিকে যাব আমরা৷ ওঁরা প্রায় পৌঁছে গেছেন৷’
খাস্তগীরের নির্দেশ পালন করতে কয়েকজন এগল তমসাময় যে ঘরে আটক সেদিকে৷ মল্লার খাস্তগীরের পাশে গিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘তাছাড়া’ কী? আপনি কী বলতে যাচ্ছিলেন?’
খাস্তগীর একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তাছাড়া আমি দেখতে চাই তমসাময়ের গুরুদেব তাঁকে রক্ষা করার জন্য আসেন কি না? শ্মশানের কাজ মিটলেই তো তমসাময়কে নিয়ে জলঙ্গীর অন্ধকার ছেড়ে শহরের দিকে রওনা হব।’
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তমসাময়কে কোমরে দড়ি বাঁধা আবস্থায় হাজির করানো হল৷ তাঁর মুখ ভাবলেশহীন৷ ঠিক এই সময় পরপর বেশ কয়েকটা গাড়ির শব্দ শুনে মল্লার বুঝতে পারল এস.ডি.পি.ও সাহেব লাশগুলো নিয়ে ফিরলেন৷ জলঙ্গীর পাড় ঘেঁষে পুলিশের গাড়িগুলো সার বেঁধে এগচ্ছে শ্মশানের দিকে৷ দড়ি বাঁধা তমসাময় ও সহকর্মীদের নিয়ে খাস্তগীর রওনা হলেন শ্মশানে যাওয়ার জন্য৷ আর তাদের সঙ্গে মল্লারও চলল৷
আশ্রমের বাইরে বেরিয়ে নদীর পাড় বরাবর শ্মশানের দিকে হাঁটতে লাগল তারা৷ প্রথমে কয়েকজন লোক৷ তারপর দড়ি বাঁধা তমসাময়৷ দু’জন লোক তমসাময়ের কোমরের মোটা দড়িটাকে দু’পাশ থেকে ধরে রেখেছে৷ তমসাময়ের পালাবার কোনও উপায় নেই৷ তমসাময়ের ঠিক পিছনে খাস্তগীর আর মল্লার৷ আর সব শেষে আরও কয়েকজন লোক৷
চারপাশে অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে জলঙ্গীর জলও কালো হয়ে এসেছে৷ নদীর ওপারটা এখন অস্পষ্ট৷ মল্লাররা শ্মশানের কাছে পৌঁছবার আগেই অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠল৷ হঠাৎ তমসাময় তাঁর পিছনে থাকা খাস্তগীর আর মল্লারের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনাদের জলঙ্গীর অন্ধকারে হাঁটতে অসুবিধা হলে বললেন৷ আমি অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব৷ আমি অন্ধকারে দেখতে পাই৷’
মল্লার বুঝতে পারল তমসাময়ের কথার মধ্যে স্পষ্ট বিদ্রূপ ফুটে উঠল তাঁদের প্রতি৷
তবে খাস্তগীরও অভিজ্ঞ লোক৷ তিনিও কথা হজম করার পাত্র নন৷ তমসাময়ের কথা শুনে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, অন্ধকারের জীবরা অন্ধকারে ভালো দেখতে পায় জানি৷ যেমন জলঙ্গীর শ্মশানের শিয়ালরা৷ আপনি গ্রে-হাউন্ড কুকুরের নাম শুনেছেন? শক্তিধর দানবীয় আকৃতির কুকুর৷ একাই যে একশো শিয়ালকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে৷ ‘গ্রে-হাউন্ড’ নামে একটা সরকারি কমান্ডো বাহিনী আছে৷ যে বাহিনীতে আমি বেশ কিছুকাল ছিলাম৷ যতই অন্ধকার হোক, আমি শ্মশান পর্যন্ত আপনাকে ঠিক নিয়ে যেতে পারব৷’
এরপর তাঁরা দু’জন আর কেউই কোনও কথা বললেন না৷ তবে মল্লারের তাঁদের দু’জনের কথা শুনে মনে হল তাঁরা যেন পরস্পরের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন৷ অন্ধকার হাতড়ে তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্মশানে উপস্থিত হল৷ ঠিক সেই সময় গাঢ় অন্ধকার নেমে এল জলঙ্গীর পাড়ে৷ ইতিমধ্যে যেখানে এস.ডি.পি.ও সাহেব তাঁর কর্মীদের নিয়ে পৌঁছে গেছেন৷
এ অঞ্চলে ইলেকট্রিসিটি নেই৷ হয়তো বা জেনারেটরেরও ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি৷ তবে বেশ কয়েকটা হ্যাজাকের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ যদিও তাতে শ্মশানের মাঝখানে মাত্র কিছুটা অংশের অন্ধকার দূর হয়েছে৷ পুলিশকর্তা আগেই কিছু পুলিস কর্মীকে এখানে পাঠিয়েছিলেন৷ তারা তিনটে চিতা সাজিয়ে ফেলেছে৷ লাশগুলোও ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে নামিয়ে পরপর মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে৷ সাদা কাপড়ে মোড়া পোস্টমর্টেম করা লাশ৷ তার মধ্যে একটা লাশ আকারে বড়৷ মল্লার বুঝতে পারল সেটা সোহমের দেহ৷
মল্লাররা শ্মশানে প্রবেশ করার পর খাস্তগীরের নির্দেশে তমসাময়কে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে খাস্তগীর আর মল্লারের কিছুটা তফাতে এক জায়গাতে দাঁড় করানো হল৷ এস.ডি.পি.ও সাহেব মল্লারদের কাছে এগিয়ে তমসাময়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে খাস্তগীরকে প্রথমে জিগ্যেস করলেন, ‘লোকটার পেট থেকে কিছু কথা বেরোল?’
খাস্তগীর জবাব দিলেন, ‘না, এখনও কিছু বলেনি৷ মনের জোর আছে লোকটার৷ পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে গিয়ে দেখতে হবে কতক্ষণ সে জোর থাকে?’
এস.ডি.পি.ও সাহেব বললেন, ‘দেখা যাক ওই বুনো আর চূর্ণীর খোঁজ কখন মেলে? পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে৷’
খাস্তগীর এরপর বললেন, ‘তাহলে আর দেরি করে লাভ নেই৷ তিন ঘণ্টা সময় তো লাগবে৷ কাজ মিটিয়ে রাত ন’টায় আমরা জেলা সদরে রওনা হব৷’
খাস্তগীর আর পুলিশকর্তার নির্দেশে এরপর কাজ শুরু করে দিল অন্যরা৷ খাস্তগীর আর এস.ডি.পি.ও-র পুলিশকর্মীরা মিলিয়ে প্রায় তিরিশ জন মতো লোক৷ তাদের একটা অংশ বৃত্তাকারে চিতা আর লাশগুলোর চারদিকে ঘিরে দাঁড়াল৷ সেই বৃত্তের মাঝে মল্লাররা আর তমসাময়ও আছে৷ দুটো বেশ বড় আকারের চিতা আর একটা কাঠের চিতা সাধারণ আকৃতির৷ পুলিশকর্মীদের বাকি অংশ দুটো বড় চিতায় ছেলেদের লাশগুলো তোলার পর তৃতীয় চিতাটায় সোহমের লাশটা তোলা হল৷ তা দেখে নিজের অজান্তেই যেন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মল্লারের বুক থেকে৷ লাশগুলো চিতায় তোলার পর আবার তাদের ওপর কাঠ চাপিয়ে বেশ কয়েকটা জ্যারিকেন থেকে কেরোসিন তেল ঢেলে দেওয়া হল চিতার ওপর যাতে দ্রুত আগুন লাগানো যায় সে জন্য৷
কয়েক মুহূর্ত বিরতি৷ খাস্তগীর এরপর ইঙ্গিত করলেন চিতাগুলোতে আগুন দেওয়ার জন্য৷ আগুন জ্বালানো হল প্রথমে একটা বড় চিতাতে৷ মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়তে লাগল চিতা জুড়ে৷ এরপর দ্বিতীয় চিতাটাতেও আগুন লাগানো হল৷ সেদিকে তাকিয়ে এই প্রথম একবারের জন্য একটা যন্ত্রণাক্লিষ্ট আর্তনাদ বেরিয়ে এল তমসাময়ের মুখ থেকে৷ তা শুনে মল্লারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা খাস্তগীরের ঠোঁটের কোণে যেন আবছা হাসি ফুটে উঠল৷ তবে তমসাময়ের গলা থেকে আর্তনাদ শোনা গেল ওই একবারই৷ তিনি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন চিতা দুটোর দিকে৷ যেখানে জ্বলতে শুরু করেছে ছেলেগুলোর দেহ৷ যাদের শরীরে পুনরায় আত্মার প্রবেশ ঘটিয়েছিলেন তিনি৷ তাদের নামকরণ করেছিলেন নবজীবন, সঞ্জীবন…
ছেলেগুলোর চিতার আগুন লাগাবার পর পুলিশকর্মীরা তৃতীয় চিতাটায় আগুন লাগাবার জন্য এগলো৷ যেখানে শোয়ানো আছে সোহমের লাশ৷
ঠিক এই সময় হঠাৎ একটা চিৎকার ভেসে এল—‘আমাকে যেতে দাও ওর কাছে, শেষবারের মতো একবার ওর মুখটা দেখতে দাও৷’
চিৎকারটা শুনেই যারা সোহমের চিতায় অগ্নি সংযোগ করতে যাচ্ছিল তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ শব্দের উৎস বোঝার জন্য সবাই তাকাল চারপাশে৷
কয়েক মুহূর্তের ব্যবধান, আবার নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও৷ একবার অন্তত যেতে দাও সোহমের কাছে৷’
শব্দটা ভেসে এল যেন শ্মাশানের গায়ের নদীর পাড় থেকে৷ মল্লার বলে উঠল, ‘এ যে চূর্ণীর গলা! চূর্ণী তবে বেঁচে আছে৷’
খাস্তগীর, মল্লার সহ তার কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে শব্দের উৎস লক্ষ্য করে এগতে যাচ্ছিলেন নদীর পাড়ের দিকে, কিন্তু তাদের সে পর্যন্ত পৌঁছবার দরকার হল না৷ তার আগেই জলঙ্গীর অন্ধকার থেকে পাড়ে উঠে এল দুটো ছায়ামূর্তি৷ কিছুটা এগিয়ে এসে মল্লারদের চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করল তারা! চূর্ণী আর বামন বুনো৷ এভাবে হঠাৎ তাদের আত্মপ্রকাশে চমকে উঠল সবাই৷
বুনোর পরনে একটা রক্তাম্বর, হাতে একটা মাছ ধরার তীক্ষ্ম ফলাযুক্ত বর্শা বা কোঁচ৷ সেটা ঠেকানো আছে চূর্ণীর পাঁজরে৷ বুনো আর চূর্ণী, দু’জনের শরীর থেকেই জল ঝরছে৷ যেন জলের ভিতর থেকে উঠে এল তারা৷ চূর্ণীর মুখে যন্ত্রণার ছাপ, হয়তো বা বুনো চূর্ণীর পাঁজরে কোঁচের তীক্ষ্ম ফলাটা দিয়ে চাপ দিচ্ছে বলে৷ তাদের দেখামাত্র খাস্তগীরের সঙ্গীরা ও পুলিশ কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে যাচ্ছিল, কিন্তু বুনো চিৎকার করে বলে উঠল, ‘কেউ আমাদের কাছে এলে, আমাকে ধরার চেষ্টা করলে, এখনই এই মেয়েটার বুকে বল্লম ঢুকিয়ে দেব৷’
বুনোর কথা শুনে খাস্তগীর হাতের ইশারায় সবাইকে থামতে বললেন৷ থেমে গেল সবাই৷
চূর্ণী এরপর আবারও ককিয়ে উঠে বুনোকে বলল, ‘ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে৷ আমি শেষবারের মতো একবার সোহমের কাছে যাই…৷’
এবার চূর্ণীর আর্তনাদ শুনে বুনো উপস্থিত সকলের উদ্দেশে বলে উঠল, ‘মেয়েটাকে আমি ছাড়তে পারি যদি তোমরা তমসাকে ছেড়ে দাও৷’
মল্লাররা যেখানে তার কিছুটা তফাতে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তমসাময়৷ মল্লার, খাস্তগীর, পুলিশকর্তা—সবাইকে অবাক করে দিয়ে তমসাময় এবার বুনোর উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘গুরুদেব আপনি এসেছেন৷ আমি জানতাম আপনি আমাকে ঠিক রক্ষা করবেন৷’
বুনো তমসাময়কে জবাব দিল, ‘তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলেই তো মেয়েটাকে নিয়ে এখানে এলাম৷ নইলে কখন ওকে শেষ করে দিতাম৷’
হতভম্ব মল্লাররা এবার বুঝতে পারল তমসময়ের তন্ত্রসিদ্ধ গুরুদেব এই বুনোই৷ নিজের পরিচয় অন্তরালে রাখার এবং বাইরের লোককে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সে তার শিষ্য তমসাময়কেই তাঁর গুরুদেব, আশ্রয়দাতা বানিয়ে রাখত৷
বুনো এরপর কর্কশ কণ্ঠে মল্লারদের উদ্দেশে বলল, ‘মেয়েটার জীবন যদি বাঁচাতে চাও, তবে তমসাকে ছেড়ে দাও৷’
খাস্তগীর এবার বুনোকে বললেন, ‘এভাবে কিন্তু তুমি পালিয়ে বাঁচতে পারবে না৷ তার চেয়ে মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ কর৷ আদালতে যা বিচার হওয়ার তা হবে৷ তোমাদের জেল হলেও প্রাণে বেঁচে যাবার সম্ভাবনা থাকবে৷’
বুনো কথাটা শুনে বলল, ‘ভালো চাও তো এখনই তমসার দড়ি খুলে দাও৷ নইলে তোমাদের চোখের সামনে মেয়েটা মরবে৷’—এই বলে বুনো সম্ভবত কোঁচটা দিয়ে চূর্ণীর পাঁজরে চাপ দিল৷ চূর্ণী ককিয়ে উঠে মল্লারদের উদ্দেশে বলল, ‘ও যা বলছে তাই কর৷ দোহাই তোমাদের, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, ভীষণ লাগছে!’
খাস্তগীর, এস.ডি.পি.ও সাহেব সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলেন চূর্ণী আর বুনোর দিকে৷ দুটে চিতা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে৷ চিতার আগুনের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে৷ বুনোর মুখেও পড়েছে সেই আলো৷ তাঁর চোখ দুটো হিংস্র শ্বাপদের মতো জ্বলছে৷ মল্লারদের প্রতি যেন তীব্র ঘৃণা বর্ষিত হচ্ছে বুনোর চোখ দিয়ে৷
বুনো আবারও কোঁচের খোঁচা দিল চূর্ণীর পাঁজরে৷ আর্তনাদ করে উঠল চূর্ণী৷ মল্লার আর এ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে খাস্তগীরকে বলল, ‘তমসাময়কে ছেড়ে দিন, নইলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে৷’
খাস্তগীরও সম্ভবত বুঝতে পারলেন এই হিংস্র প্রকৃতির তন্ত্রসাধক শেষ পর্যন্ত কোনও ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে৷ চূর্ণীর নিরাপত্তার ব্যাপারটাকে এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন৷ তাই একটু ইতস্তত করে খাস্তগীর শেষ পর্যন্ত তাঁর লোকেদের নির্দেশ দিলেন, ‘ওর দড়ি খুলে দাও৷’ তাঁর নির্দেশ পালন করে দু’জন লোক তমসাময়ের কোমরের দড়ি আর হাতের বাঁধন খুলতে শুরু করল৷ মুক্ত হয়ে গেলেন তমসাময়৷ তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠল মুক্তির উল্লাস৷
বুনো আর চূর্ণী নদীর পাড়ের কাছাকাছি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এক ছুটে গিয়ে উপস্থিত হলেন তিনি৷
খাস্তগীর বুনোকে বললেন, ‘এবার তবে ওনাকে ছেড়ে দিন৷’
বুনো আর তার শিষ্য তমসাময়ের মুখে যেন এবার ধূর্ত হাসি ফুটে উঠল৷ বুনো তার হাতের কোঁচটা তমসাময়ের হাতে ধরিয়ে দিল৷ তিনি এবার সেটার ফলা সারাসরি চেপে ধরলেন চূর্ণীর বুকের মাঝখানে৷ বুনো বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, মেয়েটাকে ছেড়ে দেব ঠিকই৷ তবে তা আমরা জলে নেমে দূরে চলে যাবার পর৷ আবারও বলছি, ‘কেউ একদম নড়বে না৷ আমাদের যেতে দাও৷ আবারও বলছি, আমরা যেমন মৃতদেহে জীবন ফেরাতে পারি তেমন নিতেও পারি৷’
একটা সামান্য মাছ ধরার বর্শা যেন স্তব্ধ করে রাখল আগ্নেয়াস্ত্রধারী এতগুলো লোককে৷ মল্লারদের দিকে চোখ রেখেই এরপর চূর্ণীর বুকে বল্লম ঠেকিয়ে তাকে নিয়ে বুনো আর তমসাময় পিছু হঠতে শুরু করল জলঙ্গীর অন্ধকার জলে নেমে পড়ার জন্য৷
ঠিক এমন সময় চারপাশ কাঁপিয়ে হঠাৎই শিয়ালের দল ডেকে উঠল৷ তারা তিনজন তখন নদীর ঢালের গায়ে পৌঁছে গেছে৷ আলোক বৃত্তের বাইরে তারা। অস্পষ্ট তাদের অবয়ব৷ বুনো আর তমসাময় এবার পিছন ফিরে চূর্ণীকে নিয়ে জলে নেমে যাচ্ছিল, ঠিক এ সময় মল্লার আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না৷ তার মনে হল চূর্ণীকে তারা একবার নিয়ে গেলে চূর্ণী আর ফিরবে না৷ মল্লার চিৎকার করে উঠল, ‘আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব৷’—এই বলে সে তির গতিতে ছুটল তাদের দিকে৷ ঘটনাটা দেখা মাত্রই তমসাময় চূর্ণীর একটা হাত চেপে ধরে তাড়াতাড়ি জলের দিকে টানার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল চূর্ণী৷ মল্লার তাদের দিকে ছুটতে ছুটতে শুনতে পেল, বুনো চূর্ণীর উদ্দেশে বলল, ‘দাঁড়ালি কেন? চল নৌকায় উঠতে হবে৷’
তমসাময় আবারও টান দিল চূর্ণীর হাত ধরে, কিন্তু সে নড়ল না৷’
তমসাময় বিস্ময়ের স্বরে বুনোর উদ্দেশে বলে উঠল, ‘মেয়েটা কথা শুনছে না কেন!’
ঠিক সেই মুহূর্তে মল্লার গিয়ে দাঁড়াল তাদের সামনে৷ তাকে দেখামাত্রই তমসাময় বুনোকে বললেন, ‘আপনি তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠুন, আমি আসছি এটাকে শেষ করে মেয়েটাকে নিয়ে আসছি৷’ এই বলে তিনি হাতের কোঁচটা ওপরে তুললেন মল্লারের বুকে বসিয়ে দেওয়ার জন্য৷ কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে চূর্ণী এক ঝটকায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল তমসাময়ের হাত থেকে৷ আর তারপরই সে খপ করে চেপে ধরল তমসাময়ের হাতের উদ্যত বর্শাটা৷ মট্ করে একটা শব্দ হল, দু-টুকরো হয়ে গেল সেটা৷ তমসাময়ের চোখে যেন এক অদ্ভুত বিস্ময় ফুটে উঠল চূর্ণীর দিকে তাকিয়ে৷
এবার পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে বুঝতে পেরে খাস্তগীর ও অন্যরাও ছুটে আসতে লাগল সেদিকে৷ ঝপ করে একটা শব্দ হল৷ নিজেকে বাঁচাতে তমসাময়ের গুরুদেব ঝাঁপ দিল জলে৷ তমসাময়ও এরপর চূর্ণী মল্লারকে ছেড়ে দিয়ে গুরুদেবের পথই অনুসরণ করতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু চূর্ণী চেপে ধরল তাঁর হাত৷ তারপর কীভাবে যেন অদ্ভুত কৌশলে তমসাময়ের অত বড় শরীরটাকে শূন্যে তুলে ছুড়ে ফেলল সামনের দিকে৷ খাস্তগীর, এস.ডি.পি.ও সাহেব আর তার লোকেরা তখন এসে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে মল্লারদের৷ তমসাময়ের পালাবার পথ বন্ধ৷ তবে নদীর বুকে এত গভীর অন্ধকার যে বুনো বা নৌকা কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ চূর্ণী এরপর আবার এগতে লাগল মাটিতে পড়ে থাকা তমসাময়ের দিকে৷ আর তার পিছনে মল্লারও৷ চূর্ণী তমসাময়ের দিকে এগতেই তিনি মাটির ওপর দিয়ে নিজের শরীরটাকে ঘষটাতে ঘষটাতে পিছু হঠতে শুরু করলেন৷ চূর্ণী আর তমসাময়ের দিকে তাকিয়ে সবাই৷ মাটিতে আছড়ে পরার পর তমসাময়ের যে আর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই তা বুঝতে পারল সবাই৷
চূর্ণী এক সময় ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল তমসাময়ের সামনে৷ দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা জ্বলন্ত চুল্লির আলো এসে পড়েছে সে জায়গাতে৷ সেই আলোতে মল্লার দেখতে পেল চূর্ণীর দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্ক ফুটে উঠেছে তমসাময়ের মুখে, আর চূর্ণীর মুখমণ্ডলে ফুটে উঠেছে এক অদ্ভুত কাঠিন্য৷ যে নরম স্বভাবের চূর্ণীকে মল্লার এত দিন দেখে এসেছে, ভূতের গল্প শুনলে যে ভয় পেত তার সঙ্গে এ চূর্ণীর যেন কোনও মিলই নেই৷
তমসাময়ের কাছে পৌঁছে চূর্ণী তাঁর উদ্দেশে কিছুটা চাপা স্বরে বলল, ‘তোকে মুক্ত করতে আমাকে এখানে এনেছিল তোর গুরুদেব৷ সে জানত না আমি তার ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছি না৷ ইচ্ছা করেই তার নির্দেশ মতো কাজ করছিলাম আমি৷ আমার শরীরে আমারই আত্মা আর কারও নয়৷’ চূর্ণীর এ কথা অন্যদের কানে তেমনভাবে না গেলেও তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মল্লার স্পষ্ট শুনতে পেল৷
আতঙ্কিত তমসাময় এবার চূর্ণীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগলেন৷ তা দেখে চূর্ণীর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল৷ সে বলল, ‘ও সব মন্ত্রে আমাকে থামানো যাবে না৷ সাপ নিয়ে সাপুড়ে খেলা দেখায়৷ কিন্তু সাপের কামড়েই তারা মরে৷ তেমনই মরবি তোরা৷’
এ কথা বলে চূর্ণী মাটিতে পড়ে থাকা তমসাময়ের হাত ধরে তাঁকে আবারও শূন্যে উঠিয়ে নিল৷ তমসাময়ের গলা থেকে একটা আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে এল—‘গুরুদেব বাঁচান আমাকে৷’
পরমুহূর্তেই চূর্ণী তমসাময়ের দেহটাকে প্রচণ্ড জোরে আছড়ে ফেলল মাটিতে৷ খাস্তগীর এগিয়ে গেলেন মাটিতে পড়ে থাকা তমসাময়ের দিকে তাকে ধরে ফেলার জন্য৷
চূর্ণী এরপর এগলো সোহমের চিতাটার দিকে৷ অন্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তমসাময়কে নিয়ে আর মল্লার অনুসরণ করল চূর্ণীকে৷ সোহমের চিতাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ল চূর্ণী৷ তার মুখমন্ডল থেকে কয়েক মুহূর্তের জন্য কাঠিন্য মুছে গিয়ে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল৷ চিতার কাঠের স্তূপের ভিতর থেকে সোহমের ব্যান্ডেজ মোড়ানো মাথার কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছিল৷ চূর্ণী হাত বাড়িয়ে পরম মমতায় সোহমের মাথাটা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্পর্শ করল৷ তারপর মল্লারের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হেসে বলল, ‘যাক, তুই অন্তত বেঁচে গেলি জলঙ্গীর অন্ধকার থেকে৷’
কথাটা বলেই চূর্ণী দ্রুত হাঁটতে শুরু করল জলঙ্গীর দিকে৷ শ্মশান ছেড়ে ঢাল বেয়ে জলের দিকে নামতে শুরু করল৷ মল্লারও তার পিছন পিছন এগিয়ে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করল, ‘তুই কোথায় যাচ্ছিস চূর্ণী?’
ফিরে দাঁড়াল চূর্ণী৷ মল্লারকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘যাচ্ছি তমসাময়ের গুরুদবেকে শাস্তি দিতে৷ আমি ছাড়া তাকে এই জলঙ্গীর অন্ধকারে কেউ খুঁজে পাবে না৷’
এ কথা বলে যেন একটু হেসে চূর্ণী বলল, ‘তবে ও আমাকে মারতে পারেনি৷ ও আমাকে আশ্রম থেকে নিয়ে গিয়ে জলঙ্গীর জলে ডুবিয়ে রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু ও জানত না তার অনেক আগেই গাড়ির মধ্যে আটকে থাকার সময় আতঙ্কে, দম বন্ধ হয়ে আমি মারা গিয়েছিলাম৷ নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে মন্ত্র পড়ে, পোড়া শোল মাছ খাইয়ে যাকে ও উঠিয়ে বসিয়েছিল, তার শরীরে অন্য কারও আত্মা প্রবেশ করেনি, ছিল আমারই আত্মা৷ যাকে পরিচালনা করার ক্ষমতা ওর নেই৷’
চূর্ণীর কথা শুনে মল্লারের মাথার ভিতর কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল৷ সে বলল, ‘তুই কী বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না৷’
পিছনে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ এবার তাদের দিকে অন্যরা আসছে৷ চূর্ণী এরপর হাসল মল্লারের দিকে তাকিয়ে৷ তারপর বলল, ‘কাল দিনের আলো ফুটলে হয়তো সব বুঝতে পারবি৷ ভালো থাকিস, আমাকে আর সোহমকে মনে রাখিস৷’
পায়ের শব্দগুলো ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে৷ আর কোনও কথা না বলে চূর্ণী এরপর একটু এগিয়ে গিয়ে ঝাঁপ দিল জলে৷ নিমেষের মধ্যে জলঙ্গীর অন্ধকারে হারিয়ে গেল চূর্ণী৷
খাস্তগীর এসে যখন মল্লারের হাত ধরলেন তখনও সে হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে অন্ধকার নদীর দিকে৷ খাস্তগীর প্রথমে বললেন, ‘তমসাময়কে আর বাঁচানো গেল না বুঝলেন৷ আইনের হাত থেকে পালাল সে৷ মাটিতে আছড়ে পড়ার সময় ওর ঘাড়টা ভেঙে গেছে৷ চূর্ণী নিশ্চয় মার্শাল আর্ট জানেন তাই না! নইলে অতবড় শরীরটাকে তুলে ছুঁড়ে ফেলা সহজ কথা নয়৷’
এ কথা বলে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘চূর্ণী কোথায় গেলেন?’
মল্লার নদীর দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘জলঙ্গীর অন্ধকারে৷’
খাস্তগীরের সঙ্গে এরপর টলতে টলতে ওপরে উঠে এল মল্লার৷ সোহমের চিতাতেও আগুন ধরানো হয়েছে৷ জ্বলতে শুরু করেছে সেটা৷ তিনটে চিতার আগুনে শ্মশানের বেশ কিছুটা জায়গা আলোকিত৷ কিছুটা তফাতে পড়ে আছে তমসাময়ের ঘাড় ভাঙা মৃতদেহ৷ তারই মাঝে মল্লারকে বসানো হল৷ একটু ধাতস্থ হবার পর মল্লার খাস্তগীরকে বলতে শুরু করল চূর্ণীর সঙ্গে তার কথোপকথন আর তমসাময়কে চাপা স্বরে বলা চূর্ণীর কথা৷ অবাক হয়ে কথাগুলো শুনলেন খাস্তগীররা৷
পরদিন জলঙ্গীর শ্মশান থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে মল্লারের প্রত্যাশা মতোই নদীর পাড়ে পাওয়া গেল চূর্ণীর আর বুনোর ভেসে ওঠা লাশ৷ গঞ্জের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আবারও চূর্ণী, তমসাময় আর তাঁর গুরুদেবের দেহের পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করা হল৷ রিপোর্টে জানা গেল বুনো আর চূর্ণীর মৃত্যু জলে ডুবে হয়নি৷ তমসাময় আর বুনোর মৃত্যু হয়েছে ঘাড় ভেঙে৷ বুনোর ঘাড়ে হাতের ছাপ স্পষ্ট৷ আর চূর্ণীর মৃত্যু হয়েছে অন্তত দু-দিন আগে হার্টফেল করে৷ এদিনই দিনের আলো থাকতে থাকতে তিনটি দেহই আবার আনা হল জলঙ্গীর শ্মশানে৷ মল্লারের অনুমতি নিয়ে চূর্ণীর দেহও তমসাময় আর বুনোর দেহের সঙ্গে দাহ করা হল সেখানে।
পুনশ্চঃ আইনগত কিছু কাজ থাকায় মল্লারকে আরও একটা দিন খাস্তগীরের সঙ্গে থেকে যেতে হল কৃষ্ণনগরে৷ তারপর দিন দুপুর নাগাদ খাস্তগীরের সঙ্গে মল্লার কলকাতা ফেরার জন্য রওনা হল৷ রানাঘাট পৌঁছে হাইওয়ের ধারে দুপুরে খাবার জন্য গাড়ি থামানো হল৷ খাস্তগীর আর মল্লার ভিতরে ঢুকে খেতে বসল৷ চারপাশে অনেক লোকজন খাচ্ছে৷ থালায় করে খাবার পরিবেশন করছে বেশ কয়েকজন হোটেল কর্মচারী৷ প্রথমে ভাত ডাল দিয়ে গেল একজন লোক৷ মাথা নীচু করে ভাত খাচ্ছিল মল্লার৷ হঠাৎ একটা গলা কানে গেল তার, ‘বাবু, মাছ দেব?’
মল্লার মুখ তুলে দেখল একটা থালায় মাছের বাটি নিয়ে হাজির হয়েছে একজন বামন লোক৷ তার আকৃতি যেন অনেকটা বুনোর মতোই৷ এরপর লোকটার কথা শুনে আরও চমকে উঠল৷ লোকটা বলে উঠল, ‘শোল মাছ খাবেন বাবু? জলঙ্গীর শোল মাছ৷ এ শোল মাছ একবারে মাংসের মতো খেতে৷’ কথাটা শুনেই মুহূর্তের মধ্যে যেন মল্লারের চোখে পরপর ভেসে উঠতে লাগল তমসাময়ের আশ্রমের সেই কালো ঘর, কুয়াশা ঘেরা জলঙ্গীর শ্মশান, রান্নাঘরে সোহমের পোড়া শোল মাছ খাবার সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য!
লোকটাকে দেখে আর শোল মাছের কথা শুনে মল্লারের মনে এমন কিছু ভাবনা আসছে বুঝতে পেরেই খাস্তগীর মল্লারকে বলল, ‘আপনি যা ভাবছেন তা নয়৷ এ লোককে এর আগে বেশ কয়েকবার দেখেছি এই হোটেলে৷ আর এই হোটেলের রান্নাও বেশ ভালো৷’
খাস্তগীরের কথা শুনে মল্লারের মন এবার বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, এবার ভুলে যেতে হবে অতীতকে৷ তমসাময়ের আশ্রম, জলঙ্গীর অন্ধকারকে সে এখন পিছনে ফেলে এসেছে৷ সোহম আর চূর্ণীর সঙ্গে তার যতটুকু সুখস্মৃতি আছে তাছাড়া সব দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা ভুলে যেতে হবে৷ সে বামন লোকটাকে বলল, ‘হ্যাঁ, শোল মাছ দাও৷ জলঙ্গীর শোল মাছের স্বাদ ভালো৷’
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন