জাতীয় সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমরা “বাংলা জাতীয় সাহিত্য’ প্রবন্ধের নামকরণে ইংরাজি “ন্যাশনাল’ শব্দের স্থলে “জাতীয়’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছি বলিয়া “সাহিত্য’-সম্পাদক মহাশয় আমাদের প্রতি কিঞ্চিৎ শ্লেষকটাক্ষপাত করিয়াছেন।

প্রথমত, অনুবাদটি আমাদের কৃত নহে; এই শব্দ বহুকাল হইতে বাংলা সাহিত্যে ন্যাশনাল-শব্দের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে। দ্বিতীয়ত, ভাষার পরিণতি সহকারে স্বাভাবিক নিয়মে অনেকগুলি শব্দের অর্থ বিস্তৃতি লাভ করে। “সাহিত্য’ শব্দটি তাহার উদাহরণস্থল। সাহিত্য-সম্পাদক মহাশয়ও “সাহিত্য’ শব্দটিকে ইংরাজি “লিটারেচর’ অর্থে প্রয়োগ করিয়া থাকেন। সম্পাদক মহাশয় সংস্কৃতজ্ঞ, ইহা তাঁহার অবিদিত নাই যে, “লিটারেচর’ শব্দের অর্থ যতদূর ব্যাপক, সাহিত্য শব্দের অর্থ ততদূর পৌঁছে না। শব্দকল্পদ্রুম অভিধানে “সাহিত্য’ শব্দের অর্থ এইরূপ নির্দিষ্ট হইয়াছে “মনুষ্যকৃতশ্লোকময়গ্রন্থবিশেষঃ। স তু ভট্টিরঘুকুমারসম্ভবমাঘভারবিমেঘদূতবিদগ্ধমুখমণ্ডন-শান্তিশতকপ্রভৃতয়ঃ।’ এমন-কি, রামায়ণ মহাভারতও সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হয় নাই, তাহা ইতিহাসরূপে খ্যাত ছিল। এইজন্য মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় “সাহিত্য’ শব্দের পরিবর্তে “বাঙ্‌ময়’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। রঘুবংশের তৃতীয় সর্গে ২৭শ শ্লোকে আছে–

লিপের্যথাবদ্‌গ্রহণেন বাঙ্‌ময়ং
নদীমুখেনেব সমুদ্রমাবিশৎ।

অর্থাৎ রঘু লিপিরূপ নদীপথ দিয়া বাঙ্‌ময়রূপ সমুদ্রে প্রবেশ করিলেন।

“জাতি’ শব্দ এবং “নেশন্‌’ শব্দ উভয়েরই মূল ধাতুগত অর্থ এক। জন্মগত ঐক্য নির্দেশ করিবার জন্য উভয় শব্দের উৎপত্তি। আমরা ব্রাহ্মণ প্রভৃতি বর্ণকে জন্মগত ঐক্যবশত জাতি বলি, আবার বাঙালি প্রভৃতি প্রজাবর্গকেও সেই কারণেই জাতি বলিয়া থাকি। জাতি শব্দের শেষোক্ত প্রয়োগের স্থলে ইংরাজিতে “নেশন্‌’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যথা, বাঙালি জাতি=বেঙ্গলি নেশন্‌। এরূপ স্থলে “ন্যাশনাল’ শব্দের প্রতিশব্দরূপে “জাতীয়’ শব্দ ব্যবহার করাতে বিশেষ দোষের কারণ দেখা যায় না। আমরাও তাহাই করিয়াছি। কিন্তু সম্পাদক মহাশয় অকস্মাৎ অকারণে অনুমান করিয়া লইয়াছেন যে, আমরা “জাতীয় সাহিত্য’ শব্দে “ভর্ন্যাক্যুলর লিট্‌রেচর্‌’ শব্দের অপূর্ব তর্জমা করিয়াছি! বিনীতভাবে জানাইতেছি আমরা এমন কাজ করি নাই। সাহিত্য যে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আমোদ বা শিক্ষাসাধক নহে, তাহা যে সমস্ত জাতির “জাতীয়’ বন্ধন দৃঢ়তর করে, বাংলা সাহিত্য, যে, বাঙালি জাতির ভূত ভবিষ্যৎকে এক সজীব সচেতন নাড়ি-বন্ধনে বাঁধিয়া দিয়া তাহাকে বৃহত্তর এবং ঘনিষ্ঠতর করিয়া তুলিবে– আমাদের প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গের বিশেষরূপ অবতারণা ছিল বলিয়া, আমরা বাংলা সাহিত্যকে, ব্যক্তিগত রসসম্ভোগের হিসাবে নহে, পরন্তু জাতীয় উপযোগিতার হিসাবে আলোচনা করিয়াছিলাম বলিয়াই তাহাকে বিশেষ করিয়া জাতীয় সাহিত্য অ্যাখ্যা দিয়াছিলাম। সভাস্থলে বক্তৃতা পাঠ করিতে হইলে শ্রোতৃসাধারণের দ্রুত অবগতির জন্য বিষয়টিকে কিঞ্চিৎ বিস্তারিত করিয়া বলা আবশ্যক হইয়া পড়ে– আমরাও বক্তৃতার বিষয় যথোচিত বিস্তৃত করিয়া বলিয়া কেবল সম্পাদক মহাশয়ের নিন্দাভাজন হইলাম কিন্তু তথাপিও তিনি আমাদের বক্তব্য-বিষয়টিকে সম্যক্‌ গ্রহণ করিতে পারিলেন না ইহাতে আমাদের দ্বিগুণ দুঃখ রহিয়া গেল।

আষাঢ়, ১৩০২

সকল অধ্যায়

১. শব্দ-চয়ন : ১
২. শব্দ-চয়ন : ২
৩. শব্দচয়ন : ৩
৪. অন্যান্য রচনা ও চিঠিপত্র হইতে সংকলিত
৫. শব্দচয়ন : ৪
৬. শব্দচয়ন : ৫
৭. শব্দচয়ন : ৬
৮. ভাষার কথা
৯. বঙ্গভাষা
১০. বাংলা ব্যাকরণে তির্যক্‌রূপ
১১. বাংলা ব্যাকরণে বিশেষ বিশেষ্য
১২. বাংলা নির্দেশক
১৩. বাংলা বহুবচন
১৪. স্ত্রীলিঙ্গ
১৫. প্রতিশব্দ
১৬. প্রদোষ
১৭. কালচার ও সংস্কৃতি
১৮. প্রতিশব্দ-প্রসঙ্গ
১৯. অনুবাদ-চর্চা
২০. বাংলা কথ্যভাষা
২১. কর্তৃকারক
২২. সর্বনাম
২৩. বাদানুবাদ
২৪. চলতি ভাষার রূপ
২৫. অভিভাষণ
২৬. ভাষার খেয়াল
২৭. শব্দতত্ত্বের একটি তর্ক
২৮. বিবিধ
২৯. বাংলা বানান
৩০. বাংলার বানান-সমস্যা
৩১. বাংলা বানান : ২
৩২. বাংলা বানান : ৩
৩৩. বানান-বিধি
৩৪. বানান-বিধি – ০২
৩৫. চিহ্নবিভ্রাট
৩৬. বানান-প্রসঙ্গ
৩৭. মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা ভাষা
৩৮. ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা
৩৯. বাংলাভাষা ও বাঙালি চরিত্র : ১
৪০. জাতীয় সাহিত্য
৪১. নামের পদবী
৪২. হরপ্রসাদ সংবর্ধন
৪৩. প্রাচীন-কাব্য সংগ্রহ
৪৪. উত্তর-প্রত্যুত্তর

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন