বাংলা বানান : ২

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃক বাংলা বানানের যে নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে তার একটা অংশ সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার আছে– এইখানে সেটা উত্থাপিত করি। যথোচিত আলোচনা দ্বারা তার চরম মীমাংসা প্রার্থনীয়।

হ-ধাতু খা-ধাতু দি-ধাতু ও শু-ধাতুর অনুজ্ঞায় তাঁরা নিম্নলিখিত ধাতুরূপের নির্দেশ করেছেন– হও, হয়ো। খাও, খেও। দাও, দিও। শোও, শুয়ো।

দেখা যাচ্ছে, কেবলমাত্র আকারযুক্ত খা- এবং ইকারযুক্ত দি- ধাতুতে ভবিষ্যৎবাচক অনুজ্ঞায় তাঁরা প্রচলিত খেয়ো এবং দিয়ো বানানের পরিবর্তে খেও এবং দিও বানান আদেশ করেছেন। অথচ হয়ো এবং শুয়ো-র বেলায় তাঁদের অন্যমত।

একদা হয় খায় প্রভৃতি ক্রিয়াপদের বানান ছিল হএ, খাএ। “করে’ “চলে’ যে নিয়মে একারান্ত সেই নিয়মে হয় খায়ও একারান্ত হবার কথা– পূর্বে তাই ছিল। তখন খা, গা, চা, দি, ধা প্রভৃতি একাক্ষরের ধাতুপদের পরে য়-র প্রচলন ছিল না। তদনুসারে ভবিষ্যৎবাচক অনুজ্ঞায় য়-বিযুক্ত “ও’ ব্যবহৃত হত।

এ নিয়মের পরিবর্তন হবার উচ্চারণগত কারণ আছে। বাংলায় স্বরবর্ণের উচ্চারণ সাধারণত হ্রস্ব, যথা খাএ, খাও। কিন্তু অসমাপিকায় যখন বলি খেএ (খেয়ে) বা ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় যখন বলি খেও (খেয়ো) তখন এই স্বরবর্ণের উচ্চারণ কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হয়। খাও এবং খেও শব্দে ওকারের উচ্চারণে প্রভেদ আছে। সন্দেহ নেই এ-সকল স্থলে শব্দের অন্তস্বর আপন দীর্ঘত্ব রক্ষার জন্য য়-কে আশ্রয় করে।

একদা করিয়া খাইয়া শব্দের বানান ছিল, করিআ, খাইআ। কিন্তু পূর্ব স্বরের অনুবর্তী দীর্ঘ স্বর য়-যোজকের অপেক্ষা রাখে। তাই স্বভাবতই আধুনিক বানান উচ্চারণের অনুসরণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শুয়ো হয়ো শব্দে এ কথা স্বীকার করেছেন, অন্যত্র করেন নি। আমার বিশ্বাস এ নিয়মের ব্যতিক্রম নেই।

আমরা যাকে সাধু ভাষা বলে থাকি বিশ্ববিদ্যালয় বোধ করি তার প্রচলিত বানানের রীতিতে অত্যন্ত বেশি হস্তক্ষেপ করতে ইচ্ছুক নন। নতুবা খাইয়া যাইয়া প্রভৃতি শব্দেও তাঁরা প্রাচীন বিধি অনুসারে পরিবর্তন আদেশ করতেন। আমার বক্তব্য এই যে, যে-কারণে সাধুভাষায় করিয়া হইয়া বলিয়ো খাইয়ো চাহিয়ো বানান স্বীকৃত হয়েছে সেই কারণ চলিত ভাষাতেও আছে। দিয়েছে শব্দে তাঁরা যদি “এ’ স্বরের বাহনরূপে য়-কে স্বীকার করেন তবে দিয়ো শব্দে কেন য়-কে উপেক্ষা করবেন? কেবলমাত্র দি- এবং খা- ধাতুর য় অপহরণ আমার মতে তাদের প্রতি অবিচার করা।

কার্তিক, ১৩৪৩

সকল অধ্যায়

১. শব্দ-চয়ন : ১
২. শব্দ-চয়ন : ২
৩. শব্দচয়ন : ৩
৪. অন্যান্য রচনা ও চিঠিপত্র হইতে সংকলিত
৫. শব্দচয়ন : ৪
৬. শব্দচয়ন : ৫
৭. শব্দচয়ন : ৬
৮. ভাষার কথা
৯. বঙ্গভাষা
১০. বাংলা ব্যাকরণে তির্যক্‌রূপ
১১. বাংলা ব্যাকরণে বিশেষ বিশেষ্য
১২. বাংলা নির্দেশক
১৩. বাংলা বহুবচন
১৪. স্ত্রীলিঙ্গ
১৫. প্রতিশব্দ
১৬. প্রদোষ
১৭. কালচার ও সংস্কৃতি
১৮. প্রতিশব্দ-প্রসঙ্গ
১৯. অনুবাদ-চর্চা
২০. বাংলা কথ্যভাষা
২১. কর্তৃকারক
২২. সর্বনাম
২৩. বাদানুবাদ
২৪. চলতি ভাষার রূপ
২৫. অভিভাষণ
২৬. ভাষার খেয়াল
২৭. শব্দতত্ত্বের একটি তর্ক
২৮. বিবিধ
২৯. বাংলা বানান
৩০. বাংলার বানান-সমস্যা
৩১. বাংলা বানান : ২
৩২. বাংলা বানান : ৩
৩৩. বানান-বিধি
৩৪. বানান-বিধি – ০২
৩৫. চিহ্নবিভ্রাট
৩৬. বানান-প্রসঙ্গ
৩৭. মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা ভাষা
৩৮. ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা
৩৯. বাংলাভাষা ও বাঙালি চরিত্র : ১
৪০. জাতীয় সাহিত্য
৪১. নামের পদবী
৪২. হরপ্রসাদ সংবর্ধন
৪৩. প্রাচীন-কাব্য সংগ্রহ
৪৪. উত্তর-প্রত্যুত্তর

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন