তুতানখামেনের গুপ্তধন

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

তুতানখামেনের গুপ্তধন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের বছর। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল। লন্ডন শহর থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে একটি ছোট্ট সুন্দর গ্রাম ব্লুবার্ড। সেখানে ছুটি কাটাচ্ছেন লর্ড কার্নারভন। ইংলন্ডের হাউস অব লর্ডসের একজন সম্মানিত সদস্য তিনি। তাঁর গ্রামের এই বাড়িটির নাম ইজিপ্ট। ইজিপ্ট বা মিশর নামে বাড়ির নাম রাখার কারণ, লর্ড কার্নারভন একজন পুরাতত্ত্ববিদ এবং বিশেষ করে মিশরের প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে খুব মাথা ঘামান। মমি, পিরামিড এবং আরও নানান বিস্ময়কর কীর্তির প্রতি তাঁর কৌতূহলের শেষ নেই।

ইজিপ্টের বারান্দায় বসে সেদিন তিনি খবরের কাগজ পড়ছিলেন।

সেদিনকার ডাকে একটি পত্রিকা এসেছে। ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ। তার একটা বিশেষ খবর তিনি খুব মন দিয়ে পড়ছিলেন।

ডেভিস নামে একজন খামখেয়ালি দুর্দান্ত প্রকৃতির মানুষ আছেন লন্ডনে। প্রায়ই তিনি দুর্গম জায়গায় দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়েন। কমাস আগে ডেভিস আফ্রিকার কঙ্গো অঞ্চলের গহন অরণ্যে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ঘুরতে-ঘুরতে পরে মিশরে আসেন। মিশরে এসে সম্প্রতি তিনি প্রাচীন কিছু জিনিস দৈবাৎ কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।

মিশরের একটা রুক্ষ পাহাড়ি অঞ্চলে মাটির তলা থেকে প্রাচীন রাজা বা ফ্যারাওদের কবর, মমি ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়েছে। পুরাতাত্ত্বিকরা এই অঞ্চলের নাম দিয়েছেন ভ্যালি অব দি কিংস অর্থাৎ রাজরাজড়ার উপত্যকা।

এই উপত্যকায় ঘুরতে-ঘুরতে ডেভিস হঠাৎ একটা ধ্বসেপড়া টিলার ফাটলে কয়েকটা হাঁড়ি দেখতে পান। হাঁড়িগুলো পোড়ামাটির। গায়ে চমৎকার কারুকার্য আছে। মুখের ঢাকনা সিল করা। সিলমোহরে যাঁদের নাম আছে, তারা কিন্তু ফ্যারাও নন, পুরুতঠাকুর।

প্রাচীন মিশরে দেবদেবীদের পূজারি পুরুতঠাকুররা খুব প্রতাপশালী ছিলেন। ফ্যারাও তাদের পরামর্শেই চলতেন। ডেভিসের কুড়িয়ে পাওয়া হাঁড়িতে যাঁদের সিলমোহর আছে, তাঁরা তুতানখামেন নামে এক রাজার পুরুত।

এই তুতানখামেন নামটা থাকায় লন্ডনের পণ্ডিতমহলে হইচই পড়ে গেছে। তুতানখামেন ছিলেন বয়সে কিশোর এক ফ্যারাও সিংহাসনে বসার পর মাত্র কিছু দিনের মধ্যেই তিনি মারা যান।

পুরোনো আমলের গ্রিক পণ্ডিতদের পুঁথিতে তার কথা জানা গিয়েছিল। তাছাড়া ওই রাজরাজড়ার উপত্যকায় প্রাচীন ফ্যারাও যুগের যেসব ফলক পাওয়া গিয়েছিল, তাতে তাঁর উল্লেখ ছিল।

কিন্তু ওই উপত্যকা তন্নতন্ন করে খুঁজে তার কবর বা মমি পাওয়া যায়নি। অমন তন্নতন্ন করে খোঁজার একটা কারণ ছিল। গ্রিক পণ্ডিতদের লেখায় তো বটেই, সেই পুরোনো ফলকেও স্পষ্ট করে উল্লেখ ছিল, তুতানখামেনের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ সে-আমলের প্রথা অনুসারে মমি করা হয় এবং মমির সঙ্গে সমাধিকক্ষে অজস্র মণিমুক্তা-হীরাজহরতও রাখা হয়। বলা বাহুল্য, এই গুপ্তধনের লোভেই অত খোঁজাখুঁজি।

শুধু পুরাতাত্ত্বিক পণ্ডিতরা নন, অনেক ধনলোভী দুর্দান্ত প্রকৃতির মানুষ, এমনকী, চোর-অকাতরাও রাজরাজড়ার উপত্যকা চষে ফেলেছে। কিন্তু তুতানখামেনের কবরের কোনও হদিশ পায়নি কেউ।

শেষে সবাই ধরে নিয়েছিল, তুতানখামেন নামে কোনও ফ্যারাও ছিলেনই না। ওটা স্রেফ বানানো গল্প।

কিন্তু ডেভিসের পাওয়া হাঁড়িতে তুতানখামেনের পুরুতদের সিলমোহর পাওয়া গেল এতদিনে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, সত্যি ওই নামে একজন ফ্যারাও ছিলেন।

তার চেয়ে বড় কথা, হাঁড়িগুলোর সিল ভেঙে ঢাকনা খোলা হয়েছে লন্ডন জাদুঘরে। ডেভিস ওগুলো জাদুঘরে জমা দিয়েছেন। ইংলণ্ডের আইনের এই রীতি। পৃথিবীর যেখানেই হোক, কোনও ইংরেজ বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজা প্রাচীন কোনও জিনিস কুড়িয়ে পেলে কিংবা উদ্ধার বা আবিষ্কার করলে তা জাদুঘরে জমা দিতেই হবে। নয়তো জেল খাটতে হবে। ডেভিস তাই ওগুলো জমা দিতে বাধ্য হয়েছেন।

এখন দেখা যাচ্ছে, হাঁড়ির ভেতরে ভাঁজ করা পোশাক রয়েছে। এই পোশাক পুরুতরা রাজার শবযাত্রার সময় পরতেন।

তার মানে, তুতানখামেনের মৃত্যুর পর তাকে কবরে নিয়ে যাওয়ার সময় পুরুতরা এই পোশাক পরেছিলেন। তারপর প্রথামত সেগুলো খুলে হাঁড়িতে ভরেছিলেন। মুখে সিল এঁটে দিয়েছিলেন। তাহলে নিশ্চয় তুতানখামেনের কবরও কোথাও আছে।

ডেভিস যেখানে হাঁড়িগুলো পেয়েছেন, তারই কাছাকাছি কোথাও আছে। অথচ ডেভিস তা না খুঁজে হাঁড়িগুলো নিয়েই মিশর থেকে চলে এসেছেন।

কেন চলে এসেছেন?

লন্ডন মিউজিয়ামের অধ্যক্ষ বলেছেন, ডেভিস যখন রাতদুপুরে আমার বাড়িতে এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে ওঠাল, তখন আমি ওর চেহারা দেখে অবাক হলাম। কী যেন আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপছে। আমি প্রশ্ন করে তার মুখে বেশিকিছু জানতে পারলাম না। শুধু কোনওরকমে বলল, এগুলো ভুতুড়ে জিনিস। এর মধ্যে ভূতপ্রেত আছে।

মিশর থেকে লন্ডন অবধি আনতে তার নার্ভের চূড়ান্ত হয়েছে তাই এ আপদ বিদায় করে বাঁচতে চায়। এই বলে ডেভিস তক্ষুনি চলে গেল। আমি হাঁড়িগুলো সাবধানে একটা ঘরে তালাবন্ধ করে রাখলাম। পরদিন সকালে শুনি, ডেভিস রাস্তায় মরে পড়ে আছে। তার লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তাররা মৃত্যুর তেমন কোনও কারণ খুঁজে না পেয়ে বলেছেন, হার্টফেল। আমার অবাক লাগে, দৈত্যের মতো বলশালী এবং দুঃসাহসী মানুষ ডেভিস। তার বিচিত্র কীর্তিকলাপের কথা কে না জানেন! অথচ সে হঠাৎ হার্টফেল করে রাতারাতি মারা পড়ল। এবং আমার কাছ থেকে যাওয়ার পরেই! এর কোনও মাথামুণ্ড খুঁজে পাচ্ছি না। ব্যাপারটা রহস্যময়। পুলিশের গোয়েন্দা দফতর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোকেরা অবশ্য তদন্ত করে দেখছে।

সাংবাদিকরা অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করেন, আচ্ছা স্যার, হাঁড়িগুলো আপনার জিম্মায় আসার পর কোনও অদ্ভুত কিছু ঘটেছে কি?

অধ্যক্ষ বলেন,–না। ওগুলো আমি যথারীতি পরদিনই জাদুঘরে নিয়ে গিয়ে রেখেছি। কিন্তু সেখানেও কোনও ভুতুড়ে ব্যাপার ঘটেনি। নানা দেশের সেরা পুরাতাত্ত্বিক পণ্ডিতদের হাঁড়িগুলো এবং পুরুতদের পোশাক-আশাক পরীক্ষা করে দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তাঁরা এখন এ কাজে ব্যস্ত।…

লর্ড কার্নারভন ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজের এই বিস্তারিত খবরটা পড়ে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

তুতানখামেন সম্পর্কে জানার জন্য তার কৌতূহল অনেকদিনের। প্রচুর পুঁথিপত্র হাতড়েছেন। ইউরোপ ও আমেরিকার জাদুঘরে বা পুরাদ্রব্যের সংগ্রহশালায় গিয়ে খোঁজাখুঁজি করেছেন। রোমের প্রখ্যাত আর্কাইভে পুরোনো পুঁথিশালায় পাঁচ বছর ধরে পুঁথি পড়ে এসেছেন–যদি তুতানখামেনের কবরের কোনও খোঁজখবর পান!

কিন্তু পাননি। এতদিন ডেভিস যদি বা একটা ক্ষীণ সূত্র পেল, সে অতর্কিতে মারা পড়ল। ঠিক কোন জায়গায় ওগুলো পাওয়া গেছে, তার মুখেই জানা যেত। কিন্তু সে রাস্তা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল।

লর্ড কার্নারভন তখনই অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে তার মোটর গাড়িটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। লন্ডনের দিকে প্রচণ্ড গতিতে চলতে থাকল তাঁর গাড়ি।

মাইল দশেক চলার পর হঠাৎ গাড়ির কলকবজা বিগড়ে গেল। ভাগ্যিস একটু তফাতে একটা গ্যারাজ ছিল। গ্যারাজের লোকেরা ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে গেল। গাড়ি সারিয়ে চালু করতে ঘণ্টা তিনেক লেগে গেল।

গ্যারাজের মালিক একটু হেসে বলল, আজ দিনটা শুভ নয়। মশাই, বেরোবার আগে কি তারিখটা লক্ষ করেননি? আজ অপয়া তেরো। আনলাকি থার্টিন।

লর্ড কার্নারভন রেগে বললেন, ওসব আমি মানি নে হে, বুঝলে?

লোকটা মুচকি হেসে বলল, ঠিক আছে। ভালোয়-ভালোয় পৌঁছন, এই ইচ্ছে করতে আপত্তি নেই। তবে কিছু বেগতিক ঘটলে আমাকে যেন শাপ দেবেন না।

লর্ড কার্নারভন আবার স্টিয়ারিং ধরে স্পিড বাড়িয়ে দিলেন গাড়ির।

লন্ডনের আধাআধি পথ এসেছেন, আবার হঠাৎ ঘড়ঘড় করতে করতে থেমে গেল গাড়ি। আবার গ্যারাজ খুঁজতে বেরোতে হল। সঙ্গে চাকর না নিয়ে এসে ভুল করেছেন। এখন আর পস্তানো বৃথা।

যাই হোক, এইভাবে রাস্তায় দুবার গাড়ি বিগড়ে যাওয়ায় লন্ডন পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল তার।

সন্ধ্যার মুখে কুয়াশা ঘন হয়ে উঠেছে। বাতি জ্বলেছে সদ্য। কিন্তু রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। আজ আর জাদুঘরে ঢোকা যাবে না। কখন বন্ধ হয়ে গেছে। বিরক্তমুখে লর্ড কার্নারভন গাড়ি চালাচ্ছেন।

একসময় হঠাৎ দেখতে পেলেন, সামনে আবছা একটা গাড়ি আসছে। গাড়িটা ঘোড়ার গাড়ি। দেখতে-দেখতে গাড়িটা এসে পড়ল।

কিন্তু আতঙ্কে লর্ড কার্নারভন দেখলেন, ঘোড়ার গাড়িটা তার গাড়ির দিকেই সোজা ছুটে আসছে। জোরে হর্ন বাজালেন। কিন্তু না–এই এসে পড়ল। লর্ড কার্নারভন ব্যস্ত হয়ে গাড়ির মুখ ঘুরিয়েই ব্রেক চাপলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে তার গাড়ি উল্টে গিয়ে পাশের একটা খানায় পড়ল। প্রচণ্ড আঘাতে অচৈতন্য হয়ে পড়লেন তিনি।

লোকজন দৌড়ে এল চারপাশ থেকে। ততক্ষণে ঘোড়ার গাড়িটা কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেছে। তারা সাংঘাতিক আহত লর্ড কার্নারভনকে হাসপাতালে পৌঁছে দিল।

লর্ড কার্নারভনের জ্ঞান ফিরল তিন দিন পরে।

কিন্তু তারপর তিনি যা বললেন, শুনে তো ডাক্তাররা উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবলেন– এই রে! দুর্ঘটনার ধাক্কায় লর্ডসায়েবের মাথার গোলমাল হয়ে গেছে!

লর্ড বললেন,–ঘোড়ার গাড়িটার ঘোড়াগুলো কালো রঙের। কোচোয়ানের পরনে ছিল প্রাচীন মিশরের পোশাক। আরোহীকে অস্পষ্টভাবে দেখেছি। মনে হয়েছে, তার মাথায় ফ্যারাওয়ের মুকুট ছিল।

হাউস অব লর্ডসের সদস্য বলে কথা। তার চিকিৎসার কোনও ত্রুটি হবে বা। তাকে নিয়ে যাওয়া হল মানসিক ব্যাধির ওয়ার্ডে। খ্যাতিমান মনস্তত্ত্ববিদ ডাক্তাররা নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, নাঃ। লর্ড সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক। তবে সেই ঘোড়ার গাড়ির ব্যাপারটা যেভাবে বর্ণনা করছেন, তাতে বোঝা যায় উনি তখন হ্যাঁলুসিনেশন-এ আচ্ছন্ন ছিলেন অর্থাৎ চোখের ভুল। মিশরসংক্রান্ত খবর পড়ে দ্রুত লন্ডনে ফিরে আসছিলেন এবং সারাপথ মাথায় ওই চিন্তা ছিল। তাই কুয়াশা এবং আবছা অন্ধকারে ঘোড়ার গাড়িটা দেখে ওই ভুল করে ফেলেছেন। ভুলের ফলেই উনি সাত তাড়াতাড়ি ব্রেক চাপেন এবং গাড়ি স্বাভাবিকভাবেই উল্টে যায়। এমনও হতে পারে, হ্যাঁলুসিনেশন-এর ফলে আতঙ্কে গাড়িটা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন খানার দিকে।

লর্ড কার্নারভন সুস্থ হয়ে বাড়ি ঢুকলেন। কিন্তু এবার তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তাঁকে পরীক্ষা করে দেখে বললেন,–সামনের শীতকালটা আপনার শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই ওই সময় আপনার কোনও গ্রীষ্মপ্রধান দেশে গিয়ে থাকা উচিত।

বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন ভারতে যেতে। কিন্তু লর্ড কার্নারভন আনন্দে নেচে উঠলেন। মিশরও তো গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। তিনি মিশরেই যাবেন।

নিছক বেড়াতে যাবেন না। রথ দেখা কলা বেচার মতো মিশরে গিয়ে পুরাতাত্ত্বিক অভিযানে নামবেন। সেই রাজরাজড়ার উপত্যকায় তন্নতন্ন অনুসন্ধান চালাবেন। কোথায় ডেভিস হাঁড়িগুলো পেয়েছিল, খুঁজে বের করবেন। মাটি খুঁড়তে তো হবেই। এজন্য লোকজন দরকার। অভিজ্ঞ তদারককারীও চাই।

এজন্য প্রচুর টাকা দরকার। ইংলন্ডের দরবার থেকে অনুমতিও দরকার। লর্ড কার্নারভনের দুটোরই কোনও অসুবিধা ছিল না।

তিনি সদলবলে মিশরের ভ্যালি অফ দি কিংস-এ গিয়ে তাঁবু পাতলেন।…

এদিকে যেদিন লর্ড কার্নারভন দুর্ঘটনায় আহত হন, সেদিনই আরেকটি বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিল।

হাওয়ার্ড কার্টার নামে এক যুবক চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে। লেখাপড়া মোটামুটি করেছে। কিন্তু তার ঝোঁক ছবি আঁকাতে। বিশেষ করে ড্রইংয়ে তার হাত বেশ পাকা। তখনকার দিনে কলকারখানার ব্যাপারে ড্রইং জানা লোকের দরকার হতো, এখনও হয়। কিন্তু নিছক ড্রইংয়ে হাত থাকলেই তো চাকরি পাওয়া যায় না। ইঞ্জিনিয়ারিং বা কারিগরি বিদ্যাও পেটে থাকা চাই। কার্টারের সেসব কিছু ছিল না।

১৯১৩ সালের ১৩ই এপ্রিল কার্টার মনমরা হয়ে বসে আছে ভিক্টোরিয়া পার্কে, একটা গাছের তলায়। হতাশায় সে ভেঙে পড়েছে। মনে-মনে সংকল্প করছে, আত্মহত্যা করে বেকারজীবনের যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি খুঁজে নেবে।

সে জায়গাটা একেবারে নির্জন। একসময় সে তৈরি হয়ে উঠে দাঁড়ায়। গাছের ডালে মাফলার বেঁধে ফাস বানাবে এবং ঝুলে পড়বে।

গাছে চড়তে যাচ্ছে, হঠাৎ কে পিছন থেকে হো-হো করে হেসে উঠল। কার্টার চমকে উঠল। ঘুরে দেখল, একটা পাগলাটে চেহারার বুড়ো ভিখিরিগোছের লোক কখন এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে এবং তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

কার্টার ক্ষোভে ও রাগে বলে উঠল, দাঁত বের করার কী আছে এতে?

বুড়ো বলল, আছে বইকী। আলবত আছে। এই তাজা জোয়ান বয়সে এমন মরার শখ দেখলে হাসি পাওয়ারই কথা।

কার্টার একটু অবাক হয়ে বলল,-মরতে যাচ্ছি কে বলল তোমাকে?

দেখেই বোঝা যায়। বুড়ো এসে কার্টারের কাঁধে হাত রেখে বলল,–শোনো বাছা, তোমাকে একটা ভালো খবর দিই। যে জন্যে মরতে যাচ্ছ, তার একটা সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি এক্ষুনি চলে যাও লন্ডন মিউজিয়ামের অধ্যক্ষমশায়ের কাছে। গিয়ে বলল, বেসে আমাকে পাঠিয়েছেন। আমি ড্রইংয়ের কাজটা ভালোই পারি। ব্যস, দেখবে–তোমার চাকরি তো হয়েই যাবে, উপরন্তু এই থেকে তুমি একদিন পৃথিবীর নামী লোক হয়ে উঠবে। যাও, এক্ষুনি চলে যাও।

কার্টার হাঁ করে তাকিয়ে ছিল ওর মুখের দিকে। এসব কথা শুনে সে তো খুবই অবাক। এই লোকটা কেমন করে তার সব কথা জানল? কে এ?

লোকটার পোশাকের দিকে এতক্ষণে চোখ গেল কার্টারের। এমন অদ্ভুত পোশাকও তো সে কস্মিনকালে দেখেনি। পোশাকটা ছেঁড়াখোঁড়া এবং নোংরা বটে

–কিন্তু একসময় দামিই ছিল। কেমন একটা বিশ্রী দুর্গন্ধও নাকে লাগছে।

কার্টার বলল, তুমি নিশ্চয় পাগল-টাগল বটে। যাও, বিরক্ত কোরো না।

লোকটা ওঁর কাধ ছেড়ে দিয়ে ফের হো-হো করে হেসে বলল, ভাগ্যলক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলতে নেই বাছা। যা বললাম, শুনলে বরাত খুলে যাবে। এখন মানা না মানা তোমার ইচ্ছা। বলে সে হনহন করে চলতে শুরু করল এবং ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে মিলিয়ে গেল।

কার্টার অবাক হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর তার মনে হল, দেখা যাক ওর কথা সত্যি না মিথ্যে।

সে পার্ক থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেল জাদুঘরে। সেখানে কর্মচারীদের কাছে জিগ্যেস করে জানল, সত্যি একজন ভালো ড্রইং-জানা লোক খোঁজা হচ্ছে।

কাটার অধ্যক্ষমশায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেল।

অধ্যক্ষ বললেন, কী চাই?

–বেন্নেস নামে এক বুড়ো ভদ্রলোক আপনার কাছে আসতে বললেন, তাই এলাম। আপনারা নাকি ড্রইং-জানা লোক খুঁজছেন। …কার্টার জানাল।

অধ্যক্ষ ভুরু কুঁচকে বললেন,–কে বললে?

–বেন্নেস ।

–বেন্নেস! সে আবার কে? কেমন চেহারা বলল তো?

কার্টার তার চেহারা ও পোশাকের মোটামুটি একটা বর্ণনা দিল। ঘরে অধ্যক্ষ এবং আরও জনাতিন ভদ্রলোক ছিলেন। তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলেন। তাদের চোখেমুখে বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠেছে।

কার্টার বলল আপনি কি তাকে চেনেন না স্যার?

অধ্যক্ষ একটু হেসে বললেন, তুমি নিশ্চয় রসিকতা করছ, যুবক। একজন বেন্নেসকে আমি এবং এই ভদ্রমহোদয়রা চেনেন বটে, কিন্তু সে চেনাও মাত্র দিন দুই আগে। তবে…

ঘরের তিনজন ভদ্রলোকই হেসে উঠলেন। অধ্যক্ষকে থামতে দেখে কার্টার জিগ্যেস করলু,–তবে কী স্যার?

অধ্যক্ষ হঠাং টেবিলের সামনে ঝুঁকে ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলেন,–এ রসিকতার অর্থ কী?

কার্টার অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি রসিকতা করিনি স্যার। সত্যি বলছি, মাত্র কিছুক্ষণ আগে ভিক্টোরিয়া পার্কে ওঁর সঙ্গে দেখা হল। ঈশ্বরের দিব্যি।

ঘরের একজন ভদ্রলোক এবার বললেন,–শোনো ভাই, ব্যাপারটা খুলেই বলি। বেন্নেস নামে একজন পুরুত ছিলেন পাঁচ হাজার বছর আগে মিশরে। তিনি ছিলেন ফ্যারাও তুতানখামেনের পুরুত। সম্প্রতি দুদিন হল, ডেভিস নামে এক অভিযাত্রী মিশর থেকে কিছু জিনিস এনেছেন। তার মধ্যে কয়েকটা মাটির হাঁড়ি আছে। একটা হাঁড়ির ঢাকায় ওই বেনেসের সিলমোহর আছে এবং ভেতরে আছে তার পোশাক। রাজার শবযাত্রায় বেন্নেস সেই পোশাক পরেছিলেন। এবার বুঝতে পারছ তো, কেন অধ্যক্ষ ক্রুদ্ধ হয়েছেন?

কার্টার শিউরে উঠল। সর্বনাশ! তাহলে কি সেই বেলেসের ভূতের সঙ্গে তার পার্কে দেখা হল? কাঁধে হাত রেখেছিল যেখানে, সেখানটায় এতক্ষণ রক্ত জমে গেছে মনে হল। এর পর অতি কষ্টে এবং কাঁপতে কাঁপতে সে বলল, দয়া করে আমাকে বেন্নেসের পোশাকটা একবার দেখাবেন?

পোশাক পাশের একটা টেবিলেই ছিল। ওঁরা তিনজনেই পুরাতাত্ত্বিক। পরীক্ষা করছিলেন এতক্ষণ সেগুলো।

কার্টারকে পোশাক দেখিয়ে দিতেই কার্টার অস্ফুট চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল।

সমসাময়িক পত্রপত্রিকা ও বইয়ের বিবরণে দেখা যায়, কার্টারকে লন্ডন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ শেষপর্যন্ত ড্রইংয়ের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তার কাজটা ছিল এই মিশরের ভ্যালি অব দি কিংস-এ পাওয়া অজস্র ফলকের চিত্রলিপি পুরাতাত্ত্বিকরা পেনসিলের স্কেচে নকল করতেন। কার্টার তাতে কালি বুলিয়ে স্পষ্ট করত। তারপর সেগুলো বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতদের কাছে পাঠোদ্ধারের জন্য পাঠানো হতো।

কার্টারের মনে মিশরের প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে ক্রমশ তীব্র কৌতূহল জেগে উঠেছিল। তখন সে জাদুঘরে বসেই পড়াশোনায় মন দিল। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল। চলল ১৯১৮ সাল পর্যন্ত। সেই ডামাডোলের মধ্যে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত চার বছর ধরে ড্রইং বিশারদ কার্টার মেতে রইল পুরোনো বই নিয়ে। প্রাচীন মিশর তাকে পেয়ে বসেছিল। বিশেষ করে পুরুত বেগ্নেসের সেই অত্যদ্ভুত আবির্ভাব কার্টারকে রহস্যের গোলকধাঁধায় ঘুরিয়ে মারছিল।

১৯১৭ সালে কার্টার আর স্থির থাকতে পারল না। অধ্যক্ষের সঙ্গে ততদিনে তার স্নেহের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কার্টার বলল, আমি মিশরে গিয়ে তুতানখামেনের কবর খুঁজে বের করব। আমাকে সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।

অনেক সাধাসাধির পর অনুমতি পাওয়া গেল। তবে অধ্যক্ষ বললেন,–দেখো বাবা, তুমি কিন্তু পুরাতাত্ত্বিক হিসেবে পণ্ডিতসমাজে স্বীকৃত নও। তাই তোমাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। বরং অন্য উপায়ে সে-ব্যবস্থা করছি। তুমি আমার চিঠি নিয়ে চলে যাও মিশরে। সেখানে লর্ড কার্নারভন চার বছর ধরে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। তুমি তার সঙ্গে দেখা করো। তাঁর দলে থেকেই তুমি তোমার কাজ করতে পারবে।

কার্টার তার চিঠি নিয়ে চলে এল মিশরে।

ভ্যালি অব দি কিংস-এ পাহাড়, মরু ও রুক্ষ অনুর্বর এলাকায় লর্ড কার্নারভনের তাঁবু খুঁজে বের করল। লর্ড খুশি হলেন এই মেধাবী বুদ্ধিমান যুবককে পেয়ে। দ্বিগুণ উদ্যমে তন্নতন্ন করে খোঁজ শুরু হল। যেখানে সন্দেহ হয়, সেখানেই মাটি খোঁড়া চলতে থাকে। কিন্তু তুতানখামেনের কবরের কোনও পাত্তা পাওয়া যায় না।

অথচ কার্টারের বিশ্বাস, ভিক্টোরিয়া পার্কের সেই অদ্ভুত রহস্যময় ঘটনার মধ্যে একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। কার্টারই একদিন না একদিন তুতানখামেনের কবর আবিষ্কার করতে পারবে।

১৯২২ সাল পর্যন্ত খোঁড়াখুড়ির কাজ চলল। কিন্তু সব নিষ্ফল হল।

লর্ড কার্নারভন এতদিনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ন-বছর ধরে পড়ে আছেন এই উপত্যকায়। অজস্র টাকাকড়ি খরচ হয়ে গেছে। লন্ডন জাদুঘরের সাহায্যও প্রচুর পেয়েছেন। কিন্তু সবই জলে গেছে। এবার বললেন,-থাক। স্বদেশে ফিরে যাই। তুতানখামেনের কবর সম্ভবত আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কার্টার বলল, যদি অনুগ্রহ করে আর একটা বছর সময় দেন, আমি কথা দিচ্ছি–তুতানখামেনের কবর আমি আবিষ্কার করবই।

লর্ড কার্নারভন বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি ফ্যারাওয়ের গুপ্তধনের লোভে পাগল হয়ে উঠেছ দেখছি।

না লর্ড! কার্টার মিনতি করে বলল, ধনরত্নের প্রতি একটুও লোভ নেই আমার। আমি একথাও দিচ্ছি, যদি তুতানখামেনের গুপ্তধন আবিষ্কার করতে পারি, তার থেকে এককণাও আমি নেব না। আমাকে বিশ্বাস করুন!

লর্ড কার্নারভন শুনলেন না। পরদিনই চলে যাবেন ঠিক করলেন।

জিনিসপত্র বাঁধাছাদা হয়ে গেছে। ভোরে মোটরগাড়ি, খচ্চর, উট আর ঘোড়ার পিঠে সব নিয়ে অনুসন্ধানী দল রওনা দেবে। রাতে কার্টার মনমরা হয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন তাঁবু ছেড়ে।

জ্যোৎস্নারাত। আনমনে ঘুরতে-ঘুরতে কার্টার ফ্যারাও দ্বিতীয় রামেসিসের কবরের কাছে এসে দাঁড়াল। জনহীন উপত্যকায় ফিকে জ্যোৎস্না পড়ে আছে। হঠাৎ দেখল, একটা অস্পষ্ট মূর্তি রামেসিসের কবরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে।

কার্টার বলল,–কে ওখানে?

অমনি নির্জন-নিশুতি রাত কাঁপয়ে একটা অট্টহাসি শোনা গেল। কার্টার চমকে উঠেছিল। কাঁপতে কাঁপতে বলল,-কে হাসছ এমন করে? কে তুমি?

জবাব এল, আমি তোমার প্রাণদাতা। হাসছি তোমার নির্বুদ্ধিতার জন্য।

–আমার প্রাণদাতা? তার মানে?

–ভিক্টোরিয়া পার্কে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। মনে পড়ে না?

কার্টার শিউরে ওঠে। কথা জড়িয়ে যায় মুখে। কোনওরকমে বলে,–আপনি বেন্নেস?

–হ্যাঁ, আমি সেই অভিশপ্ত কিশোর ফ্যারাও তুতানখামেনের প্রধান পুরোহিত বেন্নেস। শোনো কার্টার, তুতানখামেন কিশোর বয়সে দুর্বিনীত ছিল বলে তাঁকে দেবতারা অভিশাপ দিয়েছিলেন। তার আত্মা নরকযন্ত্রণায় হাজার-হাজার বছর ধরে কষ্ট পাচ্ছে। তার মুক্তি হতে পারে, যদি কোনও জীবিত মানুষ তাঁর নামে আত্মবলি দেয়। আর শোনো…।

এই পর্যন্ত শুনেই কার্টার অজ্ঞান হয়ে গেল।

যখন তার জ্ঞান ফিরল, তখন সকাল হয়ে গেছে। সূর্য উঠেছে। সে উঠে বসল। তারপর মনে পড়ল সবকথা। তখনই সেখান থেকে পালাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। লর্ড কার্নারভনের দল হয়তো রওনা দিয়েছে। কিন্তু সে-মুহূর্তে তার চোখে পড়ল, রামেসিসের কবরের তিন-চার হাত দূরে একটা ফাটল দেখা যাচ্ছে এবং ফাটলের তলায় শক্ত পাথরের একটা ধাপ। ধাপে একটা মাছের রেখাচিত্র। রেখাচিত্রের মধ্যে একটা সংকেত আছে। সেই সংকেতচিহ্ন ডেভিসের পাওয়া হাঁড়ির গায়ে ছিল। তাহলে কি…

দেখামাত্র কার্টার ছুটে চলল তাঁবুর দিকে।

তখন তাঁবু গুটোনো হয়ে গেছে। লর্ডসায়েব ব্যস্ত হয়ে কার্টারকে খুঁজছেন। তার জন্যই রওনা দিতে দেরি হয়েছে।

কার্টার হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল,–পাওয়া গেছে! তুতানখামেনের কবরের খোঁজ পাওয়া গেছে।

ফ্যারাও রামেসিসের কবরের সেই ফাটলে একটা ধাপ থেকে নিচের দিকে চলে গেছে ষোলোটা ধাপ। শেষ ধাপের সামনে দেখা গেল একটা দরজা। এই সেই তুতানখামেনের সমাধিকক্ষ!

যুগ-যুগ ধরে এই সমাধিকক্ষের গুপ্তধনের কিংবদন্তি প্রচলিত। তুতানখামেনের মৃত্যুর পর নাকি প্রাসাদের সব ধনরত্ন মণিমাণিক্য তাঁর মমির সঙ্গে এখানে এনে রাখা হয়েছিল।

কেন? এর জবাবও পাওয়া যায় একটি ফলকে। দেবতাদের অভিশাপে কিশোর রাজা তুতানখামেন মারা যান। তাই পুরোহিতরা বিধান দিয়েছিলেন, রাজার প্রাসাদের সব ধনরত্নেরও অভিশাপের ছোঁয়া লেগেছে। ওই ধন যে ব্যবহার করবে, তারই অভিশাপ লাগবে এবং সাংঘাতিক রোগের কবলে পড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যাবে।

এতদিনে সেই অভিশপ্ত রাজার মমি ও ধনরত্নের কিংবদঢ়ি সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে। লর্ড কার্নারভন এবং কার্টার তো বটেই, দলের প্রতিটি মানুষ আগ্রহে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন।

অবশেষে দরজা কীভাবে খোলা যায়, পরীক্ষা করছিল কার্টার। হঠাৎ সে চমকে উঠে বলল, লর্ড! এই দরজা মনে হচ্ছে কোনও একসময়ে ভাঙা হয়েছিল যেন।

লর্ড কার্নারভন বিস্মিত হয়ে বললেন,–সে কী!

–হ্যাঁ লর্ড। এই দেখুন, দরজার সিলমোহরগুলো দুভাগ হয়ে আছে এবং কেউ সেই ভাঙা জায়গাটা আবার জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাছাড়া কপাটের জোড়ের দিকটা লক্ষ করুন। চিড় খেয়ে আছে জায়গায়।

লর্ড কার্নারভন পরীক্ষা করে দেখে বললেন,–তাই মনে হচ্ছে, কার্টার। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে ভেতরে নিশ্চয় আর একতিল সোনাদানা তো নেই-ই, এমনকী মমিটা আছে কি না তাও সন্দেহ।

কার্টার চিন্তিতমুখে বলল,–তাহলে দরজা ভেঙে দেখা যাক কী হয়েছে।

লর্ড কার্নারভন বললেন, কিন্তু যদি সত্যি ভেতরে কিছু না থাকে, তাহলে শেষপর্যন্ত বিশ্বের পুরাতাত্ত্বিকরা, এমনকী লন্ডনের জাদুঘর কর্তৃপক্ষও ভাবতে পারেন–আসলে হয়তো আমরাই সব গুপ্তধন মেরে দিয়েছি এবং মিথ্যা করে রটাচ্ছি

যে কারা আমাদের আগেই দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল। তাই না কার্টার?

কার্টার ভেবে দেখে বলল, হ্যাঁ, তাও তো বটে।

–কার্টার, ব্রিটিশ আইন অনুসারে তুতানখামেনের সবকিছুই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজকীয় সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। অতএব আমাদের মিথ্যা বদনামের ভাগী হওয়া উচিত নয়। বরং আমরা লন্ডন জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে খবর পাঠাই। তাদের বিশেষজ্ঞ দলটি এসে আগে দেখুন, সত্যি দরজা অনেক আগে ভাঙা হয়েছিল কি না। তারপর তাঁদের সামনেই আমরা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকব এবং কী আছে দেখব। এমনটি হলে কেউ আমাদের চোর বদনাম দিতে পারবে না।

কার্টার সায় দিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন লর্ড। আজই টেলিগ্রাম করার ব্যবস্থা করি।

লোক পাঠানো হল কায়রো শহরে। সেখান থেকে টেলিগ্রাম গেল।

আর তুতানখামেনের সমাধিকক্ষের দরজায় পাহারার ব্যবস্থা হল। লর্ড কার্নারভন এবং কার্টার তো সজাগ রইলেনই। পালাক্রমে রাত জেগে প্রহরীদের দিকেও লক্ষ রাখলেন দুজনে।

চতুর্থ রাত্রে এক সাংঘাতিক ঘটনা ঘটল।

শেষ রাত্রে ছিল লর্ড কার্নারভানের পাহারার পালা। কার্টারকে জাগিয়ে দিয়ে তিনি তাঁবুতে শুতে গেলেন।

রামেসিসের কবরের কাছে তাঁবু। লর্ড চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কার্টার যেন একটা আর্তনাদ শুনল কোথাও। একজন প্রহরীকে পাঠাল ব্যাপারটা অনুসন্ধান করতে। একটু পরে সে দৌড়ে এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল,–লর্ডসায়েব পড়ে আছেন রামেসিসের কবরের ওপরে।

সেই শেষরাত্রে হইচই পড়ে গেল।

লর্ডসায়েবের শরীরে কোথাও ক্ষতচিহ্ন নেই। কিন্তু তিনি মারা পড়েছেন। মুখের কষায় জেলার সঙ্গে রক্ত আছে। নাকেও কয়েক ফোঁটা টাটকা রক্ত।

লর্ড কার্নারভনের মৃতদেহ কায়রো শহরের মর্গে পাঠানো হয়েছিল। শবব্যবচ্ছেদ করে ডাক্তাররা মৃত্যুর কোনও কারণ খুঁজে পাননি। রিপোর্টে শুধু লিখেছেন, হার্টফেল। সম্ভবত আকস্মিকভাবে ভয় পেয়ে কিংবা উত্তেজিত হয়েই হার্টফেল করে মারা পড়েছেন।

অবশ্য তাঁর বয়স হয়েছিল। তার ওপর দশ বছর ধরে এইরকম একটা পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কাটানো। স্নানাহার নিয়মিত ছিল না। নার্ভের ওপর দিনের পর দিন দশ বছর ধরে তীব্র চাপ পড়েছিল। মানসিক অবস্থা ও স্বাস্থ্য দুই-ই বিচার করে বলা যায়, হার্টফেল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

সাতদিন পরে লন্ডন থেকে বিশেষজ্ঞরা এসে পড়লেন। সবাই চুঁদে পুরাতাত্ত্বিক পণ্ডিত এবং প্রাচীন জিনিস সম্পর্কে প্রত্যেকেরই অসাধারণ জ্ঞান।

ভঁরা সমাধিকক্ষের দরজা পরীক্ষা করে বললেন, হ্যাঁ। কয়েকশো বছর আগে কেউ বা কারা এই দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল। বেরিয়ে এসে আবার দরজা আগের মতো আটকাবার চেষ্টা করেছে। সিলমোহরগুলো জোড়াতাড়া দিয়ে সেঁটে দিয়েছে। ডাকাত ছাড়া কে হতে পারে তারা?

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নানা দেশের কিছু সাংবাদিক ও ফোটোগ্রাফারও এসেছিলেন। অনেক ছবি তোলা হল দরজার। রেকর্ড হিসেবে এ ছবির দাম আছে।

দরজা ভেঙে ফেলা হল। ভেতর থেকে ভ্যাপসা গন্ধ বেরিয়ে এল প্রথমে। তারপর ক্রমশ একটা মিঠে গন্ধ ছড়ালবাসি ফুল কিংবা পুরোনো আতরের গন্ধের মতো। ভেতরে ঘন অন্ধকার থমথম করছে দিনদুপুরে।

পেট্রোম্যাক্স বাতি জ্বেলে বিশেষজ্ঞরা ভেতরে ঢুকলেন। তারপর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঘরের মেঝেয় ছড়িয়ে রয়েছে কিছু ডালাভাঙা বাক্স-পেটরা, সিন্দুক এবং মেঝের ওপর বহুমূল্য প্রাচীন কাপড়চোপড়, আর কিংবদন্তিখ্যাত সেই সোনা হীরা-মণি-মুক্তো! তাছাড়া রয়েছে রত্নখচিত অজস্র দেবতার মূর্তি, কারুকার্যময় পাত্র, প্রচুর ছবিও।

প্রথম ছবিটি তুলল ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ পত্রিকার ফোটোগ্রাফার। সেই ছবি কদিন পরে ওই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আজও তা বিভিন্ন বইপত্তরে দেখতে পাওয়া যায়।

বিস্ময়ের ঘোর কাটলে বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে বললেন,–ডাকাতরা সব ধনরত্ন নিয়ে পালাবার মুখে হঠাৎ কোনও কারণে সব ফেলে পালিয়ে গেছে। এবং বাইরের দরজাটাও আটকে দিতে বাধ্য হয়েছে, এমনকী ভাঙা সিলমোহরও জোড়া দিয়েছে আমরা তো সেটা দেখেই এসেছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? কেন তারা এমন করে সব ফেলে পালাল?

কার্টার বলল,–আমার ধারণা, ওরা সম্ভবত প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল।

একজন বিশেষজ্ঞ বললেন, কীসের ভয়?

কার্টার মাথা নেড়ে বলল, জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আতঙ্ক ছাড়া এর কোনও ব্যাখ্যা হতে পারে না। যেন তারা কোনও অশরীরী আত্মার বিভীষিকা দেখে পালিয়ে গিয়েছিল এই ঘর থেকে।

এ ঘরে তুতানখামেনের মমি নেই। সামনে একটা ছোট্ট দরজা দেখা যাচ্ছিল। সেই দরজাটা কিন্তু অক্ষত। তার জোরে তুতানখামেনের সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা সিলমোহর।

ভাঙা হল সেটা। ভেতরে ঘুপচি একটা ঘর। ঘরের মধ্যিখানে কফিন দেখা গেল। কফিনের ভেতর তুতানখামেনের মমি। অভিশপ্ত বালকরাজা ঘুমিয়ে আছেন অনন্ত ঘুমে।

কফিনের ঢাকনাটা সোনার পাতে তৈরি। সে-বাজারে তার দাম হিসেব করা হয়েছিল পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড! টাকার হিসেবে সে-যুগেই লক্ষাধিক টাকা।

এই দ্বিতীয় ঘরেও পোড়ামাটির পাত্রে অজস্র মণিমুক্তা ভরা। সিলমোহর ভেঙে সব গুনে তালিকা তৈরি হল।

দুই ঘরে যে ধনরত্ন পাওয়া গেল, কার্টার তার একটা মোটামুটি তালিকা করেছিল। এখনও সেই তালিকা আছে লন্ডন জাদুঘরে। কিন্তু তালিকার ধনরত্ন…

সে কথা পরে বলছি।

তুতানখামেনের মমি এবং গুপ্তধনের আবিষ্কারের খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পাঠানো হল রাজরাজড়ার উপত্যকায় পাহারা দিতে। গুপ্তধন নিয়ে যাওয়া হবে লন্ডনে।

কিন্তু সেসব কাণ্ডের আগে ঘটল বিচিত্র সব ঘটনা।

বিশেষজ্ঞদের মধ্যে পরস্পর তীব্র কলহ বেধে গেল। কী নিয়ে কলহ, আজ আর জানার কোনও উপায় নেই। যদিও অনুমান করতে অসুবিধা হয় না কিছু।

পরস্পরের মধ্যে কলহের পরিণামে কেউ-কেউ খুনও হয়ে গেলেন। কাটারকেও মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে উড়োচিঠি আসছিল। তাঁবুর মধ্যে সেইসব চিঠি এনে কে ফেলে রেখে যেত। কার্টার শেষপর্যন্ত ভয় পেয়ে লন্ডনে পালিয়ে গেল।

একটা ব্যাপার আঁচ করা যায়। গুপ্তধনের লোভেই যেন এসব কাণ্ড হচ্ছিল।

কিন্তু এ পর্যন্ত একটা কারণ আমরা আঁচ করতে পারি, পরের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে তা পারি না।

বিশেষজ্ঞদের মধ্যে খুনোখুনির পর যাঁরা বেঁচে ছিলেন, যে-যার দেশে ফিরে যান। তারপর অদ্ভুত রোগে ভুগে অল্প সময়েই মারা পড়েন। সমকালীন সংবাদপত্রে লেখা আছে–রহস্যময় মৃত্যু।

আর কার্টার?

এক সকালে তাকেও বিছানায় মৃত দেখা যায়। মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত। শুধু বলা হয়, হার্টফেল।

তার পাশে ডাক্তাররা লিখে রেখেছেন–সম্ভবত ভয় পেয়ে কিংবা আকস্মিক উত্তেজনায়।

কিন্তু তার চেয়েও বিচিত্র ব্যাপার, লন্ডনে শেষপর্যন্ত তুতানখামেনের গুপ্তধন বলে যে ধনরত্ন নিয়ে যাওয়া হয়, কার্টারের বেসরকারি তালিকা অনুসারে তা মাত্র শতকরা দশ ভাগ। বাকি নব্বই ভাগ কোথায় গেল? তার কোনও পাত্তা আজও মেলেনি।

সকল অধ্যায়

১. কাটিহারের গঙ্গারাম
২. আজমগড়ের অশরীরী
৩. খুলি যদি বদলে যায়
৪. হরির হোটেল
৫. ভূতে-মানুষে
৬. তিন-আঙুলে দাদা
৭. সেই সব ভূত
৮. ডনের ভূত
৯. রাতের মানুষ
১০. চোর বনাম ভূত
১১. রাতদুপুরে অন্ধকারে
১২. আম কুড়োতে সাবধান
১৩. সত্যি ভূত মিথ্যে ভূত
১৪. ছুটির ঘণ্টা
১৫. ভুতুড়ে ফুটবল
১৬. ম্যাজিশিয়ান-মামা
১৭. ভৌতিক বাদুড় বৃত্তান্ত
১৮. তুতানখামেনের গুপ্তধন
১৯. মুরারিবাবুর মোটরগাড়ি
২০. ভুতুড়ে বেড়াল
২১. ঝড়ে-জলে-অন্ধকারে
২২. কেংকেলাস
২৩. মুরারিবাবুর টেবিলঘড়ি
২৪. স্টেশনের নাম ঘুমঘুমি
২৫. কালো ছড়ি
২৬. ভূত নয় অদ্ভুত
২৭. অদ্ভুত যত ভূত
২৮. মুরারিবাবুর আলমারি
২৯. শ্যামখুড়োর কুটির
৩০. বাঁচা-মরা
৩১. অন্ধকারে রাতবিরেতে
৩২. কেকরাডিহির দণ্ডীবাবা
৩৩. অদলবদল
৩৪. জটায়ুর পালক
৩৫. অলৌকিক আধুলি রহস্য!
৩৬. চোরাবালির চোর
৩৭. পি-থ্রি বুড়ো
৩৮. নিঝুম রাতের আতঙ্ক
৩৯. ডাকিনীতলার বুড়ো যখ
৪০. আসল ভূতের গল্প
৪১. বকুলগাছের লোকটা
৪২. ঘুঘুডাঙার ব্রহ্মদৈত্য
৪৩. ছক্কামিয়ার টমটম
৪৪. হাওয়া-বাতাস
৪৫. মানুষ-ভূতের গল্প
৪৬. গেছোবাবার বৃত্তান্ত
৪৭. শনি-সন্ধ্যার পঞ্চভূত
৪৮. জ্যোৎস্নায় মৃত্যুর ঘ্রাণ
৪৯. তিন নম্বর ভূত
৫০. জ্যোৎস্নারাতে আপদ-বিপদ
৫১. চোর-পুলিশ
৫২. ভুতুড়ে চশমা
৫৩. রাতের আলাপ
৫৪. শর্মার বকলমে
৫৫. বৃষ্টিরাতের আপদ-বিপদ
৫৬. তেরো ভূতের কবলে
৫৭. দারোগা, ভূত ও চোর
৫৮. দুই বন্ধু
৫৯. ভূতের চেয়ে সাংঘাতিক
৬০. বাঁট্টুবাবুর টাট্টু
৬১. বিবেকবধের পালা
৬২. রাত-বিরেতে
৬৩. আধি ভৌতিক
৬৪. যার যা খাদ্য
৬৫. কালো ঘোড়া
৬৬. মাছ ধরার আপদ-বিপদ
৬৭. ভয়ভুতুড়ে
৬৮. কৃতান্তবাবুর কাঁকুলে যাত্রা
৬৯. বোতল যখন কোকিল হয়?
৭০. কালো বেড়াল
৭১. বহুপ্রকার ভূত
৭২. মুরগিখেকো মামদো
৭৩. দাড়িবাবাদের কবলে
৭৪. মুরারিবাবুর দেখা লোকটা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন