বাঁট্টুবাবুর টাট্টু

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

বাঁট্টুবাবুর টাট্টু

ঘোড়া ইজ ঘোড়া বাঁট্টুবাবু-ডাক্তার খাপ্পা হয়ে বললেন। এইচ ও আর এস ই হর্স; খবরদার! আর কক্ষনও আমার ঘোড়াকে টাট্টু-ফাটু বলবে না।

পণ্ডিতমশাই ফিক করে হেসে বললেন,–এই চতুস্পদ বক্ৰগতি বামন প্রাণীটিকে যদি ঘোড়া বলতে হয়, তা হলে সিঙ্গিমশাইয়ের রামছাগলটিও ঘোড়া!

বাঁট্টুবাবু-ডাক্তার তেড়েমেড়ে বললেন, তুমি পণ্ডিতমূর্খ! রামছাগলের শিং থাকে। আমার ঘোড়ার শিং আছে?

ছিল। তুমি তো ডাক্তার। অস্ত্রচিকিৎসা করে কেটে দিয়েছ।–পণ্ডিতমশাই ডিবে বের করে একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন এবং বিকট হাঁচলেন।

হয়তো হাঁচির শব্দেই ভয় পেয়ে আচমকা টাট্টু ঘোড়াটি পিঠে ডাক্তারবাবু সমেত প্রায় দিশেহারা হয়ে পালিয়ে গেল। পণ্ডিতমশাই খিকখিক করে হাসতে লাগলেন। ভিড় করে দাঁড়িয়ে যারা তর্কাতর্কি শুনছিল, তারাও হাসতে লাগল।

বাঁট্টুবাবুর আসল নামটা কী, এখনও অনেকে জানে না। বেঁটে গালা-্গোব্দা মানুষ বলে সবাই বাঁট্টুডাক্তার বলে। এই গ্রামের সরকারি দাঁতব্য চিকিৎসালয়ে তিনি বদলি হয়ে এসেছেন। এলাকার অবস্থা শোচনীয়। না রাস্তাঘাট না কিছু। বিষ্টিবাদলা হলেই জলকাদা। সাইকেলও চলে না। তাই বুদ্ধি করে ডাক্তারবাবু ঘোড়াটি কিনেছেন।

গুজব আছে, দূরের পাহাড়ি মুল্লুক থেকে ঘোড়ার পিঠে জাতা-শিল-নোড়া চাপিয়ে এ-তল্লাটে যারা বেচতে আসে, তাদের কাছেই নাকি বাঁট্টুবাবু ঘোড়াটি কিনেছেন। হাড়জিরজিরে একটা টাট্টুই বটে। নড়বড় করে দৌড়য়। এ-ও শোনা যায়, টাট্টু ঘোড়াটির স্বভাব বেয়াড়া বলেই আঁতাওয়ালারা তাকে কম দামে বেচে দিয়ে যায়। কেউ বলে পাঁচ টাকায়, কেউ বলে মাত্র দুটাকায়। আবার কেউ বলে, জাতাওয়ালাদের আন্ত্রিক রোগ হয়েছিল। তারই ভিজিট।

তবে এটা সত্যি, ডাক্তারবাবুর একটা ঘোড়ার খুব দরকার ছিল।

সেবার দেশে খুব আন্ত্রিক রোগের প্রাদুর্ভাব। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে মানুষ মরছে। ডাক্তারবাবুর দম ফেলার ফুরসত নেই। ওই টাট্টুর পিঠে চেপে গায়ে-গাঁয়ে চিকিৎসা করে বেড়াচ্ছেন। লোকে তারিফও করে, এমন ডাক্তার বহুকাল তারা দ্যাখেনি। খুব শিগগির তিনি দারুণ পপুলার হয়ে উঠেছেন এলাকায়।

বাঁট্টুবাবু এমনিতে হাসিখুশি মানুষ। কিন্তু কেউ তার ঘোড়ার বদনাম করলে বেজায় চটে যান। স্কুলের প্রাক্তন সংস্কৃতশিক্ষক পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে তার বেশ ভাব। পণ্ডিতমশাই বাইরে-বাইরে কাঠখোট্টা, ভেতর-ভেতর কিন্তু ভারি রসিক। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা হলেই ফিক করে হেসে বলেন, ওহে ডাক্তার, কিঞ্চিৎ শাস্ত্রবাক্য শ্রবণ করো।

–সময় নেই। কলে যাচ্ছি।

আহা, শাস্ত্রবাক্য শ্রবণে পুণ্য হয়।–পণ্ডিতমশাই আকৰ্ণ হেসে বলেন, দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত, মতান্তরে উচ্চৈঃশ্রবা। শিবের বাহন ষণ্ড। লক্ষ্মীর বাহন পেচক। গণেশের বাহন মূষিক। কার্তিকের বাহন ময়ূর। সরস্বতীর বাহন রাজহংস। শীতলার বাহন গর্দভ। আর বাঁটুর বাহন টাট্টু!

ডাক্তারবাবু বাঁকা হেসে বলেন,–তুমি খুব ভোজনরসিক শুনেছি। সিঙ্গিবাড়ির বুড়োসিঙ্গির শ্রাদ্ধে একশো আটখানা পান্তুয়া খেয়েছিলে। কিন্তু সাবধান! এটা আন্ত্রিকের সময়। আন্ত্রিকে ধরলে তখন, দেখছ তো? ব্যাগ খুলে প্রকাণ্ড ইনেশন-সিরিঞ্জ বের করে দেখান।

পণ্ডিতমশাইয়ের ইঞ্জেকশনকে বড় ভয়। ঝটপট গম্ভীর হয়ে বলেন, কিমাশ্চর্য! আমি তো তোমার স্তুতিই করলুম! নিন্দার ছলে স্তুতি! টাট্টুপৃষ্ঠে বাঁটু। কেমন অনুপ্রাস অলঙ্কার দিলুম, ভাবো।

ডাক্তার আর-একদফা শাসিয়ে টাট্টু ছোটান। বেঁটে গোস্বা মানুষের বেঁটে, বোগা টাট্টু ঘোড়াটি নড়বড় করে বক্ৰগতিতে অর্থাৎ এঁকেবেঁকে কী দৌড় দৌড়য়, দেখবার মতো দৃশ্য। দুষ্টু ছেলেরাও কখনও হল্লা করে দৌড়য়। তাতে বঁটুডাক্তারের টাট্টু ভয় পেয়ে কেলেঙ্কারি বাধায়। ডাক্তার হয়তো রুগি দেখতে যাচ্ছেন কেষ্টপুরে, তাকে নিয়ে গিয়ে তুলল বিষ্ণুপুরে।

তবে সবখানেই আন্ত্রিক রুগি। বিষ্ণুপুরের লোকেরা খুশিই হয়। ডাক্তারও রুগি পেয়ে খুশি হন।

পণ্ডিতমশাই গড়নে বাঁট্টুবাবুর দোসর। পরনে অবশ্য খাটো ধুতি আর হাতকাটা ফতুয়া। মাথায় দেখার মতো টিকি। স্কুলে রিটায়ার করেছেন কবে। তারপর থেকে পেশা যজমানি। এ-গাঁ সে-গাঁ থেকে পুজোআর্চায় ডাক আসে। তাই তারও বাহনের অভাবে বড় অসুবিধে। জলকাদা ভাঙা এবয়সে কষ্টকর।

বাঁট্টুডাক্তারের টাট্টু নিয়ে মুখে যতই রসিকতা করুন, ব্যাপারটা দেখার পর তাকেও ঘোড়ারোগে ধরেছিল। ভাবতেন, যেমন-তেমন একটা ঘোড়া পেলে ভালো হয়। কিন্তু ঘোড়ার যা দাম, তার পক্ষে ঘোড়া কেনা সম্ভব নয়। এক ভরসা, শীতের শেষে পাহাড়ি মুলুকের জাঁতাওয়ালারা যদি আসে এবং দৈবাৎ একটা রোগাভোগা ঘোড়া কম পয়সায় পেয়ে যান, ডাক্তারবাবুর মতোই।

পেলে দানাপানি খাইয়ে তাজা করে ফেলবেন। বাঁট্টুবাবুর মতো মাঠে কি জলার ধারে চরে নিজের আহার নিজেকে খুঁজতে দেবেন না। ডাক্তার বড় কঞ্জুস!

তখন সদ্য শরৎকাল চলেছে। বিচ্ছিরি বিষ্টিবাদলা, জলকাদা। কবে ফাল্গুন আসবে, তখন পাহাড়ি লোকেরা এসে যাবে। আজকাল আঁতার চল কমে গেছে। তবে শিল-নোড়ার চাহিদা আছে। পণ্ডিতমশাই প্রতীক্ষায় ছিলেন।

দেখতে-দেখতে কালীপুজো এসে গেল। প্রায় ছকিলোমিটার দূরে কালীপুরে এক যজমানবাড়ি আছে। পণ্ডিতমশাই তাদের কালীপুজোর পুরুত। প্রত্যেক বছর অবশ্য গোরুর গাড়ি পাঠায়। এবার ওই এলাকায় বন্যা হয়েছিল। রাস্তা ভেঙে-টেঙে ধুয়ে গেছে। জলকাদায় গাড়ি আসবে না।

কিন্তু তোক তো আসবে। পায়ে হেঁটেই যাবেন বরং। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল এল। যজমানবাড়ি থেকে লোক এল না। বংশানুক্রমে যজমান ওরা। এমন তো হওয়ার কথা নয়। বন্যায় মূর্তি গড়িয়ে পুজো না করতে পারুন, শাস্ত্রে ঘটপুজোর বিধি আছে না! গৃহদেবীর বাৎসরিক পুজো না হলেই অকল্যাণ। দিনে দিনে পাষণ্ড, নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে লোকেরা। পণ্ডিতমশাই ভাবলেন, নির্বোধ। তাই শাস্ত্রবিধি জানে না। বরং নিজে গিয়ে ব্যবস্থা করবেন পুজোর। আজই অমাবস্যা। পণ্ডিতমশাই বেরিয়ে পড়লেন। দিন ফুরিয়ে আসছে। আর তো দেরি করা যায় না। অতখানি পথ।

গ্রামের শেষে দিঘি। দিঘির পাড় দিয়ে পায়ে-চলা পথ। পণ্ডিতমশাই হঠাৎ দেখতে পেলেন, বাঁট্টুবাবুর টাট্টুটি জলের ধারে তখনও ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছে। অমনি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।

জলকাদা ভেঙে বাঁট্টুডাক্তার যদি কাহা-কঁহা মুল্লুক ওই টাট্টুর পিঠে চেপে ঘুরতে পারেন, তিনিই বা পারবেন না কেন? বেগড়বাই করলে ছাত্রদের যেমন কান টেনে শাস্তি দিতেন এবং আকর্ণ হেসে বলতেন, কান টানলেই মাথা আসে, মাথা এলেই বুদ্ধি আসে, তেমনি টাট্টুব্যাটার কান টেনে শায়েস্তা করবেন।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে পণ্ডিতমশাই নেমে গেলেন। হাতে একটি যষ্টি আছে। সাপখোপের ভয়, জলকাদায় আছাড় খাওয়ারও ভয়। সেজন্যই এই যষ্টি। আস্ত বাঁশের খেটে। এটাই ছিপটির কাজ দেবে।

ঘোড়াটিকে গুঁতো মেরে জলের ধার থেকে ওঠালেন। দেখলেন, বেশ শান্ত মেজাজের প্রাণী তো! আসলে বাঁট্টুডাক্তার খামোকা ওকে ছিপটি মারতেন বলেই অমন করে দৌড়ত।

পণ্ডিতমশাই তার গায়ে হাত রেখে আদর করে সাধুভাষায় বললেন,–বংসে! পুর্ণকর্মে গমন করিলে পুণ্যলাভ হইবে। প্রচুর চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় হেঁ-হে-হেঁ…! তোমার উচ্চৈঃশ্রবার ন্যায় সুচিক্কন বপু হইবে, হে-হে-হেঁ…!

টাট্রটি বোধ করি আনন্দে বিকট হ্রেষাধ্বনি করল, চিঁ হিঁ হিঁ হিঁ… এ যাবৎ তার হ্রেষাধ্বনি শোনা যায়নি। পণ্ডিতমশাই এক লাফে তার পিঠে চাপলেন। এমন যার হাঁকডাক, তার গায়ে জোর আছে বইকী!

লাগামছাড়া টাট্টু। আচমকা পিঠে ওজনের হেরফের টের পেয়ে থাকবে। তক্ষুনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দৌড়ল। পণ্ডিতমশাই অমনি ঝুঁকে তার গলা জড়িয়ে না ধরলে আছাড় খেতেন। সামলে নিয়ে তাকে কালীপুরমুখী করতে লাঠির গুতো মারলেন। টাট্টু আরও ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে দৌড়ল।

তারপর আর থামবার নাম নেই। আবছা আঁধার, জলকাদা ভেঙে পক্ষীরাজের মতো যেন ডালা মেলে উড়ছে। দেখতে-দেখতে আঁধার ঘনিয়ে এল। পণ্ডিতমশাই তাকে যত থামানোর জন্য তো মারেন, তত তার গতি বাড়ে। শেষে তিনি হাল ছেড়ে দিলেন।

অমাবস্যার রাত্তির। ঘুটঘুটে রাত্তির। দূরে একটা আলো জুগ-জুগ করছিল। ঘোড়াটা সেই আলোর দিকেই ছুটছে মনে হল পণ্ডিতমশাইয়ের। ততক্ষণে ঝাঁকুনিতে তার কোমরে ব্যথা ধরে গেছে। হাড় মটমট করে নড়ছে। জীবনে কখনও ঘোড়ায় চড়েননি। তাও জিন নেই ঘোড়ার পিঠে, পাদানি নেই। ঝুলন্ত পা দুখানিও জল কাদা কাটাখেচে একেবারে বিচিত্তির। হাতের লাঠিটাও কখন গেছে পড়ে। দু-হাতে ঘোড়ার গলা আঁকড়ে উবু হয়ে আছেন পণ্ডিতমশাই।

আলোর কাছাকাছি গিয়ে বাঁট্টুবাবুর টাট্টুর গতি কমল।

একটা গ্রামই বটে। দুধারে ঘরবাড়ি আবছা দেখা যাচ্ছে। একটা বারান্দায় লণ্ঠন জ্বলছিল। ঘোড়াটি সেখান গিয়ে থামল এবং বিকট ডাক ছাড়ল, চি হি হি হি!

অমনি কারা চেঁচিয়ে উঠল, এসে গেছেন! ডাক্তারবাবু এসে গেছেন!

তারপর চারদিকে হল্লাএকটা সাড়া পড়ে গেল। ওরে, ডাক্তারবাবু এসে গেছেন! ইঞ্জেকশন নিবি তো চলে আয়!

পণ্ডিতমশাই কথা বলার চেষ্টা করলেন। গলা শুকনো। কথা বেরোল না।

যে-বারান্দায় লণ্ঠন জ্বলছিল, সেখান থেকে কেউ হেঁড়েগলায় ধমক দিল, চো-ও-প সব! চো-ও-প!

হল্লাটা থেমে গেল। তখন সে ঘোড়ার কাছে এল। হাতের লণ্ঠন তুলে পণ্ডিতমশাইকে দেখে বলল, ডাক্তারবাবু, আপনার ব্যাগ দেখছিনে যে?

এবার পণ্ডিতমশাই অতিকষ্টে শুধু বললেন,–জল।

লোকটা হাঁক ছাড়ল, ওরে, জল নিয়ে আয়!

তক্ষুনি এক ঘটি জল এসে গেল। পণ্ডিতমশাই টের পেলেন জলটা বেজায় ঠান্ডা-হিম! তা হোক! ঢকঢক করে খেয়ে চোখে-মুখে ছড়িয়ে একটু সুস্থ হলেন। বললেন,–আমাকে নামাও বাবাসকল! তারপর সব বলছি।

কয়েকজন মিলে তাকে চ্যাংদোলা করে নামাল। মনে হল, গায়ের চাষি মানুষজন দিনমান জলকাদায় মাঠে কাজ করেছে, তাই এখনও হাতগুলো জলটার মতোই ঠান্ডা হিম।

লণ্ঠনের আলোটা খুব কম। স্পষ্ট করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। যেটুকু দেখা গেল, বারান্দাটা পাকা। বাড়িটাও পাকা ও দোতলা। কিন্তু পলেস্তারাখসা পুরোনো বাড়ি। জরাজীর্ণ অবস্থা বোঝা যায়। বারান্দাতেও ফাটল ধরেছে। লণ্ঠনধারী লোকটি ঢ্যাঙা, রোগাটে গড়ন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। প্রৌঢ় বলা চলে। মাথায় কাঁচাপাকা সিঁথে করা লম্বা চুল। ঘরে পণ্ডিতমশাইকে ঢুকিয়ে পিছু ফিরে বললেন,–ওরে, ডাক্তারবাবুর ঘোড়াটা দেখিস!

বাইরে থেকে সাড়া এল,–দেখছি বাড়ুজ্যেমশাই! ভাববেন না।

পণ্ডিতমশাই নমস্কার করে বললেন, আপনি ব্রাহ্মণ?

পালটা নমস্কার করে তিনি বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি?

পৈতে দেখিয়ে পণ্ডিতমশাই করুণ হাসলেন। বললেন,–আর বলবেন না।

যাচ্ছিলুম একখানে, এসে পড়লুম আর একখানে। ওই পাষণ্ড টাট্টু…

কথা কেড়ে বাঁড়ুজ্যেমশাই বললেন,–শুনেছি বটে! আপনাকে না দেখলেও যেমন আপনার কথা শুনেছি, তেমনি আপনার টাট্টুর কথা শুনেছি। আপনি নাকি সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি! কী সৌভাগ্য, আপনাকে পাওয়া গেল ডাক্তারবাবু!

পণ্ডিতমশাই হাত নেড়ে বললেন,–গণ্ডগোল হয়ে গেছে। গণ্ডগোল হয়ে গেছে।

কী গণ্ডগোল বলুন তো ডাক্তারবাবু? ব্যাগটা পড়ে গেছে তো? এক্ষুনি লোক পাঠাচ্ছি খুঁজতে। আপনি আগে রুগিকে দেখুন। আপনি চোখে দেখলেই আদ্ধেক সেরে যাবে। বাকি আদ্ধেক ইঞ্জেকশনে। আগে একটু জিরিয়ে নিন।

পণ্ডিতমশাই একটা নড়বড়ে চেয়ারে ধপাস করে বসে বললেন,-না-না! আপনি ভুল করছেন। আমি বঁটু-ডাক্তার নই।

অদ্ভুত হেসে বাঁড়ুজ্যেমশাই বললেন,–তা বললে কি চলে? এলাকা জুড়ে প্রবাদবাক্য চালু হয়ে গেছে জানেন তো?

যেখানে দেখবে টাট্টু
পিঠে ডাক্তার বাঁট্টু।
ঘুরে খটখট শব্দ
শুনে আন্ত্রিক জব্দ৷৷

পণ্ডিতমশাই জোরে মাথা নেড়ে বললেন, ভুল! ভুল! আমি হলুম ভেঁটু ভটচাজু।

বাঁড়ুজ্যেমশাই জোরে মাথা নেড়ে বললেন,-তা বললে চলে? পায়ে হেঁটে এলে বুঝতুম, বাটুবাবুর বদলে ভেঁটুবাবুই না হয় এসেছেন।

পণ্ডিতমশাই রাগ করে বললেন, খবরদার, ভেঁটু বলবেন না!

এই সময় বাইরে কে খ্যান-খ্যান গলায় চেঁচিয়ে উঠল, বাঁড়ুজ্যেমশাই, আপনার জামাই টাট্টুর পিঠে চেপে পালিয়ে যাচ্ছেন!

বাঁড়ুজ্যেমশাই হাঁক ছাড়লেন, ধর! ধর! ধরে আন!

আবার হল্লার শব্দ। অন্ধকারে ধাপধুপ শব্দে দৌড়াদৌড়ি। ধর! ধর! পালাল! পালাল!

পণ্ডিতমশাই বললেন,–ওই যাঃ! ঘোড়াটা।

তাঁকে থামিয়ে বাড়জ্যেমশাই বললেন,–ভাববেন না। এক্ষুনি ধরে ফেলবে।

–কিন্তু ব্যাপারটা কী? আপনার জামাইবাবাজি অমন করে পালালেন কেন?

গম্ভীর হয়ে বাঁড়ুজ্যেমশাই বললেন, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। আন্ত্রিক রোগের ভয় হয়েছে বাবাজির। পালানোর ধান্দায় আছে টের পেয়ে পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছিলুম। এই সুযোগে কেটে পড়েছে। কিন্তু যাবে কোথায়?

বলে তিনি পা বাড়ালেন ভেতরের দিকে। কই, আসুন। আগে রুগি দেখে নিন। তারপর প্রেসক্রিপশন, ইঞ্জেকশন ওসব হবে। আসুন, আসুন!

পণ্ডিতমশাই মরিয়া হয়ে বললেন, আমি ডাক্তার নই। যজমেনে-বামুন।

–তাতে কী? আমরাও যজমেনে বামুন ছিলুম। নইলে এই মুখদের গ্রামে কী কেউ বাস করতে আসে? আসুন? আসুন! যজমেনে বামুনেরা কি আজকাল ডাক্তার হচ্ছে না?

পণ্ডিতমশাই কাঁদকাঁদ হয়ে বললেন,–কিন্তু আমি যে ডাক্তারির কিসসু জানিনে।

জানার দরকার নেই। চাপা গলায় বাড়জ্যেমশাই বললেন, আপনাকে দেখলেই গিন্নির আন্ত্রিক সেরে যাবে। পথ তাকিয়ে শুয়ে আছেন। খালি বলেন, কই! বঁটু-ডাক্তার তো এলেন না! ওকে নাকি কল দিয়ে আসিনি বলে আমাকে শাসান। আমার হয়েছে জ্বালা।

ফিসফিস করে এসব কথা বলতে বলতে সিঁড়িতে উঠছিলেন তিনি। একটা হাতে পণ্ডিতমশাইয়ের একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছেন। অন্য হাতে লণ্ঠন। ওপরতলার বারান্দায় উঠে পণ্ডিতমশাই বললেন, আপনার হাতটা বিচ্ছিরি ঠান্ডা কেন বলুন তো?

বাঁড়ুজ্যেমশাই বললেন, যা বিষ্টিবাদলা আর আন্ত্রিক।

–আন্ত্রিকের সঙ্গে ঠান্ডার কী সম্পর্ক?

পণ্ডিতমশাইয়ের দিকে ঘুরে তিনি বললেন,–চুপ! চুপ! ওসব কথা বলতে নেই।

অন্ধকার ঘরের ভেতর প্রকাণ্ড সেকেলে খাট। তাতে গলা অবধি চাদর মুড়ি দিয়ে চিত হয়ে এক ভদ্রমহিলা শুয়ে আছেন। বাঁড়ুজ্যেমশাই লণ্ঠনটা তুলে ধরে বললেন,–ওগো, শুনছ? বাঁট্টুবাবু এসেছেন!

বাঁড়ুজ্যেগিন্নি চোখ খুলে তাকালেন। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন।

বাঁড়ুজ্যেমশাই বললেন, নাড়ি দেখতে বলছে। দেখুন তো! নইলে কেলেঙ্কারি বাধাবেন।

পণ্ডিতমশাই নাড়ি দেখতে জানেন না। কিন্তু উপায় নেই। নাড়ি দেখার ভঙ্গিতে বাঁড়ুজ্যেগিন্নির হাতটা ধরতেই নিজের হাত হিম হয়ে গেল। কী ঠান্ডা! চোখদুটোই বা অমন নিষ্পলক কেন?

বাঁড়ুজ্যেমশাই বললেন, নাড়ি টের পাচ্ছেন?

পণ্ডিতমশাই ভয়েভয়ে বললেন,–পাচ্ছি, আবার পাচ্ছি না। কিন্তু এঁর হাত দেখছি আপনার চেয়েও ঠান্ডা!

ফিক করে হেসে বড়জ্যেমশাই বললেন,–তা তো হবেই। বুঝলেন না? আমার তিনদিন আগে ফেঁসে গেছেন।

পণ্ডিতমশাই অবাক হয়ে বললেন,–কেঁসে গেছেন মানে? ওই তো দিব্যি তাকাচ্ছেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন।

অভ্যেস! বাঁড়ুজ্যেমশাই বললেন, ডাক্তার দেখলেই হাত বাড়ানো অভ্যেস। কথায় বলে অভ্যেস যায় না মলে।

–মরলে–মানে মৃত্যু হলে?

–আবার কী?

পণ্ডিতমশাই এক-পা দু-পা পিছোতে-পিছোতে বললেন, তার মানে উনি মড়া?

বাসি। আমার চেয়েও তিনদিনের বাসি।

–সর্বনাশ!

বাঁড়ুজ্যেমশাই মুচকি হেসে বললেন, সর্বনাশ কীসের? যতক্ষণ না আপনার ব্যাগ খুঁজে আনছে ওরা, বসুন এখানে। ততক্ষণ আপনাকে বেহালা বাজিয়ে শোনাই বসুন। বসুন! ওই দেখুন দেওয়ালে আমার বেহালা ঝুলছে। সাধে কি এমন চুল রেখেছিলুম? বেহালা বাজালে ঠিক এইরকম চুল রাখতে হয়।

পণ্ডিতমশাই কঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আপনি বেহালা বাজান নাকি?

বাজাতুম!–বেহালা পেড়ে নিয়ে বাঁড়ুজ্যেমশাই বললেন, যাত্রাদলে বেহালা বাজাতুম।

–বাজাতুম! তার মানে?

–দল উঠে গেল।

–কেন? কেন?

আবার কেন? আন্ত্রিক! আন্ত্রিকে গাঁসুষ্ঠু লোক বাকি কথাটা শোনা গেল না বেহলার কাঁক-কো সুরে। সুরটা কেমন যেন রাতবিরেতে বাঁশবনের শব্দর মতো, অস্বস্তিকর।

ওদিকে বাঁড়ুজ্যেগিন্নির সেই হাতটা একই অবস্থায় বেরিয়ে উঁচু হয়ে আছে তো আছেই। চোখদুটো পণ্ডিতমশাইয়ের দিকে। পণ্ডিতমশাই ততক্ষণে যা বোঝবার বুঝে গেছেন। যেই বাড়জ্যেমশাই বেহালা বাজাতে-বাজাতে সুরের আবেগে চোখ বুজেছেন, অমনি তিনি পা টিপে টিপে দরজার কাছে।

বাঁড়ুজ্যেগিন্নি চির্চি করে বলে উঠলেন,–পালিয়ে যাচ্ছে যে!

বাঁড়ুজ্যেমশাই সুরে তন্ময় হয়ে আছেন। শুনতে পেলেন না। সেই সুযোগে পণ্ডিতমশাই পড়ি-কি-মরি করে বাইরে এবং সিঁড়ি দিয়ে অন্ধকারে গড়াতে-গড়াতে নিচে।

তারপর বেরিয়েই দৌড়। সেই টাট্টুর মতো দৌড়। একেবারে দিশেহারা।

একটু পরে পেছনে হপ্পা শুনলেন, ধর! ধর! পালাচ্ছে! ডাক্তার পালাচ্ছে।

অমাবস্যার রাতে পণ্ডিতমশাই রামনাম জপতেজপতে জলকাদা ভেঙে দৌড়তে থাকলেন।…

ভোর হয়ে আসছে।

গায়ে আর এতটুকু জোর নেই পণ্ডিতমশাইয়ের। ধুতি-ফতুয়া কাদায় বিচিত্তির। চুলে কাদা, হাত-পায়ে কাদা। থপথপ করে পা ফেলে হাঁটছেন। মাঝে-মাঝে একটু বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন।

দিনের আলো আরও একটু পরিষ্কার হল। কঁচা রাস্তার দুধারে গাছ। ধানক্ষেত। একটা গাছের তলায় কেউ বসে ছিল। তাকে দেখামাত্র ওরে বাবা বলে দৌড়নোর উপক্রম করল সে।

পণ্ডিতমশাই হাত তুলে চেঁচিয়ে বললেন, মানুষ! মানুষ! আমি ভূত নই! মানুষ!

এক যুবক। পরনের প্যান্ট-শার্টের অবস্থা পণ্ডিতমশাইয়ের মতো। সে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, মা কালীর দিব্যি?

পণ্ডিতমশাই বললেন, মা কালীর দিব্যি!

যুবক সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বলল, আসা হচ্ছে কোথা থেকে?

–বেহালা বাজিয়ে বাঁড়ুজ্যেমশাইয়ের বাড়ি থেকে।

ওরে বাবা! দিনের বেলা এতদুরেও লোক পাঠিয়েছে! –বলে যুবকটি আবার দৌড়নোর জন্য পা বাড়াল।

পণ্ডিতমশাই ঝটপট বললেন,-বাবাজি! তোমায় চিনেছি। তুমিই তাহলে বাঁড়ুজ্যেমশাইয়ের সেই পলাতক জামাই? শোনো, শোনো, আমি সত্যিই মানুষ।

–তা হলে রামনাম করুন।

–রাম রাম রাম রাম রাম…

বাঁড়ুজ্যের জামাই ফিক করে হেসে বলল, –থাক, থাক। বুঝেছি। তাহলে আপনিই সেই বাঁট্টুবাবু-ডাক্তার?

–ধুস! আমি ভেঁটু ভটচাজ। লোকে বলে পণ্ডিতমশাই। বাঁটু-ডাজারের টাট্টু চুরি করেই তো বিপদে পড়েছিলুম!

বিপদ তার চেয়ে আমারই বেশি, পণ্ডিতমশাই!–বাঁড়ুজ্যেমশাইয়ের জামাই করুণ মুখে বলল, অবস্থা বুঝুন! গাঁসুদ্ধ মড়া। আমার শ্বশুরমশাই, শাশুড়িঠাকরুন পর্যন্ত। অথচ আমাকে নড়তে দেবেন না শ্বশুরমশাই। কারণ আমি যে ঘরজামাই। আমাকে ভিটে আগলাতে হবে।

এতক্ষণে প্রাণভরে হাসতে পারলেন পণ্ডিতমশাই। বললেন,–তা বাবাজি, টাষ্ট্রব্যাটাচ্ছেলে কোথায় গেল?

–বলা কঠিন। অন্ধকারে আমাকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে উধাও।

–চলো, বাবাজি! কথা বলতে বলতে এগোই।

পণ্ডিতমশাই। আমার শ্বশুরমশাই আর গাঁয়ের লোক যে ভূত হয়ে রইল?

পণ্ডিতমশাই বললেন,–ভেবো না। গয়ায় তোমাকে নিয়ে গিয়ে পিণ্ডদান করালেই হল। সব পৃথিবী ছেড়ে প্রেতলোকে চলে যাবে। কিন্তু বাবাজি, বউমাকে তো দেখলুম না?

–আমার মামাশ্বশুর গয়ায় স্টেশনমাস্টার। এখন মনে হচ্ছে, ভাগ্নির পিণ্ড দিয়েছেন। তাই আমিও আপনার বউমাকে দেখতে পাইনি।

এবার পাকারাস্তার মোেড় এসে গেল। রাস্তা চিনতে পেরে পণ্ডিতমশাই বললেন,–চলো বাবাজি। আপাতত আমার বাড়ি গিয়ে দুমুঠো খাবে। তারপর দুপুরের ট্রেনে দুজনে গয়াযাত্রা করব।

গ্রামের দিঘিতে স্নান করে জলকাদা ধুয়ে নিয়ে দুজনে ঘাটে নামলেন। নেমেই পণ্ডিতমশাইয়ের দৃষ্টি গেল ওপারের জলের ধারে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন,–ওই দ্যাখো! ওই সেই পাষণ্ড পামর চতুষ্পদ হতচ্ছাড়া! রামছাগল!

বাঁট্টু-ডাক্তারের সেই টাট্টুই বটে। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে গম আর ঘাস ছিঁড়ে খাচ্ছে। সবে বরাদুর উঠেছে। বুদ্ধিমান টাট্টু। দিব্যি চান করেও নিয়েছে।

সকল অধ্যায়

১. কাটিহারের গঙ্গারাম
২. আজমগড়ের অশরীরী
৩. খুলি যদি বদলে যায়
৪. হরির হোটেল
৫. ভূতে-মানুষে
৬. তিন-আঙুলে দাদা
৭. সেই সব ভূত
৮. ডনের ভূত
৯. রাতের মানুষ
১০. চোর বনাম ভূত
১১. রাতদুপুরে অন্ধকারে
১২. আম কুড়োতে সাবধান
১৩. সত্যি ভূত মিথ্যে ভূত
১৪. ছুটির ঘণ্টা
১৫. ভুতুড়ে ফুটবল
১৬. ম্যাজিশিয়ান-মামা
১৭. ভৌতিক বাদুড় বৃত্তান্ত
১৮. তুতানখামেনের গুপ্তধন
১৯. মুরারিবাবুর মোটরগাড়ি
২০. ভুতুড়ে বেড়াল
২১. ঝড়ে-জলে-অন্ধকারে
২২. কেংকেলাস
২৩. মুরারিবাবুর টেবিলঘড়ি
২৪. স্টেশনের নাম ঘুমঘুমি
২৫. কালো ছড়ি
২৬. ভূত নয় অদ্ভুত
২৭. অদ্ভুত যত ভূত
২৮. মুরারিবাবুর আলমারি
২৯. শ্যামখুড়োর কুটির
৩০. বাঁচা-মরা
৩১. অন্ধকারে রাতবিরেতে
৩২. কেকরাডিহির দণ্ডীবাবা
৩৩. অদলবদল
৩৪. জটায়ুর পালক
৩৫. অলৌকিক আধুলি রহস্য!
৩৬. চোরাবালির চোর
৩৭. পি-থ্রি বুড়ো
৩৮. নিঝুম রাতের আতঙ্ক
৩৯. ডাকিনীতলার বুড়ো যখ
৪০. আসল ভূতের গল্প
৪১. বকুলগাছের লোকটা
৪২. ঘুঘুডাঙার ব্রহ্মদৈত্য
৪৩. ছক্কামিয়ার টমটম
৪৪. হাওয়া-বাতাস
৪৫. মানুষ-ভূতের গল্প
৪৬. গেছোবাবার বৃত্তান্ত
৪৭. শনি-সন্ধ্যার পঞ্চভূত
৪৮. জ্যোৎস্নায় মৃত্যুর ঘ্রাণ
৪৯. তিন নম্বর ভূত
৫০. জ্যোৎস্নারাতে আপদ-বিপদ
৫১. চোর-পুলিশ
৫২. ভুতুড়ে চশমা
৫৩. রাতের আলাপ
৫৪. শর্মার বকলমে
৫৫. বৃষ্টিরাতের আপদ-বিপদ
৫৬. তেরো ভূতের কবলে
৫৭. দারোগা, ভূত ও চোর
৫৮. দুই বন্ধু
৫৯. ভূতের চেয়ে সাংঘাতিক
৬০. বাঁট্টুবাবুর টাট্টু
৬১. বিবেকবধের পালা
৬২. রাত-বিরেতে
৬৩. আধি ভৌতিক
৬৪. যার যা খাদ্য
৬৫. কালো ঘোড়া
৬৬. মাছ ধরার আপদ-বিপদ
৬৭. ভয়ভুতুড়ে
৬৮. কৃতান্তবাবুর কাঁকুলে যাত্রা
৬৯. বোতল যখন কোকিল হয়?
৭০. কালো বেড়াল
৭১. বহুপ্রকার ভূত
৭২. মুরগিখেকো মামদো
৭৩. দাড়িবাবাদের কবলে
৭৪. মুরারিবাবুর দেখা লোকটা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন