আসল ভূতের গল্প

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ভূতের গল্পও তো অনেকেই শুনেছে। কিন্তু দেখেছে ক’জন? যারা দেখেছে বলে, তারা কিন্তু নকল ভূতই দেখেছে। আসল ভূত কি দেখা দেয়? 

বলবে, ভূতের আবার আসল-নকল আছে নাকি? আলবাৎ আছে। যেমন ধরো, দুপুর রাত্রে পাঁচিলের ধারে হঠাৎ দেখলে ঘোমটা পরে কে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভীষণ ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করে ঘরে ঢুকলে। তখন বাবা গিয়ে দেখলেন, খেন্তিপিসি দিনে কাপড় শুকোতে দিয়েছিলেন তারে। তোলা হয়নি। বাতাস বইছিল জোরে। কাপড়টা উড়ে গিয়ে জবাগাছের মাথায় জড়িয়ে গেছে। আর তাই দেখে হঠাৎ ভূত- ভূত ভেবে বসে আছ। 

এই হল নকল ভূত। নকল ভূত আমিও কি কম দেখেছি? কিন্তু সে গল্প শুনেও লাভ নেই। আমার বোকামি ধরা পড়বে। তোমরাও হেসে খুন হবে। নিজের বোকামির কথা কি কেউ বলতে চায় ? 

আমি একবার একটা আসল ভূত দেখেছিলুম। একেবারে নির্ভেজাল আদি অকৃত্রিম ভূত। সেই ভূতের গায়ে অনায়াসে ‘বিশুদ্ধ এবং টাটকা’ বলে লেবেল এঁটে দেওয়া যায়। 

কিন্তু এখন যেমন সহজে বলে যাচ্ছি, আসল ভূতটা দেখার সময়ে মোটেও ব্যাপারটা সহজ ঠেকেনি। ওরে বাবা! সে বড় গোলমেলে ব্যাপার। আর সেই দৃশ্য মনে পড়লে আজও গায়ের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। 

তখন আমার বয়স মোটে বারো বছর। পড়ি ক্লাস এইটে। আমাদের স্কুলটা ছিল দুটো গাঁয়ের মধ্যিখানের মাঠে একেবারে নিরিবিলি জায়গায়। চারপাশে বড়- বড় গাছ আর ঝোপঝাড় ছিল। পিছনের পুকুরপাড়ে কল্কে ফুলের জঙ্গল ছিল। তার মাঝখানে ছিল মুক্তকেশীর মন্দির। ভাঙাচোরা কতকালের পুরোনো মন্দির। সাপের ভয়ে ওদিকটায় ছেলেরা খুব কমই যেত । 

আমার এক সহপাঠী ছিল, তার নাম পোদো। কালো কুচকুচে চেহারা। বলিষ্ঠ গড়ন। খেলাধুলোয় খুব ঝোঁক ছিল তার। কিন্তু পড়াশুনায় তেমন কিছু নয়। কোনওরকমে টেনেটুনে পাস করে যেত। 

আমার সঙ্গে পোদোর ভাব হওয়ার কারণ, ক্লাসে মাস্টারমশাই পড়া জিগ্যেস করলে আমি ওকে ফিসফিস করে বলে দিতুম। পরীক্ষার সময় তো কথাই নেই। আমার খাতা থেকে টুকতে দিতুম। এতে আমারও লাভ ছিল। কারও সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি হলে পোদো আমার পক্ষ নিত। 

তখন পাড়াগাঁয়ে প্রচণ্ড ম্যালেরিয়া জ্বরের উপদ্রব ছিল। মহামারীর মতো গাঁ উজাড় হয়ে যাচ্ছিল এই রোগে। বার্ষিক পরীক্ষার কয়েকদিন আগে বেচারা পোদো ম্যালেরিয়ায় ভুগে মারা গেল। আমি একেবারে একা হয়ে গেলুম যেন। মন ভেঙে গেল। পড়াশুনো যা করেছিলুম সব ভুলে গেলুম যেন । 

ইংরেজি আর বাংলা পরীক্ষা তো কোনওরকমে দিলুম। তৃতীয় দিনে ভূগোল আর সংস্কৃত। ভূগোলও মোটামুটি হল। কিন্তু সংস্কৃতের প্রশ্ন দেখে চড়কগাছ। একে তো পণ্ডিতমশাইয়ের ক্লাসে বরাবর ফাঁকি দিয়েছি, তার ওপর এই দেবভাষার ব্যাকরণ ব্যাপারটা আমার কাছে প্রচণ্ড হেঁয়ালি ঠেকেছে বরাবর। তখন শীতের বিকেল নেমেছে। স্কুলের পেছনের গাছপালায় ঘন ছায়ায় ঘরের ভেতরটা আবছা হয়ে এসেছে। তখন তো গাঁয়ে বিদ্যুৎ ছিল না । 

আমি জানালার পাশের সিটে বসেছিলুম। প্রশ্নপত্র নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি। হঠাৎ চোখের কোনা দিয়ে দেখলুম, হ্যাঁ—সেই পোদোই বটে, পরনে খাকি হাফ প্যান্ট, গায়ে ময়লা একটা শার্ট, জানালার বাইরে ঝোপের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এবং আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করছে। 

প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম আর কী! ভয়ে নয়—আনন্দে। কিন্তু তক্ষুনি মনে- পড়ে গেল, পোদো তো মারা গেছে। আর অমনি সারা শরীর হিম হয়ে গেল। ভয়ে চোখ বুঝে ফেললুম । 

সংস্কৃতের পরীক্ষা। পণ্ডিতমশাই নিজেই গার্ড দিচ্ছিলেন ঘরে। বললেন—ও কী রে তপু। ধ্যান করছিস নাকি? অ্যাঁ? 

চোখ খুলে কাঁচুমাচু মুখে বললুম,–পো-পো-পোদো স্যার। 

পোদো? পোদোর জন্য শোকপ্রকাশ করছিস? অ্যাঁ? –এই বলে পণ্ডিতমশাই আকর্ণ হাসতে লাগলেন। ঘরসুদ্ধ ছেলেরাও আমার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি শুরু করল। 

পণ্ডিতমশাই তারপর হাসি থামিয়ে গর্জে বললেন,–বন্ধুর জন্যে শোকপ্রকাশ পরে হবে। বুঝেছ ? 

পণ্ডিতমশাই কিন্তু ভীষণ রাগী মানুষ। দেয়ালে মাথা ঠুকে দিতেন। নয়তো কান ধরে মার্চ করাতেন। এমনি সব শাস্তি দিতেন আমাদের। তাই আর ওঁনাকে কিছু বলার সাহস হল না। লেখার ভান করলুম। 

কিন্তু মনে অস্বস্তি। আবার একটু পরে চোখের কোনা দিয়ে জানালার বাইরে তাকালুম। কী আশ্চর্য! পোদোই তো! ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এবং চোখ টিপে আমাকে ইশারা করছে। এবার স্পষ্ট দেখলুম, তার হাতে একটা কাগজ। কাগজের দিকে ইশারা করে সে কিছু বলতে চাইছে যেন। 

কাঁপতে কাঁপতে বললুম, – পো-পো-পোদো স্যা-স্যার! 

পণ্ডিতমশাই এবার সোজা আমার কাছে এসে বাজপড়ার মতো আওয়াজ দিলেন,—রসিকতা হচ্ছে? রসিকতা? পাষণ্ড! অনঢান। বলীবর্দ ! 

তখন গলা শুকিয়ে গেছে। বোবায় ধরেছে যেন। অতিকষ্টে বললুম, জ-জল স্যার! 

ক্লাসে ছাত্রদের জল খাওয়ানোর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। বাইরে টিউবেলে গিয়ে খেয়ে আসতে হতো। টিউবেলটা ছিল খেলার মাঠের এককোনায়। পণ্ডিমশাই দাঁত খিঁচিয়ে বললেন,—জল খাবে তো পোদো-পোদো করছ কেন মূর্খ? যাও—গিয়ে জল খেয়ে এসো। 

বাইরে গেলুম। কোথাও কেউ নেই। পরীক্ষার সময় আজকালকার মতো গার্জেনরা তখন স্কুলের আনাচে-কানাচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন না । 

ভয়ে-ভয়ে টিউবলের কাছে গিয়ে সেই ঝোপটার দিকে তাকালুম। নাঃ। কেউ নেই তো ওখানে! একহাতে টিউবেলের হাতল চেপে অন্যহাতে জল খাওয়া ভারি কঠিন। হঠাৎ মনে হল হাতলটায় কেউ চাপ দিচ্ছে। গলগল করে জল পড়তেও দেখলুম। জলের তেষ্টা এত বেশি যে অত কিছু লক্ষ না করে জল খেতে থাকলুম। 

জল খাওয়ার পর ভয়টা অনেকটা কেটে গেল। তখন মনে হল, নেহাত চোখের ভুল। সেই সময় চোখ গেল মুক্তকেশীর মন্দিরের দিকে। অমনি আবার বুক কেঁপে উঠল। কী অবাক। পোদো মন্দিরের বারান্দা থেকে হাত ইশারা করে ডাকছে। 

মনে হল, তাহলে নিশ্চয় পোদো একেবারে মারা পড়েনি। তার মানে, শ্মশানে গিয়ে যেভাবেই হোক বেঁচে উঠেছিল—কিংবা কোনও সাধুর দয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। আমাদের খবরটা কোনও কারণে জানানো হয়নি। 

ছেলেমানুষের বুদ্ধিতে এভাবেই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করলুম। মরিয়া হয়ে মন্দিরের জঙ্গলে ঢুকে পড়লুম । 

সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে বললুম,—পোদো! তুই বেঁচে আছিস? 

পোদো ঠোটে আঙুল রেখে ইশারায় চুপ করতে বলল। তারপর বারান্দার ওপর থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ ফেলে দিল। কাগজটা খুলে দেখি, সংস্কৃতের প্রশ্নের কতকগুলো উত্তর লেখা রয়েছে। ঠিক এগুলোই আমার জানা ছিল না। 

কাগজে গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা উত্তরগুলো প্রাণপণে মুখস্ত করতে থাকলুম। পোদোর বাঁচা-মরা ব্যাপারটা তখন মাথায় আর নেই, পরীক্ষা বলে কথা। 

একটু পরেই আচমকা কে আমার কান ধরে ফেলল। অমনি আঁতকে উঠে দেখি পণ্ডিতমশাই। 

পণ্ডিতমশাই চেরা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন,–ওরে হতচ্ছাড়া তস্কর। ওরে কূটবুদ্ধি কুষ্মাণ্ড! পড়াশুনায় ফাঁকি দিয়ে এখন এমনি করে চুরির রাস্তা ধরেছ? 

কাঁদোকাঁদো স্বরে বললুম, না স্যা-স্যার। পো-পো-পো… 

চোপরাও! স্তব্ধ হও তস্কর বালক! —পণ্ডিতমশাই আমাকে সেই কাগজটা শুদ্ধু হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চললেন।… 

ক্লাস এইটে ফেল করেছিলুম সেবার—সেই ওই পোদোর ভূতের জন্যেই । কিন্তু কেউ কি সেকথা বিশ্বাস করল? বাবা বলেছিলেন-পড়াশুনা করবে না। তাই টুকলিফাই ছাড়া উপায় ছিল না। ধরা পড়ে বেচারা পোদোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে! 

কিন্তু কাকে বোঝাব, ব্যাপারটা কত সত্যি। আমি বলেছিলুম–কিন্তু হাতের লেখাটা তো আমার নয়! পোদোর লেখা ওটা। মিলিয়ে দেখ না। 

শুনে দাদা বলেছিলেন,—হতভাগা। অসুখের আগে পোদো তোর কাছে সংস্কৃতের মানে বইটা নিয়ে গিয়েছিল না? আমি দেখেছি, বইটা ফেরত আনার পর ওটার মধ্যে পোদোর হাতে লেখা একটা কাগজ ছিল। চালাকি করিস নে ! 

আমি কিন্তু দেখিইনি কোনও কাগজ। যাক গে, যা হওয়ার হয়েছে। এই গল্পটা অ্যাদ্দিন কাকেও বলিনি। বললেই বলবে, টুকলিফাই করে ভূতের ঘাড়ে দেওয়া হচ্ছে। মহা ধড়িবাজ ছেলেরে বাবা!

সকল অধ্যায়

১. কাটিহারের গঙ্গারাম
২. আজমগড়ের অশরীরী
৩. খুলি যদি বদলে যায়
৪. হরির হোটেল
৫. ভূতে-মানুষে
৬. তিন-আঙুলে দাদা
৭. সেই সব ভূত
৮. ডনের ভূত
৯. রাতের মানুষ
১০. চোর বনাম ভূত
১১. রাতদুপুরে অন্ধকারে
১২. আম কুড়োতে সাবধান
১৩. সত্যি ভূত মিথ্যে ভূত
১৪. ছুটির ঘণ্টা
১৫. ভুতুড়ে ফুটবল
১৬. ম্যাজিশিয়ান-মামা
১৭. ভৌতিক বাদুড় বৃত্তান্ত
১৮. তুতানখামেনের গুপ্তধন
১৯. মুরারিবাবুর মোটরগাড়ি
২০. ভুতুড়ে বেড়াল
২১. ঝড়ে-জলে-অন্ধকারে
২২. কেংকেলাস
২৩. মুরারিবাবুর টেবিলঘড়ি
২৪. স্টেশনের নাম ঘুমঘুমি
২৫. কালো ছড়ি
২৬. ভূত নয় অদ্ভুত
২৭. অদ্ভুত যত ভূত
২৮. মুরারিবাবুর আলমারি
২৯. শ্যামখুড়োর কুটির
৩০. বাঁচা-মরা
৩১. অন্ধকারে রাতবিরেতে
৩২. কেকরাডিহির দণ্ডীবাবা
৩৩. অদলবদল
৩৪. জটায়ুর পালক
৩৫. অলৌকিক আধুলি রহস্য!
৩৬. চোরাবালির চোর
৩৭. পি-থ্রি বুড়ো
৩৮. নিঝুম রাতের আতঙ্ক
৩৯. ডাকিনীতলার বুড়ো যখ
৪০. আসল ভূতের গল্প
৪১. বকুলগাছের লোকটা
৪২. ঘুঘুডাঙার ব্রহ্মদৈত্য
৪৩. ছক্কামিয়ার টমটম
৪৪. হাওয়া-বাতাস
৪৫. মানুষ-ভূতের গল্প
৪৬. গেছোবাবার বৃত্তান্ত
৪৭. শনি-সন্ধ্যার পঞ্চভূত
৪৮. জ্যোৎস্নায় মৃত্যুর ঘ্রাণ
৪৯. তিন নম্বর ভূত
৫০. জ্যোৎস্নারাতে আপদ-বিপদ
৫১. চোর-পুলিশ
৫২. ভুতুড়ে চশমা
৫৩. রাতের আলাপ
৫৪. শর্মার বকলমে
৫৫. বৃষ্টিরাতের আপদ-বিপদ
৫৬. তেরো ভূতের কবলে
৫৭. দারোগা, ভূত ও চোর
৫৮. দুই বন্ধু
৫৯. ভূতের চেয়ে সাংঘাতিক
৬০. বাঁট্টুবাবুর টাট্টু
৬১. বিবেকবধের পালা
৬২. রাত-বিরেতে
৬৩. আধি ভৌতিক
৬৪. যার যা খাদ্য
৬৫. কালো ঘোড়া
৬৬. মাছ ধরার আপদ-বিপদ
৬৭. ভয়ভুতুড়ে
৬৮. কৃতান্তবাবুর কাঁকুলে যাত্রা
৬৯. বোতল যখন কোকিল হয়?
৭০. কালো বেড়াল
৭১. বহুপ্রকার ভূত
৭২. মুরগিখেকো মামদো
৭৩. দাড়িবাবাদের কবলে
৭৪. মুরারিবাবুর দেখা লোকটা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন