২. কমাণ্ডার আমজাদ বেলাল
কাশ্মীর রণাঙ্গনে আল্লাহর সাহায্য আমি স্বচক্ষে দেখেছি
কিমাণ্ডার আমজাদ বেলাল ১৯৯১ সনের নভেম্বর মাসে অধিকৃত কাশ্মীরে প্রবেশ করেন। সেখানে সুদীর্ঘ এক বছর অবস্থান করে আবার তিনি পাকিস্তানে ফিরে আসেন। কাশ্মীরে তিনি কিভাবে পৌছলেন, সফরে কি কি সমস্যায় পড়েছেন, সেখানকার মুসলমানদের মানসিকতা কেমন, সেখানে ইণ্ডিয়ার সৈন্যরা কিভাবে ক্রেক ডাউন করে, তিনি কিভাবে সৈন্যদের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং আল্লাহর যে সব মদদ তিনি নিজ চোখে দেখেছেন, তার বিবরণ এ লেখায় চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর এ ঘটনাবহুল এক বছরের ইতিহাস আমরা তাঁর জবানীতেই হুবহু পেশ করছি।
আল্লাহ্ তা’আলার অসীম রহমতে আমি বেশ কয়েক বছর আফগান জিহাদে শরীক ছিলাম। সেখানকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
ছাত্র অবস্থায় আমার মনে কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য জিহাদ করার আগ্রহ জাগে। আর সে প্রেরণায়ই আমি ঘর ছেড়ে হাজার মাইল দূরে আফগান ভূমিতে জিহাদ করার জন্যে উপস্থিত হই। সেখানে মুজাহিদ ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর জিহাদে যোগদান করি।
১৯৯১ সালের নভেম্বরে একটি মুজাহিদ সংগঠনের গ্রুপ কমাণ্ডার হিসেবে আমাকে কাশ্মীরে পাঠানো হয়। এর আগে এক অপারেশনে আমি আহত হই। আঘাত থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়ায় সংগঠনের চীফ কমাণ্ডার আমাকে আরো কিছুদিন বিশ্রাম নেয়ার পর রওনা করার পরামর্শ দেন। কিন্তু সাথীদের আবেগ ও আগ্রহ দেখে আমার আর বসে থাকতে ইচ্ছে হল না। চীফ কমাণ্ডারকে বারবার অনুরোধ করে অনুমতি আদায় করে নিলাম।
আমাদের গ্রুপে মোট একত্রিশ জন মুজাহিদ। এর মধ্যে আল-বারক’ নামক একটি সংগঠনেরও বেশ কিছু মুজাহিদ ছিল। এদের সকলের জিম্মাদারী আমার উপর ন্যস্ত করা হয়। আমাদের গ্রুপের আগে আরও চারটি গ্রুপ আজাদ কাশ্মীর থেকে অধিকৃত কাশ্মীরে রওনা করেছিল। ইণ্ডিয়ান সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে পথ তৈরি করতে না পারায় তারা ফিরে আসে।
১৮ই নভেম্বর পরম করুণাময় আল্লাহর নিকট মুনাজাত করে রওনা করলাম। আমাদের একত্রিশজনের মধ্যে ত্রিশজনই অধিকৃত কাশ্মীরের বাসিন্দা।
একমাত্র আমি ছিলাম আজাদ কাশ্মীরের। নির্যাতিত মুসলমান ভাইদের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ ও জীবনের মায়া ত্যাগ করে সশস্ত্র অবস্থায় দুর্গম পাহাড়ী পথে রওনা করলাম। অধিকৃত কাশ্মীরের সীমান্তে প্রবেশের পর আমাদের চৌদ্দ হাজার ফুট উঁচু একটি পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। সাধারণতঃ এ পাহাড়ে উঠতে দশ ঘন্টার মত সময় লাগে। আমরা দ্রুততার সাথে চলে সাত ঘন্টায় সেখানে উঠি । এ দীর্ঘ চলার পথে অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে এবং আল্লাহর সাহায্য আমরা নিজ চোখে অবলোকন করি।
আল্লাহর প্রথম সাহায্য
সন্ধ্যার পর আমাদের সফর শুরু হয়। রাত দু’টার দিকে আমরা সোজা পূর্ব মুখো হয়ে সফর অব্যাহত রাখি। চলতে চলতে আমরা ভুলক্রমে ভারতীয় সৈন্যদের দু’টি পোস্টের মধ্যবর্তী স্থানে ঢুকে পড়ি। দু’ পোস্টের ব্যবধান বড়-জোর দু’শ মিটার। মাঝখানে একটি তার ঝুলানো। তারের সাথে টিনের ঘন্টি বাধা। উদ্দেশ্য, কেউ মধ্যবর্তী স্থান অতিক্রম করলে তারের টানে ঘন্টিটা বেজে উঠবে এবং দু’পাশের পোস্টের সৈন্যরা এ উপস্থিতির খবর জেনে যাবে।
আমি অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে ইশারায় সাথীদের বসে যেতে বললাম। এরপর তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, আর পিছু হটা যাবে না, সামনে পিছনে সমান বিপদ। যেভাবে হোক সামনে এগুতেই হবে। সবাইকে
অবস্থার ভয়াবহতা বুঝিয়ে বলে আল্লাহর কাছে দু’আ করতে থাকি।
দুশমনরা অবশ্যই আমাদেরকে দেখতে পেয়েছিল। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, কখন তারা হামলা করে। ইতিমধ্যে আমরা অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী পোস্টের লোকজনের কথার আওয়াজ শুনতে পাই। সেখান থেকে কেউ নিকটবর্তী পোস্টের কমাণ্ডারকে ওয়ারলেসে বলছে, মনে হচ্ছে আমাদের পোস্টের মধ্যে দুশমন ঢুকে পড়েছে।
নিকটবর্তী পোস্টের কমাণ্ডার বলল, না তেমন তো কিছু দেখছি না। আর এর মধ্যে কার ঢুকতে সাহস হবে?”
দূরবর্তী পোস্টের কমাণ্ডার বলল, ‘ভাল করে দেখ, আমার মনে হয় কিছু দেখতে পাচ্ছি। অপর কমাণ্ডার দৃঢ়তার সাথে তার ধারণা খণ্ডন করল।
তারা ঠিকই আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা লড়াই করতে রাজী ছিল না। সম্ভবতঃ তারা মনে করেছিল, এত সাহস নিয়ে যারা এ পর্যন্ত এসেছে, তাদের উপর আঘাত করলে পাল্টা আক্রমণ অবশ্যই হবে। এ মধ্যরাতে তাদের এতবড় ঝুঁকি নেয়ার সাহস ছিল না।
আমরা আধা ঘন্টা অবস্থানের পরও দেখলাম, তারা আমাদের ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অতঃপর একটা লাঠির সাহায্যে তার উঁচু করে ধরে নীচ দিয়ে একে একে ক্রোলিং করে সবাই বেরিয়ে আসি।
আমাদের সহযোগী অন্য গ্রুপের সাথীদের ইসলাম ও জিহাদের ব্যাপারে তেমন একটা জ্ঞান ছিল না, এমন কি নামাজের ব্যাপারেও তারা উদাসীন ছিল। আমি আস্তে আস্তে তাদেরকে আল্লাহর কুদরতের বর্ণনা দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখি। পথে যখনই আমরা বিশ্রাম নিতাম বা নামাজের সময় হত, সবাইকে নামাজের তাগাদা দিতাম। আল-হামদু লিল্লাহ, আমাদের কাফেলার সকল সাথী পথেই পাকা নামাযী হয়ে যায় এবং তারা আমার সাথে ওয়াদা করে, কখনও আর নামাজের ব্যাপারে গাফলতি করবে না।
আল্লাহর দ্বিতীয় সাহায্য
তীব্র শীতের মওসুম শুরু হওয়ার আগে আমাদের কাফেলাই ছিল সর্বশেষ কাফেলা। বরফপাতের জন্যে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় কোন কাফেলার কাশ্মীরে প্রবেশ সম্ভব হবে না। এ সময় সীমান্তে ভারতীয় সৈন্যদের সংখ্যাও বেশী ছিল। তারা গুপ্তচরের মাধ্যমে সর্বদা কাফেলার আগমনের খবর জানার চেষ্টা করত। আমাদের আগমনের খবর তারা আগেই পেয়ে যায়। একশ’ চল্লিশজনের এক ইণ্ডিয়ান সেনাদল আমাদের ধরার জন্যে পথে ওঁত পেতে থাকে। তারা পাহাড়ের এমন দুটি চূড়ায় অবস্থান নেয়, যার মধ্য থেকে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোন উপায় ছিল না। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে বুঝতে পারলাম, দুশমন আমাদের ঘিরে ফেলেছে। এমন কঠিন অবস্থায় লড়াই করাও যুক্তিসংগত নয়। অতএব আল্লাহর উপর ভরসা করে নতুন কৌশল অবলম্বন করলাম।
সাথীদেরকে একটি পাহাড় দেখিয়ে আমি বললাম, তোমরা সামনে অগ্রসর হয়ে ঐ পাহাড় পর্যন্ত যাবে এবং সেখান থেকে হামাগুড়ি দিয়ে আবার ফিরে আসবে। এভাবে একজন মুজাহিদ চার পাঁচবার করে আসা-যাওয়া করবে। আল্লাহর রহমতে আমরা এ কৌশলে দুশমনকে ধোকায় ফেলতে সক্ষম হই। তারা গুপ্তচর থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশজনের এক গ্রুপের খবর পেয়েছিল। এবার আমাদেরকে তারা মনে করল, কয়েক’শ মুজাহিদের বিরাট এক কাফেলা। ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বিনা যুদ্ধেই তারা ময়দান ত্যাগ করে চলে যায়।
আটদিন সফরের পর আমরা কাশ্মীরের এক গ্রামে পৌছি। সেখান থেকে ‘আল-বারক’ গ্রুপের মুজাহিদরা আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে নিজ এলাকায় চলে যায়। আমরা কেন্দ্রের নির্দেশের অপেক্ষায় সেখানে অবস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
সাতদিন পর্যন্ত এ গ্রামে অবস্থান করে আমরা আমাদের আমীরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু তাঁর সাথে কোন যোগাযোগ করতে না পারায় আমরা আরো দু’দিন সফরের দূরত্বের এক গ্রামে যাবার সিদ্ধান্ত নেই।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সে গ্রামে উপস্থিত হলাম। সেখান থেকে শ্রীনগর, সোপুর ও কুপওয়ারার দিকে দু’টি পথ চলে গেছে। আমার কাশ্মিরী সাথীরা অনেকদিন পাকিস্তানে ছিল এবং এ অবস্থায় আমীরের সাথে যোগাযোগ না হওয়ায় তারা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ে এবং আমার কাছে বার বার ছুটির অনুমতি চাইতে থাকে। অনেক দিন ধরে পিতা-মাতা ভাই-বোনদের সাথে তাদের দেখা সাক্ষাৎ নেই। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ী যাবার জন্যে তাদের মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। তাদের মানসিক অবস্থার কথা ভেবে সকলকে নির্দিষ্ট শর্তে ছুটি দিলাম। শুধু একজন মুজাহিদ আমার সাথে থেকে গেল। যাবার সময় বার বার তারা আমাকে সঙ্গে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ জানায়। আমি কেন্দ্রের নির্দেশনা মত চলার ইচ্ছে প্রকাশ করে তাদের অনুরোধ রক্ষা সম্ভব নয় বলে জানাই।
আমার বাকী সাথীরাও একদিন শ্রীনগর-সোপুরের পথ ধরে চলে যায়। একজন গাইড সাথে নিয়ে আমি এবার আমীর সাহেবের নিকটবর্তী এক গ্রামে পৌছি। এখানে আমি এক মুজাহিদের ঘরে অবস্থান নেই। সে মুজাহিদ অন্য গাঁয়ে অবস্থান করত। পাঁচদিন অবস্থানের পরও আমীর সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হলাম না।
এদিকে সর্বত্র প্রচার হয়েছে যে, এ গ্রামে একজন আফগান মুজাহিদ এসেছে। ইণ্ডিয়ান সৈন্যরা তাই আমাকে ধরার জন্যে পঞ্চম রাতে সমগ্র গ্রাম ঘেরাও করে। অর্থাৎ- রাতের পর সকালে ঐ গ্রামব্যাপী ক্রেক ডাউন। এ সময় সমগ্র গ্রাম ঘেরাও করে কারফিউ জারী করা হয়। প্রতিটি ঘর থেকে পুরুষ, মহিলা, শিশু, বৃদ্ধদের বের করে এক মাঠে সমবেত করা হয়। তারপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর ছেড়ে দেয়া হয়, যাতে কেউ লুকিয়ে থাকতে না পারে। মাঠের মধ্যে একে একে সবার পরিচয় যাচাই করে দেখা হবে কোন মুজাহিদ বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি আছে কিনা। ক্রেক ডাউনের সময় যেসব অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়, তার বর্ণনা ভাষাতীত। গ্রামের লোকেরা সবাই আমাকে জানত। তারা এসে বলল, ‘ভাইসাব! ইণ্ডিয়ান সৈন্যরা গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। ভোরেই ক্রেক ডাউন হবে, আপনি যেভাবেই হোক আত্মরক্ষা করুন।
আমি যে ঘরে ছিলাম, সে ঘরে আমার দু’জন মুসলমান বোন ছিল। তারা আমাকে ভাই বলে ডাকত। তারা এসে বলল, ‘ভাইজান! আপনি অপেক্ষা করুন, আমরা রাতের আঁধারে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসি। দেখি বের হওয়ার কোন রাস্তা বের করা যায় কিনা।
ঘন্টাখানেক পরে এসে তারা বলল, “সৈন্যরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে বেষ্টনী তৈরী করেছে। প্রতি পাঁচ মিটার অন্তর অন্তর একজন সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। তবে এক স্থানে একটি পানির নালা আছে। তার দু’পাশের পাহারাদার দু’জনের মাঝখানে একটু বেশী ফাকা দেখা যায়। যদি এর মধ্য দিয়ে বের হতে পারেন, এছাড়া বের হবার বিকল্প কোন পথ নেই।’
দুই সৈন্যের মধ্য দিয়ে বের হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। আমি ক্লাসিকোভ লোড করে শরীরে কোট চাপিয়ে টুপি খুলে সে দিকে রওনা দিলাম। পথে অনেক দুআ পড়ে আল্লাহর কাছে গায়েবী সাহায্য প্রার্থনা করলাম। আমার ক্লাসিকোভ লোড করা ছিল। যদি ধরা পড়ার আশংকা দেখা দেয়, তবে ওদের উপর সোজা গুলী করব। শাহাদাতের আগে যে ক’জন নিয়ে যেতে পারি তা-ই লাভ।
পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে আস্তে আস্তে সৈন্যদের মধ্য দিয়ে চলতে লাগলাম । অন্ধকারে আমার কোটের চমক দেখে সৈন্যরা ধোকায় পড়ে যায়। তারা আমাকে তাদের অফিসার মনে করে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছেন স্যার?’
আমি বুঝতে পারলাম, তারা ধোকায় পড়েছে। দৃঢ়কণ্ঠে বললাম, আমি প্রস্রাব করে আসছি, এদিকে খেয়াল রেখ।
কারও পক্ষে ধারণা করাও সম্ভব নয় যে, মুজাহিদরা এত সাহসী হতে পারে এবং ক্লাসিকোভ হাতে নিয়ে সৈন্যদের মধ্য দিয়ে এভাবে পথ অতিক্রম করতে পারে। আমি গ্রাম থেকে বের হয়ে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে উঠে এক ঝোপের মধ্যে
লুকিয়ে থাকি।
সকাল হতেই ভারতীয় সৈন্যরা গুপ্তচর সাথে নিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ে। আমি একটা ঝোপের আড়ালে বসে গ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকি। সৈন্যরা ঘরে ঘরে গিয়ে সকল জোয়ান, বৃদ্ধ ও শিশুদেরকে টেনে টেনে এক মাঠে জমা করে । মহিলাদের উপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। তারা যেভাবে মহিলাদের একত্র করে ও যেভাবে তাদের সাথে হিংস্র পশুর মত ব্যবহার করে, তা দেখে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হয়। যার যার ঘরে আমি থাকতে পারি বলে সন্দেহ হয়, তাদের সবার ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় পাষণ্ড সৈন্যরা। সবার কাছেই তাদের এক প্রশ্ন, কোথায় সেই আফগান মুজাহিদ?’
আমার জীবন ঐসব সম্মানিত গ্রামবাসীর জন্যে কুরবান হোক, যাদের উপর এত জুলুম-নির্যাতন সত্ত্বেও তারা আমার সম্পর্কে কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। ইতিপূর্বে এরা অনেকবার আমাকে বলেছে, পুরো গ্রাম শেষ হতে পারে। আমরা সব কিছু কুরবানী দিতে পারি; কিন্তু আপনার কোন ক্ষতি হোক তা আমরা বরদাস্ত করব না। যে কোনভাবেই আমরা হোক আপনার হেফাজত করবই। আপনি আমাদের মেহমান, আমাদের মুক্তির মহান দূত।
ভারতীয় সৈন্যরা দুপুর নাগাদ ঘেরাও তুলে গ্রাম থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় চারজন নওজোয়ানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সৈন্যরা চলে যেতেই গ্রামের লোকেরা আমার খোজে বের হয়, সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে আমাকে খুঁজতে থাকে। বেলা দু’টোর দিকে আমি পাহাড় থেকে নীচে নেমে আসি। আমাকে জিন্দা দেখা মাত্র সারা গ্রামের লোক একত্র হয়ে আমাকে মোবারকবাদ জানাতে থাকে। কেউ চুমু খেতে থাকে, কেউ বুকে জড়িয়ে ধরে। যেন তারা তাদের সব দুঃখ, সব নির্যাতনের বিষাদ আমাকে জিন্দা পাওয়ার আনন্দে ভুলে গেছে।
যে চারজন গ্রামবাসীকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তারা যদিও মুজাহিদ ছিল না; কিন্তু তারা আমার সম্বন্ধে ভালোভাবে জানত। আমার ভয় হচ্ছিল, যদি নির্যাতনের মুখে তারা আমার খবর এবং যে ঘরে আমি থাকি, তা তাদের বলে দেয়, তবে অবস্থা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
দিনের আলোতেও সৈন্যরা কিছু দেখতে পেল না
প্রথম ক্রেক ডাউনের পরও আমি এ গ্রামে রয়েছি, সে খবর ভারতীয় সৈন্যরা জানতে পেরে দুদিন পর পুনরায় গ্রামে ক্রেক ডাউন বসায়। এবার তারা রাত সাড়ে বারোটায় গ্রাম ঘিরে ফেলে। পাঁচ হাজার ফৌজের এক বিশাল গ্রুপ এ। তল্লাশী অভিযানে অংশ নেয়। রাত দু’টার সময় আমার কাছে ক্রেক ডাউনের খবর পৌছে। তখন গ্রাম থেকে বের হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কোন উপায় না দেখে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করতে থাকি। এর মধ্যে আমার সেই কাশ্মিরী দু’বোন এসে হাজির। শলা-পরামর্শের পর তারা বলল, আমাদের ঘরের এক পাশে ঘাসের স্থূপ রয়েছে, তার মধ্যে লুকানো ছাড়া এখন আত্মরক্ষার দ্বিতীয় কোন পথ নেই।’
অন্য কোন উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত তাদের পরামর্শে রাজী হলাম। তারা দু’বোন অনেক যত্নসহকারে এক পাশের ঘাস সরিয়ে আমাকে তার মধ্যে রেখে ঘাস পুনরায় আগের মত সাজিয়ে রাখে।
ভোরে সৈন্যরা গ্রামে প্রবেশ করে ঘরে ঘরে তল্লাশী চালায়। যেখানে যা পায় ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলে, মূল্যবান জিনিসগুলো লুটে নেয় এবং অন্য সব জিনিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধ্বংস তাণ্ডবের পর শেষে একটা গ্রুপ ঘাসের স্কুপের কাছে এসে দাঁড়ায়। একজন সৈন্য অফিসারকে লক্ষ্য করে বলল, স্যার! এ ঘাসের স্থূপে তল্লাশী নিয়ে দেখবো?’
অফিসার ধমক দিয়ে বলল, এর মধ্যে কিছুই নেই। প্রথমে দুষ্কৃতিকারীরা এ সবের মধ্যে অন্ত্রপাতি লুকিয়ে রাখত। আমরা তা টের পেয়ে এতে আগুন লাগাতে থাকি। এখন তারা সাবধান হয়ে গেছে। এখন তারা এর মধ্যে কিছুই
রাখে না।
‘তবুও স্যার একটু দেখে নেই?’ অনুরোধের সুরে সিপাহী অফিসারকে বলল ।
বিরক্ত হয়ে অফিসার তার পকেটের দিয়াশলাইটি হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘যাও আগুন ধরিয়ে দাও!
তারা যা কিছু বলছে, তা আমি কান পেতে শুনছিলাম। লোড করা ক্লাসিকোভ আমার হাতেই ছিল। এক লাফে বের হয়ে কয়েকজন সৈন্যকে জাহান্নামে পাঠানো আমার পক্ষে এখন অতি সহজ। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সমগ্র গ্রাম ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে; তাই তা থেকে বিরত থাকলাম।
সৈন্যটি ক্রুপের এক পাশে দাড়িয়ে দিয়াশলাই জ্বালানোর চেষ্টা করছে। আমার মনে হল, স্কুপের ওপাশে আগুন লেগে গেছে। এবার সে অন্য পাশে দাঁড়িয়ে ম্যাচের কাঠি ঘষছে। ধারণা করলাম, সে এক সাথে উভয় পাশে আগুন লাগাতে চাচ্ছে, যাতে তাড়াতাড়ি এটি জ্বলে শেষ হয়ে যায়। এরপর তৃতীয় কাঠি জ্বালাবারও আওয়াজ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, আগুন হয়ত আমার কাছাকাছি পৌছে গেছে। এক লাফে বাইরে বেরিয়ে এ দু’ ইণ্ডিয়ানকে প্রথমে জাহান্নামে পাঠাব। তারপর যা হবার হবে।
তৃতীয় কাঠি জ্বালাবার পর পরই অফিসারের কর্কশ আওয়াজ শুনতে পেলাম, হারামখোর কোথাকার, একটা ম্যাচও জ্বালাতে পার না।’
সৈন্যটি বিনয়ের সাথে বলল, “স্যার, দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বলছে না, একটি কাঠি বাকী আছে। নিন, এটা আপনিই জ্বালান।
অফিসার রাগে-গোস্বায় জ্বলতে জ্বলতে দিয়াশলাই তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে খোঁচা মারল। আমিও এক লাফে বের হতে তৈরী হলাম। এমন সময় শব্দ পেলাম, অফিসার ম্যাচটিকে সজোরে নীচে ফেলে বুট দিয়ে পিষে দিচ্ছে। লজ্জায়-গোস্বায় জ্বলতে জ্বলতে সেপাইকে বলল, যাও, ঐ ঘর থেকে ম্যাচ নিয়ে এস।’
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন সৈন্য সেখানে এসে পৌছে। সারা ঘরের মালপত্র নীচে ফেলে তারা দলাই-মালাই করে। কিন্তু কোথাও ম্যাচ খুজে পাচ্ছে নক। অথচ ম্যাচ তাদের চোখের সামনে চুলোর পাশেই রাখা ছিল। আল্লাহ্ তাদেরকে অন্ধ করে দিয়েছেন, তাই দিবালোকেও তারা ম্যাচ খুঁজে পেল না। ইতিমধ্যে অফিসার ডাক পাড়ল, ‘আমি বলেছিলাম না, এর মধ্যে কিছু নেই, খামোখা সময় নষ্ট করছ!’ একথা শুনে সৈন্যরা ফিরে যায়।
আল্লাহ্ রাব্বল আলামীনের প্রশংসা করার মত ভাষা আমার নেই। তিনি ভাষার মুখাপেক্ষী নন এবং হৃদয়ের আবেগ প্রকাশ করার ক্ষমতাও আমাদের নেই। আমরা পারি তার দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়তে। আল্লাহর এ প্রত্যক্ষ মদদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমি তার দরবারে দু’আ করতে থাকলাম।
গাড়ী চলার শব্দ শুনতে পেলাম, ইণ্ডিয়ান সৈন্যরা ক্রেক ডাউন তুলে ফিরে যাচ্ছে। তারা যাবার আগে গ্রামের মেয়েদের সাথে এমন শালীন আচরণ করেছে, যা বর্ণনা দিতেও লজ্জাবোধ হয়।
সৈন্যরা চলে যেতেই আমার দু’বোন এসে ঘাস থেকে আমাকে বের করল। আমাকে জীবিত দেখে তাদের সে কি কান্না। তাদের সশব্দ কান্না দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আমি বেঁচে যাওয়ায় তারা যে আনন্দ প্রকাশ করল, তাতে লজ্জিত না হয়ে পারলাম না। আমি বার বার ভাবতে লাগলাম, এরা আমাদের কাছে কত বড় আশা রাখে। অথচ আমরা কত দুর্বল, তাদের আযাদীর জন্যে আমরা কতটুকু-ই করতে পারছি!
দেখতে দেখতে গ্রামের সকল লোক এসে আমার চার পাশে জড়ো হয়। পুরুষ-মহিলা, বৃদ্ধ-শিশু সবার চোখ থেকে খুশিতে আনন্দাশ্রু বের হচ্ছে। আমি নিরাপদে বেঁচে যাওয়ার জন্যে তারা একে অপরকে মোবারকবাদ জানাচ্ছে। জানতে পারলাম, ঘেরাওয়ের সময় কয়েকজন মহিলা নামাজ পড়ে আমার জন্যে দু’আ করেছে। আমাকে জীবিত ও সুস্থ দেখে তারা যে কত আনন্দিত হয়েছে, তা মুখের ভাষায় বুঝানো সম্ভব নয়।
সশস্ত্র অবস্থায় শ্রীনগর যাত্রা
এ গ্রামে আমি এগারোদিন ছিলাম। বার বার ক্রেক ডাউন হওয়ায় রাতে গ্রামে থাকা ঠিক নয় ভেবে দিনের বেলা গ্রামে কাটিয়ে রাতে পাহাড়ে চলে যেতাম। আমার সাথে গ্রামের তিনটি কিশোর রাত কাটাতে পাহাড়ে যেত। তারা মোর্চা খুঁড়ে সেখানে আমাকে ঘুম পাড়াত ও নিজেরা পালা করে পাহারা দিত। তাদের জিহাদী জবা ও ভারতের প্রতি প্রবল ঘৃণা দেখে আমি বিস্মিত হতাম। আমার কাছে একটি ক্লাসিকোভ ও দু’টি পিস্তল ছিল। তারা ক্লাসিকোভ ও পিস্তল নিয়ে মোর্চার আশেপাশে পাহারা দিত আর আমি নিরাপদে ঘুমাতাম। তারা আমার কাছে অস্ত্রের ট্রেনিং নিত এবং সর্বদা বলত, কাশ্মীর আমাদের, আমরা মুসলমান, কাশ্মীরের আযাদী আমরা ছিনিয়ে আনব-ই।
আমার কারণে এ গ্রামে দু’ বার ক্রেক ডাউন হয়েছে। আবারও হবার সম্ভাবনা আছে। ভারতীয়রা আফগান মুজাহিদদের যমের মত ভয় করে। করবেই বা না কেন? তাদের আদর্শিক গুরু রুশদের নাকানি-চুবানি খাইয়েছে এই শক্তপেশী ও ইস্পাতকঠিন ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান আফগানীরা। অতএব যতদিন তারা গ্রামে কোন আফগান মুজাহিদের অবস্থানের কথা শুনবে, ততদিন ক্রেক ডাউন চলতেই থাকবে।
এ জন্যে অন্যত্র চলে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করতে থাকি। এ কথা দু’ একজনের কাছে প্রকাশ করতেই গ্রামের সব তোক আমার নিকট এসে অনুনয়-বিনয় করে বলতে শুরু করে, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের ছেড়ে চলে যাব
আপনি।
যদিও তারা আমার কোন যুদ্ধের প্রোগ্রাম দেখেনি, শুধু লোক মুখে আফগান মুজাহিদদের বীরত্বগাথা শুনে আমাকেও একজন বীর মুজাহিদ বলে ধারণা করছে। তারা বার বার বলতে থাকে, আমরা বহুদিন ধরে হয়ত আপনারই প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমরা এ আশা নিয়ে জিহাদ শুরু করেছি যে, আফগানী ভাইয়েরা এসে আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুলতান মাহমুদ ও আহমদ শাহ আবদালীর মত এ পবিত্র ভূমি থেকে মূর্তিপূজারী পৌত্তলিকদের চিরতরে বিতাড়িত করবে। আমরা আপনাদের বহু বীরত্বগাঁথা ও কেরামতের কথা শুনেছি। এবার তা চাক্ষুষ দেখলাম। আমরা গ্রামের সকলে শহীদ হয়ে যাব, নিজেদের সব কিছু বিসর্জন দেব, তবুও আপনার হেফাজতে বিন্দুমাত্র গাফলতী করব না। আপনি আমাদের এখানেই থাকুন। আমরা আশা করি, যতদিন আপনি এ গ্রামে থাকবেন, ততদিন আল্লাহর রহমত আমাদের উপর বর্ষিত হতে থাকবে।
তাদের অনুরোধে আমি এ গ্রামে থেকেই আমীর সাহেবের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু কোন প্রকার যোগাযোগ সম্ভব না হওয়ায় অগত্যা গ্রাম ছেড়ে শ্রীনগর যাওয়ার প্রস্তুতি নেই।
গ্রামের সকল পুরুষ-মহিলা, শিশু-কিশোর জড়ো হয়ে আমাকে বিদায় জানায়। তারা আমার সাথে সাথে গ্রাম থেকে দু’ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত হেঁটে এসে আমাকে বিদায় দেয়। সকলের চোখে অশ্রু দেখে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমার দু’বোন দোপাট্টা উড়িয়ে আমাকে বিদায় জানায়। আর তাদের মা দু’হাত উঁচু করে আল্লাহর কাছে আমার নিরাপত্তার জন্যে দু’আ করতে থাকে। যে বালক তিনটি পাহাড়ে আমাকে পাহারা দিত, বাসষ্ট্যাণ্ড পর্যন্ত তারা আমাকে এগিয়ে দিয়ে যায়।
সব কিছু গ্রামে রেখে শুধু ক্লাসিকোভ, পিস্তল ও গ্রেনেডটি সাথে নিয়ে বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে রওনা হলাম। ক্লাসিকোভ কাঁধে ঝুলিয়ে তার উপর কাশ্মিরী আলখেল্লা জড়িয়ে নিলাম।
বাসে উঠার সময় কন্ট্রাক্টর আমাকে সহযোগিতা করতে হাত বাড়ালে তার হাতের নীচে ক্লাসিকোভ পড়ে। সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘মৌলভী সাব! আপনি কোথা থেকে এসেছেন, যাবে কোথায়?
তার কাশ্মিরী ভাষার প্রশ্নের জবাবে আমি উর্দুতে বললাম, আমি শ্রীনগর যাব।
সে বলল, আপনি এ বাসে যেতে পারবেন না। আমি বললাম, কেন পারব না?
আমার ভাষা শুনে ও চেহারা-সুরত দেখে সে ধারণা করেছে, আমি কাশ্মিরী নই, আফগানী কিংবা পাকিস্তানী হব। আবার সে বলল, এখন পর্যন্ত কোন সশস্ত্র লোককে এ বাসে করে শ্রীনগর নেইনি। তাছাড়া এখান থেকে শহর পর্যন্ত দশটি চেকপোেস্ট আছে। প্রতিটি পোস্টে তন্ন তন্ন করে তল্লাশী করা হয়। সকল যাত্রীকে নীচে নামিয়ে দেহ-তল্লাশী করা হয়। আপনি কোন্ সাহসে এভাবে শ্রীনগর রওনা করেছেন?
যাত্রীদের মধ্যেও আমার বিষয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। সবাই বলল, আপনি এপথ সম্পর্কে খবর রাখেন না। নেমে যাওয়াই আপনার জন্যে নিরাপদ। তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আমাকে ধমকীও দিতে লাগল, ভালোয় ভালোয় নেমে পড়, নইলে ……।
এবার আমি কঠিন স্বরে জবাব দিলাম, নিজ নিজ সিটে চুপচাপ বসে থাকুন। আমার জীবন আমার নিকট কম প্রিয় নয়। কিছুই হবে না, ঠিকমত পৌছে যেতে পারব।’
আমার ধমকী খেয়ে তারা আস্তে আস্তে চুপ হয়ে যায়। কন্ট্রাক্টরকে বললাম, আমাকে যেতে দাও, পরে যা হবার হবে, সেজন্যে চিন্তা করি না।।
বাস ছাড়তেই আমি সিটে বসে দুহাত তুলে আল্লাহ্ রাব্বল আলামীনের কাছে মুনাজাত করতে লাগলাম, হে খোদা! আমি তোমার রাস্তায় তোমার দ্বীনকে বিজয়ী করতে, লাঞ্ছিত মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করতে মাতৃভূমি ছেড়ে সুদূর প্রবাসে একাকী পথ চলছি। তুমিই আমার একমাত্র সহায়, আমাকে হেফাযত কর এবং নিরাপদ পথ প্রদর্শন কর। তুমি ছাড়া আমার দ্বিতীয় কোন সহায় ও সাহায্যকারী নেই।
আমি কায়মনোবাক্যে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে থাকি। বাস দ্রুতবেগে এগিয়ে চলছে। কন্ট্রাক্টরসহ সকল যাত্রী আমার ব্যাপারে কানাঘুষায় লিপ্ত। ইতিপূর্বে আমি অনেকবার আল্লাহর সাহায্য প্রত্যক্ষ করেছি। অতএব নিশ্চিন্ত মনে নীরবে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। আর মাত্র এক কিলোমিটার দূরে ইণ্ডিয়ান সৈন্যদের প্রথম চেকপোস্ট। যাত্রীদের চেহারা আতঙ্কে পাণ্ডুর। একটু আগেও আবহাওয়া ছিল সুন্দর, আকাশও ছিল পরিষ্কার; এরই মধ্যে হঠাৎ বরফপাত শুরু হয়। দেখতে না দেখতে সাদা। বরফে ঢেকে যায় সমগ্র এলাকা। শীত মওসুমের এটাই প্রথম বরফপাত।
ইণ্ডিয়ান সৈন্যরা রাস্তার উপর তাঁবু ফেলে রেখে নিরাপদ আশ্রয়ে কোথাও চলে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম, আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। বিনা তল্লাশীতে আমরা চেকপোস্ট পার হলাম। প্রথম বাধা নিরাপদে অতিক্রম করায় যাত্রীদের ঠোটে হাসি ফুটে ওঠে। তারা আমাকে নানা প্রশ্ন শুরু করল। আপনি কোথা থেকে এসেছেন? কোন সংগঠনের সাথে আপনার সম্পর্ক? ইত্যাদি হরেক রকমের প্রশ্ন।
কন্ট্রাক্টর কাছে এসে বলল, আজ পর্যন্ত এমন সাহসী মুজাহিদের দেখা পাইনি, যে অস্ত্র নিয়ে এভাবে নির্ভয়ে শ্রীনগর প্রবেশ করার সাহস পেয়েছে।
আমি বললাম, আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথে অবশ্যই আছে। আমরা সকলে নিরাপদে শ্রীনগর পৌছে যাব ইনশা আল্লাহ।
আল্লাহ্র অপার রহমতে শ্রীনগর পর্যন্ত পথের কোন পোস্টের সৈন্যরা বরফপাতের জন্য রাস্তায় এসে তল্লাশী করার সুযোগ পায়নি। শ্রীনগর এসে বাস থেকে নেমে দেখলাম, চারিদিক সাদা বরফে ঢাকা।
নিরাপদ আশ্রয়ে।
আজমল নামক এক মুজাহিদের নাম-ঠিকানা আমার জানা ছিল। একটা ট্যাক্সি নিয়ে তার বাড়ীর দিকে রওনা হলাম। পথে ড্রাইভার কাশ্মিরী ভাষায় আমাকে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। আমি সবকিছু না বুঝেও তার কথায় হা না বলে আমার ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। মহল্লায় পৌছার পর সে আমার অস্ত্র দেখতে পেয়ে নীচে নেমে হেঁটে আমার কাছে এসে অনেক প্রশ্ন করতে থাকে। আমি নিজের ব্যাপারে সামান্য ধারণা দিয়ে তাকে বিদায় করে দেই।
বরফপাতের জন্যে রাস্তা জনমানবশূন্য। চারিদিক নীরব-নিস্তব্দ। আমি সড়কের কিনারা ধরে একা একা হাঁটছি। এর মধ্যে একটি ফৌজী জীপ আমার কাছে এসে থেমে যায়। তারা আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করতে থাকে। আমি সে দিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ না করে পথ চলতে থাকি। কিছুক্ষণ পর জীপটি তাদের গন্তব্যে চলে যায়। এরপর আরও একটা জীপ এসে আমাকে দেখে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরে সাঁজোয়া গাড়ি আসার শব্দ পেলাম। সাঁজোয়া গাড়ি সম্পর্কে শুনা যায় যে, এরা বিনা প্ররোচনায় লোকের শরীরের উপর দিয়ে চালিয়ে যায় । আমি রাস্তা ছেড়ে কিনারায় নেমে পড়লাম। বরফ পড়ে আমার কোট, টুপি সব সাদা হয়ে গেছে। তাই তারা আর আমাকে দেখতে পেল না। গাড়ি চলে গেলে
আমিও রাস্তায় উঠে আবার হাঁটা শুরু করলাম।
পথে কোন লোকজন নেই। কারো কাছে আজমলের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতে পেরে এক ঘরের দরজায় কড়া নাড়লাম। একটি বালিকা বের হয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকে চান?’
আমি বললাম, আজমলকে, সে কি এ মহল্লায় থাকে? আমি কাশ্মিরী ভাষা বলতে না পারায় মেয়েটি মনে মনে ভেবেছে, কোন পাহাড়ী এলাকা থেকে এসেছি। (কাশ্মীর উপত্যকার বাহিরের অধিবাসীরা কাশ্মিরী ভাষা জানে না। তাদেরকে পাহাড়ী বলা হয়। তাই সে আমাকে আপদ মনে করে বলল, ‘এ পাড়ায় আজমল নামে কেউ থাকে না। বলেই ঝট করে দরজাটা লাগিয়ে দিল।
আমি ভাবতে লাগলাম, এখন কার কাছে জিজ্ঞেস করব। সবার কাছে জিজ্ঞেস করাও নিরাপদ নয়। পঞ্চাশ গজ দূরে গিয়ে একটি দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে বরফ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, ঐ বালিকাটি জানালা দিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আমার অসহায়ত্ব দেখে তার দয়া হল। সে এবার জানালা দিয়ে আমাকে কাছে ডাকে।
কাছে আসলে জানতে চাইল, আপনি কোন্ আজমলকে খুঁজছেন? সে কী কাজ করে?
আমি আজমলের কিছু বিবরণ দিতেই সে দরজা খুলে ঘরে বসতে দেয়। এবার তার বড় বোন ও মা এসে আমার পাশে বসে। এক বোন গরম অঙ্গার এনে আমার পাশে রাখে শরীর গরম করতে। ছোট বোেন নুন চা এনে আমাকে পান করতে দেয়।
একটু গরম হওয়ার পর বৃদ্ধা আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন আজমলের কাছে এসেছ?
আমি বললাম, তার সাথে ব্যক্তিগত কাজ আছে। শুধুমাত্র তাকেই বলা যাবে বৃদ্ধা বলল, সে এখানে নেই। ইণ্ডিয়া গেছে।
আমি বললাম, তার ঘর পর্যন্ত আমাকে পৌছিয়ে দিন; আমি সেখানে থেকে তার অপেক্ষা করব।
তার এক বোন বলল, এটাই আজমলের ঘর। আর আমরা তার বোন। ইনি আমাদের মা।
এদের প্রকৃত পরিচয় পাওয়ার পর আমিও বললাম, “আমি আফগানিস্তানের মুজাহিদ, পাকিস্তান থেকে এসেছি।’
একথা শুনতেই তারা তিনজন কেঁদে ফেলল। আজমলের বৃদ্ধা মা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘আপনি মা-বাপ, ভাই-বোেন ফেলে আমাদের সাহায্য করতে এত দূরে এসেছেন? যতদিন আজমল না আসে ততদিন আপনি এখানে থাকবেন। আমরা যথাসাধ্য আপনার হেফাযতের ব্যবস্থা করবো।’
এক ট্রেনিং সেন্টার কেড়ে নিল হাজার সৈন্যের মনোবল আমাদের আমীর সাহেব এসময় কাশ্মীরের বাইরে ভারতের অন্যত্র সফরে ছিল। আজমল তাঁর সফর সংগী। ফোনে তারা আমার পৌছার খবর পেয়ে সফর সংক্ষিপ্ত করে শ্রীনগর ফিরে আসেন। আমরা এক গোপন স্থানে কেন্দ্র থেকে দেয়া প্রোগাম নিয়ে পরামর্শে বসি। তাতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এখানে একটি পরিপূর্ণ ট্রেনিং সেন্টার খোলা হবে। সেখানে সকল সাথী একত্রিত হওয়ার পর পরবর্তী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
আফগানিস্তানের ট্রেনিং ক্যাম্পে অনেক কাশিরী ট্রেনিং নিয়ে কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তারা ইতিমধ্যে বহু সফল অভিযানে অংশ নিয়েছে। তবে বিশেষ কারণে তারা তাদের সংগঠনের নাম প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে।
এবার নতুন সেন্টারে পুরাতন সাথীদের সঙ্গে নতুন সাথীদেরও আফগানী ক্যাম্পের নিয়ম অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। একই নিয়ম ও পদ্ধতিতে ট্রেনিং চলছে। কখনো দৌড়-ঝাপ, কখনো অস্ত্রের ট্রেনিং, যুদ্ধের মহড়া। এরপর আল-কুরআন, ঈমান-আকীদা বিষয়ক দাস। সাথে সাথে পাহারাদারী ও মরিচা খোদাইও করানো হচ্ছে।
ভোর রাতে সেজদায় পড়ে হৃদয়ের সমস্ত আঁকুতি দিয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা একটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। আমরা পূর্ণ অভিজ্ঞতার আলোকে সর্বপ্রথম ট্রেনিং সেন্টারের হেফাজতের ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং এক ডাকে সব মুজাহিদ কমাণ্ডারের কাছে সমবেত হওয়ার মহড়া দেই। চতুর্দিকে অনেক দূর পর্যন্ত মরিচা খোদাই করা হয়।
ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার পথেই দু’ধারে ওয়ারলেসসহ কড়া পাহারা বসাননা হয়। অল্প দিনের মধ্যেই ট্রেনিংয়ের কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। দেখতে না দেখতে সকল পুরাতন সাথী ট্রেনিং সেন্টারে পৌছে যায়।
আমাদের ট্রেনিংয়ের ধরন দেখে অন্যান্য মুজাহিদ গ্রুপও দলে দলে তাদের সাথীদের আমাদের কাছে পাঠাতে শুরু করে। মুজাহিদদের অধিকাংশ গ্রুপ থেকে আমাদের মারকাজের প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলার জন্য ভূয়সী প্রশংসাপত্র আসতে থাকে। মূলতঃ আমরাই সর্বপ্রথম কাশ্মীরে পূর্ণাঙ্গ ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই।
ট্রেনিংয়ের প্রোগাম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছিল। এমন সময় পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে ক্রেক ডাউন হয় । এবার এ ক্রেক ডাউনে অংশ নেয় কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ। তারা গ্রামের এক ছেলেকে মারধর করলে সে তাদেরকে বলে দেয় যে, আমাদের এখানে. কিছু আফগান মুজাহিদ ঘুরাফেরা করছে। তার কথামত একজন গুপ্তচরসহ রিজার্ভ পুলিশের সদস্যরা আমাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়। তাদেরকে আমাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে দেখে আমাদের পাহারাদার সাথী ওয়ারলেসের মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ আমাদের নিকট সে খবর পৌঁছে দেয়।
এ খবর শুনে ক্যাম্পের মুজাহিদরা তো খুশীতে আটখানা। বহুদিন ধরে তারা এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। একে অন্যকে তারা মোবারকবাদ। জানিয়ে বলে, ওদেরকে এমনই শিক্ষা দেয়া হবে যে, কাশ্মীরকে জবর দখলে রাখার কত মজা, বেটাদের তা আজ বুঝিয়ে দেব।’
একটি সম্মুখ লড়াইয়ের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতিসহ সবাই অপেক্ষা করছে। শিকার নিজে এসে ধরা দিচ্ছে বলে ব্যস্ততার সাথে সবাই মরিচা সামলানোসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মজবুত করতে থাকে। স্থির হল, ক্যাম্পের মধ্যে ঢোকার পর ঘেরাও করে সবাইকে খতম করা হবে। কাউকে জিন্দা ফিরতে দেয়া হবে না।
এদিকে গ্রাম থেকে তারা এক মাইল অগ্রসর হওয়ার পর ভাড়াটে গুপ্তচর তাদেরকে জিজ্ঞেস করে, “আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
তারা বলল, এখানকার আফগানী ক্যাম্পে আমরা হামলা করব।’
এ কথা শুনে সে বিস্ময়ের সাথে বলল, “সে কি করে সম্ভব! আপনারা সংখ্যায় এত কম, আর আফগানীরা সংখ্যায় অনেক। উপরন্তু তাদের রয়েছে উন্নত প্রশিক্ষণ। তারা ক্যাম্পে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র তাক করে রেখেছে। আমার মনে হয়, সেখানে গেলে কেউ জিন্দা ফিরে আসতে পারব না।’
রিজার্ভ পুলিশের এ গ্রুপ কাশ্মীরে নতুন এসেছে। তারা কিছু একটা করে নিজেদের বাহাদুরী জাহির করতে চায়। তারা বলল, “কোন চিন্তা কর না, আমাদের সাথেও দেড় হাজার বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিপাহী আছে। তাছাড়া আফগানীরা অন্য দেশ থেকে এসেছে। মানসিকভাবে তারা বহু দুর্বল। এখানে তারা সাহস নিয়ে লড়াই করার সাহস পাবে কই?
রিজার্ভ পুলিশ আরো অগ্রসর হলে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যরা বিষয়টা জানতে পেরে গাড়ি নিয়ে সরাসরি তাদের সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ায়। তারা বলে ক্রেক ডাউন শেষ হয়েছে, এখন ভালোয় ভালোয় ফিরে যান।
তবুও তারা অগ্রসর হতে চাইলে সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যরা বলে, এ ক্যাম্পে হামলা করতে হলে পাঁচ হাজার সৈন্যসহ আরও বহু আধুনিক অস্ত্রের দরকার।’
গত্যা তারা ফিরে যায়। যাওয়ার পথে গ্রামবাসীদের বলে গেল; তোমরা আফগানীদেরকে অস্ত্র সমর্পণ করতে বল, অন্যথায় তাদের বাঁচার দ্বিতীয় কোন পথ নেই।’
আমরা একথা জানতে পেরে জবাবী চিঠি লিখে চ্যালেঞ্জ জানালাম, আমরা দশদিন পর্যন্ত তোমাদের অপেক্ষায় থাকব। আমরা ঘাঁটি থেকে দশ মাইল পর্যন্ত বাইরে এসে তোমাদের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত। তোমরা যত সৈন্য ও মারণাস্ত্র নিয়ে আসতে পার আস।’ এ পয়গাম দুশমনদের এত ভীত করে দিয়েছিল যে, দশদিন পর্যন্ত তারা এদিকে আর পা-ই বাড়ায়নি।
এদিকে আরেকটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যায়। ক্রেক ডাউন তুলে সৈন্যরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। তখন পাঁচজন সশস্ত্র মুজাহিদ ওই রাস্তা দিয়ে ক্যাম্পের দিকে আসছিল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তারা রাস্তার পাশে লুকিয়ে থাকে। গাড়ি চলে যাওয়ার পর রাস্তার উপর উঠে তারা সামনে অগ্রসর হতে থাকে। সামনে চল’ এই রণ সংগীত তারা কোরাসের সুরে গাইতে গাইতে রাস্তার উপর দিয়ে চলতে থাকে।
ওই গাড়ির পেছনে আরেকটি গাড়িতে দ্রুত গতিতে একশ চল্লিশজন সিপাহীর একটি পদাতিক দল ধেয়ে আসছিল। পাঁচজন মুজাহিদকে দেখে তারা রাস্তার দু’পাশে লুকিয়ে যায়। তাদের অতিক্রম করে পেছনে ফেলে আসার পর একজন মুজাহিদ প্রস্রাব করতে বসার আগে পেছনে তাকিয়ে দেখে, সৈন্যরা রাস্তার নীচে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সাথীদের ডাক দিয়ে এ খবর দিলে একজন মুজাহিদ অপেক্ষা না করে তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলী ছুড়লে সাথে সাথে পাঁচজন সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাকীরা হতাহতদের তুলে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
আমরা পরে গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করেছি, আমাদের মাত্র পাঁচজন মুজাহিদকে দেখে তারা পালাল কেন? উত্তরে গ্রামবাসীরা জানায় যে, সৈন্যরা বলেছে, তাদের। জন্যে পাঁচজন মুজাহিদের সাথে লড়াই করা কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তাদের ভয় হচ্ছিল, ফায়ারের আওয়াজ শুনে পার্শ্ববর্তী মুজাহিদ ক্যাম্প থেকে মুজাহিদরা। সাঁড়াশী আক্রমণ করলে তখন তারা কেউই যে জীবিত ফিরে আসতে পারবে না! দ্বিতীয়তঃ তাদের অন্যসব গাড়ি আগে চলে গিয়েছিল। যুদ্ধে নাকি তাদের পরাজয় ছিল নিশ্চিত। তাই বৃহৎ কোন ক্ষয়-ক্ষতি ও বিপর্যয়ের মোকাবেলার তুলনামূলক অল্প ক্ষতি বরণকে তারা মেনে নিয়েছে। পালিয়ে জীবন বাঁচাতে পারাটাও তাদের এক বিরাট বিজয়! উপরন্তু মজবুত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, পরীক্ষিত ও চৌকস আফগান মুজাহিদদের সাথে লড়াই করার হিম্মত তাদের নেই।
আমাদের আহবান অনুযায়ী ভারতীয় সেনাদের জন্যে বিশদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। তাদের পক্ষ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে এমনকি তাদের এদিকে আসার কোন লক্ষণ না দেখে কৌশলগত কারণে আমরা আমাদের ট্রেনিং সেন্টার অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাই।
আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে আমি পূর্ণ আস্থার সাথে বলতে পারি, যদি সেদিন ভারতীয় রিজার্ভ পুলিশ আমাদের উপর হামলা করত, তবে তারা একজনও জিন্দা ফিরে যেতে পারত না।
নিয়মিত আক্রমণ শুরু
নতুন স্থানে ট্রেনিংসেন্টার স্থাপনের সাথে সাথে চারিদিক থেকে বিভিন্ন সংগঠনের মুজাহিদরা ট্রেনিং গ্রহণের জন্য এখানে আসতে শুরু করে। এখানে নানাবিধ ট্রেনিংয়ের সাথে সাথে দ্বীনি তালীমেরও ব্যবস্থা করা হয়। অন্যান্য সংগঠনের মুজাহিদরা আমাদের নিয়ম-পদ্ধতি ও ক্যাম্পের দ্বীনি পরিবেশ দেখে আগ্রহের সাথে আমাদের সংগঠনে যোগ দিতে এগিয়ে আসে। আমরা সব সংগঠনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে তাদেরকে নিজ নিজ দলে থেকে কাজ করার পরামর্শ দেই। এর ফলে সকল সংগঠনের কাছে আমরা পরম শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হই। একবার আমাদের সেন্টারের দিকে একদল ইণ্ডিয়ান সৈন্য চুপে চুপে অগ্রসর। হতে থাকলে ‘আল ওমরের মুজাহিদরা তাদের দেখতে পায়। সৈন্যদের গতি দেখে তারা বুঝতে পারে, সৈন্যরা আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের খবর
দিয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে তারা সৈন্যদের গতিরোধ করে। এ লড়াইয়ে ‘আল ওমর’ গ্রুপের চারজন মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করে। চারজন মুজাহিদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমাদের ক্যাম্প রক্ষা পায়।।
ট্রেনিং চলছিল। এক গ্রুপের শেষ হতেই নতুন গ্রুপের শুরু হয়। এভাবে বহু মুজাহিদ ক্যাম্পে জমা হয়। তাদের প্রাণের দাবী, আক্রমণ শুরু করা হোক।
আমরা শুরার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন থেকে নিয়মিত আক্রমণ চালানো হবে। তবে আক্রমণের ধরন এমন হতে হবে, যাতে আমাদের প্রভাব শত্রুর প্রতি আরও বৃদ্ধি পায়। দুশমনের হৃদয় থেকে আমাদের প্রভাব যেন এতটুকু কমে না যায়।
সে সময় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ‘অপারেশন টাইগারে’ শরীক সৈন্যদের প্রতি কেন্দ্রের নির্দেশ ছিল, যে মহল্লা থেকে তোমাদের প্রতি গুলী ছোড়া হবে, সে মহল্লা পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেবে।’
আমরাও ঠিক করলাম, কোন গ্রাম বা মহল্লা থেকে ওদের প্রতি আক্রমণ করব না; বরং খোলা ময়দানে আমরা ওদের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হব ।
ছুরাহ পুলিশ স্টেশনের উপর আক্রমণ
শ্রীনগরে ছুরাহ ইনস্টিটিউট নামক একটি বড় হাসপাতাল আছে। তার সম্মুখে রাস্তার অপর পার্শ্বেই এক বিরাট পুলিশ স্টেশন। পুলিশ স্টেশনে কাশ্মিরী পুলিশেরও একটি ক্যাম্প আছে। তাদের পাশেই ইণ্ডিয়ান সৈন্যরা এক শক্তিশালী পোস্ট স্থাপন করেছে। পোস্টে দেড়শ’ ফৌজী থাকে।
এই পোস্টে আক্রমণের প্রোগাম অনুযায়ী আমরা দিনের বেলা সমগ্র এলাকা পরিদর্শন করে পজিশনের স্থান নির্বাচন করি। পোস্টের পশ্চিম পার্শ্বে ছুরাহ ইনস্টিটিউট। পোস্টের মাত্র দু’টি গেট। একটি ইনস্টিটিউটের গেটের সোজাসুজি মেইন রোডের অপর পার্শ্বে অপরটি তার উত্তরে। একটি গেট কাশ্মিরী পুলিশ ও অপরটি ইণ্ডিয়ান আর্মিরা ব্যবহার করে।
পোস্টের উত্তরে এলাহীবাগ মহল্লা ও আনছার ঝিল। এখান থেকে উত্তর দিকের সড়কটি সামনে গিয়ে দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে চলে গেছে। এর একটির নাম নওসাহারা রোড, যা আলমগিরী হয়ে ডাউন টাউনের দিকে চলে গেছে। এ মোড়ে আলমগিরীতে ইণ্ডিয়ান সৈন্যদের একটি শক্তিশালী পোস্ট রয়েছে। অপর শাখার নাম আলীজান রোড, যা গানাই মহল্লার পাশ দিয়ে চলে গেছে।
ছুরাহ ক্যাম্পের দক্ষিণ পার্শ্বেই বিদ্যুৎনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এ ক্যাম্পের পূর্ব দিক বাদে বাকী তিন দিক উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তিন দিকের দেয়ালে কোন দরজা নেই।
প্রতিদিন নিয়মিত রাত সাড়ে দশটায় ভিসানাগ মন্দির থেকে একটা জীপ ও সাঁজোয়া গাড়ি খাবার নিয়ে ক্যাম্পে ঢোকে। আমরা প্রথমে এই গাড়ি দুটির উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করি। তারপর পরিস্থিতি বুঝে ক্যাম্পেও হামলা করা হবে।
আঠারোজন সাথীকে বাছাই করা হল। গাড়ি ভিসানাগ মন্দির থেকে বের হয়ে গানাই মহল্লার পাশের ছোট রাস্তায় উঠে মেইন রোডে আসে। ছোট রাস্তার মুখে মাইন স্থাপন করে মোর্চায় সাথীরা রকেটলাঞ্চার, অপর পার্শ্বে ক্লাসিকোভ ও এলএমজি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
যদি গাড়ি মাইনে ধ্বংস না হয় কিংবা সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে রকেট লাঞ্চার থেকে তার উপর রকেট নিক্ষেপ করা হবে। যদি কোন সৈন্য নেমে পালাবার চেষ্টা করে, তাকে ক্লাসিকোভের ফায়ারে ঝাঁঝরা করে দেয়া হবে ।
আমরা মোর্চায় বসে শিকারের জন্যে অধীরচিত্তে অপেক্ষা করছি। রাত বারোটায়ও গাড়ি আসার কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। অগত্যা সাথীদের ডেকে জমা করে মাইন তুলে সরাসরি পোস্টের উপর হামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
ক্যাম্পে রকেট দাগার জন্য সুবিধাজনক স্থান মাত্র দুটি। আমরা প্রথমে দক্ষিণ দিক দিয়ে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের পাশ দিয়ে হামলা করার চেষ্টা করি। কিন্তু সমস্যা হল, যদি গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোন খুঁটির উপর আঘাত হানে, তবে সমগ্র শহরের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ রচনায় এ অসুবিধা দেখা দেয়ায় আমরা ঘুরে মেইন রোডে এসে দেয়াল থেকে মাত্র ষাট মিটার দূরে দাঁড়িয়ে রকেট নিক্ষেপ করার প্রস্তুতি নেই।
ইতিপূর্বে ছুরার পোস্টে মুজাহিদরা অনেকবার হামলা করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক রকেট এর উপর বর্ষিত হয়েছে। কিন্তু হামলাগুলি হয়েছিল অনেক দূরে থেকে, যার ফলে রকেট হামলায় পোস্টের তেমন ক্ষতি হয়নি।
রকেট নিক্ষেপ করার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। বাকী সাথীরা তিন ভাগ হয়ে ক্লাসিকোভ ও এলএমজি নিয়ে একশ’ মিটার দূরে পজিশন নিয়ে বসে যায়।
সবাই মিলে আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকি। দুআ শেষে একটি রকেট পোস্টের দিকে ছুড়ে দিলাম। ক্যাম্পের একটি জানালা দিয়ে মৃদু আলো দেখা যাচ্ছিল। এ কামরায় একজন অফিসার ঘুমাত। আমার রকেটটি সোজা গিয়ে জানালায় আঘাত হানে। প্রচণ্ড আওয়াজে রকেটটি বিস্ফোরিত হয়। সাথে সাথে ঐ কামরা থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে দেখা গেল। রকেটের ছোট ছোট টুকরা অন্যান্য কক্ষে ছড়িয়ে পড়ায় আরও কয়েকটি কক্ষে আগুন ধরে যায়। যদিও রকেটের সামান্য একটি গোলা ভিতরে আঘাত হেনেছিল, কিন্তু আল্লাহর রহমতে তাতে ক্যাম্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
রকেট ফায়ারের পর পাঁচ মিনিট পর্যন্ত চারদিক ছিল নীরব, নিস্তব্ধ। এরপর অন্যদিকে আরও একটি রকেট ছুড়ে দিলাম। এবারের রকেটটি ছাদে আঘাত হানে এবং ছাদ উড়িয়ে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় রকেটটি বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য সাথীরা তাদের ক্লাসিকোভ ও এলএমজি দ্বারা অবিরামভাবে গুলী চালাতে থাকে।
আমাদের ফায়ারের শব্দ শুনে ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য পোস্টের সৈন্যরা ফায়ার করতে থাকে। আমরা তাদের রেঞ্জের বাইরে থাকায় আমাদের কেউ হতাহত হয়নি। কিন্তু ছুরাহ পোস্ট থেকে কেউ একটি গোলাও নিক্ষেপ করল না দেখে বিস্মিত হলাম। আমাদের আক্রমণের ফলে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পাল্টা আক্রমণের সাহস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলে তারা।
এরপর আমরা মেইন রোডে একটি মাইন স্থাপন করে পাশের মরিচায় অপেক্ষা করতে থাকি। ধারণা করেছিলাম, আক্রমণের পর ছুরাহ ক্যাম্পের দিকে সাহায্যের জন্য চারদিক থেকে গাড়ী আসতে থাকবে। কিন্তু আধা ঘন্টা অপেক্ষার পরও এদিকে কোন গাড়ী আসতে না দেখে মাইন তুলে নিয়ে চলে যাই। এ হামলায় কতজন দুশমন হতাহত হয়েছে, তা আমরা সঠিকভাবে জানতে পারিনি।
কাশ্মীরের নিয়ম হল, কোন গ্রুপের হামলা করার পর তার বিবরণ নিজ দলের নামে পত্রিকা অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিতে হয়। আমরা হামলার পর কোন পত্রিকা অফিসে খবর দেইনি। উপরন্তু আমরা এলাকাবাসীকে বলে এসেছিলাম, তারা যেন আমাদের সংগঠনের নাম প্রকাশ না করে। আমরা আমাদের উদ্দেশ্য বাস্তবে সফল করে দেখাতে চাই- কোন প্রচারণায় আমরা বিশ্বাসী নই।
সাংবাদিকরা আক্রমণকারীদের সনাক্ত করতে না পেরে নিজেরাই মহল্লায় এসে খোঁজ নিতে শুরু করে। পরদিন আসসফা, আফতাব, শ্রীনগর টাইমস ও চটান প্রভৃতি পত্রিকায় হেড লাইনে আমাদের হামলার খবর প্রকাশিত হয়। এসব পত্রিকার হেড লাইনে লেখা ছিল “হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামীর মুজাহিদদের আক্রমণে ছুরাহ পুলিশ স্টেশন সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত।” অন্যান্য পত্রিকায় শিরোনাম দেয়া হয়, “হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী ও সৈন্যদের মধ্যে শ্রীনগরে এক দীর্ঘ লড়াই” ইত্যাদি।
পরদিন ইণ্ডিয়ান সৈন্যরা পার্শ্ববর্তী মহল্লায় হানা দিয়ে বেশ কয়েকজন নিরীহ লোককে গ্রেফতার করে। মহল্লার মধ্য থেকে হামলা না করে মেইন রোড থেকে আক্রমণ করায় তাদেরকে সামান্য জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হয়।
তসবীহ হল জীবনের রক্ষাকবচ।
আমি বিশেষ প্রোগ্রামে শ্রীনগর থেকে বাসে ইসলামাবাদ যাচ্ছিলাম। সাড়ে বারোটায় বাস শ্রীনগর থেকে ছাড়ে। আমি বাস ছাড়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ি। পৌনে একটায় আমার ঘুম ভাঙ্গলে দেখলাম, বাস একটি ভারতীয় সৈন্যদের চেকপোস্টে দাঁড়ানো। দু’তিনজন সৈন্য যাত্রীদের নীচে নেমে আসতে বলছে।
চোখ মুছে আমিও উঠে দাঁড়ালাম। পিছনের এক সৈনিককে উদ্দেশ করে আগেরজন আমার দিকে ইশারা করে বলছে, এর উপর সন্দেহ হচ্ছে, খেয়াল রেখ।
সে তার পরবর্তী সৈনিককে বলল, ‘একে দুষ্কৃতিকারী বলে মনে হয়। গেটে দাঁড়ানো সিপাহী আমাকে জিজ্ঞেস করে, কোথা থেকে এসেছ?
বললাম, শ্রীনগর থেকে। “কি কাজ কর? মসজিদের ইমামতী করি। ইমামতী আবার কি জিনিস? মানে নামাজ পড়াই।
এভাবে প্রশ্নের ধারা চলতে থাকায় আমার ভয় হতে লাগল। কেননা সাধারণ । ভারতীয় সৈন্যরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা সামান্য সন্দেহের বশে আমাকে বন্দী করতে পারে। আমি এদের চেয়ে বরং অফিসারের মুখোমুখি হওয়া শ্রেয় মনে করলাম। তারা মোটামুটি শিক্ষিত হয় ও তাদেরকে দলীল-প্রমাণ দিয়ে বুঝানোও যায়। একজন সৈন্যকে বললাম, তোমাদের অফিসার কোথায়? তার কাছে আমাকে নিয়ে চল, তার কাছে সব বলব।’ সৈন্যটি আমাকে কিছু দূরে বসা। কর্নেলের কাছে নিয়ে যায় ।
কর্নেল জিজ্ঞেস করল, “কোথা থেকে এসেছ? বললাম, শ্রীনগর থেকে। ‘কোথায় যাবে? ‘অনন্ত নগর। ‘কি কাজ কর?” ‘ইমামতি। “ইমামতি কি জিনিস?’
নামাজ পড়াই।
ও আচ্ছা, আল্লাহ্, আল্লাহ্ কর, না?’
পেছনে দাঁড়িয়ে এক ক্যাপ্টেন গভীরভাবে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। আমার পা কাঁপছে কিনা, কণ্ঠে জড়তা আছে কিনা কিংবা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে আমার চেহারা ফ্যাকাশে হচ্ছে কিনা এসব লক্ষ্য করছে সে।
এবার কর্নেল বলল, তোমার রাইফেলটি কোথায়? তোমাকে দ্র মানুষ বলে মনে হয়। অস্ত্র জমা দিলেই ছেড়ে দেব।’
আমি বললাম, কি যে বলেন স্যার, আমি অস্ত্র পাব কোথায়?
সে এবার ধমক দিয়ে বলল, “আর ন্যাকামি করতে হবে না। জলদী বল, তোমার অস্ত্র কোথায়?
আমি বললাম, স্যার, আপনারা ভারত থেকে এসে আমাদের দৃষ্কৃতিকারী বলেন; অপর দিকে মুজাহিদরা আমাদের বলে ইণ্ডিয়ান এজেন্ট। কিছু দিন আগে মুজাহিদরা ইণ্ডিয়ান এজেন্ট বলে কয়েকজন আলেমকে হত্যা করে তাদের লাশ চৌরাস্তা ঝুলিয়ে রেখে চলে যায়। আপনিই বলুন, এটা আমাদের দেশ, এদেশ ছেড়ে আমরা যাব কোথায়?
কর্নেল বলল, তুমি কথায় বড় পাকা। কড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তুমি। বল, এমন কোন ব্যক্তি আছে কি, যে তোমার জামানত দিতে পারে?
তখন আমি কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম বললাম। এ রকম বিপদে কাজে লাগবে বলে তাদের নাম-ঠিকানা আগেই মুখস্থ করে রেখেছিলাম। এর মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তিও ছিল, যারা সরকারের নিকট খুবই বিশ্বস্ত। জিহাদের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই।
কর্নেল বলল, এরাও তো দুষ্কৃতিকারীদের সহযোগী।
আমি বললাম, কি-যে বলেন স্যার, এরা দ্বীনদার লোক। ধর্মের কাজ করেন। না এদের দুষ্কৃতিকারীদের সাথে কোন যোগাযোগ আছে, আর না আমিও কোন দুষ্কৃতিকারী। পয়তাল্লিশ মিনিট পর্যন্ত এভাবে কথাবার্তা চলতে থাকে। বাসের সবার তল্লাশী শেষ হয়েছে। তারা অধীর অপেক্ষা ও আশংকায় আমার দিকে তাকিয়ে। আছে। তারা জানত, আমি কাশ্মিরী নই। হয়ত পাকিস্তানী অথবা আফগানী হব। আমার সরল কথায় কর্নেল মোটামুটি আশ্বস্ত হয়; কিন্তু দেহ তল্লাশী তখনও বাকী।
আমার গায়ে কাশ্মিরী আলখেল্লা জড়ানো। হাত দুটো আলখেল্লার পকেটের মধ্যে রেখে মৃদু নাড়াচ্ছি ও তার সাথে সাথে দৃঢ়ভাবে কর্নেলের কথার জবাব দিচ্ছি। যে ক্যাপ্টেন আমার সামনে ছিল, তার দৃষ্টি হাতের উপর পড়তেই বলল, “স্যার, নিশ্চয় এর পকেটে গ্রেনেড আছে। এখন ধরা পড়ার সময় নিজেও মরবে এবং আমাদেরও মারবে। তাকে দু কদম পিছিয়ে সরে দাঁড়াতে বলুন।
কর্নেল আমার দিকে ঘুরে দাড়াল এবং জোরে কমাণ্ড দিল। বলল, দু কদম হেঁটে হাত উপরে তোেল।
মনে মনে বললাম, এবার আর গ্রেফতারী থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন পথ নেই। আল্লাহর কাছে মদদ চাইলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, আল্লাহর দ্বীনের হেফাজতের জন্যে এসেছি, এর থেকেও বড় বড় বিপদে তিনি সাহায্য করেছেন। নিশ্চয়ই এবারও তিনি আমার থেকে বিমুখ হব না; যেভাবেই হোক আমাকে হেফাজত তিনি করবেন-ই।
দু’কদম পিছনে সরে হাত উপরে তুললাম। হাতে এক ছড়া তসবীহ ছিল, যা এবার আমার জন্যে আবে-হায়াৎ হয়ে জীবন-রক্ষকের ভূমিকা পালন করে। তসবীহ দেখতেই মোমের মত গলে যায় কর্নেল । সে এবার বিনয়ের সুরে বলে, “ওঃ ভগবান, আমাকে ক্ষমা কর, আমরা এক বেগুনাহ আদমীকে খামাখা কষ্ট দিচ্ছি।’
সে গর্জে উঠে বলে, “কে এই শরীফ ব্যক্তিকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে? যাও একে বাসের মধ্যে সসম্মানে বসিয়ে দিয়ে এস।
আমার সাথে বাসে হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী কাশ্মীরের আমীর সাহেবও বসা ছিলেন। আমাকে এভাবে ফিরে আসতে দেখে তার খুশীর অন্ত ছিল না। তিনি মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
নতুন পরীক্ষা
বাস চলা শুরু করলে সকল যাত্রী আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে থাকে। কে এই লোক? এতক্ষণ কর্নেলের সাথে কথাবার্তা বলল, কর্নেল তাকে গালিও দিল । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিপাহীরা এসে সসম্মানে বসিয়ে দিয়ে গেল! দেহ তল্লাশীও করল না। নিশ্চয়ই লোকটি কোন সরকারী এজেন্ট হবে। প্রথমে বুঝতে
পেরে কর্নেল তাকে গালি-গালাজ করেছে। পরে পরিচয় পাওয়ায় ছেড়ে দিয়েছে। হয়ত এদের মধ্যে কোন গোপন সংযোেগ আছে!
বাসের সকলে আমাকে ভারতীয় গুপ্তচর মনে করে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগল। কে আমি? কোথা থেকে এসেছি? কর্নেলের সাথে এতক্ষণ কি কথা হয়েছে? ইত্যাদি হরেক রকমের প্রশ্ন।
আমি যতটা সম্ভব তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, আমি কোন গুপ্তচর নই; আমাকে তারা মুজাহিদ বলে সন্দেহ করেছিল। অনেক ওজর আপত্তি করে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হয়েছি।
তারা কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না। বাসে এর বেশী বলাও সম্ভব নয়। কেননা এখানেও কোন ভারতীয় গুপ্তচর থাকতে পারে। নামার সাথে সাথে তারা আমাকে ধরে ফেলবে। অপর দিকে আশ্বস্ত না করতে পারলে ইসলামাবাদ। যাওয়াও নিরাপদ নয়। তারা কোন মুজাহিদ গ্রুপের কাছে ভারতীয় চর বলে আমাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। দেখলাম, প্রতিটি যাত্রীই আমার ব্যাপারে আলোচনায় ব্যস্ত এবং সকলেরই মারমুখী মনোভাব। অগত্যা নিজের আসন ছেড়ে সবার সামনে এসে দাঁড়ালাম। হাত দুটি দু পকেটে ঢুকিয়ে গ্রেনেড দুটি বের করে এনে তাদেরকে দেখিয়ে বললাম, এ দুটি ছিল আমার পকেটে। যদি কর্নেলের সামনে আমার দেহ তল্লাশী হত, তবে আর বাঁচার উপায় ছিল না।
এবার সবার ভুল ভাঙ্গল। তারা নিজ নিজ মন্তব্যের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে লাগল। যে ব্যক্তি দুটি গ্রেনেড পকেটে রেখে এভাবে পয়তাল্লিশ মিনিট কর্নেলের জেরার মোকাবেলা করতে পারে, তাদের দৃষ্টিতে সে অতি বড় মুজাহিদ বটে। বাস থেকে নামার সাথে সাথে তারা আমাকে সাথে নিয়ে নিরাপদ এলাকায় পৌছিয়ে দেয়। তাদের ভালোবাসা ভোলার মত নয়।
একটি ঘরে নিয়ে বাসের যাত্রীরা গরম পানি দিয়ে আমার পা ধুইয়ে দেয়। আমি এক নওজোয়ান আর আমার পিতার বয়সী এক বৃদ্ধ পা ধুইয়ে দেয়ায় লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কোনক্রমেই এদেরকে বিরত রাখতে পারছিলাম না।
তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনারা কবে আসছেন?’
আমি জানালাম, আমাদের কমাণ্ডার শীঘ্রই এসে পৌছাবেন। তিনি আসলেই নিয়মিত লড়াই শুরু হবে।
সকলে তাদের নাম-ঠিকানা আমার ডাইরিতে লিখে দেন। যখনই ডাক আসবে হাজির হয়ে আমাদের কমাণ্ডে জিহাদ করবে বলে ওয়াদা করে তারা।
হৃদয়বিদারক এক নির্যাতনের কাহিনী
মুহাররম মাসের দশ তারিখে আমি সোপুর গিয়েছিলাম। সেখানে একজন সাথী আমাকে নিকটবর্তী গ্রামের এক মুজাহিদের সাথে সাক্ষাৎ করতে অনুরোধ জানায়। সে গ্রামে গিয়ে এক মাদ্রাসায় উঠে ছাত্রদের মাধ্যমে তার খবর নিলাম । তিনি আমাকে তার ঘরে এসে সাক্ষাৎ করতে অনুরোধ জানান। এ মুজাহিদ মাত্র দশদিন আগে জম্মু জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
ঘরের দরজায় কড়া নাড়তেই তের-চৌদ্দ বছরের এক কিশোরী দরজা খুলে দেয়। আমি মুজাহিদ সাথীর কথা জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি কাঁদতে শুরু করে। দরজার দুই পাশে দুই হাত রেখে প্রবেশ পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে সে। আমি বার বার তার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর না পেয়ে ফিরে আসার জন্যে রাস্তায় বের হই। তখন সে পেছন থেকে ভাঙ্গা উর্দুতে আমাকে ডাকতে থাকে। কাছে আসলে সে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কোথা থেকে এসেছেন? তার সাথে কেন দেখা করতে চান?
বললাম, আমি শ্রীনগর থেকে এসেছি। তার সাথে বিশেষ কথা আছে।
এবার সে আমার উর্দু ভাষা ও কথার ভঙ্গীতে আন্দাজ করে, নিশ্চয়ই আমি কোন মুজাহিদ হব এবং আমি দূর থেকে এসেছি। ফলে সে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে একটি কামরার দিকে হাত দ্বারা ইশারা করে।।
এ কামরার মধ্যে সেই মহান মুজাহিদ বসে আছেন। আমাকে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে মোসাফাহা করলেন। অতঃপর আমার আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। আমি তাকে আমার সংগঠনের পরিচয়সহ কাশ্মীরে আগমনের কারণ। ব্যাখ্যা করি। তার সাথে জিহাদ ও দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয়। এরপর তাঁকে আমি আমাদের সংগঠনে যোগ দেয়ার জন্যে আহবান জানাই।
এর জবাবে তিনি বলেন, “দেখ আমজাদ! আমার অনেক সমস্যা। আপাততঃ তোমাদের সাথে যোগ দিতে পারছি না। গ্রামের যে মাদ্রাসাটি দেখেছ, সেটি আমার এক বন্ধু চালাতেন। জিহাদেও তিনি শরীক হতেন। আমি ছাড়া পাওয়ার দু’ মাস আগে ভারতীয় সৈন্যরা তাঁর দু’পা কেটে দিয়েছে। জেল থেকে বের হওয়ার পর তিনি আমাকে মাদ্রাসা পরিচালনার জিম্মাদারী ন্যস্ত করেন। এ মাদ্রাসা থেকে এ পর্যন্ত অনেক হাফেজ ফারেগ হয়েছে। অনেকে এখনও পড়ছে। অতএব দ্বীনের স্বার্থে আমাকে এ মাদ্রাসা চালাতেই হচ্ছে। আর দ্বিতীয় কারণ যদি শোনার ধৈর্য রাখ, তবে বলব।’
আমি আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বলা শুরু করেন এবং সাথে সাথে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি কেন কাঁদছেন আমি তা বুঝতে পারছিলাম না। জেল, নির্যাতন, সাথীর হাত-পা কর্তনের খবর কিংবা ইন্টারোগেশন সেন্টারে চরম নির্যাতনের মুখে দিনের পর দিন অবস্থান এসব তো কাশ্মিরীদের কাছে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এতে একজন অকুতোভয় মুজাহিদের ঘাবড়ে যাওয়ার কথা নয়। উপরন্তু তিনি একজন আলেম এবং কাশ্মিরে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবগত। তা সত্ত্বেও মাদ্রাসা পরিচালনা করার অজুহাতে কিভাবে জিহাদ পরিত্যাগ করতে পারেন এ বিষয়টিও আমাকে ভাবিয়ে তুলল।
তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে শুরু করেন, ভাই আমজাদ! গত বছর আমাকে এক সাথীর সাথে একত্রে গ্রেফতার করে বারমুলার এক ইন্টারোগেশন সেন্টারে (নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। একদিন ও একরাত চরম নির্যাতনের পর আমাকে এক কর্নেলের সামনে হাজির করা হয়। কর্নেল আমাকে উদ্দেশ করে বলে, তোমাকে তো দেখতে ভালো মানুষ বলে মনে হয়; একটা শর্ত পূর্ণ করলেই তোমাদেরকে ছেড়ে দেব।’
আমি বললাম, স্যার, কি সে শর্তটি?
কর্নেল কুটিল হেসে বলল, তোমার একটি মেয়েকে এক রাতের জন্যে আমার খেদমতে পাঠিয়ে দেবে।’ . তার জানোয়ারের মত চেহারার দিকে তাকিয়ে আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। শরীরের সমস্ত শক্তি দ্বারা সজোরে তার গালে একটা চড় কষে দিলাম। জানোয়ারটা ঘুরে পড়ে গেল। উঠে বিড় বিড় করতে লাগল, দেখাচ্ছি তোমাকে মজা, বুঝবে এবার কোন্ ভীমরুলের বাসায় ঢিল ছুড়েছ।’ বলতে না বলতে সাত-আটজন সিপাহী আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। রাইফেলের বাটের আঘাত, কিল-ঘুষি আর বুটের লাথিতে আমার দেহ থেতলে যায়। এ সময় জীপের স্ট্রাট নেয়ার শব্দ শুনতে পাই।।
এক ঘন্টার মধ্যে ওরা আমার বড় মেয়েকে ধরে নিয়ে আসে। আমাকে একটি খুঁটির সাথে বেধে রাখে ওরা। এরপর চোখের সামনে যা ঘটেছে একজন পিতার পক্ষে মেয়ে সম্পর্কে তা বলা যায় না। আমি চীৎকার করে অনুনয়-বিনয় করতে থাকি। কিন্তু কিছুতেই পশুদের মনে দয়ার উদয় হল না।
এখানেই শেষ নয়। এরপর ওরা আমার মেঝ মেয়েকে নিয়ে আসে। তার সাথেও সেই একই আচরণ করে। এ কিয়ামত সমান দৃশ্য দেখে আমার হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। চোখে আগুন ঝলসাতে থাকে। মনে হচ্ছিল, আমি এখনই মরে যাব।
এরপর ওরা আমার দুই নাবালেগা হাফেজা মেয়েকেও হাজির করে। এবার আর স্থির থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। চীৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাই। তখন আমার বড় মেয়েকে ওরা বেয়নেট মেরে শহীদ করে। বাকীদের গাড়ীতে করে গ্রামে ফেরত পাঠায়। জালেম সৈন্যরা আমার ঘর জ্বালিয়ে দেয় আর আমাকে জম্মুর হেরা নগর জেলে পাঠিয়ে দেয়।
আমার মেঝ মেয়েটি ছিল বিবাহিতা; দু’ সন্তানের মা। এ ঘটনার পর সন্তান রেখে তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়। এ শোকে আমার স্ত্রী পাগল হয়ে গেছে। মেয়েরা এক বছর ধরে এই পোড়া ঘরে জীবনমরণের সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এক বছর পর্যন্ত তারা লজ্জায় ঘর থেকে বের হয়নি। আর হবেই বা কিভাবে? বাপ বন্দী, পাগল; ইজ্জত লুণ্ঠিত। বল আমজাদ ভাই, বল! আমরা কোথায় যাব? কি করব? আমাদেরকে এ দেশ থেকে কোথাও বাইরে নিয়ে যাও। এখানে থাকা আমাদের আর শোভা পায় না।
ভাই, যদি তুমি আর এক বছর আগে আসতে, তবে হয়তো আমাদের ইজ্জত বাঁচত। আমজাদ, তুমি অনেক দেরী করে ফেলেছ। আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমাদের চীৎকার কি দুনিয়ার মুসলমানদের কানে পৌছে না? কেন তারা আমাদের সাহায্যে জন্য এগিয়ে আসছে না? আমরা কি মুসলমান নই? এক মুসলমান বোনের ইজ্জত রক্ষা করতে মুহাম্মদ বিন কাসিম ছুটে এসেছিলেন সিন্ধুতে। আর এত কাছে থেকেও তোমরা তোমাদের কাশ্মিরী বোনদের আর্তচীৎকারের কানফাটা আওয়াজও শুনতে পাও না? ঝিলাম নদী বয়ে যে হাজার হাজার মা-বোনের লাশ তোমাদের চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেছে, তা দেখেও কি তোমাদের ঈমান স্কুলিংগের মত জ্বলে উঠে না?
যদি এত কিছুর পরও তোমাদের চেতনা না আসে, তবে মনে রেখ, আমরা মরতে থাকব। দ্বীনের হেফাজতের জন্যে সর্ব প্রকারের কুরবানী দিয়ে যাব। তবুও এক কাশ্মিরী জিন্দা থাকতে কাফিরের আনুগত্য স্বীকার করব না। তাতে দুনিয়ার মুসলিম আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসুক আর না আসুক। তুমি দুনিয়ার মুসলমানদের কাছে আমাদের পয়গাম পৌছে দিও। শুধু এক ভাই নয়, হাজার ভাই হাজার বোন তাদের পথ পানে চেয়ে আছে। দয়া করে জলদী এস, ধৈর্য বাঁধ মানছে না আর ।।
তাঁর এ হৃদয়বিদারক জীবন কাহিনী শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। অসুস্থ হয়ে বিছানার উপর ছটফট করছিলাম। সতেরো দিন পর সেই মুজাহিদের এক মেয়ে একখানা কাগজে আমার নিকট লিখে পাঠায়, ‘আমজাদ! এক ভাইয়ের কাহিনী শুনেই নির্জীবের মত বিছানায় পড়ে গেলে? এখানের হাজারো ভাই-বোনের জিন্দেগী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শুয়ে থাকার সময় নেই। ওঠ, তোমাকে শত শত বোনের ইজ্জতের হেফাজত করতে হবে। এই চিঠি পড়ে আমার শরীরের জ্বর-তাপ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তখনই মেয়ের পিতাকে সঙ্গে নিয়ে জিহাদের জন্যে শ্রীনগর চলে আসি।
পাঠকদের নিকট আমার নিবেদন, কারো ইজ্জতহানির কাহিনী বর্ণনা করা আমার উদ্দেশ্য নয় বরং আপনাদের ভাবতে বলছি, যদি এরূপ অবস্থার শিকার আপনারা হন, তখন কি করবেন? সে সময় কি করণীয় হবে আপনাদের? একটু ভেবে দেখুন। আজ কাশ্মিরী ভাই-বোনদের বেলায় যা ঘটছে, আপনাদের সাথে তেমন হবে না- এর কি কোন নিশ্চয়তা আছে? এর জন্য আমরা কী প্রস্তুতি নিচ্ছি? আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াবার তৌফিক দান করুন।
প্রাণে বেঁচে গেল আরশাদ আলী
মুজাহিদ আরশাদ আলী প্রশিক্ষণ নেয়ার পর সশস্ত্র অবস্থায় ইসলামাবাদ পৌছে। সেখানে এক বন্ধুর কাছে অস্ত্র রেখে পায়ে হেঁটে নিজ গ্রাম পালাহ বটগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। শোরিয়ারের বিরাট রাস্তা পার হওয়ার সময় হঠাৎ দু’টি ফৌজী জীপ এসে তার সামনে দাঁড়ায়।
আরশাদ ভাবল, দৌড়ে পালাতে চাইলে নির্ঘাত গুলী খেতে হবে। জীপের সামনের সিটে বসা এক অফিসার তাকে লক্ষ্য করে গর্জে উঠে, এদিকে আয়, কি নাম তোর?’
‘আরশাদ আলী। ‘বাড়ি কোথায়? ‘পালাহ বটগ্রাম।
অফিসার এক সিপাইকে ডেকে তাকে তল্লাশী নিতে বলে। তল্লাশীতে আপত্তিকর কিছু না পাওয়া সত্ত্বেও অফিসার তাকে কান ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়াতে বলে। এবার আরশাদ বুকে সাহস নিয়ে বলে, আমি কি অন্যায় করেছি স্যার, আমাকে কেন শাস্তি দিচ্ছেন?
অফিসার বলল, তোমার কার্ড দেখাও?’ ‘আমি ট্রেনিং নিয়ে সবে মাত্র এসেছি, কার্ড এখনও তৈরী হয়নি।
“হারামজাদা, এক ঘুষিতে তোর মুখ ভেঙ্গে দেব। গাধা কোথাকার! কার কাছে কি বলছিস! ভাগ এখান থেকে, পিছনে তাকালেই গুলী করব।’
আরশাদ পরে জানায়, আমি নিশ্চিত মনে করেছিলাম, আমাকে সামনের দিকে দৌড়াতে বলে সে পেছন থেকে গুলী করবে। মৃত্যুর জন্য পূর্ণ প্রস্তুত হলাম। তবুও সামান্য আশা বুকে বেঁধে দ্রুত এলোমেলো দৌড়াতে লাগলাম । কিন্তু পেছন থেকে কোন গুলী এসে আমার শরীরে বিধল না। অথচ পেছনের জীপে একজন হিন্দু সিআরপি অফিসার বসা ছিল।
মাইছামার বীরাঙ্গনা
সোপুর থেকে এসে শ্রীনগরের লালচকের নিকট ‘মাইছামা’ নামক এলাকার এক ঘরে অবস্থান নিলাম। এ মহল্লায় ‘ইখওয়ানুল মুজাহিদীন’-এর এক সাথী ট্রেনিং নিয়ে সবে মাত্র বাড়ি এসেছে। দশ-বার দিন এদিক-ওদিক কাটিয়ে প্রথমে যে দিন নিজ ঘরে আসে, সে দিনই গুপ্তচররা তার আগমনের খবর ইন্ডিয়ান সৈন্যদের কাছে পৌছিয়ে দেয়।
আমাদের অবস্থান থেকে পাঁচ-ছ’টি ঘরের পর তার ঘর। গুপ্তচরের সংবাদ অনুযায়ী অতি ভোরে সৈন্যরা এসে তার বাড়ির গলির মুখে অবস্থান নেয়। রাতের আঁধার কেটে পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়ার সাথে সাথে তারা মুজাহিদের ঘর ঘিরে ফেলে। সৈন্যরা ঘরের মধ্যে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে মুজাহিদের নাম ধরে ডাকতে থাকে।
সাধারণতঃ ভারতীয় সৈন্যরা কাশ্মিীরীদের কোন রকম অবগতি করানো ছাড়াই তাদের ঘরে প্রবেশ করে। কিন্তু এখানে বিপদের আশংকা থাকায় বাইরে দাঁড়িয়ে তারা তাকে ডাকতে থাকে।
অভাবিত বিপদে পড়ে নবীন মুজাহিদ ঘাবড়ে যায়। পালাবারও কোন পথ পাচ্ছে না। আর নিজ ঘরে বসে ওদের মোকাবেলা করার অর্থ ভাইবোন সবাইকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করা। কোন উপায় না দেখে সে ঘরের মধ্যে তড়পাতে থাকে। পাচ-ছ’জন সৈন্য এক সুযোগে ঘরে ঢুকে পড়ে। ঘরে প্রবেশ করে সৈন্যরা প্রথমে মুজাহিদ ও তার সাত বছর বয়সী ছোট ভাইকে শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে।
এরপর তার দুই যুবতী বোনের উপর ওরা হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানব সভ্যতার কলংক হিংস্র ভারতীয় সৈন্যদের উপর্যুপরি ধর্ষণের ফলে ঘটনাস্থলেই দু বোন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। হিংস্র হায়েনাদের তাতেও তৃপ্তি হল নক। ওরা রশি দিয়ে বাঁধা ভাইদের সামনে মৃত বোন দু’টির হাত-পা কেটে রাস্তায় নিক্ষেপ করতে থাকে। তাদের এ বীভৎস নির্মম অত্যাচার দেখে অসহায় দু’ ভাই
চীৎকার দিয়ে বলতে থাকে, ভাইয়েরা আমার! আমাদের বাঁচাও! সৈন্যরা আমার বোনদের কেটে টুকর টুকর করছে, তোমরা কেন এগিয়ে আসছ না? কোথায় আমার ভাইয়েরা, আমাদের বাঁচাও!’।
আমি অনেকক্ষণ ধরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে তাদের করুণ চীৎকার শুনছিলাম। তাদের প্রতিটি আহবানে আমার শরীর শিউরে উঠছিল । সাধারণতঃ শ্রীনগরের কোন ঘরে সৈন্যরা প্রবেশ করে অত্যাচার করলেও অন্য ঘর থেকে তাদের উপর হামলা করা হয় না। কারণ, সৈন্যরা সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আসে। অপ্রস্তুত মুজাহিদরা তাদের উপর গুলী ছুড়লে পাল্টা আক্রমণের মোকাবেলা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তার উপর যে ঘর থেকে হামলা করা হয়, সে ঘর ধূলিস্মাৎ করে দেয়া হয়। আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলাম, কি করা যায়? ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সৈন্যদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলাম। এবার ওরা শক্ত রশি দিয়ে হাত-পা বাঁধা দু’ ভাইকে রাস্তার উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। এ অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তারা দু ভাই সে অবস্থায় চীৎকার করে বলছিল, ‘কোথায় লুকিয়ে আছ তোমরা! ওরা আমার দু’ বোনকে শহীদ করেছে। আমাদেরকেও হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর দোহাই, তোমরা এগিয়ে এস! আমাদেরকে বাঁচাও। আমার মাসুম ভাইকে বাঁচাও।
দু’ বোনের কর্তিত ও ক্ষত-বিক্ষত উলঙ্গ লাশের দৃশ্য ও মুজাহিদ ভাইয়ের আকাশ ফাটানো চীৎকার শুনে আর স্থির থাকতে পারলাম না। পরিণতির কথা মুহূর্তে ভুলে গিয়ে রাইফেল তাক করে এক ব্রাশ ফায়ারে চারজন সৈন্যকে জাহান্নামে পাঠালাম। অবস্থা বেগতিক দেখে বাকী সৈন্যরা প্রাণের ভয়ে দৌড়ে পালাল। অবলা নারীদের উপর অত্যাচারে সিদ্ধ সশস্ত্র কাপুরুষরা অস্ত্র তুলে নেয়ারও হিম্মত করল না।
রশি বাঁধা সে মুজাহিদ ওই দিনের লোমহর্ষক অত্যাচারের পর পাগল হয়ে যায়। এখন সে অলি-গলিতে ঘুরে আর চীৎকার দিয়ে বলতে থাকে, ‘ওরা আমার বোনদের হত্যা করেছে। আমার বোনদের অংগসমূহ কেটে টুকরো টুকরো করে রাস্তায় নিক্ষেপ করেছে। এখনও তোমরা বসে আছ? আমাকে বাঁচাও! আমার ভাইকে বাঁচাও!’ ইত্যাদি বলে চীৎকার করে বেড়াচ্ছে।
মাইছামার অধিবাসীরা সমগ্র কাশ্মীর অধিবাসীর আযাদীর রাহবার। কাশ্মীর আজাদীর জিহাদ শুরু হয়েছে এখান থেকেই। এ এলাকার নওজোয়ানরা সাহস, কৌশল ও বাহাদুরীতে সবার সেরা। এখানে যারা বাস করে, তারা আফগানীদের বংশধর। যুগ যুগ ধরে নাতিশীতোষ্ণ কাশ্মীরে বসবাস করলেও তাদের তেজ, স্বভাব ও হিম্মত সামান্যও হ্রাস পায়নি।
এখানকার মহিলারা পর্দানশীল। তারা বোরকা পরিধান করে। কিন্তু এতই সাহসী যে, রান্না ঘরের দা-বটি নিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। একবার এরা দা-বটি হাতে মাঠে নেমে আসলে এক মজার দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। ভারতীয় সৈন্যরা তাঁদের দেখে পালাতে শুরু করে আর তাদের পেছনে পেছনে দা-বটি নিয়ে ইসলামের বীরাঙ্গনারা ধেয়ে যায়। জরুরী অবস্থার সময় এদের দেখাদেখি অন্যান্য মহল্লার মহিলারাও কারফিউ ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে আসে। এসব অবস্থায় দেখামাত্র গুলীর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কারফিউর সময় শ্রীনগর কোলাহলপূর্ণ জনপদে পরিণত হয়; কারফিউ চলছে কিনা তা মালুম করা যায় না।
এ সাহসী মহিলাদের নজীর বর্তমান দুনিয়ায় নিতান্তই বিরল। কাশ্মিরীদের পরম বিশ্বাস, যতদিন মাইছামার বীর প্রসবিনী সাহসী নারীরা স্তব্ধ না হবে, ততদিন আজাদীর এ উত্তাল জোয়ার কেউ রুখতে পারবে না, কেউ টলাতে পারবে তাদের ইস্পাতকঠিন স্বাধীনতার শপথ।
এ ঘটনার পর আর মাইছামা থাকা নিরাপদ নয় ভেবে আমি অন্য এলাকায় চলে আসি।
ঝিলামের পাড়ে ভারতীয় পোস্টের উপর আক্রমণ
শহরের মধ্যস্থলে ঝিলামের পাড়ে ভারতীয় সৈন্যদের পাহারা পোস্ট। এ পোস্টে রাত্রে ত্রিশজন সৈন্য পাহারা দেয়। এরা প্রায়ই বিনা কারণে সাধারণ লোকদের উপর নিপীড়ন চালাত। সেখান থেকে যে সব বৃদ্ধ ও শিশু যাতায়াত করত, বিনা উস্কানিতে তারা তাদের কান মোচড়াত। বাজার থেকে আনা তাদের সওদাপাতী ছিনিয়ে নিত। আর নওজোয়ানদের তীব্র স্বোতস্বিনী নদীর কিনারায় নিয়ে লাথি মেরে নীচে ফেলে দিত।
তাদের এ অমানুষিক আচরণের ফলে বেশ কয়েকজন নিরীহ লোক পানিতে ডুবে মারা গেছে। এ পথে যাতায়াতকারী মহিলাদের তারা তল্লাশীর নামে বে-আবরু করে থাকে। মোটকথা এ বেহায়া অমানুষরা স্থানীয় লোকদের হয়রানী করার কোন সুযোগ হাতছাড়া করত না।
এদের এহেন কার্যকলাপে ধৈর্যহারা হয়ে আমরা ক’জন সিদ্ধান্ত নিলাম, যেভাবে এরা লোকদের নির্দয়ভাবে নদীতে ডুবিয়ে মারছে, আমরাও ওদের পুরো পোস্ট সেভাবেই উল্টিয়ে নদীতে ফেলব। সর্বমোট আঠারোজন মুজাহিদ এ আক্রমণের প্রস্তুতি নিলাম। দু’ ভাগ করে প্রথম আটজনকে গলির মুখে পাঠানো হল, যেন ওদের সাহায্যকারী সৈন্যরা এসে আমাদের ঘিরে ফেলতে না পারে।
কথা ছিল অতি ভোরে আমরা দু’টি লাঞ্চার দিয়ে পোস্টের উপর রকেট ছুড়ব। রকেটের হামলা হলে ওরা আমাদের মোকাবেলায় ব্যস্ত থাকবে। এ ফাকে অপর পাশ দিয়ে তিনজন সাহসী মুজাহিদ শক্তিশালী বোমা নিয়ে পোস্টে ঢুকে সাথে সাথে বিস্ফোরণ ঘটাবে। ‘
এ কাজ ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যারা বোমা ফাটানোর দায়িত্ব পালন করবে, তাদের পক্ষে অক্ষত বেঁচে যাওয়া অসম্ভব হবে। কিন্তু এছাড়া পোস্ট ধ্বংসের অন্য কোন সহজ পদ্ধতি আমাদের পরিকল্পনায় ছিল না।
আমরা রকেট ফায়ার করার জন্যে আগের রাতে যে স্থান নির্বাচন করেছিলাম, সকালে গিয়ে দেখি, সৈন্যরা সেদিকে চাদরের মত লম্বা চেপ্টা লোহার পাত টানিয়ে পোস্টকে আড়াল করে রেখেছে। স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, সৈন্যরা আমাদের গতিবিধি টের পেয়েছে। অতএব উপস্থিতভাবে আগের পরিকল্পনা পাল্টিয়ে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। এ পাশ থেকে লোহার পাতের ফাঁক গলিয়ে রকেট ছুড়লে তা তেমন কার্যকরী হবে না। এ কারণে অপর পাশ দিয়ে একযোগে রকেট ও ক্লাসিকোভ দ্বারা হামলা শুরু করলাম।
সৈন্যরা পূর্বেই প্রস্তুত ছিল। গোলা-গুলী শুরু হলে পোস্টের সাহায্যের জন্যে প্রধান ক্যাম্প থেকে চারটি সাঁজোয়া গাড়ী পোস্টের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এক সাথে দু দিকের মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এদিকে রকেটের গোলাও ছিল সীমিত। সর্বশেষ গোলাটি সাঁজোয়া গাড়ির উপর ছুড়ে এলএমজির ফায়ার করতে করতে আমরা নিরাপদ স্থানে সরে গেলাম।
পরদিন সরকারী প্রেসনোটে সাতজন সৈন্য নিহত ও দশজন আহত হয় বলে উল্লেখ করা হয়। নদীর কিনারার মরিচা থেকে যে সৈন্যরা আমাদের মোকাবেলা করছিল, তারা গুলী খেয়ে ছটফট করতে করতে নদীতে পড়ে ডুবে মারা যায়।
এ ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে কোন মুজাহিদ হতাহত হওয়া ছাড়া আল্লাহ আমাদের মনের ইচ্ছে পূর্ণ করুন। নদীতে ফেলে ডুবিয়ে মারার কৌতুকের শাস্তি কত ভয়াবহ ও করুণ, তা এ পোস্টের সৈন্যরা হাড়ে হাড়ে টের পেল।
মজার এক আলাপ অক্টোবরের শেষের দিকে আমাদের দু’জন মুজাহিদ ঝিলাম নদীর তীর দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের একজন অন্যজনকে বলল, চল গোসল করে আসি।
তারা কাপড়ের নীচে পিস্তল ঢেকে রেখে নদীতে গোসল করতে নামে। এর মধ্যেই দু’জন ইণ্ডিয়ান সৈন্য পানি তুলে নেয়ার জন্য নদীর কিনারে আসে। তাদের একজনের কাছে একটা বালতি আর দ্বিতীয়জন একটা রাইফেল হাতে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
মুজাহিদদ্বয় গোসলে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ কিনারায় তাকিয়ে দেখে, একজন সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। একজন মুজাহিদ বুদ্ধি খাটিয়ে তাদেরকে লক্ষ্য করে বলল,
স্যার কেমন আছেন? সামান্য এক সিপাইকে ‘স্যার’ বলায় তারা তো খুশীতে বাগ বাগ। ওরা বলল, “তোমরা কারা? কোথা থেকে এসেছ?’
তারা বলল, স্যার আমরা ঐ গ্রামের লোক, ক্ষেত-খামারে কাজ করি।
একজন সৈন্য বলল, তোমাদের গ্রামে তো কোন দুষ্কৃতিকারী নেই? মুজাহিদ জবাবে বলল, কি যে বলেন স্যার, আপনারা এখানে থাকতে কোন সাহসে ওরা এদিকে আসবে?’
এবার সৈন্যটি ভরসা পেয়ে এক মুজাহিদের সাথে আলাপ জুড়ে দেয়। অপর সিপাহী পানি তোলার জন্যে বালতি নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে। অপর মুজাহিদ নদী থেকে উঠে খুব সতর্কতার সাথে কাপড় পরার ভান করে পিস্তল তুলে সৈন্যটিকে লক্ষ্য করে এক গুলী ছুড়ে দেয়। গুলী খেয়ে সৈন্যটি ঘুরতে ঘুরতে নদীতে পড়ে যায়। তার রাইফেলটি নদীর কিনারায় পড়ে থাকে। মুজাহিদদের হাতে বেশী সময় ছিল না বলে রাইফেলটি তুলে এক গুলীতে অপর সৈন্যটিকে মেরে ঝিলামে ভাসিয়ে দ্রুত অন্যত্র চলে যায়।
রক্তের আখরে উদ্যাপিত স্বাধীনতা দিবস।
ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ই আগস্ট। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে সেদিন উদযাপিত হয় কালো দিবস’। চোখে পড়ে সর্বত্র কালো পতাকা। লোকজন কালো পোশাক পরে রাস্তায় নামে। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সরকারী অনুষ্ঠান ছাড়া কোন আনন্দ-উৎসব কাশ্মীরে পালিত হয় না । ১৫ই আগস্টের পরিবর্তে কাশ্মিরী জনসাধারণ ১৪ই আগস্ট স্বাধীনতা উৎসব পালন করে। ১৪ই আগস্ট সকাল থেকেই আনন্দ-উৎসব শুরু হয়। যুবক-বৃদ্ধ-কিশোররা জাতীয় পতাকা বুকে জড়িয়ে রাস্তায় নামে। প্রতিটি ঘরে আযাদীর প্রতীক চাঁদ- তারা খচিত সবুজ ঝান্ডা শোভা পায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সবুজ ব্যানারে স্বাধীনতার দাবী ও ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও শাহাদাতের অমর বাণী লিখে টানানো হয়।
এ বছরও প্রতি বছরের ন্যায় অত্যন্ত শান-শওকতের সাথে ১৪ই আগস্ট পালন করা হয়। প্রতিটি ঘরে সবুজ ঝান্ডা উড়ানো হয়। প্রত্যেক মোড়ে সবুজ ব্যানার শোভা পায়। তাতে ভারত বিরোধী নানা শ্লোগান লেখা থাকে।
আমি একটি দোতলা বাড়ীর জানালা দিয়ে এ দৃশ্য দেখছিলাম। আমাদের ঘর থেকে পনের ষোলটা ঘর পরে একটা ব্যানার টানানো ছিল। তাতে ভারতের বিরুদ্ধে দু’টি শ্লোগান লেখা ছিল। ব্যানারের এক পাশের রশি ছিড়ে ব্যানারটি রাস্তার উপর ঝুলছিল।
ইসহাক নামের একজন মুজাহিদ সেটাকে উপরে তুলে পুনরায় বাঁধতে শুরু করে। এমন সময় একটি সাঁজোয়া গাড়ী চলে আসে। গাড়ী থেকে সৈন্যরা রশি হেলতে দেখে উপরে তাকায়। ইসহাক তখনও খুঁটির উপর। তারা তাকে নীচে নামিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গুলী করে। তাকে হত্যা করেই সৈন্যরা থামেনি। তার দেহ থেকে মাথা কেটে আলাদা করে সামনে অগ্রসর হয় ।
কিছুদূর অগ্রসর হলে জামার উপর আল-জিহাদের ব্যাজ আঁটা দু’জন। মুজাহিদ তাদের সামনে পড়ে। সৈন্যরা তাদেরকেও গুলী করে হত্যা করে। সাথে সাথে সাঁজোয়া গাড়ী আরো অগ্রসর হয়ে আমাদের বাড়ীর সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। এপাশ দিয়ে গুলী চালাতেই ওপাশ দিয়ে অন্য মুজাহিদরা তাদের উপর গুলী ছোড়ে।
চার ঘন্টা ব্যাপী লড়াই চলার পর অপর পাশের মুজাহিদদের গুলী ফুরিয়ে যায়। সে সুযোগে বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা পালিয়ে যায়। এ লড়াইয়ে চারজন মুজাহিদ শহীদ হয়। অপর পক্ষে সতেরো জন হানাদার সৈন্যের নাম নিহতের খাতায় লেখা হয়ে যায়।
আবার ক্রেক ডাউনের কবলে
ক্রেক ডাউনের নাম শুনতেই ভয়ে-আশংকায় শরীরের সবগুলো লোম। দাঁড়িয়ে যায়। মানসপটে এমন ভয়াবহ এক চিত্র ভেসে উঠে, যা সুস্থ মানুষও কল্পনা করলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্রেক ডাউনের নামে ওদের পাশবিকতা ও নির্মম অত্যাচারের কথা জল্পনা করতেও কষ্ট হয়। এ সময় নওজোয়ানদের ঘর থেকে বের করা হয়। বৃদ্ধ, দুর্বল ও কমজোর লোকদের টেনে হিচড়ে বাইরে আনা হয়। বাচ্চারা ওদের বুটের তলায় পিষ্ট হয়। হায়েনার মত মহিলাদের ইজ্জত লুটে খায়। পিশাচদের নখরাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় তাদের শরীর ও মন।
তিন দিন পর্যন্ত খোলা আকাশের নীচে ক্ষুধা ও পিপাসা নিয়ে পরিচয় ও তল্লাশী শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের অবস্থান করতে হয়। হাত-পা অবশ হয়ে যায়।
কোন এলাকায় মুজাহিদ আছে বলে সন্দেহ হলেই তারা সেখানে ক্রেক ডাউন বসায়। গভীর রাতে সৈন্যরা সমগ্র এলাকা ঘিরে ফেলে। এরপর প্রতি দশ মিটার অন্তর দু’জন সৈন্য বন্দুক উঁচিয়ে দাড়িয়ে থাকে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে মাইক দিয়ে ঘোষণা করা হয় যে, এ এলাকায় ক্রেক ডাউন বসানো হয়েছে। অতএব জনগণ যেন নিজ নিজ ঘর থেকে বের হয়ে অমুক মাঠে ‘সক্তি প্যারেডে একত্রিত হয়।
এলাকার সকল পুরুষ, মহিলা ও শিশুরা সে মাঠে একত্রিত হয়। এরপর সৈন্যরা ঘরে ঘরে ঢুকে তল্লাশী চালায়। যদি কোন ঘরে কাউকে লুকানো পাওয়া যায়, তবে তাকে সাথে সাথে গুলী করে হত্যা করে। এই সময় ঘরের মূল্যবান জিনিস-পত্র সৈন্যরা হাতিয়ে নেয়। সব বাড়ী-ঘরের তল্লাশী শেষ হলে নির্দিষ্ট মাঠে অপেক্ষারত লোকদের সনাক্ত প্যারেড’ শুরু হয়। বয়স অনুযায়ী তাদেরকে বিভিন্ন লাইনে দাঁড় করিয়ে পরিচয় নেয়া হয়।
সবাইকে সর্বপ্রথম প্রমাণ করতে হয় যে, সে কাশ্মিরী । এরপর একটি গাড়ীতে বসা সরকারী গুপ্তচর বাহিনীর সামনে এক এক করে সবাইকে হাজির করা হয়। যদি গুপ্তচররা কোন ব্যক্তিকে মুজাহিদ বলে সন্দেহ করে, তবে গাড়ীর হর্ণ বেজে উঠে অথবা সৈন্যদেরকে ইশারায় বিষয়টা জানিয়ে দেয়া হয়। যাদের প্রতি তাদের সন্দেহ না হয়, তাদেরকে চলে যেতে বলা হয় । দেহ তল্লাশীসহ সকলকে নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এ সময় ভারতীয় সৈন্যরা বিনা উস্কানিতে অশ্রাব্য ভাষায় গালি-গালাজ করে।
১৮ই আগস্ট সন্ধ্যায় আমার অবস্থান থেকে বের হয়ে শ্রীনগরে শহীদদের জন্যে অনুষ্ঠিত দুআর মাহফিলে অংশ গ্রহণ করি। দুআর মাহফিলের পর মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নদী পার হয়ে অপর পারে যাবার প্রোগ্রাম ছিল। আমার মেজবান এ সময় নদী পাড়ি দিতে বারণ করেন।
রাতের বেলা নদীতে কোন নৌকা চলাচলের শব্দ পেলে সৈন্যরা নির্বিচারে গুলী ছুড়ে। সাতার না জানায় এবং পুল দিয়ে অপর পারে যাওয়াও নিরাপদ নয় ভেবে সে রাতের জন্যে এপারেই থেকে গেলাম।
রাত শেষে ভোর হতেই সৈন্যরা ক্রেক ডাউন দিয়ে সুপ্রভাত জানায়। নিরুপায় হয়ে আমিও সনাক্তি প্যারেডের জন্যে নির্ধারিত স্থানে পৌছে জওয়ানদের লাইনে বসে পড়ি।
পার্শ্ববর্তী বৃদ্ধদের লাইন থেকে এক বৃদ্ধ অবিরাম চীৎকার করছিল, আমার পেটে ব্যথা করছে, আমাকে ঘরে নিয়ে চল।।
এক সৈন্য এসে তার পেটে সজোরে লাথি মেরে বলল, “হারামজাদা, কমবখত, চুপ করে বসে থাক।
বৃদ্ধের পেটে সত্যি সত্যিই প্রচন্ড ব্যথা করছিল। তার পক্ষে লাথি খেয়েও চুপ থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। সে পুনরায় কাতরাতে লাগল।
এবার এক ক্যাপ্টেন এসে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবাজী কি হয়েছে?
বৃদ্ধ এবার তার পেটের ব্যথার কথা খুলে বললে ক্যাপ্টেন জওয়ানদের লাইনে দৃষ্টি বুলায়। সাত নম্বরে আমি বসা ছিলাম। আমার উপর তার দৃষ্টি স্থির হওয়ায় আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যায়। সে আমাকে উঠে দাঁড়াতে ইশারা করে বলল, তোমাকে শরীফ আদমী বলে মনে হয়, কোথা থেকে এসেছ? কি কাজ কর? আচ্ছা মেডিকেল স্টোর চিন?’
‘জি হ্যা, আমাদেরই একটা আছে।’
‘যাও, এই বাবাজীকে নিয়ে যাও। ঔষধ খাইয়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে আস। তোমার পরিচয় নিতে হবে। আমার হৃদয়ে আশার আলো জ্বলে ওঠল।
‘আচ্ছা দাড়াও, তোমার সমাক্তি পর্ব আগে হয়ে যাক।
এবার আমার পায়ের নীচের মাটি যেন সরে যাচ্ছিল। এদিকে বৃদ্ধ সমানে কাতরাচ্ছে। ক্যাপ্টেন সে দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এতে তো অনেক সময় লাগবে। যাও তাড়াতাড়ি ঔষধ নিয়ে ফিরে আস।”
এবার আমি উঠে বৃদ্ধকে নিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হলাম। মনের গভীর থেকে বৃদ্ধের জন্যে দু’আ করলাম, বৃদ্ধও আমার জন্যে দুআ করল।
আমি বললাম, আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করুন। আমার এ কথায় বৃদ্ধের সন্দেহ হল।
সে বলল, তোমাকে আমার সন্দেহ হয়।
আমি ভাবলাম, এ আবার কোন্ বিপদ। তাড়াতাড়ি কথা পাল্টিয়ে বললাম, বাবাজী তাড়াতাড়ি চলুন। ফিরে এসে সনাক্তি প্যারেডে অংশ নিতে হবে।
পেছন থেকে দু’জন সিপাই দৌড়ে এসে বলল, তাড়াতাড়ি কর। আমি বললাম, বাবাজী হাঁটতে পারছেন না। বড় কষ্টে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। “আচ্ছা জলদী কর’ বলে তারা সিগারেট টানতে থাকে।
মেডিকেল স্টোরে পৌছলাম। স্টোরের মালিক আমাকে আগে থেকেই চিনত। সে অবাক বিস্ময়ে বলল, আমজাদ, তুমি এখানে!’
বললাম, হ্যা দোস্ত, জলদী পালাবার কোন ব্যবস্থা কর।’ সে মেডিকেলে বসা এক বৃদ্ধকে দেখিয়ে বলল, ‘পোষাক বদলী করে এ বাবাজীর জামা-টুপি পরে নাও।
আমি নিজের জামা কাপড় রেখে বৃদ্ধের মাটিয়া রংয়ের জামা ও পুরোনো ফ্যাশনের উঁচু টুপি মাথায় দিয়ে হাতে আগুন ঘেঁকার গরম অঙ্গারের ছোট ঝুড়ি নিয়ে মাথা নীচু করে তৎক্ষণাৎ মেডিকেল স্টোর থেকে বের হয়ে পড়লাম।
সৈন্যরা আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, দূর থেকে ওরা আমাকে চিনতে পারেনি। তারা মাঝে মধ্যে দোকানের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করছিল। আমি গলির মুখে অগ্রসর হয়ে অঙ্গারের ঝুড়ি ছুড়ে ফেলে দৌড় দিলাম। এবার শোর-গোল পড়ে যায়। সৈন্যরা আমাকে ধরার জন্যে দৌড়ে গলির মুখে চলে আসে। ততক্ষণে আমি একটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে একটি ছিদ্র দিয়ে সক্তি প্যারেড দেখছিলাম।
সুনাক্তি প্যারেড শেষ হয়ে যাওয়ায় সৈন্যরা দ্বিতীয়বার খানা তল্লাশীতে আসেনি। পরে শুনলাম, সৈন্যরা আমার সম্পর্কে সেই বৃদ্ধ ও মেডিকেল স্টোরের মালিকের কাছে জিজ্ঞেস করেছে। তারা বলেছে, এখানে দাঁড়ানো ছিল, কোন দিকে গেছে আমরা লক্ষ্য করিনি।
অসুস্থ বৃদ্ধও সৈন্যদের সামনে আমাকে কষিয়ে গালি-গালাজ করে। সৈন্যরাও গালি দিতে দিতে সক্তি প্যারেডের মাঠে ফিরে যায়। এভাবে বৃদ্ধের পেটের ব্যথা আমার জন্য আবে হায়াত হয়ে দাঁড়ায়। আমি রক্ষা পেয়ে যাই।
ক্রেক ডাউন প্রতিরোধ ব্যবস্থা
ক্রেক ডাউনের এলাকার মুজাহিদরা এক গোপন মিটিংয়ে মিলিত হয়ে এ এলাকা দিয়ে আপাততঃ সৈন্যদের উপর কোন আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় । আমি প্রস্তাব দিলাম, যদি এখান থেকে আক্রমণ নাও করা হয়, তবুও পাহারার ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে সৈন্যরা যখন তখন ঘরে ঘরে তল্লাশী নিয়ে মুজাহিদদের গ্রেফতার করার সুযোগ না পায়।
আমার প্রস্তাব সকলে মেনে নিয়ে আমার উপরই এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করে। আমি প্রত্যেক গ্রুপ থেকে দশজন করে মুজাহিদ নিয়ে সকল রাস্তার মুখে পাহারার ব্যবস্থা করি। প্রত্যেক গ্রুপের পাহারার স্থান ও সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। এক গ্রুপের পর অপর গ্রুপ পালাক্রমে পাহারার দায়িত্ব পালন করে।
এভাবে এ এলাকায় এই প্রথম পাহারার নিয়ম চালু হয়। এর ফলে সৈন্যরা এখানে প্রবেশ করতে ভয় পায়। তারা প্রবেশ করার চেষ্টা করলেই মুজাহিদরা গুলী ছুড়ে। সৈন্যরা গুলীর শব্দ পেলেই এলাকা ত্যাগ করে চলে যায়।
এর কিছুদিন পর আমার ট্রেনিং সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজন হলে অন্য এক সহযোগীকে পাহারার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করে শ্রীনগর থেকে চলে আসি।
সক্তি প্যারেড থেকে নিরাপদে ফিরে এলাম
আমাদের নিজস্ব তৈরী আমার রিমোট কন্ট্রোলে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিলে তা ঠিক করার জন্যে শহরের এক মেকারের কাছে গেলাম। আমাদের নিজ হাতে তৈরী রিমোট কন্ট্রোল মেকারের বুঝে আসছিল না। তাকে বুঝাতে বুঝাতে রাত এগারোটা বেজে যায়। ঐ দিন এক গ্রুপ মুজাহিদ শহরের এক মিলিটারী পপাস্টের উপর আক্রমণ করে। যার প্রতিশোধ নিতে সৈন্যরা ঐ রাতেই ক্রেক ডাউন ঘোষণা করে।
যে স্থান দিয়ে মুজাহিদরা আক্রমণ করে, তার নিকটেই একটি বসতবাড়ি ছিল। সে বাড়ীর এক যুবক ছেলে দিল্লীতে ব্যবসা করত। ঘটনাক্রমে সে ঐ দিনই দিল্লী থেকে বাড়ীতে এসেছে। সৈন্যরা তার ঘরে গিয়ে দরজার কড়া নাড়ে। কোন প্রতিবেশী দেখা করতে এসেছে ভেবে বড় ভাই উঠে দরজা খুলে দেয়। আর সাথে সাথে ক্রদ্ধ সৈন্যরা তার উর ব্রাশ ফায়ার চালায়।
ছোট ভাই গুলীর শব্দ শুনে দৌড়ে আসে। এসে বড় ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহের উপর লুটিয়ে পড়ে। নিহত ভাইয়ের জন্যে চোখের অশ্রু ঝরাবার পূর্বেই আরেকটি ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শোনা যায়। এক ভাইয়ে বুকে আর এক ভাই পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। হিংস্র হায়েনারা হাসি-আনন্দে ভরপুর একটি সংসারের সবকিছুই লুটে নেয়ার পরেও ওদের তৃপ্তি নেই। প্রতিহিংসা নিবৃত্ত করার জন্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক নিরীহ বৃদ্ধকে গুলীর নিশানা বানায়। আরও সামনে অগ্রসর হয়ে দেখে, এক মহিলা সন্তান কোলে নিয়ে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে কিনারা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রক্ত পিপাসু প্রতিশোধপরায়ণ ড্রাইভার খামোখা জীপটাকে সড়কের পাশ দিয়ে চালিয়ে শিশু সন্তানসহ মহিলাকে পিষে ফেলে যায়।
আফসোস! এ হতভাগ্যদের সাহায্য করার জন্যে আল্লাহর সৈন্যরা কি এগিয়ে আসবে না? এই পৌত্তলিক মূর্তিপূজারী হিংস্র দানবদের সমুচিত জবাব দিতে বীর মুজাহিদ কি এখনো জাগবে না?
পরিস্থিতি অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করায় সে রাতে আর রাস্তায় বের হলাম না। ভোরে সৈন্যদের নির্দেশ মত সকলের সাথে এক মাঠে জমা হয়ে
সনাক্তি প্যারেডের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
একে একে এবার আমার পালা। কাশ্মিরীদের জন্যে দেয়া একটি পরিচয়পত্র আমার কাছে ছিল। তা দেখিয়ে প্রাথমিক বিপদ দূর করলাম। এবার গুপ্তচরের সামনে দিয়ে যেতে হবে। একটি গাড়ীর মধ্যে গুপ্তচর মুখ ঢেকে বসে আছে। তার চোখ দুটি টর্চলাইটের মত জ্বলজ্বল করছে। কারো উপর সন্দেহ হলেই হর্ণ টিপে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমান সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হবার ব্যাপারে আমার তিল মাত্র সন্দেহ ছিল না। নিজেকে বাঁচাবার কোন উপায়ই খুঁজে পেলাম না। হাঁটার শক্তিও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সর্ব শরীর থর থর করে কাঁপছিল। পা ঠিক রাখতে পারছিলাম না।
কোনক্রমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গাড়ীর পাশে এসে দাঁড়ালাম। এবার আমি গুপ্তচরকে এবং গুপ্তচর আমাকে দেখতে থাকে। ভাগ্যের ফয়সালা দ্রুত আপন মঞ্জিলে অগ্রসর হচ্ছে। গুপ্তচর ডানে-বাঁয়ে চোখ বুলিয়ে দেখল, আশেপাশে সৈন্যরা দাঁড়ানো আছে কিনা। এর পর আস্তে করে বলল, “আমজাদ, তুমি সামনে চলে যাও।’
আমার শরীর থেকে ঘাম ছুটে যায়। শরীরের রংও দ্রুত পরিবর্তন হতে লাগল। পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। হায়! গুপ্তচর আমাকে চিনে ফেলেছে। এখনই আমি গ্রেফতার হব। এক পা তুলে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে অন্য পা অসাড় হয়ে যায়। কি যে করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এক কদম দু কদম চলার পর আবার থেমে যায়। মনে হল যেন জমীনে আমার পা গেঁথে গেছে। আমি ভাবছিলাম, সে আমাকে নিশ্চিত চিনে ফেলেছে। কিন্তু না, হর্ণ বাজল না। কোন সৈনিকও আমাকে ধরতে আসল না। আল্লাহর রহমতে আমি নিরাপদে বেরিয়ে আসলাম।
পরে এক বিস্ময়কর ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয় এক মুজাহিদকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, “ওই গুপ্তচরটি আমাদের মহল্লারই ছেলে। ভারতীয় সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে ছ’ মাস ইন্টারোগেশন সেন্টারে রেখে চরম নির্যাতন চালিয়েছে। তারপর রেহাই দিয়ে ওদের জবরদস্তি গুপ্তচর বানিয়েছে। আজ পর্যন্ত কোন মুজাহিদকে সে ধরিয়ে দেয়নি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন