৪. কমাণ্ডার শের খান
খুনরাঙা পথ
[কমাণ্ডার শের খান আযাদ কাশ্মীরের একজন বীর মুজাহিদ। স্বজাতির আযাদী অর্জনের লক্ষ্যে কাশ্মীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেনাক্যাম্পে সফল আক্রমণ চালিয়ে ভারতীয় সেনাদের মনে তিনি ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে কাশ্মির জিহাদের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি পাকিস্তান থেকে পুনরায় সদলবলে কাশ্মীরে পৌছেন। দীর্ঘ আট মাস কাশ্মীরে অবস্থান করে তিনি বিভিন্ন সেনাঘাঁটিতে আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করেন। তাঁর নিজের বিবরণীতেই তা চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। তার বর্ণনাই হুবহু এখানে তুলে ধরা হয়েছে।]
বিপদসংকুল পথে যাত্রা শুরু
সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ এর এক আঁধার রাতে আনন্দ-বিহ্বল চিত্তে জিহাদের উদ্দেশ্যে আমরা কাশ্মীর রওনা হই। এ বরকতময় কাজের জন্যে আমাদেরকে মনোনীত করা ছিল আল্লাহর অপর করুণা ও অনুগ্রহ। আমাদের দলে আমরা ২৮ জন মুজাহিদ। অধিকৃত কাশ্মীর রওনা হবার আগে আমাকে মুজাহিদদের আমীর নিযুক্ত করা হয়। নায়েবে আমীর আরশাদ ভাই সফর শুরু হওয়া মাত্র অসুস্থ হয়ে পড়েন। আরেক উদ্যমী সাথী আমের ভাইও অসুস্থ হয়ে যান।
এভাবে সফর শুরু হওয়ার সাথে সাথে আমাদের জিহাদের পথে সমস্যার সূত্রপাত হয়। আমি আমার অসুস্থ সংগীদ্বয়কে সাহস দিতে থাকি। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের রুগ্ন দেহ নিস্তেজ হয়ে আসে। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তাদের পা একেবারে নিশ্চল হয়ে যায়। আমরা যাত্রা মুলতবী করে সেখানে থেমে যাই।
কিন্তু গাইডরা পরামর্শ দিল যে, এদেরকে এখানে রেখে যাত্রা অব্যাহত রাখা হোক। কারণ, সবেমাত্র সফর শুরু। প্রথমেই যখন এরা অসুস্থ হয়ে পড়ল, তো পরের অবস্থা কী হবে! সামনে আমাদের অতিক্রম করতে হবে আকাশচুম্বী সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, সীমাহীন দুর্গম পথ।
কিন্তু তাদের এ পরামর্শ আমার মনঃপূত হল না। আমি বললাম, এখানে যদি আমাদের আট রাতও অপেক্ষা করতে হয়, তা-ও করব, তবুও সাথীদেরকে ফেলে যাব না।
তারপর আমি অসুস্থ সাথীদের রাইফেল ও সরঞ্জামাদির কিছু নিজে তুলে নেই আর অবশিষ্টগুলো অন্য সাথীদের মধ্যে পালাক্রমে বহন করার দায়িত্ব দিয়ে ধীরে ধীরে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে শুরু করি।
মাল-পত্র পিঠে করে দুর্গম গিরি অতিক্রম করার অনুশীলন আগে থেকেই আমার ছিল। কিন্তু ২৫/৩০ কিলোঃ ওজনের সরঞ্জাম কারো পক্ষেই কম নয়। তদুপরি ঘোর অন্ধকার, পদে পদে বিপদের শংকা আর পাথুরে চড়াই তো আছেই। অতি মন্থর গতিতে রাতের শেষ প্রহরে আমরা এক জঙ্গলে গিয়ে উপনীত হলাম। এখানে সাথীদেরকে ঘুম পাড়িয়ে আমি আকবর ভাইয়ের সাথে পাহারাদারীতে নিয়োজিত হলাম।
প্রত্যুষে সাথীদের ঘুম থেকে জাগ্রত হবার পর আমাদেরও কিছু সময় বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু গাইডরা জানাল যে, এ অঞ্চলে বেশীক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়। এক্ষুণি আমাদের সম্মুখপানে রওনা হওয়া উচিত। অগত্যা বিশ্রাম না করেই আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। দুপুর পর্যন্ত আমাদের এ চলা অব্যাহত থাকে। আমের ও আরশাদ ভাইয়ের অসুস্থতার কারণে সফর খুব ধীর গতিতে হচ্ছিল। দুপুরের সময় একস্থানে যাত্রা বিরতি দিয়ে আহার ও নামায আদায় করার সিদ্ধান্ত হল।
প্রত্যেকে নিজ নিজ পুটুলি থেকে একটি করে রুটি বের করে আহার পর্ব শেষ করলাম। এ ধরনের সফরে বেশী খাওয়া শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে, তাই আমরা মাত্র কয়েক লোকমা করে খেয়ে নিলাম। আরশাদ ভাই কিছুই না খেতে চাওয়ায় সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। বিলকুল না খেয়ে তিনি বাচবেন কী করে,
এমন কঠিন পথ অতিক্রমই বা করবেন কেমনে?
আমরা সকলে মিলে তার সুস্থতার জন্যে দুআ করি। আরশাদ ভাইয়ের শরীর দুর্বল হলেও তার মনোবল কোন অংশেই কম ছিল না। তিনি বললেন, ‘আপনারা আমার জন্যে চিন্তা করবেন না। আল্লাহর রাস্তায় বের হয়েছি। তিনি অবশ্যই আমাদেরকে সাহায্য করবেন।’ যোহর নামাযের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে সাথীদের সংগে পরামর্শ করে আমি জানিয়ে দিলাম যে, অসুস্থ ও দুর্বল সাথীদেরকে কোনক্রমেই আমরা পথে রেখে যাব না। পেছনে ফিরে যাওয়া এখন আর তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ঘোষণা শুনে সকল সাথী পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলল যে, “ঠিক আছে, প্রাণ দিতে হয় দেব, তবুও সাথীদেরকে নিঃসঙ্গ ও নিরুপায় অবস্থায় ফেলে যাব না।’
আবার যাত্রার পালা। কিন্তু আরশাদ ভাইয়ের স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি হল না। হাঁটার শক্তি তার নেই। অবিরাম বমি হচ্ছে, গায়ে জ্বর। কিন্তু তাঁর মনোেবল দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। অন্যদেরকে, বিশেষ করে আমের ভাইকে তিনি সাহস দিচ্ছেন। অগত্যা তাঁকে নিয়ে ধীরপদে আমরা রওনা হলাম।।
আরশাদ ভাই পথে কোথাও বেশী অসুস্থ বোধ করলে, তার শরীর মনের কামনার সাথে সায় না দিলে অত্যন্ত ব্যাথিত হৃদয়ে তিনি বলতেন, “আমাদের দু’জনের জন্যে আপনারা ২৮ জন মুজাহিদ নিজেদেরকে বিপদে ফেলবেন না। আমাকে আর আমের ভাইকে রেখে আপনারা এগিয়ে যান।
কিন্তু কেউই তাঁর এ কথার সাথে একমত হল না। সাথীদের এমন নিষ্ঠা ও হৃদ্যতা দেখে আমি আনন্দিত হলাম। বিশেষ করে আরফাক ভাইয়ের উপস্থিতিটা ছিল আমার মনোবল ও সাহসিকতার বিরাট এক পুঁজি। বারবার তিনি বলছেন যে, দেখুন, কোথাও কোন সাথী ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি যেন রাইফেলটা আমার কাছে দিয়ে দেন।
মাগরিবের নামায জামাতের সাথে আদায় করা হল। সামনে রাতের কঠিন সফরের পালা। তাই আমরা অনুনয়-বিনয় ও কাকুতি-মিনতি করে মহান আল্লাহর দরবারে দুআ করলাম। তিনি-ই তো আঁধার রাতে পথ দেখান, বিপদে সাহায্য করেন।
আমাদের যে সাথীর কাছে পিকাগান ছিল, তার নাম ফয়সাল। তারও হাটুতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। তাকে নিয়েও আমাদের আশংকা ছিল যে, পথে কোথাও সে পেছনে থেকে গেলে আমাদের বিপদের সীমা থাকবে না। তাছাড়া অসুস্থ ভাইদের নিয়ে আলাদা পেরেশানী তো আছেই।
মোটকথা, সফরের প্রতিটি মুহূর্ত, পথের প্রতিটি কদম যেন আমাদেরকে এ কথাটি বলে যাচ্ছিল, ‘জীবন কারো প্রিয় হলে এখান থেকেই তুমি কেটে পড়, সম্মুখপানে আর তুমি অগ্রসর হয়ো না।’
কিন্তু জীবনের মায়া আছে কার? এখানে সবাই তো কাঁটায় জড়িয়ে জীবন দিতে এসেছে। আল্লাহর পথের সৈনিকদের আবার জীবনের মায়া! এবার রওনা দেয়ার আগে আমি আমার সবচেয়ে সাহসী সাথী আরফাক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গাইডদেরকে বলে দিলাম যে, তোমরা মুজাহিদদের নিয়ে অগ্রসর হতে থাক। পথে কোথাও থামবে না। কোন সাথী পেছনে থেকে গেলে আমরা তাকে সাথে করে নিয়ে আসব। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা নিলাম, অসুস্থ ভাইদের যদি কাঁধে করেও নিতে হয়, তবে এ কাজও আমি করব না। আরো তিন ঘন্টা কেটে গেল। আরশাদ ও আমের ভাইদের পা আর চলে । আরো তিন সাথী মুদ্দাচ্ছির, রাহীল ও সাইফুল্লাহর অবস্থাও খারাপের দিকে। এরা তিনজন ভাওয়ালপুরের বাসিন্দা, আল্লাহর রাহে জীবন দেয়ার স্পৃহা এদেরকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসেছে।
সমতল মাঠে-ময়দানে চলার মানুষ আকাশচুম্বী পর্বতমালা আর দুর্গম গিরি পথে কতক্ষণ আর কতটুকু চলতে পারে। তাদের রাইফেলগুলো আমি আরফাক ভাইয়ের হাতে সোপর্দ করে নিজে তাদের পোটলা-পাটলি তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষণ আমরা ধীর গতিতে হাঁটতে থাকি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা পাঁচজন নিশ্চল হয়ে বসে পড়ে। আমি তাদেরকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু উত্তরে তারা বলে দেয়, আমাদেরকে আপনি গুলী করে মেরে ফেলুন, তবুও
হাঁটতে বলবেন না।
পথ অচেনা মদদগার
এ কঠিন বিপদের সময় একটি শিয়াল আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এসব বনে বিপুলসংখ্যক শিয়াল ও বানর বাস করে। গহীন অন্ধকারে আমাদের নিকটে আসা শিয়ালটি অন্যদের নিকট অপরিচিত হলেও আমি ব্যাপারটা বুঝে ফেলি। একটা কিছুর আগমন টের পেয়ে সাথীরা পরস্পর কানে কানে বলতে শুরু করে, মনে হয় ভারতীয় সৈন্যরা এসে পড়েছে। তাই এখানে না থেমে নিঃশব্দে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত।’
অজানা শত্রুর ভয় তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি করে। তাদের দেহের শিরা-উপশিরায় যেন শক্তির বান ডাকে। নিশ্চল পা আবার চলতে শুরু করে।
কিছুদূর অগ্রসর হবার পরই আমরা আমাদের অন্যান্য সাথীদের সাথে মিলিত হই। একস্থানে থেমে তারা আমাদের অপেক্ষা করছিল। সেখানে সকলের পরামর্শ ও সম্মতিক্রমে ক্লান্ত ও অসুস্থ মুজাহিদদের কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হল। এ সুযোগ অন্যান্য সাথীরাও শুয়ে পড়ে। আমার বীর সাথী আরফাক ভাই দ্বিতীয়বারের মত আমার সঙ্গে পাহারায় যোগ দেন।
এ অবস্থায় অল্প কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে মাত্র। হঠাৎ এক দিক থেকে ভয়ঙ্কর ও প্রচন্ড একটি শব্দ ভেসে আসে। আমার সাথী আরফাক ভাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমার আশংকা হল, ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের আগমন টের পেয়ে গেল কিনা।
রাইফেলের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে আমি সতর্ক অবস্থায় বসে থাকি। এ ভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। কিন্তু আর কোন আওয়াজ শোনা গেল না। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। ভাবলাম, এটা কোন বন্য প্রাণীর আওয়াজই হবে। ভারতীয় সৈন্যরা এত বীর নয় যে, এ গভীর বনে শোরগোল করতে করতে আসতে সাহস পাবে।
সেপ্টেম্বর মাস। পাহাড়ী অঞ্চলে তখন প্রচন্ড শীত। শিশির পড়ে মাটি আদ্র ও ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ তীব্র শীতের মধ্যেও আমার সাথীরা নিশ্চিন্ত মনে দিব্যি আরামে ঘুমাচ্ছেন। তাদের এ বিশ্রামে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে আমি নিজেও কতক্ষণ ঘুমিয়ে কতক্ষণ জেগে ভোর পর্যন্ত পাহারা দিতে থাকি।
ভোর পাঁচটার সময় আমি সাথীদেরকে নামাজের জন্যে তুলে দেই। কয়েকজন সাথী অলসতা হেতু এপাশ-ওপাশ করতে শুরু করলে আমি কঠোর ভাষায় বললাম, এ কঠিনতর সফর এবং ভয়ানক স্থানে নামায আর দুআই তো আমাদের একমাত্র সম্বল। তাই আর বিলম্ব না করে উঠে ওযু করে নামাযটা আদায় করে নাও।
নামাযের পর আকবর ভাই ও ফয়সাল ভাইয়ের উপর পাহারার দায়িত্ব অর্পণ করে আমি আর আরফাক ভাই শুয়ে পড়ি। শোয়ার পর আমার মনে চিন্তা এল,
পাছে আবার এমন না হয় যে, আমি উদাসীনভাবে ঘুমিয়ে যাব আর শত্রু বাহিনী হঠাৎ এসে হামলা করে বসে।।
তাই সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আমি জেগে গেলাম। অথচ আজ দু’দিন যাবত বিশ্রামের এতটুকু সুযোগও আমার হয়নি। গাইডদের ঘুম থেকে উঠিয়ে আমি তাদেরকে বলে দিলাম, যেন তারা সজাগ দৃষ্টি রাখে। প্রহরীদেরকেও গাইডদের ব্যাপারে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে বলে দিলাম। কারণ, তাদের মধ্যে শত্রু পক্ষের কেউ থাকাটা মোটেও বিচিত্র নয়। তাদের কেউ যেন একাকী কোন দিকে যেতেও না পারে। এরপর নিশ্চিন্ত মনে আবার শুয়ে পড়ি।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হরেক রকমের স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্লে খানা খেলাম, চা পান। করলাম। দীর্ঘ নিদ্রার পর জাগ্রত হয়ে সাথীদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জোহর নামায আদায় করে আবার শুয়ে পড়লাম। ইতিমধ্যে খবর পেলাম, আরশাদ ভাই ও আমের ভাইয়ের অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে।
জিহাদের বরকত
সাথীদের অসুস্থতার খবরে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। কী করব, কিছুই ভেবে পেলাম না । ঔষধ-পত্র যা কিছু আমাদের কাছে ছিল, তা আরো আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে বসে ভাবতে লাগলাম, কী করা যায়।
হঠাৎ মনে পড়ল, আমার থলেতে কিছু ডালিম আছে। ডালিমগুলো বের করে ভেঙ্গে আমি তাদেরকে খেতে দিলাম। দু’জনই ডালিমগুলো পরম আগ্রহের সাথে খেয়ে ফেলে। তাদের মুখমন্ডলে আনন্দের দীপ্তি দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। কিছুটা সুস্থতা অনুভব করার পর তাঁরা গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েন। আল্লাহর ইচ্ছে থাকলে ডালিমের কয়েকটি দানাও ঔষধ হয়ে যায়।
রোগীদের সাথে আমিও পুনরায় শুয়ে পড়ি। ঘুম থেকে উঠে সাথীদেরকে আসরের নামাযের জন্যে উঠিয়ে দেই। জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করে আমরা এ অভিযান সফল করার জন্যে আল্লাহর দরবারে দুআ করি।।
দুআ শেষে পুনরায় সফর শুরু হয়। আমাদের রুগ্ন সাথীদ্বয় এখনো সফরের শক্তি ফিরে পায়নি। এদিকে কাশ্মীর উপত্যকাও আর বেশী দূরে নয়। অত্যন্ত সাহসের সাথে পা টেনে টেনে তারা আমাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করেন।
আমার কাছে তিনটি রাইফেল আর দু’টি পুটুলী। অতিরিক্ত তিনটি রাইফেল ছিল আরফাক ভাইয়ের কাঁধে। নায়েবে আমীর তখন আরফাক ভাই। আমীর ও নায়েবে আমীর ‘দু’জনই কাফেলার একেবারে পেছনে হাঁটছিলাম। যে পরিমাণ সরঞ্জাম আমরা দু’জনে বহন করছিলাম, তা বহন করা চার জনের পক্ষেও কষ্টকর ছিল। এটাও আল্লাহ তাআলার বিশেষ একটি অনুগ্রহ, তিনি তাওফীক না দিলে এত কষ্ট স্বীকার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ সবই ছিল জিহাদের রাহের বিশেষ বরকত।
আমরা যে পথে হাঁটছিলাম, তা এত দুর্গম ছিল যে, রাতের বেলা তাতে শূন্য পদে হাঁটতে পারা আল্লাহর বিশেষ মদদ ছাড়া সম্ভব ছিল না। দুর্গম পথে কাঁধে ভারী বোঝা বহন করে ক্লান্ত ও অবসন্ন পায়ে আমরা হেঁটেই চলছি। কিন্তু কোন দুঃখ নেই, নেই কোন বেদনা। আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে বের হতে পেরেছি, এতেই আমরা ধন্য।
আমরা অবিরাম দীর্ঘ পাঁচঘন্টা চলতে থাকি। রাত তখন তিনটে বাজে। গাইডদেরকে থামিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাশ্মীর পৌছুতে আর কত সময় লাগবে?
তারা জানাল, ‘এখনো আট ঘন্টার সফর বাকী আছে।আমি বললাম, তাই যদি হয়, তাহলে দিবালোকে শত্রুদের ফাঁড়ির সম্মুখে দাঁড়াবার পরিবর্তে এখানে অবস্থান নিয়ে বিশ্রাম নেয়াই উত্তম হবে।
আমি আমার সাথীদেরকে জরুরী উপদেশ প্রদান করলাম যে, আপনারা প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গায় চুপচাপ সময় অতিবাহিত করবেন। একান্ত প্রয়োজনেও কারুর নড়াচড়া করার অনুমতি নেই। আরশাদ ও আমের ভাইয়ের স্বাস্থ্য ও মানসিকতা ভালো না থাকায় তাদের ব্যাপারে আমি খুব ভাবনায় পড়ে গেলাম। কারণ, শত্রবাহিনী আমাদের আগমনের কথা টের পেয়ে গেলে যদি আমাদের পালাতেই হয়, তাহলে অসুস্থ এ দু’ ভাইয়ের উপায় কী হবে। পালাবার মত কোন শক্তিই তো এদের নেই।
নির্দেশ অনুযায়ী সাথীরা সকলে নিজ নিজ স্থানে নিশ্ৰুপ বিশ্রাম করতে থাকে। সকলের মধ্যে পরম নিষ্ঠা ও সৌহার্দের পরম বন্ধন স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল। আরফাক ও আমি অসুস্থ আরশাদ ভাইকে নিজের বাহুর উপর শুইয়ে
নেই আর রাইফেল নিয়ে পাহারার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাই। দু’ঘন্টা পর্যন্ত আমি নীরবে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পাহারা দিতে থাকি। সাথীদের নাক ডাকার আওয়াজ ব্যতীত অন্য কোন সাড়া নেই। এক প্রচন্ড নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চতুর্দিকে।
দু ঘন্টা পর হঠাৎ কয়েকটি কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ভেসে এল আমার কানে। পরক্ষণেই চতুর্দিক থেকে বেশ কিছু টর্চের আলো বিচ্ছুরিত হতে শুরু করে। শত্রু বাহিনীর ক্যাম্প নিকটেই ছিল। এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে, আগে থেকেই আমি তা অনুমান করেছিলাম। কিন্তু তাতে ভয় পেলাম না। তাছাড়া আমি হলাম মুজাহিদ কাফেলার আমীর। আবার পাহারার দায়িত্বও ছিল আমার। এ কারণে, আমানতদারী ও খবরদারীর অনুভূতি আমার অপেক্ষাকৃত বেশীই ছিল।
কোন সাথীকে গভীর নিদ্রা থেকে জাগানো সঙ্গত মনে হল না। মহান আল্লাহর দরবারে অক্ষমতার কথা প্রকাশ করে আমি দু’আ করতে শুরু করলাম, ‘প্রভু হে! তোমার বান্দাদের তুমি নিজেই রক্ষা কর।
হাত তোলার সাথে সাথে মনটা আমার মোমের মত গলে যায়। অশ্রু ঝর ঝর নেত্রে আরজ করলাম, আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে হেফাজত কর, তুমিই আমাদের একমাত্র সহায়, তুমি ছাড়া আমাদের কেউ নেই।’
এভাবে কাকুতি-মিনতির মধ্য দিয়েই আমার রাতের অবসান হল। ফজর নামায আদায় করে আমি সাথীদেরকে সফর পুনরায় শুরু না হওয়া পর্যন্ত ঝোপের মধ্যে নীরবে বসে থাকতে বললাম। এমনকি হাঁচিটা পর্যন্ত সাধ্য মত দমন করে রাখতে বলে দিলাম।
আরফাক ভাইকে পাহারার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলাম। তখনো আমি কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন। এ সময়ে জনৈক সাথী আমাকে আলতোভাবে নাড়া দিয়ে কানে কানে বলল, এখান থেকে অনুমান একশ’ মিটার দূরে ভারতীয় সৈন্যের একটি টহল বাহিনী দেখা যাচ্ছে।
ঈমানের অস্ত্র
এ খবর শুনে সংগে সংগে আমি উঠে গেলাম। দেখতে পেলাম, আমাদের থেকে অল্প দূরেই ওরা ঘোরা-ফেরা করছে। আমাদের দিকে না তাকালেও আমাদেরকে দেখে ফেলেছে হয়ত। আমি সাথীদেরকে পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার আদেশ দিলাম। কিন্তু সাথে সাথে বলেও দিলাম, যে পর্যন্ত মনে না হবে যে, ওরা আমাদের দিকে আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কোন শব্দ করবে না।
সকল সাথীকে আমি সূরা ইয়াসীন পড়ে শত্রুদের দিকে ফু দেয়ার পরামর্শ দেই। শুধু জাগতিক অস্ত্রই নয়, আত্মিক অস্ত্রও মুমিনের বিরাট সম্বল। এ আমলটি আমরা কয়েকবারই পালন করি।
এত নিকটে থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের উপস্থিতি টের পেল না এবং একটু পরেই তারা তাদের ক্যাম্পের দিকে চলে যায়। শংকামুক্ত হয়ে আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।
আমরা যে ক’জন সাথী জাগ্রত ছিলাম, কেবল সে ক’জনই যোহরের নামাযটা আদায় করে ফেলি। আর অবশিষ্ট যারা অনতিদূরে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, সতর্কতার খাতিরে তাদেরকে আর জাগানো হল না। এভাবে আসরের সময়ও আমরা তাদেরকে জাগালাম না। [জিহাদের ময়দানে নামায মাফ হয় না ঠিক, কিন্তু প্রয়োজনে বিলম্ব করার অনুমতি আছে।]
মাগরিবের নামাযের পর ক্রোলিং করতে করতে আমি প্রথমে গাইডদের নিকট পৌছৈ সফরের জন্য প্রস্তুতির নির্দেশ দিলাম। তারপর সাথীদেরকে এক এক জন করে জাগিয়ে তাদেরকেও প্রস্তুত হওয়ার আদেশ দেই। ঘুম থেকে জেগে হাত-মুখ ধুয়ে তারা হালকা কিছু খাবার খেয়ে নেয়। কারণ সামনে আমাদের অপেক্ষা করছে ধৈর্য যাচাইকারী দীর্ঘ সফর।
আল্লাহর যিকির করতে করতে আমাদের অপেক্ষার ক্ষণটির এক সময়ে অবসান ঘটে। রাতের নিশ্চিদ্র গভীর আঁধারে আমাদের সফর পুনরায় শুরু হল। পা টিপে টিপে অতি সতর্কতার সাথে আমরা সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকি।
কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর আমরা এমন একটি স্থানে উপনীত হলাম, যেখান থেকে আমাদের উর্ধ্বে আরোহণ করতে হবে। কিন্তু উপরে উঠার পথটি এতই দুর্গম যে, উঠতে গিয়ে আমাদের অসুস্থ সাথী দু’জন আমের ও সাইফুল্লাহ ভাই নীচে পড়ে যায়।
এখন নীচে গিয়ে তাদেরকে তুলে আনতে হবে। কিন্তু কিভাবে? একে তো সাথে আমার বহন ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশী ভারী বোঝা। তাছাড়া নামার জন্যে এসব রাখব কোথায়? নীচে নামবই বা কী করে? ওদেরকে নিয়ে আবার উপরে ওঠার উপায়ই বা কী?
অবর্ণনীয় এক সমস্যায় পড়ে গেলাম। কিন্তু কুদরত আমাদের সহায়তা করে। এ গহীন জঙ্গলে পরিত্যক্ত লম্বা একটি কাঠ আমাদের কাজে আসে। কাঠটি নীচের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে পালাক্রমে উভয় সাথীকে উপরে তুলে আনি।
পথে এক স্থানে পানির একটি নালা পাওয়া গেল। আমরা সকলেই পিপাসায় কাতর ছিলাম। কিন্তু আমি কঠোরভাবে সকলকে সতর্ক করে দিলাম, যেন কেউই এখান থেকে পানি পান করার চেষ্টা না করে। পানি পান করলে সামনে অগ্রসর হওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।
অধিকাংশ সাথী আমার নিষেধাজ্ঞা পালন করে। কিন্তু কয়েকজন পিপাসার তীব্রতা বরদাস্ত করতে না পেরে আমার নিষেধের আগেই পানি পান করে ফেলে। অল্পক্ষণ হাঁটার পর তারা একেবারেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে আমাদের সফরের গতি আরেকবারের মত মন্থর হয়ে যায়।
কিন্তু তারপরও আরশাদ ভাই ছাড়া সকল মুজাহিদ যাত্রা অব্যাহত রাখে । অসুস্থ আরশাদ ভাই এক স্থানে মাটিতে পড়ে যান। এবার উঠে দাঁড়ানোও তার পক্ষে মুশকিল হয়ে পড়ে। অগত্যা আরশাদ ভাইকে কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করি।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমি ক্লান্ত হয়ে গেলে আরশাদ ভাই বলল, ভাই! আমাকে নামিয়ে দিন, চেষ্টা করে দেখি, নিজেই হাঁটতে পারি কিনা।’
আমি কাঁধ থেকে তাকে নীচে নামিয়ে দিলাম। তিনি ক্লান্ত দেহে পা টেনে টেনে কোন রকমে হাঁটতে শুরু করেন।
আকাশ থেকে নেমে এল ঘুটঘুটে কালো আঁধার
সামান্য অগ্রসর হওয়ার পরে বন ও ঝোপ-ঝাড়ের বিস্তৃতি শেষ হয়ে যায় । জঙ্গল পার হয়ে আমরা একটি ময়দানে এসে উপনীত হলাম। চাঁদনী রাত,
ঝলমল করছে চাদের নির্মল আলো। এতটুকু ছায়াও নেই কোথাও। চাদের আলোয় আমাদের চলা-ফেরা, গতিবিধি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল বহু দূর থেকে।
কয়েক পা চলার পরে আমরা এক স্থানে এসে থমকে দাঁড়ালাম। কারণ, আমাদের একেবারে সামনে ভারতীয় আর্মির একটি পোস্ট। তার পাহারায় নিয়োজিত লোকদেরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি সাথীদেরকে বললাম, আমরা যখন তাদেরকে দেখতে পাচ্ছি, তো একথা স্পষ্ট যে, তারাও আমাদেরকে দেখে থাকবে, তোমরা বসে পড়।
আমাদের সামনে ছিল একটি সড়ক, যা পার হয়ে আমরা অনায়াসে কাশ্মীর ঢুকে যেতে পারতাম। কিন্তু বাধ সাধল আর্মি পোস্টটি। আমার ধারণা মতে তারা। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। তাই আরও একবার আমরা অনুনয়-বিনয় করে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলাম, প্রভু হে! আমাদের সহায় হও। আমাদের জন্যে একটু আঁধারের ব্যবস্থা কর, যাতে দুশমন আমাদেরকে দেখতে না পায়। আমরা যেন সড়ক পার হয়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারি। আল্লাহ। আমাদের আবেদন কবুল করলেন। মুহূর্তে আকাশ জুড়ে ভেসে ওঠে ঘোর কালো মেঘ। চাদের আলো ম্লান হয়ে নেমে আসে আমাদের কাংখিত অন্ধকার। এখন আর পথ-ঘাট কিছুই দেখা যায় না।
আমি সাথীদেরকে ডেকে বললাম, শীঘ্র উঠে এস। আল্লাহর সাহায্য এসে পড়েছে। আর দেরি নয়, ছুটে চল।।
কাল বিলম্ব না করে আমরা দ্রুত রওনা হয়ে নিরাপদে সড়ক পার হলাম। এখন আমাদের আলোর প্রয়োজন। সাথে সাথে কালো মেঘ দূরীভূত হয়ে আকাশে ভেসে ওঠে সেই উজ্জ্বল চাঁদ। অন্ধকার দূর হয়ে ঝলমল করে ওঠে পরিবেশ। আমরা ধীর পদক্ষেপে সম্মুখপানে এগিয়ে চলছি। একটু অগ্রসর হওয়ার পরে কয়েকটি ঘর চোখে পড়ল। তা ভারতীয় পোস্ট বলেই মনে হল। কারণ, এখানে জনবসতি থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
আমরা আরেকবারের মত সমস্যায় পড়ে গেলাম। পিছনে সরে যাওয়া তখন আর সম্ভব ছিল না। আরশাদ ভাইকে এক স্থানে বসিয়ে রেখে বললাম, আমি ওই ঘরটির কাছে গিয়ে দেখি, যদি তা দুশমনের পোস্ট হয়, তাহলে নির্ঘাত আমার উপর ফায়ার করা হবে। তাই যদি হয়, তাহলে আমি যতক্ষণ সম্ভব মোকাবেলা করব। কিন্তু আপনি আমার কাছে না এসে এ নালা বেয়ে সোজা এগিয়ে যাব । বেঁচে থাকলে আমিও আপনার সঙ্গে মিলিত হব। তারপর পা টিপে টিপে অগ্রসর হয়ে ঘরটির নিকটে পৌঁছে কয়েকটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। অতি সন্তর্পণে আমি ঘোড়াগুলোর একেবারে কাছে। পৌছে যাই। ঘরে তখন আলো জ্বলছিল। মনে মনে ভাবলাম, এ যদি দুশমনের পোস্ট না হয়, তো জনবসতি হবে নিশ্চয়। তা-ই যদি হয়, তাহলে সাথীদের
খানাপিনার জন্যে কিছু খাদ্যদ্রব্য চেয়ে নেব। একথা ভেবে আমি আরও একটু অগ্রসর হলাম।
স্বজনদের মাঝে
রাইফেল তাক করে আমি সতর্ক পদক্ষেপে ঘরটির একেবারে কাছে গিয়ে পৌছলাম। একস্থানে ঘরের দেয়াল কতটুকু ভাঙ্গা ছিল। রাইফেলটি দেয়ালের উপর রেখে আমি ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম, আমাদের এক মুসলিম বোন কুলোয় করে চাল ঝাড়ছে। আমার মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আমি অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে মুসলিম ভাই-বোনদের সাথে মিলিত হয়ে কুশল বিনিময় করলাম। আরশাদ ভাইকে ডাক দিয়ে অন্যান্য সাথীদেরকে নিয়ে এখানে চলে আসার জন্যে বললাম।
আমরা পাকিস্তান থেকে এসেছি জানতে পেরে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে এবং আমাদের আহারাদির ব্যবস্থা করে। তাদের সযত্ন আতিথেয়তায় খাওয়া শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে আবার আমরা সম্মুখপানে রওনা হলাম।
অবিরাম চলতে চলতে ভোর নাগাদ নিরাপদে কাশ্মীর উপত্যকায় উপনীত হই। বরফের ন্যায় ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওজু করে ফজর নামায আদায় শেষে সব সাথী মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে দুআ করলাম।
বহু চড়াই-উত্রাই আর অবর্ণনীয় প্রতিকূলতা ও বিপদাপদ অতিক্রম করে আমরা এখন জিহাদের ময়দানে। এ সফর ছিল আমাদের সৌভাগ্য ও শাহাদাতের সফর। এরূপ সফরের প্রতিটি কদমই সফলতার এক একটি মনযিল।।
বিকেল তিনটা পর্যন্ত আমরা উপত্যকার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থান করি। এখান থেকে মারকাজের সাথে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করার সুযোগ ছিল। ওয়্যারলেস মারফত মারকাজকে জানালাম, আপনাদের কয়েকজন ভাই জিহাদে অংশ নেয়ার জন্যে কাশ্মীর পৌছে গেছে। আদেশ করুন আমাদের কী করতে হবে? অপরদিক থেকে আনন্দভরা কণ্ঠে আমাদেরকে খোশ আমদেদ জানিয়ে বলা হল, আপনারা সামনে অগ্রসর হোন, আমরা আপনাদের সব ব্যবস্থাই করে দিচ্ছি।’আমরা রওনা হয়ে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরে দেখতে পেলাম, বিপুলসংখ্যক মুজাহিদ ভাই আমাদেরকে অভিনন্দন জানানোর উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছে। আমাদের আনন্দ তখন দেখে কে।।
অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদেরকে প্রাথমিক বিশ্রামাগারে পৌছে দেয়া হল। বিশ্রামের সব ব্যবস্থাই সেখানে মওজুদ ছিল। স্থানীয় লোকজন খানা খাওয়ানের পরে আরাম শয্যায় আমাদের শুইয়ে দিয়ে নিজেরা পাহারার জন্যে যথাস্থানে চলে যায়।
সংক্ষিপ্ত বিশ্রামের পর আমরা সকলে সিজদাবনত হয়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। তারপর সাথীদেরকে সেখানে রেখে কেন্দ্রের নির্দেশ
জানার জন্যে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছি। সংক্ষিপ্ত আলাপ-পরিচয়ের পর সুপ্রীম কমাণ্ডার আমাকে অবিলম্বে কাপওয়াড়ার প্রধান কমাণ্ডার তাহের এজাজের সাথে যোগাযোগ করার আদেশ দিয়ে বললেন, “আমাদের সব রকম নির্দেশনা আপনি তার মাধ্যমেই লাভ করতে পারবেন। আপনি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। তিনি যেখানে ভালো মনে কর আপনাকে সেখানেই রাখবেন এবং আপনার কী করতে হবে, তিনিই তা বলে দেবেন।’
বিদায়ের প্রাক্কালে সুপ্রীম কমাণ্ডারকে আমি বললাম, আমরা সঙ্গে করে কিছু সরঞ্জামও এনেছিলাম। আমাদের আবেদন, যদি ভালো মনে কর, তো সে সব আমার দলের মুজাহিদদেরকেই প্রদান করুন, যাতে আমরা দুশমনের উপর অধিক সফল হামলা চালাতে পারি।
কমাণ্ডার আমার দরখাস্ত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন না ঠিক, কিন্তু জেলা শাখার অধীনে কাজ করার এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগঠনের আওতায় থেকে অস্ত্র ও অ্যামুনিশন ব্যবহার করার আদেশ দিয়ে বিদায় দিলেন।
আদেশ শিরোধার্য জানিয়ে আমি সাথীদের কাছে ফিরে আসি। সাথীদেরকে প্রোগ্রাম সম্পর্কে অবহিত করে আমি বললাম, দু’দিন পর আমরা জেলা কমাণ্ডারের কাছে কাপওয়াড়ায় চলে যাব। এখন আপনারা এখানেই আরাম করতে থাকুন। এর মধ্যে আরশাদ ভাইকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে নেয়া দরকার।
তখন আমরা যে গ্রামে ছিলাম, তার অনতিদূরেই ছিল বাণ্ডিপুর এলাকা। সেখানে অভিজ্ঞ ডাক্তার পাওয়া যায়। কিন্তু পায়ে হেঁটে বান্ডিপুর যাওয়া খানিকটা দুষ্কর ছিল। কোন বাহন পাওয়া যায় কি না, ভাবতে ভাবতেই আল্লাহ তারও ব্যবস্থা করে দেন।
আমাদের রওনা হওয়ার খানিক আগে দুই মুজাহিদ ভাই ঘোড়ায় চড়ে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। দু’জনের একজন ছিল কমাণ্ডার তোফায়েল। মুজাহিদদের প্রশিক্ষণের যাবতীয় ব্যবস্থাপনার তিনি জিম্মাদার। কাশ্মীর আগমনের জন্যে তিনি আমাদেরকে মোবারকবাদ জানান। তাঁর ঘোড়ায় চড়েই আমরা বান্ডিপুর গেলাম।
ধৈর্যের পরীক্ষা
বান্ডিপুরের কমাণ্ডার ওমর চাচা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমাদের স্বাগত জানিয়ে তৎক্ষণাৎ আমাদের বিশ্রামের বন্দোবস্ত করেন। তার একটু পরেই তিনি আরশাদ ভাইয়ের চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার নিয়ে আসেন। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ঔষধ-পথ্য প্রদান করেন।
ইতিমধ্যে সেখানকার মুজাহিদ ও স্থানীয় সাধারণ লোকদের মধ্যে আমাদের আগমনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বিপুল সংখ্যক লোক আমাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্যে মিলিত হয়। তাই সে রাতে আর আমাদের প্রত্যাবর্তন সম্ভব হল না।
ওয়্যারলেস মারফত সাথীদেরকে জানিয়ে দিলাম, যেন তারা এ রাতের জন্যে আমাদের অপেক্ষা না করে নিশ্চিন্ত মনে আরাম করে।
স্থানীয় জনসাধারণের সাথে আলাপ শেষ করে আমি বসে আছি। এমন সময়ে ওয়্যারলেস মারফত খবর এল যে, তিনশ’র মত ভারতীয় সৈন্য ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে, সকল মুজাহিদ যেন সতর্ক থাকে।
খবর শুনে আমার শরীরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। ভারতীয় সৈন্যদেরকে উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্যে আমি প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কিন্তু ওমর চাচা আমাকে শান্ত হওয়ার উপদেশ দিয়ে বলল, এখানে তাদের উপর আক্রমণ করা আমাদের জন্যে কল্যাণকর হবে না। তাদের পথ ছেড়ে দেয়াই ভালো।
ওমর চাচার পরামর্শ মত আমরা হামলা করা থেকে বিরত হলাম। ভারতীয় সৈন্যরা অন্যদিকে চলে গেল।
বান্ডিপুর থেকে ক্যাম্পে ফিরে এসে আমরা কমাণ্ডার তাহের এজাজের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের নিকট চারজন মুজাহিদ পাঠিয়ে দেন। তারা আমাদেরকে তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
কমাণ্ডার তাহের এজাজের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমরা যথেষ্ট আনন্দিত হলাম। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে আমাদেরকে বরণ করেন ও সাদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। কিছুক্ষণ খোশ-গল্পের পর আমাদেরকে চারদিনের ছুটি দিয়ে বললেন, ‘এ ক’দিন আপনারা বিশ্রাম করে সফরের ক্লান্তি দূর করে নিন। চারদিন পর আমার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হবে। তখন আমি আপনাকে আপনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেব।
সুপ্রীম কমাণ্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ
কমাণ্ডারের আদেশ মত আমরা আরো চারদিন বিশ্রাম নিলাম। দিনগুলো আমাদের বড়ই আনন্দে কেটেছে। ঘুম, নামায ও খাওয়া-দাওয়ার বাইরে যে অবসর সময়টুকু পেতাম, তা কুরআন তেলাওয়াত ও জেলা কমাণ্ডারের রচিত জ্বালাময়ী জিহাদের তারানা শুনে কাটালাম।
চারদিন পর যথাসময়ে কমাণ্ডার আমাকে বললেন, আপনার ব্যস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। অতি শীঘ্র সুপ্রীম কমাণ্ডারের সঙ্গে আপনাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করছি। তিনি আপনাদেরকে পূর্ণ কর্মসূচী প্রদান করবেন এবং সর্বপ্রকার জরুরী হেদায়াত দান করবেন।
আরো দু’দিন অপেক্ষা করার পর সুপ্রীম কমাণ্ডারের সঙ্গে আমাদের প্রতীক্ষিত সাক্ষাত হয়ে গেল। এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব তিনি, কাশ্মীর রণাঙ্গনের মুজাহিদরা তাকে এক নজর দেখতে পারাকে সৌভাগ্য মনে করে। আমরাও তাঁর দর্শন লাভে ধন্য হলাম।
কুশল বিনিময়ের পর তিনি আমাকে জিহাদের প্রাথমিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বেশ কয়েকটি জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেন। আমার জবাবে আশ্বস্ত হয়ে তিনি বলেন, আপনারা সাথে করে যে সব অস্ত্র ও অ্যামুনিশন নিয়ে এসেছেন, তা আমি আপনাদের হাতেই অর্পণ করলাম। আশা করি, আপনারা দক্ষতার সাথে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাব।’
আমাদের সফলতার জন্য দু’আ করে তিনি আমাদেরকে বিদায় দেন।
তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাথীদের নিকট এসে সুপ্রীম কমাণ্ডারের দেয়া দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের অবহিত করি। তারা সকলেই আনন্দিত হন এবং শীঘ্র একটি জোরদার অপারেশন পরিচালনার জন্যে সকলেই উদগ্রীব হয়ে পড়েন। কিন্তু আমি তাদেরকে বললাম, আমাদের সব কাজই ধৈর্য সহকারে এবং জিহাদের নিয়ম-নীতি ও কৌশল মোতাবেক হতে হবে। বর্তমানে আমাদের হাতে যে অস্ত্র আছে, প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম। তাই পর্যাপ্ত অস্ত্র সংগ্রহ না করে কোন এ্যাকশন নেয়া ঠিক হবে না। এখন সর্বপ্রথম যে কাজটি আমাদের বেশী প্রয়োজন, তা হল নিজেদেরকে জিহাদের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী সংগঠিত করা।
তারা সকলেই আমার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ কর। তারপর আমি আমার বাহিনীকে দু’টি প্লাটুনে বিভক্ত করে এক গ্রুপের কমাণ্ডের দায়িত্ব আমি নিজের হাতে রাখি আর আরশাদ ভাইকে অপর গ্রুপের কমাণ্ডার নিযুক্ত করি।।
প্রথম এ্যাকশন
পর্যাপ্ত অস্ত্র ও অ্যামুনিশন সংগ্রহ করার পর এবার আমাদের ভারতীয়। বাহিনীর সন্ধান নেয়ার পালা। আমার সাথীরা তো অস্থির। স্থানীয় জনগণও তাঁদের বীরত্ব আর ঈমানী জযবার বহিঃপ্রকাশের জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুণছিল। আমরা ক্যাম্প ‘ক’ এর উপর আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করি। (ক্যাম্পের নাম নিরাপত্তার খাতিরে গোপন রাখা হল)
আমি সাথীদের পরিকল্পনার কথা অবহিত করি, কিন্তু এ আক্রমণ কোথায় এবং কখন করব, ইচ্ছে করেই তা গোপন রাখি। তারা আমার পরিকল্পনার কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে উঠে। বারংবার তারা জানতে চাচ্ছিল যে, এ হামলা কখন কোথায় কিভাবে হবে। তারা সকলেই নতুন। অধিকৃত কাশ্মীরের পথ-ঘাট সবই তাদের অচেনা। আমি তাদেরকে শান্ত হবার পরামর্শ দিয়ে বললাম, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনারা নতুন হলেও আমার এ অঞ্চলের পথ-ঘাট সবই জানা। ভারতীয় সৈন্যদের উপর কোথায় কখন কিভাবে সফল হামলা করতে হবে, তার
অভিজ্ঞতা আমার আছে। আপনারা নিশ্চিন্ত মনে নীরবে আমার সাথে আসুন।
সাথীদের নিয়ে আমি রওনা হলাম। পথে দু’ মুজাহিদ সাথীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। তাদের একজন হল, ফয়সালাবাদের সাকেব ভাট, অপরজন মেরী অঞ্চলের ফরহাতুল্লাহ ভাই । তারাও আমাদের সঙ্গে অভিযানে যোগ দেয়ার জন্যে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিল।
অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তারা বলল, রাইফেল ও এ্যামুনিশনের অভাবে আমরা দীর্ঘ আট মাস পর্যন্ত নির্জীবের মত বসে আছি।
আরও একটু অগ্রসর হবার পরে দেখা হল অধিকৃত কাশ্মীরের আরও কিছু মুজাহিদের সঙ্গে। তারাও আমাদের সঙ্গে এ্যাকশনে যোগ দেয়ার জন্যে অপেক্ষমান ছিল। তাদের অভিযোেগ হল, অস্ত্র না থাকায় একটানা এক বছর পর্যন্ত তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে।
তাদের কয়েকজনকে পথ প্রদর্শনের জন্যে আমরা সঙ্গে নিয়ে নিলাম। পথে কয়েকজন মুসলিম বোন আমাদের অভ্যর্থনা জানায় এবং দু’আ করে বিদায় দেয়।
আমরা বিশেষভাবে একটি বিষয় অনুভব করলাম যে, কাশ্মীর ভূখন্ডে মুজাহিদের অভাব নেই। অভাব শুধু অস্ত্র এবং যুদ্ধ সরঞ্জামের। অস্ত্র হলে আমাদের মা-বোনরাও ভারতের কাপুরুষ সৈন্যদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারত।
আমরা ভারতীয় সৈন্যদের ক্যাম্পের কাছে পৌছুলে মুজাহিদরা শিকার দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কৌশল অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিক থেকে আমরা তাদেরকে ঘিরে ফেলি। পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি প্রথমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি, যাতে পরিকল্পনায় কোন প্রকার ত্রুটি না থাকে।
সকল সাথীকে তিনটি দলে বিভক্ত করে আক্রমণের জন্যে উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করে দেই। আগে থেকেই আমার জানা ছিল যে, সন্ধ্যা সাতটায় ভারতীয় সৈন্যদের ক্যাম্পে হাজিরা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাই এ্যাকশনের জন্যে আমি এ সময়কেই বেছে নিলাম।
সিন্ধান্ত নেয়া হল, এক এক স্থানে এক এক রকম অস্ত্র তাক করা হবে। হ্যান্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ ও লাঞ্চার ব্যবহারের দায়িত্ব নিজের হাতে রাখি । একজন সাথীকে রকেট নিক্ষেপ করার দায়িত্ব দেয়া হল। তৃতীয় গ্রুপ, অর্থাৎকোরিং পার্টিকে নির্দেশ দেয়া হল যে, আক্রমণকারী গ্রুপ আক্রমণ করার পরে পিছপা হতে শুরু করলে তারা যেন অবিরাম ফায়ার করে তাদেরকে নিরাপদে সরে আসতে সহায়তা করে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার সময় সাথীদেরকে নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ক্যাম্পের নিকটতম পয়েন্টের কাছে পৌছাই। ক্যাম্প থেকে এক’শ গজ ব্যবধানে অবস্থান নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে ওয়্যারলেস সেট অন করলাম। অপর দিক থেকে হ্যালো হ্যালো আওয়াজ ভেসে আসে।
পুনরায় সাথীদেরকে অপারেশনের নিয়ম সম্পর্কে অবহিত করি। বললাম; সর্বপ্রথম ব্ৰকেট ফায়ার হবে, কিন্তু আমি যখন, আদেশ করব ঠিক তখন। তারপর আমি. গ্রেনেড নিক্ষেপ করব। এরপর চতুর্দিক থেকে মুজাহিদরা গুলী ছুড়তে শুরু করবে। কোন প্রকার অস্থিরতা দেখানো যাবে না।
অত্যন্ত ধির স্থির দৃঢতার সাথে ঘড়ির কাটা যখন সাতটা ছুঁই ছুঁই করছিল, ঠিক তখন আমি আমার রকেটবাহক সাথীকে ইংগিতে ফায়ার করার আদেশ দিলাম। রকেটলাঞ্চারের ট্রিগারে আঙ্গুল রাখার সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড এক বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে গোটা ক্যাম্প। দেখলাম, নিক্ষেপিত রকেট সোজা সে ব্যারাকের ছাদের উপর গিয়ে আঘাত হানে, যাকে আমরা টার্গেট বানাতে চেয়েছিলাম।
এ রকেট ভারতীয় সৈন্যদের ক্যাম্পে কতটুকু ধ্বংস সাধন করেছিল এবং তার পরে আমাদের গুলীবৃষ্টি ও গ্রেনেডসমূহ কিরূপ প্রলয় সৃষ্টি করেছিল, তার বিবরণ একটু পরে আসছে। তার আগে যে সামরিক ক্যাম্পটিকে আমরা আক্রমণের টার্গেট বানিয়েছিলাম, তার কিঞ্চিত পরিচয় এবং এ এ্যাকশনের কৌশল সম্পর্কে কয়েকটি সূক্ষ্ম তত্ত্ব আলোকপাত করব।
এ ক্যাম্পের নাম হল ওটলব। অত্র এলাকার নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। বান্ডিপুরে এর অবস্থান। ১৫ পাঞ্জাব, ১৬ পাঞ্জাব এবং গুর্খা রেজিমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্যাম্প এ অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে অবস্থানকারী ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা পাঁচ হাজারের মত। চতুর্দিকের জনবসতিগুলোতে তারা রীতিমত আতংক সৃষ্টি করে রেখেছিল। সাধারণ জনগণের উপর নির্যাতন ছাড়া মুজাহিদদের জন্যেও এ ক্যাম্পটির অস্তিত্ব আলাদা এক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ভারতীয় বাহিনীর এত দুঃসাহসের এও একটি কারণ ছিল যে, এ ক্যাম্পের উপর বিগত দু’বছর পর্যন্ত মুজাহিদরা কোন আক্রমণ করতে পারেনি। কারণ, ক্যাম্পটি ছিল অপেক্ষাকৃত গভীরে, অত্যন্ত নিরাপদ স্থানে। উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিক জলাশয়ে ঘেরা। পশ্চিম দিকে অবস্থিত টিলাসমূহের একেবারে চূড়ায় উঠে মিসাইল বা রকেট ফায়ার করা ব্যতীত তার উপর হামলা করার দ্বিতীয় কোন উপায় ছিল না।
কিন্তু এ পদ্ধতিতে আক্রমণ করতে গেলে আক্রমণকারীরা গোটা ক্যাম্পের ফায়ারিং এর আওতায় পড়ে যাওয়া ছিল এক রকম নিশ্চিত। হামলা করে পালাবার উপযুক্ত কোন পথ ছিল না। এমন কোন আশ্রয়স্থল ছিল না, এ্যাকশন নেবার পর যেখানে আত্মরক্ষার্থে গা ঢাকা দেয়া যেত। আমরা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।
আমার সঙ্গে মাত্র বারজন সাথী ছিল। ৯ অক্টোবর, ১৯৯৪ এর সন্ধ্যার সময়টি আক্রমণের জন্যে নির্বাচন করার আগে ভালোভাবে ভেবে নিয়েছিলাম যে, এ হামলায় আমরা সম্ভাব্য কি কি সমস্যায় পড়তে পারি।
প্রাণের ভয় সব সময় লেগেই থাকে। কিন্তু আল্লাহর পথের সৈনিকরা এ ভীতিকে কমই প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু কমাণ্ডার হিসেবে আমার সব চেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল, সর্বপ্রথম অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বিচক্ষণতার সাথে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নেয়া, যাতে শত্রু পক্ষের অধিক ক্ষতি সাধন করা যায় এবং মুজাহিদদের তেমন কোন ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়।
আমি আমার সাথীদেরকে ‘আক্রমণকারী’ ও ‘প্রতিরক্ষাকারী’ এ দুটি গ্রুপে ভাগ করে নেই। প্রতিরক্ষা গ্রুপে ফয়সালাবাদের সাকেব ভাটও ছিল। তার কাছে একটি ভিডিও ক্যামেরা। অপারেশনের চিত্রগুলো তিনি ক্যামেরাবন্দী করছিল। ক্যাম্পের উপর পরিচালিত হামলার জবাবে ভারতীয় বাহিনীর প্রতিরক্ষা মোর্চা থেকে যে ফায়ার আসবে, তার প্রতিরোধে পাল্টা ফায়ার করা ছিল তার আসল দায়িত্ব।
পশ্চিম দিকের যে পাহাড়ের উপর থেকে হামলা করার জন্যে আমরা পরিকল্পনা নিয়েছিলাম, তার চূড়া থেকে নদীর দূরত্ব সাড়ে ছ’শ ফুটের মত।
সেদিন ক্যাম্পে ঘন্টা বাজানো হচ্ছিল। তা তাদের ধর্মীয় কোন পূজা-অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি বলে মনে হল।
আমরা অনুমান করলাম, সৈন্যরা সবাই তখন কোন একটি ব্যারাকে সমবেত হয়েছে। কিন্তু কোন্ ব্যারাকে, এটা ঠিক করা গেল না। বহু ভেবে-চিন্তে এবং দূরবীন দ্বারা পর্যবেক্ষণ করে আমরা তাও নির্ণয় করতে সক্ষম হই এবং তাকে টার্গেট করে আমরা মিসাইল স্থাপন করি।
এ্যাকশনের জন্যে সাথীরা সকলেই প্রস্তুত। আমি মিসাইলবাহক সাথীকে ইঙ্গিতে ফায়ার করার আদেশ দিলাম। মুহূর্তের মধ্যে মিসাইল লক্ষ্যস্থলে নির্ভুলভাবে আঘাত হানে। ধুয়া, ধূলোবালি ও মানুষের শোরগোল শুনে আমরা নিশ্চিত হলাম যে, এ্যাকশন সফল হয়েছে।
এবার পূর্ব পরিকল্পিত কৌশল অনুযায়ী তিনটি গ্রেনেড ফায়ার করলাম। একটি গ্রেনেড ব্যর্থ হলেও বাকী দু’টো লক্ষ্যস্থলে নিক্ষিপ্ত হয়ে প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হল গোটা ক্যাম্প।
ক্যাম্পের একটু উপরে অবস্থিত প্রতিরক্ষা মোর্চা থেকে আমাদের উপর জবাবী ফায়ারিং ও গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। তারা আমাদের মিসাইল লাঞ্চ করার অবস্থানটি চিহ্নিত করতে পেরেছিল। তাই তাদের নিক্ষিপ্ত গোলা-বারুদগুলো আমাদের ঠিক পায়ের কাছে এসে পড়ে। অপরদিক থেকে টহলরত একটি সেনা দলও পরিস্থিতি টের পেয়ে ফায়ারিং শুরু করে দেয়। কিন্তু তাদের ফায়ারিং অনেকটাই ছিল আত্মরক্ষামূলক। অর্থাৎ তারা কেবল আমাদেরকে একথা অবহিত করার জন্যে গোলাবর্ষণ করছিল যে, আমরা আছি, পালাবার ব্যর্থ চেষ্টা কেউ কর না।
তদুপরি শত্রুদের ক্যাম্প ও প্রতিরক্ষা মোর্চা থেকে আসা জবাবী হামলা ছিল অত্যন্ত জোরদার। এর অল্পক্ষণ পরেই তারা মর্টার গানের গোলাবাজী শুরু করে দেয় এবং শূন্যে ফাঁকা গুলি ছুড়ে গোটা এলাকা দিনের মত আলোকিত করে তোলে।
শত্রু পক্ষের জবাবী হামলার সাথে সাথে আমাদের প্রতিরক্ষা গ্রুপ তাদের কাজ শুরু করে দেয়। তারা ফায়ারিং শুরু করে দিলে আমরা ধীরে ধীরে পিছপা
হতে শুরু করি। আমার সাথী ফরহাতুল্লাহ ভাইয়ের পা একটুখানি মচকে যাওয়ায় তাকে সামনে রেখে আমি আস্তে আস্তে সম্মুখে অগ্রসর হতে শুরু করি।
ফেরার পথে শত্রু পক্ষের গুলীবর্ষণ ছাড়া কাটাতারের মোকাবেলাও করতে হয়েছে। পাঁচ ফুট অন্তর একটি করে কাটাতারের বেড়া আমাদের অতিক্রম করতে হয়েছে। তার কাটার কোন অস্ত্র আমাদের কাছে ছিল না। ফলে এসব বাধা অতিক্রম করে অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে আমাদের অগ্রসর হতে হচ্ছিল।
এদিকে গোলাবর্ষণও চলছিল বিরামহীনভাবে। কিন্তু মহান আল্লাহর বিশেষ
অনুগ্রহে আমার সাথীদের কোনই ক্ষতি হয়নি। পাথর আর কাটাতারের ফলে। আমাদের যতটুকু বিব্রত হতে হয়েছিল, এ-ই যা।।
পরিকল্পনা মোতাবেক আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার কথা ছিল। অবিরাম এক ঘন্টা সাধনার পরে আমরা পাঁচশ’ মিটার পথ অতিক্রম করে তাদের সঙ্গে মিলিত হলাম।
এ সময়ে একটি মজার ঘটনা ঘটে। যে সব ভারতীয় সৈন্য আমাদেরকে লক্ষ্য করে মর্টার ও মেশিনগানের গুলী ছুড়ছিল, আমাদের কোরিং পার্টির জবাবী হামলা ও অবিরাম ফায়ারিংয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে।
আমাদের সাথীরা একটু পর পর পিকাগান দ্বারা তাদের উপর ফায়ারিং করছিল। বোধ হয়, এতেই তারা ভয় পেয়ে যায় যে, এবার তারা যমের হাতে এসে পড়েছে। ফলে তাদের দু’জন সৈন্য মোর্চা থেকে বের হয়ে পালাতে শুরু করে। একজন পালিয়ে নীচের ক্যাম্পের চলে যায় এবং অপরজন, সম্ভবত সে একটু আহত ছিল- উপর দিকে গিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করে।
নীচের থেকে ভারতীয় সৈন্যরা ওকে দেখে মনে করেছিল, ও কোন আহত , মুজাহিদ। আমরাও তাকে নিশানা বানাতে পারতাম। কিন্তু, ভারতীয় সৈন্যরা নিজেরাই গুলী করে তাকে যমের হাতে তুলে দেয়।
আমরা ভারতীয় সৈন্যদের ক্যাম্প থেকে দূরেই চলে গিয়েছিলাম। তবে এখনও বিপদমুক্ত হতে পারিনি। কিন্তু যেভাবে এ যাবত আমরা নিরাপদে পরিস্থিতির মোকাবেলা করে এসেছি এবং শত্রু পক্ষের অসংখ্য গুলীর কবল থেকে রক্ষা পেয়ে এসেছি, তাতে আমাদের মনে এ আসা জাগে যে, আল্লাহ তা’আলা ভবিষ্যতেও আমাদেরকে বিপদে ফেলবেন না।
কিছুক্ষণ পরে আমরা উপর থেকে নীচে নামতে শুরু করলাম। তখন ওটলব ক্যাম্প থেকে আসা গুলীগোলা শূন্য আকাশ আলোকিত করছিল ঠিক, কিন্তু আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ নিরাপদ।
মহান আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করে ওয়ারলেস সেট অন করলাম। কেন্দ্রের সঙ্গেও যোগাযোগ হল। আমাদের অভিযান সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করে বলে দিলাম, দুশমনের চ্যানেল সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে এ অভিযানে তাদের কী পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, তা যেন আমাদেরকে জানানো হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কমাণ্ডারের পক্ষ থেকে সিগন্যাল আসতে শুরু করে। ওয়ারলেস মারফত তারা আমাদেরকে অভিনন্দন জানাচ্ছিল।
দু’বছরের মধ্যে, ওটলব ক্যাম্পের এটাই ছিল প্রথম অথচ পূর্ণাঙ্গ ও সফল হামলা: এরই মধ্যে ওয়ারলেস সেটে শত্রু পক্ষে চ্যানেল শোনারও সুযোগ মিলে গেল । শুনতে পেলাম; ওটলক ক্যাম্পের সৈন্যরা চেঁচামেচি করছে এবং অন্যান্য ক্যাম্পুের কাছে এ বলে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে, সন্ত্রাসীরা আমাদের উপর প্রচন্ড হামলা করেছে। এখন আমর চতুর্দিক থেকে তাদের বেষ্টনীর শিকার। অতি সত্ত্বর আমাদের সাহায্য করুন।
আমরাও এ মজার সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। বললাম, ‘উল্টা-পাল্টা কথা বলছ কেন? আমরা সন্ত্রাসী নই-মুজাহিদ। এ ছছাট্ট শিক্ষাটুকু স্মরণ রেখ। মনে রেখ, পাল্টা কিছু করতে চাইলে তোমাদের তার চরম, মাশুল দিতে হবে।
জবাবে অসহায়ের মত অপর দিক থেকে বলা হল, তোমরা আস তো মরার জন্যে, তা আমাদেরকে মারছ কেন? মারতেই যদি হয় অফিসারদেরকে মার। তোমাদের বিরুদ্ধে যা কিছু করা হচ্ছে, সবতো ওরাই করছে। এ বলে অকথ্য ভাষায় তারা গালাগাল দিতে শুরু করে। আমি সেট অফ করে দিলাম। ২তারপর আনন্দচিত্তে মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে করতে আমরা নিরাপদ অঞ্চলপানে রওনা হই। দু’টি জনপদ অতিক্রম করে তৃতীয় জনপদে প্রবেশ করে কিছুক্ষণের জন্যে যাত্রা বিরতি দিলাম। কিন্তু ভাবলাম, এখানে অবস্থান করাও বিপদের কারণ হতে পারে। ভোর হওয়া মাত্রই শত্রুরা আহত ফনিনীর ন্যায় ফোস ফোস করতে করতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এলাকায়। তাই সিদ্ধান্ত হল, রাতারাতিই আমরা লোলাব:পৌছে যার।..
ভোর বেলা যখন ক্লান্তিতে আমাদের পা আর চলছিল না, ঠিক তখন সংকীর্ণ এক গিরিপথ অতিক্রম করে লোলাব উপত্যকায় অবতরণ করছিলাম। ঠান্ডা পানি দিয়ে ওজু করে ফজর নামায আদায় করায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির সকলেই। কিছু একটু না খেলে আর চলে না।
নাস্তার জন্যে সাথীদেরকে দুটি দলে বিভক্ত করা হল। প্রথমে একদল লোকালয়ে গিয়ে, মুজাহিদ সমর্থক জনগণের মেজবানির সুযোগ গ্রহণ করে। তাদের ফিরে আসার পর গেল দ্বিতীয় স্কুল । আমি ছিলাম দ্বিতীয় দলে। আমরা যাদের মেহমান হলাম, তাদের একান্ত কামনা, আমরা মন ভরে তৃপ্তি সহকারে আহার করি। আমরাও তাদের খুশী করতে ত্রুটি করলাম না । পেট পুরে খেয়ে জঙ্গলে ফিরে এলাম।
তখন সকাল সাতম।এটা:কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সমগ্র কারুকমান্ডারদের হাজিরা দেয়ার সময়। রেড়িও মারফত এ হাজির হয়ে থাকে- নিয়মানুযায়ী কুরআন তেলাওয়াতের পর একটি মুজাহিদ: নিয়ন্ত্রিক রেন্ডিং স্টেশন থেকে মুজাহিদ কমাণ্ডারদের হাজিরা ডাকা শুরু হল।
সাধারণত প্রথমে সিনিয়র কমাণ্ডারদের হাজিরা হয়ে থাকে। কিন্তু আজ হল তার উল্টো। প্রথমে ডাকা হল আমার নাম।
শুরুতে আমার কোড নাম ‘এ আর ‘২ শুনে অবাক হলাম।অভিযানের পুরস্কার স্বরূপ আমাদের মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ। আমাদেরকে জানানো হল যে, শক্রনিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমগুলোর রিপোর্ট অনুয়ায়ী, ওটুর ক্যাম্পের নিহতদের সংখ্যা পঁচিশেরও উর্ধ্বে। আহতের সংখ্যা আরও বেশী ।
কিছুক্ষণ পরে আমাদের জেলা কমাণ্ডার তাহের এজাজ সাহেব, ওয়্যারলেস মারফত আমাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘ওটুলব ক্যাম্পের সফল আক্রমণ আপনাদের বিরাট সাফল্য। আমি আপনাকে হৃদয়ের গভীর থেকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
এ হামলায় আমাদের হাতে বেশীর ভাগ সে সর দুশমনের পতন ঘটেছে, যাদেরকে তারত থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে কাশ্মীরে পাঠানো হয়েছিল। এরা ১৫ পাঞ্জাবের সে সব সৈন্য, যারা পূর্ব পাঞ্জাবের আন্দোলনে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল এবং গ্রেফতার হওয়ার পর বিভিন্ন কারাগারে আটক ছিল। খালিস্তান আন্দোলন দমনের পর তাদেরকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দেয়া হয়।
জেলা কমাণ্ডার তাহের এজাজ একটি গুপ্তস্থানে বিশেষ দাওয়াতে আমাদেরকে আহবান করেন। সাক্ষাতের পর এ অসম সাহসিকতার জন্যে আমাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে । ওটলব ক্যাম্পের প্রভাব অনেকটা হ্রাস পারে নিশ্চয়।
আমার জন্যে এটাও কর্ম মর্যাদার কথা ছিল না যে, আল্লাহ তাআলা এহেন বিপজ্জনক অপারেশনে আমাদেরকে সফলও করলেন এবং আমার কোন সাথীর্কে তাতে কোন প্রকার দৈহিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি।
কোলুগামের সফল অভিযান
ওটুলবের ব্যয় ফোলগামের ক্যাম্পও স্থানীয় জনবসতি এবং মুজাহিদদের জন্যে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়েছিল। লোলারের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে স্বাধীতার শাস্তি দেয়ার জন্যে।
উর্ধ্বতন কমাণ্ডারের পক্ষ থেকে এবার একপিকে টার্গেট বানানোর জন্যে আদেশ দেয়া হল । আমাদের ডিভিশনাল ক্রমার মাজেন্দ্র জাহাঙ্গীর এ অভিযানের জন্ট্রে আমাদেরকে নির্বাচন ক এরং জেলা কমান্ডার তাহের এজীজের মাধ্যমে এসংক্রান্ত নির্দেশনাবলী প্রেরণ কর।
এখানকার শত্রুপক্ষ দূরন্ত চালাক ও ভয়ংকর। ইতিপূর্বে কয়েকবার গুপ্ত হামলা
জেলা কমাণ্ডার এ বিষয়ে আমাকে জরুরী নির্দেশ দিলেন এবং জানালেন যে, চালিয়ে মুজাহিদদের বেশ ক্ষতি সাধন করেছে তারা। আল-বারক’ এর বহু মুজাহিদকে তারা শহীদ করেছে এবং অনেককে বন্দী করেছে। হিজবুল মুজাহিদীনের বেশ কিছু মুজাহিদও তাদের হাতে শহীদ হয়েছে।
এ ক্যাম্পে সাধারণ সৈন্যদের ছাড়া বিপুলসংখ্যক বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সও (বিএসএফ) ছিল। ক্যাম্পের মধ্যে সাধারণ সৈন্য এবং বিএসএফ এর ব্যারাক ছিল আলাদা আলাদা।
আমার উপর দায়িত্ব সোপর্দ করার প্রধান কারণ এ ছিল যে, কাপওয়াড়া, বারামুল্লা ও সোপুর অঞ্চলে কয়েকবছর অবস্থান করার ফলে তথাকার নাড়ি-নক্ষত্র সবই আমার আয়ত্ত হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে কোন কোন অঞ্চলের স্থানীয় মুজাহিদরাও আমার থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করে থাকে।
১৯৯৪ এর ২৭ শে নভেম্বর আমি ক্যাম্পের উপর আক্রমণ করার সিগন্যাল পাই। সুপ্রীম কমাণ্ডার আমাদেরকে যে সরঞ্জাম দান করেছিলেন, আমরা তা একটি নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রেখেছিলাম। ধেরকোটের আকবর ভাইকে মজুদ থেকে কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসার জন্যে স্থানীয় একজন মুজাহিদের সাথে পাঠিয়ে দিলাম।
এ ফাঁকে কোলগাম ক্যাম্প সম্পর্কে আরো অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ পেলাম। ক্যাম্পের পশ্চিমে মদনপুরা নামক একটি গ্রাম। সে গ্রাম অতিক্রম করে আমাদের অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ক্যাম্পের উপরে উত্তর দিকে বিশাল এক গভীর বন। পূর্বে পানির নালা।
আক্রমণ করার আগে আমাদের ভালোভাবে এটা নির্ণয় করা জরুরী ছিল যে, হামলা করার পরে প্রয়োজনে পিছনে সরে আশ্রয় নেয়ার উপযুক্ত স্থান কোনটা। আর এ তথ্যও নেয়া দরকার ছিল যে, ক্যাম্পে পাহারাদানকারী গ্রুপটি কোথায় অবস্থান করে এবং কোথায় কোথায় টহল দেয়।
টহলদার বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে ভালোভাবে তথ্য নিয়ে আমি আমার এ ক্ষুদ্র বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে নিলাম। পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি এ্যাকশন গ্রুপ এবং কোরিং পাটিং তৈরি করলাম। সিদ্ধান্ত হল, একদল আক্রমণের স্থল থেকে আমাদেরকে বের করে আনার কাজে সহায়তা করবে এবং আর একদল গ্রামের রাস্তায় প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকবে, যাতে ফেরার সময় প্রয়োজনে তারা আমাদের সাহায্য করতে পারে এবং বাইরে থেকে কোন । সাহায্যকারী সৈন্য আসতে চাইলে তাদের প্রতিরোধ করে। সাথীদের সবাইকে : নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি সাথীদের থেকে পৃথক হয়ে পড়লাম।
এ অপারেশনে সর্বাপেক্ষা কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল যে, সাথীদের দ্বারা কাজ তো মোল আনাই আদায় করে নেব, আবার সম্পূর্ণ গোপনীয়তাও রক্ষা করতে হবে। কী ভাবে কী হচ্ছে ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ টের না পায়, তার প্রতি সজাগ ও সযত্ন দৃষ্টি রাখতে হবে।
এ কারণে আমরা এক দু’জন সাথী ছাড়া কেউই এ অপারেশনের পরিকল্পনার কিছুই জানত না। সাথীদের জানের নিরাপত্তা এবং অভিযানের সাফল্যের জন্যেই
এমনটি প্রয়োজন ছিল।
এ্যাকশনের আগে সব ব্যবস্থাপনা পরিপূর্ণ হবার পরেও আমাদের একটি কাজ বাকী ছিল। ক্যাম্পের একেবারে কাছে গিয়ে এ তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন ছিল যে, শত্রুবাহিনী এখন ক্যাম্পের কোন্ স্থানে অবস্থান করছে, অর্থাৎ ক্যাম্পের
কোন্ অংশকে আমরা হামলার টার্গেট বানাব, তা নির্ণয় করা।
আমি অন্ধকার হবার অপেক্ষায় রইলাম। শীতের দিন অতি দ্রুত ফুরিয়ে রাত এল। সাতটা পর্যন্ত আমি পার্শ্ববর্তী গ্রামের আশে-পাশে চক্কর দিতে থাকি। তার পরে এক ঘরে থেকে একটি কম্বল এবং একস্থান থেকে শুকনা ঘাসের ছোট্ট কয়েকটি আঁটি তুলে নিলাম। এর মধ্যে রাইফেলটি লুকিয়ে নিয়ে ঘাসের আঁটিগুলো মাথায় করে ভারতীয় ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা দিলাম।
ক্যাম্প থেকে একশ’ গজ দূরে থাকতেই আমি অনুমান করলাম যে, আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত তো ঘাসের বোঝা মাথায় করে ছদ্মবেশে আসা গেছে, কিন্তু এ বেশেও সামনে অগ্রসর হওয়া বিপজ্জনক। যদি ওরা জিজ্ঞেস করে বসে যে, ঘাসের বোঝা মাথায় করে ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছ কেন, তখন উপায় কি হবে!
অগত্যা ঘাস ফেলে দিয়ে টলতে টলতে ক্যাম্পের দেয়ালের ঠিক নিকটে চলে গেলাম এবং এক স্থানে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে নিজেকে অনেকটা লুকিয়ে বসে পড়লাম, যেন আমি প্রশ্রাব করতে বসেছি।
সামনেই কয়েকজন সৈন্য তাদের নির্ধারিত টয়লেটের দিকে আসছিল, আর কয়েকজন ওখান থেকে ফেরত যাচ্ছিল। আমাকে তারা দেখতে পায়, কিন্তু নিরীহ পল্লীবাসী মনে করে কেউ আর ভ্রুক্ষেপ করেনি। তাদের এ উদাসীনতাকে আমি কাজে লাগালাম। গোটা ক্যাম্পটিকেই আমি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম।
ওদিকে আমার সাথীরা গায়ে কম্বল জড়ানো কাউকে ক্যাম্পের দিকে যেতে দেখে ভাবল, হয়ত কোন গুপ্তচর হবে, আমাদের সন্ধান নিয়ে সে ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু ভাগ্যিস! আমার আদেশ পালনার্থে তারা তাদের সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশন নেয়নি। তা না হলে আমাদের পরিকল্পনা সূচনাতেই নিজেদের হাতে ভণ্ডুল হয়ে যেত। আমার বিশ্বাস, এটাও ছিল মহান। আল্লাহর বিশেষ রহমত।
কয়েক মুহূর্তেই আমি দেখে নিলাম যে, ক্যাম্পের ভেতরে দুশমনরা কোন্ কোন্ স্থানে অবস্থান নিয়ে আছে, কোন্ কোন্ ব্যারাকে মিসাইল হামলা করা সফল হবে, শত্রুদের জবাবী এ্যাকশন কোন দিক থেকে আসার সম্ভাবনা আছে। এবং আমাদের আত্মরক্ষার উপযুক্ত পথ কেমন হবে।
পর্যবেক্ষ শেষে-সাথীদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। তারা তখন সন্দেহভাজন গুপ্তচরকে গ্রেফতার করার জনে প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে কিন্তু আমাকে চিনে ফেলার পর তারা হাসিতে ফেটে পড়ে। তাদের এ মহতি পরিকল্পনার কথা শুনে আমিও হাসিরে রাখতে পারলাম না। হালকা রসিকতা বিনিময়ের পরে আমি এ্যাকশনের কার্যক্রম শুরু করে দেই?
আরশাদ ভাইও আমেরু ভাইকে মিসাইল পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে আমি যথারীতি গ্রেনেড লাঞ্চারের দায়িত্ব গ্রহণ করি ; ওয়ারলেস মারফত অবশিষ্ট সাথীদেরকেও জানিয়ে দিলাম যে, তোমরা প্রস্তুত থাক এ্যাকশন যে কোন মুহূর্তে শুরু হয়ে যেতে পারে।
প্রত্যহ রাত সাতটায় ক্যাম্পের কোল ঘেষে একটি যাত্রীবাহী বাস অতিক্রম করে । অপেক্ষা শুধু সে বাসটির। কারণ, এর আগে হামলা পরিচালনা করলে যাত্রীদের সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
যথা সময়ে বাসটি অতিক্রম করল। তার আলোতে আমরা ক্যাম্পের দৃশ্য আরেকবারের মত দেখার সুযোগ পেলাম। দূরবীনের সাহায্যে টার্গেট মত মিসাইল স্থাপন করে আরশাদ ভাইকে বলে দিলাম, যেন সে আমার ইংগিত পাওয়া মাত্র টাচ দিয়ে দেয়।
উল্লেখ্য যে, মিসাইল লাঞ্চার লোড করার পর টাচ’ দেয়ার অর্থ হচ্ছে, দুটি তারের মাথা একত্র করে ফায়ার করা। কিন্তু আমরা নতুন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করে নিয়েছিল। তা হল মিসাইলের শূন্য অংশে এক লিটার পেট্রোলও নিয়ে নিলাম, যাতে লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানার পরে আগুন জ্বলে উঠে অধিক ক্ষতি সাধন করতে পারে এবং অর আলোতে আমরাও আমাদের অভিযানের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে পারি।
ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার পথে আমরা একটি পিকগান স্থাপন করে রেখেছিলাম। উদ্দেশ্য; আত্মরক্ষার জন্যে ক্যাম্প থেকে কোন সৈন্য বাইরের মোর্চার দিকে পালাবার চেষ্টা করলে যেন পালাতে না পারে।
একটু নীচে আমি নিজেই গ্রেনেড-লাঞ্চার ও রাইফেল নিয়ে বসে ছিলাম। আরশাদ ভাই মাত্র দশ গজ দূরে আমার নির্দেশের অপেক্ষায় বসে আছে। যথা সময়ে আমি ফায়ার করার আদেশ দিলাম। এক—দু’—তিন। তিন”বলার পরে আর বিলম্ব ইল না। সঙ্গে সঙ্গে মিসাইল নিক্ষেপ করে সে।মিসাইল সোজা ক্যাম্পের দেয়ালে গিয়ে আঘাত হানে এবং প্রচন্ড বিস্ফোরণের সাথে গোটা ব্যারাকু বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ভেতরে ও বাইরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। তার সাথে আমাদের কানে ভেসে আসে ভারতীয় কাপুরুষ সৈন্যদের আর্তচ্যু, আহতদের আহাজারি আর কারোও কারোও গালাগালের অকথ্য ভাষা।
ক্যাম্পের ভেতরে আমাদের কার্যক্রম এতটুকুই ছিল।আসল-খেলা যা হওয়ার: তা ছিল ক্যাম্পের বাইরে। আমাদের অনুমান সঠিক হলে ক্যাম্পের ভেতরে প্রাণে রক্ষা পাওয়া সৈন্যরা বাইরের দিকে কোথাও পালাবার কথা। আমরা এবার-সে অপেক্ষায় রইলাম, দেখি পালায় কে ।
কিছুক্ষণ পরেই কয়েকজন সৈন্য ক্যাম্পের প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে দ্রুত দক্ষিণ দিকে ছুটে চলে। কিন্তু দক্ষিণ পয়েন্টে নিয়োজিত আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর পাগান এবং ক্লাশিনকোত তাদের পালাবার চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।
ভীত-বিহুল চিত্তে তারা আমাদের দিকে, অর্থাৎ ক্যাম্পের পশ্চিম দিকে চলে আসে। আমাদের সম্মুখস্থ নালা বেয়ে পশ্চিমে কেটে পড়ার চেষ্টা করে তারা। আমি একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করলাম তার উপর। হাউমাউ করে তারা পেছন দিক সরে গেল। কিন্তু যাবে কোথায়? যেদিকে যাবে সেদিকেই ওদের যমেরু তে ধরা দিতে হবে। উপায় নেই। দিশেহারা হয়ে জ্ঞানশূন্য দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল ওরা।
ফয়সাল ভাই ছিল পিকাগানের দায়িত্বে নিয়োজিত। পঞ্চাশ রাউন্ডের বেশী ফায়ার করার অনুমতি তাকে দেয়া হয়নি। কিন্তু এত মজার শিকার দেখে তিনি লোভ সামলাতে পারলেন না। বিশেষ করে যখন শক্রর পক্ষ থেকে জবাবী হামলা :আসতে শুরু করে এবং হাজার হাজার গুলী-গোলা আমাদের অবস্থানের উপর বর্ষিত হতে থাকে, তখন ফয়সাল ভাইয়ের সন্দেহ হয়েছিল যে, শের খান আর আরশাদ ভাই দুশমনের বেষ্টনীতে পড়ে গেল কিনা! তাই তিনি ম্যাগজিন উজাড় করে গুলী ছুড়তে শুরু করে দিলেন।
আমরা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে শত্রু বাহিনীর কথা-বার্তা এবং করুণ দশা শুনছিলাম। দূর-দূরান্তের সৈন্যদেরকে তারা সাহায্যের জন্যে এ বলে আহবান করছিল যে, হাজার হাজার সন্ত্রাসী আমাদের উপর হামলা করেছে। জুলদি এসে আমাদেরকে উদ্ধার কর।
তাদের কথা শুনে আমাদের হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু সে মুহুর্তে আমাদের টু শব্দটি করা সঙ্গত ছিল না। কারণ, তখনো আমরা নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছতে পারিনি। শত্রুর হামলার শিকার হওয়ার আশংকা তখনো ছিল।
কিছুক্ষণ পরে আমি ওয়ারলেস মারফত, ফয়সাল ভাইকে কল করলাম। এবার তার দেহে প্রাণ ফিরে আসে। তিনি আমাকে জানালেন যে, পিকাগানের একটি ম্যাগজিন সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে। এখন আরো ফায়ারিং এর জন্যে তিনি আমার অনুমতি চাচ্ছেন।
আমি তাকে ধমক দিয়ে বললাম, “সাবধান আর একটি গুলীও নষ্ট করবেন না। এবার বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন।
অন্যান্য পকেও আমি নির্ধারিত স্থানে ফিরে আসার আদেশ দিলাম। আমাদের ফেরার জন্যে এমন পথ অবলন করার প্রয়োজন ছিল,ঘাতে আমার কোন সাথী কোথাও বেকায়দায় পড়ে গেলে তাকে উদ্ধার করে নিতে পারি
পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা সকলে পূর্ব দিকে হাঁটতে শুরু করি। শত্রু বাহিনীর গুলী তখনো অবিরাম চলছিল। কিন্তু তা জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গের মত শূন্যে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
রাত প্রায় ন’টার সময় আমরা সকলে একস্থানে একত্রিত হলাম। আল্লাহ আরেকবারের মত আমাদেরকে সম্পূর্ণ নিরাপদে রেখেছেন। এ লড়াইয়ে সময় ব্যয় হয়েছে মাত্র দেড় ঘন্টা।
এ সফলতার জন্যে আমার সাথীরা সকলেই আনন্দিত। খোশ-গল্প করতে করতে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা চরম ক্ষুধা অনুভব করি। আমাদের কাছে খাওয়ার মত কিছুই ছিল না। আর খাওয়ার জন্যে পার্শ্ববর্তী কোন গ্রামে যাওয়াও নিরাপদ নয়। এ জন্যে সে রাতটি আমরা প্রচণ্ড শীতের মধ্যে না খেয়ে চরম অভুক্ত অবস্থায়ও জেগে জঙ্গলে কাটিয়ে দিলাম।
রাত কেটে ভোর হল। ফজর নামাজের আযান হল। কিন্তু ওজু করার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই অনেক নীচের নালায় গিয়ে আমরা ওজু করে ফজর নামায আদায় করলাম।
নামায আদায় করে আবার জঙ্গলে। সেখান থেকে আমরা আমাদের অপারেশনের সঠিক ফলাফল জানার চেষ্টা করি। কিছুক্ষণ নীরবে অপেক্ষা করার পর শত্রুপক্ষের প্রচার মাধ্যম মারফত তাদের ক্যাম্পে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের খবর পেলাম। তাদের ওয়ারলেস অপারেটর এ বলে সংবাদ আদান-প্রদান করছিল যে, ‘সন্ত্রাসীরা আমাদের কোলগাম ক্যাম্পে প্রচণ্ড হামলা করেছে। শীঘ্র আমাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা নেয়া হোক।’
এরপর আমাদের নিজেদের কেন্দ্রীয় চ্যানেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায় । আমাদের কেন্দ্রীয় চ্যানেল আগের দিন থেকেই আমাদের অভিযানের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল। তাদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, শত্রুপক্ষের সাতাশ জন্য সৈন্য মারা গেছে। ব্যারাক বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে ধ্বংস্তুপের নীচে চাপা পড়ে আছে তেরজন সৈন্য। এ সংবাদ শুনে আমরা আল্লাহ্ পাকের শুকরিয়া আদায় করলাম।
এবার আমাদের সমস্যা একটি। তা হল খাওয়া। ক্ষুধার জ্বালা আর কারো সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু উপায় কি? দুপুর দু’টা পর্যন্ত একইভাবে আমরা সফর অব্যাহত রাখি। চলতে চলতে এক সময়ে জেলা কমান্ডার তাহের এজাজের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাত হল। তিনি আমাদেরকে স্বাগত জানালেন এবং খানাও খাওয়ালেন।
এ সময়ে একটি মজার ঘটনা ঘটে। তাহের এজাজ ভাইকে বললাম যে, আমি ডিভিশনাল কমাণ্ডার মাজেদ জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাই। তিনি কোথায় আছেন?
শুনে তিনি হেসে ফেললেন। কারণ, মাজেদ জাহাঙ্গীর তখন তাঁর পাশেই বসা; কিন্তু আমি চিনতে পারিনি। যাহোক, মাজেদ ভাইয়ের সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ হল। পরবর্তী এ্যাকশনের দায়িত্ব ও পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে তিনি আমাদের বিদায় দিলেন।
পরবর্তী দু’সপ্তাহের কনকনে শীতের দিনগুলো আমরা কখনো কম্বল মুড়ি দিয়ে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অতিবাহিত করেছি, আবার কখনো কাটিয়েছি সাথীদের ছোট-খাট রোগ-ব্যাধির শুশ্রুষা-চিকিৎসায় ।।
এ সময়ে আমরা আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি। তা হল একটি স্থান নির্বাচন করে সেখানে আমরা একটি পরিখা খনন শুরু করি। তিনদিন পর্যন্ত মাটি ও পাথর কেটে পরিখা খনন কাজ চলে। এরপর আমাদের সমস্ত আসবাবপত্র সেখানে একত্রিত করে থাকার মত নির্দিষ্ট স্থানের ব্যবস্থা করে এ তীব্র শীতের মওসুমে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করা থেকে নিশ্চিন্ত হলাম। এখন আমরা চিন্তা মুক্ত। দিনগুলো আরামের সাথেই কাটছে।
টার্গেট বি, এস, এফ ক্যাম্প
ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ। শুরু হল আমাদের নতুন প্রোগ্রাম। এবারের এ্যাকশন হিন্দুয়ারায় অবস্থিত বিএসএফ ক্যাম্পের উপর। এ ক্যাম্পের কাপুরুষ সৈন্যরা এলাকায় নিরীহ জনসাধারণ, বিশেষ করে মহিলাদের উপর নির্যাতনের ধারা অব্যাহত রেখেছে।
তাহের এজাজ ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং জেলা কমান্ডার কাসেম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের স্থানও বলে দেন। অতঃপর খানা খাইয়ে ও চা পান করিয়ে আমাকে বিদায় দেন।
ক্যাম্পে ফিরে এসে আমি আমার সাথীদেরকে একত্র করে জানালাম যে, আর বসে থাকার সময় নেই। আমাদের আবার শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার সময় এসে গেছে।
শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার খবর আনন্দেরই হয়ে থাকে। তদুপরি আমাদের পাকিস্তান ও আযাদ কাশ্মীরের দূর-দূরান্ত অঞ্চল থেকে ওখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যই হল, সেই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা, যারা আমাদের নিরপরাধ মুসলিম ভাই-বোনদের জান-মাল ইজ্জত-আব্রু নিয়ে তামাশা করছে।
যাহোক আক্রমণের সংবাদ শুনে সাথীরা সকলেই খুশী হল এবং বিজয়ের আনন্দঘন মুহূর্তটির অপেক্ষায় প্রহর গুণতে লাগল। অস্ত্র-সাজে শত্রুর অতি নিকটে গিয়ে যখন আক্রমণ করা হয় এবং ঘাতক ও হায়েনাদেরকে ঘেরাও করে হত্যা করা হয়, সে মুহূর্তটির আনন্দের কথা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না, শুধু
অনুভব করা যায়।
১৭ ডিসেম্বরের তৃতীয় প্রহরে আমরা রওনা হলাম। সন্ধ্যার সময় এক জনপদে পৌছে’ওয়ারলেস মারফত কাসেম ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। উক্ত জনপদে পৌছে যাত্রা বিরতি দিয়ে পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করার কথা তিনি আগেই বলে দিয়েছিল। মুজাহিদভক্ত এক হৃদয়বান ব্যক্তির ঘরে খানা খেয়ে রাত যাপনের জন্যে আমরা আমাদের কুদরতী নিবাস’ জঙ্গলে চলে গেলাম।
কাশ্মীর ভূখন্ড এমনিতেই শীতপ্রধান দেশ। তার উপরে ডিসেম্বরের কনকনে। শীত। আবার সময়টিও হল রাতের বেলা। আমরা কম্বল মুড়ি দিয়ে শোয়ার চেষ্টা করে তাতেও ব্যর্থ হলাম।
মধ্য রাতের কিছু আগে তাপমাত্রা ছিল শূন্যের কয়েক স্তর নীচে। চোখ খুলে আমি দেখতে পেলাম যে, এ বরফজমা পরিবেশেও সকল মুজাহিদ আরামের সাথে ঘুমুচ্ছেন। আসলে আল্লাহ্ যখন তাঁর বান্দাকে স্বস্তি দিতে চান, তখন কঠিন থেকে কঠিনতর মুহূর্তেও বান্দর চোখে দ্রিা এসে যায়।
ওয়ারলেস সেট অন করে কাসেম ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি শীঘ্র আমাকে তাঁর কাছে চলে যেতে বললেন। সাথীদের সবাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রওনা হলাম। অল্পক্ষণ পরেই তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়ে গেল।
রাতের তখন তৃতীয় প্রহর। গভীর নিদ্রায় সকলেরই চোখ বুজে আসছে। আমারও একই অবস্থা। ভাবলাম, একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হত না। কিন্তু কীভাবে? এখানে তো বিছানা-কম্বল কিছুই নেই। তবুও একটি গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে রইলাম। ভাগ্যিস, কাসেম ভাই দয়া করে আমাকে পাহারার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল।
এভাবে কিছুক্ষণ জেগে, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে রাত কাটালাম। ভোর হল। আমরা জামাতের সাথে ফজর নামায আদায় করলাম। নামাযের পর কাসেম ভাই সু-সংবাদ শুনালেন যে, তিনি আমাদের সকলকে চা পান করাবেন। স্থানীয় কয়েকজন সাথীকে পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে চা আনার জন্যে পাঠানো হল। কিছুক্ষণ পরে দেখতে পেলাম, গ্রামের কয়েকজন মহিলা নানা রকম খাদ্যদ্রব্য ও চা হাতে করে মুজাহিদদের পেছনে পেছনে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এতে আমরা কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। কারণ, যে কোন এ্যাকশনে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে চলা আমাদের জন্যে অপরিহার্য। করে আসছিও তাই।
এ ধরনের গেরিলা যুদ্ধে জনসাধারণের কারো সঙ্গে বিশেষ করে মহিলাদের সূঙ্গে মুজাহিদদের কথা বলা নীতির পরিপন্থী। কিন্তু কাশ্মীরে মা-বোনদের আবেগ ও চেতনার সামনে অনেক সময় গেরিলা যুদ্ধের নীতিওমুখ থুবড়ে পড়ে। বোনেরা তাদের ভাইদেরকে এক নজর দেখে এবং নিজ হাতে পানাহার করিয়ে আনন্দ বোধ করে থাকে।
নাস্তা ও চা পানের পর্ব সমাপ্ত করে আমরা অভিযানের জন্যে সম্মুখপানে রওনা হলাম। এ অঞ্চলে আমাদের কমাণ্ড ছিল কাসেম ভাইয়ের হাতে। কিন্তু
তিনি আমাকে বললেন, এ্যাকশনের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ম আপনাকেই করতে হবে। আর কাজও করবে আপনার গ্রুপ। আমরা শুধু আপনার সহযোগিতায় থাকব।
.
তার কথামত আমাকে গোটা অভিযানের পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল প্রস্তুত করতে ইল। আমরা যে ক্যাম্পের উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিয়েছি, তা হিন্দুয়ারা বারারীপুর ক্যাম্প নামে পরিচিত। এটি আমাদের এক মহান মুজাহিদ শহীদ শওকতের বাড়ির নিকটে একটি খোলা মাঠে অবস্থিত। এ কারণে তার উপর হামলা করা অসম্ভব না হলেও দুষ্কর ছিল নিঃসন্দেহে।
ক্যাম্পের পেছন দিকটা ছিল ঢালু। এ স্থানটি আমরা আড়াল হিসেরে ব্যবহার করতে পারতাম। কিন্তু সামনে বেশ কিছু গাছ থাকায় পেছন দিক থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করা ছিল অসুবিধাজনক। অন্যান্য দিকে কোন আড়াল না থাকায় সেসব দিক থেকেও হামলা করা ছিল অসম্ভব। মিসাইল ছোড়ার সাথে সাথে শত্রু বাহিনী আমাদের উপর অনায়াসে গুলী ছুড়তে পারত আর আমরাও পালাবার কোন সুযোগ পেতাম না।
সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, হামলা নিকটবর্তী ক্ষেতের দিক থেকেই পরিচালনা করা হবে। ওখানে এক আধটু ঝোপ-জঙ্গলও আছে, যা প্রয়োজনে আমরা কাজে লাগাতে পারব। ক্ষেতের মধ্যে প্রকান্ড একটি গাছ এবং পানির একটি ছোট নালাও আছে।
আল্লাহর নাম নিয়ে আমি সেই গাছের পেছনে মিসাইল স্থাপন করলাম। কোরিং পার্টিকে আড়ালে বসিয়ে বলে দিলাম, যেন তারা রাস্তার দিকে দৃষ্টি রাখে, যাতে ওদিক থেকে কোন হামলা আসতে না পারে।
আমাদের আক্রমণের নির্দিষ্ট সময় ঘনিয়ে আসলে ঠিক সে সময় দূরে একটি গাড়ীর আলো দেখা গেল। গাড়িটি ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছিল। আমরা শংকিত হয়ে পড়লাম। তাহলে কি ওরা আমাদেরকে দেখে ফেলল? দু দিক থেকে আমাদেরকে ঘিরে ফেলল নাকি ওরা?
কিন্তু না গাড়িটি স্বাভাবিকভাবে পথ অতিক্রম করে চলে গেল। আসলে ওটা ছিল একটি প্রাইভেট ট্যাক্সি। আমরা শংকামুক্ত হলাম। পুনরায় অভিযানের প্রতি মন দিলাম। তখন ক্যাম্প থেকে আমরা মাত্র ৭৫ মিটার দূরে। মুজাফফরাবাদের আশফাক ভাই এবং স্থানীয় এক মুজাহিদ আলীম কাশ্মিরী তখন আমার সঙ্গে ছিল। এ্যাকশনের আগে আমি সাথীদেরকে আর একবার রিহার্সেল করালাম। আশফাক ভাই মিসাইল নিক্ষেপ করবেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা নালায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রোলিং করে বের হবার চেষ্ট করব।
শুরু হল এ্যাকশন প্রচন্ড বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ক্যাম্প। আগুন, ধুয়া ও বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ক্যাম্পে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রু বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রচন্ড ফায়ারিং শুরু হয়। সার্চ লাইট ও নিক্ষেপিত গোলার আলোতে সমগ্র এলাকা দিনের মত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
ততক্ষণে আমার সব সাথী নালায় পৌছে গেছে। কিন্তু আলো এত উজ্জ্বল ছিল যে, মাটিতে পড়ে থাকা সুইটি পর্যন্ত চোখে পড়ার মত। ফলে আমি একটুও নড়াচড়া করতে পারলাম না। বাধ্য হয়েই দু’জন সাথীর সঙ্গে গাছের পেছনে লুকিয়ে রইলাম।।
কাসেম ভাই ওয়ারলেস মারফত সংকেতে আমাকে বললেন, “চল, এখানে থাকা বিপজ্জনক।’
আমি কোন জবাব দিলাম না, পাছে শত্রু পক্ষের কোন অপারেটর আমার কথা শুনে না ফেলে এবং আমাদের পালাবার পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে না যায়।
এতে কাসেম ভাইয়ের আশংকা হল, আমি আহত হয়ে পড়ে রইলাম কিনা! তাই আবারও তিনি আমাকে সংকেত দিলেন। কিন্তু আমি এবারও সাড়া দিলাম না।
দু ঘন্টা পর্যন্ত ফায়ারিং ও আলো বিচ্ছুরণের ধারা চলতে থাকে। আমরা চুপচাপ গাছের পেছনে লুকিয়ে রইলাম। অতঃপর আমি আমার সাথীদ্বয়কে দ্রুত কাসেম ভাইয়ের কাছে চলে যেতে বলে নিজে তাদের পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করি।
কাসেম ভাই এতক্ষণে আমাদের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েছেন। ওয়ারলেস মারফত তিনি শেষবারের মত আমাকে কল করলেন, এস, আর-২ তুমি কোথায়? আমার ডাক শুনে থাকলে জলদি বেরিয়ে এস। অন্যথায় আমরা চললাম।
এবার আমি ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলাম। বললাম, কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমার অপেক্ষা করুন। আমি আসছি. আপনি রওনা দিলে শত্রুরা আপনাকে দেখে ফেলবে। ফলে এখান থেকে বের হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
ঠিক দু’ঘন্টা পরে আলো কিছুটা কমে আসে। কিন্তু দুশমনের রাইফেলগুলো তখনো ক্ষান্ত হয়নি। মর্টারের গোলা আমাদের মাথার উপর দিয়ে হালকা আলো বিচ্ছুরণ করে চলেছে তখনও। ক্যাম্পের সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা সামনে অগ্রসর হতে সমর্থ হলাম।
ইত্যবসরে পার্শ্ববর্তী গ্রাম রফাবাদ থেকে গাড়ীর একটি বহর আমাদের জন্য সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে। আমরাও বহু কষ্টে পানির নালা পর্যন্ত পৌঁছতে সমর্থ হই। কিন্তু মাথা তুলে হাঁটার সুযোগ এখনো হয়নি। কারণ গোলার আলো না থাকলেও রফাবাদ থেকে আগত গাড়ীগুলোর আলো গোটা সড়ক এবং তার আশ-পাশ আলোকিত করে রেখেছে।একটানা ক্রোলিংয়ের কারণে আমাদের কনুইগুলো ছিলে গিয়েছিল। কেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল পরনের কাপড়। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমাদের এ কঠিন সফর চলতে থাকে।
চলতে চলতে এক পর্যায়ে আমি কোন রকমে সড়কও অতিক্রম করলাম। কাসেম ভাই সাথীদেরকে নিয়ে সড়কের ওপারে অপেক্ষমান ছিলেন। আমাকে দেখা মাত্র তাদের চেহারায় আনন্দের দ্যুতি খেলতে শুরু করে।
চাঁপা কণ্ঠে আমরা কুশল বিনিময় করলাম। কিন্তু তখনো আমরা শংকামুক্ত হতে পারিনি। শত্রুবাহিনী কোথাও ওঁৎ পেতে বসে আছে কিনা এ আশংকায় আমরা সম্মুখে সকলে একত্রে রওয়ানা না হয়ে গোটা কমান্ডোজকে তিন ভাগে ভাগ করে নিলাম। কথা হল, পরস্পর জানাজানি ছাড়াই তিনটি গ্রুপ তিন দিকে চলে যাবে, যাতে কোথাও ওঁৎ পেতে থাকা শত্রুর কবলে পড়তে হলে সকলকে
পড়তে না হয়।
একে অপরকে আল্লাহর হাওলা করে আমরা পৃথক পৃথক রওনা হলাম। প্রথমে কাসেম ভাইয়ের গ্রুপ, তারপর সলীম কাশ্মীরীর এবং সব শেষে আমার গ্রুপ। প্রতি দুই গ্রুপের রওনার মাঝে ব্যবধান রেখেছি পাঁচ মিনিট।
বেশ কিছু পথ চলার পরে চাদের ক্ষীণ আলোতে দেখতে পেলাম যে, কয়েকজন লোক ওঁৎ পেতে সড়কের কিনারায় বসে আছে। দেখামাত্র আমরা দ্রুত মাটিতে শুয়ে পড়ে পজিশন নিয়ে ক্রোলিং করতে করতে ওদের একেবারে নিকটে চলে গেলাম।
আমাদের সকলের আঙ্গুল রাইফেলের ট্রিগারের উপর। গুলী করার আদেশ দেব ভাবছি। অপর দিকের কথার আওয়াজ শুনে আমার মনে সন্দেহ জাগল। আসলে ওরা ভারতীয় সৈন্য নাকি আমাদেরই লোক, পরীক্ষা করার জন্যে আমি আমার কোড নাম বললাম।।
জবাবে যে কোড নাম আসল, তা শুনে আমরা সকলে হাসিতে ফেটে পড়লাম। তারা ছিল কাসেম ভাইয়ের গ্রুপের মুজাহিদ। এবার কাছে গিয়ে রসিকতা করে আমি বললাম, কাসেম ভাই, আপনি আজ আমাদের হাতে শহীদ হতে গিয়েও বেঁচে গেলেন।
জবাবে কাসেম ভাই বললেন, “এমনই যদি হত, তো আমি একা কেন, আপনাদের সাথে করে আল্লাহর নিকট চলে যেতাম।
কিছুক্ষণ খোশ-গল্পের পর আমরা আবার সামনে রওনা হলাম। পথে তৃতীয় দলটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কিন্তু বেশী বিলম্ব না করে আবার আমরা আলাদা। আলাদাভাবে সফর শুরু করি।
ছয়জন সঙ্গী সাথে নিয়ে সারা রাত অবিরাম হাঁটার পর সকাল বেলা একটি গোপন আস্তানায় গিয়ে উপস্থিত হই। সেখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে শুয়ে চোখ বুঝে একটু ঘুমাবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু শোয়ার খানিক পরেই তন্দ্রাভাব নিয়েই আমাকে উঠে যেতে হল। কারণ, আমাদের হাই কমাণ্ডের আদেশ, কোন অবস্থাতেই লোকালয়ে রাত কাটানো যাবে না।
যদি আমরা নিরাপদে সরে যেতে সক্ষমও হই আর ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের সন্ধানে নেমে পড়ে, তাহলে নিরপরাধ বেসামরিক লোকেরা সৈন্যদের অত্যাচারের শিকার হবে।
তাই সকাল সকাল সাথীদের ঘুম থেকে উঠিয়ে সেখান থেকে আমরা রওনা দিয়ে পুনরায় জঙ্গলে চলে গেলাম। কাপুরুষ ভারতীয় সৈন্যদের এতটুকু বুকের পাটা নেই যে, বাঘ-ভল্লুকের আবাস এ গভীর অরণ্যে আমাদের খুঁজে বেড়ায়।
ফজর নামাযের পর একটি উঁচু স্থানে বসে ওয়ারলেস মারফত শত্রুবাহিনীর কথা শোনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও কোন তথ্য সংগ্রহ। করা সম্ভব হল না।
আটটার সময় কেন্দ্রীয় চ্যানেল আমাদের হাজিরা টানতে শুরু করেই নিয়ম অনুযায়ী আমাকে কল করল। একে অপরের খোঁজ-খবর নিলাম, কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু আমাদের হামলায় শত্রুপক্ষের কি পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, সে সম্পর্কে কারুরই কিছু জানা ছিল না।
এর কারণ সম্ভবতঃ এটা ছিল যে, যে ক্যাম্পের উপর আমরা হামলা করেছিলাম, তা ছিল এমসি থেকে অনেক দূরে। অপরদিকে স্কুল ছাত্রের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের জন্যে অপেক্ষা করার ন্যায় আমরা আমাদের অভিযানের ফলাফল জানতে অস্থির। পরবর্তীতে আপ্রাণ চেষ্টা করে শত্রুপক্ষের ওয়ারলেস বার্তা থেকে আমরা ছোট-খাট সংবাদ পেতে থাকি।
হিন্দুয়ারা ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টারের সংবাদ, ‘পনের ব্যক্তি মারা গেছে
এবং অ্যামুনিশন ডিপো পুড়ে গেছে।’
আমি ওয়ারলেসে তাদের লক্ষ্য করে বললাম, “কি ভাই, রাত কেমন কাটল?
জবাবে তাদের অপারেটর চড়া গলায় বলল, “আমি জানি, তুমি আফগানী। কিন্তু তোমরা আমাদের মারছ কেন? মারতেই যদি হয়, তো নরসীমাকে মার।
আমাদের গরীব ছেলে-মেয়েদেরকে এতীম করে তোমাদের লাভ কী?
জবাবে আমি হাসিমুখে বললাম, ভালো কথা, কিন্তু আমাদের মজলুম কাশ্মিরী ভাই-বোনদের রক্ত ঝরানোর জন্যে নরসীমা রাও তো এখানে আসে না!
আমার জবাব শুনে সে অশ্রাব্য ভাষায় আমাকে গালাগাল করতে শুরু করে। অগত্যা আমি সেট বন্ধ করে দিলাম।
আইবির ক্যাম্পে আক্রমণ এবার আমাদের টার্গেট কাপওরায় অবস্থিত ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আই বি) একটি কেন্দ্র। যুগের কলংক এ প্রতিষ্ঠানটির অপতৎপরতার কুখ্যাতি সকলেরই জানা। কাশ্মীরে আইবি কর্মকর্তাদের কাজ হল, মুজাহিদদের মাঝে পরস্পর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা এবং জনসাধারণের মনে মুজাহিদদের প্রতি অনাস্থা জন্ম দেয়া।
একদিন লোলাব থেকে ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার জাবের জাব্বার আমাকে জানালেন যে, আইবি সদস্যরা আমাদের গোপন ঘাঁটির সন্ধান পেয়ে গেছে। অতি দ্রুত তারা হানা দিতে আসবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যথাশীঘ্র আপনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
আমাদের এ গোপন ঘাটিতে এমন কোন ভারী সরঞ্জাম ছিল না, যা অন্যত্র সরাতে হবে। সকল সাথী ঘাঁটি ছেড়ে অদূরে এক নিরাপদ স্থানে পজিশন নিয়ে ওঁৎ পেতে বসে পড়ি।।
আমরা সারা দিনের ক্ষুধার্ত, একফোটা পানিও পান করা সম্ভব হয়নি। শত্র : বাহিনীর মুখখামুখি হওয়ার স্পৃহা ক্ষুধার জ্বালা দূর করে দিয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করা সত্ত্বেও সৈন্যদের আগমনের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। ফলে আমি ওয়ারলেস মারফত আবার ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করি।
তিনি বললেন, এটা আসলে একটি গুজব ছিল। তার কারণ, ভারতীয় সৈন্যরা ঘোষণা করেছিল, তোমাদের এ মুজাহিদ গ্রুপটিকে কেউ ধরে দিতে পারলে তাকে মোটা অংকের পুরস্কার দেয়া হবে। আইবির সহায়তায় কিছু লোক সুযোগটি গ্রহণের জন্যে এ অপপ্রচারে লিপ্ত হয়।
আইবির এ ক্যাম্পটি ছিল ভারতীয় সৈন্যদের ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টারের নিকটে। এ কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আক্রমণ ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টারের উপরও করা হবে।
একদিন প্রচন্ড বরফপাত হল এবং সমগ্র এলাকা ছিল বরফের সাদা চাদরে আবৃত। আমরা ক্যাম্পের উপর আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা নিলাম। বাইরে প্রায় চার ফুট বরফের আস্তর জমে আছে। আমাদের কারো কাছে গরম পোষাক ছিল না।
পোষাকের বন্দোবস্ত হল। গরম বুটেরও ব্যবস্থা করলাম। তারপর গন্তব্যে এগিয়ে চললাম।
সকাল এগারোটা থেকে আরম্ভ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা হাঁটতে থাকি। প্রচন্ড শীত ও বরফ আমাদের সফরকে অত্যাধিক জটিল করে তুলেছিল। সন্ধ্যা প্রায় ছ’টার সময় আমরা ক্যাম্পের নিকটে পৌছে গেলাম।
একটি নিরাপদ স্থানে সাথীদেরকে রেখে আমি নিজে ক্যাম্পের খবরাখবর সংগ্রহ করতে চলে গেলাম। ক্যাম্পের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে আক্রমণ করার স্থান এবং পেছনে হাটার পথ নির্ণয় করে সাথীদের কাছে ফিরে এলাম।
সাথীদেরকে ক্যাম্পের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করে নিকটবর্তী একস্থানে গিয়ে জেলা কমাণ্ডারের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি এ এ্যাকশনের প্রয়োজনীয় প্রচুর অ্যামুনিশন আনার জন্য নির্দিষ্ট একস্থানে কাউকে পাঠানোর কথা বললেন। আমি একজন কাশ্মিরী মুজাহিদ এবং আমাদের দু’জন সাথীকে যথাস্থানে পাঠিয়ে দিলাম। দুদিন পর কাংখিত সরঞ্জামাদি নিয়ে তারা ফিরে আসে।
আক্রমণের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে দু’দিন কেটে গেল। তৃতীয় দিন সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে আমরা ক্যাম্প অভিমুখে রওনা হলাম।
সংখ্যায় আমরা পনেরজন। তন্মধ্যে পাঁচজন ছিল স্থানীয় মুজাহিদ। গোটা এলাকা এখনো রীতিমত বরফে ঢাকা।
ক্যাম্পের নিকটে পৌছে মিসাইল স্থাপন করার স্থান ঠিক করা হল। কিন্তু বরফের কারণে মিসাইল লাঞ্চার স্থাপন করা ছিল দুষ্কর।
সকলে মিলে হাতের সাহায্যে বরফ সরালাম। এক ঘন্টা কঠোর পরিশ্রমের পর মিসাইল স্থাপনের জায়গা করে নিতে সক্ষম হলাম ।
সাথীরা সকলেই তখন শীতে থরথর করে কাঁপছে। মিসাইল স্থাপন করে ক্যাম্পের দ্বিতীয় দিকে কোরিং পার্টিকে বসালাম। আর তৃতীয় দিকে বসালাম রকেটলাঞ্চার সজ্জিত গ্রুপকে।
প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি নিজে মিসাইল থ্রো করার জন্যে ফিরে আসি। রাওলাকোটের আদেল ভাইকে বলেছিলাম যে, তিনি আগে রকেট নিক্ষেপ করবেন। আমার মিসাইল থ্রো করার কথা তার পরে।
৩১ জানুয়ারী সন্ধ্যায় ঠিক ছ’ টার সময় আদেল ভাই পরিকল্পনা মোতাবেক সর্বপ্রথম রকেট নিক্ষেপ কর। রকেট সোজা গিয়ে আইবির অফিস ভবনের উপর আঘাত হানে। পর মুহুর্তেই আমি মিসাইল নিক্ষেপ করলাম। চোখের পলকে ভবনটি বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এবার অন্যান্য সাথীরা লাঞ্চারের মাধ্যমে গ্রেনেড ছুড়তে শুরু করে।
আইবির ভবনের অদূরে এক কিলোমিটারের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যদের আরো চারটি ক্যাম্প ছিল। আমাদের আশংকা ছিল, গোলাগুলির শব্দ শুনে তারা বীরত্ব দেখানোর চেষ্টা করে বসে কিনা। এ কারণে তাদের আগমনের পথে আগেই আমি পিকাগান সজ্জিত কয়েকজন মুজাহিদ মোতায়েন করে রেখেছি।
আমাদের ধারণা অনুযায়ী কয়েকজন সৈন্য এদিকে আসার চেষ্টা করলে মুজাহিদরা তাদের উপর প্রচন্ড ফায়ারিং করে, যার ফলে তাদের কয়েকজন সৈন্য মারা যায়। আমাদের এ হামলা পনের মিনিট পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এরপর পরিকল্পনা মোতাবেক আমরা পিছনে সরতে শুরু করি।
জঙ্গলে একস্থানে বসে আমি ওয়ারলেস অন করলাম। শুনতে পেলাম আইবির মেজর ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টার প্রধানের নিকট সাহায্য তলব করছে। নিজেদের ২২ জন সৈন্যের মৃত্যু এবং অনেকে ধ্বংসাবশেষের নীচে চাপা পড়ে থাকার সংবাদ দিয়ে সে হেড কোয়ার্টারকে বলল যে, আশ-পাশের চার ক্যাম্পে যেন বলে দেয়া হয়, তারা যেন সন্ত্রাসীদের প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখে এবং গতিবিধি দেখে রাখে। ওরা যে গ্রামে গিয়ে অবস্থান নেবে, আগামী দিন ঘেরাও করে আমরা ওদেরকে গ্রেফতার করব।’
হৃদয়বান মেজবানদের আশ্রয়ে
আমাদের অভিযান শেষ। এবার আমাদের সামনে ক্ষুধা ও পিপাসার ন্যায় কঠিন সমস্যা। এখান থেকে সরে যাওয়াও একান্ত প্রয়োজন। কারণ, আশেপাশে অসংখ্য ভারতীয় সৈন্যের ক্যাম্প।
তীব্র ঠাণ্ডা ও বরফের মধ্য দিয়ে পা টেনে টেনে রাত দু’টার সময় লোকালয় থেকে কিছু দূরে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেই। কনকনে শীত এবং ক্লান্তিতে আমরা সকলেই অস্থির। পর্যাপ্ত পরিমাণ লাকড়ি ছিল আমাদের কাছে। কিন্তু ভিজা হওয়ায় তা আর জ্বালানো সম্ভব হল না।
আরো কয়েক ফার্লং হাঁটার পর এক স্থানে আমরা যাত্রা বিরতি দিলাম। এখানে কিছু শুকনো কাঠ পাওয়া গেলে আগুন জ্বালাতে সক্ষম হই।
শীতার্ত দেহে আমরা সকলে কিছু উত্তাপ গ্রহণ করলাম। পরনের কাপড় ভিজে গিয়েছিল, তাও শুকিয়ে নিলাম। এরপর আহারের সন্ধানে রওনা হলাম পার্শ্ববর্তী গ্রামের দিকে।
গ্রামে পৌছে আমি একটি ঘরের দরজায় করাঘাত করি। ঘরের মালিক আমার বহু পুরোনো পরিচিত লোক। হাসিমুখে আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বললেন, আপনি আজ বিরাট এক কাজ করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এ সফল অভিযান আপনারই কীর্তি।
আমি মুচকি হেসে বললাম, কৈ আমরা তো কিছুই করিনি।
‘করিনি বললে কী হবে? অভিযানে যাওয়ার সময় আমি আপনাদেরকে দেখেছিলাম। তারপর তিনি বললেন, মনে হয় আপনারা সকলেই ক্ষুধার্ত।
আমি কিছুই বললাম না। কিন্তু আমাদের মনের কথা বুঝতে তাঁর বাকী থাকল না। রাত তৃতীয় প্রহরে তিনি আমাদের জন্যে খাবারের আয়োজন করেন। চা পান করাতেও ভুল করলেন না। অবশেষে সেখানেই শুয়ে পড়ার প্রস্তাব করলে আমি রসিকতা করে বললাম, ভোরে যদি ভারতীয় সৈন্যরা. আপনার বাড়ীতে মেহমান হয়ে যায়, তাহলে?
জবাবে তিনি বললেন, ‘চিন্তার কোন কারণ নেই, এ গৃহকেই আপনি মোর্চা বানিয়ে নিন।
কিন্তু তখন ওখানে অবস্থান করা ছিল কৌশলের বিরোধী। তাই আমি বললাম, না, রাতটা আমাদের জঙ্গলেই কাটাতে হবে।
পুনরায় চা পান করে জঙ্গলের দিকে রওনা দিলাম। জঙ্গলে বরফের বিছানায় শোয়া আর সম্ভব হল না। তাই বড় একটি গাছের নীচে বসে পড়লাম। আমি পাহারার দায়িত্ব গ্রহণ করলে অন্যান্য সাথীরা বসে বসে ঝিমুতে শুরু করে।
সূর্যোদয়ের পর তন্দ্রাচ্ছন্ন সাথীদেরকে জাগালাম। সকলের কাপড়-চোপড় কাদামাখা। দেখে মনে হল, সবাই প্লাস্টিকের কাপড় পড়ে আছে। একে অপরের অবস্থা দেখে হাসতে শুরু করি।
কিছুটা বেলা হলে সাথীদের নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে একটি ঘরে গিয়ে বসলাম। অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের নির্জীব দেহে প্রাণ ফিরে আসে। আমাদের মেজবান বিভিন্ন ঘর থেকে কাপড় সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন এবং আমাদের ভিজা
ও কাদামাখা কাপড়গুলো পরিষ্কার করার জন্যে নিয়ে যান।
আমাদের গোসলের অবসরে গৃহকর্তা আমাদের খানাপিনার আয়োজন করে ফেলেন। এটা ছিল মুজাহিদদের প্রতি কাশ্মিরী জনগণের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথেই এসব করেছিলন আর বারবার বলছিলেন যে, আমার একান্ত কামনা ছিল, কোন মুজাহিদ আমার ঘরে আসবে, তাহলে আমি মন ভরে তার সেবা করতে পারব। আল্লাহর শোকর, আজ আপনাদের মাধ্যমে আমার সে ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে।
লোকটি ছিল আমার পুরনো পরিচিত। কাশ্মীর উপত্যকায় প্রথমবার অবস্থানের সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ওখান থেকে চলে আসার পর কে একজন গুজব ছড়িয়েছিল যে, আমি সীমান্ত এলাকায় শহীদ হয়ে গিয়েছি। তিনিও এ খবর শুনেছিলেন এবং অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। এখন জীবিত তার ঘরে মেহমান হওয়ায় তিনি খুবই আনন্দিত হন।
আমাদের পাহারায় নিয়োজিত ছিল গ্রামের বেশ কিছু লোক। গ্রামের প্রত্যেকের ব্যাপারে আমরা অবহিত এবং নিশ্চিত ছিলাম। তথাপি আমরা চাচ্ছিলাম যে, যত তাড়াতাড়ি হোক আমরা সেখান থেকে জঙ্গলে চলে যাব। কারণ, লোকালয়ে আমাদের দীর্ঘ উপস্থিতি মেজবানদের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। তাই খানা খাওয়া এবং ভিজা কাপড় শুকানোর পর আর বিলম্ব না করে জঙ্গলের দিকে রওনা হলাম।
জঙ্গলের খানিকটা ভেতরে নিরাপদ একস্থানে মাটি খুঁড়ে একটি ঘাঁটি বানিয়ে নিয়েছিলাম। তাতে বিশজন মুজাহিদ থাকতে পারত এবং তার মধ্যে আবশ্যকীয় যাবতীয় আসবাবপত্র রাখা ছিল। অবসর সময়ে আমরা সেখানে বিশ্রাম করে কাটাতাম।
কয়েকদিন পরেই রমযান মাস শুরু হয়ে গেল। কমাণ্ডার আমাদেরকে বলে দিয়েছিলেন, আমরা যেন রমযান মাসে কুরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদত অধিক পরিমাণে করি এবং আল্লাহর দরবারে মুসলিম মিল্লাতের মুক্তি ও সমগ্র বিশ্বের মুজাহিদদের জন্যে দু’আ করি।
ক্রুসেন ক্যাম্পে হামলা
একদিন আমি বাংকারে বসে আছি। জেলা কমাণ্ডার তাহের এজাজ ও ডিভিশনাল কমান্ডার মাজেদ জাহাঙ্গীরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হল, এবার ক্রুসেন ক্যাম্পের উপর হামলা করা হবে। এ ক্যাম্পের সৈন্যরা সোগামে তেরজন মুজাহিদকে শহীদ করেছিল। এর প্রতিশোধ নেয়া একান্ত আবশ্যক।
ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়েছিল এক সমতল স্থানে। তার একদিকে ছোট একটি পাহাড়। নিকটেই চন্ডিগ্রাম ও কুলিগ্রামের সেনাক্যাম্প। ফলে তাতে আক্রমণ করা অসম্ভব না হলেও দুষ্কর ছিল নিঃসন্দেহে।
মাগরিবের নামায আদায় করে আমরা ক্যাম্পের দিকে রওনা করলাম । সিদ্ধান্ত হল, মিসাইল টাচ্ দেয়ার পরিবর্তে এবার লাইট-সুইচ ব্যবহার করব। এটা একটা নিরাপদ পদ্ধতি। কারণ, এ পদ্ধতিতে মিসাইল ফায়ার করতে হয় না, আলোর কিরণ পড়ে নিজে নিজে বিস্ফোরিত হয়।
ক্যাম্পে যাওয়ার রাস্তায় ভারতীয় সৈন্যরা দিনরাত পজিশন নিয়ে পাহারায় নিয়োজিত থাকে। পার্শ্ববর্তী ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পের দিকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হল।
সাথীদের দু’টি গ্রুপে বিভক্ত করে এক গ্রুপ আগে পাঠিয়ে দিলাম আর অপর গ্রুপকে রাখলাম কয়েক গজ পেছনে। নীরবে হেঁটে আমরা ক্যাম্প থেকে প্রায় চারশ গজ দূরে অবস্থিত পাহাড়ে পৌছে গেলাম। এখানে আমাদের থামতে হল। কারণ তার পঞ্চাশ গজ সামনেই সৈন্যরা একটি বাংকার বানিয়ে রেখেছিল।
চাদের আলোতে ঝলমল করছিল এলাকা। আমরা শংকিত হয়ে পড়লাম যে, পাছে সৈন্যরা আমাদের গতিবিধি দেখে ফেলে কিনা। সাথীদেরকে কয়েকটি ঝোপের আড়ালে বসিয়ে দিয়ে পিঠে দু’টি মিসাইল নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ক্যাম্পের দিকে এগুতে শুরু করলাম।
মিসাইল দুটোর এক একটির ওজন নয় কেজি। তিন ফুট লম্বা ও প্রায় পৌনে তিন ফুট প্রস্থ। একে এম-৫৭ মিসাইল বলা হয়। রাইফেল তো আছেই। এ দুটি মিসাইল ও রাইফেল বহন করে একটানা তিনঘন্টা আমি ক্যাম্পের দিকে ক্রোলিং করতে থাকি। ক্যাম্পের অবস্থান সম্পর্কে আমার ভালো জানাশুনা থাকলেও একটি পোস্টের অবস্থান আমার জানা ছিল না। হামাগুড়ি দিতে দিতে
অজান্তে আমি সেই পোস্টের নিকটে এসে পড়ি।
হঠাৎ দেখতে পেলাম, আমার থেকে আনুমানিক ছয়ফুট ব্যবধানে এক সৈন্য দাঁড়িয়ে। অকস্মাৎ একজন ভারতীয় সৈন্যকে সামনে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যাই। ভাবলাম, এবার ধরা পড়ে গেছি, আর রক্ষা নেই। সৈন্যটি আমাকে দেখে ফেলেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। আমার আগমন সে টেরই পায়নি। কিন্তু তারপরও আমি যথাস্থানে অসাড় হয়ে পড়ে রইলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত প্রায় দশটা বাজছে। আমার আগে থেকেই জানা ছিল যে, প্রতি ঘন্টা পর পর পাহারাদারদের ডিউটি পরিবর্তন হয়। অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যটিও এখান থেকে চলে যাবে। আমি তার প্রত্যাগমনের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ঠিক দশটার সময় সে অপর প্রহরীকে ঘুম থেকে তুলে দেয়ার জন্যে চলে গেল। এ সুযোগে আমি দ্রুত পোস্ট পার হয়ে ক্যাম্পের মাত্র পঞ্চাশ গজ ব্যবধানে পিঠ থেকে মিসাইল নামালাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শান্ত হয়ে ধীর-স্থিরভাবে একটি উপযুক্ত স্থানে মিসাইল স্থাপন শেষে শুয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। দেখলাম, প্রায় পনের মিনিট পর অপর প্রহরী এসে হাজির। ঘুমে তার শরীর টলমল করছিল। সেও আমাকে দেখতে পেল না।
আমার কাজ ছিল খুব দীর্ঘ। রাত দেড়টার সময় সব কাজ শেষ করলাম। এবার দুটা বাজার অপেক্ষা, যাতে আবার পাহারাদার বদলের সুযোগে পোস্ট অতিক্রম করে ঘাঁটিতে ফিরে যেতে পারি।
ঠিক দুটার সময় পাহারাদার পরিবর্তন হল। এ সুযোগে আমি দ্রুত বেরিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে সাথীদের কাছে পৌছে যাই। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে সঙ্গে নিয়ে অতি সাবধানে নিরাপদ পথে আবার বেরিয়ে পড়ি।
ঘুমে সকলের চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। পার্শ্ববর্তী এক জঙ্গলে পৌছে ঝোপের মধ্যে তাদেরকে শুয়ে থাকতে বললাম। সময়টা ছিল রাতের শেষ প্রহর। সেনাক্যাম্প আমাদের একেবারে সামনে।
এবার অপেক্ষা, সূর্য কখন উদয় হবে আর তার প্রথম কিরণ মিসাইলের উপর প্রতিফলিত হবার সাথে সাথে মিসাইল ক্যাম্পের উপর আঘাত হানবে।
অপেক্ষার প্রহর এক সময় শেষ হল। পূর্ব আকাশে সূর্য উদয় হবার পর কিরণ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিসাইল গিয়ে সোজা সেই ব্যারাকের উপর আঘাত হানে, যাকে আমি টার্গেট বানিয়েছিলাম। একটি বিস্ফোরিত হয় ব্যারাকের এক কোণে, অপরটি ঠিক মধ্যখানে।
প্রচণ্ড বিস্ফোরণে গোটা ক্যাম্প প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মিসাইল দুটোতে তেল আর পেট্টোল ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। ব্যারাকটিও ছিল কাঠের তৈরি। ফলে বিস্ফোরণের সাথে মুহুর্তের মধ্যে ব্যারাকে আগুন ধরে যায়।
দুশমনের ক্যাম্পে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে মুজাহিদরা আবেগাপ্লুত হয়ে নারায়ে তাকবীর শ্লোগান দিতে শুরু করে। বহু কষ্টে আমি তাদেরকে থামালাম। তারপর ওয়ারলেস মারফত ক্যাম্পের খবর নেয়ার চেষ্টা করি। এক পর্যায়ে শুনতে পেলাম, ক্যাম্পের এক সেনা-অপারেটর সোগাম ক্যাম্পকে খবর দিচ্ছে আমাদের উপর আযাব নেমে এসেছে। ক্যাম্প পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেছে। এখন আমাদেরকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করুন; অতি শীঘ্র উদ্ধারকারী গাড়ী পাঠিয়ে দিন।
এর অল্পক্ষণ পরেই দেখতে পেলাম, সতেরটি গাড়ীর বহর ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে। আমার ওয়ারলেস সেট অন করা। তাতে আমাদের অভিযানের আলোচনাই হচ্ছিল। আমাদের শুনতে বড় সাধ ছিল যে, কতজন সৈন্য মারা পড়েছে।
খানিক পরে সেট মারফত মৃতের সংখ্যাও জানতে পারলাম। সংবাদটা হেড অফিসকে জানাল যে, এ দুর্ঘটনায় ৪০ জন সৈন্য মারা গেছে। কারো আহত হবার খবর পেলাম না। পরদিন পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীরা গুনে গুনে সেই ৪০ টি লাশ ট্রাকে তুলে দেয়।
ডিভিশনাল কমাণ্ডার মাজেদ জাহাঙ্গীর ওয়ারলেস মারফত আমাদেরকে অনতিবিলম্বে লোলাব ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যাওয়ার আদেশ দিলেন। আদেশ মোতাবেক আমরা অন্যত্র রওনা হই। পথে মাজেদ ভাইও এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হল। এ সফল অপারেশনের পুরস্কার স্বরূপ তিনি আমাদের গ্রুপকে মোটা-তাজা একটি খাসী কিনে দেন। খাসিটি যবাই করে আমরা তৃপ্তি সহকারে আহার করলাম এবং বিজয়ের আনন্দ উদ্যাপন করলাম।
অবরুদ্ধ ভাইদের উদ্ধার অভিযান।
এরপর কয়েকদিন আমরা জঙ্গলের গোপন বাংকারে অবস্থান করি। এ সময়ে আমরা প্রতিদিন ফজর নামায আদায় করার পর এলাকায় গিয়ে সকালের নাস্তা করতাম।
একদিন ফজর নামায আদায় করে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্যে আমাদের কাশিরী মুজাহিদ সাথী শমবাবাকে গ্রামে পাঠালাম। শমবাবা অত্যন্ত সাহসী মুজাহিদ। নিবাস কাশ্মীরের কেরালাপুরায়। মাথায় লম্বা লম্বা চুল, তাকেও এখন শের খানই মনে করা হয়। ভারতীয় সৈন্যরা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু দুর্ধর্ষ এই বীর মুজাহিদ ওদের ধরা-ছোয়া ও কলা-কৌশলের বাইরের লোক।
যা হোক শমবাবা কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে সংবাদ দিল যে, ভারতীয় সৈন্যদের বিশাল এক বাহিনী বানের স্রোতের মত পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঢুকে পড়েছে।
এ খবর শুনে আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। আমাদের দু’জন সাথী ঐ গ্রামে কয়েকজন মুজাহিদের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিল। আমার বুঝতে আর বাকী রইল না যে, ওরা সকলেই সৈন্যদের ঘেরাওয়ে আটকা পড়েছে।
কিছুক্ষণ পর খবর যা পেলাম, তাতে তা-ই সত্য প্রমাণিত হল। হরকাতুল আনসারের জেলা কমাণ্ডার আবু উবায়দা ভাই আমাকে ওয়ারলেস মারফত জানালেন যে, আমরা বারোজন মুজাহিদ এক স্থানে আটকা পড়ে আছি এবং ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আপনার কিছু করা সম্ভব হলে করুন।
গ্রামে আটকেপড়া সাথীদের চারজন হিজবুল মুজাহিদীনের সদস্য আর বাকীরা হরকাতুল আনসারের। পরিস্থিতি ছিল বড়ই সঙ্গীন। এ খবর আমাদের সুপ্রীম কমাণ্ডারের কানে গেলে তার পক্ষ থেকেও আমাকে আদেশ করা হল, যেভাবে হোক, আটকেপড়া মুজাহিদদের ভারতীয় সৈন্যদের কবল থেকে উদ্ধার কর।
আমার গ্রুপে মুজাহিদ ছিল খুব কম। ওয়ারলেস মারফত আশে-পাশের অন্যান্য সব কয়টি সংগঠনের কাছে সাহায্যের আবেদন জানালাম। অত্র অঞ্চলে যে কয়টি মুজাহিদ সংগঠন আছে, তারা পরস্পর সহানুভূতি ও সহযোগিতার জন্যে সম্মতি জানালে আমি সকলকে বলে দিলাম, যে কয়টি স্থানের সৈন্যদের ভেতরে প্রবেশ করার পথ আছে, তার সবকটিতেই যেন তারা ওঁৎ পেতে বসে থাকে।
আমি সাকেব ভাটের নেতৃত্বে ছোট একটি গ্রুপকে অবরুদ্ধ এলাকার পেছন দিকে পাঠিয়ে দিলাম, যাতে এ পথে আর কোন সৈন্য ভিতরে ঢুকতে না পারে।
সোগাম এবং চণ্ডিগ্রাম ক্যাম্পসমূহের রাস্তায়ও পাহারার ব্যবস্থা করলাম।
এ ছাড়া টকিপুরা এবং লালপুরার মুজাহিদদেরকে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান নিতে বলে দিলাম।
এখন অন্ততঃ এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, অবরোধকারী সৈন্যরা বাইরে থেকে আর সাহায্য পেতে সক্ষম হবে না। কিন্তু অবরোধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের সংখ্যাও প্রায় দু’হাজার। দু’জন কর্নেল তাদের কমাণ্ড দিচ্ছিল।
অবরুদ্ধ মুজাহিদরা যে ঘরে ছিল, তাও সৈন্যদের জানা ছিল। ফলে গ্রামে ঢুকেই তারা সোজা সেই ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে ভেতরে থেকে মুজাহিদরা ফায়ারিং শুরু করে দেয়। ভারতীয় সৈন্যরা মুজাহিদদের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
কিছুক্ষণ পর দশজন সাথী নিয়ে আমি তাদের মাত্র একশ’ গজ ব্যবধানে পৌছে গেলাম। খানিকটা উপরে এক জঙ্গলে পজিশন নিয়ে অবরুদ্ধ মুজাহিদদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। তাদেরকে একথা বলে দেয়ার প্রয়োজন ছিল যে, তারা যেন একত্রিত না থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তা আর সম্ভব হল না।
এবার আমাদের দিকেও মর্টারের গোলা আসতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার সাথীদেরকে সৈন্যদের উপর ফায়ার করার আদেশ দেই। আমি নিজে পিকাগান ও গ্রেনেড লাঞ্চার দ্বারা ফায়ার করতে শুরু করি।
এবার দিশেহারা হয়ে সৈন্যরা আমাদের দিক এলোপাতাড়ি গুলী ছুড়তে শুরু করে। কিন্তু তাদের সব গুলী আমাদের পরিবর্তে জঙ্গলের গাছে গিয়ে আঘাত হানে। দুপুর দুইটা পর্যন্ত তাদের বেশীর ভাগ ফায়ার জঙ্গলের দিকে এসে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এবার তাদের ধারণা হল, আমরা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছি। কিন্তু মহান আল্লাহর অসীম মেহেরবানীতে তারা আমাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারেনি। উল্টো আমাদের সাথীরা যে ঘরে অবরুদ্ধ হয়েছিল, তার পাশের সৈন্যদের অবস্থান ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। ফলে সাথীরা বের হয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
অপর দিকে ওয়ারলেস মারফত শুনতে পেলাম, সৈন্যরা তাদের অফিসারদেরকে বলছে যে, তারা মুজাহিদের চাপের মুখে সারেন্ডার করতে যাচ্ছে।
জবাবে অফিসার বলছে, “তোমাদের লজ্জা করছে না, মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুজাহিদের কাছে সারেন্ডার করার কথা মুখে আনছ।
এ সব কথোপকথন আমার অতি নিকটেই হচ্ছিল। অনুমান করলাম যে, এবার তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, লড়াই করার শক্তি আর তাদের নেই।
দিনের শেষ প্রহরে আবু উবায়দা ভাই ওয়ারলেস মারফত আমাকে খবর জানালেন, চারজন মুজাহিদ শহীদ হয়েছে। তাদের দু’জন হরকাতুল আনসারের, আর দু’জন জমিয়তুল মুজাহিদীনের। বাকীরা সকলে নিরাপদ রয়েছে।’
আমি তাকে বললাম, ঠিক সন্ধ্যার সময় আবার হামলা করব, তখন আপনি বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবেন।
পরিকল্পনা মোতাবেক সন্ধ্যা ছ’টার সময় আমরা সৈন্যদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালাম। কিন্তু সাথীরা অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হল না। সাড়ে সাতটার সময় আবার হামলা করলাম। এবার সব ক’জনই নিরাপদে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হল।
পরদিন সকালে ভারতীয় সৈন্যরা নিহতদের লাশ এবং আহতদের তুলে নিতে শুরু করে। এ অভিযানে একজন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন এবং বত্রিশজন সৈন্য নিহত হয়। তাদের হেলমেট, বুট ও রাইফেলের ম্যাগজিন গ্রামের আশে-পাশে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে ছিল।
আমাদের মিশন সমাপ্ত হওয়ায় ওয়ারলেস মারফত সাথীদেরকে নিকটবর্তী একস্থানে জড়ো হবার আদেশ দিলাম। কিন্তু তারা আগেই পাশের একটি গ্রামে। চলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাদের দেখা না পেয়ে আমরা সামনে অগ্রসর হতে শুরু করি।
তখন প্রায় মধ্য রাত। আমরা গ্রামের একটি রাস্তা দিয়ে পথ অতিক্রম করছি। পার্শ্ববর্তী একটি দোকানের ছাদে কয়েকজন সৈন্য বসা ছিল। অন্ধকারে আমি তাদেরকে চিনতে পারিনি। কাছে গিয়েই একজন সৈন্যের কাঁধে হাত রেখে সজোরে চাপ দিলাম। কিন্তু সে একটুও নড়াচড়া করল না। আমি উচ্চস্বরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?
সে বলল, আমি একো কোম্পানীর লোক।।
শুনে আমি চমকে উঠি। ভাবলাম অন্যদেরকে অবরোধ থেকে উদ্ধার করে এবার নিজেই বুঝি অবরোধে ধরা দিলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে আমি সাহসের সাথে বললাম, একো কোম্পানীর লোক হলে তুমি এখানে স্থিরভাবে বসে থাক।
সৈন্যটি করুণ সুরে বলল, ঠিক আছে স্যার।’
এরপর বিলম্ব না করে আমি দ্রুত জঙ্গলের দিকে চলে এলাম। সৈন্যটি মনে করেছিল, আমি তাদেরই অফিসার।
সে রাতটা আমরা বরফের উপর বসে বসে জেগে কাটিয়ে দেই। ভোের হলে মাজেদ জাহাঙ্গীর ভাই ও সুপ্রীম কমাণ্ডারের সাথে আমাদের যোগাযোগ হল। তারা আমাদের এ সফল অভিযানের জন্যে সীমাহীন আনন্দ প্রকাশ করেন। এছাড়া দশ হাজার রুপি, এক হাজার রাউণ্ড গুলি এবং তিনটি মিসাইল পুরস্কার
দিয়ে তারা আমাদেরকে আরো বীরত্ব প্রদর্শনের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন।
রমযান মাসের সফল অভিযান।
আমরা পবিত্র রমযান মাসে রোযা রাখা এবং জিকির-আজকারে সময় কাটানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। বরফপাত এবং শীতের তীব্রতা এখনো কমেনি। আমি জেলা কমাণ্ডার তাহের এজাজ ভাইকে দাওয়াত করলাম, যেন রমযানের কয়েকটা দিন তিনি আমাদের সাথে অতিবাহিত কর।
রমযানের ৭ তারিখে তিনি এবং ব্যাটলিয়ন কমাণ্ডার আবদুল আকবর ভাই আমাদের ক্যাম্পে আগমন করেন। পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে তাঁদের জন্য ইফতারীর আয়োজন করা হল। এশার নামাযের পরে তাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মেহমানদের কোথায় রাখবেন?
বললাম, জঙ্গলে।
তাঁরা বলল, বরফ খুব বেশী আর রাতও হয়ে গেছে অনেক। আমরা এখানেই থেকে যাই।’
কিন্তু লোকালয়ের এই বিপদসংকুল স্থানে তাদেরকে রাখতে আমি অপারগতা প্রকাশ করলাম। অগত্যা তারা জঙ্গলের দিকে রওনা হল। রাত সাড়ে দশটায় আমরা আমাদের গোপন ঠিকানায় উপনীত হলাম।
তাহের ভাই বললেন একটানা সফল অভিযানের পর এখন রমযান মাসের এ বাকী দিনগুলো আপনার আরামে কাটানো দরকার। পাঁচদিন তারাও আমাদের সঙ্গে অতিবাহিত করলেন।
আমাদের আরো কয়েকটা দিন বিশ্রাম করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যদের তা সহ্য হল না। কে একজন তাদেরকে জানিয়ে দিল যে, তাহের এজাজ অমুক ক্যাম্পে শের খানের সাথে আছেন। আমাদের ইন্টেলিজেন্সও সঙ্গে
সঙ্গে আমাদের অবহিত করলেন যে, আপনার গোপন আস্তানা এখন আর ‘গোপন’ নেই। কাজেই দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
খবর শুনে আমরা রাতারাতি মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্র ও অতি প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সঙ্গে করে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে রওনা হলাম। আমার কয়েকজন সাথী তাহের ভাইয়ের সঙ্গে দূরবর্তী এক আস্তানায় চলে যায় আর আমি অন্যান্য সাথীদের নিয়ে অন্য একদিকে রওনা হই।
দিনটি ছিল রমযান মাসের তের তারিখ । বেশ কিছু পথ অতিক্রম করে আমরা শামরিয়াল নামক এক গ্রামে উপস্থিত হই। এখানে রাতের খানা খেলাম। সাহরী খাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, সামনের ছোট্ট নদীটি পার হয়ে ওপারে গিয়ে বিশ্রাম করব ও সাহরী খাব।
নদীর কূলে গিয়ে দেখতে পেলাম, প্রচন্ড শীতের কারণে পানির উপরিভাগ জমে গেছে। ভাবলাম, জমাটবাধা পানির আস্তরের উপর দিয়ে হেঁটেই আমরা নদী পার হতে পারব। সকলের আগে ফয়সাল ভাই সাহসিকতার সাথে নদীতে পা রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে পানির জমাট আস্তর ভেঙ্গে তিনি গলা পর্যন্ত ডুবে যান।
আমরা বড় কষ্টে তাকে উদ্ধার করে আনলাম। তারপর সকলে মিলে পরামর্শ করে নতুন পদ্ধতিতে নদী পার হয়ে চা-নাস্তা খেলাম। শীতের তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পেলে একটি সড়কে গিয়ে পৌছলাম, যে সড়ক দিয়ে ভারতীয় সৈন্যরা
অবাধে চলাফেরা করে থাকে। শত্রুবাহিনী এ পথেই আমাদের আস্তানায় হানা দিতে যাবে বলে আমার ধারণা। মনে মনে আমি তাদেরকে মুজাহিদ হত্যার মজা দেখানোর এই পরিকল্পনা নেই, যা অন্যান্য সাথীরা জানত না।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমি রাস্তার উপর থেকে বরফ সরিয়ে এবং রাস্তার নীচে মাটি খুঁড়ে কয়েকটি মাইন পুঁতে রাখলাম। দু’জন সাথী ছাড়া আর কেউই এ খবর জানতে পারেনি। মাইনের সাথে রিমোট-সিস্টেমও স্থাপন করে রাখি।
অবশেষে পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে গিয়ে আমরা সাহরী খেয়ে পুনরায় জঙ্গলের দিকে রওনা হলাম। বরফের আস্তর তখন চার ফুট উঁচু। আমরা এই বরফের উপরই ফযর নামায আদায় করে নেই। তারপর সেখান থেকে একটু উপরে গিয়ে গাছের আড়ালে বসে শত্রুর আগমনের অপেক্ষায় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
ভোর পাঁচটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত আমরা ভারতীয় সৈন্যদের গাড়ীর অপেক্ষা করতে থাকি। আমার ধারণা মতে তাদের এ পথে আমাদের আস্তানায় হানা দিতে যাবার কথা।
তিনটার পর হঠাৎ দেখতে পেলাম, সৈন্যরা আমাদের আস্তানায় হানা দেয়ার জন্যে ধেয়ে যাচ্ছে। সাথে তাদের দু’টি জীপ ও একটি বড় গাড়ী।
সাথীরা ইংগিতে ফায়ার করার অনুমতি চাইল। কিন্তু আসল রহস্য তাদের অজানা। আমি কেন ফায়ার করছি না বা তাদেরকে ফায়ার করার অনুমতি দিচ্ছি
তারা তা বুঝে ওঠতে পারেনি। বললাম, ধৈর্য ধর, এরা আমাদের ফেলে আসা আস্তানায় হানা দিতে যাচ্ছে। ফেরার পথে দেখবে মজা। •
আমরা বসে রইলাম, অপেক্ষা কখন ওরা ফিরে আসে। বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখতে পেলাম, ওরা ব্যর্থ অভিযানের আনন্দে উৎফুল্লচিত্তে ফিরে আসছে। একজন সৈন্য বাঁশি বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছে।
প্রথম আসল একটি জীপ। আমাদের টার্গেট অতিক্রম করে চলে গেল। আমি হাত সংবরণ করে রাখলাম। তাতে সৈন্য ছিল এক থেকে দু’জন। একজন গোয়েন্দা এবং একজন কর্নেলও তাতে ছিল। পরক্ষণে বড় গাড়িটি যেই মাত্র আমার পুঁতে রাখা মাইনের উপর এসে পৌছল, সঙ্গে সঙ্গে রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা বিস্ফোরণ ঘটালাম।
গাড়ীটি বিশ ফুট উপরে শূন্যে উঠে যায়। যে লোকটি বাঁশি বাজাচ্ছিল, তার অর্ধেক দেহ বাঁশিসহ ছিটকে একটি দেবদারু বৃক্ষের উপর গিয়ে আটকে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যে গাড়ীতে আরোহী আঠারজন সৈন্যের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি একটি গাছের উপর পড়ে যায়। জীপে আরোহণকারী বাকী চারজন্য সৈন্যও একই সাথে মারা পড়ে।
মাইনের রিমোট-সিস্টেমে একটি রিসিভার থাকে। আমি মাইন পুঁতে রিসিভারের সাথেও কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য রেখে দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, বিস্ফোরণের পর সৈন্যরা যখন তদন্ত করতে আসবে এবং রিসিভার ওঠানোর
চেষ্টা করবে, তখন তারাও যেন বিস্ফোরণের শিকার হয়।
বিস্ফোরণে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। নদীর ওপারের ক্যাম্প থেকে দ্রুত সৈন্যরা এসে যায়। খুঁজে খুঁজে তারা লাশ একত্র করতে শুরু করে। কয়েকজন সৈন্য অকুস্থলের এদিকে-ওদিকে ঘোরাফেরা করছিল।
অল্পক্ষণ পরেই তারা তা পেয়ে যায়। মাটি থেকে ওঠানোর পর আরো কয়েকজন সৈন্য তা দেখার জন্যে আশে-পাশে জড়ো হয়। রিসিভারের সাথে এক কিলোঃ বারুদ রেখে দিয়েছিলাম। মাইন পেয়ে গেছে মনে করে সৈন্যরা সম্ভবত খুশিই হয়েছিল।
আরো কয়েকজন সৈন্য তা দেখার জন্যে জড়ো হওয়া মাত্র আমি বোতামে টিপ দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার অভিপ্রায় অনুযায়ী পুনরায় প্রচন্ড বিস্ফোফণ ঘটে। আরো কয়েকজন সৈন্যের ইহলীলা সাঙ্গ হয়। আমাদের এ সফল
অভিযানে শত্রুদের ক্যাম্পে শোকের ছায়া নেমে আসে।
আবার অবরুদ্ধ অবস্থায় সাথীদের নিয়ে এবার আমি নিরাপদ অবস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সাবধানতার খাতিরে দূরের কোন এক লোকালয়ে গিয়ে ইফতার করার
সিদ্ধান্ত নেই। লোকালয়ে পৌছে আমরা ইফতার করে তাহের ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।
আমাদের কুশলাদি জেনে তাহের ভাই আমাদেরকে তাঁর কাছে চলে যেতে বললেন। কিন্তু তিনি তখনো আমাদের থেকে অনেক দূরে থাকায় আমরা সেদিকে না গিয়ে পার্শ্ববর্তী আস্তানায় চলে গেলাম। এ সাফল্যের কারণে তাহের ভাই খুশী হয়ে আমার দলের মুজাহিদদের জন্যে দশ হাজার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেন।
এ অভিযানের পর আমরা দর্দপুরা থেকে ফলারোস চলে যাই। সেখানে প্রায় দশদিন বিশ্রাম করি। একাদশ দিবসে আমরা প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা। করছিলাম। ইত্যবসরে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে ফায়ারিং এর শব্দ আসতে শুরু করে। আমাদের কয়েকজন সাথী তখন উক্ত এলাকায় অবস্থান করছিল।
ওয়ারলেস মারফত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম, তারা ভারতীয় সৈন্যদের ফাঁদে আটকা পড়েছে। রাওলাকোটের আদেল ভাইয়ের তো পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছিল না।
আমার পেরেশানীর আর সীমা রইল না। আস্তানা অতিক্রম করে সাথীদের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম যে, রাস্তার উপর টহলদার সৈন্যরা সক্রিয় রয়েছে। এর অল্পক্ষণ পর হঠাৎ দেখতে পেলাম, আমাদের চারিদিকেও সৈন্য আর সৈন্য। অর্থাৎ- আমরাও অবরোধে পড়ে গেছি। অগত্যা একদিন একরাত পর্যন্ত অসহায়ভাবে ওখানেই পড়ে থাকতে হল।
সৈন্যদের সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, কোন প্রকারে বের হওয়ার সুযোগই পেলাম না। অপরদিকে আমার সাথীরা গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে। টানা একদিন এক রাত অপেক্ষার পর সৈন্যদের চাপ কিছুটা কমে আসলে আমিও সাথীদের সাথে মিলিত হলাম।
আদেল ভাইয়ের এখনো কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তাই ভারতীয় সৈন্যদের উপর আমার মনে প্রচন্ড ক্রোধের জন্ম হল। ওরা একদন্ডও আমাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।
সাথীদের প্রস্তুত হওয়ার আদেশ দিলাম। সৈন্যদের উপর আক্রমণ করে আদেল ভাইকে মুক্ত করে আনতে হবে। একটু সামনে অগ্রসর হওয়ার পর এক সাথী উচ্চস্বরে বলে উঠে, “ওই তো আদেল ভাই!
তাকিয়ে দেখি আদেল ভাই আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। কাছে আসার পর জানতে পারলাম, তিনিও একদিন পর্যন্ত জঙ্গলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। তাকে অক্ষত অবস্থায় পেয়ে শান্ত হলাম এবং আস্তানায় ফিরে চললাম।
পরদিন জেলা কমাণ্ডার তাহের এজাজ আমাকে ফলাবোস ত্যাগ করে টকিপুরা চলে যেতে বলল। সেখানে কী একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে বলে তিনি জানালেন।
আদেশ মত আমি টকিপুরা চলে গেলাম। তাহের এজাজ ভাই আমাকে সোগাম ক্যাম্পের উপর আক্রমণ করার আদেশ দিলেন। তাই সঙ্গীদের নিয়ে আবার সোগাম অভিমুখে রওনা হয়ে গেলাম।
আধাপথ অতিক্রম না করতেই খবর পেলাম যে, একজন জেনারেল চগ্রিাম ক্যাম্প পরিদর্শনে আসছে। সুতরাং আগে তাকে স্বাগতম জানানো প্রয়োজন। প্রথম প্রোগাম আপাততঃ মুলতবী করে সঙ্গে সঙ্গে আমি চণ্ডিগ্রামের দিকে রওনা হলাম ।
১৯৯৫ সালের ১৪ই এপ্রিল রাত আটটায় সাথীদের নিয়ে আমি ক্যাম্পের কাছে উপনীত হই। প্রথমে সাথীদেরকে বিভিন্ন পজিশনে বসালাম। তারপর চারজন মুজাহিদ আর দু’টি মিসাইল নিয়ে আমি নিজে ক্যাম্পের আরো কাছে চলে যাই। মিসাইল দু’টো ক্যাম্প থেকে দু’শ গজ ব্যবধানে স্থাপন করলাম।
রাত ঠিক দশটার সময় মিসাইলে টাচ দেয়া হল। একটি মিসাইল অ্যামুনিশন ডিপোর উপর গিয়ে আঘাত হানে। আর দ্বিতীয়টি আঘাত হানে সৈন্যদের আবাসিক ব্যারাকে।
প্রচণ্ড বিস্ফোরণের উভয় স্থানেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। পরে জানতে পারলাম যে, আমাদের এ অভিযান অত্যন্ত সফল হয়েছে। ওয়ারলেস মারফত আমরা চন্ডিগ্রামের খবর সংগ্রহ করলাম, যা ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টারকে প্রদান করা হচ্ছিল। ক্যাম্পে প্রচন্ড হামলা হয়েছে। বিস্ফোরণে বহু সৈন্য মারা গেছে। ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়ে আছে অসংখ্য সৈন্য। কাজেই
অনতিবিলম্বে সাহায্য পাঠানো হোক।’
একদিকে ব্যারাক বিধ্বস্ত হওয়ায় গোটা ক্যাম্পের সব সৈন্য ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়ে গেছে। অপরদিকে অ্যামুনিশন ডিপো থেকেও লাগাতার বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। এসব তামাশা আমরা সরাসরি প্রত্যক্ষ করছিলাম। বড় মজা লাগছিল তখন।
দু ঘন্টা পর সাহায্য নিয়ে সেখানে গাড়ীর বহর এসে পৌঁছে। পরে ওয়ারলেস মারফত জানতে পারলাম যে, আমাদের এ অভিযানে চল্লিশজন সৈন্য নিহত এবং সত্তরজন গুরুতর আহত হয়েছে। তাহের এজাজ এ সফল হামলার জন্যে অভিনন্দন জ্ঞাপন ছাড়াও আমাদের জন্য পঁচিশ হাজার রুপী পুরস্কার ঘোষণা করেন।
কয়েকদিন বিশ্রাম নেয়ার পর তাহের এজাজ ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম, সংগঠন আমাকে আযাদ কাশ্মীর চলে যাবার আদেশ করেছে। আমি এ আদেশ সানন্দে পালন করে কয়েকদিন পরই নিরাপদে আযাদ কাশ্মীর চলে আসি।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন