৩. কমাণ্ডার শামশীর খান

৩. কমাণ্ডার শামশীর খান

পদে পদে আল্লাহর নুসরাত

কমাণ্ডার শামশীর খান ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের এক সিংহ-পুরুষ, দুর্ধর্ষ মুজাহিদ কমান্ডার। আফগান জিহাদের পোড়খাওয়া এ মুজাহিদ কাশ্মীরে প্রত্যাগমন করে বেশ কিছু সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। তার এ কৃতিত্বের দরুন তাকে দক্ষিণ কাশ্মীর তথা জম্মুতে জিহাদের তৎপরতা বিস্তৃতি, সেখানকার মুজাহিদদের সংগঠিত করা, ট্রেনিং প্রদান প্রভৃতির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ দায়িত্ব পালনকালে কমাণ্ডার শামশীর খান ভারতীয় বাহিনীর সাথে যেসব সংঘর্ষে লিপ্ত হন, তারই ঈমানদীপ্ত কাহিনী শামশীর খানের নিজের ভাষায় এখানে বর্ণিত হয়েছে।

জম্মুর পথে যাত্রা

সুপ্রীম কমাণ্ডের নির্দেশ অনুযায়ী আমি নিজ অবস্থান থেকে কাশ্মীরের ইসলামাবাদ পৌছলাম। এখানে একজনের সাথে আগেই সাক্ষাত করার কথা ছিল। তিনি জম্মু যাবেন। কিন্তু আমাদের মিশন ভিন্ন। তাঁর সাথে দু’ঘন্টা

আলোচনা করে কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌছি। এরপর তিনি জম্মুর পথে যাত্রা করেন। তিনি যাবেন বাসে আর আমি যাব বরফাবৃত পর্বতচূড়া, জঙ্গল ও নদী নালা পেরিয়ে বন্ধুর পথ ধরে।

ঘনিষ্টজনদের থেকে বিদায় নিয়ে এক লোকালয়ে পৌছলাম, যেখানে গাইড আমার অপেক্ষায় ছিল। সে পূর্ণ প্রস্তুত। অ্যামুনিশন ও খাদ্য-পানীয় কাঁধে নিয়ে গন্তব্যের পথে পা বাড়ালাম। গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কয়দিনে জম্মু প্রদেশে পৌছতে পারব?

বলল, “চারদিন তো লাগবেই।’

এর চেয়ে কম সময়ে পৌছা যায় না?

গাইড বলল, যাবে ঠিকই, কিন্তু সে পথ বড় দুর্গম। পথে পথে উঁচু উঁচু পর্বত ও অসংখ্য গভীর খাদ। আপনি বললে সে পথই ধরব। তাতে একদিন আগেই আমরা জম্মুর সীমান্তে পৌঁছে যাব।’

বললাম, কোন অসুবিধে নেই, দুর্গম পথেই আমরা চলব। আর কষ্ট-ক্লেশ, সে তো জীবনসঙ্গী। আল্লাহ আমাদের মদদগার হলে কষ্টের ভয় কি আর।।

দুর্গম পথে দু’দিন আমাদের যাত্রা চলল। দিন রাত সমানে শুধু পথ চলা। বরফাবৃত চূড়া, ঘন জংগল ও গভীর নদী পেরিয়ে শুধুই সামনে চলা। শীত, পানি প্রবাহ পেরিয়ে ওপারে যেতে মনে হত যেন রক্ত হীম হয়ে গেছে। আবেগের উত্তাপে তবুও পা থামে না।

অস্তগামী সূর্যের কিরণে ঝিকমিক করছে বরফঢাকা পাহাড়ের চূড়া। এমন। সময়ে গাইড এক সুখবর দিল, ঐ চূড়ার ওপাশেই সীমানা।

এ কথা শুনতেই আমার ক্লান্ত-শ্রান্ত অবশ পা সতেজ হয়ে ওঠে। দ্রুত অগ্রসর হতে থাকি। তিন-চার ঘন্টার মধ্যে আমরা বরফঢাকা দুর্গম পাহাড় অর্ধেক পেরিয়ে যাই। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। তাই আমরা যত শীঘ্র সম্ভব জম্মু সীমান্তে পৌঁছতে চেষ্টা করছিলাম ।

হঠাৎ আকাশ মেঘে ছেয়ে যায়। প্রথমে বৃষ্টি, এরপর তুষারপাত। গাইড আকাশ পানে তাকিয়ে বলল, “আবহাওয়া মোটেই সুবিধেজনক নয়। অন্ধকার ক্রমে গাঢ়তর হচ্ছে। এভাবে প্রচণ্ড বরফপাতের সাথে তীব্র হাওয়া বইলে শীতের প্রকোপে পথেই আমাদের ইহলীলা সাঙ্গ হবে।’

আমি বললাম, থামলে চলবে না; সামনে অগ্রসর হতে হবে। সীমান্তের নিকটে পৌঁছে হিম্মতহারা হওয়া মঞ্জিলে পৌছে ফেরৎ যাওয়ার নামান্তর নয় কি?

গাইড তো আর আমার মত আবেগদীপ্ত নয়। তাই বলল, “আজ ফিরে চলুন, বাকী পথ আগামীকাল পাড়ি দেব। এমতাবস্থায় পর্বত চূড়ায় উঠলে মৃত্যু

সুনিশ্চিত। তখন মঞ্জিল হাতছানি দিয়ে ডেকেও আমাদের পাবে না।’

শেষে গাইডের কথাই মানতে হল। এবার আরোহণের বদলে অবতরণের পালা। ক্ষণিক পরেই আমরা এক গ্রামে পৌছে একটি বাড়ীতে উঠলাম। রাতটা ওখানেই কাটালাম।

ভূয়া মুজাহিদদের অপকীর্তি। খুব ভোরে পুনরায় সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় এক ব্যক্তি বলল, ‘এ গ্রামে ‘আল-ফাতাহ’ নামে একটা সংগঠন একজন ফরাসী ইঞ্জিনিয়ারকে অপহরণ করে বন্দী করে রেখেছে।

কথাটা শুনেই চমকে উঠলাম। আমার জানা মতে কাশ্মীরে আল-ফাতাহ নামের কোন সংগঠন নেই। এ সব ভূয়া সংগঠন মুজাহিদদের জন্যে একটা মাথা ব্যথা হয়ে দাড়িয়েছে। বেকারগোষ্ঠী ও ভারতীয় এজেন্টরা মুজাহিদদের ছদ্মবেশে এভাবে হীনস্বার্থ উদ্ধার করে চলছে।

সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের জোরে জনগণের পয়সা লুটে আর পথিকদের বিপাকে ফেলে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এ অপকর্ম ঐ গ্রুপেরই হবে। এরা উক্ত ইঞ্জিনিয়ার থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ নিয়ে তাকে ছেড়ে দেবে।

তবে এসব অপকর্ম সরকারী এজেন্টদের হাতে বেশী ঘটে থাকে। সারা বিশ্বে কাশ্মীর জিহাদ ও মুজাহিদদের দুর্নাম রটাতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে। বিশ্ব জনমত মুজাহিদদের বিপক্ষে চলে যাওয়ার আশঙ্কা হচ্ছিল। তাই সমস্ত মুজাহিদ সংগঠন এ ধরনের অপতৎপরতায় জড়িত সমস্ত লোকদের নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নেয়।

গাইডকে বললাম, জম্মু পৌছার আগেই সমস্যার একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। আমি দেখতে চাই, ইঞ্জিনিয়ারকে যারা অপহরণ করেছে তারা কারা।

গাইড বলল, “ইঞ্জিনিয়ারকে যারা অপহরণ করেছে, তারা খুবই শক্তিশালী এবং সংখ্যায়ও অনেক। আর আপনি একা। তাই এ বিষয়ে জড়িত না হওয়াটাই উত্তম।

বললাম, প্রয়োজনে, এখানে মুজাহিদ সংগঠনের সাহায্য নেয়া হবে।

অপহরণ করে ইঞ্জিনিয়ারকে যে গ্রামে রাখা হয়েছে, সে গ্রামের দূরত্ব এখান থেকে অন্ততঃ দশ মাইল। তাই পায়ে হেঁটে চললাম। সে গ্রামের পথে গাড়ীর ব্যবস্থা নেই।

মাইলখানেক চলার পর পেছন হতে দু’টি ছোট ট্রাক আসতে দেখা গেল। ভয় হল, এরা আবার আর্মি কিনা। তাই সড়ক ছেড়ে পাশ দিয়ে চলতে থাকি। গাড়ী নিকটে এলে দেখলাম, তারা মুজাহিদ। ইঙ্গিত করতে তারা গাড়ী থামায়।

উভয় গাড়ীতে আনুমানিক সত্তরজন মুজাহিদ হবে। কমাণ্ডার আমার অতি পরিচিত। গাড়ী থামতেই তিনি লাফ দিয়ে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন, বিশেষ কোন মিশন আছে কি?

বলল, এটা রুটিন মাফিক টহল।’ আমি তাকে বললাম, বিশেষ প্রোগাম না থাকলে আমার সঙ্গে চলুন।

তাকে ইঞ্জিনিয়ারের অপহরণের ঘটনা বললাম। এ সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তারও জানা মতে কাশ্মীরে আল-ফাতাহ নামের কোন সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। নিশ্চয়ই দুষ্কৃতিকারীরা সরকার থেকে পয়সা মারার জন্যে এটা করেছে।

আমি ইঞ্জিনিয়ারকে উদ্ধারের সকল্প ব্যক্ত করে বললাম, আপনি সাহায্য করলে কাজটা সহজ হত।

কমাণ্ডার খুব উৎফুল্ল চিত্তে আমার প্রস্তাবে সায় দিলেন। গাড়ীতে চড়েই আমরা দ্রুত গন্তব্য পথে চললাম।

‘আল-ফাতাহ’র আস্তানায়

যে গ্রামে ইঞ্জিনিয়ারকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, আমরা তার থেকে এক কিলোমিটার আগেই গাড়ী ছেড়ে পায়দল গ্রামে পৌছলাম। গ্রামের বাইরে কিছু লোকের সাথে দেখা। তথ্য নেয়ার জন্য তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এ গ্রামে কি কয়েকজন মুজাহিদ এসেছিল?’ .

তারা অজ্ঞতা প্রকাশ করে। তাদের কথার ভঙ্গিতে বুঝলাম, কিছু গোপন। করছে তারা। আমি তাদের আস্থাভাজন হয়ে বললাম, এখানে অবস্থানরত লোকগুলো মুজাহিদ নয়। তারা তো দুষ্কৃতিকারী। মুজাহিদদের দুর্নাম রটানোর জন্যে তারা ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। তারা এক নিরপরাধ ব্যক্তিকে অপহরণ করে এ গ্রামে বন্দী করে রেখেছে। আমরা মুজাহিদ, নিরপরাধ লোকটিকে আমরা মুক্ত করতে চাই। আপনারা আমাদের সাহায্য করুন এবং যে ঘরে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, সে ঘরটি দেখিয়ে দিন। মুজাহিদদের নাম ও আমাদের কথা শুনে লোকটি নিশ্চিত হয়। অতঃপর বলল, এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। অপহরণকারীরা নিজেদের মুজাহিদ বলে দাবী করছে। এ জন্যে তারা এখানে আশ্রয় পাচ্ছে।

এরপর তারা সে ঘরটি দেখিয়ে দেয়, যে ঘরে ইঞ্জিনিয়ারকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।

দশ মিনিটের মধ্যে আমরা ঘরটি ঘিরে ফেললাম। এখানে নিরাপত্তামূলক কোন ব্যবস্থা চোখে পড়ল না। এটা এ গ্যাংয়ের অপরিপক্কতারই পরিচায়ক। মুজাহিদরা। যে কোন পদক্ষেপ নিলে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা করে থাকে।

ঘেরাও করার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কয়েকটা ফাকা গুলী করি। এরপর ওই ঘরবাসীদের বলি যে, তোমরা এখন অবরুদ্ধ। বাঁচতে চাইলে হাত উঁচিয়ে বেরিয়ে এস।

ক্ষনিক পর সবাই হাত উঁচিয়ে বেরিয়ে এল। তারা সংখ্যায় সাতজন। ইঞ্জিনিয়ারও তাদের সঙ্গেই আছেন। মুজাহিদরা এ দুস্কৃতিকারীদের পিটুনি শুরু করে। আমি তাঁদের বাধা দিয়ে বললাম, এদের না পিটিয়ে বরং বন্দী কর। এমন শিক্ষা এদের দিতে হবে, যাতে আর কারও ক্ষতি করতে না পারে।

এরপর দু’জন মুজাহিদ ঘরে ঢুকে সবকটা অস্ত্র কজা করে নেয়। আমাদের দেখে ইঞ্জিনিয়ার ভয়ে থর থর করে কাঁপছেন। তার এ অবস্থা দেখে মনে ব্যথা পেলাম আর দুষ্কৃতিকারীদের প্রতি মনটা বিষিয়ে উঠল। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে তারা কেন এমন পেরেশান করল। ইঞ্জিনিয়ারকে বড় বিমর্ষ দেখাচ্ছে। হয়ত সে ভেবেছে, এবার কোন বড় ধরনের দুষ্কৃতিকারীর হাতে পড়েছে। জীবনের আশা আর নেই।

আমি অগ্রসর হয়ে তার সাথে কোলাকুলি করলাম। তার চোখের অশ্রু মুছে দিলাম। এতে সে আরো ঘাবড়ে যায়। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আপনি এখন নিরাপদ; আর কোন ভয় নেই।

কিন্তু তিনি কাশ্মিরী বা ইংরেজী ভাষা মোটেই বুঝেন না। আমি ইঙ্গিতে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আপনি এখন মুক্ত। আপনার কোন অনিষ্ট করা হবে না। কিন্তু তার ফ্যাকাশে চেহারায় আশংকার ছাপ এখনও স্পষ্ট দেখা যায়। হাড় কাঁপানো শীতে তার দাঁত ঠক্ ঠক্‌ করছে। এক মুজাহিদ নিজের ওভারকোট। খুলে তাকে পরিয়ে দেয়। এবার ইঞ্জিনিয়ার কিছুটা বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতা মিশ্রিত নয়নে আমাদের দিকে তাকান। আমরাও তার দিকে তাকিয়ে বন্ধুত্বের হাসি হাসলাম । এতে তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আকারে-ইঙ্গিতে এতক্ষণ চেষ্টা করেও যা বুঝাতে ব্যর্থ ছিলাম, এক মুজাহিদের ছোট্ট এক আন্তরিক ব্যবহার তা বুঝিয়ে দেয়। সে বুঝে নেয়, আমরা তার দুশমন নই- বরং বন্ধু।

এরপর ইঞ্জিনিয়ার অপহরণকারী চক্রকে সঙ্গে করে গতরাতে যে গ্রামে ছিলাম, সে গ্রামের পথে চললাম। গ্রামে পৌছে দেখি, আমার সঙ্গী মুজাহিদরা আগেই সেখানে পৌছে আমাদের অপেক্ষা করছে।

এ অপহরণকারী চক্রের দু’জন ভারতীয় সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশের সদস্য। উভয়ে শিখ। তাদের দাড়ী মুণ্ডানো। এর অর্থ এরা মৌন শিখ।

শিখ দু’জন বলল, তারা সোর্স সদস্য। ইদানিং দল ত্যাগ করেছে।

আমি বললাম, এ দু’জনকে পৃথক করা হোক। প্রথমে অন্যান্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা যাক। তারপর তাদের পালা।

আমি নামধারী ভূঁয়া মুজাহিদদের বললাম, সাফ সাফ বল, কে এ নিরপরাধ প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ারকে অপহরণ করেছে? লজ্জা হয় না তোমাদের, যে, হীনস্বার্থে সরকার থেকে কয়েকটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্যে আমাদের পবিত্র জিহাদকে বিশ্ববাসীর সামনে হেয় প্রতিপন্ন করছ?

কিন্তু তাদের দাবী, তারা ভূয়া নয়। তারা আল-ফাতাহ সংগঠনের সদস্য। সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেএ সব করেছে তারা।

আমরা ভাল করেই জানি যে, ভূঁইফোড় সংগঠনগুলোর জন্ম হয় এ সব অপকর্মের জন্যেই। হীনস্বার্থ হাসিলের জন্যে এরা নিজেদেরকে মুজাহিদ বলে জাহির করে। সাথীরা বলল, “এত সহজে এরা সত্য কথা প্রকাশ করবে না। অন্য পন্থা অবলম্বন করা হোক, তাতে গর্তের সাপ অল্প সময়ে বেরিয়ে আসবে।’

আমি বাধা দিয়ে বললাম, না, সোজা আঙ্গুলেই ঘি তুলব আজ।

অন্য সাথীদের বললাম, শিখ দু’ বন্দীকে বলে দাও যে মিথ্যা বললে অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন হবে।

এরপর শিখদের দিকে ফিরে পাঞ্জাবী ভাষায় বললাম, সরদারজী! ছাচ্ছি গল । কর তো জান ছড়া। (অর্থাৎ সত্য বল, তাহলে মুক্তি দেব)।

তারা বলল, আমরা ভারতভুক্ত পাঞ্জাবের অধিবাসী এবং সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশের সদস্য। কাশ্মীরে ভারতীয় নিপীড়ন আমাদের বিবেককে দংশন করে। ভাবলাম, পাঞ্জাবে ভারত সরকার শিখদের দমন করছে। এ দিকে আমরা এ জালিম শাসকের ক্রীড়নক হয়ে কাশ্মিরী ভাইদের উপর অত্যাচার করছি। তাই আমরা দুজন দলত্যাগ করে মুজাহিদদের সাথে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস! শেষে এ ভূয়া মুজাহিদদের ফাঁদে পড়ে গেলাম।

আজব কথা বললে সরদারজী ! স্বজাতির উপর নিপীড়ন দেখে বিবেকের দংশন অনুভব হয়নি, পাঞ্জাবে থাকতে বিদ্রোহ করলে না। কিন্তু কাশ্মীর পৌছেই তোমাদের বিবেক জেগে উঠল? এটা কেমন কথা সরদারজী! সত্য কথা বল।

আমার প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বলল না সে। ক্ষণিক পরে বলতে লাগল, ‘বিশ্বাস করুন আর না করুন, যা বলেছি সত্যই বলেছি।’

শেষতক তারা কিছু স্বীকার করছে না দেখে ওয়াকিটকিতে চীফ কমাণ্ডার সাহেবের সাথে যোগাযোগ করার পর এদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ হল।

ইঞ্জিনিয়ারের তিনটি শব্দ আমার বোধগম্য হয়। কাশতওয়াড়া, ফেমেলী ও ফ্রান্স। অর্থাৎ সে ফ্রান্সের অধিবাসী। তবে তার পরিবার রয়েছে কাশতওয়াড়ায়।

চীফ কমাণ্ডারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, ‘বন্দীদেরকে আমার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দাও। শরীয়া বোর্ড তাদের বিচার করবে। খেয়াল রেখ, তাদের যেন কোন কষ্ট না হয়। তাদের জন্যে পরিমাণ মত খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থা করবে। আর ইঞ্জিনিয়ারকে নিরাপত্তা প্রহরায় কাশতওয়াড়া রওনা করিয়ে দাও।

ইঞ্জিনিয়ারকে কাশতওড়া রওনা করিয়ে দেয়ার সময় আনন্দে তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে বারবার আমাদের জড়িয়ে ধরে। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আমাদের দেখতে থাকে। এপর ৭ জন দুস্কৃতিকারীকে চীফ কমাণ্ডারের ক্যাম্পে রওনা করিয়ে পুনরায় আমি জম্মুর পথ ধরলাম।

কুফরের সমুদ্রে কিছুক্ষণ কয়েকঘন্টা চলার পর আমরা ঐ চূড়া পার হই, বরফপাতের কারণে যেখান থেকে আমাদের ফিরে যেতে হয়েছিল। চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখলাম এক অপরূপ দৃশ্য। একদিকে কাশ্মীর উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় সারি সারি নয়নাভিরাম সুউচ্চ পর্বতমালা। অপরদিকে জম্মু উপত্যকা আর গাঢ় সবুজ গাছপালা। এ অপরূপ দৃশ্য দেখে দেখে হাজারো ছবি ভেসে উঠে আমার নয়নতারায়।

কাশ্মীরে চলছে নিপীড়ন-নির্যাতন ও প্রত্যয়-সাহসিকতার সংঘাত। অপরদিকে জম্মু প্রদেশ, যাকে সব সময় কাশ্মীরের তরবারী উঁচু করা বাহু বলা হয়, আজ সে বাহু নিথর। কল্পনার চোখে দেখলাম, বাহু সচল হয়ে উঠছে, তুলে নিচ্ছে পতিত দু’ধারী শামশীরখানা। দেখলাম, সে তরবারীখানা একের পর এক কেটে যাচ্ছে খুনীর ধমনী। আরো দেখলাম, জম্মুর তাওহীদি কাফেলা তরবারী হাতে জিহাদে ঝাপিয়ে পড়ছে। আর সাম্রাজ্যবাদী ভারত তার দানবীয় দেহটা নিয়ে উন্মত্ত জিঘাংসায় জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিচ্ছে ভূস্বর্গ কাশ্মীর উপত্যকা। দাউ দাউ করে জ্বলছে পুরো কাশ্মীর।

জম্মুর পথে এটা আমার তৃতীয় সফর। আগে গ্রুপ বেধে গিয়েছিলাম। কিন্তু এবার একাকী । অজানা পথে একাকী যেতে হবে। আমার সাথে অস্ত্র এবং গোলা বারুদও রয়েছে। এত কিছু নিয়ে সবার চোখকে ফাঁকি দেয়া বড়ই দুষ্কর। দ্বিতীয়ত, এ পথে হিন্দু অধিবাসীদের সংখ্যা বেশী। পদে পদে রয়েছে ফৌজ ও ইন্টেলিজেন্সের ফাঁদ। কিন্তু যে দায়িত্ব আমি নিয়েছি, যে মিশন সামনে রেখে ঘর ছেড়েছি, যার পথের পথিক আমি, তিনি নিঃসম্বল বান্দাদের একা ছেড়ে দেন না, তাঁরই অসীম রহমতের ছায়ায় এগিয়ে চলছি আমি।

পদে পদে আল্লাহর নুসরাতের বিশ্বাস যখন আপনার মনে আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি করবে, তখন আপনি হবেন এ ভূভাগের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তি। অজানা ভয়, শত্রু ও হিংস্র প্রাণী আপনার নিকট মনে হবে নিষ্প্রাণ। শত্রুর সুবিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে আপনি ভয় পাবেন না।

পর্বতচূড়া হতে নেমে আমরা সামনে চলতে থাকি। হালকা বরফপাত। হচ্ছিল। আমাদের কাপড় ভিজে যাচ্ছে। শীতে দাঁত ঠক ঠক করে কাঁপছে। এ সময় আমরা জঙ্গল দিয়ে হাঁটছি। মনে মনে মহান আল্লাহর নাম স্মরণ। করছিলাম। ঠাণ্ডায় হাত সঞ্চালন করাও দুষ্কর হয়ে দাড়ায়। গাইড বলল, প্রথম গ্রামটিই আমাদের মনযিল । গ্রামটি সম্পূর্ণ হিন্দু বসতী । গ্রামের মাঝখানে মুসলিম ঘর শুধু একটি। সবার অলক্ষ্যে ওই গ্রামের নিকটে পৌছলাম। পাহাড়ী উপত্যকার চেয়ে জম্মুর বসতী এলাকায় মুজাহিদদের বেশী ভোগান্তীর কারণ ও পরিমাণটা আন্দাজ করতে পারলাম। ঘন্টাখানেক চলার পর রাখাল ও গোয়ালদের পাহাড়ী বাড়ী-ঘরের নিকট পৌছলাম।

গাইড বলল, আমাদের মনযিল আর বেশী দূরে নয়। তবে অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে।’

প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে আত্মরক্ষার জন্যে গাইড কিছু কাঠ যোগাড় করে আগুন ধরায়। তাতে কাপড় শুকিয়ে নিলাম। আগুনের তাপে শরীরও সতেজ হয়ে উঠল। সাথে আনা রুটি ও মরিচ দিয়ে নাস্তা সারলাম।

রাত আটটায় অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলে গ্রামের পথ ধরি। গ্রামে তখন পিনপতন নীরবতা। বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকা লোকগুলোর বুক কাঁপার শব্দও শোনা যাচ্ছিল। খুব সতর্ক পদে মুসলিম ঘরের দ্বারে পৌছি। কুফরের সমুদ্রে ইসলামের দ্বীপ দেখে আনন্দে মন ভরে ওঠল। ভাবলাম, আল্লাহ পাক সবখানেই মুজাহিদের জন্যে সাহায্যের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

গাইড মেজবানের দরজায় মৃদু করাঘাত করে। ক্ষণিক পরে এক লোক দরজা খুললে আমরা ফিস্ ফিস্ করে নিজেদের পরিচয় দিলাম। সে তৎক্ষণাৎ আমাদেরকে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে বলে। আমাদের দেখে তার আনন্দ যেন উপচে পড়তে চায়। তিনি বারবার বলতে লাগলেন, “আমি কতই না সৌভাগ্যবান, এক মুজাহিদ আমার ঘরে পদধূলি দিয়েছেন।’

তিনি আমাদের আগুনের ব্যবস্থা করে খানাও পাকালেন। খেয়ে দেয়ে। অবশেষে আমরা গভীর ঘুমে ঢলে পড়লাম।

রাখাল বেশে

দুপুরের বেশ আগে আমরা জেগে উঠি। পাছে কেউ আমাদেরকে মুজাহিদ বলে সন্দেহ করে এই ভয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করলাম। পোষাক খুলে একটা ছেড়া চাদর গায়ে জড়িয়ে পুরাতন একটা পুটি মাথায় পরলাম, যা এ অঞ্চলের গরীব রাখালদের পোষাক। তবে পুরনো জুতা পেলাম না বলে আমারটাই পরলাম। তবুও এখন কেউ আমাকে মুজাহিদ বলে সন্দেহ করবে না। চেহারা-সুরতে আমি এখন পুরোপুরি একজন গরীব রাখাল। পোষাক বলে এ লোক মেষপাল ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। নামাজ আদায় শেষে মেজবানকে তার আন্তরিক মেহমানদারীর জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম।

এতক্ষণে সূর্য বেশ তেতে উঠেছে। আমরা সেতুর নিকট পৌছলাম। সিআর পি সৈন্যরা ওখানে পাহারা দিচ্ছে। গাইড পরামর্শ দিল, ‘সেতু না পেরিয়ে অন্য পথে চলতে হবে। সৈন্যদের মুখোমুখি হওয়া কখনও নিরাপদ নয়।

সে আরও বলল যে, ‘সামনে একটি মুসলিম ঘর আছে। সে ঘর থেকে এখানকার নিরাপদ রাস্তা জেনে নিতে হবে।’

গাইডের কথামত লোক চলাচলের পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে চললাম। আধঘন্টা পর ওই মুসলিম ঘরে পৌছি। সেখানে তিনজন যুবকের সাথে সাক্ষাত হয়। সবাই শিক্ষিত। কথাবার্তার ফাঁকে তাদের বললাম, জম্মু মুসলিমদেরও এখন জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়া চাই।।

আমার মুখে উপত্যকায় ভারতীয় ফৌজের জুলুম-নিপীড়নের বিবরণ শুনে তারা সচেতন হয়ে ওঠে। ক্ষণিকের সাক্ষাতের ফলেই তারা বেকারার হয়ে বলল, ‘এক্ষুণি আমরা মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দিতে চাই। আপনি ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে আমাদের নেতৃত্ব দিন। এরপর দেখবেন, জম্মুর জনপদ কিভাবে ভারতীয় ফৌজের জন্যে মৃত্যুপুরী হয়ে দাঁড়ায়।’ আমি বললাম, ইনশাআল্লাহ সব ব্যবস্থাই হবে। আপাততঃ আমাদের নিরাপদ রাস্তা দেখান, যাতে সিআরপি ও অন্যান্য বাহিনীর চোখ এড়িয়ে গন্তব্যে পৌছতে পারি ।।

ইসলামের বাধন কত গভীর, এ অচেনা ভাইদের সাথে ক্ষণিকের সাক্ষাতেই তা বুঝতে পারলাম। কয়েক মুহূর্তে পরস্পরে এত আন্তরিক হয়ে গেলাম, যেন সবাই বহুদিনের চেনা। তারা বলল, এ দেশে আপনাকে কেউ সন্দেহ করবে না। কিন্তু আপনার সাথের অস্ত্রটা একটা সমস্যা। সব পথেই আপনি সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনী দেখতে পাবেন। তারা শরীর তল্লাশীর পরই আপনাকে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি দেবে।

ফলে অস্ত্র রেখে যাওয়া ছাড়া উপায় না দেখে যুবক ভাইদের হাতে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ তুলে দিয়ে বললাম, কয়েকদিন পর আমাদের লোক এখানে আসবে। তারা কোড নাম বললে তাদেরকে অস্ত্র দিয়ে দেবে।’ কোড নাম জানিয়ে দিয়ে আমরা আবার সামনে চললাম।

অল্প দূর যেতেই এক বকরী রাখাল আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি হিন্দু না মুসলমান?

বলল, “আমি মুসলমান।

আমার জুতা জোড়া তাকে দিয়ে বললাম, এ নতুন জুতা জোড়া তুমি নিয়ে তোমার ছেড়া জুতা জোড়া আমাকে দাও।

সে আশ্চর্য হল, এ কেমন লোক! দামী জুতার বদলে প্লাষ্টিকের ছেড়া জুতা নিচ্ছে! সে অবাক হলেও তার জুতা আমাকে দিয়ে আমার জুতা জোড়া সে পরে নিল। রাখালের জুতা জোড়া ছিল ছোট, তবুও চাপাচাপি করে পরে নিয়ে অগ্রসর হলাম।

এখন আমার মাথার চুল এলোমেলো। দাড়ি ধূলো-মলিন। শেলোয়ারের এক পা হাটু পর্যন্ত উঠানো। আর অন্যটা মাটি ছুয়ে আছে। গায়ের কাপড় মেটে রঙের, ভীষণ ময়লাযুক্ত। হাতে লম্বা এক লাঠি, তাতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। এখন আমার পরিচিত কেউও আমাকে চিনতে পারবে না।

ছোট নদীটা সেতুর উপর দিয়ে পার হলাম। এ পথে লোকজনের চলাচল কম থাকায় কোন সেনাগার্ড দেখা গেল না। সেতু পেরিয়ে আবার সড়ক পথে চলছি। পনের মিনিট চলার পর পিছন হতে একটা গাড়ী আসতে দেখলাম।

ওয়াগন জাতীয় গাড়ী। একে মিটাডোর বলে। গাড়ীটা থামিয়ে তাতে উঠে পড়লাম। ঘন্টাখানিক চলার পর এক সেতুর পাশে এসে গাড়ী থেমে যায়। বাইরে তাকিয়ে দেখি সিআরপি সশস্ত্র জওয়ানরা দাঁড়িয়ে আছে।

বেচে গেলাম মৃত্যুর ছোবল থেকে

সেনাগার্ড সবাইকে নীচে নামার নির্দেশ দেয়। একে একে সবাই নীচে নেমে যায়। কিন্তু আমি গাড়ীতেই বসে থাকি। আমার পরিকল্পনা ছিল, সবার পরে নামব। সবাইকে জেরা করতে করতে সেনারা যখন বিরক্ত হয়ে পড়বে, তখন,

আমি আর বেশী প্রশ্নের সম্মুখীন হব না।

যাত্রীদের সবাইকে পালাক্রমে জেরা করা হচ্ছে। তোমার নাম কি? কোথা থেকে এসেছ? কোথায় যাবে? কেন যাবে? এ ধরনের লাগাতার প্রশ্ন।

তল্লাশীর নিয়মটা এ ধরনের। গাড়ী সেতু ঘেঁষে দাঁড়ায়। এরপর তল্লাশী চলে। নির্দোষ প্রমাণিত ব্যক্তিকে পায়ে হেঁটে সেতুর ওপারে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। পালাক্রমে সকলের তল্লাশীর পর সেতু পার হলে ফাকা গাড়ী নিয়ে সেতু পার হওয়ার ছাড় দেয়া হয়। সেতুর ওপারে গিয়ে সবাইকে গাড়ীতে উঠতে হবে। কয়েকজন লোক তল্লাশীর পর নিয়মমত সেতু না পেরিয়ে এ পারেই দাঁড়িয়ে থাকে। একজন সিআরপি অফিসার তাদের দেখে অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলল, ‘ভাগ শালা এখান থেকে।’

একে মহাসুযোগ মনে করে তৎক্ষণাৎ গাড়ী থেকে নেমে পড়ি এবং তল্লাশী ছাড়াই ধমকপ্রাপ্ত দলটির সাথে খুঁড়িয়ে সেতুর ওপারে চলে যাই। আমার এ চালাকী কারো চোখে ধরা পড়েনি। পড়লে তার উত্তরটাও ভেবে রাখি যে, তোমরাই তো বললে, সবাই ওপারে চলে যাও।

যদিও বেআইনী কোন কিছু আমার নিকট নেই; তবুও শত্রুসেনাদের বোকা বানিয়ে দারুণ একটা আনন্দবোধ হল। ওপারে গিয়ে দেখি, সিআরপি গ্রুপ আমাদের গাড়ীর কয়েকজন সন্দেহভাজন যুবককে আটকে রেখেছে। যুবকগুলো শিক্ষিত। তাদের ছাড়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের গাড়ী চলবে না। মিনিট কয়েক বসে আশংকার মধ্যে কাটাই। ভাবলাম, এরপর গাড়ী কখন ছাড়ে তার কোন ঠিক নেই, পায়খানা-প্রস্রাবের প্রয়োজন এখানেই সেরে নেই।

সেতুর অল্প দূরে রাস্তার ধারেই একটা বড় পাথর পেলাম। পাথরের আড়ালটা খুব যুৎসই। তাই বসে পড়লাম। বসতেই এক সৈন্য আমাকে দেখে ফেলে। একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে আমাকে তার কাছে ডেকে নেয়। ততক্ষণে গাইডের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমিও চিন্তায় পড়ে গেলাম, কোন চর গোমর ফাঁস করে দেয়নি তো? তারা কি জেনে ফেলল, আমি বিনা তল্লাশীতে এপারে চলে এসেছি? হরেক রকম প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করছে।

আমি রোগীর ন্যায় ধীর পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সৈন্যটির নিকট গেলাম। সৈন্যটি বলল, তুমি এখানে প্রস্রাব করলে কেন?”

উত্তরে বললাম, স্যার, আড়াল দেখে বসেছিলাম, রোগী মানুষ, বেশী দূর যেতে পারি না।

সৈন্যটি গালি দিয়ে বলল, “আরে আড়ালের বাচ্চা, এটা ভগবানের মূর্তি। এখানে আমরা প্রার্থনা করি।’

ভালোভাবে লক্ষ্য করার পর বুঝলাম, সত্যিই এটা একটা মূর্তি। আপন ভগবানের সাথে এমন আচরণ দেখে সে আমাকে গুলী করেও মারতে পারত। কিন্তু হিন্দু সৈনিকটি হয়ত কোমল হৃদয়ের মানুষ; আমার অসুস্থ চাল-চলন দেখে তার ভেতরের সুবোধ মানুষটি জেগে উঠেছিল হয়ত। তাই কয়েকটা গালি দিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। এ গালি খেয়ে আমি তেমন ক্ষুব্ধ হইনি। কারণ, মরণফাঁদ থেকে বেঁচে যাওয়া আমার জন্য কোন ছোট নেয়ামত নয়।

ইন্ডিয়ান সেনার কবল থেকে ঠিকমত ফিরে আসলে গাইডের ভয় দূর হয়। এই প্রথমবার কোন ইন্ডিয়ান সেনার সাথে আমার নিরস্ত্র অবস্থায় কথা বলার অভিজ্ঞতা হল। গাইড আমার সৌভাগ্যকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, “সে আপনাকে গুলী করলেও কেউ তাকে প্রশ্ন করত না। এমনই বেপরোয়া এদের তৎপরতা।

আমিও মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম, এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে নিরাপদে পার করার জন্যে।

সন্ধ্যা নাগাদ গন্তব্যে পৌঁছলাম। মাগরিবের পর দায়িত্বশীল মুজাহিদদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক শুরু হল। আমার ছদ্মবেশী চেহারা দেখে তারা বিস্মিত হয়। তাই নিজের পরিচয় এবং মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে প্রথমে তাদের বিস্ময় দূর করলাম। এরপর তারা আমাকে গোটা এলাকার মুজাহিদদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত করায়। ইন্ডিয়ান সেনাদের তৎপরতা সম্পর্কেও ব্যাপক আলোচনা হল।

এ এলাকায় মুজাহিদদের সংখ্যা যথেষ্ট দেখে আমি নিশ্চিত হলাম যে, মুজাহিদরা এ অঞ্চলে ভারতীয় সেনাদের বিরুদ্ধে সফল অপারেশন চালাতে পারবে। দায়িত্বশীল মুজাহিদদের বললাম, সম্ভব হলে সমস্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত সাথীদের আমার সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করুন।

তারা বলল, সম্মিলিতভাবে সবার সাথে সাক্ষাৎ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করা যেতে পারে।’

সে মতে পরদিনই সাক্ষাৎ শুরু হল। মুজাহিদদের সাথে সাক্ষাতের সময় আমার শিরার রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠে। সবাই যেন এক একটা বিজলীর ঝলক। তাদের আবেগ দেখে আমি অবাক হলাম। প্রত্যেক মুজাহিদই পাহাড়সম হিম্মত আর ট্রেনিংয়ে খুবই দক্ষ। সবার একটাই প্রশ্ন, কতদিন আর আমাদের এভাবে বসিয়ে রাখবেন, জিহাদ শুরু করার অনুমতি কবে পাব?

আগেই বলেছি, বিশেষ কারণে এখনো জম্মুতে সশস্ত্র জিহাদ শুরু করা হয়নি। তাদের বললাম, আমি তো এসেছি আপনাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে। এখন আপনাদের সামনে অগ্রসর হওয়ার পালা। আপনাদের আর বসিয়ে রাখা হবে না । তথাপি এ জন্যে আমাদেরকে সুশৃংখল পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে, যাতে আমরা অল্প ঝুঁকি নিয়েই দুশমনের অধিক ক্ষতি সাধন করতে পারি।’

চারদিন ধরে সকলের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। পরিকল্পনাও তৈরী হল। মুজাহিদদের অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জেনে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানানোর ব্যবস্থা করলাম। আমার কাজ শেষ করে এ ব্যাপারে এখানের অন্যান্যদেরও অনুমতি নিলাম।

মিশন হল শুরু

পরবর্তী মঞ্জিল ‘ডোডা শহর। আমার গাইড হিসেবে এক শিক্ষিত যুবককে দেয়া হয়। আমরা একটা টাটা গাড়ীতে চড়ে ডোডা রওনা হলাম। ডোডা শহরের অল্প দূরে এসে গাইড কানে কানে আমাকে বলল, ডোডা সেতুতে আমরা সমস্যায় পড়তে পারি । এখানে সিআরপি সদস্যরা কঠোর চেক করে। কাউকে সন্দেহ করলে পরিচয় পত্র দেখাতে হয়।

আমি বললাম, তখন দেখা যাবে, যে সত্ত্বা এ পর্যন্ত আমাকে রক্ষা করেছেন, তখনও তিনিই একটা উপায় বের করে দেবেন।

ডোডা ব্রীজ পৌঁছে দেখি, গাড়ীর দীর্ঘ লাইন। কঠোর চেকিং চলছে। আমি চিন্তা করতে লাগলাম, তাৎক্ষণিকভাবে কি করা যায়। দেখলাম, তারা শুধু আন্তঃনগর বাসগুলো চেক করছে। কিন্তু লোকাল গাড়ীর যাত্রী নামানো হয় না। ঠিক করলাম, এ গাড়ী ছেড়ে লোকাল গাড়ীতে উঠব।

আমাদের বাসের পাশেই একটা ওয়াগান এসে থামল। এক ভারতীয় সৈন্য আমাকে উঁকি মেরে দেখে অন্যটায় উঠে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে অন্য গাড়ীর দিকে ফিরল।

ওয়াগানের দু’তিনটে সিট খালি। চোখের পলকে আমরা টাটা গাড়ী ছেড়ে ওয়াগনে উঠে বসলাম। সাথে সাথে গাড়ী ছেড়ে দিল। এভাবে আমরা কঠোর চেকিংয়ের ফাঁক গলিয়ে কেটে পড়লাম।

ডোডা পৌছে এক দায়িত্বশীল মুজাহিদের ঘরে উঠলাম। তাকে বললাম, এক্ষুণি আমি এখানে অন্যান্য দায়িত্বশীল মুজাহিদদের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই।

তিনি আমাকে নিয়ে একটি ঘরে পৌছলেন। স্থানীয় অধিকাংশ মুজাহিদ কি একটা প্রোগ্রামে সেখানে সমবেত হয়েছিল। এত অল্প সময়ে সবাইকে এক। জায়গায় পেয়ে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল। এদের অধিকাংশই আমার আফগানিস্তানের সাথী এবং এরা আমার নিকটেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত।

আমাকে দেখে তারা আনন্দে আত্মহারা। সবাই একে একে আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করে। এ ভালবাসাই মুজাহিদের ঐক্যের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। জিহাদরত মুজাহিদরা ঐকান্তিকভাবে পরস্পরের সাক্ষাতের জন্য এমনই ব্যাকুল থাকেন। এমন ভালবাসা সহোদর ভাই আর প্রেমিক-প্রেমিকাদের মাঝেও খুঁজে পাওয়া ভার।

ডোডা শহরে মুজাহিদদের উপদেষ্টা আহসান ডার ও দু’জন পাকিস্তানী মুজাহিদ এজাজ ভাই ও খালিদ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হল । তাদের সাথে দুপুরে রওনা হলাম একটা পিকআপে করে। গাড়িতে উঠে অন্যান্য কাশ্মিরী মুজাহিদ টহলরত সৈন্যদের মত চারিদিকে ক্লাশিনকোভ তাক করে চলতে থাকে। ক্ষণিক পর আমাদের গাড়ী এক পুলিশ ফাঁড়ি অতিক্রম করে। কিন্তু আমাদের দিকে তারা তাকালোও না। আহসান ডারকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি?

বলল, “ভাই এরা আমাদেরই সাথী, কাশ্মিরী পুলিশ সর্বোতভাবে মুজাহিদদের সহযোগী।

সোপুর পৌছে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে শরীক হলাম। বৈঠক শেষে আবার রওনা দিলাম। এবার গন্তব্য পিটন । আমাদের সাথে অন্যতম মুজাহিদ নেতা শামসুল হকও রয়েছেন। পথে কয়েকস্থানে সেনাছাউনীর পাশ থেকে যেতে হয়েছে।

যেতে যেতে রাত হয়ে যায়। তাই সোপুরের ছরী গ্রামে আহসান ডারের ঘরে উঠলাম। পথে আমার এক বন্ধু আশরাফ ডারের বাড়ী। আশরাফ ডার একজন অকুতোভয় মুজাহিদ। আজ দু’বছর ধরে তিনি ঘর ছেড়েছেন জিহাদের উদ্দেশ্যে। তার সাথে আমার পরিচয় আজাদ কাশ্মীরে।

অবশেষে আশরাফ ভাইয়ের ঘরেই উঠলাম, তার আম্মা-আব্বার সাথে সাক্ষাৎ করব এ ইচ্ছে নিয়ে। আহসান ডার আশরাফ ভাইয়ের আব্বার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন এ বলে যে, এ আশরাফের বন্ধু। শুনে তিনি আমাকে সস্নেহে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন, যেন আমিই আশরাফ ডার।

আশরাফ ভাইয়ের আব্বা আমার নিকট থেকে ছেলের খবরাখবর নিলেন। তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। আপনারা ঘাবড়াবেন না। ইদানিং একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাকে আজাদ কাশ্মীর থাকতে হচ্ছে।

এরপর গেলাম কমান্ডার শামসুল হক সাহেবের বাড়ীতে। তার বড় ছেলেও মুজাহিদ। বাকি দু’জন ছোট, পড়া-লেখা করছে। তারা বলল, আমরাও মুজাহিদ।

আমি বললাম, মুজাহিদ হলে তোমাদের রাইফেল কোথায়? বলল, রাইফেল আব্দুর কাছে রেখে দিয়েছি।’

বললাম, রাইফেল ছাড়া জিহাদ করবে কিভাবে? আব্দুর কাছ থেকে রাইফেলটা নিয়ে নাও।

তারা মুখ ভার করে বলল, আব্দুর কাছে রাইফেল চাই; কিন্তু দেননা, কি করব আর।’

আমরা সবাই হেসে উঠি। মুজাহিদ বাপের ছেলেও প্রত্যয়ী মুজাহিদ।

এরপর ওরা আরও দৃঢ়কণ্ঠে বলল, “আমরা তো এখনও ছোট। একটু বড় হলে ঠিকই আব্দুর থেকে রাইফেল নিয়ে নেব। আমার বড় ভাইয়ার নিকট যেমন রাইফেল আছে, আমার নিকটও থাকবে। তখন আমরাও জিহাদ করব, দুশমন মারব।’

অল্পক্ষণেই তাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, কিন্তু বেশীক্ষণ এ ঘরে অবস্থান নিরাপদ নয় বলে আবার পথ ধরলাম। এবারের গন্তব্য আরীপন্থন গ্রাম।

আক্রমণের সূচনা

আরীপন্থন পৌছে এখনো কর্তব্য স্থির করতে পারিনি। এর মধ্যে গ্রামের কয়েকজন মহিলা দৌড়ে এসে বিমুখে আমাদের নিকট দাঁড়ায়। আমার সাথী এক কাশ্মিরী মুজাহিদ তাদেরকে কারণ জিজ্ঞেস করল। তারা জানাল ‘বেরো রোডের উপর সৈন্যরা বাস থামিয়ে যাত্রীদের হয়রানী করছে, মহিলাদের উত্যক্ত করছে।’

একথা শুনেই আমাদের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সংখ্যায় আমরা অল্প হওয়া সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিলাম, এ মহিলাদের মনে মুজাহিদদের ব্যাপারে এ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাতে হবে যে, আমাদের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত এ মাটিতে ভারতীয় সেনাদের স্বেচ্ছাচারিতা চলবে না।

আহসান ভাই এক কাজে গেছেন। বাকী আমরা ছয়জন মুজাহিদ। তিনজন পাকিস্তানী তিনজন কাশ্মিরী । তাদের মধ্যে আমার প্রিয় বন্ধু শওকত ভাইও একজন। ক্লাশিনকোভ এবং অতিরিক্ত ম্যাগজিন নিয়ে রোডের উপর আর্মীদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলাম। দূর থেকেই তাদের দেখা যাচ্ছে। দেখতে পেলাম, এখনও যাত্রীদের হয়রানী বন্ধ হয়নি।

মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হল। দুআ পড়তে পড়তে ক্ষেতের উপর দিয়ে ক্রোলিং করে এগুচ্ছি। আমাদের ইচ্ছে, সৈন্যদের পিঠের উপর ওঠে ওদের নাকানি-চুবানি দেব। একদম তাদের নাকের ডগায় গিয়ে পৌছলাম। আগেই তিন সদস্যের এক ক্রোলিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছিল।

গেরিলা যুদ্ধের নীতি হল, যোদ্ধাদের দুই গ্রুপে বিভক্ত করে এক গ্রুপকে হামলায় ও অপর গ্রুপকে পর্যবেক্ষণে নিয়োগ করা হয়। আক্রমণকারী গ্রুপ তার কাজ শেষে ফিরে আসার সময় ক্রোলিং গ্রুপ শত্রুর উপর ফায়ার করে তাদের ভীত করে তোলে। আমি ছিলাম আক্রমণকারী গ্রুপে।

আমরা পৌছতেই যাত্রীবাস ছেড়ে যায়। রাস্তা সম্পূর্ণ খালি। চারটি ট্রাক ও সৈন্যরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা নিশ্চিন্তে গল্প করছে। আমরা আকাশ

ফাটিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে ক্লাশিনকোভের ফায়ার শুরু করলাম।।

প্রথম ফায়ারেই টহলরত কয়েকজন সৈন্য মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে। আমরা যেন তাদের অদৃশ্য মৃত্যুদূত। তারা চীৎকার করে আকাশ মাথায় তুলল। আর বাকিরা এদিক-ওদিক ভাগতে ভাগতে ‘হায় রাম’ হায় রাম’ বলে হাহাকার জুড়ে দেয়।

যারা পালাবার চেষ্টা করছে, তারা গুলীর আঘাতে পাকা ফলের মত টুপ টুপ করে ঝরে পড়তে থাকে। একজন দৌড়ে গাড়ীতে উঠে গাড়ী স্টার্ট দেয়।

কয়েকজন সৈন্য তাতে উঠে পড়ে। গাড়ীর উপর ফায়ার করলেও তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

রোডের চারিদিকে শুধু সৈন্যদের বিক্ষিপ্ত লাশ পড়ে ছিল। কিছু সৈন্য পালিয়ে যায় আর কিছু সড়কের অপর পাশে পজিশন নিয়ে আমাদের উপর ফায়ার শুরু করে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে আমরা অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলি । নিকটেই আর্মীদের একটি বড় ক্যাম্প। তারা সংবাদ পায় যে, সড়কে টহলরত সৈন্য ও মুজাহিদদের মাঝে সংঘর্ষ চলছে। তাই ক্যাম্পের দিক থেকেও প্রচণ্ড ফায়ারের শব্দ ভেসে আসে। তারা আমাদের ভয় দেখাচ্ছিল, কিন্তু আমরা তো বাজিমাৎ করে দিয়েছি। ৬ মিনিট ফায়ার করার পর প্রোগ্রাম অনুযায়ী আমরা পিছু হটতে থাকি। ওদিকে পজিশন নেয়া কিছু সৈন্য আমাদের দেখতে পেয়ে

আবার ফায়ার শুরু করে।

এবার তিন সদস্যের ক্রোলিং গ্রুপ সৈন্যদের উপর ফায়ার শুরু করে। আমরা এ সুযোগে নিরাপদ অবস্থানে পৌছে তাদেরকে সংকেত দিলে তারা এসে আমাদের সাথে মিলিত হয়।

আমরা নিরাপদে আরীপন্থন পৌছে গেলাম। ক্ষণিক আগের মহিলাদের বিষাদক্লিষ্ট মুখমন্ডলে তখন আনন্দের ঢেউ খেলছিল। শিশুরা আমাদের বিজয় দেখে খুশীতে লাফাচ্ছিল।

সৈন্যরা আমাদের পিছু নেয়ার সাহস করেনি। তথাপি এ গ্রামে অবস্থান করা আমাদের জন্য বিপদমুক্ত নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, পুশকর গ্রামে রাত কাটাব। এ গ্রামটি মুজাহিদদের গোপন ঘাঁটি। কয়েকঘন্টা পায়ে হেঁটে আমরা পুশকর পৌছলাম। আমাদের সঙ্গী এক মুজাহিদের বাড়ী এ গ্রামেই। আমরা তাঁর ঘরেই উঠলাম। মুজাহিদের মা আমাদের আপন ছেলের মতই আপ্যায়ন করলেন।

আত্মার সম্পর্ক সত্যিই বিস্ময়কর। এ অচেনা মহিলা আমাদের পায়ের ক্ষত দেখে কেঁদে ফেলেন। এরপর গরম পানি ও বাটা মেহ্দীপাতা আমাদের নিকট পাঠিয়ে দেন। মেহদীবাটা লাগানোতে ক্ষতের ব্যথা কমে আসে। পরদিন আবার আরীপন্থন পৌছে জানতে পেলাম যে, আহসান ভাই এজাজ ভাইকে নিয়ে ইসলামাবাদ রওনা হয়ে গেছেন। আমাকেও সত্ত্বর ইসলামাবাদ পৌছার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই আবার ইসলামাবাদের পথ ধরলাম।

এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা

পথেই রাত হয়ে যায়। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। ঘুমের ঘোরে চলতে গিয়ে একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। এক মুজাহিদ আমার হাত ধরে ফেলে। পরে আমি তার হাত ধরেই চলতে থাকি। এ সময় আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। ঐ মুজাহিদের হাত ধরে চলতে চলতে পুরোদস্তুর ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু পথ চলতে কোন ব্যাঘাত হল না। এ ভাবে ঘন্টাখানিকের মত ঘুমিয়ে

এরপর থেকে এটা আমার অভ্যাস হয়ে যায় যে, হাঁটতে হাঁটতে ঘুম

ধরলে এক সঙ্গীর হাত ধরে নিতাম। একই সঙ্গে ঘুমাতাম এবং পথ চলতাম।

ভোের তিনটায় আমরা ইসলামাবাদের (অনন্তনাগ) প্রথম গ্রাম পরওয়ানীতে পৌছি। গ্রামবাসীরা আমাদের আগমন সংবাদ পেয়ে দলে দলে বেরিয়ে এসে। অভ্যর্থনা জানায়। আহসান ডার ও স্থানীয় মুজাহিদদের সাথে পরামর্শ শেষ করে আমরা আবার সামনে অগ্রসর হলাম।

মুজাহিদদের গোয়েন্দা

বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আমরা কুগর গ্যাস্ট্রাস’ নামক এক গ্রামে পৌঁছি। রাতটা এখানেই কাটে। এ রাতে আমি পাহারা দেয়ার জন্যে জিদ ধরলাম। ইতিপূর্বে কাশ্মিরী মুজাহিদরা আমাদেরকে পাহারায় নিয়োগ করত না। বলত, তোমরা মেহমান, আর মেহমানের হেফাজত করা এবং তাদের আরামে রাখা আমাদের কর্তব্য।

এবারও তাদের সে একই কথা। আমি বললাম, এখানে এসেছি দুমাস হল। এখন আমি আর মেহমান নই। দ্বিতীয় কথা, আমি তো জিহাদ করতে এসেছি। তাই আপনাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব কষ্টের সমভাগী হতে চাই। কারও জন্য কোনরূপ বিশেষ আচরণ আমার পছন্দ নয়।

অবশেষে সে রাতে আমি কাশ্মিরী মুজাহিদ শওকত ভাইয়ার সাথে পাহারা দেয়ার সুযোগ পেলাম। তার সাথে আমার অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।

জিহাদের পথে পাহারা দেয়ার সুসংবাদ সম্পর্কিত এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “এক সকাল কিংবা এক সন্ধ্যা সীমান্ত পাহারা দেয়া জগত ও জাগতিক সব কিছুর চেয়ে উত্তম।” এতে এক অপার্থিব আনন্দও রয়েছে। সায়্যেদুল কাওনাইন মুহাম্মদ (সাঃ) আমরা অধমদের জন্যে কতসব সৌভাগ্যের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন।

নিকষ আঁধার রাতের নীরবতায় ঘুম তাড়িয়ে, শত্রুর অপেক্ষা করে পাহারা দিয়েও রাতে এক নিদারুণ আনন্দ পেলাম। রাত্র দুইটার সময় আমরা উভয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ি। চারটার দিকে অন্য সাথীদেরকে জাগিয়ে দেই।

জামাতের সাথে ফজর নামাজ আদায় করে আমরা নাস্তা করছিলাম। এ সময়ে বাইরে শোরগোল শুনা গেল। বাইরে গিয়ে দেখতে পেলাম, গ্রামের বহু মহিলা পুরুষ আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। জিজ্ঞেস করতে তারা বলল, ‘এখান থেকে জলদি বেরিয়ে যান, এক্ষুণি সংবাদ পৌছেছে যে, সৈন্যরা এ গ্রাম, ঘেরাও করতে অগ্রসর হচ্ছে।

এ ভাবে একাধিকবার আমি সাধারণ জনতার জিহাদী জযবা অবলোকন করেছি। ভাবতে আনন্দ লাগে, কাশ্মীরের প্রতি ইঞ্চি মাটি মুজাহিদদের নখদর্পণে।. প্রতিটি কাশ্মিরী জনগণ আপন মুজাহিদ ভাইদের হেফাজত এবং

তাদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরীর দায়িত্ব পালনে কত যত্নশীল। সৈন্যরা কয়েক মাইল দূরে থাকতেই জনসাধারণ মুজাহিদদের সে সংবাদ পৌছিয়ে দেয়।

এক ব্যক্তি তার গ্রামের পাশ দিয়ে সৈন্যদের কুগর গ্যান্ট্রাস গ্রামের দিকে আসতে দেখে সে দৌড়ে আমাদের নিকট আসে। তাই সৈন্যরা আসার আগেই আমরা তাদের সংবাদ পেয়ে যাই।

আমরা সবাই তখনই হাতে অস্ত্র তুলে নিলাম। গ্রামবাসীদের বললাম, সবাই নিজ নিজ ঘরে চলে যান। বাধা না দিয়ে সৈন্যদেরকে এদিকে আসতে দিন।

আমরা বুঝতে পারছিলাম, আর্মীরা এখনো গ্রামে এসে পৌছেনি, না হয় পাহারারত মুজাহিদরা আমাদের খবর দিত।

মুজাহিদদের ধরতে আসা সৈন্যরা পালিয়ে গেল

ক্ষণিক পরেই পাহারারত এক মুজাহিদ ভারতীয় সৈন্যদের আগমন সংবাদ সত্যায়ন করে। তাকে গ্রামের সব মুজাহিদকে একত্রিত করার দায়িত্ব দিয়ে আমরা গ্রাম থেকে বেরিয়ে গেলাম। ভারতীয় সৈন্যরা পজিশন নিয়ে আমাদের। বের হওয়ার পথ আটকে রেখেছে। মুখোমুখি হতেই উভয় পক্ষ থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলী শুরু হয়ে যায়। শত্রু পক্ষ প্রচুর সৈন্যসহ পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল।

গেরিলা যুদ্ধের নীতি হল, শত্রুপক্ষ আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে আসলে তার সাথে সরাসরি মোকাবেলায় অবতীর্ণ না হওয়া। নিয়ম হল, তখন নীরবে লুকিয়ে থাকা এবং সুযোগমত শত্রুপক্ষের অসতর্ক মুহূর্তে তাদের কুপোকাত করা। তাই আমরা সৈন্যদের বেষ্টনী থেকে বের হয়ে বাইরে নিরাপদ স্থানে কেটে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

এ পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনজন মুজাহিদ সৈন্যদের উপর বিরামহীনভাবে ফায়ার করতে থাকে। ভারতীয় সৈন্যরা তাদের মোকাবেলায় ব্যস্ত হলে এ সুযোগে আমরা বেষ্টনী থেকে বের হতে থাকি। কিন্তু তারা আমাদেরকে দেখেও পজিশন ছেড়ে আমাদের পথ রুদ্ধ করার সাহস করল না। গুলী-বৃষ্টির মাঝে মুজাহিদরা বেষ্টনী ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। বেশ দূরত্বে এসে আমরা পেছন থেকে সৈন্যদের উপর ফায়ার শুরু করলাম। এ সুযোগে ক্রোলিং গ্রুপের তিন মুজাহিদও বেষ্টনী ভেঙ্গে আমাদের সাথে যোগ দেয়।

এবার শুরু হয় সৈন্যদের সাথে লুকোচুরি খেলা। সৈন্যরা আমাদের পিছু ধাওয়া করে আর আমরা লুকিয়ে তাদের উপর ফায়ার করতে থাকি। মুজাহিদরা এ ক্ষেত থেকে অন্য ক্ষেতে সৈন্যদের উপর গুলী চালায় আর চলে যায় এ টিলা হতে অন্য টিলায়।। . এ এলাকা ছিল আমাদের সাথীদের নখদর্পণে। সৈন্যরা খুব সতর্ক হয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমরাও খুব সাবধানে তাদের উপর ফায়ার করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিলাম।

আমাদের ধাওয়া করার ব্যাপারে সম্ভবতঃ সৈন্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই খুব দৃঢ়পদে চারঘন্টা যাবৎ আমাদের পিছু নেয়। এ সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন সৈন্য আমাদের গুলীতে নিহত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর শোকর, আমাদের কোন সাথীর গায়ে একটু আঁচড়ও লাগেনি। তিনি আমাদের তার আপন মদদের ছায়ায় আশ্রয় দেন। আমরা স্বল্পসংখ্যক হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়।

জম্মুর পথে

ইসলামাবাদের মিশন শেষে আহসান ভাইসহ আমাদের এ কাফেলা জম্মুর ‘আধমপুর শহরের দিকে অগ্রসর হয়। জম্মুর মুজাহিদদের সুসংগঠিত করার কাজ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। তাদেরকে আরও বেগবান, আরও শক্তিশালী কার জন্যে ওখানকার মুজাহিদদের সাথে সাক্ষাৎ করা খুবই জরুরী।

পথ অত্যন্ত দুর্গম। ঘন জঙ্গল, বরফঢাকা দীর্ঘ পথ আর নদী পেরোতে হবে। উপরন্তু ইন্ডিয়ান চর ও হিন্দুদের খপ্পরে পড়ার সমূহ আশঙ্কাও রয়েছে। চলতে চলতে আমরা এক পাহাড়ী রাখালের বস্তীতে পৌছলাম। তারা আমাদের লিপ্টন চায়ের আমন্ত্রণ করে। আমরা তাদের দাওয়াত সানন্দে গ্রহণ করলাম।

কাশ্মীরে লিপ্টন চা বলতে সাধারণতঃ মিষ্টি চা বুঝায়। আরেকটা হল নুন চা। চা পান করায় শরীর সতেজ হল। আবার দ্রুত পথ চলতে লাগলাম।

একটু পরে পথে এক প্রবল স্রোতস্বিনী নদী বাঁধ সাধল। নদীর পানি বরফের ন্যায় ঠান্ডা আর এত খরস্রোতা যে, পার হওয়া ভারী মুশকিল। কিন্তু আল্লাহর পথের অকুতোভয় মুজাহিদদের সামনে এ বাধা অতি তুচ্ছ বই কি। স্রোতের ধাক্কায় ভেসে যাওয়ার ভয়ে সবাই একে অন্যের হাত ধরে নদীতে নেমে পড়লাম। পানি এত ঠান্ডা যে, তাতে নামতেই মনে হল, কে যেন হাটু পর্যন্ত পা কেটে দিয়েছে। আরো সামনে গিয়ে বুঝলাম, নদী খুব গভীর। পানি গলা পর্যন্ত ঠেকেছে।

প্রচন্ড স্রোত আমাদের পা উপড়ে দিচ্ছিল বারবার। তবুও অসীম সাহস নিয়ে কাফেলা সামনে এগিয়ে চলছে। আল্লাহ আল্লাহ করে কোনভাবে পার হলাম। ঠান্ডায় সকলের শরীর অবশ হয়ে গেছে। অপর পাড়ে গিয়ে অর্ধ অচেতন অবস্থায় সবাই শুয়ে পড়ি। অনেকক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর আমরা আবার অগ্রসর হতে থাকি।

এদিকে আহসান ভাই বিশেষ কারণে জম্মুর প্রোগ্রাম পিছিয়ে দিলেন। আমরা কাশ্মীরের সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া কুল হিন্দের’ পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এর উচ্চতা প্রায় পনের হাজার ফিট।

এবার আমাদের গন্তব্য বুড়গ্রাম শহর। দুর্গম, কঠিন পথ পেরিয়ে আমরা যখন গন্তব্যে পৌছি, তখন রাত হয়ে গেছে। খানা খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি।

এরপর ভোরেই এক গোপন স্থানে পৌছলাম। সেখানে মুজাহিদদের এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছিল।

সামরিক উপদেষ্টার ভূমিকায়

এতদিন আমরা শুধু অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। নিজেদের অবস্থান আর দুশমনের ঘাটির খবর নেয়া, রাস্তাঘাট আর মৌসুমের হাল-হাকীকত জানা হচ্ছিল এতদিন। আলহামদুলিল্লাহ-এ ক’মাসে কাশ্মীরের প্রত্যন্ত অঞ্চল, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, মুজাহিদ এবং কমাণ্ডারদের সাথে পরিচয়পর্ব পূর্ণরূপে সম্পন্ন হয়।

এ মিটিংয়ে বিশিষ্ট কমাণ্ডারগণ উপস্থিত হন। সামরিক উপদেষ্টা পরিষদ গঠনসহ আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমাকে উক্ত পরিষদের নায়েব-উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদনের যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু আমীরের প্রতি ভালবাসা ও তার আনুগত্যের সামনে নিজের মতামত ব্যক্ত করা থেকে বিরত রইলাম। এ পরিষদের দায়িত্ব হল গোটা কাশ্মীরের মুজাহিদদের সাথে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন, তাদের আরো তৎপর করে ভোলা, আক্রমণ রচনায় সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের সমস্যা সমূহের সমাধান করা।

আমি এ দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে হাজারো চেষ্টা করলাম। কারণ, কাশ্মীরে আমার চেয়ে উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং সমরবিদ অসংখ্য মুজাহিদ রয়েছেন। এরা বৰ্হিদেশ থেকে আগত প্রতিটি মুজাহিদের চেয়ে কম অভিজ্ঞ নন। অথচ, আফগান জিহাদে দেড় বছর কাটানো ছাড়া আর কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। বড় কোন আক্রমণে অংশ নেয়ার সুযোেগও আমার হয়নি। বাস্তবেই আমি অযোগ্য। পাথেয় শুধু আল্লাহর মদদ, আর শক্তি হল, জিহাদের আবেগ আর শাহাদাতের তামান্না।

আধুনিক বিশ্বের অভিজ্ঞ সমরকুশলীরা শুনে বিস্মিত হবেন যে, কাশ্মীর জিহাদে বিগ্রেডিয়ার আর মেজর জেনারেলদের মধ্যে মাত্র বিশ বছর বয়সের

তরুণরাও রয়েছেন।’

পরদিনই আমি কাজ শুরু করে দিলাম। এখন অন্য কোথাও যাবার বদলে বড়গাম এলাকায় ট্রেনিংয়ের কাজ শুরু করতে হবে। এখানে ঐ সব তরুণদের ট্রেনিং দেয়া হবে, যাদের সীমান্ত পেরিয়ে ট্রেনিংয়ের জন্যে আফগানিস্তানে যাওয়া দুষ্কর। অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পা রাখতে হবে। কারণ, স্থানে স্থানে সৈন্যদের ক্যাম্প রয়েছে। তাদের চোখ এড়িয়ে ট্রেনিং চালাতে হবে।

তিনদিনের মধ্যেই পঞ্চাশজন তরুণ একত্রিক হল। ট্রেনিং সেন্টারের জন্যে ঘন জঙ্গলের ভিতর এক প্রশস্ত মাঠ তৈরী করা হল। সৰ সাজ-সরঞ্জামের ব্যবস্থা করার পর সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যায়। সব সাথী একত্রিত হওয়ার পর তাদের উদ্দেশে প্রাথমিক কিছু আলোচনা করতে গিয়ে ট্রেনিংয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত করালাম। কারো আবেগের কমতি নেই। সবাই বীরত্ব ও হিম্মতে প্রদীপ্ত। শহীদী তামান্নায় সবাই উদ্দীপ্ত। থাকার জন্যে। একটা অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করা হল। এ ঘরের খোঁজ পাওয়া সৈন্যদের জন্যে অত্যন্ত দুষ্কর।

ট্রেনিং শুরু হল। খুব ভোরে উঠে ঠান্ডা পানিতে ওযু করা। এরপর জামাতের সাথে ফজর নামাজ আদায়ের পর দরসে কুরআন’। তার পরে ব্যায়ামের কসরত। এরপর শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। চলে যোহর পর্যন্ত। দিনের বেলা সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ইসলামী কিতাবাদীও পাঠ করে শুনান হত।

ট্রেনিংপ্রাপ্তদের পরীক্ষা

পনের দিনেই ট্রেনিং সমাপ্ত করা হয়। বাহ্যতঃ এতটুকু সময় খুবই অল্প।। কিন্তু ট্রেনিংয়ের ফলাফল সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তথাপি সম্মুখসমরে ট্রেনিংপ্রাপ্ত তরুণদের পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এর জন্যে আমাদের বেশী দূরে যেতে হল না। সৌভাগ্যবশতঃ এ জঙ্গলের অদূরেই একটা সড়ক রয়েছে, যা সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছেছে। সীমান্তের সেনাঘাঁটির রসদ এ রাস্তা দিয়ে আনা নেয়া হয়। আমরা সেই রসদ গাড়ীতে হামলার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আক্রমণের আগে আমি একদল মুজাহিদ নিয়ে সড়ক পর্যবেক্ষণ করতে গেলাম। সড়কটা কাটা এবং সংকীর্ণ। ছোট ছোট পাহাড় ও টিলার মাঝ দিয়ে একে বেঁকে এগিয়ে জঙ্গলে পড়েছে। জঙ্গলের পর বহু দূর পর্যন্ত সমতলভূমি। সমতলভূমি পেরুলেই সীমান্ত রেখা। আক্রমণের জন্যে আমরা আমাদের সুবিধামত একটা স্থান পর্যবেক্ষণ শেষে ক্যাম্পে ফিরে এলাম।

রাতে পুনরায় পর্ববেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে চলে যাই। সড়কের এক স্থানে গর্ত খুঁড়ে তাতে নিজেদের তৈরী মাইন স্থাপন করলাম। এরপর মাইনের সাথে তার জয়েন্ট করে তারের দ্বিতীয় মাথা নিয়ে রাখলাম জঙ্গলের দু’শ মিটার ভেতরে। এটা এ্যাকশনের প্রথম পর্ব। কোন গাড়ী মাইন অতিক্রম করার সময় তারে ব্যাটারী সংযোগ করে বিস্ফোরণ ঘটানো হবে মাত্র। মাইন পুঁতে রাস্তাটা আগের ন্যায় সমান করে দেয়া হল। এখানে কোন বিপদ আছে, তা সন্দেহ করার কোন নিশানা রাখা হল না। এরূপ ভাববারও কোন অবকাশ ছিল না।

আমাদের হিসাব মতে পরদিনই রসদ যাওয়ার কথা। তাই রাতেই সব প্রস্তুতি সমাপ্ত করি। মুজাহিদদেরকে কয়েক গ্রুপে ভাগ করা হল ঃ

(১) এ্যাকশন পার্টি- যারা শত্রুর উপর সরাসরি আক্রমণ করবে।

(২) কোরেং পার্টি- এদের দায়িত্ব হল এ্যাকশন পার্টিকে সহজে পিছু হটার পথ করে দেয়া।

(৩) সিগন্যাল

৮৩ পার্টি- এদের কাজ শত্রুর গতিবিধি ও আগমনের সংবাদ দেয়া। বাকী দুই গ্রুপের নাম হল রোডব্লক গ্রুপ। এদের কাজ এ্যাকশন পয়েন্ট (হামলা কেন্দ্র)-এর দু’দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। মুজাহিদদের হাতে আক্রান্ত শত্রুকে কোনরূপ সাহায্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত রাখা। রোডব্লক গ্রুপ এ্যাকশন পয়েন্টের দু’দিকে এক কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান নেয়।

ভোরে ফজর নামাযের পর সবাই অনুনয়-বিনয় করে আল্লাহ পাকের নিকট মদদ ও নুসরত কামনা করি। এরপর আমি এ্যাকশন গ্রুপের ২৬ জন মুজাহিদ নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছলাম। অন্যান্য গ্রুপও নিজ নিজ স্থানে পৌছে গেল। সিগন্যাল পার্টি এমন সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল যে, তারা এবং এ্যাকশন পার্টি উভয়ে পরস্পরকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিল।

আমরা অধীর হয়ে সিগন্যাল পার্টির দিকে তাকিয়ে রইলাম। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সিগন্যাল পার্টির রসদগাড়ী আসার সংকেতে সতর্ক হলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই গাড়ীর বহর দৃষ্টিগোচর হল।।

গাড়ির বহর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। রসদ বহরের প্রথম গাড়ীটা আস্তে করে মাইনের উপর উঠে এসেছে। এক-দুই-তিন, তার-বেটারীর সংযোগ, অমনি প্রচন্ড বিস্ফোরণ। গাড়ীটা সৈন্যসহ শূন্যে উঠে গেল। মহাবিপদ দেখে পিছনের গাড়ীগুলো থেমে যায়। তাদের সম্বিৎ পাওয়ার আগেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ জন মুজাহিদের ২৬টা ক্লাশিনকোভ এক সাথে গর্জে উঠে।

তবে কয়েক সেকেন্ড পর আমরা ফায়ার বন্ধ করে দিলাম। যাতে সৈন্যরা মনে করে, মুজাহিদরা পালিয়ে গেছে। ফায়ারিং বন্ধ হতেই সৈন্যরা গাড়ী থেকে বেরিয়ে আড়াল নেয়ার জন্যে দৌড় দেয়। আমরা তাদের এ ভুল পদক্ষেপেরই অপেক্ষায় ছিলাম। মুজাহিদদের ক্লাশিনকোভগুলো আবার গর্জে উঠে। সাথে সাথে কিছু সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

আনুমানিক আড়াই মিনিট পর আমরা ফায়ার বন্ধ করলাম, এরপর তারা কি পদক্ষেপ নেয় তা দেখার জন্য। তারা কোন প্রতিরোধই করল না। বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা একে অন্যকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়া শুরু করে। আহতরা ‘হায় রাম’ ‘হায় মাতা’ বলে চীৎকার জুড়ে দেয়।

তাদের মত এরূপ আর্তচীৎকার বর্তমান কাশ্মীরের নিত্যদিনের দৃশ্য। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভীরু সেনাদল হল হিন্দুরা। এ কথা সত্য যে, ভীরু জাতি কুটিলমনা হয়ে থাকে। নিরস্ত্র জনতাকে হামলার সময় এরা নেকড়ের চেয়েও হিংস্র হতে পারে।

তিন মিনিটের ভেতর এ্যাকশন শেষ করে পিছনে সরে আসার প্রোগাম ছিল। তিন মিনিট শেষ হতেই কোরেং পার্টি ফায়ার শুরু করে। আমরা পিছু হটে আসি। আমরা পিছু হটে আক্রমণ অব্যাহত রাখলে সব কয়টি সৈন্য নিহত হত, হাতে প্রচুর গনীমতও আসত। কিন্তু এ সব করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা অপারেশন শেষ করে নির্দিষ্ট এক স্থানে পৌছে গেলাম।

আমাদের পৌছার পরই বাকী সব গ্রুপও পৌছে গেল। আল্লাহর রহমতে আমাদের একজন সাথীও আহত হয়নি। আমি নিশ্চিত হলাম, এ তরুণ মুজাহিদরা যে কোন যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়তে পারবে, সে সাহস এদের আছে।

আমার ধারণা ছিল, এ এ্যাকশনের পর এ এলাকায় সৈন্যদের ধরপাকড় বৃদ্ধি পাবে। তাই আগেই এ স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ঐ দিনই আমাদের অস্থায়ী ট্রেনিং সেন্টার এর অস্তিত্ব মিটিয়ে দেয়া হয়।

বডগামের ট্রেনিং সমাপ্ত হওয়ার পর আমার পরবর্তী মনযিল ছিল ইসলামাবাদ। ভবিষ্যতে মুজাহিদদেরকে এ্যাকশন প্ল্যান দেয়ার জন্যে ঝটিকা সফর শুরু হল। কিন্তু সবখাবেই আমি এই বেদনাভরা কণ্ঠ শুনতে পেলাম,

আমাদের অভাবটা জনসংখ্যার নয়, অভাব অস্ত্রের।

পরিস্থিতি এমন যে, অনেক মুজাহিদের নিকট ক্লাশিনকোভও নেই। কারো ক্লাশিনকোভ আছে কিন্তু গুলী নেই। কারো মুখে এ কথা শুনা যায়নি, আমরা ক্ষুধার্ত, আমরা বস্ত্রহীন। অথচ থাকা-খাওয়ার সমস্যাও তাদের প্রকট। কিন্তু সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ কম। তাদের সমস্যা একটিই, ক্লাশিনকোভ আর গুলী।

আমি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, বন্ধুরা, আল্লাহর উপর ভরসা দৃঢ় কর। তারই আশ্রয়ে এই জিহাদের সূচনা, অগ্রযাত্রা এবং সফলতা। আমাদের সমস্যার সমাধান করবেন তিনিই। সৈন্যদের থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ওই অস্ত্র দিয়েই তাদেরকে ঘায়েল করতে হবে। আল্লাহর রহমতে এ পদক্ষেপ ও পরামর্শ খুবই সফল হয়।

জনাব আহসান ডারের সঙ্গে আমার বিভিন্ন এলাকার মুজাহিদ ও সাধারণ জনগণের সাথে সাক্ষাৎকার গ্রহণের এক পর্যায়ে পালওয়ামা নামক গ্রামে পৌছি। এখানে এক হিন্দু পন্ডিতের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ আলাপ হয়। গ্রামবাসী ও স্থানীয় মুজাহিদরা আগেই আমাদের আসার সংবাদ দিয়েছিল। ফলে পথেই বহু লোক আমাদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। গ্রামের নিকটে পৌছতেই আর এক হিন্দু পণ্ডিত দৌড়ে আমাদের দিকে আসে। নিকটে আসলে আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি, দৌড়াচ্ছেন কেন?

উত্তরে বলল, “আজকে আমার ছেলের বিবাহ। তাই আপনাদেরকে বিবাহ অনুষ্ঠানে নিতে এসেছি।’

একজন হিন্দুর এরূপ ব্যবহারে আমি বিস্মিত হলাম। আমরা ব্যস্ততা দেখিয়ে বললাম, আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতেই হল। স্থানীয় মুজাহিদরা তার সম্পর্কে বলল যে, তিনি কোন সন্দেহজনক ব্যক্তি নন।

হিন্দু পণ্ডিত আমাদের সামনে রকমারী খাদ্য পরিবেশন করেন। যে খাবারের ব্যাপারে পূর্ণ বিশ্বাস হল যে, এটা হালাল, আমরা শুধু সেগুলোই গ্রহণ করলাম। এক ফাকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি মুজাহিদের ভয়ে এ নিমন্ত্রণ করছেন? বেশীর ভাগ হিন্দুই তো কাশ্মীর ছেড়ে জম্মু চলে গেছে। আর আপনি এখানে রয়ে গেলেন কেন?

তিনি বললেন, প্রথমে ভয় ছিল। সরকার আমাদের জানায় যে, মুসলিম উগ্রবাদীরা তোমাদের হত্যা করবে। ওরা খুব অত্যাচারী। তাই কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাও। আমার আত্মীয়-স্বজন সবাই এ ভয়ে কাশ্মীর থেকে পালিয়ে যায় ।

আমি কিছু সমস্যার কারণে যেতে পারিনি। কয়েকদিন পর মুজাহিদরা এ গ্রাম। দখল করে নেয়। তারা আমার নিরাপত্তা দানের সাথে সাথে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের সকল সম্পত্তি হেফাযতের দায়িত্বও গ্রহণ করে। এখন আমি নির্ভয়ে বসবাস করছি। এখন আগের চেয়ে বেশী নিরাপত্তা বোধ করছি। পক্ষান্তরে, মুজাহিদদের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের সহায় সম্পত্তি জম্মুতে ভারতীয় সেনাক্যাম্পে ভাগ বাটোয়ারা হচ্ছে।’

আমি তাকে বললাম, কিন্তু পণ্ডিতজী! আপনার ভারত সরকার কি করছে, তা কি দেখছেন?

এক পর্যায় পণ্ডিত মশাই খুব আবেগাপ্লুত হয়ে বলে উঠলেন, ভারত আর তার সৈন্যদের সাথে এখন আমাদের কোনরূপ সম্পর্ক নেই। আমাদের সহমর্মিতা আর সহযোগিতা সব মুজাহিদদের সাথে। অস্ত্রধারী বীর যুবকদের জন্যে আমাদের দরজা উন্মুক্ত। মুজাহিদদের চরিত্র-মাধুর্যে আমরা মুগ্ধ।

আমি তাকে কিছুটা অপ্রকৃতস্ত করে বললাম, এ সব বলছেন জীবনের ভয়ে।

ভগবানের দোহাই, যা কিছু বলেছি সবটাই আমার মনের কথা, এটাই বাস্তব এবং সত্য। আপনি স্থানীয় মুসলমানদের জিজ্ঞেস করে দেখুন।

বাস্তবতা হল, ভারতীয় উৎপীড়ন সত্ত্বেও মুজাহিদরা কঠোরভাবে ইসলামী। অনুশাসন মেনে চলছেন। তারা কেবল হিন্দুদের মাথা গোজার ঠাই নয়, পূর্ণ হেফাজতের দায়িত্বও কাঁধে নিয়েছেন। কাশ্মীরের সর্বত্রই আমি এ চিত্র দেখেছি।

আবার জম্মুর পথে

পুনরায় ইসলামাবাদ পৌছলাম । ভাই আহসান ডার আমাকে এবং ওহীদ শেখকে বলল, আমার সাথে বানেহাল চল।

বানেহাল শহরে কয়েকদিন আগে মুজাহিদরা ভারতীয় সেনাদের যোগাযোগ কেন্দ্রে প্রচণ্ড হামলা চালিয়েছিল, যার ফলে কাশ্মীর বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে জম্মুর গত প্রোগ্রাম সফল হয়নি। তাই এবার জম্মু যাওয়ার সুসংবাদ শুনে সব ক্লান্তি নিমেষে মিলিয়ে যায়।

আহসান ডারকে বললাম, জম্মু গমনকারী এ কাফেলায় আমরা বিশজন সাথী। অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সড়ক পথে যাওয়াটা নিরাপদ নয়।

অবশেষে পাহাড়-জঙ্গল, নদী-নালা পেরিয়েই আমরা চলতে লাগলাম।

পরদিন রাতের অন্ধকারে আমরা বানেহাল পৌছে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়লাম। সুমধুর আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার আযান ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ক্লান্ত মুজাহিদরা উঠে বসে। ঘুম আর হীম শীতল পানি কোনটাই মুজাহিদকে নামাজ হতে বিরত রাখতে পারে না। ঐক্য ও সংহতির সুন্দরতম বিকাশ একমাত্র আল্লাহর সামনে নত মস্তকে দাঁড়ানোর মধ্যেই ঘটে। নামায আল্লাহর সাথে বান্দার সেতুবন্ধন। এ বন্ধন সুদৃঢ় হলেই মুজাহিদদের প্রতি আল্লাহর নুসরত নেমে আসে। এ বন্ধনই প্রচণ্ড ক্ষুৎপিপাসা সত্ত্বেও আমাদেরকে সদা কর্মতৎপর করে রাখে। এ বন্ধনই মর্টার সেলের অমানবিক নিপীড়নও অম্লান বদনে সয়ে যাওয়ার শক্তি যোগায় আল্লাহর সৈনিকদের।

নামায শেষ হতেই দলে দলে মুজাহিদ আসতে থাকে। মিটিংয়ে সকলের একটাই দাবী, আমাদের এ্যাকশন শুরু করার অনুমতি দিন। আহসান ভাই খুব কষ্টে তাদের বুঝালেন। জম্মুর তৎপরতা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। তাই মজবুত নেটওয়ার্ক তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এ্যাকশন হতে বিরত থাকতে হবে। তাদের দায়িত্ব দেয়া হল, গ্রামে গ্রামে জনমনে জিহাদ ও আজাদীর অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করার। আপাততঃ এটাই আপনাদের কাজ।

মহা-প্রলয়ের মাঝেও সুখ-দ্রিা

ফিরতি পথে পারওয়ামা জিলার এক গ্রামে পৌছলাম। রাত হয়ে যাওয়ায় এ গ্রামে ঘুমিয়ে পড়লাম। কাফেলায় আমার বন্ধু শওকত ভাইও ছিল। একটানা দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি; তাই বিছানায় যেতেই ঘুমিয়ে পড়ি। সম্ভবতঃ রাত তিনটা হবে। কেউ আমাকে ঝাকি দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আমি পার্শ্ব বদল করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।

আমি এখানে গভীর ঘুমে অচেতন আর বাইরে ঘটে যাচ্ছে মহাপ্রলয়। সৈন্যরা আমাদের রাতের গোপন মিটিংয়ের সংবাদ পেয়েছিল। বহু বিশিষ্ট মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ সভায় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ছিল দ্বিতীয় সারির অর্ধশতাধিক মুজাহিদ। এরূপ মোক্ষম সুযোগটি সৈন্যরা লুফে নিতে চাইল। মাঝরাতে ইসরাইলী ইন্টেলিজেন্স মোসাদের হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ভারতীয় ব্লাক ক্যাট (কালো বিড়াল) সারা গ্রাম ঘেরাও করে ফেলে। বাইরে ক্লাশিনকোভ আর

রকেট-লাঞ্চারের প্রচণ্ড গোলাগুলী হচ্ছে। আর আমি তখনও ঘুমে অচেতন।

ব্ল্যাক ক্যাট সৈন্যদের সাথে পাহারারত মুজাহিদদের প্রথম সংঘর্ষ হয়। একজন মুজাহিদ ফাক পেয়ে দৌড়ে এসে বিশ্রামরত মুজাহিদদের সংবাদ দেন যে, ভারতীয় সেনারা চারিদিক হতে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। তাই যে কোন ভাবে তোক বেষ্টনী ভেঙ্গে আমরা যেন বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। সংবাদ পেয়ে সকলের হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। আমি ভিন্ন কামরায় থাকাতে তারা আমাকে জাগাতে পারল না। বাড়ীর মালিকও আমাকে জাগানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এত গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিলাম যে, গোলাগুলীর প্রচণ্ড শব্দও কানে যাচ্ছিল না।

আমার সাথী মুজাহিদরা সংঘর্ষের ফাঁকে ফাঁকে ব্ল্যাক ক্যাটের ঘেরাও ভেঙ্গে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন। ঘেরাওয়ের বাইরে গিয়ে সাথীদের গণনা করার পর খবর হয় যে, শামশীর খান তো বেরুতে পারেনি। বাড়ীর মালিক তাদের বলল, “আমি তো তাকে জাগিয়ে হামলার সংবাদ দিয়েছিলাম। সে এখনও কেন আসছে না।’

ব্ল্যাক ক্যাটরা পা পা করে ওই ঘরের দিকে অগ্রসর হয়, যেখানে আমি অচেতনভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি পেছনে পড়ে যাওয়ায় সবাই শঙ্কিত হন। শওকত ভাই শঙ্কিত হন সবচেয়ে বেশী। তিনি আহসান ডারকে বললেন, ‘আমি ঐ ঘরে গিয়ে শামশীর ভাইকে নিয়ে তবে ফিরব।’

আহসান ডার বলল, ‘পাগল হলে নাকি? শামশীর তো এতক্ষণে শহীদ হয়ে গেছেন। আর না হয় কমাণ্ডোর হাতে বন্দী অবস্থায় রয়েছে। এখন গিয়ে কোন লাভ নেই, সারা গ্রাম কমাণ্ডোদের দখলে। এর ভিতরে তাদের বেস্টনী ভেঙ্গে মুজাহিদরা বের হয়ে এসেছেন। পুনরায় তাদের ফাঁকি দিয়ে যাওয়া আবার ফিরে আসা অসম্ভব।

আহসান ডার শওকত ভাইকে ভিতরে যেতে নিষেধ করে। কমাণ্ডার ইন চীফের এ কথা শুনেও শওকত ভাই বলল, “নিশ্চয়ই আপনি আমাদের চীফ কমাণ্ডার, আপনার আদেশ পালন করা আমাদের কর্তব্য। তবে আপনিই তো আমাকে শামশীর ভাইয়ের গার্ডের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাই তার হেফাজত এবং শত্রুর ঘেরাও থেকে তাকে নিয়ে আসার দায়িত্বও আমার। জীবনের বিনিময়ে হলেও আমি এ কর্তব্য পালন করতে চাই। আপনি আমাকে বাঁধা দিবেন না। আমি যাবই এবং শামশীর ভাইকে নিয়েই তবে ফিরব।’

অন্যরাও শওকত ভাইকে বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। সকলের বাধা উপেক্ষা করে ক্লাশিনকোভ হাতে গ্রামের দিকে চললেন।

তিনি ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডোর দুর্ভেদ্য বেষ্টনী ভেঙ্গে তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমার কক্ষে পৌছলেন। ফায়ারের প্রচন্ড শব্দ তখনও আমার ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি। আর শওকত ভাই শামশীর ভাই!’ বলে মৃদু স্বরে ডাকতেই আমি জেগে উঠি। এটা সম্ভবতঃ শওকত ভাইয়ের ভালবাসা ও হৃদ্যতারই আকর্ষণ।

আমি জেগে উঠে বেরিয়ে আসলাম। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, শামশীর ভাই! কি মহাবিপদ ডেকে আনলেন আপনি, কমাণ্ডোরা ঘেরাও করে আছে। আর আপনি ঘুমোচ্ছেন। সবাই তো চলে গেছে। জলদী করুন, কমান্ডোরা এক্ষুণি ঘরে ঢুকবে।

আমি মনে করলাম, হয়ত কোন সাধারণ ক্রেক ডাউন হবে। সহজেই বেরিয়ে পড়তে পারব। বললাম, আপনাকে এত পেরেশান দেখাচ্ছে কেন?

শওকত ভাই বলল, ভাই! ঘটনা মারাত্মক। এরা সাধারণ আর্মী নয়- ব্ল্যাক ক্যাট। তাও হাজার হাজার। জলদী বের হয়ে যান।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পরই অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পারলাম। কমাণ্ডেরা বেধড়ক ফায়ার করে চলছে। মুজাহিদদের বেরিয়ে যাওয়ার কোন খবর এখনও তারা পায়নি। তারা কয়েকশ মিটার দূর থেকে সোজা আমাদের দিকেই গুলী ছুড়ছিল। ঘরের অদূরেই জঙ্গল ও বাগান। শওকত ভাই সেদিকে ইঙ্গিত করে বলল, আপনি ওদিকে চলে যান, আমি অন্য দিক হতে কমাণ্ডোদের উপর ফায়ার করি।’

আমি বললাম, তুমি একা ওদিকে যাবে কেন, বরং আমরা একত্রেই যাই।

আমার কথা শুনে শওকত রেগে বলল, ‘বুঝছেন না কেন, চুপচাপ আমার কথা শুনুন। নাকের ডগায় দুশমন দাঁড়িয়ে আছে। আর আপনি অযথা সময় নষ্ট করছেন। প্রতি মুহূর্তে বেষ্টনী সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে।

আর কোন কথা না বলে তখনই দৌড়ে বাগানে ঢুকলাম। শওকত ভাই এক দেয়ালের আড়ালে দাড়িয়ে তিনটি ফায়ার করল। এটা ছিল আমার প্রতি সাঙ্কেতিক নির্দেশ। আমি দৌড়ে গাছের আড়ালে পৌছে গেলাম। তখনও আমার দিকে গুলী আসছিল। পাঁচ মিনিট কমান্ডোদের দিকে ফায়ার করলাম, যাতে এ ফাঁকে শওকত ভাই বেরিয়ে আসতে পারে। পনের মিনিট অপেক্ষার পর শওকত ভাই আসল না দেখে আমি ক্ষেতের মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকি।

এক মসজিদের ইমামের সাথে সাক্ষাৎ

অনেক পথ চলার পরও সাথীদের কারো সাক্ষাৎ পেলাম না। আমাদের দু’জনের অপেক্ষা করে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে তারা। কোন দিকে যাচ্ছি তার ঠিক নেই। ক্ষণিক পর ভোরের আলো ফুটে ওঠে। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি। পা

চলছিল না। তার উপর উভয় পা ক্ষত-বিক্ষত। কারণ, কে যেন ভুলে আমার জুতা নিয়ে গেছে।’

সূর্য ওঠার আগেই এক গ্রামে পৌছি। একটি মসজিদ দেখে আমি দাঁড়ালাম। শশ্রুমণ্ডিত ইমাম সাহেব বাচ্চাদের কুরআন পড়াচ্ছেন। মসজিদে ঢুকে তাকে মুজাহিদদের সংবাদ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি প্রথমে আমার দিকে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

বললাম, আমি বহিরাগত মুজাহিদ। মিলিটারী আমার পিছু নিয়েছে। আমার সাথী মুজাহিদদেরও সন্ধান পাচ্ছি না।

আমার রক্তাক্ত পায়ের উপর দৃষ্টি পড়তেই তার মনের ভাব পাল্টে গেল। সোহাগমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘বেটা! তোমার জুতা কোথায়?

‘এক মুজাহিদ সাথী ভুলে আমার জুতা পরে নিয়েছেন।

এ কথা শুনে তিনি নিজের জুতা দুটি খুলে আমাকে পরিয়ে দিলেন। এরপর বললেন, মুজাহিদরা এ পথেই গিয়েছে। সামনে একটা নালা দেখবে, তা পার হয়ে হাঁটলে তুমি মুজাহিদদের খোঁজ পাবে।’

তার কথামত অগ্রসর হলাম। নালা পার হয়ে দেখি, আমার মুজাহিদ সাথীরা বসে আছে। আমাকে সামনে দেখেও তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, আমি এখনও জীবিত। তারা পরস্পর বলতে লাগল, আহসান ভাই তো তখন শওকত ভাইকে যেতে দিতে চাচ্ছিলেন না। এখন দেখ! আমাদের বীর শওকত ভাই কিভাবে শামশীর ভাইকে দুশমনের পাঞ্জা থেকে মুক্ত করে এনেছেন।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম, বীর শওকত নিজেই আবার শত্রুর খপ্পরে পড়ে যাননি তো। আহসান ডার আমার পূর্ণ বিবরণ শুনে শওকত ভাইয়ের জন্য পেরেশান হয়ে পড়েন।

ব্র্যাক ক্যাট কমান্ডোদের সাথে সম্মুখ সমরে

সামান্য অগ্রসর হতেই দেখি, কালো বিড়াল’রা আবার আমাদের নাকের ডগায় এসে উপস্থিত। আমি আহসান ভাইকে বললাম, এরা সাধারণ আর্মী নয়। অত সহজে এরা আমাদের পিছু ছাড়বে না। তাই আমাদেরকে সাধারণ গেরিলা পদ্ধতি ছেড়ে সম্মুখসমরে লড়তে হবে।

সবাই এতে একমত হলাম। সমস্ত মুজাহিদকে দু দু’জন করে ভাগ করে দেয়া হলে সবাই স্ব স্ব পজিশনে পৌছে যায়। ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডোরা সতর্ক পদে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা ফায়ার শুরু করে দেয়। আমরা নীরব থাকি।

সৈন্যরা আরও খানিকটা সামনে অগ্রসর হলে তাদের অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্যে আমরা কয়েক রাউণ্ড গুলী করলাম। এরপর উভয় দিক হতে ফায়ারিং শুরু হয়ে যায়। ব্ল্যাক ক্যাটরা মনে করেছিল, তাদের ভয়ে আমরা পজিশন ছেড়ে পালাব, তখন আমাদেরকে খতম করবে। ‘

তারা খুব জোশের সাথে আরও অগ্রসর হলে আমাদের মাপা মাপা ব্রাশ ফায়ার তাদের অভ্যর্থনা জানায়। এতে বেশ ক’টি ব্ল্যাক ক্যাট চিতপটাং হয় এবং বাকীরা সতর্ক পদক্ষেপে পিছিয়ে যায়। তাদের ভুল ভাঙ্গে যে, প্রতিপক্ষ দুর্বল নয় ।

এভাবে দু’ঘন্টা অতিবাহিত হয়। এ সময় আশপাশের সব এলাকায় দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, আহসান ডার ও শহীদ শেখকে ব্ল্যাক ক্যাটরা ঘেরাও করে রেখেছে। তাই যে মুজাহিদই এ সংবাদ পায়, সে দৌড়ে এসে আমাদের সাথে মিলিত হতে থাকে।

ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডোদের নিয়ে ভারত বেশী গর্বিত। এক ঘন্টা পর্যন্ত ভারতের এ গর্বের ধন সোনা মানিকেরা আমাদের বেষ্টনীতে আটকা পড়লে ফাঁক-ফোকর দিকে ইদুরের মত পালানোর চেষ্টা শুরু করে। কমাণ্ডোরা ওয়ারলেসের মাধ্যমে। ক্যাম্পে যোগাযোগ করে জরুরী সাহায্য তলব করে। অপরদিকে আমাদের উপর নেমে আসে অদৃশ্য সাহায্য।

সেনাবহর ধ্বংস

খালিদ ভাই ও এজায ভাইসহ এক গ্রুপ মুজাহিদ রণাঙ্গনের মাইলকয়েক দূর দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তারা দেখতে পেলেন, চল্লিশটি কনভয় এক সেনাবহর রাস্তা দিয়ে আসছে। এ সেনাবহর যাচ্ছিল ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডোর সাহায্যে। ওই মুজাহিদরা দূর থেকেই তাদের আসতে দেখে ওঁত পেতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন।

ক্লাশিনকোভ ও রকেটলাঞ্চারসহ আত্যাধুনিক অস্ত্র মুজাহিদদের হাতে ছিল। তারা পজিশন নিয়ে নেন। গাড়ী খুব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। তারা কল্পনাও করতে পারেনি যে, প্রতিপদে তারা মৃত্যুর পানে এগিয়ে চলছে।

সেনাবহর গুলীর রেঞ্চের আওতায় আসতেই মুজাহিদদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। রকেটের আঘাতে বেশ কয়েকটি গাড়ীর ছাদ উড়ে যায়। তার সাথে কয়েক ডজন সৈন্যও খতম হয়। ক্ষণিক সংঘর্ষের পর বহরের সব গাড়ী বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা এবার দৌড়ে পেছন দিকে ভাগতে থাকে।

ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডোরা ওয়ারলেসের মাধ্যমে এ সংবাদ পাওয়ার পর আমাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে অস্থির হয়ে পড়ে। এতক্ষণে সারা এলাকায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। স্থানে স্থানে মুজাহিদ ও কমাণ্ডোদের মাঝে প্রচণ্ড ফায়ারিং চলতে থাকে।

সন্ধ্যা পাঁচটা পর্যন্ত লড়াই চলে। এ সময় আমাদের চিন্তা হল, ব্ল্যাক ক্যাটের সাহায্যার্থে আরও. সৈন্য এসে পড়বে। ফলে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বন্দী বা শহীদ হবার আশঙ্কা আছে।

সিদ্ধান্ত হল, সংঘর্ষ বন্ধ করে আমরা এলাকা ছেড়ে চলে যাব। আমরা ফায়ার বন্ধ করে পেছনে সরে আসতে শুরু করলে ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডেরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তারা মৃত সৈন্যদের লাশ ফেলে ইঁদুরের চেয়েও ভীরুতার প্রমাণ দিয়ে উধ্বশ্বাসে পালিয়ে যায়। পরে জানতে পারি যে, ব্ল্যাক ক্যাটের সাহায্যে প্রেরিত সৈন্যরা রণাঙ্গনের অদূরে অন্য এক মুজাহিদ গ্রুপের হাতে পরাজিত হয়।

হৃদয়বিদারক সংবাদ।

সন্ধ্যার সময় এক ব্যক্তি এসে এ মর্মান্তিক সংবাদ দিল যে, শওকত ভাই শহীদ হয়ে গেছেন। আমাকে বিদায় দেয়ার পর কমাণ্ডোদের সাথে সংঘর্ষের সময় ব্রাশ ফায়ারে তার দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তাঁর গুলীতে নিহত তিন কমাণ্ডো সেনার লার্শ তার পাশেই পড়ে ছিল।

শওকত ভাইয়ের শাহাদাতের সংবাদে আমার বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু নির্ভীক মুজাহিদ আমাকে মুক্ত করে নিজে আল্লাহর পথে জীবন বিলিয়ে দিলেন! মুজাহিদরা সবাই শওকত ভাইর জন্যে ছিল পাগলপারা। আমার জন্যে তার ত্যাগ ও কুরবানী চির জীবন হৃদয়ফলকে অঙ্কিত থাকবে।

শওকত ভাইয়ের পরিবার শেখ আবু আব্দুল্লাহ্র ন্যাশনাল কনফারেন্সের সমর্থক। তবে জিহাদের আহবান শুনে শওকত ভাই অস্ত্র হাতে তুলে নেন। তখন তার আব্বা কাশীর আযাদী আন্দোলনের বিরোধী ছিল। শওকত ভাই কয়েক বার আমাকে বলেছিল, ‘আমার আব্বা জিহাদের বিরোধী, তাই তাকে আমি গুলী করে মারব।’

শওকত ভাইকে দাফন করা হল। এ যুদ্ধে ওদের ১৫০ জন সৈন্য নিহত ও ৪০টি গাড়ী সমপূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। অল ইণ্ডিয়া রেডিও সরকারের প্রেস নোটের বরাতে প্রচার করে যে, এ যুদ্ধে সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর আমাদের এক সাথী শাহাদাতের সৌভাগ্য লাভ করে।

দ্বিতীয় মর্মান্তিক সংবাদ হল, যে ইমাম সাহেব আমাকে তার জুতা পরিয়ে পথ দেখিয়ে সাহায্য করেছিলেন, তাকেও গুলী করে শহীদ করা হয়েছে। আমি চলে আসার পর কমাণ্ডোরা গ্রামে এসে ইমাম সাহেবকে জিজেস করে সন্ত্রাসীরা

এদিক দিয়ে যায়নি তো? ইমাম সাহেব ‘আমি জানি না’ বললে, তার উপর চরম নির্যাতন করা হয়।

এরপর ঐ নরপশুরু কুরআন পাঠকারী নিস্পাপ শিশুদের মারতে মারতে জিজ্ঞেস করে, বল সন্ত্রাসীরা কোনদিকে গেছে? শিশুরাও বলতে অস্বীকার করে। শেষে তারা ছোট্ট একটি শিশুর চুল ধরে শূন্যে তুলে বলে, মুজাহিদরা কোনদিকে গেছে না বললে তোকে আছড়িয়ে মারব।’

অসহ্য বেদনায় নীল হয়ে যায় শিশুটির ফুল-পাপড়ীর মত কোমল চেহারাখানি। প্রাণভয়ে সে বলে দেয়, এক অস্ত্রধারী এখান দিয়ে গেলে উস্তাদজী তাকে জুতা পরিয়ে দেন। এ কথা শুনে কমাণ্ডারা ইমাম সাহেবের উপর ব্রাশ ফায়ার করে। আল্লাহর এ প্রিয় বান্দা মসজিদের চত্বরেই রক্তাক্ত বদনে লুটিয়ে পড়েন।

এ এলাকা আর নিরাপদ নয় দেখে আমরা তখনই শোপিয়া শহর রওনা দেই। পরে সৈন্যরা এসে শুধু তাদের বিধ্বস্ত গাড়ী ও মৃত সৈন্যদের লাশ ছাড়া কিছুই পায়নি।

শামসুল হক ভাই আমাকে জানালেন, কয়েকদিন হল, একজন পাকিস্তানী মুজাহিদ এসেছেন এবং তিনি শ্রীনগরে অবস্থান করছেন। লোকটি অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ও উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করলে বলল বাশারত আব্বাসী’। বাশারত আব্বাসী সম্পর্কে ইতিপূর্বে অনেক কথাই শুনেছি। তাই তার সাথে সাক্ষাত করার জন্য আমার মন উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

এ সময় কাশ্মিরী মুজাহিদ ফ্রন্ট পাকিস্তানী মুজাহিদদের আগমন প্রত্যাশী ছিল। আমি সুপ্রীম কমান্ডের কাছে ব্যক্তিগতভাবে অনেকবার চিঠি লিখেছি,

পাকিস্তান থেকে কাশ্মীর ফ্রন্টে লোক পাঠানোর জন্যে। আমার চিঠি লেখার উদ্দেশ্য এ নয় যে, কাশ্মীরে মুজাহিদের সংখ্যা কম। বরং আমার উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানীদের আগমনে কাশ্মিরী মুজাহিদদের মধ্যে সাহস বৃদ্ধি পাবে তারা বুঝতে পারবে, দখলদার ভারতীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শুধু আমরাই লড়াই করছি না, বহির্বিশ্বের মুসলিম ভাইয়েরাও আমাদের সাথে আছে।

বাস্তবেও দেখা গেছে, কাশ্মিরীদের সাথে কোন পাকিস্তানী মুজাহিদ থাকলে তারা দ্বিগুণ উৎসাহ ও শক্তিতে বলিয়ান হয়ে দুর্দমনীয় হামলা চালিয়েছে।

বাশারাত ভাইকে দেখার জন্যে আমি শ্রীনগর এলাম। শামসুল হক ভাইয়ের সাথে আগেই আমি শ্রীনগর আসার প্রোগাম করেছিলাম। সারাদিন গায়ের মেটো পথে পায়ে হেঁটে সন্ধ্যায় শ্রীনগর উপকণ্ঠে পৌছলাম।

একটি গোপন আস্তানায় শামসুল হক ভাইয়ের সাথে আমার সাক্ষাত করার কথা ছিল। সেখানে গিয়ে আমি তাকে পেলাম না। তখন তিনি অন্য এক কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি হাজির হল। তিনি আমাকে বললেন, বাশারত ভাই এর সাথে সাক্ষাত করতে হলে আপনাকে পোশাক বদল করে অস্ত্র রেখে যেতে হবে।

ভোর বেলায় আমরা গোপন স্থানে পৌছার জন্যে রওনা হলাম। পথে কুয়াশায় আমাদের শরীর ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। আমি আগে থেকেই। প্যান্ট-শার্ট পরে ছিলাম। শামসুল হক ভাইয়ের পরনে সাফারী স্যুট। আমাদের পোশাক দেখে কেউ মুজাহিদ মনে করার সুযোেগ ছিল না।

গন্তব্যে পৌছে দেখি, আমাদের হাতিয়ার আগেই সেখানে পৌছে গেছে। তবে বাশারত ভাই এখনো সেখানে পৌঁছেননি। আগ্রহের আতিশয্যে আমি বার বার শামসুল হক ভাইকে জিজ্ঞেস করছিলাম, কি ভাই! বাশারত ভাই কখন আসবেন?

তিনি আমার কথার কোন জবাব দিচ্ছিলেন না। সময় গড়িয়ে জোহরের নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেল। শামসুল হক ভাই আমাকে নামায পড়াতে বললেন। আমি বললাম, ফ্রন্টের আমীরের উপস্থিতিতে ইমামতি করার ধৃষ্টতা আমার নেই।

তিনি বললেন, শামশীর ভাই! এটা আমার নির্দেশ।’

অগত্যা আমি নামায পড়ালাম। নামাযান্তে দুআয় আমি মুজাহিদদের অতি প্রিয় ও সর্ব পরিচিত একটি বাক্য আবৃত্তি করলাম, হে আল্লাহ! আমাদের ভাগ্যে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও শাহাদাতের মৃত্যু নসীব করুন।

মুনাজাতের পর শামসুল হক ভাই আমার উদ্দেশে বললেন, আপনার কোন সাথীকে যদি আল্লাহ শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করেন, তাহলে আপনার খুশী হওয়া উচিৎ, তাই না?”

বললাম, হ্যা, কেন খুশী হব না? আমরা সবাই তো এ পথেরই যাত্রী।

আমি তার কথা না বুঝেই জবাব দিয়ে বসলাম। গভীরভাবে তলিয়ে দেখিনি, শামসুল হক ভাই এ কথায় আমাকে কি বুঝাতে চাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসু নেত্রে তার দিকে তাকালাম। বললেন, শামশীর ভাই! আমরা যার সাথে সাক্ষাত করতে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এলাম, তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। বাশারত আব্বাসী, শহীদ হয়েছেন।

এ কথা শুনে আমি দুঃখে-শশাকে বিহব্বল হয়ে পড়লাম। আমার ধমনিতে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল। মনের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘বাশারত ভাই! আপনি আমাদের আগে চলে গেলেন! অথচ আমার তো বহু দিন, থেকে কাশ্মীর উপত্যকার পাহাড়-জঙ্গল, নদী-নালা, মাঠ-ঘাট চষে বেড়াচ্ছি। কিন্তু এ সুবর্ণ সুযোগ আমাদের হাতের মুঠোয় আসল না। আপনি এত সৌভাগ্যের অধিকারী যে, কাশ্মীর ফ্রন্টে পা রাখার সাথে সাথেই পরিতৃপ্ত হয়ে স্বর্ণশিখরে পৌছে গেলেন। সফর শুরু করলেন, আর সৌভাগ্যের স্বর্ণসিড়ি আপনার পা চুম্বন করল।

শামসুল হক ভাই ভেবেছিল, বাশারত আব্বাসীর শাহাদাতে আমি ভেঙ্গে পড়ব। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আমি নিজেকে সামলে নিয়ে নিলাম। বললাম, এ মহান মর্যাদা যাদের পাওয়ার, তারা পেয়ে গেছে, ভাগ্যান্বেষণকারীদের বসে থাকার অবসর কোথায়?

শামসুল হক ভাইকে উৎসাহিত করার জন্যে আমার মনোভাবের বিপরীতে বললাম ‘আমীরে মুহতারাম! আপনাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আমাদের এক বন্ধু আল্লাহর প্রিয় মনযিলে আমাদের আগে পৌঁছেছেন, আর আমরা তার পেছনে যাব। কোন অগ্রগামী অশ্বারোহী যদি দ্রুত লক্ষ্য স্থলে পৌছে যায়, তবে তাতে দুঃখ করার কি আছে, এ তো খুশীর ব্যাপার।

আমার এ অভিব্যক্তিতে শামসুল হক ভাই বললেন, ‘বাশারত আব্বাসী শ্রীনগরে শহীদ কবরস্থানে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন। আমাদের তার কবরের গিয়ে তাকে সালাম জানানো উচিত।’

এজন্যে আমি শহীদ কবরস্থানে যাবার ব্যবস্থা করে ফেললাম। শামসুল হক ভাই আমাদের নিষেধ করে বললেন, সেখানে যাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। ভারতীয় সেনাবাহিনী সব সময় শহীদ কবরস্থান ঘিরে রাখে । তোমার সেখানে গ্রেফতার হবার আশংকা আছে। এমন ঝুঁকি না নেয়া ভাল।

আমি বার বার তাকে অনুরোধ করলে শেষ পর্যন্ত তিনি যেতে অনুমতি দিলেন।

শহীদদের কবরস্থানে

জম্মু কাশ্মীরের শহর, গঞ্জ, পল্লীতে শহীদদের হাজারো কবর ছড়িয়ে রয়েছে। এমন কোন পল্লী নেই, যার মাটি কোন মুজাহিদের দাফনে ধন্য হয়নি। শ্রীনগরের বিশাল মাঠ শহীদ মুজাহিদদের কোলে নিয়ে শুয়ে আছে নীরবে। শহীদী কাফেলায় নিত্যদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন বাসিন্দা।

শহীদদের কবরস্থানে যাবার আগে একটি নিরাপদ স্থানে আমি পরিধেয় পোশাক বদলিয়ে নিলাম। গায়ে গেঁয়ো জামা আর পায়ে চপ্পল পরে আমি অতি সাধাসিধে কাশ্মিরী যুবকের বেশ ধরলাম। জামার ভিতরে ক্লাশিনকোভ লুকিয়ে নিলাম।

চারজন বৃদ্ধ ও দু’জন বালক নিয়ে নিরাপদে পৌছে গেলাম শহীদ কবরস্থানে। পথে ইন্ডিয়ান আর্মি আমাদের কোন জিজ্ঞাসাবাদ করেনি।

কবরস্থানে পৌছে ভাগ্যবান মুজাহিদদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম পেশ করলাম। বিস্তৃত মাঠে সারি সাটি শহীদের কবর। এরই মধ্যে আরো নতুন নতুন কবরের চিহ্ন দেখা যায়। এখানে দাফনকৃত প্রাথমিক শহীদদের অনেকের সাথেই আমার পরিচয় ছিল, ছিল গভীর সম্পর্ক। অনেকেরই নাম-পরিচয় আমি জানি না। কিন্তু এরা সবাই ছিল কাশ্মীরের মুক্তিপাগল বীর সন্তান। আযাদীর অগ্নিমশাল প্রজ্বলিত করে ওরা ঠাঁই নিয়েছে আল্লাহর প্রিয় সান্নিধ্যে।

নিযুত শহীদের কবরের পাশে আরো পাঁচ হাজার শহীদের দাফনের জন্যে জমিন উপযোগী করে রাখা হয়েছে। কবরস্থানের অদূরে একটি নাম ফলকে দৃষ্টিগোচর হল একটি বাক্য শহীদ মকবুল বাটের জন্যে অপেক্ষমান’।

শহীদ মকবুল বাটকে বিহার জেলখানায় গুলীবিদ্ধ করে শহীদ করার পর তাকে সেখানেই ওরা দাফন করে দিয়েছে।

আমি বাশারত আব্বাসী ভাই এর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছি, এ পাকিস্তানী জীবনপণ সংগ্রামী নেতা স্বীয় জীবন দিয়ে নিপীড়িত কাশ্মিরী ভাই-বোনদের হৃদয়ে গড়ে নিয়েছেন নিবিড় সম্পর্ক, যা কোন স্বার্থের টানাপড়েনে ভেঙ্গে যাবার নয়। নানা রংঙের ফুলে বাশারত আব্বাসীর কবরটি ঢেকে দিয়ে কাশ্মীরের ভাই-বোনেরা তাঁর প্রতি ঢেলে দিয়েছে কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসার অর্ঘ্য। তার বুকের উপর সবুজ জমিনে চাদ খচিত পাকিস্তানী পতাকা।

আমি তার শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে ফাতেহা পড়ে এ মর্দে মুজাহিদ ও সাথীদের জন্যে দুআ করলাম । আর যারা এ পথের যাত্রী, তাদের আকাঙ্খা পূরণে আল্লাহর সাহায্য চাইলাম। এরাই তো সেই কাফেলা, যারা আখেরাতে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিসিক্ত হবে এবং এরাই আমাদের সোনালী পথের দিশারী। যাদের খুনরাঙা তরবারীর বদৌলতে এখনো প্রবাহমান রয়েছে ঈমান ও ইজ্জতের আবে হায়াত।

অনেকক্ষণ আমি ঠায় নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম। সহযাত্রীরা আমাকে বলল, ‘চলুন, এখানে বেশীক্ষণ দাঁড়ানো নিরাপদ নয়।’

তাদের সাথে স্থানীয় মুজাহিদ আস্তানায় পৌছালে সেখানে শ্রীনগরের জেলা কমান্ডার মূসার সাথে দেখা হল। তিনি শ্রীনগরে আযাদী আন্দোলন আরো তীব্রতর করার জন্যে একটি মিটিং করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমাকেও এ মিটিংয়ে থাকার জন্যে বললেন। আমি রাজি হলাম।

এ গোপন মিটিংয়ে শ্রীনগরের সকল প্লাটুন কমাণ্ডার, ব্যাটলিয়ন কমান্ডার, কোম্পানী কমাণ্ডার ও জেলার সহকারী কমাণ্ডাররা উপস্থিত হল। শ্রীনগরে তখন ইণ্ডিয়ান গোয়েন্দাদের জোর তৎপরতা। মুজাহিদদের গতিবিধির খবর তাদের কাছে প্রতিনিয়ত পৌছে যাচ্ছিল। সরকারী গোয়েন্দাদের চর আমাদের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করে। কতিপয় গাদ্দারের অশুভ তৎপরতা আমাদের সব সময় শংকিত করে রাখে।

নির্ধারিত স্থানে পৌছানোর আগে আমরা শ্রীনগরের এক বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। আমাদের ধারণা ছিল, ইণ্ডিয়ান আর্মিদের কাছে আমাদের উপস্থিতির খবর পৌঁছালে ওরা ক্রেক ডাউন করবে।

খাওয়া সেরেই চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে আমরা সামনের একটি গ্রামে হাজির হলাম। এখানেই আগামী রাতে সবার মিলিত হবার কথা।

দোতালা বাড়ীর উপরে ছিলাম আমরা আর নীচে বাড়ীওয়ালা ও তার পরিবারবর্গ। গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হল, এক পর্যায়ে সকলেই ঘুমের ঘোরে সমুদ্রে গেলাম।

কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে যায় বিপত্তি। ভারতীয় আর্মি আমাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে।

অবরুদ্ধ অবস্থায়

আমরা সকলে তখনও সেই ঘরে ঘুমে বিভোর। ততক্ষণে ভারতীয় সেনারা পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। ভারতীয় সেনাদের একটি সাধারণ নিয়ম হল, মুজাহিদদের ভয়ে এরা একজনকে আটক করার উদ্দেশ্যে পুরো গ্রাম রাতের আঁধারে ঘিরে নেয় এবং সকাল পর্যন্ত চতুর্দিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। সকল মানুষের আগমন নির্গমন বন্ধ করে দেয় তারা।

ভোর বেলায় মসজিদের মাইক থেকে প্রচার করে, যদি কোন ব্যক্তি তাদের নির্দেশ অমান্য করে বেরিয়ে যেতে চায়, তাকে গুলী করে হত্যা করা হবে। এরপর ভোরের আবছা আঁধার পরিষ্কার হলে খানা তল্লাশীর মাধ্যমে মুজাহিদ ও সন্দেহভাজনদের খোঁজ করে। গ্রামের সকল নারী-পুরুষকে ভিন্নভিন্নভাবে একত্রিত করে গুপ্তচররা মুজাহিদদের সনাক্ত করার চেষ্টা করে।

আমাদের উপস্থিতি ও অবস্থান সম্পর্কে গুপ্তচরের তথ্য ছিল নির্ভুল । সঠিক তথ্যানুযায়ী এক ভারতীয় সিপাই সরাসরি আমাদের দোতলায় এসে ঢু মারে।।

তখন রাত তিনটা। পায়ের শব্দ পেয়ে আমাদের এক সাথী জেগে যায়। সে চোখ মেলেই সামনে ভারতীয় সিপাহীকে দেখে রাইফেলের দিকে হাত বাড়ায়। রাইফেলে হাত লাগাতেই সিপাই দৌড়ে নীচে নেমে চীৎকার দিলে বলল, “এখানে ১০/১২ জন সন্ত্রাসী শুয়ে আছে।

আবু খালেদ মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে প্রস্তুত করে আমাদের জাগিয়ে দেয় এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে সকলকেই অবহিত করে। সূবাই অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হল। কিন্তু আমার অস্ত্র ছিল আরেকজনের কাছে জমা দেয়া। রাতে সে বাইরে চলে গিয়েছিল।

একটা হতাশায় বুকটা ভরে গেল, এভাবে অসহায় অবস্থায় বিনা মোকাবেলায় ধরা পড়ব! প্রতিশোধের স্পৃহা নিবৃত করার সুযোগ পাব না! হঠাৎ করে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

কোন মতে এখান থেকে বের হয়ে সেনাদের কাছে নিজেকে সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রমাণ করানোর চিন্তা করলাম। আমার পরনে ছিল একটি দামী জ্যাকেট।

এক পকেটে লিবারেশন ফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্বলিত কাগজপত্র। এজন্যে। জ্যাকেটটি খুলে অন্য একজনের হাতে দিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে নীচে নেমে এলাম। তখন আমার অন্য অস্ত্রধারী সাথীরা মোকাবেলার পরিকল্পনা করছে।

নীচের আঙিনায় কোন সৈন্য দেখতে পেলাম না। আমাদের দেখে ঐ সৈনিকের চীৎকারে সৈনিকরা বাইরে পজিশন নিয়ে প্রস্তুত, যাতে ওরা আমাদের গুলী থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। আঙিনা ছেড়ে পা রাখতেই পাঁচ-ছ’জন সিপাই আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ওরা কমাণ্ড দিল হ্যান্ডকাপ পড়তে এবং পালানোর চেষ্টা না করতে।

আমি যে নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে প্রকাশ করার চিন্তায় বেরিয়েছিলাম, সেনাদের হুঁশিয়ারী উচ্চারণে সে কথা ভুলে গিয়ে ধমকে বললাম, ‘আমি বেরিয়ে যাবই।।

ধমকি দিয়ে পিছনের দিকে দৌড়ানোর চেষ্টায় যেই বাড়ালাম, অমনি পা পিছলে একটা খাদের মধ্যে পড়ে যাই।

টা-টা-স-স করে মাথার উপর দিয়ে কয়েকটি বন্দুকের গুলী চলে যায়। উপর থেকে মাটির দেয়াল ভেঙ্গে আমার গায়ে মাটি চাপা পড়ার উপক্রম। এটি ছিল কৃষকদের মৌসুমী পানি সেচের কৃপ। এই কূপে পড়ে যাওয়ার ফলে আমার গায়ে কোন গুলী বিদ্ধ হল না। আর তখনও অন্ধকার থাকায় আমি জীবিত না মৃত এটা পরখ করার সুযোগ সৈন্যরা পায়নি। অবশ্য খাদে না পড়লে সেনাদের বুলেটে আমার শরীর চালনীর মত ঝাঁঝরা হয়ে যেত।

অনেকক্ষণ মৃতের মত নীরব থেকে ক্রোলিং করে আবার ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম। আঙিনার দিকে আসতে দেখে আমার দেহরক্ষী আব্দুল আহাদ ভাই ভারতীয় সৈন্য মনে করে আমার প্রতি দু’টি ফায়ার করে বসে। আমি চীৎকার দিয়ে বললাম, আব্দুল আহাদ ভাই! আমি শামশীর।

উভয় ফায়ারই আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়, আমার কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু আমার চীৎকার শুনে আব্দুল আহাদ ভাই বলল, “আহ! শামশীর ভাই, আমি একি করলাম?

আমি দ্রুত তার কাছে পৌছে বললাম, কোন অসুবিধা হয়নি, আমি বিলকুল অক্ষত।

তখন সে যেন নতুন জীবন ফিরে পেল।

সেনাবাহিনী এমন এক অবস্থার সম্মুখীন হল যে, যদি তারা মুজাহিদদের গ্রেফতার করতে ঘরের দিকে অগ্রসর হয়, তা হলে মুজাহিদদের বুলেটে তাদের জান খোয়াতে হবে। জীবনের ভয়ে ওরা ঘরের দিকে আর পা বাড়ায়নি।

এদিকে মুজাহিদ কমাণ্ডার ইন চীফ অব শ্রীনগর মূসা ভাই এর কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আমি সাথী মুজাহিদদের বললাম, এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবেন? চলুন বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা করি, এখনও অন্ধকার আছে, সকাল হয়ে গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।

শ্রীনগরের প্লাটুন কমাণ্ডার বললেন, এই অবস্থায় বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা তো বিপজ্জনক।

আমি বললাম, ঘেরাও এর মধ্যে নিষ্ক্রিয় বসে থাকার মধ্যে তো ঝুঁকি আরো বেশী। আসুন, আমরা বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।

কিন্তু প্লাটুন কমাণ্ডার তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে আমি গম্ভীর রাগত স্বরে বললাম, আপনি নিজের সাথে অন্যদের জীবনও কেন অর্থহীন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন?

আমি সবাইকে বললাম, তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়, না হয় সময় হাতছাড়া হয়ে যাবে। আমি তাঁর বাজু ধরে নিজের সাথে নিয়ে চললাম। অন্য সাথীরাও অনুগামী হল। ফায়ারিং এর আওয়াজে ততক্ষণে গ্রামের মানুষ ঘরে বাতি জ্বালাচ্ছে। আমরা কয়েকটি বাড়ী পেরিয়ে গ্রামের সীমানায় পৌছে দেখি, সৈন্যরা বেরিকেড দিয়ে রেখেছে। সব ঘরে আলো জ্বলে ওঠার কারণে আমরা সেনাদের চোখে পড়ে যাওয়ার আশংকা হল। আমি চীৎকার দিয়ে বললাম, “ঘরের লাইট গুলো সব নিভিয়ে দাও, না হয় গুলী করব।

আমি একথা বললাম অনেকটা কর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। কিন্তু এতে দু’টো সুবিধা হল, আমরা অন্ধকারে নিরাপত্তা পেলাম আর সৈন্যরা মনে করল যে, উর্দুতে সৈন্যরা ছাড়া আর কেউ কথা বলে না, হয় তো কোন সেনা ইউনিট সন্দেহভাজন লোককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

এ ভাবে আমরা সকল সাথী সেনা ব্যারিকেড পেরিয়ে গ্রামের বাইরে চলে আসি। আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, সেনাবাহিনী একেবারে আমাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।

সেনাঘেরাও ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত ও মজবুত। তদুপরি সাথীদের মনোবল বাড়ানোর জন্যে আমি বললাম, আজ কোন ক্রেক ডাউন হচ্ছে বলে মনে হয় না। এটা সাধারণ সেনাঘেরাও! সতর্কতার সাথে দু’ দু’জন করে বেরিয়ে যান। অবশ্যই আমরা ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে যেতে সক্ষম হব।

আমার কথায় সবাই আশ্বস্ত হয়ে দু’জন করে বেরিয়ে পড়ল। আমি আর একজন পাকিস্তানী ভাইকে নিয়ে সবার পেছনে পড়ে গেলাম। এমন সময় আমার মনে হল কোন কাশ্মিরী ভাইকে আমার সাথে রাখা প্রয়োজন ছিল, কারণ এখানের পথ-ঘাট আমাদের চেনা নেই। কাশ্মিরী ভাষাও আমরা জানি না।

আমার যখন এ কথা খেয়াল হল, তখন সময় অনেক গড়িয়ে গেছে, এক সঙ্গীন অবস্থার মুখোমুখী আমরা। গ্রামের চতুর্দিকেই গোলাগুলী শুরু হয়ে গেছে।

আমাদের অনেক সাথী আর্মিদের পর্যদস্ত করে তখন মূল ব্যারিকেড পেরিয়ে গেছে। আমি বেরুনোর কোন পথ পাচ্ছিলাম না।

এমন সময় কমাণ্ডার আবু খালেদ ভাইকে আমাদের দিকে এগুতে দেখলাম। ভাবলাম, যে দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা তিনি করেছিলেন, হয়ত আর্মিরা তাঁর পথ আগলে রেখেছে। আবু খালেদ ভাইয়ের ব্যর্থতা আমাদের জন্যে বিরাট সহায়তা হিসাবে প্রতিভাত হল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার ফিরে এলেন কেন?

তিনি বললেন, আমি গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে সামনে এগুতেই দেখি, সেনাদের হাতের নাগালে এসে গেছি। ওরা আমাকে হাতিয়ার ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেয়।

আমি কাল বিলম্ব না করে ফায়ারিং করতে করতে এদিকে চলে এলাম।

ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা তিনজন এক সাথে আর্মি ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। ঘটনাক্রমে আমাদের তিনজনের মধ্যে রাইফেল ছিল মাত্র একটি। আমি তিনজনের অগ্রভাগে হাঁটছি। আবু খালেদ ভাই মধ্যে। আর করীম ভাই রাইফেল উচিয়ে সবার পেছনে। আমরা অতি সন্তর্পণে পথ চলে গ্রামের শেষ প্রান্তের একটি ঘন সফেদা বাগানে এসে পৌঁছলাম।।

রাতের আঁধার ফুটে সকাল হয়ে গেছে। যেই না ব্যারিকেড পেরিয়ে ওপারে যাবার জন্যে এগুলাম, আর্মিদের সাথে আমাদের চোখাচুখি হয়ে গেল। ওরা হাঁক দিল, “তোমরা কারা?’

আমরা দৌড়ে একটি ধান খেতে লুকিয়ে শুয়ে পড়ি। আর্মিরা আমাদের লক্ষ্য করে সমানে গুলী বর্ষণ করছে। কিন্তু একটিও আমাদের গায়ে লাগেনি।

আর্মিরা অব্যাহত গুলী বর্ষণ করছে, এর মধ্যেই আমরা দিক বদল করে ক্রোলিং করে ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। বহুদূর পর্যন্ত ক্ষেত বিস্তৃত ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে সব রাইফেল দিয়ে আর্মিরা ফায়ার করছে, সেগুলোর রেঞ্চ দেড় কিলোমিটারের বেশী নয়। এজন্য নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়ার জন্যে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি। ধান ক্ষেতের গভীর কাদায় আমরা বেশী দ্রুত অগ্রসর হতে পারছিলাম না। বার বার শক্তি হারিয়ে গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছিল।

ভোর সাড়ে চারটা থেকে বেলা ন’টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে ক্রোলিং করছি। দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা কাদা পানিতে গড়াগড়ি করে আমাদের শরীর এত বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল যে, যে কেউ দেখলে বলত, আমরা কাদা মাটিতে বসবাসকারী কোন জীব। সাথীদের কাউকে আর তার পূর্বের অবয়বে। সনাক্ত করা সম্ভব নয়। কাদায় ক্রোলিং করতে করতে শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে আমরা ক্রমশঃ প্রাণস্পন্দনহীন হয়ে যাচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ পর মাথা উঁচু করে একটি টিলা দেখে প্রায় নিরাপদ দূরত্বের কাছাকাছি পৌছে গেছি অনুমান করে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম।

সামনে অগ্রসর হতেই আবার বিপদ। সামনেই একটি সাঁকো। আমি পেরুতে অপারগ আর ওদিক থেকে গোলা বর্ষিত হচ্ছে তীব্রভাবে। এমতাবস্থায় আবু খালেদ ভাই গো ধরলেন- সঁকো পেরিয়েই যেতে হবে। বললাম, সাকো পেরুতে গিয়ে ধরা না পড়ি, বরং দিক বদলিয়ে অন্য পথে চলুন।

খালিদ ভাই বলল, তাহলে আমাদের গুলীর আওতায় পড়ে যাওয়ার আশংকা আছে।’

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল, আমরা ঘুরে যাব। একটি বড় আইল অতিক্রম করার জন্য আমরা তিনজন ৫০ গজ করে দূরত্বে থেকে রওনা হলাম। যেই আমি আইলের উপর উঠলাম, অমনি এক ঝাঁক গুলী আমার পাশে এসে পড়ে।

সঁকো ছাড়া খাল পেরুনোর আর কোন বিকল্প পথ রইল না। অগত্যা আমি নিজের অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কোন মতে সাঁকো পেরিয়ে একটি গাছের কাছে পৌছে গেলাম। করীম ভাই সঁকোয় ওঠা মাত্র তার শরীর ঘেষে শশা শো করে কয়েক রাউন্ড গুলী চলে গেল। তিনি শরীরটাকে বাঁকিয়ে আত্মরক্ষা করলেন। জীবনপণ চেষ্টা করে খুব তাড়াতাড়ি সাঁকো পেরিয়ে আমার কাছে গাছটির দিকে অগ্রসর হলেন।

গুলি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে আমি গাছের আড়ালে চলে গেলাম। তখন আমরা আর্মিদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। আবু খালেদ ভাই সাঁকো পার হচ্ছিলেন, আনাড়ী পায়ে অগ্রসর হতে গিয়ে তার বিলম্ব হচ্ছিল। হঠাৎ করে তার গায়ে একটি গুলী আঘাত হানে। এ আশংকাই আমরা দূর থেকে করছিলাম। আহত খালেদ ভাই না অগ্রসর হতে পারছিলেন, না পেছনে ফিরে আসতে পারছিলেন।

আমরা তার ৬০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি চীৎকার করে বলতে লাগলেন, “তোমরা চলে যাও! নিজের জীবন বিপন্ন কর না। আমি সম্ভব হলে ফিরে আসব। হয়ত আল্লাহ কোন পথ খুলে দিবেন।

কিন্তু আমরা তাকে এমন সঙ্গীন অবস্থায় ছেড়ে যেতে পারি না। যে. প্রভু আমাদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন, তাঁর ইচ্ছা হলে এখান থেকেও আমরা বেঁচে যেতে পারব। অতএব তাকে বিপদে রেখে আমরা চলে যেতে রাজী হলাম না। সাঁকোর এই দুর্গমতা জয় আমরা করবই।

আমি আর করীম ভাই যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার অদূরে একটি ছোট পল্লী ছিল। আমি করীম ভাইকে বললাম, আপনি এই পল্লীতে গিয়ে বলুন, আমরা মুজাহিদ। আমাদের এক সাথী সাঁকোয় আটকা পড়ে গেছে।

গুলীর আওয়াজ শুনে পল্লীর লোকেরা বেরিয়ে আমাদের দেখছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই দুই যুবক করীম ভাইয়ের সাথে এগিয়ে এল। করীম ভাইকে সাথে নিয়ে যুবকদ্বয় নির্ভয়ে এগিয়ে গেল সাঁকোর দিকে। দশ মিনিট চেষ্টা করে

তারা খালেদ ভাইকে আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। খালেদ ভাই ততক্ষণে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। তার সমস্ত শরীর ও কাপড় কাদা পানিতে একাকার হয়ে গেছে।

সাহায্যকারী এ দু’ যুবক আল জিহাদ’ গ্রুপের সদস্য। এরা আমাদেরকে গ্রামে নিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে দেখি, আমাদের অন্যান্য সাথীরা চলে এসেছে; কিন্তু কমান্ডার মূসা ভাইয়ের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না।

আমার মনে পড়ল যে, পুরো অপারেশনে তিনি একবারও আমাদের সামনে আসেননি। রাতে আমাদের সাথে শুয়ে ছিলেন, কিন্তু এক সৈন্য যখন আমাদের ঘরে উঁকি দেয়, তখন আমরা জেগে উঠে মূসা ভাইকে ঘরে দেখতে পাইনি।

পরে জানতে পেরেছি, রাতে উঠে তিনি তাহাজ্জুদ পড়তে মসজিদে যাওয়ার পথে সেনাদের হাতে আটকা পড়েছেন। এরা সেই সোনালী যুগের সিপাহসালারদের মত, যারা দিনের বেলায় যুদ্ধের ময়দানে নাঙ্গা তরবারী নিয়ে জিহাদ করেন আর রাতের আঁধারে আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে থাকেন।

কর্দমাক্ত বেশ-ভূষণে একাকার রণক্লান্ত চেহারা দেখে গ্রামের লোকেরা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। তারা পরিষ্কার পরিধেয় কাপড় এনে বলল, ‘আপনারা ময়লা কাপড়গুলো বদলে নিন। আমি তাদের শুকরিয়া জানিয়ে বললাম, না, এর প্রয়োজন নেই।

ঝিলাম হ্রদে পৌছে আমরা ইচ্ছে মত গোসল করে নিলাম। জামা-কাপড়ও পরিষ্কার করলাম। সারাদিনের ক্লান্তি, অবসাদ ও দুশ্চিন্তা দূর হল। মৃত্যুদূতের পদ-ধ্বনি কানের কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্য অন্তনিহিত হয়ে গেল। সে দিন যথার্থভাবেই উপলব্ধি করলাম যে, যদি আল্লাহ রক্ষা কর তাহলে পৃথিবীর কোন শক্তিই কাউকে মারতে পারে না। তিনি আমাদের প্রতিটি কদম তার সাহায্যের বারিধারায় সিক্ত করেছেন।

হ্রদের স্বচ্ছশীতল পানিতে শরীর-কাপড় পরিষ্কার করে আমরা আবার গ্রামে ফিরে এলাম। ঠিক করলাম, নৌকা ছাড়া অন্য কোন পথে আমাদের যাত্রা নিরাপদ নয়। গ্রামে বেশী সময় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ।

গ্রামের এক যুবক আমাদের নিরাপদ স্থানে পৌছে দেয়ার জন্যে হ্রদে ছোট্ট নৌকাটি ভাসিয়ে দিল। এদিকে আমাদের পেছনে ধেয়ে আসা সৈন্যরা মনে করছিল, তখনও আমরা ধান ক্ষেতের কোথাও লুকিয়ে আছি।

স্রোতের টানে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। নৌকায় যাত্রা আমাদের জন্যে তেমন সুবিধাজনক ছিল না। হ্রদের কোন কোন স্থানে ছিল অস্বাভাবিক স্রোত, সেই সাথে ছোট্ট নৌকার ডুবুডুবু অবস্থা। কয়েকবার পানির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে ডুবে গিয়েও যেন আবার ভেসে উঠেছে নৌকাটি।।

যাত্রা পথে নয়নাভিরাম হ্রদের দু’ তীরের দৃশ্য ছিল মায়াকাড়া। কোথাও ছোট্ট নৌকায় লোকদের মাছ ধরার দৃশ্য ছিল অপূর্ব। কিন্তু এত সব নৈসর্গিক

দৃশ্য দেখার মত মানসিক প্রশান্তি আমাদের ছিল না। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়াই ছিল আমাদের মুখ্য চিন্তা।

দিবাকর দিনের আলো গুটিয়ে অস্তাচলে হারিয়ে গেছে। চারদিক থেকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। এমন সময় আমরা একটি ছোট্ট গ্রামে পৌঁছলাম। নৌকা এখানে আমাদের নামিয়ে দিয়ে ফিরে গেল। মাত্র দশ-বারটি ঘরের এ পল্লীবাসী আমাদের পরম যত্ন সহকারে জায়গা দেয়।

অত্যাধিক ঠাণ্ডায় ও ভেজা কাপড়ে আমরা থরথর করে কাঁপছিলাম । পল্লীবাসীরা আমাদের জন্যে একটি ঘরের ওঠোনে আগুন জ্বালায়। কিছুক্ষণ আগুকে সেঁকে নেয়ার পর পরিধেয় কাপড়ও শুকিয়ে গেল, আমরাও সতেজ হয়ে উঠলাম। পল্লীর লোকেরা আমাদের পরম আদরে খাওয়ারও ব্যবস্থা করল।

বিগত রাতের নিঘুম দীর্ঘ ক্লান্তিময় যাত্রার শ্রান্তি ভর করল সবার চোখে-মুখে। ঠিক করলাম, আবু খালেদ ভাইকে শ্রীনগর পাঠিয়ে দিয়ে আমি নিজ গ্রাম বেরুয়ারা যাব। নদীর তীরে উজান দিক থেকে আসা নৌকার জন্যে অপেক্ষা করতে হল। অনেক্ষণ পর দেখা গেল, একটি ছোট্ট ডিঙ্গি ভাটির দিকে আসছে যা শ্রীনগর যাবে বলেই মনে হল।

কাছে আসলে দেখা গেল, এক ইংরেজ দম্পতি নৌকার আরোহী। এরা পর্যটক। ভূস্বর্গ কাশ্মীর দেখতে এখানে এসেছিল। কিন্তু এখন পুরো কাশ্মীর জ্বলন্ত মরুভূমি। আমরা মাঝিকে নৌকা তীরে ভিড়ানোর ইশারা করলাম। আমাদের হাতে ক্লাশিনকোভ দেখে ওরা ভয়ে কুকড়ে গেল। আমাদের ডাকাত অথবা হত্যাকারী ভেবে ভয়ে নীল হয়ে গেল ইংরেজ দম্পতির চেহারা। আবু খালেদ ভাই এগিয়ে এসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললেন, তোমরা যদি আমাদের শ্রীনগর পর্যন্ত নিয়ে যাও, তাহেল আমাদের খুব উপকার হবে।’

এরূপ অপ্রত্যাশিত আবেদন শুনে ইংরেজ দম্পতি প্রাণ ফিরে পেল, তাদের চেহারা থেকে ভয় কেটে গিয়ে দেখা দিল স্বস্তির আভা। একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে পুরুষ লোকটি বলল, তোমরা তো অনেক লোক, আর নৌকাতো ছোট্ট ।।

আবু খালেদ বললেন, না, কেবল আমার সাথে আরেকজন লোক নৌকায় যাবে।’

ইংরেজ দম্পতি সহাস্যে তাদের নৌকায় উঠতে আহবান করল। এরা দুজন চড়ে বসতেই নৌকা ভাটির টানে এগিয়ে চলল শ্রীনগরের দিকে।

বাকী পাঁচ সাথীকে বিদায় জানিয়ে আমি বেরুয়ার পথে রওনা হলাম। আমার নিজ গ্রামে আগেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল যে, শামশীর খান সেনাবাহিনীর ক্রেক ডাউনে পড়েছিল, কিন্তু কোন মতে পালিয়ে বেঁচে গেছে। পরিবারের সবাই আমার জন্য পেরেশান ছিল, মা ছিল প্রতি মুহূর্তে আমার পরিণাম চিন্তায় উদ্বিগ্ন।

হঠাৎ করে আমি বাড়ি ফিরে আসায় সবাই খুশি হল । সারা গ্রামের নারী-পুরুষ আমাকে দেখার জন্যে ভীড় করল। শরীরের ক্লান্তি দূর করার জন্যে ক’দিন বাড়িতে বিশ্রাম করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আবার সেনাবাহিনীর মুখোমুখী

দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন গ্রামে কেটে গেল। এরই মধ্যে সংগঠনের পক্ষ থেকে নির্দেশ পাঠান হল। সঙ্গে সঙ্গে আমি রওনা হলাম। পথে শেখ ওয়াহীদের সাথে দেখা। এক বাড়ীতে আমরা বসলাম। তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ভাবলাম, একটু জিরিয়ে নেই, বৃষ্টিটাও বন্ধ হোক। কিন্তু বিশ্রাম নামক কোন বস্তু আমাদের ভাগ্যে ছিল না। তসবির দানার মত একটির পর একটি জিহাদে আমার বিরামহীন মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আমরা বসে বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করছি। এমন সময় গৃহস্বামী খবর নিয়ে এলেন, গ্রামের মাথায় পুলিশ এসে গেছে, আপনারা আত্মরক্ষার চিন্তা করুন।

আমরা ছিলাম ঘরের দোতলায়। সময় এত কম ছিল যে, সিঁড়ি বেয়ে নামতে সময় লাগবে বলে দোতলা থেকে মই বেয়ে সোজা নীচে নেমে গেলাম। তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে নীচে বাঁধা ঘোড়ার রশিতে পঁাচ লেগে আমি ও সাথী ওয়াহিদ উভয়েই হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পেিড় যাই। অবশ্য সৌভাগ্যক্রমে কেউই তেমন কোন আঘাত পাইনি।

গ্রামের সামনে বিশাল ফসলী মাঠ। ফসল কেটে ফেলায় এখন ফাঁকা ময়দান। পানি জমে থাকায় পুরো ময়দানই কাদায় নরম হয়ে আছে। পা ফেলতেই প্রায় হাটু পর্যন্ত কাদায় তলিয়ে যায়। এক পা উঠালে আরেক পা উঠানো যায় না। যেন জিঞ্জির দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে পা দু’টো।।

এদিকে পুলিশ পৌছে গেছে অনেক কাছাকাছি। শেষতক বুট খুলে ফেলে খালি পায়েই অগ্রসর হবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে লাগলাম। গ্রামের অন্যান্য মুজাহিদরাও দৌড়াতে শুরু করল নিরাপদ স্থানে পৌছার লক্ষ্যে।

পুলিশ বাহিনী আমাদের পেছনে তাড়া করছে। কিন্তু তখনও এরা কোন গুলী ছুড়তে সাহস করেনি নিজেদের নিরাপত্তার ভয়ে। অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর আমরা পেছনে ফিরে দেখি, কোন পুলিশ আমাদের দিকে আর এগুচ্ছে না।

শস্য ক্ষেত্রে শ্রমিকরা কাজ করছিল। তারা নিজেদের খাবার আমাদের জোর করে খাইয়ে দিল। এমন সময় অল্প দূর থেকে একজন মহিলা ইশারা করে বলল,

ঐ দেখ, পূর্ব দিক থেকে সৈন্য আসছে।’

জায়গাটা ছিল একদম ফাঁকা। যন্ত্রচালিতের ন্যায় আমরা দৌড়াচ্ছিলাম, সৈন্যরা আমাদের ধাওয়া করল। প্রায় ঘন্টাখানিক পরেও দেখি, সৈন্য ও আমাদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশঃ কমে আসছে। সামনে একটি জলাশয়ের সম্মুখীন

হলাম। এর কোল ঘেষে চলে গেছে একটি খাল। উপায়ন্তর না দেখে খালে নেমে পড়লাম। খালটি ছিল শুকননা, আর বড় বড় পাথরে ভরা।

আমাদের সফল মোকাবেলায় শত্রুরা ব্যর্থ হল।

আমরা খালের পাড়ে দাঁড়ালে সহজেই শত্রুসেনা আমাদেরকে গুলীর টার্গেট বানাতে পারত। খালের খাদে নেমে তেড়ে আসা সৈন্যদের এক হাত দেখিয়ে দেয়ার প্ল্যান করলাম। আমরা খালে নেমে পড়ায় ওদের দৃষ্টি থেকে আড়াল হয়ে গেলাম। খালের বড় বড় পাথরের আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম শত্রুসেনাদের।

যখনই ওরা খালের তীরে এসে পৌছল, তখন ওরা একেবারে আমাদের রাইফেলের সামনে। দ্রিম দ্রিম করে একযোগে আমাদের সব কয়টি রাইফেল গর্জে উঠল।

আকস্মিক মোকাবেলায় পলায়নপর শত্রুরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে ডজনখানের লাশ গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।

আমাদের অবস্থান আন্দাজ করার আগেই আমরা বড় বড় পাথরের আড়ালে গিয়ে পিছু হটতে লাগলাম। কারণ, দীর্ঘক্ষণ মুখোমুখি লড়াই করার মত পর্যাপ্ত গোলাবারুদ আমাদের ছিল না।

অকল্পনীয় আক্রমণে শত্রুসেনারা নিজেদের লাশগুলো হেফাজত ও আহতদের সামাল দেয়ার দিকে নজর দিল। আমরা কালক্ষেপণ না করে মুখখামুখি অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু ততক্ষণে আমাদের স্থানীয় সাথীরা অনেক দূরে চলে গেছে। ওয়াহিদ ভাই আমি আর দু’জন পাকিস্তানী সাথী পেছনে পড়ে গেছি।

এলাকার অবস্থা ও অবস্থান আমাদের জানা নেই। তদুপরি ইন্ডিয়ান আর্মি ক্যাম্প বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো, কোখেকে কোথায় গিয়ে ফেঁসে যাই এ নিয়ে পড়লাম মহা মুশকিলে । কিন্তু কি আর করা যাবে! আল্লাহর উপর ভরসা করে চার বন্ধু রওনা করলাম।

এক শিখ যুবকের সহযোগিতা

এক গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পথের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন শিখ নজরে পড়ল। এক সময় আমরা তাদের মুখোমুখি হলাম। শিখ দেখলেই পাঞ্জাবী ভাষায় ওদের সাথে কথা বলা আমার একটা হবি। অভ্যাস

অনুযায়ী ওদের সাথেও পাঞ্জাবী ভাষায় কথা বললাম।

ওরা আমার মুখে পাঞ্জাবী ভাষা শুনে খুব খুশি হল। আমি কুশলাদি জিজ্ঞেস করলে ওরা আমাদের কুশলাদি জানতে চাইল। বললাম, আমরা ভালই আছি। তবে পথটায় একটু প্যাচ লেগে গেছে। দেখিয়ে দিলে ভালো হত।

ওদের একজন বলল, আরে ভাই! যাওয়া তো পরে হবে, আগে চা-কফি পান করে নাও।

এদের অকল্পনীয় হৃদ্যতায় আমি বললাম, আমাদের খুবই তাড়া আছে, দেরী করতে পারব না। তোমাদের ধন্যবাদ। চা অন্যদিন, আজ শুধু পথটা একটু দেখিয়ে দাও।

এক শিখ যুবক আমাদের সাথে রওনা হল, কথার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কোত্থেকে এসেছ?

বললাম, জম্মু থেকে এসেছি সরদার! ও বলল, ‘চল! আমি তোমাদের রাস্তায় উঠিয়ে দিয়ে আসছি।

কয়েকশ’ গজ এগুতেই একটি বালক বলল, সামনে আর্মি ক্যাম্প আছে, আপনারা অন্য পথে যান।’

শিখ বলল, ‘ভয়ের কারণ নেই, আমি তোমাদের নিরাপদ পথে উঠিয়ে দেব। আপনারা সহজেই সে পথে মঞ্জিলে যেতে পারবেন।

শিখ যুবক আমাদেরকে একটি নিরাপদ পথের সন্ধান দিয়ে চলে এল। আমরা ওর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। পুরো জিহাদেই শিখরা মুজাহিদদের জন্যে সহযোগিতা এবং বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত রেখেছে।

অনেক পথ চলে রাতে আমরা একটি গ্রামে এসে পৌছলাম। এখানে আহসান ডারের সাথে মোলাকাত হল। রাতটা সে গ্রামে বিশ্রাম করে পরদিন সবাই সোপুরের দিকে পা বাড়ালাম।

আমাদের নিরাপত্তায় ঘোড়ার আশ্চর্য ইঙ্গিত

অগ্রগামী দু’ সাথী আমাদের চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে চলে গেছে। তাদের বলা হয়েছিল, যদি সামনে কোন অসুবিধা থাকে, তবে ফায়ার করবে, আমরা সতর্ক হয়ে যাব।

রাত তিনটার সময় যখন পাটনাখোড়া নামক গ্রামে পৌছলাম, একটি ঘোড়াকে দেখতে পেলাম সড়কের মধ্যপথে চলছে। আমরা মনে করলাম, হয়ত ঘোড়াটা দড়ি ছিড়ে পালাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ঘোড়াটি আমাদের পাশাপাশি চলতে লাগল। ঘর পালানো ঘোড়ার মত ওর মধ্যে কোন চঞ্চলতা নেই। নিশ্চিন্তে ধীরভাবে সমান তালে আমাদের আগে আগে যাচ্ছে। আমরাও ওকে কোন জ্বালাতন করিনি।

দীর্ঘক্ষণ ঘোড়াটি আমাদের সাথে চলল। হঠাৎ করে একজন মুজাহিদের ঘাড়ে ঘোড়াটি কামড়ে দিলে মুজাহিদ চীৎকার দিয়ে দৌড় দেয়। আমরা শান্ত ঘোড়ার হঠাৎ দুষ্টুমিতে খুব মজা করে বললাম, আরে ওতো তোমাকে আদর করছে। এরপর আরো কিছুক্ষণ শান্তভাবেই এগিয়ে চলে আবার একজনকে কামড়ে দিল।

এবার ঘোড়র বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিলাম। কয়েক ঘা লাগিয়ে তাড়িয়ে দিলাম রাস্তা থেকে। দশ-পনের মিনিট আমরা চুপচাপ হাঁটার পর দেখি, ধানক্ষেত মাড়িয়ে ঘোড়াটি আমাদের সামনে সড়কের মাঝখানে পথ আগলে দাঁড়াল। আমরা ওটাকে এড়িয়ে পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ঘটলো অদ্ভুদ ঘটনা। সেই ঘোড়াটিই সামনে দিয়ে দৌড়ে এসে চার পা উপর দিকে করে মাঝ পথে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। ভাবখানা এমন যে, কোন ক্রমেই আমাদের এগুতে দেবে না, হয় কামড়ে দেবে, না হয় চড়াও হবে।

এ পর্যন্ত আমরা ঘোড়াটির আচরণে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। কিন্তু এ অবস্থা দেখে আহসান ডার বলল, ‘বিপদ বন্ধুরা! আমাদের সামনে একটা কিছু অবশ্যই সমস্যা আছে। ঘোড়াটির বার বার এই অদ্ভুদ আচরণ আমার কাছে এমন কোন অশুভ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঘোড়াটা বার বার আমাদের থামিয়ে দেয়ার জন্যে চেষ্টা করছে, কিন্তু আমাদের রুখতে পারছে না।

অধিকাংশ মুজাহিদ আহসান সাহেবের এ যুক্তিকে উড়িয়ে দিল উদ্ভট কল্পনা বলে। কিন্তু তার ক্রমাগত চাপের মুখে সবাই যাত্রায় বিরতি দিল।

সবাই বলল, “ঠিক আছে, আমরা পনের-বিশ মিনিটের জন্যে যাত্রা বিরতি দিলাম। দেখা যাবে ঘোড়া এবার কি করে, আর অস্বাভাবিক কোন সংকেত পাওয়া যায় কিনা।

তখনও কয়েকজন সাথী বলছিল, আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিৎ, একটি কাল্পনিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম।

কিন্তু আহসান ভাই নিজে কমাণ্ডার, তার নির্দেশ এবং অধিকাংশ সাথীরও তখন একটু বিরতির পক্ষেই মত থাকায় শেষতক আর অগ্রসর হলাম না। রাস্তার পাশেই ছিল মাড়ানো ধান ও খড়ের আঁটির স্তুপ। আমরা খড় বিছিয়ে আর ধানের আঁটি মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ঘুমিয়ে গেলাম, আর দু’জন প্রহরায় রইল।।

৩০/৩৫ মিনিট ঘুমিয়ে আমরা জেগে দেখি, ঘোড়াটি নেই। যে ঘোড়াকে পিটিয়ে তাড়াতে পারলাম না, আর এটি এখন নিজেই কোথাও চলে গেল। এ বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলল। আমরা ঘোড়ার এই ড্রামা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু সামনে এগুতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

মিনিট বিশেক সময় পথ এগুতেই আমরা রাস্তায় একজনের দেখা পেলাম। আমাদের হাতে রাইফেল দেখে লোকটি বুঝতে পেরেছিল, আমরা কাশ্মিরী মুজাহিদ। সে বলল, আপনাদের ভাগ্য ভাল। মাত্র ২০ মিনিট আগেও এখানে শতাধিক সেনা ছড়িয়ে ছিল। এরা এখন গ্রামের দিকে চলে গেছে, হয়ত কোথাও ক্রেক ডাউন দিয়েছে।

তখন ঘোড়া বার বার আমাদের পথ আগলে দাঁড়ানোর ভেদ আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। থেমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম না করলে আমরা আর্মিদের মুখোমুখি পৌঁছে যেতাম। আর তখন আমাদেরই বেশী ক্ষতি হওয়ার আশংকা ছিল। যেহেতু আর্মিরা সংখ্যায় আমাদের চেয়ে অনেক বেশী।

পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। অপ্রত্যাশিতভাবে ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে আমরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। অদূরে গ্রামের মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে ফজরের আযান। আল্লাহু আকবার

আল্লাহু আকবার আল্লাহ মহান, আল্লাহ সর্বাপেক্ষা বড়।

ইথারে ভেসে আসা সুমিষ্ট আযানের আহবানে আমার হৃদয় থেকে অবচেতন মনে উচ্চারিত হল, নিঃসন্দেহে আমার প্রভূ সবচেয়ে বড়, সব চেয়ে মহান । সকল কিছুই আল্লাহর মহাশক্তির কাছে তুচ্ছ। ভারতীয় সেনাদের কোন শক্তি নেই যে, আমাদের অগ্রযাত্রা রোধ করে। আল্লাহ পদে পদে আমাদের সাহায্য করছেন, আমরা কেন মহাপ্রভূর রহমত থেকে নিরাশ হব! অবচেতন মনে অনর্গল আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হল এসব শব্দ। আল্লাহর অভাবিত মদদে সকল বাধার পাহাড় আমার কাছে নগণ্য মনে হচ্ছিল।

পাশেই প্রবাহিত ঝরণার ঠাণ্ডা পানিতে অযু করে আমরা শুকরিয়া নামায আদায় করলাম। হৃদয়ে প্রোথিত আল্লাহর অস্তিত্বকে যখন গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়, তখন যে নামাযে কি অপূর্ব স্বাদ, তা কাউকে বুঝানো যাবে না।

নামাযান্তে সোপুরের নির্ধারিত মিটিংয়ে যোগদানের জন্যে আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম। আল্লাহর বিশেষ রহমতে আর কোন বাঁধা-বিপত্তি ছাড়াই মিটিং শেষ করে ইসলামাবাদ চলে এলাম।

আশরাফ ডার এর সাথে মোলাকাত ইসলামাবাদ ফেরার পথে ফালওয়ামা জেলার সীমান্ত দিয়ে আমরা আসছিলাম। পথে একজনের কাছে খবর পেলাম, আশরাফ ডার ফালওয়ামা এসেছেন। কাশ্মীরে আশরাফ ভাই এসেছেন প্রায় এক মাস আগে, কিন্তু আমার সাথে এ পর্যন্ত তার দেখা হয়নি। তাঁর আগমনের খবর পেয়ে আমি বহুবার সাক্ষাতের জন্য গিয়েছি, কিন্তু ততক্ষণে তিনি সে স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছেন।

আশরাফ ভাই এর সাথে আমার সাক্ষাতের আগ্রহ দেখে যাত্রীরা যাত্রা বিরতি দিয়ে আমাকে বাসনা পূর্ণ করার সুযোেগ দিলেন। সুরক্ষিত স্পটে গিয়ে আশরাফ ভাইয়ের দেখা পেলাম। পরস্পর চোখাচোখি হতেই মাসুম শিশুর মত দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আশরাফ ভাই। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। দীর্ঘ বিরহের পর মিলনের আতিশয্যে কারো মুখ থেকে কোন কথা উচ্চারিত হয়নি।

আশরাফ ভাই ও আমার মধ্যে যে কত প্রগাঢ় হ্রদ্যতা, কত গভীর ভালোবাসা, তা মৃত্যুর মুখোমুখি জিহাদের ময়দানে নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্যের জীবন বাচানোর বাজীতে যারা অভ্যস্ত নন, তাদের বোঝানো যাবে না। জিহাদের ময়দান সকল পার্থিব স্বার্থের ফানুসকে ধূলো-মলিন করে আমাদের মধ্যে যে জান্নাতী হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল, ভালোবাসার যে সেতু রচিত হয়েছিল, তাতে কোন দেনা-পাওনার হিসাব ছিল না। ছিল না কোন বীর-বাহাদুরীর অহংকার।

আল্লাহর জন্য ছিল আমাদের ভালোবাসা। ঠিক তদ্রুপ আল্লাহ সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই আমাদের বুলেট ঝাঁঝরা করে দিত দুশমনের বুক। দোস্তী-দুশমনী সবই আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই মহান বাণীর বাস্তব দর্শন ছিল আমাদের যুদ্ধজীবন।

বিগত এক বছর কাশ্মীরে এসে আমি আশরাফ ভাই এর শূন্যতা এই মর্মে উপলব্ধি করছিলাম। হঠাৎ তাঁর সাক্ষাৎ পেয়ে মনে শত পুঞ্জিভূত বেদনা সুখ-দুঃখের কথার ডালি খুলে দিলাম। দীর্ঘক্ষণ চলল আমাদের হৃদ্যতাপূর্ণ। আলোচনা। অধিকৃত কাশ্মীরের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে আমি তাঁকে ধারণা দিচ্ছিলাম। আর তিনি আমাকে আজাদ কাশ্মীরের নানা ঘটনা শুনাচ্ছিলেন।

জম্মু কাশ্মীরের মুজাহিদদের জিহাদী অগ্রগতির দাস্তান শুনে তার চেহারা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল। এমন অপার্থিব খুশির আভা চেহারায় খেলে গেল, যেমন কোন রসিক বাগানের মালিক পরিশ্রমের পর কাঙ্খিত ফুলের সৌরভে নিজেকে হারিয়ে তন্ময় হয়ে যায় ফুলের সৌন্দর্যে, সৌরভে। আমি জানি, জম্মুর আযাদী। আন্দোলনের অগ্রগতি এই মহান মুজাহিদ নেতাদের রোপিত বীজেরই অঙ্কুরোদগম চারা ।।

একবার আমরা ক’জন সাথী গ্রামের মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। এমন সময় চোখে পড়ল, দশ পনেরজন টহলরত আর্মি আমাদের অদূরের পথ দিয়ে এগুচ্ছে।

হাঁটতে এসে মোকাবেলা করার কোন প্রোগাম আমাদের ছিল না। কিন্তু এতগুলো শিকার চোখের সামনে দিয়ে নিরাপদে চলে যেতে দেখে আমাদের সংকল্প পাল্টালাম। নিজেদের মধ্যে কয়েকমিনিট কথা বলে ঠিক করলাম, না। এদেরকে এভাবে মুজাহিদদের ভূখণ্ডে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করার স্বাদ বুঝিয়ে দেয়া দরকার।

ক্লাসিকোভে ম্যাগাজিন ভরে বড় বড় পাথরের আড়ালে পজিশন নিয়ে আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। তারা আমাদের খুব কাছাকাছি আসা মাত্রই একসাথে সবাই ফায়ার করে দিলাম। কয়েকজন আর্তচীৎকার করে লুটিয়ে পড়ল, আর বাকীরা চীৎকার দিয়ে পেছনে দৌড় দিল। আকস্মিক আক্রমণে এরা বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করার চিন্তা করতে পারেনি।

অক্ষত সেনারা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে আমাদের দিকে গান ফায়ার করল, আমরা এদের জবাবে কয়েক রাউন্ড গুলী চালালাম। শেষতক ওরা স্তব্ধ হয়ে গেলে আমরা পাথরের আড়ালে আড়ালে ওদের রেঞ্চের বাইরে এসে গ্রামের দিকে রওনা দিলাম।

পথে আশরাফ ডার ও শামসুল হক ভাই আমাদের সাথে যোগ দিলেন। শামসুল হক ভাইয়ের সাথে একত্রে সফর করা সিকিউরিটি প্রশ্নে ঠিক ছিল না। আমি বিষয়টির প্রতি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করলে তিনি বললেন, কোন অসুবিধা নেই; আল্লাহ-ই শ্রেষ্ঠ নিরাপত্তাদাতা।।

যাবার পথে এক স্থানে আমাদেরকে একটি হাইওয়ে পার হতে হবে। কিন্তু এ রাজপথে সব সময় আর্মি-পুলিশের টহল থাকে। সড়ক থেকে অল্প দূরে অপেক্ষা করে দু’জন সাথীকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসতে বলা হল। তারা এসে জানাল, আপাততঃ কোন পুলিশের গাড়ি রাজপথে চোখে পড়েনি।

ফাঁকা মনে করে আমরা যেই মাত্র সড়কে উঠতে যাচ্ছি, অমনি সামনের দিক থেকে ৫/৬টি আর্মির সাজোয়া যান (ছাদে মেশিনগান স্থাপন করা) চোখে পড়ল। আমরা অতি সন্তর্পণে ক্লাসিকোভগুলো জামার ভিতরে লুকিয়ে রাস্তার দু’ধার দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে এক মনে হেঁটে যাচ্ছি। ঘুণাক্ষরেও কেউ সেনাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি। সেনারা সাধারণ পথচারী ভেবে আমাদের প্রতি সন্দেহ করার অবকাশ পায়নি।

কিন্তু আমরা যদি সেনাদের গাড়ি থেকে পেছনে ফিরে যেতে ইচ্ছা করতাম, তাহলে ওদের সন্দেহের শিকার হতে হত। সবাই ভারতীয়দের গুলীর লক্ষ্যে পরিণত হতাম।

পাশ দিয়ে মারণাস্ত্র সজ্জিত শত্রুদের অতিক্রম করে চলে যাবার পর আমার বিশ্বাস হল, যতক্ষণ আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে রাখবেন, ততক্ষণ শত্রু বাহিনী আমাদের একটি পশমও নাড়াতে পারবে না।

ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাজোয়া যানগুলো চলে যাওয়ার পর আমরা আবার একত্রিত হলাম। আশরাফ ভাই ও আমি পাশাপাশি হাঁটছি। তার পরিধেয় জামা কাপড়গুলো খুব ময়লা হয়ে গিয়েছিল। আমি বললাম, আশরাফ ভাই! আপনি জামা-কাপড়গুলো বদলিয়ে নিন, এগুলো ভীষণ ময়লা হয়ে গেছে। আপনি একজন বড় কমাণ্ডার, আপনার ময়লা থাকা বেমানান। অন্ততঃপক্ষে মানানসই জামা-কাপড় পরা তো উচিৎ।

তখন শীতের তীব্রতাও ছিল বেশী, কিন্তু তার পরনে একটি সোয়েটারও ছিল । আমি এ বিষয়টিও উত্থাপন করলাম। তিনি হেসে বললেন, শামশীর ভাই! আমি পাকিস্তান থেকে এ কাপড়গুলো নিয়ে এসেছি। যতদিন পর্যন্ত এগুলো দিয়ে আবরু ঢাকা যায়, ততদিন গায়ে জড়িয়ে রাখব, ছিড়ে গেলে আবার পাকিস্তান গিয়ে বদলে আনব।’

তাঁর কথায় আমার হাসি পেল। বললাম, এ আবার কেমন কথা? আপনি শুধু কাপড় বদলাতে পাকিস্তান ফিরে যাব!

আশরাফ ভাই আমার কথায় কোন জবাব দিলেন না। রেডিও অন করে এয়ার ফোনে ক্রিকেট খেলার ধারাভাষ্য শুনছিলেন। আশরাফ ভাই খেলার পাগল নন; কিন্তু তখন পাক-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল, আর পাক দল ক্রমাগত জয়ী হচ্ছিল।

পাক-ভারত ক্রিকেটে স্বভাবতঃই উভয় পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা থাকে। পাক দলের বিজয় সংবাদে তার হৃদয়েও নাড়া দিল। পাকিস্তান দলের বিজয় তাকে খুবই উজ্জীবিত করে।

পাক-ভারত ক্রিকেট ম্যাচ কেন্দ্রীয় কমাণ্ডারকেও ভীষণ নাড়া দিল। তিনি আশরাফ ভাইকে খোঁচা দিয়ে বললেন, কাশ্মীর ধ্বংস করে দিচ্ছে ভারত। আর পাকিস্তানকে দেখ, ভারতের সাথে কেমন খাতির জমিয়ে পাতানো খেলা শুরু করেছে, আর তোমরা ভারতের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে লড়ছ।’

আশরাফ ভাই পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে বললেন, পাকিস্তান এক তরফাভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে না, আন্তর্জাতিক চাপ তাকে মেনে নিতে হয়। তবে দেখছেন না, পাকিস্তান খেলায় জিতে যাচ্ছে? কাশ্মীরেও তো এখন ভারতীয় বাহিনী চরম মার খাচ্ছে। কাশিরীরা কি তাতে খুশী হচ্ছে না!’

দীর্ঘক্ষণ চলল তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমাণ্ডার সাহেব হার মানার ভান করে আলোচনার ইতি টানলেন।

সানারাকুলীপুর পৌছে আমি আশরাফ ভাইয়ের সাথে তাদের বাড়িতে উঠি। আশরাফ ভাইদের বাড়ি আমি এর আগেও কয়েকবার গিয়েছি, কিন্তু একদিনও আশরাফ ভাইকে পাইনি। আজ তাকে সাথে করেই হাজির হলাম। বাহারী খানার ব্যবস্থা হল, মজা করে খেলাম।

আগেই উল্লেখ করেছি, শামসুল হক ভাইয়ের বাড়ীও এ গ্রামেই। তাঁর প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। বলতে গেলে সানুরাকুলীপুর এতদাঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।

দ্বিতীয় দিন আমার ভাই খালেদ আর পাকিস্তানী কিশোর সারফরাজ এল।

একান্ত সাহচর্যে আশরাফ ভাই ও আমি নেতৃবৃন্দের ব্যস্ততায় আমরা ছিলাম দায়িত্বমুক্ত। ছুটির দিনগুলো আশরাফ ভাইয়ের সাথে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা করে কাটাচ্ছি। ভূ-স্বর্গ কাশ্মীরের নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলো আশরাফ ভাইদের এখানে মুক্ত মনে দেখতে পেলাম। কাশ্মীরের টলটলে ঝরণাধারা ফলে-ফুলে সুশোভিত বাগান, চারদিকে সবুজের সমারোহ, চোখ জুড়ানো ফসলে ভরা মাঠ, পাখ-পাখালীর কুঞ্জন, সাজানো গোছানো পল্লীর বাড়ী-ঘর।।

দিনভর আমরা চষে বেড়াচ্ছি এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। এতদাঞ্চলের গোপন মুজাহিদ আস্তানাগুলো ঘুরে দেখেছি। প্রতিদিন একবার সানুরাকুলী গ্রামে আমাদের আসা হত।

একদিন সানুরাকুলী গ্রামের বাইরে আশরাফ ভাই আমাকে তাদের ফসলী জমিন দেখাতে নিয়ে গেলেন। ছোট ছোট আখরুট গাছ দেখিয়ে আশরাফ ভাই বললেন, ‘এগুলো আমার নিজের হাতে লাগানো।

অদূরে এক বৃদ্ধ রাখাল এক পাল ছাগল চড়াচ্ছিল। আশরাফ ভাই বললেন, এই পালের সবগুলো ছাগল আমাদের। আর এই বুড়ো ছোট বেলা থেকেই ছাগল চড়ান।’

আমি টিপ্পনি কেটে বললাম, আচ্ছা! তাহলে তো এতে আমাদেরও হিস্যা আছে, তাই না? আশরাফ ভাই বললেন, হ্যা, অবশ্যই আছে। আপনি যত ইচ্ছে নিতে পারেন। আপনি সহ সকল মুজাহিদের খাওয়ানোর আয়োজন করার ইচ্ছা আছে।’

তিন-চার দিন পর আশরাফ ভাই আমাদের দাওয়াত দিলেন। ছাগলের গোশত দিয়ে ঐতিহ্যবাহী কাশ্মিরী বিরানী পাকানো হল। আমরা ক’জন পাকিস্তানীর জন্যে বিশেষভাবে পাকিস্তানী রান্নার ব্যবস্থা হল।

দীর্ঘদিন পর নানা স্বাদ ও হরেক আইটেমের উপাদেয় খানার গন্ধে ভরে উঠল নাসারন্দ্র। আশ-পাশের মুজাহিদদের আগমনে ভরে গেল আশরাফ ভাইদের বাড়ী। উমর সরফরাজ, খালেদ ও আমাকে পাকিস্তানীদের দস্তরখানে বসান হল। আশরাফ ভাই আমাদের সাথে বসতে বসতে বললেন, ‘ভাই! আমরাও পাকিস্তানী, পাকিস্তানীদের সাথেই আমরা বসব।’

খেতে খেতে উমর সরফরাজ বলল, ভারতীয় সেনারা বেপরোয়া আনাগোনা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে। এদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নেয়া দরকার।’

দস্তরখানে বসেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারতীয় সেনাদের এ অঞ্চলে বাহাদুরীর মজা দেখাতে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হল সরফরাজকে।

আহার পর্ব সেরে আশরাফ ভাই আমাকে তার আম্মার সাথে সাক্ষাত করতে নিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে আগে থেকেই জানতেন। আশরাফ ভাই আমার পরিচয় দিয়ে বললেন, আম্মু! ও আমার ঘনিষ্ট বন্ধু শামশীর খান, পাকিস্তানে আমরা এক সাথেই থাকতাম।’

আশরাফ ভাইয়ের আম্মা বললেন, আমি ওকে জানি। ও-ই তো আমার কাছে তোমার খবরা-খবর পৌছাত।

আশরাফ ভাইয়ের মা এমন একজন মহিয়সী মহিলা, যাকে দেখলে স্বর্ণযুগের মহিমান্বিত মহিলাদের কথা মনে পড়ে, যারা নিজেদের পেটে ধারণ করতেন যুগ শ্রেষ্ঠ বীর মুজাহিদ ও বিজয়ী শহীদদের নিজ কোলেই দিতেন তাদের বিজয়ী থাকার প্রশিক্ষণ।

আশরাফ ভাইদের পুরো পরিবারটি ছিল জিহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত। তাঁর বোনও স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।

আহারান্তে খোশ-গল্পের পর মুজাহিদরা নিজ নিজ ঠিকানায় চলে গেলে সরফরাজ আমাকে আবার স্মরণ করিয়ে দিল, আমি এ কয়দিন সেনাবাহিনীর গতিবিধি কড়া পর্যবেক্ষণ করে আপনাদের তথ্য দেব, কোন দিন এদের উপর হামলা করা যায়।

জীবনের শেষ নিশিতে আশরাফ ভাই

দু-তিন দিন বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে চতুর্থ দিন আমরা সানুরাকুলী থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি গোপন ঠিকানায় রাত কাটালাম। আমাদের আশ্রয়দাতা পরিবারটি ছিল শিয়াদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবুও রাতভর আমরা নির্ভয়ে ঘুমালাম।

ভোর বেলায় ফজরের নামায পড়তে উঠে দেখি, আরাফ ভাই নেই। বাইরে বেরিয়ে দেখি, আশরাফ ভাই ক্লাশিনকোভ নিয়ে দাঁড়িয়ে। বিস্মিত হলাম তার এ কাজে। আমরা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছি, তখন থেকে তিনি বাইরে রাইফেল নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন রাতভর জেগে জেগে। তাকে বললাম, আশরাফ ভাই, আপনি! পাহারার কি প্রয়োজন ছিল? এ বাড়ী তো সুরক্ষিত, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোন আশংকা নেই। আপনি জেনে-শুনে এতটা কষ্ট কেন করতে গেলেন?

আশরাফ ভাই বলল, তবে পাহারার প্রয়োজন ছিল।’

আমি বললাম,আশরাফ ভাই! যদি আর্মি এসে যেত, তাহলে আপনি একা কি ঠেকাতে পারতেন?

স্মিত হেসে আশরাফ ভাই বললেন, “আসলে তখন দেখা যেত।

পাহারারত সেই রাতই ছিল তার জীবনের শেষ নিশি। ফজরের নামাযের পর আমাদের ইচ্ছা ছিল সানুরাকুলীপুরার শামসুল হক ভাইয়ের বাড়ীতে সকালের নাশতা সারব। কিন্তু গৃহস্বামী তার এখানে নাশতা না খাইয়ে আমাদের বিদায় করতে রাজী হল না। তাঁর বার বার অনুরোধে আশরাফ ভাই বললেন, ‘ভাই! একজন মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে যাওয়ার চেয়ে না হয় আমরা এখানে নাশতাটা খেয়েই যাই।’

শেষ পর্যন্ত আমরা চায়ের সাথে এক স্লাইস রুটি খেয়ে নাশতা সেরে সানুরাকুলীপুরার পথে পা বাড়ালাম।

বাড়ী পৌছে শামসুল হক ভাই আমাদের মেহমানখানায় বসিয়ে এ বলে বাড়ির ভেতরে গেলেন যে, দশ মিনিটের মধ্যেই তিনি এসে আমাদের নাশতায় শরীক হব। নাশতা আগে থেকে তৈরী ছিল। কয়েক মিনিট পরই তিনি নাশতাসহ চলে এলেন আমাদের কাছে।

আমরা সবেমাত্র খাওয়া শুরু করেছি, এমন সময় গ্রামের অপর প্রান্ত থেকে উপর্যুপরি ফায়ারিং ও কোলাহলের আওয়াজ ভেসে এল । তাড়াতাড়ি বাড়ির বাইরে এসে দেখি লোকজন ওদিক থেকে দৌড়ে এদিকে আসছে। এক ব্যক্তি আমাদের উদ্দেশে বলল, ও পাড়ায় মুজাহিদরা আর্মি ব্লকের মধ্যে আটকা পড়েছে, ক্রস ফায়ার চলছে।’

শামসুল হক ভাই বলল, ‘পাহারাদার মুজাহিদদের একত্রিত কর।

আশরাফ ভাই চার মুজাহিদের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন। আমি শামসুল হককে বললাম, আপনারা কোন নিরাপদ স্থানে চলে যান, হতে পারে আর্মিরা এখানে আপনাদের অবস্থান জেনে যাবে। না হয় এখানে হামলার উদ্দেশ্যেই আসছিল, পাহারারত মুজাহিদরা ওদের ঠেকিয়ে রেখেছে।

আমরা বিলক্ষণ জানতাম যে, মুজাহিদ কমাণ্ডারদের শহীদ কিংবা গ্রেফতার করা ভারতীয় সেনাদের প্রধান টার্গেট। এজন্যে কমাণ্ডার ও নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মুজাহিদদের প্রধান দায়িত্ব।

শামসুল হক ভাই আমাকে নির্দেশ দিলেন, ‘আশরাফ ও অন্যান্য মুজাহিদদের নিয়ে শীঘ্রই তোমরা আমার কাছে চলে আসবে।

শাহাদাতের আগে আশরাফ ভাই।

আশরাফ ভাইয়ের কাছে পৌছলে তিনি বললেন, “আমরা সব সাথী মিলে এখানে প্রায় ১৫/১৬ জন হব। আমার ইচ্ছে হল, সবাই এক সাথে পেছন থেকে আর্মিদের উপর হামলা করব। যদি আমাদের সাথীরা এদের ঘেরাওয়ে পড়ে থাকে, তারা সহজেই বেরিয়ে আসতে পারবে।

আমি বললাম, আশরাফ ভাই, আর্মিদের জনবল ও অবস্থান আমাদের জানা নেই, এমতাবস্থায় হামলা করলে আবার আমরাও ঘেরাওয়ে পড়ে যাই কিনা। এছাড়া শামসুল হক ভাই আপনাকে নিয়ে যাবার কথা বলেছে।’

আশরাফ ভাইয়ের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল, তিনি আমাকে বললেন, শামশীর ভাই, সাথীদের জীবন রক্ষা করাও আমাদের প্রধান কর্তব্য। এদের ঘেরাওয়ে ফেলে রেখে আমরা চলে যেতে পারি না।

আমি তখন দেখছি, আশরাফ ভাইয়ের চেহারায় শাহাদাতের খুনরাঙ্গা জ্যোতি খেলে যাচ্ছে। সাথীদের মুক্তি ও প্রতিশোধের দুর্বার আকাঙ্খ তাকে করে তুলছে দুর্দমনীয়। আমার কথোপকথনের মধ্যেই হাজির হল আশরাফ ভাইয়ের আব্বা। সেনাদের সাথে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত শুনে, তিনিও নিষেধ করলেন না। ছেলে যেমন দৃঢ় ঈমান ও অসীম সাহসের পাহাড়, পিতাও অনুরূপ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার দরিয়া। তদুপরি পুত্রের অনিষ্ট চিন্তায় তার চোখে-মুখে একটা আশংকার কালিমা ভেসে উঠেছিল।

আশরাফ ভাই তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আব্ব, আপনি ঘরে চলে যান, আমি অল্পক্ষণের মধ্যেই সাথীদের মুক্ত করে নিয়ে আসব।’

আমার মন সায় দিচ্ছিল না। একান্ত প্রিয়বন্ধু আশরাফ ভাইকে মোকাবেলায় পাঠিয়ে আমার পক্ষে থেকে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। আমিও তার সাথে রওনা হলাম। গ্রামের শত শত নরনারী আমাদের কল্যাণের দুআ করছিল। আশরাফ ভাইয়ের মা-বোনেরাও আমাদের বিজয় কামনা করে বিদায় জানালেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা কাউসা গ্রামের কাছে পৌছে গেলাম। তখনও থেমে থেমে ফায়ারিং চলছিল। কিন্তু কোন আর্মি বা মুজাহিদ আমাদের চোখে পড়ল না। গ্রামের পেছনে থেকে একটা নদী বয়ে গেছে। নদীর পাড়ে আর্মিরা উঁচু বাংকার তৈরী করে রেখেছে।

আমরা নদীর উপর সরু কাঠের সেঁতু পেরিয়ে ওপারে উঠলেই আর্মি নজরে পড়ল। কিছু সাধারণ লোক এদিক-সেদিক ঘোরা-ফেরা করছিল। আশরাফ ভাই বললেন, “আমাদের পিছিয়ে পুলের ওপারেই থাকতে হবে। এখান থেকে আর্মির উপর ফায়ার করলে সাধারণ লোকজন ক্রস ফায়ারের মধ্যে পড়ে যাবে।

আমরা পিছিয়ে এসে নদীর পাড়ের মোর্চার আড়ালে পজিশন নিলাম। আশরাফ ভাই আমাদের একটু দূর থেকে টার্গেট নিলেন। আশরাফ ভাই বললেন, “আমি সামনের আর্মিদের উপর গুলী চালাব। ওরা যদি পুল পেরিয়ে এপারে আসতে চায়, তাহলেই তোমরা ওদের আক্রমণ করবে, এভাবে আমরা ওদের উপর চাপ বৃদ্ধি করলে এদিকে ওরা ঝুঁকে পড়লে ঘেরাও শিথীল হয়ে যাবে। এই সুযোগে মুজাহিদরা পালাতে সক্ষম হবে।

আমি আশরাফ ভাইয়ের সাথে বসে গেলাম। কয়েকজন আর্মিকে দেখলাম এগিয়ে আসছে। আশরাফ ভাই এদের উপর হামলা করল, ওরা হয়ত এরকম হামলার আশংকা করেনি, তাই দ্রুত পালিয়ে গেল।

ওরা আমাদের সংখ্যা সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারেনি। কিছুদূর গিয়ে হয়ত ওরা ভেবেছে মাত্র একটি রাইফেলের গুলী হল। হয়ত কোন এক মুজাহিদ নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে। কয়েকজন আর্মি দৌড়ে এল নদীর তীরে। আমরা যদিও নদীর পাড় থেকে দূরে, কিন্তু অন্যান্য সাথীরা তীরেই ছিল। আর্মিদের কাছে আসতে দেখে তারা সবাই এক সাথে ট্রিগার টিপে দেয়। আর্মিরা আবার দৌড়ে আশ্রয় নিয়ে জবাবী ফায়ার করল।

আর্মিরা ছিল মোর্চাবন্দী, অস্ত্র ও সংখ্যায় শক্তিশালী। আমরা শুধু ক্লাসিকোভ দ্বারা না ওদেরকে হটাতে পারছিলাম, না ওদের উপর কঠিন হামলা করতে পারছিলাম।

আমাদের এক সাথীর কাছে রকেটলাঞ্চার ছিল। আশরাফ ভাই আমাকে বললেন, কাউকে বলুন রকেট বহনকারীকে এখানে পাঠিয়ে দিয়ে সে যেন ওর স্থানে অবস্থান নেয়। আমি ক্রোলিং করে আমার একেবারে নিকটের মুজাহিদকে বললাম, আপনি রকেটলাঞ্চারধারীর স্থানে গিয়ে ওকে আশরাফ ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিন।

অল্পক্ষণ পরেই আশরাফ ভাইয়ের দিক থেকে রকেটলাঞ্চার আঘাত হানল আর্মির অবস্থানে। ধূলো-বালি উড়তে দেখা গেল। ওদের পক্ষ থেকে জবরদস্ত জবাবী হামলা শুরু হল। দেখতে দেখতে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ।

অল্পক্ষণের মধ্যে আগুনের কুণ্ডলি আর গোলার আঘাতে ধূলোবালু উড়তে শুরু করল আকাশের দিকে। একটু পরে আর্মিদের পক্ষ থেকে কিছুক্ষণ কোন গুলী বর্ষিত হল না। হয়ত মোর্চায় অবস্থানরত আর্মিরা আহত বা নিহত হয়েছিল। ওদিকের আর্মিরা ঘেরাও ছেড়ে সবাই আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের হাতে গোলাবারুদ ছিল খুবই কম, কিন্তু তবুও আমরা পুল পেরিয়ে তাদের অগ্রসর হতে দিচ্ছিলাম না। উভয় দিকে কান ফাটানো গোলাবর্ষণের আওয়াজ, এদিকে আমাদের বুলেট শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

আশরাফ ভাই আমাকে খবর পাঠালেন, অন্যান্যদের পিছু হটার নির্দেশ দিতে। আমি নদীর তীরের সাথীদের পাহাড়ের উপর দিকে ক্রোলিং করে পিছিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়ে আমিও আর একজনকে নিয়ে পিছাতে থাকলাম।

আশরাফ ভাই একা তখনও স্বস্থানে অবস্থান করছিল। আমি গুলী করতে করতে পিছিয়ে যাচ্ছি, যাতে ওরা দ্রুত এগিয়ে আসার সাহস না পায় এবং সাথীরা নিরাপদ দূরে চলে যেতে পারে। এক পর্যায়ে আমিও পিছিয়ে সামনের দিকে চলে এলাম। আশরাফ ভাই একা ভিন্ন পথে রয়ে গেছেন।

সানুরাকুলিপুরা এসে দেখি মানুষ এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে পালানোর জন্যে। গ্রামের মানুষ আশংকা করছে মুজাহিদরা পিছিয়ে এলে আর্মি এ গ্রামের উপর চড়াও হতে পারে। আমারও আশংকা ছিল তাই। এক কিশোরকে ডেকে বললাম, ‘গ্রামের সকল কিশোর যুবককে বাইরে চলে যেতে বল। ক্রেক ডাউন পড়লে এদের ঝামেলা হবে।’

এরপর এ গ্রাম ছেড়ে আমিও নিরাপদ অবস্থানে চলে গেলাম।

সন্ধ্যায় সানুরাকুলীপুরে এসে দেখি, সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আশরাফ ভাইয়ের মাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, আশরাফ ভাই কোথায়?

তিনি জিজ্ঞাসু নেত্রে আমাকে বললেন, “কেন, সেই যে বেরিয়ে গেল এখনও ফিরেনি।’

আশরাফ ভাই আর্মিদের মোকাবেলায় আমাদের সাথে ছিল একথা আমি ইচ্ছা করেই তার মাকে জানাইনি। আশরাফ ভাইয়ের ফেরার বিলম্বে সবার চেহারায়ও ফুটে উঠল উৎকণ্ঠা। গ্রামের এক নোক বলল, “বেটা, দুআ কর, শুনেছি দু’জন মুজাহিদ শহীদ হয়েছে।’

এ সংবাদ শুনে আমি শরীয়া আদালতের স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে বললাম, আপনি থানায় গিয়ে জেনে আসুন, কে কে শহীদ হয়েছেন। চেয়ারম্যান সাথে সাথে মোটর সাইকেলে খবরের সত্যতা যাচাই করতে থানায় যান। (এখানে জেনে রাখা দরকার, কাশ্মীরে প্রতিগ্রামে মুজাহিদদের সমর্থিত একজন চেয়ারম্যান সামাজিক অপরাধ ও প্রয়োজনীয় বিচারানুষ্ঠান শরীয়তের বিধান মতে করে থাকেন)।

চেয়ারম্যান চলে যাওয়ার পরই প্লাটুন কমাণ্ডার শবনমের সাথে আমার দেখা। তিনিও আমাকে শাহাদাতের সংবাদ দিলেন, যে সংবাদ আমি মোটেও শুনতে চাচ্ছিলাম না। তিনি বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আশরাফ ভাই শহীদ হয়েছেন।’

আমি বললাম, আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন, আশরাফ ভাই শহীদ হয়েছেন?

শবনম বলল, আমরা আর্মি ঘেরাও থেকে পালানোর সময় দেখেছি, আশরাফ ভাই আমাদের আগে আগে যাচ্ছেন। আমরা যে যেদিকে পেরেছি পিছিয়ে গিয়েছি। কিন্তু ততক্ষণে আশরাফ ভাইকে আর্মিরা ঘিরে ফেলেছে। এখন পর্যন্ত তার না পৌঁছার অর্থই হল তিনি আর্মিদের হাতে শহীদ হয়েছেন।

আমি শবনমকে বললাম, আপনি এখনই একথা অন্য কাউকে বলবেন না।

দু’ঘন্টা পরে চেয়ারম্যান ফিরে এলেন, তার চেহারায় দুশ্চিন্তা ও শোকের চিহ্ন। অবস্থাটা এমন ছিল যে, তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই তিনি কেঁদে ফেলবেন।

আমি তাকে অন্য ঘরে নিয়ে একাকী জিজ্ঞেস করলাম, কি খবর নিয়ে এলেন? তিনি সেই হৃদয়বিদারক খবরটি বললেন, ‘আশরাফ ও একজন পাকিস্তানী শহীদ হয়েছেন।

আমি সব সময়ই যে কোন কঠিন সংবাদ শোনার মত মনোবল পোষণ করতাম। কিন্তু আশরাফ ভাইয়ের মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে দুর্বল করে ফেলল। একসাথে দীর্ঘদিন যাবৎ পাশাপাশি দু’জন জিহাদের ময়দানে বিচরণ করেছি। কিন্তু তিনি মনযিলে মকসুদে চলে গেলেন আর আমি এখনও রয়ে গেলাম ঝড়-ঝঞ্জাময় দুনিয়ায়।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন