রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫ – ৪

নির্মলেন্দু গুণ

৭৫-এর শুরুতে, ঐ জাসদতাত্ত্বিকের বাকশালে যোগদান করার খবর পাঠ করে, চট্টগ্রামের ঐ রাতের দৃশ্যটি আমার খুব মনে পড়ে গিয়েছিলো। পরে, ৭৫-এর শেষের দিকে, রমনা থানার হাজতে গিয়ে, ক্ষমতার কাছ থেকে ফিরে আসা জাসদের জঙ্গী তরুণকর্মীদের সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়, তখনও চট্টগ্রামে দেয়া কবি আল মাহমুদের ঐ-রাতের সদর্প ঘোষণার তাৎপর্য আমি নতুন করে অনুভব করার চেষ্টা করেছিলাম।

অল্পদিনের ব্যবধানেই রব-জলিলের জাসদ ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগদানকারী কবি আল মাহমুদ, বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার পর, ক্ষমতায় আসা জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামাজিক সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট–‘জাসাস’-এর সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।

সুরাইয়া খানম ও আবুল হাসানের মধ্যকার বন্ধুত্বকে প্রেমের সম্পর্কে উন্নীত করার পেছনে আমার একটি খুবই কার্যকর ভূমিকা ছিল। বার্লিন থেকে ফিরে আসার পর, আবুল হাসানের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলা তাঁর পক্ষে সম্ভব কি-না, তা সহৃদয়চিত্তে ভেবে দেখার জন্য টিএসসি-র সবুজ ঘাসের গালিচায় তিনজন মুখোমুখি বসে, হাসানের পক্ষ থেকে আমিই সুরাইয়াকে অনুরোধ করেছিলাম। সুরাইয়া প্রথমদিকে হাসানের সঙ্গে নিজেকে আবেগী-সম্পর্কে জড়াতে রাজি হয়নি। পরে, ফেনী ব্রাউন ও কীটস-এর সম্পর্কের কথা বিবেচনায় গ্রহণ করে সুরাইয়া হাসানের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে রাজি হয়। কিন্তু আমি একটু আশ্চর্য হয়েই লক্ষ্য করি যে, কিছুদিনের মধ্যেই সুরাইয়া হাসানকে তাঁর প্রেমের একান্ত শিকারে পরিণত করে, আমার কাছ থেকে ক্রমশ আপন গোপন গুহার ভিতরে হাসানকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যেন আমি ওদের প্রেমের পথের কাঁটা। মনে হয় সুরাইয়াকে তুষ্ট করার জন্য, আবুল হাসানও আমার প্রতি একধরনের উদাসীনতা প্রদর্শন করে চলেছে। এ নিয়ে অবশ্য আমার মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না। আমি ভাবছিলাম, হাসান যদি এই প্রেমে সুখী হয়, তবে তাই হোক। ঐ সময়টাকে রূপসী ও রহস্যময়ী মৈত্রেয়ীর প্রেমে নিমগ্ন না থাকলে, নব-প্রেমিকযুগলের এই উদাসীনতা আমাকে হয়তোবা আরও বেশি কষ্ট দিতে পারতো।

[শিল্পী মৈত্রেয়ী রায় তাঁর পিতা, মনস্বী লেখক প্রফেসর শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিল। শ্রী রায় প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের আমন্ত্রণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে ঢাকায় এসেছিলেন। মৈত্রেয়ী ছিল, শুধু তখন পর্যন্ত নয় এখনও পর্যন্ত, আমার দেখা রমণীদের মধ্যে সবচেয়ে রূপসী। তখন ওর মতো রূপসী-বিদূষী ও বিদেশিনীর প্রেমে পড়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারাটা ছিল সকল কবির জন্যই খুব কঠিন ব্যাপার। হাসান তখন চিকিৎসার্থে পূর্ব-বার্লিনে। ঢাকায় থাকার কারণে, অন্য অনেকের মতো আমি মনে-মনে রূপসী মৈত্রেয়ীর প্রেমে পড়ি। তারপর প্রচলিত নিয়ম মাফিক, মৈত্রেয়ীর প্রেম অর্জনের জন্য আরও কয়েকজন প্রেমার্থীর সঙ্গে আমি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হই। অন্য কেউ লেখার আগেই আমি মৈত্রেয়ীকে নিয়ে ‘পিপীলিকা’ কবিতাটি লিখে ফেলি এবং শাহজাদপুরে রবীন্দ্রস্মৃতিপীঠ পরিদর্শনে যাবার পথে যমুনাবক্ষে ওকে ঐ কবিতাটি পাঠ করে শোনাই। ও বাংলা ভালো জানতো না। পরিবারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় সে বড় হয়েছে। ভালো ইংরেজি জানে। ইংরেজিতে লেখালেখিও করে। তখন আমার বাংলা কবিতাটি মেয়েকে ইংরেজিতে তর্জমা করে বুঝিয়ে দিতে, ওর বাবা-মা আমাকে সাহায্য করেন। তাতে আমার খুবই উপকার হয়। কবিতাটি মৈত্রেয়ীর মনকে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়। করুণাময়ী মৈত্রেয়ী, তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারে এবং ওর উদ্দেশ্যে ধাবিত আমার ভালোবাসাকে অবিশ্বাস্য-প্রশ্রয় দান করে আমাকে চিরঋণী করে।

কিছুদিনের মধ্যেই, আমাকে প্রথমে প্রেমে ডুবিয়ে ও পরে বিরহে নিক্ষেপ করে, সে তার পিতা-মাতার সঙ্গে বাংলাদেশ ত্যাগ করে, ইউরোপ হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যায়। যাবার পথে, রোম থেকে সে আমাকে শেলী ও কীটস-এর কবর থেকে তোলা রক্তলাল গোলাপের দুটো পাপড়ি ওর চিঠির ভাঁজের ভিতরে পুরে পাঠায়। আমি তখন দিবানিশি জেগে, মৈত্রেয়ীকে নিয়ে একটি প্রায় পুরো কাব্যগ্রন্থ ৈিচত্রের ভালোবাসা : প্রকাশকাল: জুন ১৯৭৫ ] রচনা করি।

কিছুটা রাজনৈতিক ও কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার কারণেই সুরাইয়া আমাকে এবং আমি সুরাইয়াকে অপছন্দ করতে শুরু করি। সুরাইয়া হাসানকে সত্যি-সত্যিই ভালোবাসে কি-না, এ নিয়েও আমার মনে সন্দেহ কাজ করতে থাকে। হাসান ছাড়াও, কবিতার জগতের বাইরের অপরিচিত পুরুষদের সঙ্গে সুরাইয়াকে আমি প্রায়ই দেখতাম। আমার সন্দেহ হতো, কি জানি। সুরাইয়া আবার সিআইএ-র সঙ্গে যুক্ত নয়তো? শুধু সুরাইয়া নয়, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর, আমি মৈত্রেয়ীকেও সিআইএ-র সঙ্গে যুক্ত বলে মনে-মনে সন্দেহ করতাম। তবে ঐ সন্দেহটা খুব একটা জোরালো ছিল না। সুরাইয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো- কোনো অফিসারের ওঠা-বসা ছিল বলে, সুরাইয়া সম্পর্কে ঐ সন্দেহটা ছিল খুবই জোরালো। আমি সুরাইয়াকে কিছুটা ভয়ও পেতাম। ওর এক ভাই তখন সেনাবাহিনীতে ছিল বলে শুনেছিলাম।

হাসানের কারণে সুরাইয়া আমাকে মুখ ফুটে ‘আপনি হাসানের কাছে আসবেন না’—কথাটা বলতে পারতো না। কিন্তু এমনটিই সে মনে-মনে চাইতো। সুরাইয়া আমাকে একটু ঘুরিয়ে অন্যভাবে বলতো, “আপনি ওর কাছে বেশি আসবেন না। আপনি আসলে ও একটু ইমোশনাল হয়ে যায়। তাতে ওর ক্ষতি হয়।’ আমি সুরাইয়ার যুক্তিটা মানতাম না। বার্লিন থেকে ফেরার পর আমি জানতাম, হাসান খুব বেশিদিন বাঁচবে না। হাসানও তা জানতো। ফলে, মৃত্যুপথযাত্রী হাসানের শয্যাপাশে যতটা সম্ভব বসে থেকে তাঁকে সঙ্গ দেয়ারই চেষ্টা করতাম আমি। সুরাইয়া তা পছন্দ না করলেও হাসান, ওর মা এবং বোন বুড়ি আমাকে ধরে রাখতো। আমাকে কাছে পেলে হাসান সত্যিই একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তো।

খালেদের অভ্যুত্থানটি যে ব্যর্থ হয়েছে, তা গোপন করার মতো সামান্য ব্যাপার ছিল না। পিজির পাশেই রেডিও। হাসানের কাছে এতো বড় খবরটি গোপন থাকার কথা নয়। হাসান আমার মতো রাজনীতি- নিমগ্ন ছিল না, তবে আমার মনের দিকটা বিবেচনা করে সে আমার রাজনৈতিক উদ্বেগকে নিজের উদ্বেগে পরিণত করতো। আমি তা জানতাম। তাই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার কথাটি জানালেও, হাসানের কাছ থেকে আমি খালেদ মোশাররফের করুণ মৃত্যুর খবরটি গোপন করলাম তাছাড়া খালেদের নিহত হওয়ার খবরটি তখনও সমর্থিত ছিল না খালেদের সঙ্গে হাসানেরও পরিচয় ছিল।

হাসান ভাবলো, ১৫ আগস্টের শোক সামলে উঠনে না উঠতেই আমি যে আবার একটা আঘাত পেয়েছি, তাতে হয়তো আবার আমি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবো। সেই ভয় থেকেই হাসান বললো, তুমি আবার গ্রামে ফিরে যাবে না তো! বুঝলাম, হাসান আমার মনের ভাবনা ঠিকই ধরতে পেরেছে। আমি এরকম ভাবছিলামও বটে। কিন্তু সেই ভাবনাটাকে মনের ভিতর বাড়তে না দিয়ে হাসানের পান্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, না, তুমি সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত আমি আর গ্রামে ফিরে যাবো না।

হাসান কি একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছিল আমার কথা মধ্যে? হয়তো পেয়েছিল। তাই বললো, এবার আমিও তোমার গ্রামের বাড়িতে যাবো

হাসান আগে বেশ কয়েকবার আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেছে। আমাদের পরিবারের সকলের সঙ্গেই ওর মধুর সম্পর্ক। গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর হাসান অভিমানি কণ্ঠে বলেছিল, ‘তোমার মতোই আমিও ভাবছি আমার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবো। ঢাকা আমার আর ভালো লাগছে না। গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়ে পুকুরের পাড়ে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর বানিয়ে তার মধ্যে আমি থাকবো একা। কবিতা লিখবো। মা থাকবে, বোন থাকবে।…’ তাঁর পাশে কোনো প্রেমিকার কথা সে আর কেন জানি, ভাবতে পারছিল না। আমি বললাম, ঠিক আছে যাবে, আগে তো তুমি সেরে ওঠ।

হাসান বললো, তুমি তো এখনও মহাদেবের বাসাতেই থাকছো, তাই থাকো। ঐ মেসে আর ফিরে যেয়ো না। একদিন সময় করে নীলা বৌদিকে নিয়ে এসো। খুব দেখতে ইচ্ছে করে। বলবে রান্না করে কিছু নিয়ে আসতে। তীর্থ (মহাদেবের ছেলে তীর্থ তখন মাত্র এক বছরের) ভালো আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ, ভালো আছে। আমি উঠে যাচ্ছিলাম। হাসান আমাকে নীলার কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিলো।

রাতে বাসায় ফিরে গিয়ে আমি আর মহাদেব রেডিও নিয়ে বসলাম খবর শোনার জন্য এভাবেই আমাদের সময় কাটে। বিভিন্ন রেডিওর খবর শুনি এবং প্রাপ্ত খবরের ভিত্তিতে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করি। তখন আমাদের নাওয়া-খাওয়ার কোনো ঠিক নেই। নানা রকমের দুশ্চিন্তার মধ্যে আমাদের সময় যে কীভাবে কেটে যায়, তা বুঝতেই পারতাম না। আজিমপুরে আমাদের পাশের গলিতেই থাকতেন আবুল মঞ্জুর। তিনি তখন খুব সম্ভবত বিগ্রেডিয়ার ছিলেন। গভীর রাতে কার্ফুর মধ্যে গলির ভিতরে তাঁর গাড়ি আসতো। আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম, এই বুঝি সেনাবাহিনীর জীপ এলো আমাদের তুলে নিয়ে যেতে। পরে জেনেছিলাম, গভীর রাতে মঞ্জুর বাসায় ফেরেন। তাতে আমাদের ভয় কিছুটা কাটে। হাজার হলেও তিনি আমাদের পাড়ার মানুষ। বিপদে আপদে তাঁর সাহায্য পাওয়া যাবে।

শেষ পর্যন্ত তাহেরের নেতৃত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য কিছুটা উদগ্রীব ছিলাম। দুপুরে রেডিও অফিসে গিয়ে শুনে এসেছিলাম, মোশতাককে তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে দেননি। শুনেছিলাম, তাহের তাকে পায়খানার মধ্যে আটকে রেখেছিলেন। কিন্তু রাতে যখন জিয়ার পর তিনিও জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন, তখন বুঝলাম এই যুদ্ধে তাহেরও হেরে গেছেন। তাঁর সিপাহী বিপ্লবটিও ব্যর্থ হয়েছে। তাই ব্যক্তিগতভাবে কর্নেল তাহেরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেও, জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে জিয়া তাহেরের নাম একবারের জন্যও উল্লেখ করেননি। জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে জিয়া বলেন :

‘প্রিয় দেশবাসী, আসসালামু আলাইকুম।

আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি : বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার এবং অন্যান্যদের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চীফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছে। এ দায়িত্ব ইনশাআল্লাহ আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আপনারা সকলে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। দেশের সর্বস্থানে, অফিস-আদালত, যানবাহন, বিমান বন্দর, নৌবন্দর ও কলকারখানাগুলি পূর্ণভাবে চালু থাকবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। খোদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’

(সূত্র : দৈনিক বাংলা ৮ নভেম্বর ১৯৭৫)।

জিয়ার ভাষণের পর-পরই খালেদের হাতে ক্ষমতা হারানো খন্দকার মোশতাকও জাতির উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ প্রদান করেন। তিনি অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে তাঁর ভাষণে ৩ তারিখের জেল-হত্যার দায় এড়াবার উদ্দেশ্যে তাঁর সরকারকে ‘১৫ আগস্ট থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যমান সরকার’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর অন্তিম ভাষণে তিনি জেনারেল ওসমানীর ভূমিকাকে মূল্যায়ন করেন এভাবে : ‘আমার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এম এ জি ওসমানীর সংকটকালীন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পরিসমাপ্ত হয়েছে। দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী এই কর্মবীর যা করেছেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’

খালেদ মোশাররফ কর্তৃক মনোনীত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মুহম্মদ সায়েম আগের দিন রাতে (৬ নভেম্বর) জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন

৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি সায়েম জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন :

‘গত ১৫ আগস্ট কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকুরিরত সামরিক অফিসার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবার পরিজনকে হত্যা করে। জনাব খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে সামরিক আইন জারী করেন। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার সঙ্গে সামরিক বাহিনী সংশ্লিষ্ট ছিলো না।’

(সূত্র : দৈনিক বাংলা : ৮ নভেম্বর ১৯৭৫)

খালেদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যাবার পর, মনে হয়েছিলো স্বাভাবিকভাবেই অতঃপর তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। জিয়া তাঁকে আর রাখবেন না। আর জিয়া যদি তাঁকে রাখতেও চান, তিনিই থাকতে চাইবেন না। কিন্তু, তিনি অপরিবর্তিত থেকে গেলেন। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে, ভোল পাল্টিয়ে, তিনি আবার বেতার-টিভির সামনে এসে উপস্থিত হলেন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে। আমরা অত্যন্ত কৌতূহল নিয়ে তাঁর কৌতুকময় দ্বিতীয় ভাষণটি শুনলাম। আগের দিন খালেদের জোরে তিনি যে-প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, পরদিন ক্ষমতায় থাকতে দেয়ার কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে তিনি সেই ক্ষমতাচ্যুত খুনি প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাকের ভূয়সী প্রশংসা করে যে ভাষণটি প্রদান করেন, তা ছিল নিম্নরূপ :

‘বিসমিল্লাহের রাহমানের রাহীম। প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, আসসালামু আলাইকুম।’

‘গতরাতে আপনাদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে কি পরিস্থিতিতে আমার প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়েছে—তার কিছুটা আভাস দিয়েছি। প্রেসিডেন্ট পদে খোন্দকার মোশতাক আহমদের পুনর্বহাল হওয়ার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত দাবী সত্ত্বেও তাঁরই অনুরোধক্রমে আমি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছি। খোন্দকার মোশতাক আহমদের দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের যে মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তা যে কোনো উন্নয়নশীল দেশে বিরল এবং সেই দেশের জনগণের জন্য গর্বের বিষয় …..

(সূত্র : দৈনিক বাংলা : ৮ নভেম্বর ১৯৭৫)

খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানটি কি তবে ব্যর্থ হলো? তাঁর আত্মদান বিফলে গেল? বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর কি কোনো সদর্থক ভূমিকা ছিল না? আমি বলবো, না ব্যর্থ হয়নি। খালেদ মোশাররফ তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১. খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও তাঁর তথাকথিত ‘সূর্যসন্তানদের ক্ষমতাচ্যুত করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের (আত্মস্বীকৃত খুনিদের) দ্বারা শাসিত হওয়ার গ্লানির হাত থেকে তিনি আমাদের বাঁচিয়েছিলেন।

[পরবর্তিকালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িতদের দ্বারা শাসিত হওয়াটা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল কিনা—তা অবশ্য ভিন্ন বিচার্য বিষয়।]

২. তিনি জেল-হত্যার বিচারের লক্ষ্যে বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি কে এম সোবহান-এর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন। কারা, কীভাবে জেলের ভিতরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছে—তা তদন্ত করার পাশাপাশি, ৩ তারিখের সন্ধ্যায় কী পরিস্থিতিতে দুষ্কৃতকারীদের দেশত্যাগ করতে দেয়া হয়েছে–তাও ঐ তদন্ত কমিশনের বিচার্য হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।

৩. ১৫ আগস্টে বর্বর হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের সামরিক বাহিনী যে যুক্ত ছিল না, এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাটি তিনি তাঁর নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের মাধ্যমে জাতি ও বিশ্বকে অবহিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রকৃতপ্রস্তাবে, প্রথমে জাতির জনককে সপরিবারে ও পরে জেলের ভিতরে বন্দি চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করার কলংকের হাত থেকে সেদিনই আমাদের সেনাবাহিনী মুক্তি লাভ করেছিলো। এটা ছিল খালেদের একটা খুবই বড় কৃতিত্ব।

আমার লেখাটি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু পারলো না। পারলো না এই জন্য যে, আমি লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, নভেম্বর মাসটি ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য ছিল আরও বেশি ঘটনাবহুল। ঐ মাসটি আমার কাছে কেন বেশি ঘটনাবহুল ছিল, তা বলার জন্যই আমাকে আরও কয়েক পাতা লিখতে হচ্ছে।

৮ নভেম্বর তারিখে আমরা জানতে পারি, ৭ নভেম্বরের সকালে বিপ্লবী সিপাহীরা ঢাকা টেলিভিশনের ভিতরে ঢুকে টিভির কর্মাধ্যক্ষ জনাব মনিরুল আলম, প্রধান হিসাবরক্ষক জনাব আকমল হোসেন ও টিভির প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনাব সিদ্দিক সাহেবকে গ্রেফতার করে; পরে ঐ গ্রেফতারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আলোকচিত্রগ্রাহক ফিরোজ চৌধুরীও সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। সারাদিন তাঁদের টিভিতে আটক রাখার পর সন্ধ্যার দিকে, চোখ বেঁধে তাঁদের অজানা স্থানের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকে তাঁদের আর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতের দালাল হিসেবেই তাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছিল বলে লোকমুখে শুনতে পাই। তাঁরা নিহত হয়েছেন বলেই তখন খবর রটে।

উন্মত্ত সিপাইরা সেনাবাহিনীকে অফিসার মুক্ত করার নামে বেশ কিছু সংখ্যক সামরিক অফিসারকেও গুলি করে হত্যা করেছে বলে খবর পাওয়া যায়। ঐসব রোমহর্ষক সংবাদ শোনার পর সিপাহী বিপ্লবের ভয়ে আমার ও মহাদেবের হৃৎকম্প বেড়ে যায়। আকমল সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন আমাদের দেশের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ারদের একজন। মাত্র কিছুদিন হয় বিয়ে হয়েছিল তাদের। ওদের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হতে থাকে; কিন্তু মুখ বুজে কষ্টকে বুকের মধ্যে বহন করা ছাড়া তখন আমার আর কিছুই করার থাকে না। আমার ঘুম আসে না। অজস্র চিন্তা এসে মাথায় ভিড় করে। আমি আমার চারপাশে আততায়ীর তপ্ত নিঃশ্বাস শুনতে পাই প্রিয়জনদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও মনে-মনে নিহত হতে থাকি

হাসানের অবস্থা ভালো নয়। শ্বাস নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। হৃৎপিণ্ডের নষ্ট হয়ে যাওয়া বাল্ব দুটো ক্রমশ আরও খারাপ হতে চলেছে। শীত পরাতে শ্বাসকষ্টের সঙ্গে কাশিটাও এসে যুক্ত হয়েছে। সুরাইয়া আমাকে জানালো, এখন কাশির সঙ্গে একটু-একটু রক্তও যাচ্ছে। ডাক্তাররা খুব একটা আশা দিতে পারছেন না। তবু পিজির ডাক্তাররা চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন যথাসাধ্য। আমরা সকাল বিকাল হাসানের কাছে যাচ্ছি। ওকে সঙ্গ দিয়ে যতটা সম্ভব অসুখের যাতনা ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। ওর শয্যাপাশে বন্ধুবান্ধব আর অনুরাগীর ভিড় লেগে আছে। সন্ধানী প্রকাশনী থেকে হাসানের নতুন কবিতার বই ‘পৃথক পালংক’ বেরিয়েছে। লাইনোতে ছাপা। কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা চমৎকার বাইকালার প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদে একটি পুরনো দিনের পালংকের ছবি। চার ফর্মার কবিতার বইটি হাতে নিয়ে হাসান সারাক্ষণ নাড়াচাড়া করছে। বারবার পড়ছে কবিতাগুলো। এ বইয়ের অধিকাংশ কবিতাই অসুখ আর মৃত্যুর বিষাদময়তা দিয়ে মোড়া। আগের দুটো কাব্যগ্রন্থের তুলনায় এই বইয়ের কবিতাগুলো ভিন্নস্বাদের হয়েছে। হাসান বইটি কোনো মন্তব্য ছাড়াই উৎসর্গ করেছে ওর কবি-বান্ধবী সুরাইয়া খানমকে। আমি হাসানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছি। এবং এ বইয়ের কবিতাগুলো যে খুবই ভালো হয়েছে, তা বলেছি। হাসান আমার প্রশংসা শুনে খুশি হয়েছে। হাসান ওর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি হরণ করো’ আমাকে উৎসর্গ করেছিল। আমি আমার প্রথম বইয়ে হাসানকে একটি কবিতা উৎসর্গ করেছিলাম। কিন্তু কোনো বই উৎসর্গ করা হয়নি। হাসানকে বললাম, আমি আমার পরের বইটি তোমাকে উৎসর্গ করবো। বইটির কিছু কবিতা লেখা হয়ে গেছে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাকি কবিতাগুলো লিখে ফেলবো। হাসান বললো, তোমার ‘চৈত্রের ভালোবাসা’ বইটা আমাকে দিতে পারতে। আমি লজ্জা পেলাম। বললাম, তোমার এই বইটির মতোই ওই বইটা ছিল মৈত্রেয়ীকে নিয়ে লেখা, কিছু কবিতা ছিল পূরবীকে নিয়ে। তাই ওটা তোমাকে দিইনি। এবার আর মিস হবে না। হাসান হাসলো। আমি বুঝতে পারলাম, ঔ হাসির স্বস্তি এবং আনন্দের চাইতে অভিমানের পরিমাণটাই বেশি ছিল। কিন্তু আমার তখন কিছুই করার ছিল না। আমি যে ইতোমধ্যেই বিলম্ব করে ফেলেছি, তা তখন কেমন করে বুঝাবো। হাসান যে আমাকে ঢাকায় ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং তাঁর জীবন সংশয় দেখা দেবে—তা আমি কেমন করে জানবো?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন