রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫ – ৫

নির্মলেন্দু গুণ

আজ ১১ নভেম্বর। সকালের দিকে বাসা থেকে বেরিয়েছি। রয়েলটির টাকা উদ্ধার করার জন্য বাংলাবাজারে প্রকাশকদের কাছে যাবো। হাতে টাকা নেই একেবারে। ঢাকায় আসার পর থেকে মহাদেবের ওপর খাচ্ছি। ‘পূর্বদেশ’ (অবজারভার হাউস থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক) বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মহাদেবও প্রায় বেকার। বাকশাল গঠনের পর সরকারী সিদ্ধান্তে চারটি কাগজ রেখে বাকি সব কাগজ বন্ধ

হয়ে যাবার কারণে, তখন পূর্বদেশও বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যাওয়া কাগজের সাংবাদিকরা তখন তাদের মোট বেতনের একটা অংশমাত্র পায়। পুরোটা পায় না। বন্ধ হয়ে যাওয়া কাগজের অনেক সাংবাদিককে তখন সরকারী চাকরি দেয়া হয়েছিল। মহাদেব সরকারী চাকরি নেয়নি। ফলে তাকে বেশ অর্থকষ্টের মধ্যেই দিনাতিপাত করতে হচ্ছিল। বাংলাবাজারে আমার বইয়ের প্রকাশকদের কাছে যাবার সময় ভাবলাম, কিছু টাকা দিয়ে যদি মহাদেবকে সাহায্য করা যায় তো ভালো হবে। হাসানের জন্যও কিছু ফলটল কিনে নিয়ে যেতে পারবো।

সারাদিন বাংলাবাজারে কাটিয়ে, বিউটি বোডিং-এ দুপুরের খাওয়া সেরে পড়ন্ত বিকেলের দিকে আমি বাংলাবাজার থেকে পিজির উদ্দেশ্যে ফিরে আসি। নীলাকে যে পিজিতে নিয়ে যাবো বলে বসিয়ে রেখে এসেছিলাম, তা আমার একদম মনেই ছিল না। এই লেখাটি লিখতে শুরু করার পর, সম্প্রতি নীলা আমাকে এ-সত্যটি জানিয়েছে। শুনে আমারও মনে পড়লো।

রিকশায় করেই আমি পিজির গেইটে আসি। রিকশা থেকে নেমে ভিতরে ঢুকতে যাবো এমন সময় আমার চোখে পড়লো— রিসেপশনের সামনের ছাদের নিচে একদল মিলিটারি অপেক্ষা করছে। দূর থেকে মিলিটারি জিপ দেখলেই ভয়ে আমার বুক কাঁপে। এখন দেখছি

একেবারে আমার চোখের সামনে। অপেক্ষমাণ। কে জানে কার জন্য অপেক্ষা করছে এই মিলিটারি জিপ? আমার জন্য নয় তো? আমার ভয়টাই আজ সত্য হবে না তো! জলপাই রঙের জিপটি রয়েছে সামনে। তার পেছনেই একটি জলপাই রঙের বড় পিকআপ ভ্যান। জিপে একজন সামরিক অফিসার বসে আছেন, তার পাশে একজন ড্রাইভার। পিক- আপটিতে দশ বারোজন সশস্ত্র জোয়ানের একটি দল। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় তারা কারও জন্য অপেক্ষায় আছে। হাসপাতালে ঢুকতে গেলে ওদের সামনে দিয়েই আমাকে যেতে হবে। তাই আপাতত হাসপাতালে না-ঢোকার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি গেট-সংলগ্ন নাহিদ স্টোর- এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি যে ভয় পেয়ে গেছি, মিলিটারিদের দেখে, তা যথাসম্ভব গোপন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি। আমি মিলিটারিদের দিকে পেছন দিয়ে নাহিদ স্টোর থেকে এক খিলি পান নিই। ইচ্ছা করেই বিলম্ব করতে থাকি, যাতে এর মধ্যে মিলিটারিরা চলে যায়। আমি তাদের চলে যাবার জন্য সময় দিই। পান মুখে পুরে কিছুক্ষণ পর একটু কালো জরদা চাই। পানের বোঁটা হাতে নিয়ে আমি চুনের সন্ধান করি। পকেটে খুচরো পয়সা থাকার পরও আমি একটি পাঁচ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরি দোকানীর উদ্দেশ্যে। তাতে বেশ কিছু সময় কাটানো সম্ভব হয়। শুধু এক খিলি পান খাবার জন্য আমি যে এতোটা সময় নিচ্ছিলাম সেজন্য দোকানীটি যে খুব বিরক্ত হচ্ছিল আমার ওপর, তা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু আমি কেন ওরকম করছিলাম, ঐ দোকানীটি তা বুঝতে পারলো কিছুক্ষণ পর; যখন মিলিটারিরা তাদের অফিসারের নির্দেশমতো পিক-আপ থেকে নেমে আমাকে পেছন থেকে ঘিরে ফেললো। আমি দোকানীর হঠাৎ ভড়কে যাওয়া বিকৃত চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম, আমাকে চারপাশ থেকে মিলিটারিরা ঘিরে ফেলেছে। তখন পাঁচ টাকার অবশিষ্টটা ফেরত দেয়ার উদ্দেশ্যে আমার দিকে প্রসারিত দোকানীর হাতটি ভয়ে ফ্রিজ হয়ে যায়। আমার পক্ষেও হাত বাড়িয়ে অবশিষ্ট টাকাটা আর ফেরত নেয়া হয়ে ওঠে না। সামরিক অফিসারের স্টিকের গুঁতো খেয়ে আমি ত্বরিৎগতিতে তার দিকে এমনভাবে ফিরে দাঁড়াই, যেন এতক্ষণ আমি এসবের কিছুই টের পাইনি। আমি যেন এই ভুবনের কেউ নই।

মিলিটারিদের এ্যাকশনের মধ্যে এমন একটি ভাব ফুটে ওঠে, যেন তাঁরা একজন খুব দুর্ধর্ষ আসামিকে গ্রেফতার করতে চলেছেন। যেন এ- সময়ে আমি এখানে আসবো- এমন একটা পাকা ইনফরমেশন পেয়েই তারা এখানে এসেছিলেন। মনে হলো দীর্ঘ অপেক্ষার পর তারা তাদের প্রার্থিত আসামিটিকে খুঁজে পেয়েছে। এখন তাকে ধরবার পালা। আমি আমার চেহারার মধ্যে যতদূর সম্ভব নির্বিকার ভাবটি বজায় রাখার চেষ্টা করি। খুব বিনীত ভঙ্গিতে আমার বগলের নিচে চেপে ধরা বইয়ের প্যাকেটটি হতে নিতে চাই। তখন ঐ অফিসার আমার বইয়ের প্যাকেটটি ছিনিয়ে নেবার জন্য প্যাকেটটি ধরে আচমকা জোরে টান দেন। তাতে আমার প্যাকেটের ভিতর থেকে একটি বই মাটিতে পড়ে যায়। বইটির নাম—‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’। আমি বইটি মাটি থেকে তুলতে গেলে- তিনি আমাকে বাধা দেন। তিনি নিজেই বইটি হাতে তুলে নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকেন। তার আগে তিনি বইয়ের ছাপা আমার প্রতিকৃতিতে চোখ বোলান। বইয়ের প্রথম কবিতা ‘হুলিয়া’র ওপর চোখ রেখে প্রশ্ন করেন, আমিই নির্মলেন্দু গুণ কি-না। আমি তাতে কিছুটা স্বস্তি বোধ করি; ভাবি, আমার পরিচয় জানার পর নিশ্চয়ই আমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। তাই কিছুটা আনন্দের সঙ্গেই বলি, জ্বি আমিই। আমার বন্ধু কবি আবুল হাসান এই হাসপাতালে অসুস্থ, আমি তাঁকে দেখতে এসেছি ঐ অফিসারটি আমার বইটি নিজের দখলে নিয়ে নেন। তাতে আমি খুশি হই। মনে করি, তিনি হয়তো কবিতার ভক্ত। আমার কবিতার বইটি হয়তো তাঁর পছন্দ হয়ে থাকবে। ভাবি, বইটি সঙ্গে থাকাতে ভালোই হলো।

আমি যখন ভাবছি তিনি এখন আমাকে হাসপাতালে যাবার অনুমতি দেবেন, তখনই জিপে উঠতে-উঠতে তিনি আমাকে পেছনের জোয়ানদের পিক-আপটিতে ওঠার নির্দেশ দেন। আমি তখন খুবই ভয় পেয়ে যাই। জীবনাশংকায় আমার মুখ শুকিয়ে আসে। গত ক’দিন ধরে সিপাইদের অবস্থার যেসব খবর পেয়েছি, তাতে সিপাইদের সঙ্গে উঠতে আমার পা একেবারেই নড়ছিল না। বিশেষ করে ৭ নভেম্বরের টিভি-হত্যাকান্ডের ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। এবার কি তবে আমার পালা? ভগবান জানেন। আমাকে ঐ জোয়ানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে অফিসারটি যদি অন্য কোথাও চলে যান, তাহলে ওরা কি আমার প্রতি সুবিচার করবে? ভারতের দালাল সন্দেহে ওদের হাতেই হয়তো আমার মৃত্যু হবে। আমি শেষবারের মতো ঐ অফিসারটিকে অনুরোধ করে বলি, প্লিজ আমাকে আপনার জিপে উঠতে দিন। তিনি আমার অনুরোধে কান না দিয়ে জিপে উঠেই তাঁর ড্রাইভারকে জিপ চালানোর নির্দেশ দেন। জিপটি চলতে শুরু করে। তখন পেছনের পিক-আপ ভ্যান থেকে নেমে আসা কয়েকজন জোয়ান, একটু আগে যাদের সঙ্গে উঠতে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম, আমাকে প্রায় চ্যাংদোলা করে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। পিক-আপে উঠে আমি একটি সীটের ওপর বসতে চেয়েছিলাম। তারা আমাকে নিচে বসবার জন্য বলে। আমি তাদের পায়ের নিচে লেটা দিয়ে বসি। তারা তাদের অস্ত্রগুলো আমার মাথা ও বুকের ওপর স্থাপন করে। আমি অসহায়ের মতো বাইরের দিকে তাকাই। লোকজন ঐ ঘটনাটি পথে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছিলো। আমি পথের মধ্যে একটি পরিচিত মুখের সন্ধান করি, যাতে আমার মিলিটারির হাতে ধরা পড়ার খবরটি তাকে জানাতে পারি। কিন্তু না, কোনো চেনামুখই আমার চোখে পড়ে না। আমি তখন মৃত্যুর জন্য মনে মনে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। হাসান এবং মহাদেবের দিকে আমার খুব রাগ হতে থাকে। এদের চিঠি পেয়েই না আমি ঢাকায় ফিরে এসেছি। না হলে আমি তো আমার গ্রামেই থাকতাম। কী ভুলটাই না করলাম। অনুশোচনায় আমার বুক ভেঙে কান্না আসে।

আমাকে পিক-আপে উঠাতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল, তাই অফিসারের জিপটি কোন্ পথে অগ্রসর হয়েছে তা জানার জন্য পিক- আপের জোয়ানরা শাহাবাগ-এর মরা-ঝর্নাটির কাছে দাঁড়িয়ে পথচারিদের সাহায্য নেয়। তখন পথচারিরা জানায় যে, ঐ জিপটি সোহরওয়ার্দী উদ্যানের ভিতরে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের দিকে গেছে। জোয়ানরা তখন আমাকে নিয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের দিকে ছুটে যায়।

আমরা যখন ভিতরে প্রবেশ করি তখন সামরিক অফিসারটি কন্ট্রোলরুমে অবস্থানরত পুলিশদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দান করে বেরিয়ে আসছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। তিনি ইঙ্গিতে তাঁর জোয়ানদের কী একটা নির্দেশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যান। ভিতরে একজন পুলিশের এসপি বসেন। ঐ এসপিসহ বেশ ক’জন পুলিশ জোয়ানদের হাত থেকে আমার চার্জ বুঝে নেবার জন্য এগিয়ে আসেন। পুলিশের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে জোয়ানরাও তাদের পিক-আপে উঠে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

আমি অসহায়ের মতো একা দাঁড়িয়ে থাকি। আমি বুঝতে পারি, আমাকে আপাতত পুলিশ কাস্টডিতে রেখে যাওয়া হচ্ছে। পরে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। কন্ট্রোল রুমের পুলিশরা আমার প্রতি খুবই সদয় ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শরিফের কেন্টিনে আড্ডা দিতেন, এমন দু’একজনকে সেখানেই পাই। তাঁরা সবাই আমাকে সাহস দেবার চেষ্টা করেন। বলেন, কবি সাহেব, আমাদের দিক থেকে আপনার কোনো ভয় নেই। আমরা আপনার কোনো ক্ষতি করবো না। আমরা আপনার সম্পর্কে কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে, বুঝেন-ই তো। আমরা কিন্তু আপনাকে ছাড়তেও পারবো না। তারা কেন আপনাকে ধরেছে, তা তারাই ভালো জানে। আপনার জন্য আমরা চিন্তিত।

পুলিশদের সহানুভূতিমূলক আচরণ ও তাদের কথা থেকে আমি বুঝতে পারছিলাম আমার ভবিষ্যত-চিন্তায় ঐ পুলিশ অফিসাররাও চিন্তিত। তখন এসপি সালাম সাহেব আমাকে সাহস দেবার জন্য একটি পুলিশের খাতা খুলে আমাকে দেখান। তাতে দেখলাম, আমাকে যিনি আটক করেছেন তার নাম লেখা আছে। তার নাম কর্নেল নোয়াজেশ আহমদ। আমাকে অভয় দিয়ে এসপি সালাম সাহেব জানালেন, কর্নেল নোয়াজেশ সাহেব আমাকে পুলিশের হেফাজতে রেখে যাবার সময় লিখিতভাবে একটি নির্দেশ রেখে গেছেন পুলিশের জন্য— Dont misbehave with him. (উনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন না।) ঐ কথাটি পুলিশের খাতায় লিখে দিয়ে তিনি ইংরেজিতে তাঁর নাম স্বাক্ষর করেছেন। আগে রাগ করলেও, ঐ নির্দেশটা লিখে দিয়ে যাবার জন্য কর্নেল নোয়াজেশের প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করি। ভেবে পাই না, এমন নির্দেশই যদি রেখে যাবেন, তাহলে তিনি আমাকে গ্রেফতারই বা করলেন কেন? আমি যে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত, আমি যে অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফের সাফল্য কামনা করেছিলাম, তা তো তাঁর জানবার কথা নয়। সন্দেহবশত ধরলেনই যদি, তবে আবার আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করার জন্য পুলিশের প্রতি লিখিত নির্দেশ দেবার কারণ কি? এই নির্দেশের অর্থ কি এই যে, এই কবির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে হলে আমি বা আমরা করবো, তোমরা পুলিশরা করো না? কী জানি! বিষয়টা আমার কাছে খুবই রহস্যজনক বলে মনে হতে থাকে। তিনি কি কারও কাছ থেকে আমার বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছিলেন?

পুলিশ আমাকে অভয় দিলেও আমি তাদের সম্পূর্ণভাবে আস্থায় নিলাম না। আমি প্রথম সুযোগেই পায়খানায় যাবার নাম করে, পায়খানার ভিতরে ঢুকে আমার বুক পকেটে রাখা দুটো চিঠি বের করলাম। একটি চিঠি ছিল আমার ভারতবাসী বড় ভাইয়ের লেখা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি ঐ চিঠিটি লিখেছিলেন। অন্যটি আমেরিকা থেকে লিখেছিলেন পূরবী বসু। ঐ পত্রেও ছিল আমার জন্য উদ্বেগ। মহাদেবের বাসার ঠিকানায় চিঠি দুটো এসেছিল। আমি ভাবলাম, দেহ তল্লাসি করে ঐ চিঠি দুটো পেলে আবার সমস্যা হতে পারে। তাই ঐ চিঠি দুটো আমি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে টয়লেটের মধ্যে ফ্ল্যাশ করে দিলাম।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আলো জ্বলে উঠেছে শহরে। ঐসব জ্বলে-ওঠা আলোর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবি, আমার জীবনের আলো নিভতে না জানি আর কতক্ষণ বাকি! এসপি সালাম সাহেব আমাকে কন্ট্রোল রুম থেকে রমনা থানায় হস্তান্তর করার জন্য রমনা থানার ওসিকে একটি গাড়ি ও কিছু পুলিশ পাঠানোর জন্য ওয়ারলেসে ম্যাসেজ পাঠালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রমনা থানা থেকে এক গাড়ি পুলিশ চলে এলো। সোহরওয়ার্দী উদ্যানের পুলিশ-কর্মকর্তারা আমাকে ব্যথিত মনেই বিদায় জানালেন। গাড়িতে উঠবার সময় আমার কানের কাছে এসে একজন বললেন, এই রাতটা যদি ভালোয় ভালোয় কেটে যায় তো বাঁচলেন। আচ্ছা, আপনাকে সাহায্য করতে পারেন, এমন কেউ কি আছেন, আর্মিতে? আমার তখন আবার খালেদের কথাই মনে পড়লো। বললাম, না ভাই, যিনি ছিলেন তিনি নিহত হয়েছেন। একবার জেনারেল সি.আর দত্তর কথাও মনে এসেছিল। কিন্তু তার নাম বলে, জানি, কোনো লাভ তো হবেই না বরং ঐ নামের কারণে আমার আরও বিপদ বাড়তে পারে।

আমি রমনা থানায় বেশ ক’জন পরিচিত পুলিশের দেখা পেলাম। আমি একসময় খুবই নিশাচর ছিলাম। তখন ঢাকার পথে তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল। তারা আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তার মধ্যে পড়লেন। রমনা থানার দারোগা সাহেব আমাকে সম্মান দেখিয়ে তাঁর পাশেই একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখলেন। আমি ভাবলাম আর্মির সঙ্গে নিশ্চয়ই তাঁর কথা হবে একসময়। কর্নেল নোয়াজেশ নিশ্চয়ই আমার কথা ভুলে যাবেন না। তিনি একটা নির্দেশ অবশ্যই দেবেন। তখন হয় তিনি আমাকে ছেড়ে দেবেন, না হয় আমাকে চোখ বেঁধে পাঠিয়ে দেবেন ক্যান্টনমেন্টে এবং সেখানেই আমার বিচার হবে। চার জাতীয় নেতা এবং খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহযোগীদের মতো হয়তো গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করা হবে আমাকেও। দারোগা সাহেব চাচ্ছিলেন যেন আমাকে আর্মি এসে নিয়ে যায়। তাহলে তিনি একটা উটকো ঝামেলা থেকে বাঁচেন। যখন তা হলো না, এবং হবার আশাও কম বলে মনে হলো— তখন রাত বারোটার দিকে তিনি আমাকে বললেন, কবি সাহেব, আপনাকে হাজতে ঢুকাবো না বলে ভেবেছিলাম কিন্তু আর তো অপেক্ষা করা যায় না। এবার একটু কষ্ট করে ওখানেই চলে যান। ওখানে একটু কষ্ট হবে, তবে আমি বলে দিচ্ছি, অন্য আসামিরা আপনাকে বিরক্ত করবে না।

দারোগা সাহেব আমাকে হাজতে ঢুকিয়ে অন্য আসামিদের কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তখন বেশ ক’জন আসামি সমস্বরে আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললো, দাদাকে আমরা চিনি। উনি আমাদের গুরু। গুরু, আপনি এখানে কেন? ঐ সব আসামিদের সঙ্গে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে আমার পরিচয় হয়েছিল। ওরা মারফতী লাইনের সংসারত্যাগী মানুষ। হাইকোর্টে সিদ্ধি সেবন করে। আর মারফতী গান করে। ওদের পেয়ে আমার হাজতের ভয়টা একেবারেই কমে গেলো।

দারোগা সাহেবও খুশি হয়ে বিদায় নিলেন। কর্নেল নওয়াজেশ সাহেবের ঐ নির্দেশটির মূল্য আবারও টের পেলাম রমনা থানার দারোগা সাহেবের আচরণে। তিনি হয়তো ভয় পাচ্ছিলেন, হাজতের ভিতরে ধরা পড়া দাগী আসামিরা যদি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। হাজতের দাগী আসামীরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করায় তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফিরতে পারলেন বলেই মনে হলো।

হাজতের ভিতরে ঢুকেই পরিচয় হলো কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। এরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। জাসদ ছাত্রলীগ করে। জাসদ আহুত ১৮ নভেম্বরের জনসভায় প্রচারকার্য চালানোর সময় বেবি ও মাইকসহ পুলিশ রাস্তা থেকে ওদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এসেছে। ওরা কর্নেল তাহেরের ভক্ত ও অনুসারী। ওরা জিয়ার দিকে খুবই ক্ষিপ্ত ছিল। বললো, “জিয়াকে আমরা দেখে নেব। শালা বিশ্বাস ঘাতক। আমরাই তাঁকে মুক্ত করেছি, আর এখন সে আমাদের জেলে পুরছে।’

‘কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে…’ কবিতাটির কথা আমার মনে পড়লো। ভাবলাম, ভালোই হয়েছে। কর্নেল তাহের আর জেনারেল জিয়ার সমর্থকরা একসঙ্গে মিলতে পারলে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের বিপদ আরও বাড়তো।

নোয়াজেশ-এর তাঁবুতেই যে খালেদের মৃত্যু হয়েছিল তা তখন আমি জানতাম না। ১১ তারিখেই জেনারেল জিয়াউর রহমান দ্বিতীয়বারের মতো জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। তিনি তাঁর অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ভাষণে বলেন :

‘আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক। কতিপয় মহলের বিভিন্ন প্রচারণার সঙ্গে আমার নাম জড়িত দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই যে রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এবং আমাদের সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক।’

(জাসদের ডাকা ১৮ তারিখের জনসভায় কর্নেল তাহেরসহ জাসদ নেতাদের সঙ্গে জেনারেল জিয়াও ভাষণ দেবেন বলে তখন জাসদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হচ্ছিল। রমনা থানায় আনীত জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের ঐরূপ প্রচার চালানোর সময়ই রাস্তা থেকে গ্রেফতার করা হয়। সভাটি হওয়ার কথা ছিল বায়তুল মোকারমের প্রাঙ্গণে।)

১৪ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর দূরবস্থা সম্পর্কে আপনারা অবগত আছেন। স্বাধীনতার পর ঐ দিন পর্যন্ত যে সরকার অধিষ্ঠিত ছিল সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি তাদের অবহেলার ফলে…।’

[সূত্র : দৈনিক বাংলা, ১৩ নভেম্বর ১৯৭৫]

এরকম একটি জীবন-মরণ সংকটের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার জন্য নিজেকেই দায়ী বলে মনে হতে থাকে আমার। আমার মনে এরকম বিশ্বাস কাজ করতে থাকে যে, আজকের এই পরিস্থিতিটিকে আমিই ইনভাইট করেছি। এখন এর মূল্য তো আমাকে দিতেই হবে। আমার জন্য তখন ঘুম অবাস্তব কল্পনা। তবু হঠাৎ কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি কিছুক্ষণের জন্য? কী জানি! একটু আগে তন্দ্রার ভিতরে আমি একটি স্বপ্ন দেখছিলাম। কে যেন আমাকে বলছে : ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডটি নিঃসন্দেহে খুবই বর্বর, খুবই নির্মম এবং নিষ্ঠুর একটি ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোনো তুলনা নেই। এমনকি পৃথিবীর কোনো কাব্যেও এরকম নিষ্ঠুরতার সন্ধান পাওয়া যাবে না। তাই বলে, কবি হলেই তুমি এমন বিশেষ কে যে, ঐ ঘটনার পর তোমাকে এতোটাই ভেঙ্গে পড়তে হবে; মানসিকভাবে এতোটাই বিপর্যস্ত হতে হবে; লোকজনকে জানান দিয়ে তোমার মন খারাপ ভাবটিকে প্রকাশ করতে হবে; ঢাকাকে আর ‘বাসযোগ্য নয়’ বলে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে এই নগরী ত্যাগ করে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যেতে হবে? বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এতোটা প্রেম দেখানোর মতো কোনো বাস্তব যুক্তি তোমার জন্য কি ছিল? তাঁর সঙ্গে তুমি এমনকি ব্যক্তিগতভাবে পরিচিতও ছিলে না। আসলে, তুমি তাড়িত হয়েছিলে তোমার পোয়েটিক-ইগো দ্বারা। একটি বড়-রকমের ট্রাজিক ঘটনা যে ঘটে গেছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অনেকেই তা স্বীকার করেন। প্রকাশ করার সুযোগ নেই বলে অনেকেই গোপনে ঐ ঘটনার বেদনা অনুভব করেছেন। কিন্তু তুমি অন্যদের মতো তোমার প্রতিক্রিয়া গোপন করতে চাওনি। শত্রুকে শাস্তি দেবার শক্তি তোমার ছিল না, যার ছিল সে অস্ত্র হাতে লড়তে ভারতে চলে গেছে। তুমি তো লড়তেও যাওনি। তোমার অস্ত্র হচ্ছে অভিমান। সেই অভিমানের অস্ত্রে নিজেকে উন্মাদে পরিণত করে, তুমি নিজেকে অন্যের চাইতে পৃথক প্রমাণ করার সুযোগ তৈরি করে নিয়েছো। এর সবটাই যে তোমার জ্ঞাতসারে ঘটেছে, তুমি পরিকল্পিতভাবে এগুলো করেছো, তা আমি বলবো না, তবে তুমি নিশ্চয়ই অস্বীকার করবে না যে, কল্পনায় এই ঘটনার সঙ্গে কোনো-না- কোনোভাবে নিজেকে তুমি জড়িত করে দেখতে চেয়েছিল। তোমার কবিস্বভাবের এই খুব ভেতরের গোপন-চাওয়াটাই তোমার পরবর্তি আচরণগুলোকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। তাই গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে এসেই তুমি যখন ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মুখে পড়লে, যখন তুমি এমন একটা ভাব প্রকাশ ও প্রচার করতে চেয়েছো যে, তোমার অনুমোদন নিয়েই খালেদ মোশাররফ তাঁর অভ্যুত্থানটি ঘটিয়েছেন। তুমিই তাঁর গাইড-ফিলোসফার।’

‘তোমার বিগত কিছুদিনের আচরণের মধ্য দিয়ে যে সংঘাত ও সংকটকে তুমি আহ্বান করেছো, আজ সেই সংকট তোমার জীবনে প্রবেশ করেছে। কর্নেল নোয়াজেশ তোমাকে গ্রেফতার করেছেন, কথাটা যত না সত্য, তার বড় সত্য হলো, কর্নেল নোয়াজেশকে তুমি তোমার গোপন ইচ্ছাপূরণের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য করেছো। এমন কিছু ঘটুক, তুমি কি তা চাওনি? চেয়েছো। চেয়েছো। কিন্তু এখন যখন ঘটনা ঘটে গেছে তখন ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করে ভয় পাচ্ছো। এখন ভয় পাচ্ছো কেন? যে বিপদকে মনে-মনে কামনা করেছিলে, সে এসেছে, এখন তাকে বীরের মতো স্বাগত জানাও। তুমি যে বঙ্গবন্ধুর কথা বলো, তিনি তো তোমার মতো ভয় পাননি। তিনি তো যথার্থ বীরের মতো ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়েও তাঁর বিশ্বাসের কথা বলেছেন। তাঁর ভালোবাসার কথা বলেছেন। তুমি ভয় পাও কেন? ভয় পেয়ো না, ওঠ, জাগো।’

স্বপ্নের ঘোর কেটে গেলে আমি দ্রুত উঠে বসলাম। বুঝতে পারলাম, আমি স্বপ্নমতো কিছু একটা দেখেছি। আমার গ্রামের শ্মশানবাসী জগা সাধুর শুভ্রশশ্মশ্রুমন্ডিত হাসিমাখা মুখখানি আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। তবে কি তিনিই এই কথাগুলো আমাকে বললেন? তখন আমার ভিতরে বিভ্রম কাজ করছিল না। আমি স্পষ্টই অনুভব করতে পারছিলাম, আমি আগের চাইতে সাহসী। কোথা থেকে আমি যেন সাহস খুঁজে পাচ্ছি।

দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সময় লক্ষ্য করেছি, কোনো অপরাধ না থাকলেও, জন্মগতভাবে হিন্দু হওয়ার কারণেই আমি নিজেকে এক পর্যায়ে শাস্তিযোগ্য বলে ভাবতে শুরু করি। জন্মগতভাবে হিন্দু বা মুসলমান, শিখ বা খ্রিস্টান হওয়াটা যে আসলে কোনো অপরাধ নয়, হিংসার উন্মত্ততার ভিতরে পড়ে, তা আর তখন স্থির সত্য বলে আমার মনে হয় না। জীবন বাঁচানোর জন্মগত অধিকারবোধটি তখন ভিতর থেকেই কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। ১৯৬৪-তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসে আমি এরকম উপলব্ধি করেছিলাম। তারপর, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পটভূমিতে ‘হিন্দু-শূন্য পাকিস্তান’ গঠনের লক্ষ্যে পরিচালিত পাকবাহিনীর অঘোষিত শুদ্ধি অভিযানের ছত্রছায়ায়, আমাদের আশপাশের গ্রামের একদল লুটেরা-মুসলমান যখন নির্বিবাদে আমাদের বাড়িঘর লুট করছিল, তখনও আমি ঐরকমের উপলব্ধির শিকার হয়েছিলাম। এই উপলব্ধিটি এমনই মারাত্মক একটি ব্যাপার যে, তখন মানুষ একটি তুচ্ছাতিতুচ্ছ পতঙ্গে পরিণত হয়। সে তার সকল প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। প্রবল প্রতিপক্ষ তখন পতঙ্গ নিধনের মতো করেই দুর্বল প্রতিপক্ষকে নিধন করে। হত্যাকারীকেও মানুষ-হত্যার বিবেকী দায় তখন আর বইতে হয় না।

শুধু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতেই নয়, বিশ্বাসগত রাজনৈতিক মত-পার্থক্যের কারণেও দেশে যখন ঐরকমের সংঘাতক্ষেত্র তৈরি হয়, তখনও বিজয়ী শক্তির হাতে পরাজিতরা কীটপতঙ্গবৎ নিহত হয়। ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাপুঞ্জ বিশ্লেষণ করে আমি এই ধারণায় উপনীত হলাম যে, জাতির জীবনে এখন সেরকম সময়ই উপস্থিত হয়েছে। আমি এখন আর কবি নির্মলেন্দু গুণ নই, আমি একজন কীট নির্মলেন্দু গুণ। আমি এখন একজন সামান্য পতঙ্গ। যাকে বুটের তলা দিয়ে মাড়িয়ে দিলেও কেউ, আহা! এটা কী করলেন, বলে সামান্য আক্ষেপটুকুও এখন আর প্রকাশ করবে না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন