রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫ – ৬

নির্মলেন্দু গুণ

৩ নভেম্বরের ভোর থেকে ৬ নভেম্বরের মধ্যরাত পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থেকেও খালেদ মোশাররফ যে তাঁর প্রতিপক্ষকে মুহূর্তের জন্যও কীট-পতঙ্গের দৃষ্টিতে দেখেননি, এটি মানবিক দৃষ্টিকোণ বিচারে খুব বড়মাপের একটি বিষয় ছিল। ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার পর, কোনো সামরিক অফিসার ইতোপূর্বে প্রতিপক্ষের সঙ্গে এমন মানবিক আচরণ করেছেন বলে মনে পড়ে না। এটি অবশ্যই খুব বড় একটি ঘটনা। হয়তো ঐ রকমের বড় মাপের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে গিয়েই খালেদ ব্যর্থ হয়েছেন। যে দেশে ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের জেল-হত্যার মতো নৃশংস ঘটনায় স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শক্তিটি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, সেই দেশে কোনো রক্তপাতহীন সামরিক অভিযানের পক্ষে জয়ী হওয়া কখনই সম্ভব ছিল না, এবং উচিতও নয়। খালেদ মোশাররফের মতো আপাত-ব্যর্থ একজন সমরনায়কের প্রাধান্য দিতে চাইবো। বলবো, ব্যাটা নিজে তো মরেছেই, আমাদেরকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে গেছে। বলবো, কী দরকার ছিল ঐরকমের একটি ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো শান্তিবাদী-অভ্যুত্থান ঘটানোর?

একসময় খালেদকে নিয়ে আমি নিজেও এরকমই ভেবেছি। ভেবেছি, এই খালেদের জন্যই আজ আমার এই দুর্ভোগ। পরে মানুষের ঘুমিয়ে পড়ার কারণে রাত যখন খুব গভীর হয়ে আসে, যখন খুব ঘনঅন্ধকারে নিমজ্জিত হয় পৃথিবী, যখন এই মরপৃথিবীর কোনো-কোনো মানুষের চোখে আলো এসে পড়ে অনেক দূরের কোনো গ্রহ থেকে; -যখন আমার দেহ মৃত্যুকে গ্রহণ করার জন্য বীরের মতো প্রস্তুত হয়, তখন হঠাৎ মনে হয় যে-কোনো মূল্যে নিজ-জীবনকে রক্ষা করার চেয়েও জগৎ-সংসারে এমন কিছু বড় বিষয়ও আছে, যার কাছে জীবনের মতো একটি বড় জিনিসকেও খুবই তুচ্ছ বলে মনে হয়। তাইতো হাসি মুখে জীবনদানের ঘটনা পৃথিবীতে খুব একটা কম ঘটেনি। আমাদের দেশেও অমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। আমি নিজে ভীতু বলেই খালেদকে দুষেছি। আত্মস্বার্থে আমার দৃষ্টি অন্ধ থাকার কারণে আমি তাঁর রক্তপাতহীন ব্যর্থ- অভ্যুত্থানে সৌন্দর্যকে দেখতে পাইনি।

সেদিন রমনা হাজতে পুরোপুরি না কাটালেও, আজ ২১ বছর পর ঐসব দিনের কথা লিখতে বসে অনুভব করছি, এখন আমার চোখের ছানি অনেকটাই কেটেছে। তাই এতদিন পর আজ খালেদের বীরত্ব এমন করে আমার চোখে পড়লো। ৭২ ঘণ্টা ক্ষমতায় থেকেও খালেদের হাতে এক ফোঁটা রক্তও যে ঝরেনি; তাঁর উন্মত্ত হিংসার আগুনে তাঁর প্রতিপক্ষ যে কীটপতঙ্গের মতো ভষ্মীভূত হয়নি— এখানেই তিনি বড়। সবসময় বৈষয়িকভাবে জয়ী হওয়াটাই বড় কথা নয়। খালেদ হয়তো অন্যায়ের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে রাতভর সুবাস ছড়িয়ে, কুয়াশাঢাকা ভোরে শীতের শেফালির মতো ঝরে যাওয়াটাকেও মূল্যবান বলেই মনে করেছিলেন। সামান্য সময়ের পরিচয়ে, কবিতা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে খালেদ আমাকে বলেছিলেন, তিনি কবিতা ভালোবাসেন। হয়তো কবির মতোই ভেবেছিলেন তিনি, ‘যদি মরে যাই ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই।’

খালেদ ঐ অভ্যুত্থানে জয়ী হননি বলেই, তিনি ব্যর্থ, এমন চিন্তাকে আমি আজ আর সমর্থন করবো না। আমি বলবো, প্রতিপক্ষকে পতঙ্গের মতো নিধন করে জয়ী হওয়ার রাজনৈতিক ধারণাটিকেই তিনি তাঁর ঐ ব্যর্থ-অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে চ্যালেঞ্জ করে গেছেন। তিনি এমন এক উচ্চতর মানবিক ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন যে, শত্রু হলেও মানুষ মানুষই। কোনো অবস্থাতেই মানুষ কীট-পতঙ্গ নয়। শত্রুকেও কীট-পতঙ্গের মতো (১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর-এ যেমন ঘটেছে) হত্যা করাটা অন্যায়। জয়ী হওয়ার জন্য খালেদ এমন কাজ করেননি।

তাই, খালেদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আগামী দিনের ইতিহাসবেত্তারা নির্দ্বিধায় এমন দাবি করতে পারবেন যে, খালেদ ছিলেন আপাদমস্তক মানবিক। খালেদের প্রতিপক্ষ ছিল বর্বর, নিষ্ঠুর এবং অমানবিক। মানবিকতার চর্চা করতে গিয়ে খালেদ তাঁর জীবন দিয়েছেন বটে, কিন্তু তার এ জীবনদান ব্যর্থ হয়নি। এই মূল্যবান সত্যটি তিনি প্রমাণ করে যেতে পেরেছেন যে, ১৯৭১ সালে তিনি বর্বরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। বর্বরতার পক্ষে নয়। অনেকেই তা পারেনি। তারা সাময়িকভাবে জয়ী হলেও, শেষ-বিচারে তারা পরাজিত হয়েছেন। শুধু মানবিক ইতিহাসের বিচারেই নয়, রোজ হাসরের দিনে, মনে করি তা সর্বশক্তিমান আল্লাহর বিচারেও সত্য বলেই গণ্য হবে। খালেদ কাউকে খুন করেননি। এটা আমাদের অনেকের চোখ এড়িয়ে যাওয়া খুব বড় একটা ঘটনা।

রমনা হাজতে; পাকা মেঝের ওপর হাত দুটোকে বালিশ বানিয়ে তার ওপরে শুয়ে শুয়ে আমি আমাদের রক্তাক্ত ইতিহাসের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। আমি যে কেন এমনভাবে এ-দেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। আমি কি চাইলে অন্যরকম কবিতাও লিখতে পারতাম না? জীবনানন্দের মতো। হাসান যেমন লেখে। পারতাম। কিন্তু আমি যে কেন সুকান্তের মতো এতো স্পষ্ট করে রাজনৈতিক বিষয়নির্ভর কবিতা লিখতে গেলাম? আমার বাবার কথা খুব মনে পড়লো। তিনি আমাকে ঢাকায় আসতে দিতে চাননি। আমার মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা কী কষ্টটাই না পাবেন। তাকেসহ আমার পুরো পরিবারটিকে এভাবে কষ্ট দেয়াটা কি আমার উচিৎ হলো? আমাকে ১৯৭১-এ ভারত থেকে যিনি বাংলাদেশে ফিরতে দিতে আগ্রহী ছিলেন না— আমার সেই বড় ভাই যখন জানবে আমি নেই, তখন? ভুল হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আমি বেঁচে যাবো, এমন ভাবনা আমার মনে তখন একেবারেই আসছিল না।

আমার প্রিয় পরমায়ুকে প্রসারিত করে দিয়ে একটি নিদ্রাহীন রজনীর অবসান হয়। পাখির কিচির-মিচির শব্দে মগবাজারে, রমনা থানার হাজতে ভোর আসে। আর কাক ডাকা ভোরের দিকে আমাদের হাজত- ঘরটি পরিষ্কার করার জন্য একজন মেথরের আগমন ঘটে। তার নামটি আজ আর মনে নেই আমার। তখন জেনেছিলাম। আমি তার সঙ্গে কথা বলে তাকে একটা কাজ দিই। বলি, এই ঠিকানাটা তুমি তোমার কাছে রাখো।

ঐ ঠিকানায় আমার এক বন্ধু থাকেন। উনার নাম মহাদেব সাহা। তুমি তার কাছে গিয়ে আমার কথা বলবে। বলবে আমি আমাকে ধরে এখানে রেখে গেছে। তিনি তোমাকে যাতায়াত ভাড়া ছাড়াও কিছু টাকা বখশিস দেবেন। আমার কাছে বেশি টাকা নেই। এই টাকাটা রাখো। বলে তার হাতে পাঁচ টাকার একটা নোট গুঁজে দিই। বলি, পারবে তো? আমার চিরকুটটি লুকিয়ে কোমরের ভাঁজে গুঁজতে লোকটি বললো, খুব পারবো। আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, বাবু।

লোকটি আমার চিরকুট নিয়ে বেরিয়ে গেলে আমার মনে একটু স্বস্তি ফিরে আসে এই ভেবে যে, অতঃপর মহাদেব আমার খবর জানতে পারবে। বাসায় না ফিরে যাওয়াতে মহাদেব ও নীলা নিশ্চয়ই আমার দুর্ঘটনার কথা আঁচ করতে পেরেছে। এতক্ষণ আমি ছিলাম আমার প্রিয়- পরিচিতজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাবলাম, এই চিরকুটটি আমাকে আমার প্রিয়জনদের সঙ্গে যুক্ত করতে সাহায্য করবে। (ঐ লোকটি ঐ চিরকুট যথাসময় মহাদেবের বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল এবং নীলার কাছ থেকে সংবাদ পৌঁছে দেবার বখশিস হিসেবে একটি পঞ্চাশ টাকা নোট আদায় করেছিল বলে নীলা সম্প্রতি দাবি করেছে।)

সকালে হাজতিদের সবাইকে তন্দুর রুটি আর লাউ ভাজি খেতে দেয়া হয়। সকলের সঙ্গে মিলে আমিও তাই খেলাম। পেটের ভালোমন্দের কথা ভেবে আর লাভ নেই। দেহই যদি না থাকে, তো পেট ভালো রেখে আর লাভ কি? হাইকোর্টের মাস্তান-বন্ধুদের কারণে হাজতে সিগারেটের অভাব ছিল না। বিশেষ ব্যবস্থায়, দারোগা সাহেবের নির্দেশে একটু চা-ও দেয়া হলো আমাকে।

এরই মধ্যে মহাদেব এসে থানায় হাজির। মহাদেবকে খুবই বিধ্বস্ত দেখায়। বুঝতে পারি রাতভর আমার মতই মহাদেবের ওপর দিয়েও একটা বড়রকমের ঝড় বয়ে গেছে। আমাকে সপ্রাণ দেখতে পেয়ে, মহাদেব খুবই স্বস্তিবোধ করলো। মহাদেবকে দেখে আমিও হালে পানি পাই। বলি, দোস্ত, আমাকে যত তাড়াতাড়ি পারো এই নরক থেকে উদ্ধার করো। সারারাত কী টেনশনের মধ্যেই না কাটিয়েছি। থানা- হাজত-কারাগার কখনও কবির বাসস্থান হতে পারে না।

কিন্তু কী করা যায়, তা মহাদেবও যেমন ভেবে পাচ্ছিল না— আমিও তেমনি ভেবে পাচ্ছিলাম না। কাকে বললে কাজ হবে, কাকে বলা দরকার, কিছুই ঠিক মতো ভাবতে পরছিলাম না। পরে দুজনের মিলিত পরামর্শ অনুযায়ী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং দৈনিক বাংলায় কবিদের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মহাদেব বিদায় নেয়।

সকাল দশটার দিকে শুরু হয় হাজতিদের কোর্টে নিয়ে যাবার আয়োজন। নিয়ম হলো ২৪ ঘণ্টার মধ্যোই হাজতিদের হাজির করতে হয়। সেখান থেকে কেউ খালাস হয়ে যায়, কেউ যায় কেন্দ্রীয় কারাগারে, কেউ আবার পুলিশ রিমাণ্ডে থানায় ফিরে আসে। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে কোর্টে নেয়া হবে না। পরে যখন বুঝলাম আমাকেও কোর্টে নেয়া হবে তখন ভাবলাম, অন্য সব কম-গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের যেভাবে কোমরে দড়ি দিয়ে লট বাঁধা হচ্ছে, আমাকে সেরকম করে বাঁধা হবে না। আমি আর্মির হাতে ধড়া পড়া লোক। তা ছাড়া আমি একজন কবি। আমার একটা পৃথক মর্যাদা আছে। কিন্তু না, কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি রশিতে আমাকেও কোমর পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধা হলো। হাতে ঐ বিখ্যাত হ্যাণ্ডকাপ, খুব ছোটবেলা থেকে নাটকে-সিনেমায় যেগুলো দেখে আসছি। কোনোদিন হাতে ছুঁয়ে দেখিনি। আজ যখন আমার নিজের হাতেই আক্ষরিক অর্থে শোভা পেলো, তখন আর না দেখে কী চলে? আমার দুই হাত একসঙ্গে বাঁধা। এক ধরনের থ্রিল অনুভব করলাম তাতে। আজ একটু ছেলেখেলার মতোই লাগে ঐদিনটির কথা ভাবতে কিন্তু ঐ দিন ঐ হ্যাণ্ডকাপগুলো নকল নয়, সত্যিকারের হ্যাণ্ডকাপই ছিল

কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের সবাইকে পুলিশ-ভ্যানে তোলা হলো। বিরাট ভ্যান। উপরের দিকে জালি কাটা। তাতে চোখ লাগিয়ে বাইরের লোকজনদের চলাচল দেখা যায়। আমরা সবাই ঐ জালিপথে চোখ রেখে বাইরের আকাশ-বাতাস, লোকজন, গাড়ি রিকশা ও ঢাকার ব্যস্ত রাজপথ দেখতে-দেখতে চললাম পুরনো ঢাকায়, কোর্টে

কোর্টে যাবার পর নিয়মমতো আসামিদের ছবি তোলার জন্য একটি নির্জন কক্ষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। আমিও গেলাম। সেখানে একজন একজন করে আসামির ছবি তোলা হচ্ছে। একসময় আমার ছবিও তোলা হলো। যিনি ছবি তুলছিলেন, তিনি আমাকে মুখটা সোজা আমি করে দেবার ছল করে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, আপনাকে চিনি। আমি বাংলা একাডেমীতে আপনার কবিতা আবৃত্তি শুনেছি। আপনার এই ছবির একটি কপি আমি আমার কাছে রেখে দেবো। পরে আপনাকে দেবো। আমার শুনে খুব ভালো লাগলো। বললাম, যদি বাঁচি তবে তো। আমাকে ওরা কোথায় নিয়ে যাবে, আপনি কি কিছু অনুমান করতে পারেন?

তিনি আমার সঙ্গে বেশি কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। পুলিশ তাকে তাড়া দিচ্ছিল। তিনি দ্রুত ক্লিক ক্লিক করে পরপর আমার দুটো ছবি তুললেন। যাবার সময় আমি ঐ আলোকচিত্রশিল্পীকে বললাম, ভাই, আমি যদি আর না থাকি, তবে আমার এই শেষ-ছবিটা আপনি আমার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেবেন। কবি মহাদেব সাহার কাছে পৌঁছে দিলেও চলবে। তিনি বললেন, আপনি ভাববেন না। আমি যতটা পারি মানুষজনকে আপনার খবর জানিয়ে দেবো।

ছবি তোলার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একজন হাকিমের এজলাশে। সেখানে পুলিশ আমাকে তিন দিনের রিমাণ্ড চাইলে, মাননীয় হাকিম পুলিশের দাবি মেনে নিয়ে আমাকে রমনা থানার হাজতে ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন। তিনি আমাকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেনও না। আমি ভাবছিলাম, আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠালেই ভালো হয়। তাতে আর্মি এসে আমাকে সহজে নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু তা আর হলো না। আমি একটা বড় রকমের মারের অপেক্ষা নিয়ে রমনা থানায় ফিরে গেলাম।

১১ তারিখের রাতে একজন অপরিচিত যুবক আমার আর্মির হাতে এ্যারেষ্ট হওয়ার খবরটি মহাদেবের বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। মহাদেব তখন বাসায় ছিল না। সে গিয়েছিল পিজিতে। হাসানের কাছে। হাসানের কাছ থেকে বাসায় ফিরে এসেই মহাদেব নীলার কাছে আমার আর্মির হাতে এ্যারেস্টের খবরটি পায়। নীলার কাছে শুনেছি, মহাদেব ঐ খবর পেয়ে ছোটদের মতোই অঝোরে কাঁদতে শুরু করেছিল। মহাদেব, মনে হয় ঐ রাতেই আমার জন্য বরাদ্দ ওর কান্নাটুকু কেঁদে শেষ করে ফেলে থাকবে। তখন দশটার পর ঢাকায় কার্য্য শুরু হয়ে যেতো। হাতে ঘণ্টাখানেকের চেয়ে কম সময়। এর মধ্যেই মহাদেব বাইরে বেরুবার জন্য যখন তৈরি হলো, তখন মহাদেবকে বিরত করতে না পেরে ওর বাসার মালিকের (ক্যাপ্টেন রব সাহেব, তিনি একজন মুসলিম লীগার ছিলেন) ছেলে হাবিব মহাদেবের নিরাপত্তার কথা ভেবে তার সাথে যায়। ঐ রাতেই মহাদেব আমাদের কবি-বন্ধুদের দু’একজনের বাসায় গিয়ে আমার বিষয়টি নিয়ে কথা বলে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে খুব ভালো সাড়া পাওয়া যায় না। আমার খবর পেয়ে তারা খুবই ভয় পেয়ে যায়। ভাবে, আমার কেসটি নিয়ে মুভ করতে গেলে হয়তো নিজেদেরই বিপদ হতে পারে। আমি এজন্য আমার বন্ধুদের খুব একটা দোষ দিই না, কেননা, তখনকার পরিস্থিতিটা আজকের দিনের আলোকে ঠিক বোঝা যাবে না। মহাদেব কার্য্যর মধ্যে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাসায় ফিরে আসে মহাদেব ভেবেছিল, রাতের মধ্যে যদি আমাকে প্রয়োজনীয় প্রোটেকশন দেয়া না যায়, তবে হয়তো আর সময় না-ও পাওয়া যেতে পারে। তাই সে খুবই বিচলিত হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো কার্য্যর মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিল- কিছু একটা করার আশায়। কিন্তু পারেনি। আমি বুঝতে পারি, ঐ কিছু করতে না পারার ব্যথা মহাদেবকে কতটা কষ্ট দিয়েছিল সেদিন।

পরদিন তরুণ কবি মোস্তফা মীর এবং আমার ছোট ভাই শৈবালেন্দু (তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো) লোকমুখে ছড়িয়ে-পড়া আমার গ্রেফতার হওয়ার খবর পেয়ে মহাদেবের বাসায় আসে এবং মহাদেবের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়। তাতে মহাদেব এবং আমার বল বাড়ে। মহাদেব তরুণ কবি মোস্তফা মীর ও আমার ছোট ভাই শৈবালেন্দুকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে মুক্ত করার জন্য সাহায্য চাইতে দৈনিক বাংলায় যায়। সেখানে আমাদের বড়-কবি ও বড়-সাংবাদিক কাজ করেন। কবি শামসুর রাহমান, কবি আহসান হাবীব, কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ুন, শ্রী নির্মল সেন – এঁদের সঙ্গে আমার ব্যাপারে মহাদেবের কথা হয়। তাঁদের কাছে মহাদেব আমার মুক্তি চেয়ে একটি বিবৃতি প্রদানের অনুরোধ করে। তাঁরা আমার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে রাজি হলেও কিছু বলতে রাজি হননি। আমার জন্য কিছু করা তো দূরে থাক, আমার বিষয়টি নিয়ে নিজের ওপর ঝুঁকি না বাড়িয়ে বাসায় ফিরে যাবার জন্যই সেদিন তাঁরা মহাদেবকে পরামর্শ দিয়ে বিদায় করেছিলেন। মহাদেব অবশ্য সেদিন তাঁদের প্রদত্ত ঐ পরামর্শটি মেনে চলেনি।

১১ তারিখ রাতে, মহাদেবকে বাসায় না পেয়ে ঐ অচেনা যুবকটি পিজি হাসপাতালে গিয়ে আবুল হাসানকে আমার এ্যারেস্ট হওয়ার খবর জানায়। তাকে দেখতে গিয়ে আমার আর্মির হাতে এ্যারেস্ট হওয়ার কথা শুনে আবুল হাসান খুবই ব্যথিত হয়। মহাদেব এবং আবুল হাসানের চিঠি পেয়ে আমি যে ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম— এটি পৃথক-পৃথকভাবে হাসান এবং মহাদেব, দু’জনের মধ্যেই এক ধরনের গিল্টি ফিলিং তৈরি করেছিল। সুস্থ থাকার কারণে, এবং পরবর্তি টার্গেট হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকার ভয়ে, সর্বোপরি বন্ধুত্বের টানেই মহাদেব আমাকে মুক্ত করার জন্য জীবনপণ করে মাঠে নেমেছিল, কিন্তু নীরবে উদ্বিগ্ন বোধ করা এবং হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে শুয়ে পরমকরুণাময়ের কাছে আমার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া, আবুল হাসানের পক্ষে আর কিছুই করার ছিল না। কে ছিলো ঐ অচেনা যুবক? আজ পর্যন্ত আমরা তার কোনো হদিস পাইনি।

আমার ব্যাপারে পুলিশের সঙ্গে আর্মির কোনোরূপ যোগাযোগ হয়েছে কি-না, তা জানতে চাইলে পুলিশ না-সূচক জবাব দেয়। সরকারের নানাধরনের গোপন এজেন্সি থাকে। আমার কেসটি ডিল করার জন্য কোন্ এজেন্সিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে রমনা থানা কর্তৃপক্ষ আমার ব্যাপারে যে নির্বিকার ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমি সময় কাটাতে বাধ্য হচ্ছিলাম। আমার যেমন স্বভাব, আমার ইচ্ছার বাইরে আমি একটি মুহূর্তও কাটাতে পারি না। আর এখন? আমার স্বাধীন—সার্বভৌম কবি- চিত্তের ওপর অস্ত্রের জোরে চাপিয়ে দেয়া এই নিষ্ঠুর অবদমন, কী অসহ্য! অথচ মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া, এ-মুহূর্তে আমার কিছুই করার নেই। কিচ্ছু করার নেই, এমন কি এরা যদি আমাকে মেরেও ফেলে, তবুও। সুতরাং আমাকে যে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, ভাবলাম এটাই আমার লাভ। বর্বরতা যখন রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন রাষ্ট্রজীবন থেকে ন্যায়-নীতি আইন-কানুনসহ যাবতীয় মূল্যবোধই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ এখন সেরকমই একটা প্রচণ্ড দুঃসময় অতিক্রম করছে। অনেকের মতো আমিও সেই দুঃসময়ের শিকার। এ নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই। দুঃখজয়ের শক্তি অর্জন করাটাই এখন আমার কাজ।

দ্রুতই আর্মির হাতে আমার গ্রেফতার হওয়ার খবরটি ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তাতে আমাকে বিনাবিচারে, গোপনে গায়েব করে দেয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। আমিও কিছুটা স্বস্তিবোধ করি। আমাকে কেন কোর্ট থেকে রিমাণ্ডে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে, সারাদিন তার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলো না। আমার সম্পর্কে পুলিশের রহস্যজনক নীরবতা সারাদিনই বজায় থাকলো।

সন্ধ্যার দিকে, মাগরিবের আজানের পর, বেশ ক’জন সিভিল পোশাক পরা গোয়েন্দা কর্মকর্তা রমনা থানায় আসেন। তাদের নির্দেশমতোই আমাকে হাজতের গেট খুলে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ধারণা করি, কর্নেল সাহেবের নির্দেশেই ঐ গোয়েন্দারা আমার সম্পর্কে তদন্ত করতে এসেছে। আমাকে হাজত থেকে বাইরে নিয়ে যাবার সময় একজন সহআসামি আমার হাতে একটি ট্যাবলেট গুঁজে দিলো। বললো, দাদা পুলিশকে বিশ্বাস নেই। এর এখন মুখে যত ভালো কথাই বলুক না কেন, কখন যে টর্চার করতে শুরু করবে বলা যায় না। এই ট্যাবলেটটি সঙ্গে রাখুন। আন্তরিকতার স্পর্শযুক্ত ঐ ট্যাবলেটটি সাদরে গ্রহণ করে আমি অজানার উদ্দেশ্যে হাজতের বাইরে পা রাখি ভগবান জানেন, আমাকে এখন কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে।

হাজতে যেসব আসামিকে ধরে আনা হতো— আমি গত দু’দিন ধরে দেখছি, পুলিশ তাদের একেকজনকে একেক সময় ধরে বাইরে নিয়ে যায় ইন্টারোগেট করার জন্য। পুলিশের ইন্টারোগেট মানে খুবই কঠিন ব্যাপার। পুলিশের কাছে টর্চার হচ্ছে ইন্টারোগেটের সুফল লাভের বিশ্বস্ত উপায়। বিশেষ করে রাতের দিকেই ঐ টর্চার-কর্মটি চলতো। কিল-ঘুষি, লাথি-চড়-থাপ্পড় ছাড়াও আরও বিভিন্ন উপায়ে আসামিদের টর্চার করা হতো। আসামিদের আর্ত-চিৎকারে থানার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠতো। যখন আসামিটি মার খেতে খেতে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার উপক্রম হতো, তখন পুলিশরা একটি মৃতদেহকে চ্যাংদোলা করে ধরে আনার মতো করে আসামিটিকে নিয়ে এসে হাজতের ভিতরে শুইয়ে দিয়ে চলে যেতো। তখন অত্যাচারিতের দেহের ভিতরে এখন ও যে প্রাণটুকু অবশিষ্ট আছে, তার প্রমাণ পেতে আমাকে বেশকিছুক্ষণ উদ্বেগের সঙ্গেই অপেক্ষা করতে হতো। আমি খুবই ভয় পেয়ে যেতাম। মনে হতো লোকটি হয়তো আর বাঁচবে না। পরে মানুষের বেঁচে থাকার শক্তিও যে বই অসীম— তাও লক্ষ্য করতাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখতাম ঐ মৃত্যুপথযাত্রীটির জ্ঞান ফিরে এসেছে এবং আমাদের দিকে তাকিয়ে জলের জন্য ইঙ্গিত করছে। তখন তার মুখে জল ঢেলে দিতো অন্য আসামিরা। সঙ্গে ঐ পেইনকিলার ট্যাবলেট। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ও মারামারি-হানাহানির অপরাধে ধৃত আসামিরাই শংকার মধ্যে থাকতো বেশি। পলিটিক্যাল আসামিরা সেইদিক থেকে কিছুটা দুর্ভাবনামুক্ত ছিল। কর্নেল সাহেবের দয়ায় আমি কম বেশি পলিটিক্যাল আসামির মর্যাদাই ভোগ করছিলাম। আমাকে চোর-ডাকাতের মতো ট্রিট করা হচ্ছিল না। ১৮ নভেম্বরের জনসভার প্রচারকার্যে নিয়োজিত জাসদের ছাত্র-কর্মীদেরও পুলিশ টর্চার করেছিল বলে আমার মনে পড়ে না। খুব সম্ভবত ১২ তারিখেই ওরা কোর্ট থেকেই জামিনে মুক্ত পেয়ে চলে গিয়েছিল অথরা ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত হয়েছিল। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। ১২ তারিখ থেকে রমনা থানার হাজতে কিছুটা পলিটিক্যাল চাট যুক্ত আসামি বলতে ছিলাম আমি একাই। অন্য সব আসামিরা ছিল চুরি-ডাকাতি, মরামারি, ছিনতাই, খুন এইসব অভিযোগে ধৃত। লালশালু পরা, হাতে লোহার কয়ড়া লাগানো ঢাকা হাইকোর্টের বটবৃক্ষতলবাসী গঞ্জিকাসেবীরাও জামিনে মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল। তাই বলে হাজতটি ফাঁকা হয়ে যায়নি। বড় নগরীর থানার হাজত কখনও ফাঁকা থাকে না। এ হচ্ছে লক্ষ্মীর ঝোলা। ভরাই থাকে। আর হাজত ভরা থাকলে, কে না জানে যে, তাতে দেশের লাভ, উকিলদের লাভ এবং পুলিশের লাভ।

পুলিশের অভয় সত্ত্বেও আমি মানসিকভাবে পুলিশের কঠিন- ইন্টারোগেশনের মুখোমুখি হবার জন্য মনে-মনে তৈরি হয়েছিলাম। আমাকে দোতলায় একটি ঘরের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো। পকেটে রাখা পেনইকিলার ট্যাবলেটে হাত রেখে আমি গিয়ে বসলাম গোয়েন্দাদের মুখোমুখি একটি চেয়ারে। আমাকে ঘিরে পাঁচ ছয় জন আইবির লোক। আমি স্থির করেই রেখেছিলাম, আমি একটি বর্ণও মিথ্যা বলবো না। আমি আমার ব্যাপারে যা সত্য তাই বলবো। কোনো তথ্য গোপন করবো না। তাতে যা হবার হবে। আমার মনে হয়েছিলো, মিথ্যা পরিচয়ে বাঁচার চাইতে সত্যপরিচয়ে মরাটাও আমার জন্য উত্তম হবে। আর আগেই বলেছি, আমি কোথা থেকে, কোন দূরের ভুবন থেকে যেন সাহস পাচ্ছিলাম। আমার মরণের ভয় আর ছিল না। আমি হাজতের ভিতরে এককোণে বসে পাহারারত সেন্ট্রি-পুলিশের বুলেটবেল্টের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। পুলিশ বলতো, কী দেখেন, কবি সাব? আমি বলতাম, দেখছি আপনার কোমরের বুলেটগুলো। আপনি কোমরে বহন করছেন বলে ভাবছেন— এগুলো আপনার। আপনি এগুলোর আসল মালিক নন। আপনি হচ্ছেন বাহক। পুলিশ ঠিক বুঝে উঠতে পারতো না আমার রসিকতাটা। বলতো, তার মানে? তখন আমি রহস্যভেদ করার মতো করে বললাম, জীবনের বিনিময়ে এই বুলেটগুলোকে যারা দেহে ধারণ করবে, বুলেট হচ্ছে তাদেরই।

আমার ঐ কথা বলার পর হাজতচত্বরে এক ধরনের নিস্তব্ধতা নেমে আসতো।

গোয়েন্দা পুলিশরা, তাই আমাকে যতটা অপ্রস্তুতভাবে পাবে বলে ভেবেছিল, ততটা অপ্রস্তুত অবস্থায় তারা আমাকে পেলো না। প্রশ্নের ধরণ শুনেই আমি বুঝতে পারলাম, এটি একেবারেই পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক। আমার বাবা-কাকারা এরকম প্রশ্নের উত্তর বিগত পাকিস্তান আমল থেকেই দিয়ে আসছেন। দেশটা যে আবার পাকিস্তানের পথে এগিয়ে চলতে শুরু করবে— তাদের প্রশ্নের মধ্যে আমি তারই আভাস পেলাম। আমাকে তারা ১৯৭১-এ আমার অবস্থান ও ভূমিকা থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত আমার অবস্থান, আমার প্রতিক্রিয়া জানবার জন্য যতরকম প্রশ্ন করা হতে পারে, তাই করলো। আমি প্রতিটি প্রশ্নের দ্রুত উত্তর দিলাম। তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার বরং ভালো লাগছিল এই ভেবে যে, আমি মন খুলে আমার সকল দুঃখ-বেদনার কথা বাংলাদেশ সরকারের পুলিশদের জানাতে পারছি। এবং তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমার বলা কথাগুলো সরকারি নথিপত্রে লিপিবদ্ধ করছেন। আমি যে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেল হত্যার ঘটনায় খুবই ব্যথিত হয়েছি, আমি যে পাগল হয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলাম, তা বললাম। ভারতে যে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনরা রয়েছেন তাও জানালাম। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ট সম্পর্কের কথাও আমি সানন্দেই স্বীকার করলাম।

একজন গোয়েন্দা বললেন, ১৫ আগস্টের পর আপনাকে মোহাম্মদপুর এলাকায় কাদের সিদ্দিকীর জিপে উঠতে দেখা গেছে। সত্য?

আমি বললাম, না, কথাটা সত্য নয়। আমি একটু জোরের সঙ্গেই বললাম, ভাই ১৫ আগস্টের পর আমার সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর যদি দেখা হতো, তবে আমি কি আর এখানে থাকি? সে-ও আমাকে নিশ্চয়ই ঢাকায় রেখে যেতো না।

আপনি কি তবে ১৫ আগস্টের পর গ্রামের বাড়িতে যাবার নাম করে অন্য কোথাও গিয়েছিলেন?

বুঝলাম ওরা আমাকে সীমান্তের ওপারে কাদের বাহিনীতে পাঠাতে চাইছেন।

আমি বললাম, না ভাই, আমি পুরো সময়টা আমার গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। আপনারা তদন্ত করে দেখতে পারেন। আমি একটু ভীতু ধরনের মানুষ। আমার সাহস কম। আমি অস্ত্র হাতে নিতে ভয় পাই। ১৯৭১- এও আমি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি।

আপনি খালেদ মোশাররফকে চিনতেন?

একদিন খুব অল্পসময়ের জন্য তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। খুব সামান্যই কথা হয়েছে। কুশল বিনিময়। এটাকে ঠিক চেনা বলা যাবে না।

তার জন্য আপনার দুঃখ হয়?

আমি বললাম, হয়। প্রতিটি অকাল ও অপঘাত মৃত্যুর জন্যই আমার দুঃখ হয়।

আপনার এক বন্ধু নাকি পিজিতে অসুস্থ। ঠিক তো? কী যেন নাম তার?

আবুল হাসান। পিজিতে খোঁজ করলেই জানতে পারবেন। তিনি খুবই অসুস্থ।

তাঁকে দেখার জন্যই আপনি পিজিতে গিয়েছিলেন, নাকি অন্যকিছু? অন্যকিছু হতে যাবে কেন? আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন।

জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠে আমি যে একসময় কাজ করেছি এবং জাসদের নেতাদের সঙ্গে আমার যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, সে প্রসঙ্গেও তারা জানতে চাইলো।

আমি বললাম, এদের সবাই আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত

কর্নেল তাহেরকে চেনেন?

আমি বললাম, নেত্রকোনার লোক হলেও কর্নেল তাহেরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। আমি তাকে নামেই শুধু জানি।

গণকণ্ঠ পত্রিকায় কী করতেন আপনি?

আমি বললাম, আমি সম্পাদকীয় লিখতাম। একটি রাজনৈতিক কলামও লিখেছি। সরকারী আমল। এবং আওয়ামী লীগের কিছু-কিছু নেতা-কর্মীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমি ঐ পত্রিকায় লিখেছি। কিন্তু তাই বলে আমি কখনও জাসদের রাজনীতির সমর্থক ছিলাম না। তাদের সঙ্গে আমার বনিবনা হয়নি। গণকণ্ঠে যোগ দেবার সময় আল মাহমুদ চার- নীতির পক্ষে প্রচার চালাবে। বঙ্গবন্ধু ঐ শর্তেই কাগজটির দায়িত্ব রব- সিরাজ-আল মাহমুদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঐ কাগজে যোগদানে আমারে প্রলুব্ধ করার জন্য আল মাহমুদ আমাকে ঐ কথাই বলেছিলেন জাসদের কথা তখন আসেনি। রব-জলিলের নেতৃত্বে জাসদ গঠিত হওয়ার পর ঐ কাগজটি জাসদের কাগজে পরিণত হয়। আমি জাসদের পক্ষে লিখতে অস্বীকার করায় আল মাহমুদের সঙ্গে আমার বিরোধ হয়। তোহা ভাইয়ের সঙ্গে আল মাহমুদের বিরোধ হয়। তখন ঐ প্রবীণ সাংবাদিক তোহা ভাই (মরহুম তোহা খান)-এর সঙ্গে একাত্মতা প্রবেশ করে আমিও গণকণ্ঠের চাকুরি ছেড়ে দিই।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন