নির্মলেন্দু গুণ
গণকণ্ঠ ত্যাগ করার পর সাংবাদিক বজলুর রহমানের আহ্বানে আমি কিছুদিনের জন্য সংবাদ-এ যোগ দিই। এক বছরের মাথায় সংবাদ থেকেও আমার চাকুরি চলে যায়। তারপর লেখক-সাংবাদিক রাহাত খানের আহ্বানে আমি কিছুদিন অন টেস্ট বেসিসে উত্তেফাকে লিখেছিলাম। মঈনুল হোসেনের মন জয় করতে পারিনি, তাই চলে আসি। তারপর আর কোনো কাগজে যাইনি। আমি বুঝতে পারি, আমি ঠিক সাংবাদিক নই। অনেকদিন বেকার থাকার পর আমি রেজা আলী ও রামেন্দু মজুমদার পরিচালিত বিটপী এ্যাডভার্টাইজিং ফার্মে কপিরাইটিংয়ের কাজ পাই। সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারি না। অফিসের অনুমতি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যাওয়ার অভিযোগে ১৫ আগস্টের কিছুদিন আগে আমার ঐ চাকরিটিও চলে যায়। এরপর থেকে আমি বেকারই ছিলাম। ১৫ আগস্টের পর আমার গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে ওটাও একটা কারণ ছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমি তো একলাই। চাকরি হারানোর ভয় আমার আর ছিল না।
আমার ঘণ্টা-দুয়েক স্থায়ী জবানবন্দিটি বেশ কয়েকজন মিলে লিপিবদ্ধ করেন। তারা আমার কথায় ও তাদের উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর শুনে খুব মজা পাচ্ছিল বলেই মনে হয়। ফলে একজন বুড়োমতো মানুষ, মুখে শাদা দাড়ি, আমাকে প্রশংসা করে বলেছিলেন, কবি সাহেব, আপনি খুবই সাহসী এবং সত্যবাদী। আপনি একজন ভালো মানুষ।
আমি বললাম, আমি সত্যবাদী এবং ভালো মানুষও, কিন্তু সাহসী না।
তিনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, সত্যবাদী আর সাহসীতে তফাৎ খুবই কম।
আমি বললাম, কী জানি হতে পারে।
ইন্টারোগেশনের এক পর্যায়ে আমাকে একবার চা পরিবেশন করা হলো। আমার সঙ্গে তারাও চা-পান-সিগারেট খেলেন। আমাকেও তারা তাদের সামনে সেদিন সিগারেট খেতে দিয়েছিলেন। আর তখনই পকেট থেকে সিগারেট বের করতে গিয়ে ঐ ট্যাবলেটটির গায়ে হাত পড়েছিলো আমার। আমি তখন একটু হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি এভাবেই আমাকে ইন্টারগেট করবেন? আমাকে মারধোর করবেন না?
আমার কথা শুনে ওরা একটু লজ্জা পেলেন। বললেন, না ভাই। কর্নেল সাহেব তো আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করতে লিখিত নির্দেশ দিয়ে গেছেন। উনিও খুব ভালো মানুষ। তা ছাড়া আপনি তো আর সত্য আড়াল করছেন না। সাহসের সঙ্গে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য কথা বলছেন। সত্য জানার জন্য আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার তো কোনো প্রয়োজন নেই।
একজন জানতে চাইলেন, আপনার কি হাজতে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে?
আমি বললাম, না তেমন কিছু নয়। কষ্ট হয় যখন হাজতের অন্য আসামিদের পুলিশ অমানুষিকভাবে অত্যাচার করে। ওদের আর্তচিৎকার শুনে আমার খুব কষ্ট হয়।
কী করা যাবে বলেন, ওরা তো আর আপনার মতো সত্য কথা বলে না। ওরা হচ্ছে ক্রিমিন্যাল
আমি ক্রিমিন্যাল নই;— পুলিশের কাছ থেকে এই স্বীকৃতিটুকু লাভ করার লজ্জায় আমি মাথা নিচু করে থাকি। বলি, এটা একটা সমস্যাই বটে। মানুষ যে কবে সত্য বলার সাহস অর্জন করবে। তবে একথাও তো ঠিক যে, পুলিশরা অনেক সময়ই অর্থের লোভে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেয়। কনফেশন করার জন্য ক্রিশ্চিয়ান পাদ্রীরা যতটা নির্ভরযোগ্য, সত্য ভাষণের জন্য পুলিশ কি ততটা নির্ভরযোগ্য?
আমার ঐ কথার কোনো জবাব না দিয়েই ওরা আমায় খুশিমনে বিদায় জানায়। বলে, আমরা চাই আপনি মুক্তি পান। তবে আমাদের ইচ্ছাটাই তো শেষ কথা নয়। আর সবকিছুই নির্ভর করবে ঐ কর্নেল সাহেবের ওপর। একজন আমার কানের খুব কাছে এসে আমাকে জানায়, আমাদের হাতে ক্ষমতা থাকলে আমরা আপনাকে এখনই মুক্তি দিতে পারতাম। কিন্তু ঐরূপ ক্ষমতা তাদের ছিল না।
বাংলাদেশকে স্থলপথে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে ভারত। আমাদের দক্ষিণে সমুদ্র। সমুদ্রপথেও ভারতেরই দাপট। ঐরকমের একটি বিশাল দেশের প্রতি আমাদের মতো ছোট একটি দেশের দৃষ্টিভঙ্গি কীরকম হওয়া উচিত, এই প্রশ্নে বাংলাদেশের অভিভাবক শ্রেণীর রাজনীতিবিদরা দুটো স্পষ্ট ধারায় ভাগ হয়ে যান। একদল মনে করতে থাকেন— শক্তিশালী ভারতের সঙ্গে আমাদের সৎ-প্রতিবেশীসূলভ সুসম্পর্ক থাকাই ভালো। তাতে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হবে। চীনের কাছে ১৯৬২-র যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ভূখণ্ড হারানোর তিক্ত অভিজ্ঞতা ও পাকিস্তানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত একাধিক যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় রেখে ভারত বিগত বছরগুলোতে তার সামরিক শক্তিকে যেভাবে বাড়িয়ে তুলেছে এবং তুলে চলেছে—, তার সঙ্গে যদি পাল্লা দিয়ে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার চিন্তা করতে হয়, তা হবে আমাদের মতো একটি ছোট দরিদ্র দেশের জন্য খুবই আত্মঘাতী, অবাস্তব এবং অসম্ভব ব্যাপার। ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার তালিকায় পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের নাম লেখানোর বিপদ কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা অনুভব করে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যাণ্ড। অর্থাৎ যুদ্ধ নয়, শান্তি। সংঘর্ষ নয়, সম্প্রীতিই হবে বাংলাদেশের পথ। ভারতের সঙ্গে কুসম্পর্ক বজায় রেখে চলাটা যে ভালো নয়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান খুব চড়া মূল্য দিয়ে তা অনুভব করেছে। তাই আমাদের সঙ্গে বৈরি আচরণ করার সুযোগ আমরা ভারতকে দিতে পারি না। ভারতকে বন্ধুত্বের বন্ধনে বেঁধে রাখাটাই হবে আমাদের কাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ঐ ধারার জনপ্রিয় নেতা। বাংলাদেশটিকে তিনি ‘মুসলিম বাংলা” বলে মনে করতেন না। মুসলমানদের পাশাপাশি বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী হিন্দু- বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়কেও তিনি সর্বদা বিবেচনায় রেখে চিন্তা- ভাবনা করতেন, কথা-বার্তা বলতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতি হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের মিলিত বিশ্বাস, শ্রম ও ভালোবাসার ফসল। সংস্কৃতির মূলধারাটি অবশ্যই সর্বকালে সর্বদেশে তার বৃহত্তর জনগোষ্ঠিরই ধর্মাশ্রয়ী হয়; খণ্ডিত বাংলার পূর্বপটের সংস্কৃতির মূল ধারাটি তাই বলা বাহুল্য, ইসলামধর্ম নির্ভর কিন্তু তাই বলে ইসলামী সংস্কৃতির চারপাশে ব্যারিকেড দিয়ে তাকে অন্যধর্মনির্ভর সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিত হবার পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে, না দিলে ইসলামী সংস্কৃতি বিকশিত হবে না, ইসলাম চলে যাবে- ইসলামকে তিনি অতটা ঠুনকো কিছু বলে ভাবতেন না। মরু অঞ্চলের পোশাক পরে মুসলমান সাজার প্রয়োজন আছে বলেও তিনি মনে করতেন না।
এই ধারার বিপরীতে, মুসলিম-বাংলার ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ধারার অনুসারীরা মনে করতেন, ভারতের পথ আমাদের পথ হতে পারে না। ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার কথা মুখে যতই বলুক না কেন, মাঝে মাঝে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্য থেকে লোক- দেখানো রাষ্ট্রপতি বা বিমানবাহিনী প্রধান বা রাষ্ট্রসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি তারা যতই নিয়োগ করুন না কেন- এটি হচ্ছে পলিটিক্স। ভারত আসলে একটি ছদ্মবেশী হিন্দুরাষ্ট্র ছাড়া কিছু নয়। ‘হিন্দুস্থানই এর যথার্থ নাম। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বলাটা যে একইসঙ্গে ভারতে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক মুসলমান এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী তার চেয়ে কিছু কম অমুসলমানদের জন্য অপমানজনক, এ দিকটা, তাদের ধর্মান্ধ চোখে ধরা পড়তো না। তারা মনে করতেন, ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র প্রমাণ করতে পারলে বাংলাদেশকে আর কষ্ট করে ‘মুসলিম বাংলা’ প্রমাণ করতে হবে না। অটোমেটিক্যালি তা প্রমাণিত হয়ে যাবে। সন্দেহ জাগে, ভারতকে হিন্দুর হাতে সঁপে দিয়ে তারা কি বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে এখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘুর সম্পদলুণ্ঠনকর্মটিকে সহজ করতে চাইতেন? তারা ভাবতেন ভারত সবসময়ই বাংলাদেশকে শোষণ করার তালে থাকবে এবং আমাদের সঙ্গে বড় ভাই সুলভ আচরণ করবে। তাকে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস করা যায় না। ভারতকে শক্তির মাধ্যমে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আমাদের থাকা দরকার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও, ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আমাদের উচিত মুসলিম উম্মার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা। ভারতকে চাপের মধ্যে রাখার জন্য একদলশাসিত, নাস্তিকের দেশ কমিউনিষ্ট চীনের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নতি করা দরকার। পাকিস্তানের মতোই। ১৯৭১ সালে এদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। আবার কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেনও। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন ঐ ধারার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তিনি খুব চমৎকার ভাষায় সাম্প্রদায়িক চুলকানিযুক্ত ভারতবিরোধী বক্তব্য প্রদান করতে পারতেন। তিনি বলতেন, ওপার থেকে দলবেঁধে ‘ধুতি পরে আসা হিন্দুরা’ সব লুটেপুটে খেয়ে যাচ্ছে। ঐ সুনির্বাচিত চিত্রকল্পটির বদৌলতে ধুতি পরে আসার ভারতীয় হিন্দুরা উপদ্রবকারী বুনো হাতিতে পরিণত হতো। ভারত থেকে আসা ঐসব হিন্দুরা যে বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দুদের পরমাত্মীয়স্বজনও বটে— ভাসানী সাহেব জেনেও তা না জানার ভান করতেন। ধৃতি নামক পরিধেয়টির প্রতি বিদ্রুপ প্রদর্শন করাটাও ছিল। খুবই আপত্তিজনক। মিত্রবাহিনী হিসেবে আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেবার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে তিনি বলতেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে আমাদের হাজার-হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। সেকারণেই বাংলাদেশের এই দুর্দশা। বাংলাদেশে ঢোকার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য লুটপাটে বা অন্যবিধ অপকর্মে কখনও অংশগ্রহণ করেনি— তা এমনকি ভারতও বলবে না। মিলিটারিরা, তা সে যে দেশেরই হোক, মিশনের পাদ্রী বা মঠের ভিক্ষু নয়, দেশে ফিরে যাবার পর, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের অপকর্মের অভিযোগে সামরিক আদালতে বিচার হয়েছিল বলেও শুনেছিলাম। এর মধ্যে লুটতরাজ ও নারী ধর্ষণে অংশ নেয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেও শুনেছি। কিন্তু ভাসানী সাহেবের কথামতো, লুটতরাজ করার জন্যই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঢুকেছিল, লুটতরাজ ও নারী ধর্ষণ ছাড়া তার পেছনে অন্য
কোনো মহৎ প্রেরণা বিদ্যমান ছিল না— এমন মিথ্যা ধারণা বিতরণকারীকে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না। ১৯৭১-এ বাংলাদেশকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার জন্য কম করেও বারো হাজার ভারতীয় সেনা প্রাণ দিয়েছিল। ওঁরা হিন্দুস্তানী ছিল বলেই কি ভাসানী সাহেব তাঁদের প্রাণকে এতো তুচ্ছ বলে মনে করতেন? না, এটা খুবই অন্যায় কথা।
৭১-পরবর্তি বাংলাদেশে মওলানা ভাসানী সাহেবই ‘প্রগতিশীল সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিয়েছিলেন। ঐ প্রগতিশীল সাম্প্রদায়িকতাকে সেদিন শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকার। তার কুফলও তিনি ভোগ করেছেন জীবন দিয়ে, মৃত্যু-অন্তে। ১৫ আগস্টের মতো নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বা ৩ নভেম্বরের জেল-হত্যার মতো বর্বর ঘটনা ঘটে যাবার পরও মওলানা ভাসানী ঐরূপ অপকর্মের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করেননি। তাঁর রহস্যময় নীরবতা বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার খুনিদের অপকর্মকেই সমর্থন যুগিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় মওলানা ভাসানীকে যথেষ্ট ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। বঙ্গবন্ধুর একটি মস্ত ভুল ধারণা ছিল যে, মওলানা সাহেব তাঁকে পুত্রবৎ স্নেহ করেন। তাঁকে মওলানা সাহেব ভালোবাসেন। কিন্তু আমার তা কখনও সত্য বলে মনে হতো না। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার পর, ঐ কথিত রাজনৈতিক পুত্রের রুহের মাগফেরাত পর্যন্ত কামনা করেননি— তাতে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে আমার ধারণটিই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। এবং সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হওয়াতে আমি খুশি হই।
৭ নভেম্বরে ‘সিপাহী বিপ্লবের’ মাধ্যমে খুনি-মেঘের আড়াল ভেদ করে যখন লুকানো সূর্য উঁকি দেয়, তখন, দীর্ঘ নীরবতার পর আমরা আবার মওলানা সাহেবকে বিবৃতি নিয়ে দেশবাসীর সামনে হাজির হতে দেখি। ১২ নভেম্বর এক দীর্ঘ বিবৃতির মাধ্যমে ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে ৭ নভেম্বরের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নতুন শক্তিকে আশীর্বাদ করেন এবং দেশবাসীকে আধিপত্যবাদীদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তাঁর ঐ আশীর্বাদী বিবৃতিটি পরদিনের সরকারী পত্রিকা দৈনিক বাংলার প্রথম পাতাজুড়ে ফলাও করে প্রকাশিত হয়। তাতে আমি মোটেও অবাক হই না। আমি অবাক হই, যখন দেখি যে, মওলানা ভাসানী তাঁর বাসস পরিবেশিত ঐ বিবৃতিতে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে হোক— ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র রাষ্ট্রীয় আদর্শটিকে সমর্থন করেছেন।
ঐ বিবৃতিতে তিনি বলেন,… ‘বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মর্যাদার সঙ্গে এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বেঁচে থাকবে।’
[সূত্র : দৈনিক বাংলা, ১৩ নভেম্বর ১৯৭৫]
যারা মওলানা ভাসানীর ভক্ত, অনুসারী—; যারা ভাসানীকে স্বাধীনতার স্থপতি বলে মনে করেন; প্রকারান্তরে তাঁকে যারা জাতির পিতা বলে খুশি হতে চান, ভেবে পাই না, পরবর্তিকালে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে বিসর্জন দিয়ে তারা কীভাবে মওলানা ভাসানীকে অপমান করতে পারলেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রশ্নটি নিয়ে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে মওলানা ভাসানীর বিরোধ হয়েছিল, —এমন কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। ভাসানী যদি ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিকে সত্যিই ‘মিন’ করে থাকেন, তাহলে তো জেনারেল জিয়ার সঙ্গে তাঁর কোনো এক পর্যায়ে বিরোধ হবারই কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। কেন হয়নি? এটা খুবই রহস্যজনক।
আমি যখন রমনা থানার হাজতের ভিতরের নিশ্চলতায় বন্দি ছিলাম, তখন বাইরের পরিস্থিতি ছিল খুবই গতিচঞ্চল। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরকে পেছনে ফেলে ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবের মাধ্য নতুন সরকার সবে ক্ষমতায় বসেছে। রাজনীতিবিদদের কনুইয়ের গুঁতোয় হটিয়ে দিয়ে, বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ামক শক্তি হিসেবে অবির্ভূত হয়েছে আমাদের সেনাবাহিনী। সিভিলসমাজ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিয়ে শুরু হয়েছে খাকি পোশাকের দাপট প্রতিষ্ঠার যুগ। সামরিক গণতন্ত্রের রক্তযাত্রা।
সামরিক গণতন্ত্রের ধারণার উদগাতারা চমৎকারভাবে সারা বিশ্বকে, বিশেষভাবে ভারতকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে যে, খোলশের মতো ১৯৭১-এ আমরা পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করেছি বটে, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্র-আদর্শকে আমরা ছাড়িনি। পাকিস্তানই আমাদের পথ। পাকিস্তানই আমাদের আদর্শ। পাকিস্তানের মতোই আমরা চলবো সামরিক রথে। সামরিক শাসনের পথে। এই সামরিক শাসনের রথ ও পথের শেষ কোথায়?—তা কেউ জানে না।
১৪ নভেম্বর পড়ন্ত দুপুরের দিকে এক ভদ্রলোক আসেন আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য। আমি আমার ছোটভাই শৈবালেন্দুর দিয়ে-যাওয়া মহাদেব-পত্নী নীলার রান্না করা সুস্বাদু খাবার সাবাড় করে ভারতীয় পশমী চাদরটিকে মুড়িয়ে বালিশের মতো বানিয়ে মাথার নিচে স্থাপন করতঃ পাথরের খাটে ছাদের দিকে চোখ রেখে আরাম করে শয়ন করেছি। স্যাঁতাপরা হাজতঘরের দেয়াল ও ছাদের ওপর চুইয়ে পড়া জলশিল্পীর আঁকা নানারকমের মূর্ত-বিমূর্ত ছবিতে চোখ রেখে কী যেন ভাবছিলাম। বালি খসে পড়া হাজতের চার দেয়ালের মধ্যে কত মানুষের নাম যে লেখা আছে। সেখানে, একটু চেষ্টা করলেই অজস্র রকমের মুখ কল্পনায় নির্মাণ করা সম্ভব। অনেকদিন পর মনে হচ্ছিল ঘুম আসবে। তখনই সেন্ট্রি এসে হাজির হলো আমাদের হাজত-ঘরের সামনে। বললো, কবি সাহেব আপনার লোক। আমি শোয়া থেকে মেঝের ওপর হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। যে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তাঁকে আমি আগে কোথাও দেখেছি বলে আমার মনে পড়লো না। তাঁর স্বাস্থ্য ভালো। মুখে সুন্দর করে ছাঁটা গোঁফ। গায়ের রঙ কালো। মাথায় চুল একটু কম। কেমন আছো? আমি তাঁর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলাম না। আমি আর্মির গোয়েন্দা বলে ইতোমধ্যেই তাঁকে সন্দেহ করে নিয়েছি। তাই কিছুটা ভয়ে এবং কিছুটা ঘৃণায় আমার মুখ থেকে কোনো কথা বেরুলো না। তিনি বুঝলেন, আমি তাঁকে আস্থার মধ্যে নিচ্ছি না। তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা বললেন, মহাদেব সাহার কথা বললেন। বললেন, আমি সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আছি। আমি একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি। আমার নাম মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন। কবি সিকানদার আবু জাফরের কথাও তিনি বললেন। এতোগুলো প্রিয় নাম শোনার পর তাঁর ওপর আমার কিছুটা আস্থা আসে। আমি দরোজার লোহার শিকের ভিতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে তাঁর সঙ্গে করমর্দন করি। আমার মুক্তির জন্য প্রয়োজনবোধে রাষ্ট্রপতি সায়েম পর্যন্ত যাওয়া যায় কি-না, তা ভেবে দেখার জন্য তাঁকে অনুরোধ করি। আমার ক্ষীণ প্রত্যাশা ছিল, বিচারপতি সায়েম নিয়ে। মোশতাককে হটিয়ে দিয়ে খালেদ মোশাররফ তাঁকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলেন। তিনি খালেদের কোনো উপকারে লাগতে পারেননি। তাঁর মাধ্যমে খালেদের একজন সমর্থক যদি উপকৃত হয়, তবে তা তো তাঁর কিছুটা হলেও ঋণমুক্ত হওয়ার কথা। আমার মন বলছিল, তাঁর কাছে যেতে পারলে কাজ হবে। কিন্তু যাবে কে? সিরাজ ভাই বললেন, আমি দারোগার সঙ্গে আমার পরিচয় দিয়ে কথা বলেছি। তাঁরা তোমার প্রতি সহানুভূতিশীল। তোমাকে শারীরিকভাবে যাতে নির্যাতন করা না হয়, সেজন্য আমি দারোগাকে ওয়াদা করিয়েছি। ভয় নেই। আমি আইজি-র সঙ্গেও কথা বলবো। আমাকে সাহায্য করার আশ্বাস তিনি দিয়ে চলে যান। একজন ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা আমার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় আমি খুবই খুশি হই। আমার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। আমি ভাবতে শুরু করি, আমার মুক্তি খুব দূরে নয়।
সম্প্রতি এই লেখা তৈরি করার সময় আমি পূর্ণ সচিব হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ঐ সময়টাতে তিনি নিজেও আর্মি-প্রহরায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নিকটজন হিসেবে মোশতাকের সরকার তাঁর বাড়িতে পাহারা বসিয়েছিল। একজন মেজর সর্বক্ষণ তাঁকে পাহারা দিত। তিনি ঐ মেজরকে সঙ্গে নিয়েই আমাকে সাহায্য করার জন্য রমনা থানায় গিয়েছিলেন। ঐ মেজর সঙ্গে থাকার কারণে রমনা থানার দারোগা সিরাজ ভাইকে খুবই সমীহ করতে বাধ্য হন। উদার মনের অধিকারী সিরাজ ভাই সেদিন আমাকে কিছু সিগারেটও দিয়ে এসেছিলেন, যা আমি হাজতের অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে ভাগ করে মহানন্দে পুড়িয়েছিলাম।
১৬ নভেম্বর দুপুরবেলা। হঠাৎ রমনা থানা প্রাঙ্গণ বুটের সঙ্গে চঞ্চল হয়ে ওঠে। স্যালুটের পর স্যালুট চলতে থাকে। এক সঙ্গে আসা বেশ কটি জিপের আওয়াজ পাওয়া যায়। বোঝা যায়, থানায় গুরুত্বপূর্ণ কেউ এসেছেন। আমি তো চুন খেয়ে মুখ-পোড়ানো মানুষ, বুটের শব্দ শুনলেই ভয় পাই। ভাবি, ঐ বুঝি এলো আমার যম। পুলিশদের দৌড়াদৌড়ি শুনে হাজতকক্ষের সকল হাজতি দ্রুত গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলো। যখন বুঝলাম বুটের শব্দ হাজতের দিকে আসছে, তখন আমার বুকের পালপিটিশন বেড়ে গেলো। সর্বনাশ। না জানি কে এলো আমার দ্বারে। পাছে চোখে পড়ে যাই, সেই ভয়ে আমি অন্য হাজতিদের পেছনে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করি। কিন্তু লাভ হয় না। পুলিশ হাজতের সামনে এসে সরাসরি আমার নাম ধরে ডাক দেয়। কোথায় কবি সাহেব? আমার জন্য নিশ্চয়ই একটা সুখবর আছে, এরকম মনে করে হাজতের ভিতরের বেশ ক’জন আমাকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। মনের ভিতরে প্রচণ্ড দুর্বিনীত ভাবের সৃষ্টি হলেও, আমি খুবই বিনীত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াই। ঐ পুলিশের পেছনেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন পুলিশের একজন বড়কর্তা। আমাকে বেরুতে দেখে তিনি আমার দিকে এগিয়ে আসেন। তিনি নিজেকে ডিআইজি বলে দাবি করেন। আমি তাঁকে আদাব দিই। বলি, এখন আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে এসেছেন বুঝি? তিনি মাথা নেড়ে বললেন, না ভাই, আপনাকে আমরা অনেক কষ্ট দিয়েছি। আর নয়। আমরা এবার আপনাকে মুক্তি দিতে এসেছি।
হাজতের লৌহদরোজাটি খোলা থাকার পরও আমি হাজত থেকে সম্পূর্ণ বেরুচ্ছিলাম না। ৩ নভেম্বরের জেল-হত্যার ঘটনার কথা মনে করে আমি একটু ভয় পাচ্ছিলাম বেরুতে। খাঁচায় বন্দি-পাখির মতোই দরোজা খোলা পেয়েও আমি খাঁচা ছাড়ছিলাম না। ঐ পুলিশ অফিসার আমার দ্বিধাগ্রস্ত ভাবটা ঠিকই বুঝতে পারলেন। তিনি তখন আমাকে নির্ভয় করার জন্য আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে তাঁর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভয় কিসের? হাজতের জন্য মায়া হচ্ছে? তাঁর স্পর্শের মধ্যে আমি অভয়বোধ খুঁজে পেলাম। আমি তাঁকে বিশ্বাস করলাম। বললাম, হ্যাঁ, যখন মুক্তির এতো কাছে চলে এসেছি, তখন সত্যি বলতে কি, এই হাজত ছেড়ে যেতে আমার সত্যিই মায়া লাগছে। একটা পিছুটান আমি সত্যিই অনুভব করছি। ভালোবাসার সুখের স্মৃতি যে মানুষকে পিছু টানে, তা নিজ-জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম; অপমান লাঞ্ছিত দুঃখের স্মৃতিও যে মানুষকে পিছু টানে, তা আজ আমার নতুন করে জানা হলো।
হাজতের অন্যসব বন্দি-আসামিরা আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, তারা সবাই এইরকমের একটি মুহূর্তেরই স্বপ্ন দেখছে। তাদের অনেকের স্বপ্নই হয়তো সফল হবে না। বন্দির কাছে মুক্তির চেয়ে বড় স্বপ্ন আর হয় না। চলে আসার সময় পেছনের দিকে তাকিয়ে যখন আমি ঐ হাজতের মধ্যে গুটিসুটি মেরে নিশ্চুপ বসে থাকা নিজেকে আজ দেখতে পেলাম না, তখন আমি খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। সবার উদ্দেশ্যে বললাম, যাই, আবার দেখা হবে। বললাম বটে, কিন্তু সেটা ছিল নিতান্তই কথার কথা। আমি ঠিকই জানতাম, ঐগুলো শুধুই কথার কথা। তবু বলতে হয়। বলাটাই ভালো। যারা বন্দি, তাদের ঐরকমের আশার কথা শুনতে ভালো লাগে। মিথ্যা হলেও।
হাজত থেকে বেরিয়ে আমি ওসি-র রুমে এসে বসি। আমাদের জন্য চা-বিস্কিট আসে। ডিআইজি সাহেবের সঙ্গে আমিও চা-বিস্কিট খাই। স্বাধীন মানুষ হিসেবে আমি আবার নিজেকে অনুভব করতে শুরু করি। ইতোমধ্যে আমাকে মুক্তি দেবার জন্য যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি করা হয়। যে কাগজটি কোর্টে হাকিমের কাছে জমা দেয়া হবে, সেই কাগজে ডিআইজি সাহেব লেখেন ‘Honourably released. ‘
এমন আকস্মিকভাবে আমাকে যে মুক্তি দেয়া হতে পারে, আমি বা মহাদেব আঁচও করতে পারিনি। ঐ দিন রোববার ছিল। আমি আরও একটি বিনিদ্র রজনী পাড়ি দেবার জন্যই মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলাম তখন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো দুপুর এলো আমার মুক্তির বার্তা নিয়ে। মুক্তির আনন্দে আমার মনটা নেচে উঠলো। আহ কী আনন্দ! দুঃখ যেমন আকস্মিকভাবে আসে, আনন্দও তেমনি। তখনও দুপুরের খাবার নিয়ে শৈবালেন্দু বা মোস্তফা মীর থানায় আসেনি। এলে ভালো হতো। একটু পরে থানায় এসে ওরা যখন আমাকে পাবে না, তখন?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন