জাদু আয়না ও সুন্দরী মেয়ে

দিব্যজ্যোতি মজুমদার

সবুজ ঘন বনভূমি আর গান-গাওয়া নদীর পাশে এক গ্রাম ছিল। সেই গ্রামের রাজার ছিল একটিমাত্র মেয়ে। সে ছিল খুব সুন্দরী। তার আলো-করা রূপে মানুষ পশুপাখি সবাই অবাক হয়ে যেত। এমন রূপ তারা আগে কোনদিন দেখেনি।

মেয়ে কিশোরী হল। একদিন তার বিয়ে হল। বিয়ে হল ভিন গাঁয়ে। তার ছিল একটা জাদু আয়না, এই আয়না কথা বলতে পারত। ঠিক মানুষের মতো। যখনই সে সাজগোজ করত, শধু এই আয়নাতেই মুখ দেখত। আর বাইরে বেড়াতে যাওয়ার সময় কিংবা নাচের আসরে যাওয়ার আগে এ আয়না না হলে তো তার সাজগোজই হত না। বড় প্রিয় আয়না।

একটা ঘরে সে এই আয়নাকে রেখে দিত। কাউকে ঢুকতে দিত না সেই ঘরে। এমন কি আপনজনদেরও না। সেই ঘরে একা একা সে আয়নাকে জিজ্ঞেস করত, ও আমার প্রাণের আয়না, ও আমার আদরের আয়না, বলতো, এই দুনিয়ায় আমার চেয়ে সুন্দরী আর কেউ আছে কিনা! আয়না সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিত, কেউ না কেউ না। কেউ নেই কেউ নেই।

যখনই সে সাজগোজ করত, তখন একই প্রশ্ন করত। একই উত্তর পেত। রোজ রোজ একই প্রশ্ন, একই উত্তর। শুনে শুনে তার বিশ্বাস হল,—তার মতো সুন্দরী দুনিয়ায় আর কেউ নেই। নিজের রূপের গর্বে সে হয়ে উঠল ভীষণ হিংসুটে। দেমাকে যেন মাটিতে তার পা পড়ে না। আর হবেই বা না কেন? আয়না যে সে কথাই বলে। আর এ আয়না যে জাদু আয়না।

দিন কাটে। অনেক দিন কেটে গেল। এমন সময় সেই সুন্দরী মেয়ে একদিন মা হল। তার একটা ফুটফুটে মেয়ে হল। কচি শিশুর রূপ দেখে মা চমকে উঠল। মেয়ের এ কি রূপ? এ যে তার থেকেও সুন্দরী! মায়ের মাথাটা কেমন টলমল করছে।

শিশু মেয়ে বড় হচ্ছে। পুকুরের ফুল যত ফোটে, দেখতে হয় তত সুন্দর! এ মেয়ে যত বড় হচ্ছে রূপও যেন ফেটে পড়ল। এ কি রূপের বাহার। মা বুঝল, রূপে এ মেয়ে তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। তার ওপরে মেয়ের মিষ্টি কথা। দুয়ে মিলে অপরূপ। কিন্তু মেয়ে তার রূপ জানে না, তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই, গর্বও নেই। তাকে তাই আরও মিষ্টি লাগে।

মেয়ের বয়স হল বারো বছর। মা ভয় পেয়ে যাচ্ছে, এই বুঝি তার মেয়ে জেনে ফেলে সে কত সুন্দরী! মেয়ে যদি জেনে ফেলে?

একদিন মেয়েকে ডেকে মা বলল, ওই ঘরে তুমি কখনও ঢুকবে না। কেউ ঢোকে না। তুমিও ঢুকবে না। মনে রাখবে আমার কথাটা মেয়ে মাথা নাড়ল।

এমনি করে আবার দিন বয়ে যায়। মা রোজ রোজ একই প্রশ্ন করে, জাদু আয়না একই উত্তর দেয়। উত্তর শুনে শান্তি পায় মা।

একদিন মেয়ের খুব কৌতুহল হল। তাকে সবাই ভালোবাসে, সে সব ঘরে যায়, ঘোরে। শুধু ওই ঘর বাদে। কেন? ও ঘরে কি আছে? সে গেলে কি হবে? সে কেন যেতে পারবে না? সে তো কোন খারাপ কাজ করে না কখনও। তবে? এ নিষেধ তার ভালো লাগে না। কৌতুহল বাড়ে।

মা গিয়েছে নাচের আসরে। বাড়িতে সে একা। সে চাবির গোছা নিয়ে সেই ঘরের কাছে গেল। খুলে ফেলল দরজা। ঘরে ঢুকেই তার খুব আনন্দ হল। কেন এতদিন বাধা দিয়েছে তাকে? কিন্তু ঘরে বিশেষ কিছুই দেখতে পেল না। এমন কিছু নেই যাতে নিষেধ মানতে হবে। সে চাবি দিয়ে দরজা বন্ধ করে ফিরে গেল।

পরের দিন। মা বেড়াতে গিয়েছে। মেয়ে মনে মনে ভাবল, আচ্ছা, ওই ঘরে যদি কিছু না-ই থাকবে তাহলে মা কেন নিষেধ করল? কেন আমায় ঘরে ঢুকতে বারণ করল? নিশ্চয়ই কিছু আছে। এই ভেবে সে আবার ঘরে ঢুকল। চারদিকে তাকাতে লাগল। হঠাৎ দেখতে পেল, একপাশে সুন্দর একটা কাঠের ঝুড়ি রয়েছে। ঝুড়িতে কি সুন্দর লতাপাতা নকশা করা। ঢাকনা খুলেই সে একটা আয়না দেখতে পেল। হাতে তুলে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করে সে আয়না দেখছে। হঠাৎ আয়না মানুষের মতো কথা বলে উঠল। বলল, ও মেয়ে! তোমার মতো সুন্দরী তো এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। মেয়ে তাড়াতাড়ি আয়নাকে ঝুড়ির মধ্যে রেখে দিল। দরজা ঠিকমতো বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে গেল।

পরের দিন মা আয়না হাতে সাজগোজ করতে বসেছে। অন্য দিনের মতো মা জিজ্ঞেস করল, ও আমার প্রাণের আয়না, ও আমার আদরের আয়না, বলতো, এই তোমার চেয়েও একজন সুন্দরী আছে কিনা।’

জাদু আয়না উত্তর দিল,‘হ্যা, তোমার চেয়েও একজন সুন্দরী আছে। সে অনেক বেশি রূপসী।’

ঝড়ের বেগে মা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। খুব ব্যথা মনে, মুখ শুকনো। সন্দেহ হল, এ ঠিক মেয়ের কাজ। ওই সুন্দরী নিশ্চয়ই তার মেয়ে। রাগে কপাল দপদপ করছে। মেয়ের কাছে গিয়েই ফেটে পড়ল মা, তুই ঘরে ঢুকেছিলি?

মেয়ের তো বুক কাঁপছে। বলল, কই না তো! আমি কখন ঢুকলাম?

মা বলল, মিথ্যে কথা। তুই ঢুকেছিলি। হাঁ তুই, জাদু আয়না নইলে বলল কি করে আমার চেয়েও সুন্দরী আর একজন আছে। আর তুই-ই শুধু আমার চেয়ে সুন্দরী। আর কেউ নেই। তুই ঢুকিসনি ঘরে?

মা শুধু যে মেয়েকে ওই ঘরেই ঢুকতে দেয়নি তা নয়, এত বয়স পর্যন্ত কোনদিন তাকে প্রাসাদের বাইরে যেতে দেয়নি। বাইরের কোন লোক মেয়েকে চেনে না, জানে না, দেখেওনি। কেউ যদি মেয়েকে দেখে বলে, মায়ের চেয়েও সুন্দরী! তাহলে! মা রাগে-দুঃখে দিশেহারা হয়ে গেল।

রাতে স্বামীর কয়েকজন বিশ্বাসী সৈন্যকে ডেকে পাঠল মা। তাদের কাছে মেয়ে দিয়ে মা বলল, এই হতভাগীকে গভীর জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবে। কেউ যেন না জানে৷

সৈন্যরা আর কি করবে। তারা মেয়েকে নিয়ে প্রাসাদের বাইরে এল। সঙ্গে দুটো কুকুর। অাঁধার রাতে কষ্টে তারা পথ চলতে লাগল। শেষকালে পৌঁছল গভীর জঙ্গলে।

মেয়ে একটি কথাও বলছে না। সৈন্যরা বলল, কেউ না জানলেও আমরা প্রাসাদ প্রহরীরা জানি তুমি কার মেয়ে। তোমার মা বড় নির্দয়, সে তোমাকে মেরে ফেলতে বলেছে। সে কাজ আমরা কেমন করে করি? তুমি এত ভালো মেয়ে, তুমি এত রূপসী, তেমার কথা এত সুন্দর। আমরা তোমাকে মারতে পারি না। তোমাকে ছেড়ে দিলাম। তুমি বনে বনে ঘুরে বেড়াও। বনের দেবতা তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি ভালো থেকো।

সৈন্যদের চোখের পাতা ভিজে এল। মেয়ে বনের পথে হাঁটতে লাগল। বন থেকে বেরুবার আগে সৈন্যরা সঙ্গের কুকুর দুটোকে মেরে ফেলল। তাদের তরবারিতে টাটকা রক্ত লেগে রইল। তারা ফিরে এল প্রাসাদে। মাকে বলল, আমরা হতভাগী মেয়েটাকে মেরে ফেলেছি। তার দেহের রক্ত লেগে রয়েছে আমাদের অস্ত্ৰে মা বেজায় খুশি। লাফিয়ে লাফিয়ে সে চলতে লাগল।

মেয়ে গভীর বনের কিছুই চেনে না। আপন মনে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। বড় একা লাগছে, ভয়ও করছে। গা ছমছম করছে। এমন সময় সে একটা সুন্দর ছোট বাড়ি দেখতে পেল। একটাই বাড়ি, আশেপাশে আর নেই। সে দরজার সামনে গেল, দরজায় তালা নেই, ভেজানো রয়েছে। সে ভেতরে ঢুকল, কাউকে দেখতে পেল না। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে ঘরটা বড় আগোছালো রয়েছে। কি আর করে। সে ঘর গোছাতে লাগল, সব জিনিস পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখল। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল। তার পরে একটা খাটের নীচে চুপটি করে লুকিয়ে থাকল। মেয়ে তো জানত না এই বাড়ি আসলে একদল ডাকাতের। ডাকাতেরা দিনের বেলায় নানা দূর দূর জায়গায় ডাকাতি করতে যেত, আর সন্ধেবেলা ফিরে আসত এই ডেরায়। সেদিনও লুটের মালপত্র নিয়ে ডাকাতরা ফিরে এল। ঘরে ঢুকেই সবাই অবাক হয়ে গেল। একি? সবকিছু এমন সাজানো-গোছানো কেমন করে হল? এরকম তো থাকে না? তারা অবাক হয়ে বলল, কে ঢুকেছিল আমাদের ঘরে? কে-ই বা এমন করে সব গুছিয়ে রাখল?

বড় ক্লান্ত তারা। রান্নবান্না করে খেয়ে-দেয়ে তারা শুতে গেল। আর ঘুমিয়ে পড়ল। যেখানে তারা খেয়েছিল সে জায়গা তেমনই রইল, পরিষ্কার করল না। সকাল হতেই তারা বেরিয়ে পড়ল ডাকাতি করতে। এইতো তাদের নিত্য দিনের কাজ।

ডাকাতের দল চলে যেতেই মেয়ে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এল। ভয়ে তার বুক দুরদুর করছে, খিদেতে মাথা ঘুরছে। নীচের ঘরে এসে সে রান্নবান্না করল আর মনের সুখে খাওয়া-দাওয়া করল। আগের দিনের মতোই ঘর গুছিয়ে রাখল। এটো বাসন-কোসন ধুয়ে রাখল, খাওয়ার জায়গা পরিষ্কার করল। এমনি করে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এল। সে রাতের জন্য অনেক কিছু রান্না করে সাজিয়ে রাখল। ডাকাতরা এসে খাবে। সব ঠিকঠাক আছে কিনা ভালোভাবে দেখে নিয়ে অাঁধার হতেই সে আবার লুকিয়ে পড়ল।

ডাকাতরা ফিরে এল। তাদের আজ খুব আনন্দ। অনেক জিনিস আজ তারা পেয়েছে। ঘরে ঢুকেই তারা অবাক হয়ে গেল। আগের দিনের মতোই সব গোছানো। শুধু কি তাই? তাদের জন্য রান্না-করা খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আর কি পরিপাটি করে। তারা বলল, কে এমন করে সবকিছু গুছিয়ে রাখছে?

বেশি কথা বলার সময় নেই। ক্লান্তি আর খিদে। তারা খেতে বসে গেল। এই ডেরায় আসার পরে কেউ কোনদিন তাদের জন্য এমন করে খাবার তৈরি করে রাখেনি। খাওয়া শেষ হলে তাঁরা খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে খুঁজল। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। নাঃ, কেউ কোথাও নেই।

পরের দিন সকালে ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ইচ্ছে করেই সবকিছু আরও বেশি করে অগোছালো করে রাখল। দেখাই যাক না কি হয়।

তারা চলে যেতেই মেয়ে আবার বেরিয়ে এল লুকোনো জায়গা থেকে। হায় কপাল। ডাকাতগুলো যে কি অগোছালো মানুষ। আহা! ওদের কেউ নেই যে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে। মেয়ে সব ঠিকঠাক করে রাখল। ভালো ভালো রান্না করল। নিজে খেল। ওদের জন্য গুছিয়ে রাখল। সকালবেলার সে ঘরবাড়ি এখন আর চেনাই যাচ্ছে না। ঘন উঁচু গাছের ওপারে সূর্য ডুবে যেতেই মেয়ে আবার লুকিয়ে পড়ল। বড় ভয় করে যে। আঁধার হতেই ফিরে এল ডাকাতরা। নাঃ, সেই একইরকম সাজানো-গোছানো, তাদের জন্য রান্না করা। অবাক কাণ্ড। তারা বলল, ‘রোজরোজ কে এমন করছে? এত গুছিয়ে রাখছে কে? যদি সে মেয়ে হয়, তাহলে সে হবে আমাদের বোনের মতো। বোন ভাইয়ের সবকিছু দেখাশোনা করবে, বাড়ি আগলাবে। আমরা প্রাণ দিয়ে তাকে ভালোবাসব। তার গায়ে আঁচড় পড়তে দেব না। আমাদের মধ্যে কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইবে না—সে যে আমাদের আদরের বোন। আর যদি সে ছেলে হয় তবে তাকেও আমাদের ডাকাতদলে ডুকে পড়তে হবে, ছাড়াছাড়ি নেই। সেও হবে ডাকাত। পরের দিন খুব ভোরবেলা ডাকাতরা বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু আজ তারা ভুল করল না। তাদের মধ্যে একজনকে রেখে গেল। সে বাড়ির পাশে এক ঝোপে লুকিয়ে রইল। আজ ধরতেই হবে, রোজ রোজ কে তাদের ঘরদের এমন গুছিয়ে রাখে। যে তাদের এমন উপকার করছে তাকে দেখা দরকার, তাকে জানা দরকার।

মেয়ে তো আর জানে না তাকে ধরবার জন্য কেউ লুকিয়ে রয়েছে। তাই সে লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে কাজকর্ম করতে শুরু করল। সবকিছু গুছিয়ে রেখে রান্না চাপিয়ে একটু বাইরে এসে দাঁড়াল। কেউ তো নেই। তাকে তো কেউ দেখছে না। বাড়ি তো ফাঁকা। মেয়েকে দেখতে পেয়েই ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল সেই লুকিয়ে থাকা ডাকাত। ডাকাতকে দেখতে পেয়েই ভয়ে দৌড় দিল সেই মেয়ে। তাকে ছুটতে দেখে ডাকাত চিৎকার করে বলল, ‘ভয় পাচ্ছ কেন? কোথায় যাচ্ছ তুমি? ভয় পাওয়ার কি আছে? তুমি তো কোন খারাপ কাজ করনি। বরং আমাদের কতই না উপকার করেছ। তুমি যে কি ভালো মেয়ে। পালিয়ে যেয়ো না, কাছে এসো।

দূরে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়ে বলল, ‘ভীষণ ভয় করছে। তোমরা কি আমাকে মেরে ফেলবে?

ডাকাত বলল, সে কি? ও কথা মুখেও এনো না। তুমি যে আমাদের বোন। কি সুন্দর তোমাকে দেখতে। তেমনি তুমি ভালো। কিন্তু, তুমি এই গভীর বনে এলে কেমন করে? তুমি কে? কাদের মেয়ে?

মেয়ে আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে ডাকাতের কাছে এল। বলল, ঘরের অনেক কাজ বাকি। তোমাদের জন্য রান্নাবান্নাও হয়নি। আগে সব শেষ করি, পরে সব বলব?

ডাকাত অবাক হল। এমন বোন হয়? তাদের ভাগ্য। মেয়ে সব কাজ শেষ করল।

রান্না করে দুজনে খেল। অন্যদের জন্য গুছিয়ে রাখল। তারপরে বসল গল্প করতে। সব কথা তাকে খুলে বলল। মায়ের কথা, সৈন্যদের কথা, লুকিয়ে থাকার কথা।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনও তেমন অন্ধকার হয়নি। বাইরের উঠোনে দুজন গল্প করছে। এমন সময় ডাকতরা ফিরে এল। আজ তারা বেশ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। বাড়িতে কি হল জানার জন্য সবাই ব্যস্ত। দেখে, দুজনে বসে আপনমনে গল্প করছে।

কাছে এসে তারা বলল, তাহলে খুঁজে পেয়েছ?

ডাকাতটি মাথা নেড়ে শুধু বলল, ‘হ্যাঁ।

ডাকাতরা বলল, ‘আঃ কি সুন্দর মেয়ে। আমাদের আদরের বোন। কোন ভয় নেই তোমার। আমরা প্রাণ দিয়ে তোমাকে আগলে রাখব। আজ থেকে তুমি আমাদের বোন হলে। আদরের বোন।

ঘরে এসে তারা বোনকে সবকিছু বুঝিয়ে দিল। সব জিনিসের ভার দিল তার ওপরে। সব কিছু সেই দেখাশোনা করবে। এমন বিশ্বাসী আর কে আছে? তাদের বোন যে এই মেয়ে। তারা ডাকাতি করে সব এনে দেয় বোনকে। বোন তাদের দেখাশোনা করে। এমনি করে সুখে দিন কেটে যেতে লাগল।

প্রাসাদে মা দিন কাটায়। বেশ আনন্দে-ফুর্তিতে। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার কেন যেন সন্দেহ হল, মনটা কেমন করে উঠল। যদি মেয়ে বেঁচে থাকে। সৈন্যরা কি সত্যিই তাকে মেরে ফেলেছে? যদি না মেরে থাকে? তবে? তার কথা হয়তো সৈন্যরা রাখেনি। তাহলে? মেয়ে তবে বেঁচে আছে? সন্দেহ হল কেন? মন এমন করছে কেন? তাহলে নিশ্চয়ই মেয়ে মরেনি, ঠিক বেঁচে আছে। কি করবে মা তা ভেবে নিল। মায়ের এক দাসী ছিল। সে খুব বিশ্বাসী। সেই ছেলেবেলা থেকে তার কাছে আছে। এখন সে বুড়ি। কিন্তু তাকে না হলে মায়ের চলে না। নিজের ঘরে ডেকে এনে মা সেদিন তাকে সব খুলে বলল। সন্দেহের কথা জানাল। এখন কি করতে হবে তাও মা বলে দিল।

মা চুপচুপ করে বলল, ‘বুড়িমা, তুমি এক কাজ করো। তুমিই পারবে। নানা গাঁয়ে তুমি খোজ করো। যেখানে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে তুমি দেখবে, বুঝবে সেই আমার মেয়ে। তারপরে যেমন করে হোক তাকে তুমি মেরে ফেলবে। আমার জন্য এ কাজ তোমাকে করতেই হবে।

বুড়ি বলল, ‘ওমা, তুমি বলছ আর এ কাজ আমি করব না? দেখনা আমি ফিরে এলাম বলে। এই কথা বলে বুড়ি রওনা দিল।

ঘুরতে ঘুরতে বুড়ি এল ডাকাতদের বাড়িতে। কাউকে সে দেখতে পেল না। ঘরে ঢুকল। ঢুকেই দেখে অপরূপ সুন্দরী মেয়ে ঘরের কাজ করছে। দেখেই বুঝতে পারল—এ মেয়ে কে! এই মেয়েকেই তো সে খুঁজছে। যাক, তাহলে সব কাজই ঠিকঠাক করা যাবে। বুড়িকে দেখেই মেয়ের খুব আনন্দ হল। তাকে আদর করে বসতে দিল। খেতে দিল। বুড়ি তখন বলল, ‘মেয়ে, কি সুন্দরী তুমি! এমন রূপ আগে দেখিনি। তা তুমি কে? তোমার বাড়ি কোথায়? তোমার মায়ের নাম কি? মেয়ে কিছুই সন্দেহ করল না। সব খুলে বলল। বুড়ি ঠোঁটের ফাঁকে হাসতে লাগল।

বুড়ি বলল, ‘আহা, তোমাকে দেখাশোনার কেউ নেই। এমন রূপ, অথচ চুলগুলো কি এলোমেলো। দাও, ভালোভাবে চুল বেঁধে দি। কাছে এসো। মেয়ে রাজি হল। কেউ তো কোনদিন এমন করে আদর করেনি। পেছন ফিরে সে বুড়ির সামনে বসে পড়ল। বুড়ি আদর করে তার চুল আঁচড়িয়ে বেঁধে দিতে লাগল। বুড়ি তার পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল একটা লম্বা ধারালো কাটা। চুল বাঁধা শেষ হয়ে এসেছে, বুড়ি হঠাৎ মেয়ের ঘন চুলের মধ্যে কাটা ঢুকিয়ে দিল। ধারালো কাটা মাথায় ঢুকে গেল। ঢলে পড়ল মেয়ে। নিথর হয়ে গেল তার দেহ। মনে হল সে সত্যি মরে গিয়েছে। নিস্তেজ দেহটার দিকে তাকিয়ে বুড়ি হাসতে হাসতে বলল, যাক। ঠিকঠাক কাজ হয়েছে, কথা রেখেছি। দেহ সেখানেই পড়ে রইল, বুড়ি রওনা দিল বাড়ির পথে। বুড়ির কাছে সব কথা শুনে মা নিশ্চিন্ত হল। বুড়িমা তো আর তাকে ঠকাবে না। যাক আপদ বিদায় হল।

ডাকতরা ফিরে এসে দেখে তাদের আদরের বোন কাটা গাছের মতো পড়ে রয়েছে। তাদের চোখ ছলছল করে উঠল। এ কি হল? কেন এমন হল? তারা খুব যত্নে দেহটি পরীক্ষা করল, কোন আঘাতের চিহ্নই দেখতে পেল না। বোন মরে গিয়েছে, কিন্তু দেহ তো এখনও শক্ত কাঠ হয়ে যায়নি। কেমন যেন নিস্তেজ ভাব। বোনের কপালে আর গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখটা ফুলের মতো তাজা আর সুন্দর। তারা বলল, আমরা এমন সুন্দর মুখের বোনকে মাটিতে পুততে পারব না। কিছুতেই না। তাই তারা সকলে মিলে একটা সুন্দর শবাধার তৈরি করল। শবাধারের ওপরে সোনা-হীরে-মুক্তো দিয়ে সাজাল আর তাদের যত সোনার গহনা ছিল সব পরিয়ে দিল আদরের বোনের দেহে। শবাধারের ঢাকনা কাঁটা দিয়ে আটকাল না, আলগোছে ঢাকনা বন্ধ করল। আর হাওয়া-বাতাস ঢোকবার জন্য কয়েকটা ফুটো রাখল। বোনের দেহ যাতে পচে না যায় তাই শবাধার বাইরে আলো হাওয়ায় রেখে দিল। বুনো জন্তুরা যাতে বোনকে স্পর্শ না করতে পারে তাই বুনো লতার সঙ্গে বেঁধে তাকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখল। লতাটা ঢিলে করলেই শবাধার নেমে আসবে। সব কাজ শেষ করে তারা চুপ করে গাছের নীচে বসে রইল। গাল-বুক ভিজে যাচ্ছে, আজ তাদের বোন আর বেঁচে নেই। দিন দশেক তারা বাড়িতেই রইল, কাজে গেল না।

তারপরে কাজে যেতে হল। প্রতিদিন যাওয়ার সময় ও বাড়ি ফিরবার পরে তারা শবাধারটাকে নামাত আর বোনকে দেখত। সদ্য-ফোটা ফুলের মতো সতেজ রয়েছে তাদের বোনের মুখ। জীবন্ত মুখ। ঘুমিয়ে রয়েছে আদরের বোন। এমনি করে দিন কাটে। এখন হয়েছে কি, একদিন ডাকাতরা সকালে কাজে বেরিয়ে গিয়েছে। এমন সময় সেখানে এল একজন লোক। সে গাঁয়ের কথক। নানা জায়গায় সে গল্প শুনিয়ে বেড়ায়। তার ঝুলিতে অনেক অনেক গল্প। তার নাম এসেরেনগিলা। আর তার মনিবের নাম ওগুলা। ডাকাতদের ডেরায় এসে কথক কাউকে দেখতে পেল না। এধার-ওধার তাকাতেই তার চোখে পড়ল সোনালি শবাধারটি। এমন সুন্দর আধার সে আগে দেখেনি। কত জায়গায় সে ঘুরে বেড়ায়। এসেরেনগিলা ছুটে গেল মনিবের কাছে। বলল, এক্ষুনি চলো আমার সঙ্গে। এমন জিনিস আগে দেখিনি। কেউ নেই সেখানে। ওটাকে নিয়ে আসতেই হবে। কথক উত্তেজনায় হাফাচ্ছে। ওগুলাও অবাক হল।

দুজনে সেখানে গেল। লতা ঢ়িল করে কথক শবাধারটি নামাল। কেউ নেই, তবু এসে পড়ে যদি। তাড়াতাড়ি করে দুজনে মাথায় তুলে শবাধার নিয়ে চলল। তারা জানেও না। ভেতরে কি রয়েছে। শেষকালে ওগুলার বাড়ি পৌঁছে গেল। একটা ছোট ঘরে শবাধারটিকে রেখে দিল।

কয়েকদিন কেটে গেল। একদিন ওগুলা ভাবল, আজ দেখব ওর মধ্যে কি আছে। ঢাকনা তো কাঁটা দিয়ে আটকানো ছিল না, আলগা করে বন্ধ ছিল। ঢাকনা খুলতেই ওগুলা অবাক হয়ে গেল। একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু মনে হচ্ছে সে বেঁচে নেই। কিন্তু মৃতদেহের গা থেকে যেরকম গন্ধ বের হয় তা তো হচ্ছে না? মানুষ মারা গেলে যেরকম দেখতে হয়, সেরকমও তো মনে হচ্ছে না। কোন রোগে মারা গিয়েছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। তবে? সে ভালোভাবে মেয়ের দেহ পরীক্ষা করতে লাগল। কিন্তু কিছুই পেল না। কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু আপনমনে বলল, এমন ফুটফুটে মেয়ে। কিসে তার মৃত্যু হল? আশ্চর্য।

ওগুলা ঢাকনা বন্ধ করল। ভালোভাবে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু থাকতে পারল না। আবার ঘরে ঢুকল। আবার ঢাকনা খুলে দেখল। মনে মনে বলল, বোধহয় এ মরেনি। আহা। যদি বেঁচে থাকে। আমার মেয়েরও তো এইরকমই বয়েস। আহা। বেঁচে থাকলে দুজনে কেমন ভাব হত, একসঙ্গে খেলত। দরজা বন্ধ করে আবার সে বাইরে এল। নিজের মেয়েকে বলল, ও ঘরে যেও না কিন্তু। কক্ষনো যেও না। মেয়ে বলল, আচ্ছা। প্রতিদিন বহুবার করে ওগুলা ঘরে যায় ঢাকনা খোলে, মৃত মেয়েকে দেখে।

অনেক দিন কেটে গেল। ওগুলার মেয়ের কেমন কৌতুহল হয়। তাকে ঢুকতে দেয় না, অথচ, বাবা বারবার ঢোকে। তারও ইচ্ছে হয়, দেখি না কি আছে ও ঘরে।

একদিন ওগুলা বাইরে গিয়েছে। মেয়ে বলল, খালি খালি বারণ করা। কেন ও ঘরে ঢুকব না? ঢুকলে কি হয়? আজ দেখব ও ঘরে কি আছে। ঘরে ঢুকেই ওগুলার মেয়ে অবাক হয়ে গেল, কি সুন্দর একটা কাঠের আধার। দেখি না ভেতরে কি আছে! কি হয় দেখলে?

ওগুলার মেয়ে আস্তে আস্তে ঢাকনা তুলে ধরল। একটি মেযের মাথা দেখা যাচ্ছে, মাথায় ভর্তি কালো চুল আর সোনার গয়না। পুরো ঢাকনাটি খুলে ফেলল। একটি সুন্দর মেয়ে শুয়ে রয়েছে। তারই বয়সি কি সুন্দর মেয়ে। এত গয়না গায়ে। কি সুন্দর মুখ আর মাথার চুল। সে বুঝতে পারল না, মেয়েটি কেন এর মধ্যে এভাবে ঘুমিয়ে আছে। আপনমনে বলল, আহা! ও যদি কথা বলত। কেমন বন্ধু হতাম আমরা। কত গল্প করতাম। ও যদি কথা বলত। মুখের কাছে মুখ এনে সে ডাকল, এমবোলো! এমবোলো! যেমন করে অপরিচিত কাউকে তারা ডাকে। কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আবার ডাকল। জলভরা চোখে বলল, ‘এমন করে ডাকছি, তুমি সাড়া দিচ্ছ না কেন? এমবোলো। এমবোলো। ঢাকনা বন্ধ করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

ওগুলা ফিরে এল। এমন করে দরজা বন্ধ কেন? মেয়েকে বলল, তুমি কি ওই ঘরে ঢুকেছিলে? মেয়ে বলল, না তো। তুমি তো আমায় ঢুকতে দাও না। আমি তো যাইনি।

পরের দিন ওগুলা কাজে বেরিয়ে গেল। মেয়েও ঢুকল ওই ঘরে। না ঢুকে থাকতে পারছে না। ঘরে ঢুকে ঢাকনা খুলে ফেলল। ডাকল, এমবোলো, এমবোলো! কোন সাড়া নেই। মেয়ে ঘুমিয়েই আছে। ‘আমি তোমাকে বার বার ডাকছি। তুমি কোন সাড়া দিচ্ছ না। তোমার সাথে খেলতে ইচ্ছে করছে। তোমার চুলগুলো ঠিক করে দেব? মাথায় আদর করব? তোমার চুলের উকুন বেছে দেব? তবু সাড়া নেই। ওগুলার মেয়ে ঘুমিয়ে-থাকা মেয়ের মাথায় হাত দিল। আঙুল ঢুকিয়ে দিল ঘন চুলের মধ্যে। কি যেন শক্ত মতো হাতে ঠেকল? কোন গয়না বুঝি? চুল ফাঁক করে মেয়ে দেখল একটা লম্বা ধারালো কাটা মাথায় ফোটানো রয়েছে।ইস ওর মাথায় কাটা বাঁধা? আমি ওটাকে তুলতে চেষ্টা করি। আহা! ওর যেন না লাগে। কাঁটাটা টেনে বের করতেই ঘুমন্ত মেয়ে বেঁচে উঠল একবার, চোখ খুলল, বড় বড় চোখে অবাক হয়ে চেয়ে রইল, চারিদিকে দেখল। আস্তে আস্তে আধারের মধ্যে উঠে বসল। মিষ্টি গলায় বলল, ‘ওঃ! কতদিন যে ঘুমিয়ে ছিলাম।

ওগুলার মেয়ের গলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চোখ ছলছল করছে। সে সামলে নিয়ে বলল, শুধুই ঘুমিয়েছিলে?

মেয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।

ওগুলার মেয়ে বলল, এমবোলো।

সুন্দরী মেয়ে বলল, আই এমবোলো।

এবার মেয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায়? এটা কোন জায়গা?

অন্য মেয়ে উত্তর দিল, ‘তুমি আমার বাবার বাড়িতে আছ। কেন? এটা তো আমার বাবার বাড়ি।

মেয়ে বলল, কিন্তু আমাকে এখানে কে আনল? কেমন করে শবাধার দেখতে পেল, কীভাবে ওগুলাকে খবর দিল, কীভাবে তারা সোনালি আধার নিয়ে এল। সব বলল তাকে। তক্ষুনি দুজন দুজনকে খুব ভালোবেসে ফেলল। যেন আপন দুই বোন। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল, আদর করল, খেলল, গল্পগুজব করল। অনেকক্ষণ কেটে গেল।

মেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বলল, বোন, তুমি আমার মাথায় আবার কাটাটা ঢুকিয়ে দাও, আমি একটু ঘুমিয়ে থাকি। ওগুলার মেয়ে তাই করল। মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঢাকনা বন্ধ করে মেয়ে ফিরে এল। ঘুমিয়ে-থাকা মেয়ে আবার মৃতের মতো নিস্তেজ হয়ে গেল। এখন তার মাথায় যে ধারালো কাটা বেঁধা রয়েছে!

ওগুলার মেয়ে এখন আর বাইরে অন্য সখীদের সঙ্গে খেলতে যায় না। বাড়ির বাইরে যেতে আর এতটুকু ভালো লাগে না। বন্ধুরা অভিযোগ করে, সে নানা অজুহাত দেখায়। কোনভাবেই তাকে আর তারা পায় না। কেমন করে পাবে? একটি ঘর আর একটি নতুন সাখী তাকে আটকে দিয়েছে। অন্য আর কিছুই তার ভালো লাগে না। যখনই তার বাবা বাইরে যায়, তক্ষুনি সে ঘরে ঢুকে আধারের ঢাকনা খোলে, ঘন চুলের মাঝ থেকে ধারালো কাটা টেনে বের করে। মেয়ে জেগে ওঠে, চোখ মেলে। তারা গল্প করে, খেলা করে, কতই আনন্দ। এমনি করে সুখে দিন কাটে। অনেক দিন একটানা ঘুমিয়ে মেয়ে কাহিল হয়ে গিয়েছিল, রোগ হয়ে গিয়েছিল। এখন বৰু প্রতিদিন খাবার আনে। মেয়ে আর রোগাটে রইল না। আরও সুন্দরী হয়ে উঠল।

এমনি করে অনেক দিন কেটে গেল। ওগুলা কিছুই জানতে পারল না। কিন্তু একদিন তারা ধরা পড়ে গেল। অনেকক্ষণ গল্প করছে, খেলায় মেতে রয়েছে। সময়ের খেয়াল নেই। বাবার আসার সময়ের কথা ভুলে গিয়েছে। খেলছে তো খেলছেই। গল্প করছে তো করছেই। হঠাৎ বাবা ফিরে এল। দরজা ভেজানো রয়েছে। হাত দিতেই খুলে গেল। ওগুলা অবাক হয়ে দেখল দুটি মেয়ে গল্প করছে, মাথা-হাত নেড়ে শুধুই বকবক করে চলেছে। ওগুলাকে দেখে তো মেয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। বাবা কিন্তু তাকে বকুনি দিল না। নরম গলায় বলল, ভয় পাওয়ার কি আছে? তা, তুমি কেমন করে এ মেয়ের জীবন ফিরিয়ে আনলে? এর ঘুম ভাঙালে কেমন করে? তুমি কি করলে বল তো?

মেয়ে বাবাকে সব খুলে বলল। লম্বা ধারালো কাঁটাটার কথা খুব ভালোভাবে বলল। ওগুলা তখন অপরূপ সুন্দরী মিষ্টি মেয়ের পাশে বসে পড়ল। তার সব কথা জানতে চাইল। মেয়েও মন খুলে সব কিছু বলল। তার জীবনের করুণ কাহিনি।

কিছুক্ষণ তিনজনেই চুপ করে রইল। তারপর ওগুলা বলল, আমি এক বিরাট এলাকার সর্দার, আমি গোষ্ঠীপতি। তোমার মা যেখানে থাকে সেটাও আমার এলাকা। মা হয়ে এমন কাজ? রূপের গর্ব এত? আমার এলাকাতে বাস করে মেয়েকে মেরে ফেলার চক্রান্ত? ঠিক আছে, কালকে এসব নিয়ে খোঁজখবর করব। কালকে হবে এলাকার ‘ওজাজা—সবাইকে ডেকে এনে এক সভা হবে। সবাইকে সেখানে থাকতে হবে। তুমিও থাকবে। কেননা, তুমি হবে আমার বউ। বড় আদরের বউ। একথা শুনে সুন্দরী মেয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে রইল।

সেদিনই চারিদিকে খবর চলে গেল। কাল সকালে হবে এলাকার ‘ওজাজা’। সেই বিরাট জমায়েতে সবাই এল। নিষ্ঠুর মা, সৈন্যরা, বুড়িমা সবাই এল। এল না শুধু সেই কয়জন ডাকাত। তারা এই সভার কোন খবর পায়নি। তারা যে গভীর বনে লুকিয়ে থাকে, তাদের বাড়ির খবর কেই বা রাখে? সবাই যার যার কথা বলল। এখানে তো মন খুলে কথা বলতেই আসা।

শেষকালে সভায় এল সেই সুন্দরী মিষ্টি মেয়ে। ওগুলার মেয়ের হাত ধরে আস্তে আস্তে সে সভার মাঝে এল। চারিদিক আলো করে।

যেই না মা সেই মেয়েকে দেখেছে, অমনি লাফিয়ে উঠল সে। রাগে তার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। পাশে-বসা বুড়িমার চুল ধরে টেনে জিজ্ঞেস করল, ওই তো আমার মেয়ে। ও-তো বেঁচে আছে। মরেনি। তুমি যে বললে তাকে মেরে ফেলেছ? বুড়িমা খুব অবাক হয়ে গিয়েছে। মরা মেয়ে বেঁচে ফিরল কি করে? সত্যি কি সেই মেয়ে? বলল, হাঁ, আমি তো তাকে মেরেই ফেলেছিলাম। কিন্তু…?

মেয়েটা একটা উঁচু পাথরে বসল। ওগুলা বলল, সবাই এখানে রয়েছে। তোমার জীবনের কথা তুমি বল।

মেয়ে আরম্ভ করল। তার ছেলেবেলা থেকে শুরু করল। নিঃসঙ্গ জীবনের কথা, মায়ের নিষেধ, তার কৌতুহল, জাদু আয়না, সৈন্যদের কথা, মরে যাওয়ার কথা, বেঁচে ওঠার কথা—আর শেষকালে ওগুলার বাড়ির কথা। সব বলল সে। মাঝে মাঝে সব ঝাপসা হয়ে উঠছে, চোখের জল বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে মেয়ে যখন ডাকাতদের কথা বলছে তখন তার কি কান্না। কোথায় হারিয়ে গেল তারা। আর কি কোনদিন দেখা হবে? মেয়ে থামল। মাথাটা নুয়ে রয়েছে।

সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। এমন নিষ্ঠুর মা। মেয়েকে মেরে ফেলতে চায়? আর এমন মিষ্টি মেয়েকে? শাস্তি চাই, শাস্তি চাই। প্রতিশোধ চাই। ডাইনি কোথাকার। ওকে পুড়িয়ে মারা উচিত। আর সেই বুড়িটাকেও।

এইরকম যখন চিৎকার হট্টগোল হচ্ছে তখন মা আর বুড়িমা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। মেয়ে যদি এক্ষুনি তাদের চিনিয়ে দেয়? তাহলে? ডাইনির শাস্তি? ভিড়ের মধ্যে তারা পেছন দিকে চলে গেল। সভা ছেড়ে পালাল। বনের পথ ধরল। আরও গভীর বন। তারপরে দূর এক দেশে চলে গেল। আর কখনও ফিরল না, কোথায় হারিয়ে গেল দুজনে।

সবার সামনে ওগুলার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হল। সবাই খুশি। গায়ের লোক, ওগুলা, মেয়ে— সবাই। সবার চেয়ে খুশি হল ওগুলার মেয়ে। এমন খেলার সাথী। এখন থেকে তারই কাছে থাকবে।

আর ডাকাতরা? তারা সেই গভীর বনে নির্জন বাড়িতে থাকে। তারা ‘ওজাজার কথা শোনেনি। সেখানে যায়ওনি। সবই তাদের রয়েছে, শুধু নেই আদরের বোন।

শবাধারে মেয়ে ছিল, হোক সে ঘুমন্ত, তবুতো বোনকে প্রতিদিন দেখতে পেত। তাও নেই। তারা ডাকাত। আরও কোন বড় ডাকাত তাদের বোনকে বোধহয় ডাকাতি করে নিয়ে গিয়েছে। তারা প্রতিদিন চোখের জল ফেলে। কাজ করে, সব করে তবু বোনকে ভুলতে পারে না। কি হল তাদের বোনের? কোথায় রয়েছে সে? কোন দূর দেশে কোথায় গেল তাদের আদরের বোন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন