দিব্যজ্যোতি মজুমদার
মিষ্টি জলের এক মস্ত বিলে থাকত এক কচ্ছপ আর তার বউ। তাদের এক বন্ধু ছিল। সে শকুন। সময় পেলেই শকুন সেই বিলের ধারে উড়ে আসত দূর পাহাড় থেকে। শুকনো চরায় তিন বন্ধু মিলেজুলে খোশমেজাজে গল্প গুজব করত। কচ্ছপের তো ডানা নেই, সে উড়তে পারে না। তার ভারি দুঃখ। সে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারে না। এই এক দুঃখে কচ্ছপ সবসময় মনমরা হয়ে থাকে।
একদিন মনে মনে কচ্ছপ এক ফন্দি আটল। বেশ খুশি খুশি মনে বউকে ডাকল।
বউ গলা বাড়িয়ে টুকটুক করে তার কাছে এল।
কচ্ছপ বলল, আচ্ছা বউ, শকুনের কাছে আমরা কেমন দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছি, এটা তুমি বুঝতে পারছ?
বউ গোলগোল চোখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন, ছোট হতে যাব কেন? শকুন তো আমাদের বন্ধু।
কচ্ছপ নরম গলায় উত্তর দিল, ছোট হওযার কারণ আছে। দেখ, বারবার শকুন আমাদের বাড়িতে আসে। আমি তো একবারও তার ওখানে যেতে পারিনি। সে আমার বন্ধু। তার বাড়িতে না গেলে কি সম্মান থাকে বল! সে-ই শুধু আসবে, আর আমি যেতে পারব না?
বউ আরও অবাক হল, সে আবার কি কথা। আমি তো মোটেই বুঝতে পারছি না এতে শকুনের কাছে আমরা ছোট হতে যাব কেন। আমাদের তো ডানা নেই, উড়তে পারি না। শকুন তাই ওসব ভাববে কেন। হ্যাঁ, আমাদের যদি ডানা থাকত আর তখন যদি আমরা বন্ধুর বাড়িতে না যেতাম, তাহলে কথা উঠতে পারে বটে। কিন্তু এখন তো সে কথা ওঠে না। কি যে সব মাথামুণ্ডু চিন্তা কর।
বউ, তুমি যা-ই বল না কেন, বড্ড ছোট হয়ে পড়ছি। একটু ভেবে দেখ।
এতই যদি ভাবনা হয় তাহলে দুটো ডানা গজিয়ে নাও। আর উড়ে উড়ে বন্ধুর বাড়ি চলে যাও!
বউ, তা কেমন করে হবে? আমি ডানা পাব কেমন করে? সে-ভাবে তো আমার জন্ম হয়নি।
বেশ, তাহলে কি করতে চাও?
কচ্ছপ মাথা দুলিয়ে বলল, একটা বুদ্ধি বের করেছি। অনেক ভেবে এক সুন্দর কায়দা মাথায় এসেছে।
বউ বলল, তাহলে বলেই ফেল। শুনি তোমার বুদ্ধিটা কি?
একটু ভেবে নিল কচ্ছপ। এধার ওধার চোখ ঘুরিয়ে সে বলল, বউ তুমি এক কাজ কর। প্রথমে তুমি আমাকে একটা ঝুড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দাও। তারপরে ঝুড়ির মুখ তামাক পাতা দিয়ে ভালো করে ঢেকে দাও। তারপরে সবটা ঘাসের দড়ি দিয়ে খুব ভালো করে বেঁধে দাও। সব ঠিকঠাক হয়ে গেল, কেমন?
বউ বলল, তারপর?
কচ্ছপ গলাটা আরও লম্বা করে বলল, শকুন তো বেড়াতে আসবেই। শকুন এলে বোঁচকাটা তাকে দেবে। বলবে, বন্ধু, এর মধ্যে অনেক তামাক পাতা আছে, এগুলো বিক্রি করে আমাদের জন্য কিছু শস্যের দানা আনতে হবে। ব্যাস, তাহলেই হবে।
বউ তখন পাশের বনে গেল। বেশ কিছু শুকনো তালপাতা কুড়িয়ে আনল। ধীরে ধীরে শক্ত মজবুত এক ঝুড়ি তৈরি করল। তার মধ্যে কচ্ছপকে ঢুকিয়ে, তামাক পাতায় চাপা দিয়ে ভালো করে বেঁধেছেদে এক পাশে সরিয়ে রাখল।
শকুন যেমন আসে তেমনি এল। বিরাট ডানা মেলে মাটিতে পা ফেলে এধার ওধার কাত হয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়াল শকুন। ঠোঁটে দু-একবার পালক পরিষ্কার করে হাসিমুখে বলল, কি ব্যাপার? বন্ধুকে দেখছি না যে, কোথায় গেল?
বউ বলল, আর বল কেন বন্ধু, তোমার বন্ধুর যে কি কাণ্ড! সেই-সকালে অনেক দূরে কোথায় চলে গিয়েছে। কয়েকজন লোকের সঙ্গে দেখা করা নাকি খুব জরুরি। আর এধারে দেখ, বাড়িতে একরতি দানা নেই। খিদেতে মরে গেলাম। তোমার বন্ধুর কথা আর বলে কাজ নেই।
শকুন বলল, হায় কপাল! খাবার কিছু নেই। ইস্! তুমি তো খিদেয় বড় কষ্ট পাচ্ছ!
বউ বলল, এমন বিপদে কেউ পড়ে না বন্ধু! কেউ ভাবতেই পারবে না, কি ভীষণ কষ্ট চলছে। আচ্ছা বন্ধু, তোমাদের এলাকায় কিছু শস্যদানা কিনতে পাওয়া যায় না?
কেন পাওয়া যাবে না! প্রচুর আছে। কিনতে চাইলেই কেনা যাবে। কেন বলত?
বউ বোঁচকাটা নিয়ে এল। উঃ, বড্ড ভারি। বলল, তোমার বন্ধু এই বোঁচকাটা রেখে গিয়েছে। এর মধ্যে অনেক তামাক পাতা আছে। বলে গিয়েছে, বন্ধু শকুন এলে এটা দিতে। সে এর বদলে খাবার-দাবার কিনে আনবে। দেখ, কি করতে পার। আর যে পারি না।
শকুন তো বড় দয়ালু। সে তক্ষুনি রাজি। সময় নষ্ট না করে, কথা না বাড়িয়ে সে শক্ত ঠোঁটের ফাঁকে বোঁচকা ঢুকিয়ে নিয়ে দুবার ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ে গেল। চলল তার বাড়ির পথে, পাহাড়ি এলাকার পথে।
শকুন উড়ছে, উড়ছে। বোঁচকাটা বড় ভারি, তার ডানা দুটাে কাঁপছে, ডানা ঝাপটাতে কষ্ট হচ্ছে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে, বুক ফুলে ফুলে উঠছে। তবু শকুনকে যে যেতেই হবে! এ যে বন্ধুর জন্য কষ্ট। এ-তো কষ্টই নয়। আহা, বন্ধুর বউ খিদের জ্বালায় কতই না কষ্ট পাচ্ছে! উড়ে চলেছে শকুন।
পাহাড় এসে পড়েছে। উঁচু পাহাড়ে শকুনের বাড়ি। সে আরও উপরে উঠেছে। এই তো এসে গেল তার বাড়ি।
ডানার কাজ শেষ হয়েছে। ডানা শান্ত করে নেমে চলেছে শকুন। হঠাৎ শকুন হাওয়ায় শুনতে পেল কে যেন বলছে, শকুন বন্ধু, আমি তোমার বন্ধু কচ্ছপ। শুনতে পাচ্ছে? আমার বাঁধন খুলে দাও। বলেছিলাম না, তোমার বাড়ি বেড়াতে আসব! কেমন!
হাওয়ায় শনশন শব্দের মধ্যে কথা শুনে শকুন কেমন যেন হয়ে গেল। তার দেহ যেন কেমন করে উঠল। ঠোঁট ফাঁক হতেই বোঁচকা আলগা হয়ে নীচে পড়তে লাগল।
শকুন নিচু হয়ে দেখতে লাগল, বোঁচকা গাছের ডালের মতো আছড়ে পড়ল পাহাড়ের শক্ত পাথুরে ঢালুতে। পিড়িড়ি-পিড়িড়ি। চৌচির হয়ে গেল কচ্ছপের শক্ত খোলা, টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল এধারে ওধারে। আর কচ্ছপ মারা গেল।
সেদিন থেকে কচ্ছপ আর শকুনের বন্ধুত্ব চিরকালের জন্য ছুটে গেল। সে বন্ধুত্বে আর জোড়া লাগেনি। শুধু কি তাই? সেদিন থেকে কচ্ছপের পিঠের খোলে অমন ফাটাফাটা দাগ হয়ে গেল। আজও সে দাগ মিলিয়ে যায় নি, তাকালেই দেখতে পাবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন