দিব্যজ্যোতি মজুমদার
অনেক পুরনো কালের কথা। সেই কালে এক গায়ে থাকত একজন লোক আর তার বউ। বহুদিন ধরে তারা সেই গায়ে ঘর-সংসার করছে। অনেক অনেক বয়সে তাদের একটা ছেলে হল। দুজনের মনেই খুব আনন্দ। সকাল বেলার রোদের মতো ঘর আলোতে ভরে গেল। সে যে কি আনন্দ তা তারা বোঝাবে কেমন করে?
তাদের অবস্থা মোটামুটি বেশ ভালোই ছিল। কেননা, তাদের ছিল একশো গোরু। যদিও গোরুগুলোর কোন বাছুর ছিল না তবু সুখে দিন কেটে যেত। তাদের জমিজিরেত ছিল না, কিন্তু একশোটা গোরু কম কিসে!
বাগানের গাছ যেমন দেখতে দেখতে বড় হয়, পুষ্ট হয়, ছেলেও তেমনি বেড়ে উঠল। ছেলের বয়স হল পনেরো। মাঠে-বনে গোরু চরিয়ে ছেলের স্বাস্থ্য হয়েছে সুন্দর, সবল। তাকে এখন জোয়ান মনে হয়।
কিন্তু হঠাৎ ছেলেটির বাবা মারা গেল। একটু মুষড়ে পড়ল সে। আবার কয়েকদিন পরে সব ঠিক হয়ে গেল। বছর তিনেক পরেই তার মা-ও মারা গেল। ছেলেটি খুব কাঁদল। বড় একা সে। বাবা-ও নেই, মা-ও নেই। শুধু বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া একশো গোরু সে পেল। আর তো কেউ নেই, তাই সে-ই হল এসবের উত্তরাধিকারী। কয়েকদিন সে বাড়িতেই রইল। মায়ের শ্রাদ্ধশ্রান্তি করল। যা যা ছেলেদের করতে হয়, সবই ভালোভাবে করল। বাবা-মা যে তার বড় আপনার জন ছিল।
এমনি করে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। যতক্ষণ বাইরে থাকে, বেশ থাকে। কিন্তু বাড়িতে এলেই বড় একা লাগে। কথা বলার কেউ নেই, সুখ-দুঃখের গল্প করার কেউ নেই। এমনি করে আর কতদিন চলবে? তাই ছেলেটি ঠিক করল,—সে বিয়ে করবে। একদিন এক পড়শিকে সে বলল, আমি বিয়ে করব। বাবা মা মারা গেল, আর তো আমার কেউ নেই। আমি বড় হয়েছি। একা একা ভালো লাগে না। তাই বিয়ে করতে চাই। তুমি কি বল?
পড়শি খুব খুশি হয়ে বলল, ঠিক কথা, বিয়ে তো করাই উচিত। বড় হয়েছ, তার ওপর বাবা মা নেই। একা একা তো লাগবেই! বিয়ে তো করতেই হবে।
ছেলেটিও পড়শির কথা শুনে খুব খুশি হল। লাজুক লাজুক মুখে বলল, তাহলে, তাহলে মেয়ে তো তোমাদেরই খুঁজেপেতে দিতে হবে। আমি তো কিছু জানি না।
পড়শি মাথা নেড়ে বলল, ‘আরে! সে তো আমাদেরই করতে হবে। এ তো আমাদের কর্তব্য। তোমার বাবা নেই, মা নেই, আমরাই তো এসব দেখব। তোমার জন্য একটা খুব সুন্দরী মেয়ে দেখব, সে তোমার খুব ভালো বউ হবে।
‘তাহলে, তাই দেখ।’ ছেলেটি বলল। একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘একজন যদি মেয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে তবে খুব ভালো হয়। তাড়াতাড়ি করাই ভালো।
পড়শি বলল, বনের দেবতা, থানের দেবতা ভালো করবেন। তার ইচ্ছেতেই সব হবে।
গাঁয়ের সবাই মিলে পরামর্শ করল। বউ হবে সুন্দরী আর খুব ভালো। পরের দিন সকালে একজন পড়শি বেরিয়ে পড়ল মেয়ের খোঁজে। অনেক অনেক দূর যেতে হতে পারে, তাই সঙ্গে নিল খাবার। যতক্ষণ আর যতদিন সে ময়ে খুঁজে না পাবে, ততদিন আর গাঁয়েই ফিরবে না। ঘুরতে ঘুরতে সে ভালো পাত্রী পেল। গায়ে ফিরে এল।
পড়শি ছেলেটিকে বলল, ‘হ্যাঁ, শেষকালে পাত্রী পেলাম। কিন্তু সে এ গায়ের মেয়ে নয়, পাশের গায়েরও নয়। সে থাকে এখান থেকে অনেক দূরে। তবে তুমি যেমনটি চাও ঠিক তেমনি।
ছেলেটি বলল, সে কার মেয়ে?
পড়শি খুব উৎসাহে বলতে লাগল, সে মেয়ে খুব বড়লোকের মেয়ে। তার ছয় হাজার গোরু-মোষ আছে। শুধু কি তাই? ওই মেয়েই তার একমাত্র সন্তান। একটাই মেয়ে, আর কোন ছেলেপুলে নেই। বুঝতেই পারছ, সব পাবে ওই মেয়েই।
একথা শুনেই ছেলেটি খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল। সে ভাবল, এমন মেয়েকেই বিয়ে করতে হয়। এ মেয়েকেই সে বিয়ে করবে। মুখে বলল, ‘ভাই, আমি রাজি। এই মেয়েকেই আমি বিয়ে করব। তুমি কালকেই মেয়ের বাবাকে মতটা জানিয়ে দিতে পারবে?
পড়শিও পাত্রী ঠিক করতে পেরে খুব খুশি। তার পছন্দ-করা মেয়েকে ছেলেটি বিয়ে করতে চেয়েছে, এটা কি কম কথা? তাই তাড়াতাড়ি বলল, ‘আরে, এ আর বেশি কথা কি? বনের দেবতা, থানের দেবতা ভালো করবেন, তার ইচ্ছেতেই সব হবে। কাল সকালেই আমি মেয়ের বাবার গায়ে রওনা হব। কোন কিছু ভেবো না তুমি?
সবে পুব দিকে সূর্য লাল হয়েছে। লাল ছটা আকাশে রক্ত ছড়াচ্ছে। পড়শি খাবার বেঁধে রওনা দিল দূর গায়ের পথে। সূর্য যখন আকাশে আগুন ছড়াচ্ছে, পথের মাটি যখন উনুনের ধারের মতো গরম হয়ে উঠেছে, তখন পড়শি পৌঁছল সেই গায়ে, মেয়ের বাবার বাড়িতে। ছেলেটির মনের কথা সব জানাল। ছেলেটির কথা সব খুলে বলল।
বাবা বলল, বেশ, শুনলাম তোমার কথা। শুনলাম ছেলেটির মনের কথা। কিন্তু বাপু, আমার মেয়ে কেমন তা-তো জানই। কন্যাপণ তো তেমন কম নিতে পারি না। তা যখন ছেলেটির মনে ধরেছে, তখন একশোটা গোরু দিলেই চলবে। ছেলে যদি রাজি থাকে, তবে আমি কথা দিচ্ছি মেয়েকে আমি তার হাতেই দেব। একশোটা গোরু। দেখ, সে রাজি কিনা?
সব হবে। আমি একথাই ছেলেটিকে জানাব। তাহলে চলি।
বাবা বলল, ‘হ্যা, ওই কথাই রইল।
ঘটক পড়শি মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে সেখান থেকে রওনা হল। গায়ে ফিরে এসে সে সব কথা ছেলেটিকে জানাল। মেয়ের বাবার সঙ্গে যা যা কথা হয়েছিল, সব খুলে বলল।
সব শুনে ছেলেটি বলল, ভাই, সব তো বুঝলাম। কিন্তু মেয়ের বাবা একশোটা গোরু চেয়েছে, আর আমার তো ওই একশোই সম্বল। জমি নেই, জিরেত নেই, অন্য কোন কিছুই নেই। মনে কর আমি তাকে সব দিয়ে দিলাম, তাহলে আমি আর বউ খাব কি? বঁচিব কেমন করে? আমার তো একশোটা গোরু ছাড়া আর কিছুই নেই। বাবা-মা আমার জন্য আর তো কিছু রেখে যায়নি। কি করি বলতো?
পড়শি বলল, সে তো ঠিক কথা। সব দিয়ে দিলে তোমরা দুজনে খাবে কি? তা এই যখন অবস্থা, তুমি কি আর সেই মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে? তুমি বলে দাও, ও মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না। বড় বেশি চাহিদা। আমি তাহলে মেয়ের বাবাকে সে কথাই জানিয়ে আসি। আর তোমার যদি বাপু মত থাকে, তাও বলো। সে খবরও পৌঁছে দিতে পারি।
চুপ করে রইল ছেলেটি, মাথাটি তার ঝুঁকে রয়েছে, হাতদুটো কোলের ওপরে। বেশ চিন্তিত। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল তারা। ছেলেটি কোন কথা বলছে না দেখে পড়শি উঠে পড়ল। হঠাৎ ছেলেটি বলল, নাঃ, যা হবার হবে, ওই মেয়েকেই আমি বিয়ে করব। বাবার শর্তে আমি রাজি। তুমি সেকথাই বল, একশো গোরু আমি দেব, অমন মেয়ের বদলে সবই আমি দেব। মেয়ের বাবাকে খবর দাও, আমি একশো গোরু দিয়ে তার মেয়েকে নিয়ে আসব।
পরের দিন ভোর হতেই পড়শি চলল দূর গায়ের পথে। আজ সে আরও তাড়াতাড়ি চলছে। অন্য দিনের চেয়ে সে আগেই পৌঁছে গেল। মেয়ের বাবার বাড়িতে পৌঁছেই খবর দিল, ‘হ্যাঁ, ছেলে রাজি হয়েছে। সে একশো গোরুই পণ দেবে। যদিও তার আর কিছুই নেই তবু সে সব দেবে। ছেলে মত দিয়েছে।
বাবা হাসিমুখে বলল, তাহলে আমিও রাজি। সে আমার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে পারে।
তারপরে পড়শি ও বাবা খাওয়া-দাওয়া সেরে খুঁটিনাটি সব আলোচনা করল। অনেক কথা হল। শেষকালে ঠিক হল, সেই গায়ের একজন মাতব্বর ছেলেকে আনতে যাবে। সব কথা পাকা করে নিজের গায়ে ফিরে এল পড়শি।
যে দিন ঠিক করা ছিল সে দিন মাতব্বর ছেলেটির বাড়ি এল। খুব যত্নআত্তি করে ছেলেটি তাকে সেবা করল। খুব খাওয়া-দাওয়া হল। তারপর বিয়ে নিয়ে নানান কথা হল।
মেয়েটির সঙ্গে ছেলেটির বিয়ে হয়ে গেল। কথামতো ছেলেটি মেয়ের বাবাকে তার সম্পদ একশোটা গোরু দিয়ে দিল। মেয়েকে বিয়ে করবার পণ হিসেবে। বিয়েতে খুব খাওয়া-দাওয়া হল। পাড়া-পড়শি সবাই প্রাণ খুলে আনন্দ করল। সবাই খুশি।
ছেলেটি বউকে নিয়ে নিজের গায়ে ফিরে এল। মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে অনেক কিছু খাবার-দাবার এল। সেগুলো মেয়ের বাবাই দিল। চোখের জল মুছে মেয়ে নতুন সংসার পাতল।
এমনি করে দশদিন কাটল। বাবার পাঠানো খাবার-দাবারে বেশ আনন্দেই দিন কাটল। দুজনেই খুব খুশি।
দশদিন পরে ছেলেটি চমকে উঠল। সব খাবার শেষ। অন্য কোন উপায় নেই। এখন সে-ই বা কি খাবে আর বউকেই বা কি খেতে দেবে? পেটে দেবার কিছুই যে অবশিষ্ট নেই। এ কি হল?
ছেলেটি শুকনো মুখে বলল, বউ, আমার তো আর কিছুই নেই। তুমি বাপের বাড়ি থেকে যা এনেছিলে সব ফুরিয়ে গেল। তোমার আমার পেট চলবে কেমন করে? সে একদিন ছিল যখন আমার বাড়িতে প্রচুর দুধ হত। অনেক গোরু। আমি দুধ দোহাতাম, অনেক দুধ। আর বিনিময়ে কত কিছুই পেতাম। কিন্তু সব গোরু তোমার বাবাকে দিতে হল। তোমাকে পাবার জন্য আমি সবই দিযে দিলাম। বউ এখন কি করি?
বউ কোন কথা বলল না। চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইল। স্বামীর মুখের দিকেও তাকাল না। ছেলেটি কেমন যেন ভেঙে পড়েছে।
কিছুক্ষণ পরে ছেলেটি আবার বলল, বউ, এক কাজ করি। তোমার হয়তো খারাপ লাগবে। কিন্তু উপায় কি বল? আমার গাযে অনেক পড়শির গোরু মোষ আছে। আমি তাদের দুধ দোহাবার কাজ নি। তাতে দিন-মজুরি পাব। তাতেই পেট চালাতে হবে। অন্য উপায় তো দেখি না বউ।
বউ আস্তে আস্তে বলল, আমি তোমার বউ, তুমি যা বলবে তাই হবে। তুমি তাই কর।
ছেলেটি তো এখন আর ছোট নেই। সে পুরো যুবক হয়ে উঠেছে। অনেক কিছু ভাবতে শিখেছে, অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। একদিন তার কত কি ছিল, আজ তার কিছু নেই। তার মনে খুব কষ্ট হল। বিয়ের পর দশদিন যেতে না যেতেই তাকে এমন অবস্থায় পড়তে হল। কিন্তু কি আর করে। পড়শিদের গোরু-মোষের দুধ দুইতে গেল। আর সেদিন থেকে এই গোরু দোহাবার দিন-মজুরিই হল তার পেশা। প্রতিদিন এই কাজে সে সক্কাল বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ত। ফিরত দুপুর বেলা, আকাশ যখন আগুন ছড়ায়।
এমনি করে কষ্টে দিন যায়। তারা দিন আনে দিন খায়। স্বামী যতক্ষণ না ফেরে বউয়ের তেমন কোন কাজ নেই। সে এলে তবেই রান্না শুরু হয়। খেতে খেতে প্রতিদিনই অনেক দেরি হয়ে যায়।
একদিন দুপুরবেলা। বউ দোরের সামনে চুপচাপ বসে রয়েছে। গালে হাত দিয়ে নানান কথা ভাবছে। ছেলেবেলার কথা, পুরনো দিনের কথা। এমন সময় সামনের পথ দিয়ে যাচ্ছিল এক যুবক। অপূর্ব সুন্দর দেখতে। যুবক তাকিয়ে দেখে একটি মেয়ে চুপ করে বসে রয়েছে। মেয়েটি খুব সুন্দরী। যুবকটি ভাবল, একে বিয়ে করতে পারলে খুব ভালো হয়। এমন সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু মেয়েটি তো অন্যের বউ, সে কি তাকে বিয়ে করবে? দেখাই যাক না।
সে একজন ঘটক ঠিক করল। মেয়েটিকে খুব সুখে রাখবে তাও জানাল। ঘটক একদিন এসে মেয়েটিকে যুবকটির মনের কথা জানাল।
বউ বলল, বনের দেবতা, থানের দেবতা শুনলেন তুমি কি প্রস্তাব দিলে। তুমি যা বললে তা দেবতাও শুনেছেন, আমিও শুনলাম। কিন্তু যে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তাকে যে কিছদিন অপেক্ষা করতে হবে। এখনও আমার মত নেই। আমার মত হলেই তোমাকে জানাব, তুমি যুবকটিকে তখন খবর দিও। আমি একটু চিন্তা করে নি। এক্ষুনি আমি কিছু বলতে পারব না।
ঘটক আশা নিয়ে ফিরে গেল। বউয়ের সব কথা যুবককে জানাল। আরও তিন মাস কেটে গেল। একইভাবে দিন কেটে যাচ্ছে। হঠাৎ তাদের বাড়িতে বউয়ের বাবা এল। অনেকদিন মেয়ের কোন খোঁজখবর পায় না। কেমন আছে মেয়ে জামাই? এইসব ভেবেই বাবা জামাই-এর গায়ে এল। গায়ে পৌঁছে পড়শিদের জিজ্ঞেস করে মেয়ের বাড়ি পৌছল। মেয়ে তখন ভেতরে শুয়ে রয়েছে। কাজ নেই, স্বামী বাইরে। সে আর কি করে? তাই শুয়ে ছিল। দরজায় শব্দ হতেই মেয়ে বলল, ‘কে’?
বাবা বলল, আরে খোল। আমি এসেছি, তোর বাবা। মেয়ের তো চোখে জল চলে এল। আনন্দে বুক কাঁপছে। তাড়াতাড়ি উঠেই সে দরজা খুলে দিল। বাবা মেয়েকে কাছে টেনে নিল। তারপরে ঘরে গিয়ে শুধু গল্প আর গল্প। বাবা বলল, তা কেমন আছিস বল।
মেয়ে বলল, বাবা খুব ভালো আছি। তোমার কিছু চিন্তা করতে হবে না। খুব ভালো আছি। তুমি বিশ্রাম কর, আমি আসছি।
মেয়ে অন্য ঘরে যেতে যেতে শুনতে পেল, বাবা বলছে, ‘আরে, আমার খাবার জন্য তোকে ব্যস্ত হতে হবে না।
অন্য ঘরে গিয়ে মেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। কান্না চাপতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে। এ কি হল? এতদিন পরে বাবা এসেছে মেয়েকে দেখতে, অথচ মেয়ের ঘরে একরত্তি খাবার নেই। সব শূন্য। বাবাকে সে কি খাওয়াবে? বাবার জন্য কি রাঁধবে। এখন কি করে সে মুখ দেখাবে? ভাবছে আর কাঁদছে। কাঁদছে আর ভাবছে।
ভাবতে ভাবতে সে পেছনের দরজায় এল। দরজা খুলে উদাস চোখে স্বামীর আসার পথে চেয়ে রইল। হঠাৎ সেই যুবকটিকে সে দেখতে পেল। বুকে বল পেল। বুদ্ধি এল মাথায়। সে যুবকটিকে ডাকল। যুবকটি কাছে এল।
বউ বলল, এখানে একা একা কি করছ?
যুবকটি বলল, বেশ কয়েক মাস আগে তোমার কাছে একজন ঘটক পাঠিয়েছিলাম। তোমায় আমি বিয়ে করতে চাই। তা তখন তুমি রাজি হও নি। এখনও কি তোমার মত পালটায় নি? আমি যে দিনেরাতে তোমাকেই স্বপ্ন দেখছি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে না? আমার বাড়ি যাবে না?
বউ বলল, তুমি যা বললে বনের দেবতা, থানের দেবতা তা শুনলেন। আমি যা শুনলাম দেবতারাও তা শুনলেন। আমি আর তোমাকে অপদস্থ করব না। তুমি যদি সত্যিই আমাকে চাও, আমি দেরি না করে এক্ষুনি তোমার সঙ্গে যাব। কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমার বাড়িতে একজন অতিথি এসেছে। তার জন্য কিছুটা মাংস চাই। তাকে রান্না করে খাওয়াতে হবে। রান্না-খাওয়া হলেই আমি তোমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ব, তোমার বাড়ি যাব। কথা বলে উত্তেজনায় বউ হাঁপাচ্ছিল।
‘অতিথিটি কে? কোথা থেকে এসেছে? যুবকটি জিজ্ঞেস করল।
বউ বলল, আমার বাবা। দূর গা থেকে আমার বাড়িতে এসেছে। সে-ই অতিথি।
যুবকটি বলল,‘কোন চিন্তা নেই তোমার। একটু দাঁড়াও, আমি এক্ষুণি মাংস নিয়ে আসছি।’
আনন্দে যুবক চলে গেল। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল বউ। আবার চোখ বেয়ে জল পড়ছে, বুক ফুলে উঠছে। এমন সময় যুবক ফিরে এল। তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ফেলল বউ। যুবক কাছে এল, তার হাতে পাতায় জড়ানো কিছুটা গোরুর মাংস। বউয়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
মাংস বউয়ের হাতে দিয়ে যুবক বলল, তুমি চেয়েছিলে, তাই এনে দিলাম। বেশিক্ষণ দেরি কর না। কতক্ষণ অপেক্ষা করব?
বউ বলল, বনের দেবতা থানের দেবতা তোমার কথা শুনলেন। আমিও শুনলাম। তোমায় আর বেশি দেরি করতে হবে না।
যুবকের হাত থেকে মাংস নিয়ে বউ উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। তাড়াতাড়ি উনুন ধরিয়ে মাংস রান্না করতে বসে গেল বউ।
যে তাকে মাংস দিয়েছিল সেই যুবক বউয়ের বাড়ি থেকে বেশি দূরে গেল না। আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। সেও উত্তেজনায় কোথাও স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না। গাছতলায় বসে আবার উঠে পড়ে, আবার অন্য গাছের নীচে বসে। মেয়েটি আসবে তো? না শুধুই মুখের কথা।
মাটির হাঁড়িতে মাংস ফুটছে। পাশে গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছে বউ। মনে নানা চিন্তা। এমন সময় দিন-মজুরির কাজ শেষ করে তার স্বামী ঘরে ফিরল। ঘরে ঢুকেই দেখে বউয়ের বাবা বসে রয়েছে। তাকে দেখেই সে অাঁৎকে উঠল, মুখে ছলাৎ করে রক্ত উঠে এল। এমন অবস্থা যে, কোন কথা তার মুখে এল না। তাকে দেখে বউয়ের বাবা খুব খুশি হল। হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে ডাকল। কেমন আছে, সংসার কেমন চলছে—অনেক কিছু জানতে চাইল। কোনরকমে মাথা নেড়ে উত্তর দিয়ে সে চলে এল বউয়ের কাছে। এসে দেখে বউ কি যেন রান্না করছে।
বউকে জিজ্ঞেস করল, বউ, কি রাঁধছ?
বউ বলল, ‘মাংস। অবাক হল স্বামী। সে জিজ্ঞেস করল, ‘মাংস? কোথায় পেলে বউ? একটু চুপ করে থেকে বউ বলল, ‘পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে এনেছি। পড়শির বউ দিয়েছে।
একথা শুনে তার স্বামী একেবারে চুপ করে গেল। কোন কথা বলল না। হয়। সে এত গরিব। আজ অন্যের কাছে ভিক্ষা করতে হচ্ছে। হায়! এমন অবস্থা তার।
তারপরে অস্তে আস্তে স্বামী বলল, বউ, আমরা এখন কি করব? আমাদের দুজনেরই খাবার জোটে না, তার ওপরে একজন অতিথি। কি হবে?
বউ ধরা গলায় বলল, আমি কি বলব বল? কেমন করে চলবে তাই-বা বলি কেমন করে? আমি জানি না।
স্বামী বলল, আমি যাদের যাদের বাড়ি কাজ করি মানে গোরু দোহাই, তারা তো বেশ ধনী। তাদের কাছে গিয়ে বলি,—আমার বাড়িতে অতিথি এসেছে। তার জন্য আমায় যা-হোক কিছু দাও, তাকে রান্না করে খাওয়াতে হবে তো! আমি বেশি খেটে সেগুলো শোধ দিয়ে দেব। নাহয় আরও বেশিক্ষণ খাটব। কি বল বউ?
বউ কোন কথা বলল না। স্বামী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার মালিকদের গিয়ে সব বলল। আসলে এই লোকটি খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করে। তাই মালিকরা সবাই তাকে ভালোবাসে। তার দুদিনে তারা তাকে কিছু কিছু জিনিস সাহায্য করল। তাকে তারা মাংস দিল, দুধ দিল, জোয়ার-বাজরা দিল, সে রওনা দিল বাড়ির পথে।
বউয়ের মাংস রান্না শেষ হয়েছে। এমন সময় স্বামী ফিরে এল। বউয়ের হাতে মাংস-দুধ জোয়ার-বাজরা দিল। বউ সেগুলো রান্নাঘরের একপাশে গুছিয়ে রাখল। স্বামী হাতমুখ ধুতে উঠোনে গেল। হাড়ি থেকে মাংস ঢেলে বউ সেটা বারকোশে রাখল। বাবাকে খেতে দেবে।
এদিকে যে মাংস দিয়েছিল সেই যুবক বাড়ির আশেপাশেই ঘুরছিল। অনেকক্ষণ হয়ে গেল, বউ তো এল না? সে ব্যস্ত হল। সাতপাঁচ ভেবে সে বাড়ির খুব কাছে এল। সামনের দিকের দরজা খোলা দেখে সে দাওয়ার নীচে দাঁড়িয়ে উকি মারল। হয়তো বউকে দেখা যাবে। দেখল, ভেতরে বসে একজন বুড়ো-মতন লোক ও বউয়ের স্বামী পাশাপাশি গল্প-গুজব করছে। চোখাচোখি হতেই যুবক মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাল, বউয়ের স্বামীও মাথা নোয়াল। স্বামী ছেলেটিকে চেনে না, কিন্তু অভিবাদন যখন করেছে, তখন ভেতরে ডাকাই উচিত। তার ওপরে ভর-দুপুরে একজনকে কি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা যায়? স্বামী তাকে হাত নেড়ে ডাকল। সঙ্গে সঙ্গে যুবকটি দাওয়া পেরিয়ে ভেতরে এসে ঢুকল আর স্বামীর পাশে বসল।
স্বামী তো আর অচেনা লোকটার মনের কথা কিছুই জানে না, তাই বন্ধুর মতো আলাপ করতে লাগল। সে তো জানে না, এই লোকটিই তার বউকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যেতে চায়। সব পাকা করে ফেলেছে। তারা তিনজন আলাপ-আলোচনা কথাবার্তা বলতে লাগল। বউয়ের বাবা, বউয়ের স্বামী আর অসাধু জানোয়ার—এই তিনজন। এই জানোয়ার তাদের ঘরের শান্তি নষ্ট করতে চায়। তারা গরিব তবু শান্তিতে রয়েছে। তারা গরিব তাই শান্তি নষ্ট করা সহজ। সেই সুযোগই নিচ্ছে জানোয়ারটা। পাশাপাশি বসে তারা গল্প-গুজব করছে। কতই না বন্ধুত্ব। হায়!
বউ বারকোশে মাংস নিয়ে ঘরে ঢুকল। তাকিয়ে দেখে তিনজন পাশাপাশি বসে গল্প-গুজব করছে। ছোট ছোট তিনটে বারকোশে মাংস ঢেলে সে এগিয়ে দিল তাদের দিকে। তিনজন যখন হাত বাড়িয়ে খাবার নিতে গেল, তখন বউ বলল, এখন তিন বোকা মিলে খাওয়া শুরু কর।
বাবা অবাক চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, আমি বোকা? বোকামির কি কাজ করলাম?
মেয়ের চোখ ছলছল করে উঠল। আস্তে আস্তে বলল, বাবা, আগে তোমরা খেয়ে নাও। পরে বলব তোমরা তিনজনেই কি বোকামি করেছ।
বাবা রেগে গেল। বলল, আমি কিছুতেই খাব না। এক টুকরোও মুখে দেব না।
আগে তোমায় বলতে হবে কেন তুমি আমায় বোকা বললে? তারপরে তোমার বাড়িতে আমি খাব। নইলে নয়।
মেয়ে আর কি করে! তাকে বলতে হল। সে বলল, বাবা, তুমি এক মহামূল্য জিনিস খুব সস্তায় বিক্রি করে দিয়েছ। মানে, অতি সামান্য জিনিসের বদলে খুব দামি জিনিস বিক্রি করেছ।
বাবা অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,‘আমি? দামি জিনিস সস্তায় বিক্রি করেছি? মনে পড়ছে না তো! কোন জিনিস?
মেয়ে মাথা নামিয়ে বলল, সে জিনিস আমি। তুমি আমাকে বড় সস্তায় বিক্রি করে দিয়েছ।
বাবা আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন করে?
মেয়ে এবার সোজা বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, বাবা আমি ছাড়া তোমার আর কোন মেয়ে নেই। এমন কি আমার আর কোন ভাইও নেই। আমি তোমার একমাত্র সন্তান। সেই তুমি একশোটা গোরুর বিনিময়ে আমাকে বিক্রি করে দিলে। অথচ তোমার নিজেরই ছয় হাজার গোরু-মোষ রয়েছে। একশোটা গোরু তোমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান হল,—আমার চেয়েও বেশি। তুমি বেশি দামি জিনিসের মূল্য বুঝলে না, তাকে এইভাবে বিকিয়ে দিলে। তাই তোমাকে বলেছি, তুমি মহামূল্য জিনিস খুব সস্তায় বিক্রি করে দিয়েছ। ঠিক না?
বাবা মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে রইল। অল্পক্ষণ পরে বলল, ঠিক কথা। আগে কোনদিন ভাবিনি। তুমি ঠিক ধরেছ। এ আমি কি করেছি? সত্যি আমি বোকা।
তারপর বউয়ের স্বামী ভয়ে ভয়ে বলল,‘আমি কেন বোকা? আমি কিরকম বোকামি করেছি।
বউ বলল, তুমি আরও বেশি বোকা। বাবার চেয়েও বেশি।
স্বামী বলল, কেমন করে?
বউ করুণভাবে হাসল। বলল, তোমার ছিল একশোটা গোরু। এগুলো তুমি তোমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারী হিসেবে পেয়েছিলে। তুমি জানতে, তোমার গোরুগুলোর কোন বাচা-কাচ্চা নেই, শুধুই একশো গোরু। আমাকে বিয়ে করার লোভে তুমি জ্ঞান হারালে। আমার বিনিময়ে সব গোরু কনেপণ হিসেবে দিয়ে দিলে। তোমার তো আর কিছুই নেই। তোমার গায়ে কত মেয়ে রয়েছে। তাদের কনেপণ ছিল দশটা কি বিশটা গোরু। তুমি তোমার অবস্থা বুঝলে না। তাদের বিয়ে করলে তোমার আরও অনেক গোরু থাকত। শুধু তুমি আমাকেই বিয়ে করতে গেলে। বিয়ের পর তুমি কি খাবে, বউকে কি খেতে দেবে—এসব মোটেই চিন্তা করলে না। বিয়ের দশদিন পরেই সব ফুরিয়ে গেল। আমাদের দুজনের খাওয়ার মতো কিছুই রইল না। তোমার অনেক ছিল, বুদ্ধির দোষে তুমি আজ দিনমজুর। অন্যের দয়ায়, অন্যের অপমান সহ্য করে তোমার দিন চালাতে হয়। অথচ তোমার তো এমন হবার কথা নয়। অন্যদের গোরুর দুধ দুইয়ে তোমার পেট চালাতে হয়। অথচ তোমার অনেক গোরু ছিল। তুমি যদি অর্ধেক গোরু কনেপণ দিয়েও তোমার গায়ের কোন মেয়েকে বিয়ে করতে, তবে আরও অর্ধেক গোরু তোমার থাকত। খাওয়ার চিত্তা করতে হত না। তাই মনে করে দেখ, তুমি আরও বেশি বোকা কিনা।
হতচ্ছাড়া জানোয়ার যুবকটি কর্কশভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘খুব তো বড় বড় কথা হচ্ছে। তা, আমি বোকা কিসে? আমি তো কোন বোকামি করি নি। এবার বল।
বউ বলল, বাবা আর স্বমীর চেয়ে তুমি আরও বেশি বোকা। তিনজনের মধ্যে তোমার বোকামি সবচেয়ে বেশি।
যুবকটি বলল, কেমন করে?
বউ ঠোঁটের ফাঁকে একটু হেসে উত্তর দিল, তুমি আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছিলে। তুমি আমাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলে। কিসের বিনিময়ে? কিছুটা গোরুর মাংসের বিনিময়ে। হায় কপাল! তুমি আমাকে কিছুটা মাংসের বিনিময়ে কিনতে চেয়েছিলে। সেই আমি যাকে একশোটা গোরুর বিনিময়ে কিনতে হয়েছে। তাই মনে করে দেখ, তুমি কি এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোকা নাও?
অসাধু জানোয়ার বসার চৌকি থেকে এক লাফে নেমেই দৌড় দিল। একবারও পেছনে তাকাল না, বনের পথে সে মিলিয়ে গেল।
বাবা মেয়ে-জামাই-এর সঙ্গে আরও দুদিন থাকল। তৃতীয় দিনে যাওয়ার জন্য তৈরি হল। মেয়ে জলভরা চোখে বাবাকে বিদায় দিল। বাবার চলে যাওয়ার পথের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়ে। বাবাকে আর দেখা যাচ্ছেনা। পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল।
বাবা গাঁয়ে ফিরে এসে জামাইয়ের একশোটা গোরুকে এক জায়গায় আনল। নিজের গোরু-মোষ থেকে আরও দুশোটা গোরু-মোষ তার সঙ্গে রাখল। একজন কিষানকে সঙ্গে দিল। কিষান তিনশো গোরু-মোষ নিয়ে মেয়ে-জামাইয়ের গায়ের দিকে রওনা দিল।
মেয়ে-জামাইয়ের আর কোন অভাব রইল না। তারা সুখে শাস্তিতে নিজেদের গাঁয়ে বাস করতে লাগল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন